চাহিত পথিক বধূ শূন্য পথপানে।
মল্লার গাহিত কারা।
ঝরিত ঝরণাধারা
নিতান্ত বান্দিত গিয়া কাতর পরানে।

কথাটা এমন নয় যে, পূর্বরাগের অন্তর্গত ভাবের বিষয়টা আগে কেউ জানত না। অনাদি-অনন্ত সংসার-চক্রে আবর্তিত পুরুষ-রমণীর মন ব্যাপারটা একটা শাশ্বতিক সত্য বলে এমন ভাবা মোটেই সমীচীন নয় যে, বৈষ্ণব রসশাস্ত্রকারেরাই প্রথম পূর্বরাগ কথাটা আবিষ্কার করলেন। অথচ শব্দান্বেষী রসিক মানুষজন এটাই জানেন পূর্বরাগ কথাটা যে বৈষ্ণব রসশাস্ত্রকারদেরই সৃষ্টি। আর সত্যি কথা, বার বার এটা দেখাও গেছে যে, রাধা কৃষ্ণের প্রেম-পর্যায়ের প্রসঙ্গ এলেই পূর্বরাগ শব্দটা প্রথমেই চলে আসে। অথবা পূর্বরাগ কথাটার উচ্চারণ মাত্রেই শুধু রাধা-কৃষ্ণের পদ-পদাবলীর উল্লেখ শুরু হয়ে যাবে। তবু কখনো একবার, একবারের তরেও কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না যে,

তবু দেখ সেই কটাক্ষ
আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য
যেমনটি ঠিক দেখা যেত
কালিদাসের কালে।

না দেখি তাহারে / হৃদয় বিদরে / রহিতে না পারি ঘরে।

মনে আছে, সেদিন অভিজ্ঞান-শকুন্তল-এর ক্লাস চলছিল। সেই যে মহারাজ দুষ্যন্ত দূর থেকে আশ্রমবাসিনী শকুন্তলাকে দেখামাত্রই বলতে আরম্ভ করলেন—এই অসামান্য শরীর-সৌন্দর্য এই রমণীর, অথচ তাকে দিয়ে কণ্ব-মুনি কিনা গাছে জল দেবার খাটনি খাটাচ্ছেন; মানুষটা কী বোঝেন না যে তিনি পদ্মফুলের পাতা দিয়ে গাছ কাটার চেষ্টা করছেন। রাজা তখনও শকুন্তলার সামনে আসেননি তখনও, কোনো কথাও হয়নি পরস্পরে, তাতেই এই। তারপরেই মন্তব্য—এমন সুন্দর এই যার চেহারা তার বোধ হয় আর দামী বেশবাস-ভূষণালংকার লাগে না, শ্যাওলার মধ্যে পদ্মফুল যেমন, চাঁদের মধ্যে কলঙ্করেখা যেমন, বাকল-পরা এই মেয়ে যেন আরও বেশী সুন্দর—ইয়মধিকমনোজ্ঞা বল্কলেনাপি তন্বী।

অনেকক্ষণ এটা-ওটা, ইতি-উতি কথা চলল রাজার মনে। প্রথম খোয় মনোহরণ ঘটে গেলেও পরিশীলিত ভদ্রজন রমণীর শরীর নিয়ে কথা বলে উপমার অঙ্গলীসংকেতে, তারপর দুষ্যন্তের মতো নাগরক পুরুষও শকুন্তলার প্রত্যঙ্গ-শংসায় মত্ত হয়ে হয়ে ওঠেন। প্রথম দেখায় প্রথম আকর্ষম ব্যক্ত করে ফেলেন এমন শরীরী ভাষায় যে রবীন্দ্রনাথের মতো মহাভাবের কবি পর্যন্ত তার অনুবাদ করতে বাধ্য হন—

অধর কিশলয়-রাক্তিমা আঁকা,
যুগল বাহু যেন কোমল শাখা,
হৃদয়-লোভনীয় কুসুম-হেন
তনুতে যৌবন ফুটেছে যেন।

শকুন্তলাকে দেখে দুষ্মন্তের মনের ভিতরে যে আলোড়ন তৈরি হল, তেমনই এক আপ্লুতি তৈরি হল শকুন্তলার মনে। তিনিও অনুভব করেছিলেন যে, এই মানুষটিকে দেখে তাঁরও মনের মধ্যে তপবনের সত্ত্বভাবের বিরোধী বিকারগুলি জেগে উঠছে। বস্তুত নির্বিকার চিত্তের মধ্যে প্রথম এই ভাববিক্রিয়াটাই পূর্বরাগ।

কি খেনে দেখিলু তারে না জানি কি হৈল মোরে
আটপ্রহর প্রান ঝুরে।


আমাদের প্রাচীন রসশাস্ত্রকারেরা প্রথম খোর এই প্রতিক্রিয়াটা বুঝতে পেরেছিলেন ‘পূর্বরাগ’ শব্দটা সৃষ্টি করার অনেক আগে। অর্থাৎ যখন কিনা এক রমণী-পুরুষের মধ্যে প্রেমের আরম্ভ থেকে মিলন শেষ হওয়া পর্যন্ত ঘটনাগুলি ঘটতে থাকে, সেগুলিকে কতগুলি পর্যায়ে ভাগ করে রসশাস্ত্রকারেরা তার নাম দিয়েছেন—দশা এবং তার সংখ্যা হল দশ—দশ দশা।

সাহিত্যর্পণের লেখক বিশ্বনাথই হচ্ছেন প্রথম সেই মানুষ, যিনি পূর্বরাগের একটা সার্থক সংজ্ঞা দিয়েছেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টি প্রয়োগ করে তিনি দেখিয়েছেন যে, পূর্বরাগ অন্তত দশ দশটি হৃদয়ভাবের সমাহার এবং সেগুলিই পূর্বরাগের এক একটি প্রকার। বিশ্বনাথ পূর্বরাগ ব্যাপারটাকে বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার—অর্থাৎ কিনা যেখানে পুরুষ-রমণীর পরস্পর বিরহদশা চলে, তার মধ্যে পূর্বরাগের প্রকার নির্দেশ করে একটা আশ্চর্য তৈরী করেছেন। সাধারণ্যে এটাই ধারণা হবে যে, পূর্বরাগ তো সম্ভোগ শৃঙ্গারেরই অঙ্গ কেননা, এখান থেকেই মিলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমরা পরে ভেবে দেখেছি যে, তত্ত্বগতভাবে দেখলে পূর্বরাগের মধ্যেও প্রকট বিরহের আর্তি আছে। দেখা কিংবা শোনার পর ভাল লাগার একটা বিস্তার তৈরী হয় সুরের বিস্তারের মতো। অথচ সেই সময় হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে প্রেমের সম্ভাবনামূলক কথাবার্তাই হয়নি, হয়তো এখনও মেলেইনি কোনো নিশ্চয়তার সংকেত। কিন্তু একজন আর একজনকে দেখার পর, কিম্বা একের রূপগুণের কথা শোনার পর ভাল লাগার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায় এবং অনেক সময় সেটা অপর জনের অজান্তেই। ফলত এক পক্ষের ভাল লাগাটা আরম্ভ এবং বিস্তার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা না পাওয়ার দুঃখ চলতে থাকে এবং আমরা বিরহ কিংবা বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার ছাড়া অন্য কিছু বললে বিপ্রলম্ভ বা বিরহের সংজ্ঞার মধ্যে একটা অব্যাপ্তি দোষ ঘটে যাবে।

কাজেই ঠিকই বলেছেন বিশ্বনাথ। কেননা, পূর্বরাগ সত্যিই এক অর্থে মিলনপূর্ব বিরহ অথবা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তার আভাসে সেটা সুখের মতো এক ব্যথা। বিশ্বনাথ তাই পূর্বরাগের একটা ফুতসই সংজ্ঞা তৈরী করে বললেন—পরস্পরের কথা শোনা অথবা পরস্পরের দেখা হওয়ার পর থেকে পুরুষ-রমণী ‘দুই জনা’-র মধ্যেই যখন অনুরাগের আবেশ ঘটে অথচ যেখানে পরস্পরের কারও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ঘটেনি, তখন সেই বিরহমলিন দশাটাকেই পূর্বরাগ বলতে হবে –

শ্রবণাদ্‌ দর্শনাদ্‌বাপি মিথঃ সংরূঢ়রাগয়োঃ ।
দশাবিশেষ্যে যো’ প্রাপ্তৌ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে।।

বিশ্বনাথ কবিরাজ ১৩৭৮ থেকে ১৪৩৪ সালের অর্ন্তবর্তী সময়ের দুই গঙ্গাবংশীয় কলিঙ্গ-রাজা চতুর্থ নরসিংহদের এবং চতুর্থ নিশাঙ্কদেবের সভাতে সান্ধিবিগ্রহিক অর্থ ‘ফরেইন মিনিষ্টার’ ছিলেন। বংশগতভাবে কবি এবং পণ্ডিত বলেই তিনি প্রথম প্রয়োজনবোধ করেছিলেন—হৃদয়ান্বেষী পুরুষি-রমণীর মনে হঠাৎই সমারূঢ় প্রেমের অনিশ্চয়তাকে সংজ্ঞিত করার। পূর্বরাগ নামে এই শব্দটাকে জন-বিদিত করার মূলেও তিনিই। বিশেষত ‘রাগ’ মানে যেহেতু রঞ্জন, রাঙিয়ে দেওয়া, তাই পরুষ-রমণীর মিলন-পূর্বকালে তাঁদের হৃদয় রাঙিয়ে দেওয়ার ভাবটাকে পূর্বরাগ বলে অভিহিত করার মধ্যেও একটা কবিন্দনোচিত বেদনাবোধ আছে।

সেই বিশ্বনাথ পূর্বরাগের একটা সযৌক্তিক সংজ্ঞা সৃষ্টি করার পরেই বললেন যে, অনেকভাবেই সেই আকুল হৃদয় রাঙা হয়ে উঠতে পারে। প্রথমত নাম-গুণের কথা শুনে-হয়তো বা সেটা তীর্থে-তীর্থে ঘুরে বেড়ানো ব্রাহ্মণের মুখে, কিম্বা সেটা ভাট-চারণ-বন্দীজনের মুখে শুনে তৃতীয়ত সখী-মুখে। ব্রাহ্মণের কথায় পরে আসছি। বিশ্বনাথ দূতের কথায় শ্রীহর্ষের লেখা নৈষধচরিতে নল-দময়ন্তীর উদাহরণ দিয়েছেন। নিষধ-দেশের রাজা নৈষধ নল বিদর্ভ-দেশ থেকে ফিরে আসা দূতের মুখে রাজপুত্রী বৈদর্ভী দময়ন্তীর রূপগুণের কথা শোনার পরেই দময়ন্তীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ তৈরী হল। তাতে নল আবার এক অলৌকিক রাজহংসের কাছে দময়ন্তীর প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা জানিয়ে সেই রাজহংসকে পাঠালেন ময়ন্তীর কাছে। নলের কীর্তি খ্যাতি আর গরিমার কথা শুনে দময়ন্তীরও আকর্ষণ জন্মাল নলের ওপর। এই পারস্পরিক পূর্বরাগ বিশ্বনাথের দূতমুখের উদাহরণ।

এই যে দূতেরা এসে নলকে দময়ন্তীর রূপগুণের কথা বলেছিল, তারা কিন্তু বন্দী-চারণ বা ভাট জাতীয় মানুষ। তারা পৃষ্ঠপোষক রাজা-রাজড়াদের কীর্তি খ্যাতির বন্দনা-গান করে বেড়ায়। পরবর্তীকালে এদেরই নাম ‘ভাট’। প্রাচীন এই ভাটদের মুখে কথা-প্রচারের ঘটনা উদ্ববদাসের পদে ধরা পড়েছে রাধারাণীর কানে। উদ্ধব দাস পূর্বরাগের প্রসঙ্গে কৃষ্ণের বাঁশী থেকে আরম্ভ করে ভাট এবং সখীর মুখ এই তিন উপকরণ-মাধ্যম একসঙ্গে করে লিখেছেন —

পহিলে শুনিলুঁ অপরূপ ধ্বনি
কদম্বকানন হৈতে।
তার পর দিনে ভাটের বর্ণনে
শুনি চমকিত চিতে।।
আর এক দিনে মোর প্রাণ সখি
কহিল যাহার নাম।
শুনিগণ-গানে শুনিলুঁ শ্রবণে
তাহার এ গুণগ্রাম।।
সহজে অবলা তাহে কুলবালা
গুরুজনজ্বালা ঘরে।
সে হেন নাগরে আরতি বাঢ়য়ে
কেমনে পরাণ ধরে।।

শুক বলে –আমার কৃষ্ণ মদন-মোহন।
শারী বলে—আমার রাধা বামে যতক্ষণ।। (নইলে শুধুই মদন।)

বিশ্বনাথ কবিরাজের কথার ওপর ভরসা করে এক টীকাকার লিখেছিলেন—বন্দী-চারণ-ভাটের প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ, মুনি-ঋষিদের কথাও আসে যাঁরা দূতের কাজটি করে দেন। পুরাণগুলিতে এমন উদাহরণ আছে যেখানে নায়ক কিংবা নায়িকার কাছে একতেমের রূপ-গুণের খবর আসছে ঋষি-মুনির মুখে। কিন্তু এমনও তো পারে যে, সেই পুরুষ অথবা সেই রমণীর রূপ-গুণ এতটাই যে, তার কথা শোনামাত্রেই অনুরাগ জন্মাতে পারে। তার বিশ্বনাথ আবার এমন কথাও বলেছেন যে, কাব্যে কিংবা নাট্যে এই পূর্বরাগের প্রকাশ দেখাতে হল, নায়িকা-রমণীর অনুরাগের কথাটা আগে বলা ভাল—তারপর যদি সেই রমণীর ইতিবাচক ইঙ্গিতে বুঝে তবেই পুরুষের আকর্ষণের কথা বর্ণনা করবেন কবিরা – আদৌ বাচ্যঃ স্ত্রিয়া রাগঃ পুংসঃ পশ্চাত্তদিঙ্গিতৈঃ

বিশ্বনাথের মতো এমন একজন বোদ্ধা আলংকারিকের মুখে এই কথা শুনে বেশ ক্ষুদ্ধ আমরা। এমন মন্তব্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা পুরুষতান্ত্রিকতা কাজ করে। প্রথমত মনে হয় – মানুষের স্বভাব তো বোঝা উচিত ছিল শাস্ত্রকার পণ্ডিতের। কেননা পুরুষের স্বভাবেই মধ্যেই কামনার এত আধিক্য থাকে যে, যৌবনা রমণীর ব্যাপারে তার কৌতূহল স্বভাবতই বেশী হয়, আকর্ষণের প্রকটতাও তাই তার দিক থেকেই বেশী হওয়া উচিত, এবং তদুচিত পূর্বরাগেরও প্রসঙ্গ সেখানে প্রথম অবতারনার বিষয় হয়ে ওঠে।
কাব্য-নাট্যে রমণীর পূর্বরাগ আগে দেখানোর অন্য একটা উদ্দেশ্যও আছে। তাতে পুরুষের কাছে অতিকাম্য, অথচ যেটা প্রায়শই হয় না, সেই রমণীর দিক থেকে একটি পুরুষের প্রতি পূর্বরাগ তৈরী করাটা কবির কাছেও বেশ বর্ণনাযোগ্য বিষয় হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত রমণীকুলের স্বভাবলজ্জা এবং পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বচন—হাজার হাজার বছর ধরে মেয়েদের cultural processing of sex যেভাবে ঘটেছে, তাতে রমণীর পূর্বরাগের ঘটনাটা আগে বর্ণনীয় হলে পুরুষ মানুষেরই অভিলাষ তৃপ্ত হয়, কিন্তু সেটা বাস্তব নয়।

তবু সেটা শাস্ত্রে-কাব্যে ঘটেছে এবং ঘটেছে যখন, তখন সেটা চরম সুন্দর এবং মধুরও বটে। কতটা সেটা মধুর এবং সুন্দর, সেই পুরুষেপ্সিত ঘটনাটা বর্ণনা করেছে আমাদের মহাভারত এবং পুরাণগুলি। অর্থাৎ এটাই আমরা বলতে চাই যে, কাব্য-নাট্যে কবি-নাট্যকারেরা মেয়েদের পূর্বরাগ আগে বর্ণনা করবেন—এইরকম একটা শাস্ত্রীয় নির্দেশ দিলে, সেটা কিন্তু এই পৌরুষেয় মনোভাবেই প্রকট করে তোলে যে, পুরুষরাই এইভাবে মেয়েদের দেখতে চায়। পুরুষরাই, প্রায় অনেক পুরুষই তাঁদের অপ্রাকৃত বুদ্ধিতে প্রায় অসম্ভবের ক্ষেত্রেও এই সম্ভাবনায় মুগ্ধ হন যে, মেয়েরাই তাঁদের দেখে প্রেম নিবেদন করছে, মেয়েরাই অন্তরে অনন্ত মুগ্ধতা বহন করে তাঁদের প্রতি আকর্ষণ প্রকট করে তুলেছে এবং মেয়েদের এমন করুণ অবস্থায় তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে ধরা দিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং কিছুতেই যেন তাঁরা এক রমণীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারছেন না।

পণ্ডিতজনেরা লক্ষ্য করেছেন যে, যৌনতার প্রথম আরম্ভ যদি শুধুমাত্র মানসিক-মধুর এক আকর্ষণ দিয়ে শুরু হয় তাহলে সেই আকর্ষণ থেকে আরম্ভ করে মিলনোত্তর যৌনতার পূর্ণ অভিব্যক্তি পর্যন্ত পুরুষেরই ক্রিয়াশীলতা বেশি থাকে। এমনকী রতিকৌশলের মধ্যেও পুরুষেরা যেভাবে চায়, সেইভাবেই সেই পুরুষায়িত কল্পনায় মেয়েদের কল্পনা করতে চায় পুরুষ। আমরা মনে করি, এই রকম একটা অচেতন পৌরুষেয় ভাবনার আবর্তে পড়েই বিশ্বনাথ কবিরাজের মতো এক রসশাস্ত্র বিশারদ এই ধরনের একটা শাস্ত্রীয় নির্দেশ দিয়ে ফেলেন যে, আগে মেয়েদের অনুরাগ-আকর্ষণ দেখাতে হবে কবিদের তারপর মেয়েরা সম্মতিসূচক লজ্জা-লজ্জা ভাব-টাব দেখালে তবে ছেলেদের আকর্ষণ পূর্বরাগ বর্ণনা করবে—সরল-রসিক শাস্ত্রকার বিশ্বনাথ এমন একটা নির্দেশের কারণ দেখিয়ে অকপট চিত্তে, অচেতনায়, আমাদের আধুনিক তির্যক বিচারকূটের ঊর্ধ্বে উঠেই যেন কথা বলেছেন। বলেছেন—কবি-নাট্যকারের তাঁদের ইপ্সিত বর্ণনার মধ্যে পুরুষের পূর্বরাগ আগে বলতেও পারেন বটে, কিন্তু মেয়েদের পূর্বরাগ আগে দেখালে সহৃদয় শ্রোতা-দর্শকের কাছে সেটার আবেদন হয় মধুরতর, অনেক বেশী সেটা হৃদয়ঙ্গম হয়ে ওঠে – হৃদয়ঙ্গমং ভবতি।

আদৌ পুরুষানুরাগে সম্ভবত্যপি এবম্‌ অধিকং

আমরা এই পণ্ডিত-বৃদ্ধ রসশাস্ত্রকারকে দোষ দিই না। সত্যিই তো কাব্য-নাট্য-সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক তো তখনকার দিনে পুরুষরাই ছিলেন। ফলত তাঁদের হৃদয়-সঙ্গত কথা তো এটাই হবে যে, মেয়েরা পুরুষদের দেখে আকর্ষিত বোধ করছে, এটা ভাবতেই ভাল লাগবে তাদের। শুধু ভাল লাগা নয়, এটাই তাদের আন্তরিক বিশ্বাস। কেননা মেয়েরা যেমন, যেমনটা তাদের মানসিকতা, এক কথায় মেয়েরা যা—অখিল পুরুষকুল তাদের সেইভাবে দেখে না। বরঞ্চ পুরুষেরা যেমনটা তাদের নিজস্ব পৌরুষেয় মানসিকতা, ঠিক সেইভাবেই মেয়েদের বিচার করে এবং তাদের দেখেও সেইভাবেই। অর্থাৎ পুরুষ যেভাবে চায় যে, মেয়েদের ইচ্ছে এইরকম হোক, কিংবা এইভাবে তারা পুরুষের আকর্ষণের কথা মৌখিকভাবে ব্যক্ত করুক সেইভাবেই কবি-সাহিত্যিজের বর্ণনীয় বিশয় গরে তোলেন। এমনকী এক বিশেষ পুরুষ তার ভাবভঙ্গী, ব্যক্তিত্ব দিয়েও কীভাবে আকর্ষণ করছে এটা পুরুষ যেভাবে চায় যে, মেয়েরা এইভাবেই ব্যক্ত করুক—The will of women as men want to experience it –সেইভাবেই কিন্তু পুরুষের গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা। হয়তো এই কারণেই Thomas Hardy লিখেছিলেন – It’s difficult to define her feelings in language which is chiefly made by men to express theirs. (Thomas Hardy, Far from the Madding crowd, vol.II, London : smith Elder, 1874, p.256)
এমনকী একথা বৈষ্ণব পদাবলীর বহুতর মধুর পদ-শব্দের মধ্যেও সত্য। বিদ্যাপতির পদে যখন শ্রীমতী নিজের পূর্বরাগের কথা শোনান, তখন এইটুকু অন্তত এক প্রেমমুখরা রমণীর মুখ থেকেও একথা বেশ মানিয়ে যায় যে,এই বনমালী মাধবকে একবার দেখার জন্য আমার চোখের আকুল দৃষ্টি দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়ে ছুটতে থাকে। সে চোখের আকুলতা এমনই যেন মিলনশেষে কমলিনীকে ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন দিনমনি

দরসনে লোচন দীঘল ধাব।
দিনমণি পেখি কমল জানু জাব।।

যার অরুণ-কিরণ-করাঙ্গুলির স্পর্শে কমলিনীর একটি একটি হৃদয় দল উন্মীলিত হবার কথা, তাকে দেখার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র চোখটুকুও যেন পদ্মের পাঁপড়ির মতো দীঘল হয়ে উঠেছে।

একটি অভিমত পুরুষকে দেখে মুগ্ধ এক রমণীর অভিব্যক্তিটুকু হয়তো খুব স্বাভাবিক কেননা রজঃসন্ধির কালে সন্ধিনী বালিকার শরীরে যে উর্বরতা আসে তাতেই সে রমণী হয়ে ওঠে এবং রমণীয়ভাবেই তার একটা ইশারা তৈরী হয় পুরুষ-কৌতুহলের প্রত্যুত্তরে। হয়তো বা শারীরিক মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অসহায়তার ফলেই পশ্চিম দেশের এক রমণী, যিনি নিজের মুখে তাঁর সমস্ত যৌনতা নির্দ্ধিধায় প্রকাশ করেছেন, যদিও সেই মহিলা নিজে পুরুষের যৌনতার আধার হয়েছেন অন্তত একশবার, কিন্তু অমানুষী শব্দে এই কথাটা তিনি লিখেছিলেন— And the day came when the risk to remain tight in a bud was more painful than the risk it took to blossom… A leaf fluttered in through the window this morning, as if supported. রমণীর পূর্বরাগের বিষয় এমনটাই হবার কথা, কিন্তু যে মূহূর্তে পূর্বোক্ত বিদ্যাপতির পদে যখন এমন কথা আসে যে, মাধব বনমালীকে দেখার পর থেকেই আমার লাজলজ্জা সব চলে গেছে এবং আপনা-আপনিই আমার নীবীবন্ধন খসে গিয়ে বসন ভূমিতে লোটাচ্ছে—

সাজনি মাধব দেখল আজ।
মহিমা ছাড়ি পলাএল লাজ।।
নীবী সসরি ভূমি পলি গেলি।
দেহ নুকাবিঅ দেহক সেরি।।

তখন বুঝি এমন একটা কাম্য পরিস্থিতির বর্ণনা জন্যই রসতাত্ত্বিক বিশ্বনাথ মেয়েদের পূর্বরাগের কথা আগে জানাতে বলেছেন। তা নইলে মাধবকে একবার দেখার জন্য যে রমণীর আঁখিপাত দীঘল হয়ে ওঠে—এমন স্নিগ্ধমধুর প্রতিক্রিয়ার অনুপাতে তার নীবীবসনের সংসরমান উত্তরণটা এক লজ্জাবতী বিদগ্ধা রমণীর পক্ষে অতিদ্রুত এক পর্যায় ঘনিয়ে তোলে এবং এমন ব্যবহারের মধ্যে পৌরুষেয়তার স্থূল হস্তাবলেপ ঘটে যায় পদকর্তার অজ্ঞাতসার অভ্যস্ত মানসিকতায়।

এমন ঘটনা যে কোনো বিদগ্ধা রমণীর জীবনে ঘটতে পারে না তা নয়, কিন্তু তার জন্য প্রেমের পর্যায়কাল আরও খানিক এগিয়ে আসার কথা। পূর্বরাগের জায়গায় থেকে আরও বেশ খানিক এগিয়ে সেখানে প্রায় যুগল-মিলনের সূচনা হবার কথা, এমনকী সেখানেও যদি রমণীর নীবীবন্ধ জটিল কোনো সমস্যা তৈরী করে, তাহলে সেটা তো পুরুষের কার্যকারিতা হিসেবেই দেখতে পান বৈষ্ণব কবি। পূর্বরাগে শারীরিক আসঙ্গ থাকে না—একথা পদাবলীকারেরাই স্বীকার করেন—‘সঙ্গ নহে রাগ জন্মে কহি পূর্বরাগ’— এখন সেই পূর্বরাগে যদি নীবী-বন্ধন শিথিল হয়ে ওঠার প্রশ্ন আসে, তাহলে সেই নীবীকে আপনিই খসে পড়তে হয় ভুঁয়ে। কবির কল্পনায় আর রাধাপ্রেমের গাঢ়তায় নীবীতেও প্রাণের সঞ্চার হয়। তা নইলে নীবীমোচন একেবারেই পুরুষের কর্মের মধ্যে পড়ে—যেটা পুরুষ রসশাস্ত্রকার এবং এক পুরুষ কবি বোধহয় রমণীর কাম্যতায় দেখতে চান বা দেখাতে চান। অথচ দেখুন, এটা যে পৌরুষেয় তৎপরতায় কতটা দ্রুত সংঘটিত হয়, এমনকী প্রেমমুগ্ধা এক রমণী কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরুষের তরফ থেকে নীবীস্পর্শ কীভাবে ঘটে, তার একটা অসামান্য বর্ণনা আছে জয়দেবের গীতগোবিন্দে। যদিও এই বৈষ্ণব কবি একেবারে সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে এই স্পর্শকাতর বিষয়টি ‘প্রথম-সমাগমের পর্যায়ে এনে ফেলেছেন এবং তা বর্ণনা করেছেন পৌরুষেয় অসহায়তার করুণায়।

মানুন না মানুন, এটা আমার বিশ্বাসের জায়গা যে, হরিস্মরণে মন সরস না হলে জয়দেবে অধিকার নেই; বিশেষত যেটা স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর বৈরাগ্যতুঙ্গ সন্ন্যাসকালের পরম আস্বাদ্য গ্রন্থ, সেটাকে রাধাকৃষ্ণের যৌনতার প্রকরণ বলে ধরে নিয়ে আমার পক্ষে যৌনতার আভাস দেওয়া সম্ভব নয়, তবু কৃষ্ণ যেহেতু সর্বোত্তম নরলীলা স্বরূপে অবস্থান করছেন, তাই মনুষ্যসমাজে দৃষ্ট যৌনচার এখানে অন্যতম ভিত্তি বটে। হরিস্মরণে সরস মনের সঙ্গে জয়দেব আরেকটু যোগ করেছিলেন, ‘যদি বিলাসকলাসু কুতূহলম্‌’—অর্থাৎ কিনা অবতার সার কৃষ্ণ অবতারের মনুষ্য স্বরূপ তিনি মানুষের রতিকলাবিলাসের আধারেই বর্ণনা করবেন। ফলত সাধারণ্য যেভাবে যৌনতাকে উপভোগ করে, জয়দেব সেই উপভোগ্যতাতেই কৃষ্ণলীলা নিরূপণ করেছেন।

সত্যি বলতে কী, জয়দেব এখানে চরম। একে তো তাঁর অপভ্রংশ ললিত ছন্দ, তার ওপরে সেখানে বাংলা ভাষায় প্রথম সমাগমধ্বনি ফুটিয়ে তুলে ধীর সমীরে যমুনাতীরে যে কাব্য তিনি লিখলেন, তাতে যৌনতার সঙ্গে স্ত্রীলোকের উপভোগ্য পৌরুষের রতিবিলাস আরও মদির হয়ে ওঠে। এক ভদ্রলোক স্ত্রীলোকের ওপর পৌরুষের আক্রমণের চিন্তায় লিখেছিলেন—জয়দেবের বর্ণনা স্ত্রীলোকের কাছে স্ত্রীভাবের অবমাননা ছাড়া কিছু নয়। কেননা জয়দেবের রাধা সখীকে বলেছেন—প্রথম যখন কান্ত কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হল, সে আমার কী লজ্জা, প্রথম সমাগমের লজ্জা। তারপর তাঁর মুখে আমার রূপগুণের শত প্রশংসা চাটু শুনে আমি যেই একটু অনুকূল হয়েছি, যেই না আমি একটু ইতিবাচক হেসেছি, অমনি কিনা, কী দুষ্টু স্বভাবের মানুষ রে বাবা! অমনি কিনা আমার জঘনমেখলায় হাত রেখে শিথিল করে দিল মেখলার বন্ধন—‘মৃদু-মধুর-স্মিত-ভাষিতয়া শিথিলীকৃত-জঘন দুকূলম’।
গবেষক বলেছেন—কৃষ্ণ এখানে রাধার প্রতি যে ব্যবহার করেছেন সেটা অনেকটা নেকড়ে বাঘের ছাগল ধরার সমান। আমি এই গবেষক মহাশয়ের নাম মনে করতে পারছি না, তবে কাল স্মৃতি যতটুকু জানান দেয়, তাতে ধারণা হয়—এই গবেষক Wendy Doniger-যুগলের একজন হবেন—অথবা তিনি যেই হোন তাঁর এই ভারতীয় রসশাস্ত্র সম্বন্ধে বোধ কম আছে বলেই শেকপীয়রের Rape of Lucrece থেকে উদ্ধার করে ধর্ষণের সমানতায় তিনি লিখে ফেললেন, এখানে রাধার অবস্থাটা ছিল—

The wolf has seized its prey
and the poor lamb cries.

জয়দেবে রাধার কথাগুলি আমরা উদ্ধার করে দিয়েছি এখানে—কোথাও কী মনে হচ্ছে যে, বিনোদিনী রাইকিশোরী কৃষ্ণস্পর্শে নারীবাদিনীদের মতো ক্রুদ্ধ হয়েছেন। ‘প্রথম-সমাগমে’র কৌতুক এবং লজ্জার আবেশের মধ্যে পুরুষ-কৃষ্ণের এই সাহসটুকু রাধা কতটা আস্বাদন করছেন, সেটা সখীর কাছে তাঁর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি থেকেই পাওয়া যাবে। এই অভিব্যক্তির শেষটায় বিনোদিনীর আপন আস্বাদন ঘটে, রাধা বলেন — আমার এ কেমন অলসতা ছিল, সখী ! আমার চোখ বুজে আসছিল, রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল আমার দুই গাল—অলস-নিমীলিত-লোচনয়া পুলকাবলি-ললিত-কপোলম্‌।

আমরা কিন্তু এখানে হ্লাদিনী-সার রাধারাণীর কৃষ্ণস্পর্শজনিত মুগ্ধ ভাবোদয়গুলির বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যান করতে বসিনি এখানে। আমাদের প্রসঙ্গ ছিল—বিদ্যাপতির রচনায় রাধারাণীর কৃষ্ণদর্শনে পূর্বরাগের কথা। সেখানে কৃষ্ণদর্শনের মহিমায় কৃষ্ণভাবিতা রাধারাণীর স্বয়ং সংসরমান নীবীবন্ধনের কথাটা প্রেমপর্যায়-ভাষ্যের পূর্বানুকল্প হয়ে পড়ায় আমরা পুরুষের লেখনীতে পৌরুষেয়তার হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় বলেছিলাম। বিশেষত বিশ্বনাথের মতো রসতত্ত্ববেত্তার এখানে নির্দেশ আছে, সেটা আমাদের ঠিক লাগে না। কেননা নর-নারীর হৃদয়সংক্রান্ত বাস্তবটা এমনই যে, কে, কখন, কাকে দেখে আগে কীভাবে মোহিত হবে—এটা বিধাতা পুরুষও জানেন না। সেখানে শাস্ত্রকারের শাস্ত্রীয় নির্দেশটুকু রসতাত্ত্বিক গার্জেনগিরি বলে মনে হয়।

পুর্বরাগের রসশাস্ত্রের বাখানি : কে প্রথম কাছে এসেছে – তুমি না আমি ।

সবচেয়ে উপযুক্ত এবং বাস্তব কথাটা বলেছেন রূপ গোস্বামী। রূপ গোস্বামী তো সেই মানুষ যিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর, মনোভীষ্ট জানতেন। এমন উপযুক্ত রসিক বলেই তিনি কাব্য-নাট্যের নবরসরুচিরা সরস্বতীকে নূতনতর রসভাবনায় নতুন করে সাজিয়ে দিতে পেরেছিলেন। রাধাভাবের মহাশক্তি তাঁর অন্তরে ছিল বলেই নারী-পুরুষের প্রেমপর্যায়ের নির্মাণ তাঁর লেখনীতে শাস্ত্রীয় পৌরুষেয়তায় আহত হয় না। তিনিই যুক্তি সম্মতভাবে প্রথম বোঝালেন যে, প্রণয়-নিবেদন বা দর্শন-শ্রবণে প্রেম-পূর্বরাগের উদয় হওয়াটা পুরুষ-রমণীর সমভাবের বিষয়। অর্থাৎ কখনো সেটা পুরুষের দিক থেকেও হতে পারে আবার কখনো সেটা মেয়েদেরও হতে পারে। এর কী কোনো বাঁধাধরা নিয়ম থাকতে হয় নাকি—প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে! স্ত্রী-পুরুষের বয়ঃসন্ধির কালে লিঙ্গভিত্তিক নিয়ম-নিয়ন্ত্রণ চলে না। কিন্তু ব্যবহারিক জগতে প্রধানত নিজেদের স্বভাবগত কারণে পুরুষেরাই যে মেয়েদের ব্যাপারে আগে অনুরাগী হয়, এই বাস্তব সত্যটা পুরুষোত্তম কৃষ্ণের উদাহরণেই প্রতিষ্ঠা করেছেন রূপ গোস্বামী। তিনি তত্ত্ববেত্তা বিশ্বনাথের রসতাত্ত্বিক নির্দেশটাকে বাস্তবোচিত দৃষ্টিতে বিচার করে রসিক বুদ্ধিতেই তাঁর মত খণ্ডনও করেছেন, আবার মণ্ডনও করেছেন।

রপ গোস্বামী পূর্বরাগের প্রসঙ্গ তুলে লিখেছেন-কৃষ্ণের পূর্বরাগের কথাই যদিও প্রথমে বলা উচিত, কিন্তু চকিতচাহনী মেয়েদের পূর্বরাগের বর্ণনায় রসমাধুর্য অনেক বেশী প্রকট হয়ে ওঠে —

অপি মাধবরাগস্য প্রাথম্যে সম্ভবত্যপি।
আদৌ রাগে মৃগাক্ষীণাং প্রোক্তা স্যাচ্চারুতাধিকা।।

রূপ গোস্বামী কিন্তু তাঁর ‘রসভাবিতা মতি’ অনুসারে পূর্বরাগের বর্ণনীয়-বিষয়ে একটা ইচ্ছে প্রকাশ করছেন, তিনি বিশ্বনাথের মতো কোনো নির্দেশ দিচ্ছেন না। তিনি বরঞ্চ তাঁর সামাজিক পৌরুষেয় ভাবটা স্বীকার করে নিয়েই বলছেন—মানছি, অনুরাগের বিষয়ে পুরুষরাই আগে তাদের অভিলাষ ব্যক্ত করে, কিন্তু মেয়েদের অনুরাগের বর্ণনীয়তার মাধুর্য বেশী বলেই মৃগনয়নী ব্রজরমণীদের পূর্বরাগ আগে প্রকট করে তুললে কাব্য-নাটক অনেক বেশী জমে যায়।

পূর্বরাগের ক্ষেত্রে রূপ গোস্বামী যে পুরুষের ‘প্রাথম্য’ স্বীকার করে নিলেন, সেখানে তাঁর অন্তর্গত যুক্তির মধ্যে বাস্তব যেমন আছে, তেমনই আছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে, যে গ্রন্থ বেদ বলে পরিচিত সেই ভাগবত পুরাণের সমর্থন। ভাগবত পুরাণে যেদিন কৃষ্ণের কালিয়দমনের ঘটনা চলছিল, সেদিন এই ভয়ঙ্কর কালিয় নাগ কৃষ্ণের শরীর পেঁচিয়ে ধরেছে –- এই খবর পাওয়া-মাত্র ব্রজকুলের রমণীরা—আরও স্পষ্ট ভাষায় সেই গোপীরা—যারা কৃষ্ণের স্বজন-সৌহার্দ আগে দেখেছে, যারা তার হাস্যমধুর নয়ন দুটি দেখেছে বলে মনে মনে কৃষ্ণের প্রতি খানিক ‘অনুরাগবতীও’ বটে—সেই সংত্রস্ত গোপিনীরা কৃষ্ণের বিপন্নতা দেখে পুত্রশোকাতুরা জননী যশোমতীর কাছে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণের জন্য সমব্য প্রকট করে তুলেছেন—এই গোপিনীদের দেকে কৃষ্ণের নাকি প্রথম অনুরাগের সৃষ্টি হয় গোপীদের প্রতি – একথা রসিক-সুজনেরা বলে থাকেন। বলে থাকেন পদাবলীর গবেষকরাও। যেমনটা লিখেছেন গোবিন্দদাস—

কালিদমন দিন মাহ।
কালিন্দীতীর কদম্বক ছাহ।।
কত শত ব্রজ নব বালা।
পেখলুঁ জনু থির বিজুরিক মালা।।
তোহে কহ সুবল সাঙ্গাতি।
তবধরি হাস না জানো দিনরাতি।।
তঁহি ধনী মণি দুই চারি।
তঁহি মনোমোহিনী এক নারি।।
সো অব মঝু মন পৈঠে।
মনসিঞ্জ ধূমেহু ঘুম নাহি দিঠে।।
অনুখন তাহ্নিক সমাধি।
কো জানে কৈছন বিরহ-বিয়াধি।।
দিনে দিনে খিন ভেল দেহা।
গোবিন্দদাস কহ ঐছে নব লেহা।।

এটি অবশ্যই পূর্বরাগের পদ এবং এই পদে কালিয় দমনের দিনেই ব্রজরমণীদের মধ্যে একতমা এক রমণীর প্রতি কৃষ্ণের অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছে—এই মনোগোপ্য কথাটা কৃষ্ণ তাঁর সুবলসখাকে জানিয়েছেন। সেই মনোমোহিনী নারীকে দেখার পর থেকে দিনরাত তাঁর ঘুম নেই। রমণী তাঁর মন জুড়ে বসেছে। তদবধি তাঁর ভাবনাতে স্থির হয়ে আছে এই ব্রজবালা, তাঁর কথাই ভাবছেন অনুক্ষণ। সেই কালিন্দীতীরে কদম্বছায়ায় যে যুবতীকে দেখেছিলেন কৃষ্ণ, তাঁর বিচ্ছেদ যেন আর সইতে পারছেন না তিনি। তাঁর শরীর ক্ষীণ হচ্ছে দিন দিন। পদকর্তা গোবিন্দদাস ভণিতায় সান্ত্বনা জানাচ্ছেন কৃষ্ণকে—কী আর করবে বলো। নতুন নতুন এই প্রেমের আঠাটাই এইরকম যে, তোমার শরীর-মনে যা সব ঘটছে, তা কেন ঘটছে ভাল করে বোঝা যায় না।

স্পষ্টতই এই পদে পূর্বরাগের, বিশেষত পুরুষ কৃষ্ণের পূর্বরাগের মঞ্চসজ্জা করছেন পদকর্তা গোবিন্দদাস এবং তাঁর অনুভব-কল্পনাতেই কালিয়-দমনের দিন ব্রজরমণীদের থির বিজুরির মালার মাঝে মণি হেন ধনী রাইকিশোরীকে দেখেন তিনি। তদবধি কৃষ্ণের মনে অনুরাগ তৈরী হয়েছে বলে গোবিন্দদাস পদরচনা করেছেন।

শ্রদ্ধেয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই পদের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে লিখেছেন—শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে—কালিয় দমন-দিনে গোপীগণকে দেখিয়া শ্রীকৃষ্ণের পূর্ব্বরাগের উদয় হইয়াছিল। ধেনুকবধের দিনে শ্রীকৃষ্ণকে দেখিয়া গোপীগণের পূর্ব্বরাগের উদয় হয়। যদিও লীলা পর্যায়ে কালীদমন-লীলাই পূর্ব্বে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, তথাপি লীলা বর্ণন করিবার সময় শ্রীপাদ শুকদেব গোস্বামী ধেনুক-বধই পূর্ব্বে বর্ণনা করিয়াছেন। আচার্য্যগণ বলেন, শ্রীকৃষ্ণলীলারস-ভাবিত চিত্তের আবেশ-বশতঃ লীলার পৌর্ব্বাপর্য্য রক্ষিত হয় নাই। আমাদের মনে হয়, তিনি লীলার চারুতা সম্পাদনের জন্যই, গোপীগণের পূর্ব্বরাগ পূর্ব্বে বর্ণন করিবার অভিপ্রায়েই অগ্রে ধেনুকবধ-লীলাই প্রকাশ করিয়াছেন। জ্ঞানদাস-‘‘ধেনুকবধের দিনে আঁখিতে পড়িয়া গেল মোর’’ বলিয়া শ্রীরাধার পূর্ব্বরাগের পদে ধেনুকবধের প্রসঙ্গ তুলিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণের পূর্ব্বরাগের পদে গোবিন্দ দাস বলিয়াছেন—‘‘কালি-দমন দিন মাহ। কালিন্দীতীর কদম্বক ছাহ। কতশত ব্রজ নব বালা। পেখলুঁ জনু থির বিজুরকি মালা।। তঁহি ধনী মণি দুই চারি। তঁহি মনোমোহিনী এক নারি।। সো অব মঝু মন পৈঠে। মনসিজ ধুমেহু ঘুম নাহি দিঠে।।’’ এ-কথা এক্কেবারে ঠিক যে লীলারস ভাবিতচিত্ত আচার্যদের আবেশে লীলার পৌর্বাপর্ব্য রক্ষিত না হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক, এমনকী এক একটি বিশেষ দিন ধরে এক একটি লীলাখণ্ডের সৃষ্টিও কিন্তু আচার্যদের লীলাবেশেই সম্পন্ন, হয়েছে—যেমনটা গোবিন্দদাসের পদে কালিয়দমনের দিনে কৃষ্ণের পূর্বরাগের বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও জানাই যে, ভাগবত পুরাণে ‘কালিয়দমন-দিনে’ কৃষ্ণের পূর্বরাগের বিষয় এতটুকুও বর্ণিত হয়নি, প্রথম দেখায় অনুরাগী হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বরঞ্চ ঘটনা একেবারেই উলটো—যার ফলে পূর্বরাগের ক্ষেত্রে পুরুষের প্রয়াস আগে হয়—এই বাস্তবের উল্লেখ করলেও রূপ গোস্বামী ভাগবতী ভাবনাতেই একথা লিখেছেন যে, পূর্বরাগের বিষয়ে মেয়েদের কথাটা আগে লিখেলে সেটাতে বেশী চমৎকার তৈরী হয়—প্রোক্তা স্যাচ্চারুতাধিকা

ভাগবত পুরাণে কালিয়দমনের দিনেও গোপরমণীদেরই হৃদয় বিস্ফুরিত হয়েছে কৃষ্ণের জন্য, আর ধেনুকাসুর-বধের দিন তো তাঁদের হৃদয় আরও বেশী লীলায়িত এবং মুগ্ধ –বস্তুত মুগ্ধতার এই আকরিক মহিমাই কিন্তু পরবর্তীকালে ব্রজরমণীদের পূর্বরাগ-প্রকরণ তৈরী করে দিয়েছে।

শ্রীমদ্ভাবতে তালবনে ধেনুকাসুরের অত্যাচার স্তব্ধ করে করে দিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম সখাদের সঙ্গে নিয়ে ব্রজপুরে গোষ্ঠে প্রবেশ করছেন। কৃষ্ণের চেহারাটা তখন দেখার মতো। সঙ্গে এতগুলো গরু ফিরছে, তাদের পদাহত ধূলিতে কৃষ্ণের কেশরাশি ধূসর হয়ে উঠেছে। সেই কেশরাশিতে ময়ূরপুচ্ছ বাঁকা টালে বনফুলের মধ্যে একত্রে গ্রথিত, মুখে মধুর হাসিটি লেগে আছে, আর আছে ইতি-উতি চোখের চাওয়া। কুঞ্চিতাধরপুটে মুরলীর গান—কৃষ্ণ ফিরছেন, তাঁর সখারা সদ্য ধেনুকাসুর-বধের প্রসঙ্গ তুলে নানা প্রশংসায় ভরিয়ে তুলছে তাঁকে। এইরকম এক কৃষ্ণকে দেখার ইচ্ছেতেই ব্রজকুলের রমণীরা অনেকে একসঙ্গে মিলে ছুটে এসেছে—

তং গোরজশ্ছুরিত-কুন্তলবদ্ধবর্হ-
বন্য প্রসূন-রুচিরেক্ষণ-চারুহাসম্‌।
বেণুং ক্বণন্তমনুগৈরুপগীতকীর্তিং
গোপ্যো দিদৃক্ষিতদৃশো’ভ্যগমন্ সমেতাঃ।।

ধেনুক-বধের পরেও এই যে কৃষ্ণের লীলায়িত প্রত্যাবর্তন—এখানেই এক ধীরোদাও নায়কের ধীরলালিত্যে সংক্রমণ। ব্রজের রমণীরা এক ‘হিরো’ নায়ককে তাঁদের সহজগম্য ললিতরূপে দেখতে পাচ্ছেন বলেই তাঁদের হৃদয় উদ্বেলিত হচ্ছে। এরপর ভাগবতী বর্ণনায় গোপরমণীদের নয়নগুলি ভ্রমরের মতো উড়ে গেল যেন—কৃষ্ণমুখের কম-মধু পান করার জন্য। এতেই তাঁদের সমস্ত দিনের বিরহ-সন্তাপ জুড়িয়ে গেল যেন। মনের মধ্যে এই উদ্বেল হুতাশন তো আর বাইরে প্রকট করা যায় না। কাজেই অন্তরের ভাবটা সংবৃত করার জন্য বাইরে তাঁরা ঘনিয়ে আনলেন লজ্জা। সেই লজ্জারও একটা শৃঙ্গার-সজ্জা আছে যেখানে মানসিক সেই উচ্ছ্বাস ছায়ার মতো ধরা পড়ে। ভাগবত পুরাণের রসিক কবি বলেছেন—সব্রীড়হাস বিনয়ং যদপাঙ্গমোক্ষম্। অর্থাৎ লজ্জার সঙ্গে হাসি আছে, আবার সেই হাসিটিও চাপার জন্য লাস্য-হস্তের আবরণ আছে। সব মিলিয়ে এটা ছিল গোপবধূদের প্রথম অনুরাগের অতিথি সৎকার—যে সৎকার পূর্ণ প্রাণে গ্রহণ করেই তবে ব্রজভূমির গোষ্ঠে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ –

তৎ সৎকৃতিং সমাধিগম্য বিবেশ গোষ্ঠং
সব্রীড়াহাসবিনয়ং যদপাঙ্গমোক্ষম্‌।।

ভাগবতের এই শ্লোকটাকে রসিকের চূড়ান্ত অনুভবে ব্যাখ্যা করেছেন টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। অনেক কথা বলতে বলতে তিনি মন্তব্য করেছেন—এই শ্লোকে ‘সৎকার’ এর ‘সমধিগম’ কথা দুটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটা গোপবধূদের ব্যাপার, দ্বিতীয়টি ‘সমধিগম’ কৃষ্ণের ব্যাপার। লজ্জার সঙ্গে হাসি, হাসির সঙ্গে বিনয়—এই পর্যন্ত গোপীজনের সৎকার। আর এগুলিকে সম্পূর্ণ স্বীকার করার জন্য কৃষ্ণের অপাঙ্গ-মোক্ষণ, সাধারণ নেত্রপাত নয় কিন্তু, তির্যক চাউনিতে অনুরাগ-স্বীকার। রসিক ভক্তের ব্যাখ্যা হল—কটাক্ষ লাভ করার জন্যই এমন কটাক্ষ—ততস্তৎকটাক্ষপ্রাপ্ত্যর্থমের কৃষ্ণেনাপঙ্গামোক্ষ ইতি জ্ঞেয়ম্।

ভাগবতের এই বর্ণনা গোপীকুলের পূর্বরাগের উদাহরণ যতই হোক, এই বর্ণনার সবচেয়ে সূক্ষ্ম প্রমাণযোগ্য দিকটাই হল মেয়েদের প্রেমে পড়ার বিষয়টা আগে লিখলে কবিরা মজা পান অনেক বেশী। পূর্বের দেখা বা পূর্বে কৃষ্ণের বিষয়ে শুনে থাকতে পারেন এইরকম গোপরমণীদেরই সারা দিন কেটেছে না দেখার বিরহে; তারপর ধেনুকবধের নায়ককে একবার দেখেই মানসিক আসঙ্গের মধ্যে শরীরী অনুভব তৈরী হচ্ছে এমনভাবেই যাকে মানসিক চুম্বন বলা যায় এবং তাতে তাঁদের বিরহ-কষ্ট মূহূর্তে অবলুপ্ত হচ্ছে—তাপং জহুর্বিরজং ব্রজযোষিতাহ্নি। তারপর তো সেই লজ্জা, হাসি এবং তার সংবরণ-লাস্য—এগুলি তো কৃষ্ণের বর্ণনায় পাওয়া যেত না। তিনি তো নিজের নায়ক-স্বভাবে খানিক ‘হিরোইজম’ দেখিয়েই পৌরুষেয় কাঠিন্যে একবার অপাঙ্গ মোক্ষন করেই ভবিষ্যতের সম্ভবনা তৈরী করলেন।

কিন্তু কবি-সাহিত্যিক এবং রসতাত্ত্বিকেরা জানেন যে, কাব্য-নাট্যের চারুতা-বিস্তার কখনোই পুরুষের ভাববিক্রিয়ার প্রদর্শনীতে বিশ্রান্তি লাভ করতে পারে না। তাতে পুরুষ মানুষ মেয়েলি হয়ে পড়ে এবং তাতে রসের চাইতে রসাভাসের সম্ভবনা বেশী তৈরী হয়। ফলত এই সত্য ধ্রুবসত্য বটে যে, কৃষ্ণ স্বয়ং ‘অখিলরসামূতমূর্তি’ হওয়া সত্ত্বেও পুরুষের যৌনতার নিরিখে তাঁরই ব্রজগোপীদের দেখে প্রথম অনুরাগ-কৌতূহল হবার কথা। রূপ গোস্বামী চৈতন্যের মনো’ভীষ্ট জানেন এবং পরম রসিক বলেই তিনি পূর্বরাগের বিষয়ে কৃষ্ণের প্রেমোন্মুখিতা স্বীকার করেও কাব্য-নাট্যের চারুতা সম্পাদনের নিরিখে স্ত্রীলোকের পূর্বরাগের বর্ণনীয়তা স্বীকার করেছেন প্রথমে। এবং দেখা যাচ্ছে—ভাগবত পুরাণেও তাই—রসশাস্ত্রের ব্যাকরণ সম্বন্ধে অনবহিত থাকা সত্ত্বেও গোপরমণীদের অনুরাগের কথা সেখানে আগে এসেছে।

শ্রদ্ধেয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় গোবিন্দদাসের ভাবাবেশে পূর্বরাগের পৌর্বাপৌর্য প্রমাণ করার জন্য ভাগবত পুরাণে বর্ণিত কালিয়-দমনের দিনটাকে কৃষ্ণের অনুরাগ-উন্মেষের দিন বলতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি যে, ভাবাবিষ্ট গোবিন্দদাসের কল্পনায় লীলার পৌর্বাপৌর্য-ব্যতিক্রম ঘটে থাকলেও কালিয়-দমন-দিনে কৃষ্ণের পূর্বরাগের কথা যেমনটা হরেকৃষ্ণ বলেছেন, তেমনটা কিন্তু আমরা ভাগবত পুরাণে দেখিনি। ভাগবত পুরাণে যে শ্লোকে ব্রজবধূদের আগমন ঘটছে। সেখানে কৃষ্ণের পূর্বরাগের কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখতে পাই না। কৃষ্ণ কালিদহে নেমেছেন যমুনা নদীকে বিষমুক্ত করার জন্য। কেউ যেখানে জলস্পর্শ করার সাহস করে না, কৃষ্ণ সেই জলস্থানে নেমেছেন এবং এখানে তাঁর নায়কোচিত বিলাসমূর্তি ধেনুকাসুর-বধের কাল থেকে অনেক বেশী উদ্ধত এবং কঠিন। কালিয় নাগ তাঁকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে বহুল ফণায় এবং এই বিপর্যয়ের খবর চলে এসেছে ব্রজপুরের সকলের কানে।

ততক্ষণে সকলেই চলে আসেন যমুনার তীরে সেই জায়গায়, যেখানে যমুনার জল খানিকটা ঢুকে এসেছে স্থলভূমির মধ্যে। সেটাকেই ‘অন্তর্হ্রদ’ বলছেন ভাগবতের কবি। সকলে যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে সকলে দেখেছেন –কালিয় পেঁচিয়ে ধরেছে কৃষ্ণের শরীর, আর তীরে দাঁড়িয়ে বলরাম এবং কৃষ্ণের অন্যান্য সখারা কৃষ্ণকে শক্তিপ্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করছেন, কিন্তু কৃষ্ণ এখনও কিছুই করছেন না –

অন্তর্হ্রদে ভুজগভোগ-পরীতমারাৎ
কৃষ্ণং নিরীহমুপলভ্য জলাশয়ান্তে।

চিন্তাকুল গোপজনেরা যখন কৃষ্ণের করুণ অবস্থা দেখে কাঁদতে আরম্ভ করেছেন, তখন ব্রজবধূজনের অবস্থাটা বর্ণনা করেছেন ভাগবতের কবি এবং সোখানে গোপীকুলের অবস্থাটা কিন্তু পূর্বাহ্নেই অনুরাগগ্রস্ত এবং এখানে আগে-পরে এমন কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই যাতে গোপবধূদের ওপর কৃষ্ণের ভাব পূর্বরাগের চিহ্নিত করা যায়। কালিয়বেষ্টিত কৃষ্ণকে দেখে গোপীদের প্রতিক্রিয়া পৃথক দুটি শ্লোকে বর্ণনা করেছেন ভাগবতের মহাকবি ব্যাস এবং গোপরমণীদের প্রথম বিশেষণ হল—গোপ্যো’ নুরক্তমনসো ভাগবত্যনন্তে—তাঁরা অন্তহীন ভগবৎস্বরূপ কৃষ্ণের প্রতি পূর্বাহ্নেই অনুরক্ত। তাঁদের অনুরক্তি বুঝবো কেমন করে ? না, কৃষ্ণের সৌহার্দ-বন্ধুত্ব, তাঁর হাসির কথা, তাঁর চাহনির কথা এবং মধুর আলাপের কথা তাঁদের মনে পড়ছে এই সময়। তাঁদের সেই প্রিয়তম নায়ককে আজ মরণকুণ্ডলীতে পাকিয়ে ধরেছে এই মহাসর্প কালিয়। কৃষ্ণের এই অবস্থা দেখে তাঁরা এত কষ্ট পাচ্ছেন যে, তাদের সামনে এই তিন ভুবন যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে –

গোপ্যো’নুরক্তমনসো ভগবত্যনন্তে
তৎসৌহৃদঃ স্মিত-বিলোকগিরঃ স্মরন্ত্যঃ।
গ্রস্তে’হিনা প্রিয়তমে ভৃশদুঃখতপ্তাঃ
শূন্যং প্রিয়ব্যতিহৃতং দদৃশুস্ত্রিলোকম্।।

[ভাগবত ১0.১৬.২0]

যে পুরুষের জন্য এত অনুরাগ জমা হয়ে ছিল, সেটা সামাজিক কারণে প্রকাশ করা যায় না বলেই ব্রজরমণীরা সমতুল্য এক বয়স্কা জননী যশোমতীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। পুত্রশোকে আকুল জননী যে আশঙ্কায় উদ্বেলিত সমদুঃখিতা ব্রজবধূরা সেই আশঙ্কা নিয়েই যশোমতীর সামনে কৃষ্ণের পূর্বাচরিত প্রিয় বৃত্তান্তগুলি বলে যশোদাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন এবং কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা মৃতের মত নিশ্চেষ্ট হয়ে রইলেন—

তাঃ কৃষ্ণমাতরমপত্যমনুপ্রবিষ্টাং
তুল্যব্যথাঃ সমনুগৃহ্য শুচঃ স্রবন্ত্যঃ।
তাস্তাঃ ব্রজপ্রিয়কথাঃ কথয়ন্ত্য আসন্
কৃষ্ণাননে’র্পিত দৃশো মৃতকপ্রতীকাঃ।।

[ভাগবত ১0.১৬.২১]

কৃষ্ণ এবার পিতা-মাতা থেকে নদীতীরে দাঁড়ানো সকলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে, সকলেই তাঁরা কষ্ট পাচ্ছেন। তিনি আর দেরী করলেন না। অদ্ভুত এক অলৌকিক শক্তিতে সর্পরাজের বাঁধন ছাড়িয়ে নিয়ে কালিয়র মাথার ওপর নৃত্য শুরু করলেন। এখানে এইমাত্র বার্তা ছিল যে, কালিয় নাগের আবেষ্টনে বিপর্যস্ত তাঁর এই অবস্থা দেখে গোকুলবাসীরা স্ত্রী-পুত্র সহ সকলেই কষ্ট পাচ্ছেন—এইরকম দেখেই কৃষ্ণ নিজেকে বন্ধনমুক্ত করলেন—

ইত্থং স্বগোকুলমনন্যগতিং নিরীক্ষ্য
সস্ত্রীকুমারমতদুঃখিতমাত্মহেতোঃ।

[ভাগবত ১0.১৬.২৩]

এখানে এই বিশাল জনপদপাসী ব্রজজনের মধেও কৃষ্ণকে পৃথকভাবে কোথাও গোপরমণীদের দিকে কটাক্ষ মোচন করতেও দেখছি না, তাঁদের পৃথক অবস্থানে আপন পূর্বরাগবশে চোখ তুলেও কৃষ্ণকে তাকাতে দেখছি না। অবশেষে কালিয় দমন সম্পূর্ণ হলে পুত্রকে বিপন্মুক্ত দেখে কৃষ্ণের প্রতি নন্দ-যশোদার স্নেহ-ব্যতিকরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিন্তু কৃষ্ণের পূর্বরাগ উন্মেষণের জন্য গোপিনীদের থির বিজুরির মালার কোনো সত্তা এখানে নেই, আর তাঁদের মধ্যে ‘তঁহি’ কানো ‘মনোমোহিনী এক নারী’ তো ছিলেনই না।

আমরা জানতে চাই—ভাগবত পুরাণে ধেনুকাসুর বধের দিন এবং কালিয়-দমনের দিন—এই দুটি দিনেই গোপীদের হৃদয় প্রকট হয় উঠেছে ব্রজকুলের নায়ক পুরুষের জন্য এবং সেটাও কোনো রসশাস্ত্রীয় ব্যাকরণ মেনে নয়। আগে ভাষা, পরে তার ব্যাকরণ তৈরী হয় বলেই ভাগবত পুরাণে ব্রজকুলললনাদের প্রথমোদ্বেলিত হৃদয় খেয়াল করেই রূপ গোস্বামী লিখেছেন—মৃগাক্ষী ব্রজবধূদের হৃদয়রাগ আগে বর্ণনা করলে, তাতে বর্ণনার মাধুর্য ভাল করে প্রকাশ পায়, কিন্তু এটাও ঠিক যে কৃষ্ণের মতো এক পুরুষের পূর্বরাগ আগে বর্ণনা করাটাই উচিত ছিল। এখানে সবিশেষে এটাই বলা দরকার যে, রসশাস্ত্রকার হিসেবে হৃদয়ভাবের যত খুটিনাটি রূপ গোস্বামী উল্লেখ করেছেন, পূর্বতন ‘ট্র্যাডিশনাল রেটোরিশায়ানে’রা সেখানে মূক-মৌন হয়ে যাবেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, স্ত্রী-পুরুষের যৌনতা, ইরোটিসিজম এবং প্রেমবিষয়ক সমস্ত কিছুই রূপ গোস্বামীর লেখনীতে রাধা-কৃষ্ণ-কেন্দ্রিক হয়ে উঠলেও রূপ গোস্বামীর বাস্তব-বোধ যে কতটা ছিল, সেটা ওই পূর্বরাগবিষয়ক শ্লোকের টীকায় পণ্ডিত-রসিক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ব্যাখ্যান থেকে বোঝা যায়। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর আনন্দচন্দ্রিকা টীকায় রূপের মন্তব্য – কৃষ্ণের পূর্বরাগের কথাই যদিও আগে বলা উচিত – এই পংক্তি ব্যাখ্যা করে লিখলেন—অনুরাগের প্রথম উন্মেষ নিয়ে যদি কিছু বলতেই হয়, তাহলে এটাই বলা উচিত যে, বয়ঃসন্ধির আরম্ভে নারী-পুরুষ দুয়েরই নির্বিকার চিত্তমাঝে যে প্রাথমিক বিক্রিয়া দেখা যায়, তাকেই তো ঐতিহ্যবাহী রসতাত্ত্বিকেরা ‘ভাব’ নামে চিহ্নিত করেছেন। তাহলে সেই নিয়মে সেই ‘ভাব’ নামক প্রথম-বিক্রিয়ার পরে পরেই তো পুরুষ-রমণীর পরম্পরান্বেষণ শুরু হয় –

প্রাথম্যে প্রথোদ্ভূতত্বে ইতি বয়ঃসন্ধ্যারম্ভে
‘নির্বিকারাত্মকে চিত্তে ভাবঃ প্রথম বিক্রিয়া’
ইত্যুক্ত রীত্যা প্রথমবিক্রিয়ান্তরমেব…
স্ত্রী-পুংসয়োঃ পরস্পরান্বেষণং সম্ভবতি।

বৈষ্ণব বিশ্বনাথ এখানে ‘ভাব’ শব্দের বিশ্লেষণ গ্রহণ করেছেন বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্যদর্পণ থেকেই। তাঁরই উদাহরণ দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যৌবনোন্মেষে বয়ঃসন্ধির কালে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরান্বেষণ চলে সমানভাবে, এই সময়ে এমন মন্তব্য চলবে না যে, ছেলেদের যৌনান্বেষণা আগে হয়, মেয়েদের হয় পরে; কিংবা মেয়েদের আগে হয়, ছেলেদের পরে। এই সময়ে সমভাবেই একের ওপর অপরের আকর্ষণ তৈরী হবার কথা।

স্ত্রী-পুরুষের এই চিরন্তন হৃদয়ভাবের বাস্তবটুকু স্বীকার করে নিয়েই বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রূপগোস্বামীর মহদাশয় প্রকট করে বলছেন—যদিও দু-পক্ষের এই সমভাবই হবার কথা, তবুও স্ত্রীলোকের সমাজ-সম্ভাবিত লজ্জা,ভয়, ধীরতা এবং কুলাচারের আবরণ থাকায় হঠাৎ করেই তারা নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছের কথা,পুরুষানুরাগের কথাটা প্রকাশ করে উঠতে পারে না, অর্থাৎ তাদের পূর্বরাগের কথা তারা প্রকট করে তুলতে পারে না। কিন্তু পুরুষের তো এই দায় নেই। লজ্জা, ভয়, ধীরতা কিংবা কুলাচার-কোনোটাই তাদের নিজের অনুরাগ-খ্যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বলেই তারা নিজের ইচ্ছেমত এমনকী হঠাৎ করেই সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকের প্রতি তাদের অনুরাগ ব্যক্ত করতে পারে। আরম্ভ করতে পারে রমণীর হৃদয়ান্বেষণ —

প্রথম-বিক্রিয়ান্তরমেব স্ত্রী-পুংসযোর্যদ্যপি
পরস্পরান্বেষণং সম্ভবতি, তদপি (তথাপি)
স্ত্রিয়া লজ্জা-ভয়-ধৈর্য-কুলাচারাদিভিরাবৃত্তায়াঃ
সহসৈব পুংসি পূর্বরাগো ন প্রকটীভবতি।
পুংসস্ত্ত তৈরনাবরণাৎ সহসৈব প্রথমক্রিয়াক্ষণে
এব প্রায়শঃ স্ত্রীজনান্বেষণং স্যাদিতি যুক্তেঃ।

[Ujjwalanilamani, Ed, Pandit Durgaprasad and Wasudev Laxman Pansikar, 2nd, Ed, Bombay : Nirnay Sagar Press, 1932, pp. 511-512; See Anandachandrika Commentary of Vishvanatha Chakravarty]

এই কারণেই কৃষ্ণের পূর্বরাগ আগে বর্ণনীয় হওয়া উচিত ছিল বলে রূপগোস্বামীর মন্তব্যটা খুব বাস্তবোচিত, এটাই বলার চেষ্টা করেছেন বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।

তবু দেখ সেই কটাক্ষ/ আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য/ যেমনটা ঠিক দেখা যেত কালিদাসের কালে

রূপ গোস্বামীর পূর্বরাগের রসতত্ত্ব যে কতটা আধুনিক সেটা বিশ্বনাথ চক্রবর্তী তাঁর টীকায় পরিষ্কার বুঝিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক কালের তাত্ত্বিক-গবেষকদের মতামতটা জানিয়ে দেবার দায় আসে। আধুনিক গবেষকরা Alfred Kinsey এর বিখ্যাত গ্রন্থ Sexual behavior in the Human Female থেকে বিজ্ঞান সম্মত প্রমাণ উল্লেখ কর বলেছেন—We have already observed that the anatomy and physiology of sexual response and orgasm do not show differences between the sexes that might account for the differences in their sexual responses.

এখানে প্রশ্ন থেকে যায় একটাই – তাহলে মেয়েদের যৌনতার কুতূহল এবং প্রবৃত্তি অনেক কম প্রকট হয় কেন এবং কেনই বা তাঁদের আচার-আচরণ-ব্যবহারে পুরুষের মতো প্রকট হয়ে ওঠে না তাদের প্রবৃত্তি এবং যৌনতা? এর উত্তরে গবেষক পণ্ডিতেরা বলেছেন যে, পুরুষের মধ্যে প্রায় স্বভাবসিদ্ধ এবং সর্বগতভাবে বহুগামিতার প্রবৃত্তি আছে, সেটা কিন্তু মেয়েদের মধ্যে অনেকটাই কম – somewhat weaker polygamous tendency, হয়তো তার কারণও আছে—হাজার হাজার বছর ধরে মেয়েদের যে সামাজিক নির্মাণ ঘটেছে জীবনের সমস্ত পর্যায়ে, সেই সামাজিক নির্মাণই তাদের অন্তর্গত সাংস্কারিক চরিত্রটাকেই বদলে দিয়েছে যেন। নারী-পুরুষের যৌনতার বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাদের মধ্যে দুই বিখ্যাত পণ্ডিত Clellan S. Ford এবং Frank A. Beach প্রায় ১৮৫টি সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর (in 185 societies) নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহুগামিতার প্রবৃত্তি এবং কৌতূহল নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। তাতে তাঁরা এই তথ্য দিয়েছেন যে, বিশেষ বিশেষ সেই সব সমাজগোষ্ঠী যেখানে নারী-পুরুষের ব্যাপারে সামাজিক বিধিনিষেধের কোনো দ্বিচারিতা নেই এবং যে সমাজে মেয়েদের কিংবা ছেলেদের পরকীয়া প্রেমে এবং যৌনতাকেও কোনো বাধা দেওয়া হয় না, সেখানে মেয়েরাও কিন্তু পুরুষদের মতোই বহুগামিতায় কোনো দ্বিধা বোধ করে না, কিংবা নিশ্চেষ্ট থাকে না নূতন থেকে নূতনতর পুরুষের অনুসন্ধিৎসায়।

[Joel D. Block, The other Man- the other Woman, Los Angeles, Wellness Institute, 2000,pp. 59-60]

পাশ্চত্য পণ্ডিতকুলের এই অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুটা আমাদের প্রস্তুত বিষয় পূর্বরাগের অনুপূর্বিক চতুরতায় প্রয়োগ করতে চাই না। কিন্তু এটাই আমাদের প্রতিপাদ্য যে, মেয়েদের দিক থেকে আগে প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা কিংবা হৃদয়ানুমোদিত পুরুষের কাছে তাঁদের কামনার সশব্দ অভিব্যক্তি ঘটানোর ব্যাপারটাও তেমন কোনো আশ্চর্য তথা অভূতপূর্ব ব্যাপার হতে পারে না। কিন্তু ওই যে বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর লিখেছেন—মেয়েদের আত্মপ্রকটনের ক্ষেত্রে লজ্জা, ভয়, ধীরতা এবং কুলাচারের একটা আবরণ থাকে, যে কারণে অতিবিদগ্ধা রমণীদের পক্ষেও হঠাৎ করে এই ভাল লাগার ব্যাপারটা প্রকট করে তোলা সম্ভব হয় না—তদপি স্ত্রিয়া লজ্জা-ভয়-ধৈর্য-কুলাচারাদিভিরাবৃত্তায়াঃ সহসৈব পুংসি পূর্বরাগো ন প্রকটীভবতি।

বিশ্বনাথের এই সুচিন্তিত কথাটাই আজকের দিনের গবেষকেরা কী অসামান্য শব্দবন্ধে প্রতিধ্বনি করে বলছেন যে মেয়েদের এই অব্যক্ত অপ্রকটীকৃত ভাবটা আসলে শাশ্বতিক এক social conditioning যা হাজার হাজার বছরের অন্তর্গত সামাজিক প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে – culturally induced [তদেব]
প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে মেয়েদের মুখ ফুটে পূর্বরাগের বিষয়টা যে পুরুষের মতোই স্বাভাবিক এক প্রকরণ হয়ে উঠতে পারে, তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আছে ভাগবত পুরাণেই এবং সেটা রসশাস্ত্রকার তাত্ত্বিকদের অজানা থাকার কথা নয়। বিশেষত তাতে কবি-নাট্যকারদের বর্ণনীয়তা অধিক চমৎকারিণী হয়ে ওঠে, সেটা বুঝেই হয়তো রূপ গোস্বামী কিংবা বিশ্বনাথ চক্রবর্তীরা মেয়েদের পূর্বরাগের বিষয়টা আগে সাজাতে বলেছেন। এই আলোচনায় পুনরায় যাবার আগে আপনাদের ভাগবতী কথা শোনাতে চাই কৃষ্ণপ্রিয়া রুক্মিণীর নামে। এখানে পূর্বরাগের বিষয়টা একান্তভাবেই স্ত্রীলোকের পরিসর।

সেকালের দিনে বিদর্ভ দেশের বড়ো সুনাম ছিল। এই সুনাম শক্তি অথবা বলদর্পিতায় যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে। তখনকার দিনে যে বিস্তীর্ণ ভূমিকে আমরা দাক্ষিণাত্য বলি, সেই জায়গার আরম্ভই বিদর্ভকে দিয়ে। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে, নর্মদা নদী আর তাপ্তীর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নদীঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলটাই বোধহয় বিদর্ভ। চেদিরাজ্য থেকে এই বিদর্ভ যেমন খুব দূরে নয়, তেমনই মথুরা-দ্বারকা থেকেও এটা খুব দূরে নয়। সংস্কৃত ভাষা আর সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রীতিটাকেই যেহেতু বৈদর্ভী রীতি বলে, তাই এখানকার মানুষ-জনের ভাবভঙ্গি, আচার-ব্যবহার এবং মুখের ভাষা সারা ভারতবর্ষের মধ্যেই বিখ্যাত ছিল। বিশেষত এই দেশের রাজার ঘরের মেয়েদের কথা-বার্তা, বিদগ্ধতা এমন উচ্চপর্যায়ের ছিল যে, বৈদর্ভী রমণী বলতেই ভারতবর্ষীয় পুরুষদের মনে অন্য এক স্বপ্ন তৈরি হত।

জরাসন্ধ-কৃষ্ণ-শিশুপালের সময়ে এই বিদর্ভ দেশের রাজা ছিলেন ভীষ্মক। গবেষণার দৃষ্টি থেকে ভালো করে খুঁজলে প্রমাণ করা যায় যে, ভীষ্মকও মোটামুটি কৃষ্ণের জ্ঞাতি-গুষ্টির মধ্যেই পড়েন, কারণ তাঁরাও ভোজবংশীয়। এই ভীষ্মকের এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম রুক্মী, তিনি জরাসন্ধ-শিশুপালের গুণমুগ্ধ আর মেয়ে হলেন রুক্মিণী। যেমন তাঁর রূপ, তেমনই গুণ। রুক্মিণীর সমসাময়িক কালে তাঁর মতো সুন্দরী আর দ্বিতীয় ছিল কি না সন্দেহ—অনন্যা প্রমদা লোকের রূপেণ যশসা শ্রিয়া। যেমন ফরসা তাঁর গায়ের রং, তেমনই তাঁর দেহের সৌষ্ঠব। চেহারাটা লম্বা এবং ‘স্লিম’—বৃহতী চারুসর্বাঙ্গী তন্বী। স্থূলতা যদি কোথাও থেকে থাকে তবে সে শুধু স্তনে, জঘনে, নিতম্বে—পীনোরুজঘনস্তনী। চুল কালো এবং কোঁকড়ানো। নখ লাল। তীক্ষ্ণ, সাদা সমান এবং ঝকঝকে দাঁতের স্মিত হাসিতে রুক্মিণীকে মনে হয় স্বর্গের মায়াময়তা নেমে এসেছে ভুঁয়ে—মায়াং ভূমিগতামিব। যেন চাঁদের কিরণ জমাট বেঁধেছে রুক্মিণীর নারী-শরীরের আনাচে কানাচে।

সেকালের রাজা-রাজড়ারা এই বৈদর্ভী সুন্দরীর খবর রাখবেন না, এমনটা হতেই পারে না। বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ কিংবা অন্যান্য পুরাণগুলিতে রুক্মিণী বিয়ের ‘পলিটিকস্‌টা তেমনটি ঠিক ধরা নেই, যেমনটি আছে হরিবংশের বর্ণনায়। এখানে দেখছি—কৃষ্ণ তখন মথুরায়। জরাসন্ধের সঙ্গে তার আগেই বেশ কয়েকবার তাঁর ঝামেলা হয়ে গেছে। হঠাৎ মথুরায় কৃষ্ণের গুপ্তচরেরা—লোকপ্রাবৃত্তিকা নরাঃ—কৃষ্ণকে এসে খবর দিল—শুনে এলাম, বিদর্ভের কুণ্ডিনপুরে অনেক রাজা-রাজড়ার সমাগম হচ্ছে। ভীষ্মকের ছেলে রুক্মী নাকি দেশ-বিদেশের অনেক রাজাদের কাছে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়েছে। লোকেরা বলাবলি করছে—রুক্মীর বোন রুক্মিণীর স্বয়ংবর-সভার অনুষ্ঠান হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই। রাজারা সব সেখানে যাচ্ছেন সৈন্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে।

চরেরা সংবাদের মধ্যে ব্যঞ্জনা মাখিয়ে কৃষ্ণকে বলল—যে সব রাজারা তাঁদের নিজেদের শক্তি সমন্ধে সচেতন এবং এই মুহূর্তে রুক্মিণীকে পাওয়ার জন্য যাঁরা একে অন্যকে শত্রু ভেবে নিচ্ছেন –তাঁরা সবাই এখন সাভিলাষে চলেছেন কুণ্ডিনপুরে। শুধু আমরা, শুধু এই আমরা, যারা মথুরার এক টেরে পড়ে আছি, তারাই কি শুধু সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে এইখানেই পড়ে থাকব ‘নিরুৎসাহা ভবিষ্যামঃ কিমেকান্তচরা বয়ম’? কথাগুলি কৃষ্ণের উদ্দেশ্যেই । মৌখিক সংকেতটা তাঁর দিকেই। কিন্তু এই কথাগুলি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক, সেই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর মনেও একটা গূঢ় মনঃকষ্টের সঞ্চার হল, বার্তাবহ চরেরা সে প্রতিক্রিয়া দেখতে পেল না। এই স্বয়ংবরের আয়োজনের কথা শোনামাত্র তাঁর মনে হল—কে যেন তাঁর হৃদয়ে কাঁটা ফুটিয়ে দিল—হৃদি শল্যমিবার্পিতম্‌

এই কাঁটা কীসের তা আমাদের বুঝতে দেরি হয় না। কৃষ্ণ রুক্মিণীর রূপের কথা শুনেছেন, গুণের কথাও বাদ যায়নি; হয়তো বা মনে ছিল—এই বৈদর্ভী রমণী আমারই, একান্তই আমার। আসলে মথুরা-দ্বারকার এই বিদগ্ধ পুরুষ আর বিদর্ভনন্দিনী সেই স্বয়ংবরা রমণীটির মধ্যে নিঃসাড়ে এক অন্তর-প্রক্রিয়া চলছিলই। কেউ তার খবর জানত না। শুধু বিষ্ণুপুরাণ আর ভাগবতপুরাণের ব্যাস তাঁদের কাহিনির সূত্রপাতেই পাঠকদের আশ্বস্ত করে সংক্ষেপে বলেছিলাম—কৃষ্ণ চাইতেন—রুক্মিণী আমার হোক, আর রুক্মিণীও চাইতেন কৃষ্ণ আমার হোক—রুক্মিণীং চকমে কৃষ্ণঃ সা চ তং চারুহাসিনী

পারস্পরিক এই চাওয়া-চায়ির মধ্যে যেটা আসল সত্যি, তা হল- শুনে শুনে ভালোবাসা-আলংকারিকভাবে যাকে বলে শ্রবাণানুরাগ। কংসকে মেরে, মগধের অধিরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কৃষ্ণের মর্যাদা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল, যাতে করে বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণী তাঁর মধ্যে আপন মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে রুক্মিণীর অসামান্য রূপ আর সৌন্দর্যের কথা শুনে শুনে কৃষ্ণও তাঁর মধ্যে লজ্জাবস্ত্র –পরা এক মহিষীর রূপ দেখতে পেলেন। ফলত এই না-বলা-বাণীর অন্তরাল থেকে হঠাৎই যেদিন শোনা গেল—রুক্মিণী স্বয়ংবরা হবেন, রাজারা সব ছুটে আসছেন কুণ্ডিনপুরে, সেদিন কৃষ্ণের মনে কে যেন কাঁটা ফুটিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি যাদব-সৈন্যদের যুদ্ধসজ্জা করতে বললেন—তিনি বিদর্ভে যাবেন। ‘আমরা শুধু জানাতে চাই যে, উজ্জ্বলনীলমণির টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বয়ঃসন্ধির কালে যুবক-যুবতীর স্বাভাবিক পরস্পরান্বেষণের কথা বলেছিলেন, বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবত পুরাণ সেটা কিন্তু উল্লেখ করেছে তথাকথিত পূর্বরাগের রসতাত্ত্বিক প্রকরণ তৈরী হবার আগেই—একেবারে জীবনসিদ্ধ স্নায়বিক সরসতার আধারে। আমরা লক্ষণ বুঝে পরে এই সরসতার নাম দিয়েছি পূর্বরাগ এবং এই স্বভাবজাত প্রবৃত্তির মধ্যে কীভাবে এমন একটা চিহ্ন তৈরী করা যায় যে, এটা পুরুষের আগে হবে অথবা মেয়েদের আগে হবে ! অন্তত রুক্মিণীর ব্যাপারে আমাদের এটাই বলতে হবে যে, এই পরস্পরানুরাগের সাধারণ খবরের পর রুক্মিণীর প্রাগ্রসর ভূমিকাটা কৃষ্ণের চিরকালীন ভাবমূর্তিটাকেও ধূসর করে দেয়।

কৃষ্ণ বিদর্ভে এলেন এবং এসে দেখলেন—জরাসন্ধ ইত্যাদি বড়ো বড়ো রাজারা আগেই এসে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হল, জরাসন্ধরা কিন্তু এই সময়ে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারটা পছন্দ করছিলেন না। তার কারণও আছে। জরাসন্ধের সঙ্গে কৃষ্ণের অনেক যুদ্ধের মধ্যে একেবারে শেষেরটায় কৃষ্ণের জয় হয়েছিল। হয়তো এরই জেরে জরাসন্ধ আপাতত একটা লোকদেখানো স্তুতিবাদ করলেন কৃষ্ণের, কিন্তু অন্য দিকে তাঁকে সাজা দেওয়ার জন্যকাজে লাগালেন অন্য এক শক্তিশালী শক্তিকে। হরিবংশে যেমনটি দেখেছি, তাতে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, একদিকে কৃষ্ণ এবং অন্যদিকে জরাসন্ধের মতো বিখ্যাত রাজার মাঝখানে পড়ে রুক্মিণীর অবস্থা হয়েছিল অনেকটা দুই সিংহের মাঝখানে দাঁড়ানো হরিণের মতো। হয়তো এই কারণেই রুক্মিণীর স্বয়ংবরসভা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে হয়।

অবশ্য বেশিদিন এইভাবে স্বয়ংবর-সভা চেপে রাখা গেল না। জরাসন্ধ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অন্যান্য নরপতিদের লাগিয়ে দেওয়ায় কৃষ্ণ যেমন অন্যত্র যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত রইলেন, তেমনই আরেক দিকের খবর হল—জরাসন্ধ এবং বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণী দুজনেই নিজের নিজের মতো করে একটু সময় পেয়ে গেলেন। এই সময়ের সদ্-ব্যবহার জরাসন্ধ করলেন একভাবে, রুক্মিণী করলেন আরেকভাবে। অবশ্য কৃষ্ণ যে কিছুই সদ্‌ব্যবহার করলেন না, তা নয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি দ্বারকায় নিজের বাড়ি-ঘর সব তৈরি করে ফেললেন। মথুরায় বারংবার জরাসন্ধের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তিনি তাঁর সাময়িক স্তুতিতে ভুলে যাবেন, এমন মানুষ তিনি নন। তিনি নিজেকে এবং নিজের পরিজনকে সুরক্ষিত করে তারপরে আবার‍ও মন দিলেন বিদর্ভনন্দিনীর দিকে। তিনি এখনও কৃষ্ণের ঘরে অসেননি বটে, কিন্তু মনে তাঁর নিত্য আসা-যাওয়া।

সময় পেয়ে জরাসন্ধ ঠিক করলেন তাঁর বংশবদ শিশুপালের বিয়ে দেবেন, সুন্দরী-শ্রেষ্ঠা রুক্মিণীর সঙ্গে। আমি আগেই বলেছি—তিনি চাইবেন কেন, তিনি ইচ্ছে করবেন। তিনি ইচ্ছে করেছেন, এখন সেই ইচ্ছে যাতে কোনওভাবেই বানচাল না হয়ে যায়, এবং যাতে শিশুপালের মনে কোনও কষ্ট না থাকে, তাই সমস্ত রাজাদের এক জায়গায় জড়ো করার কথা ভাবলেন জরাসন্ধ—নৃপান্ উদ্‌যোয়জয়ামাস চেদিরাজপ্রিয়েপ্সয়া। যে সব রাজাদের সঙ্গে কৃষ্ণের শত্রুতা আছে তাঁদের সবাইকে বেছে বেছে এক জায়গায় নিয়ে জরাসন্ধ শিশুপালের বরযাত্রী নিয়ে গেলেন বিদর্ভনগরে। জরাসন্ধের সবচেয়ে বড়ো সুবিধে রুক্মী ভীষ্মকের শক্তিমান পুত্র, রুক্মিণীর দাদা—স্বয়ং জরাসন্ধের পক্ষে। কংস মারা যাওয়ার পর রুক্মীর কৃষ্ণ-দ্বেষ আরও বেড়েছে। তিনি জানেন যে, তাঁর বোন রুক্মিণী কৃষ্ণকে ভালোবাসে, তিনি এও জানেন যে, কৃষ্ণও রুক্মিণীকে পেতে চান। কিন্তু মনে মনে তিনি ঠিকই করে রেখেছেন যে, কোনভাবেই তিনি কৃষ্ণের হাতে নিজের বোনকে দেবেন না—তাং দদৌ ন চ কৃষ্ণায় দ্বেষাদ্‌ রুক্মী মহাবলঃ।

এরই মধ্যে জরাসন্ধ তাঁর রাজসাজ নিয়ে এসে গেলেন বিদর্ভে এবং বরকর্তা হিসেবে শিশুপালের জন্য মেয়ে চাইলেন ভীষ্মকের কাছ থেকে। ভীষ্মককে উপায়ন্তর না দেখে রুক্মিণীকে বাগদান পর্যন্ত করে দিলেন শিশুপালের কাছে। অন্যদিকে রুক্মিণীর ভাই রুক্মী জরাসন্ধের খাতির-যত্নে নিজেকে সঁপে দিলেন আগে থেকেই। সময় আর বেশি নেই। রুক্মিণী বুঝলেন, তাঁর ভালোবাসা, তার প্রেম—কোনও কিছুরই মূল্য তিনি পাবেন না। পিতা ভয়ার্ত এবং ভাই জরাসন্ধের বংশবদ। কাজেই সময় আর নেই। পাকাপাকি এবং আনুষ্ঠানিক বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। আগামী কাল বা পরশুই সেই বিয়ে।

এই অবস্থায় হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণ খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলে দিয়েছেন—মহামতি কৃষ্ণ বিয়ের আগের দিনই রুক্মিণীকে হরণ করে নিলেন—শ্বোভাবিনি বিবাহে তু তাং কন্যাং হৃতবান হরিঃ। এই সংক্ষিপ্তসার এমনিতে ঠিকই অছে, কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। অন্য এক অচেনা-দেশে গিয়ে—মেয়ে কখন কোথায় থাকবে জানা নেই—এই অবস্থায় কন্যাহরণ অত সহজ নয়। কিন্তু কৃষ্ণের পক্ষে ব্যাপারটা কেমন সহজ হয়ে গেল, সেটা অত্যন্ত রোমাঞ্চকরভাব জানিয়েছে ভাগবতপুরাণ। শত সংক্ষিপ্ততার মধ্যেও এই পুরাণটি জানিয়েছে কীভাবে রুক্মিণীকে রথে চাপিয়ে হরণ করে নিয়ে যাওয়ার সুয়োগ পেলেন কৃষ্ণ।

ভাগবতে দেখছি—যে মুহূর্তে রুক্মিণীর সহোদর রুক্মী ঠিক করলেন যে, বোনকে তিনি শিশুপালের হাতেই তুলে দেবেন, সেই দিনই রুক্মিণী বিদর্ভের এক বিশ্বস্ত ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর হাতে বিদর্ভের রাজনন্দিনীর মোহর আঁটা একটা চিঠি দিয়ে রুক্মিণী তাঁকে কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন দ্বারকায়। ব্রাহ্মণ-দূত খুব তাড়াতাড়ি খবর নিয়ে আসবেন রুক্মিণীর কাছে, জানাবেন কৃষ্ণের প্রতিক্রিয়া।

দ্বারকায় সোনার আসনে বলে ছিলেন কৃষ্ণ। ব্রাহ্মণকে দেখে আসন থেকে নেমে তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করতেই তিনি সমস্ত বিবরণ দিয়ে রুক্মিণীর পত্র দিলেন কৃষ্ণের হাতে। কৃষ্ণ একান্তে চিঠি খুললেন। রুক্মিণী লিখেছেন –

তিন ভুবনের সেরা সুন্দর আমার !
লোকের মুখে হৃদয়ের জ্বালা-জুড়োনো তোমার কথা অনেক, অনেকবার শুনেছি। তোমাকে একবার দেখলে পরে লোকের নাকি সব পাওয়ার অনুভূতি হয়। তোমার এত গুণ আর এত সৌন্দর্যের কথা বারবার শুনে আমার মনের সব লজ্জাই যেন ঘুচে গেল। নির্লজ্জের মতো আমার মন কেমন যেন তোমারই স্বপ্ন দেখতে শুরু করল—ত্বয়ি অচ্যুতাবিশতি চিত্তম্ অপত্রপং মে

বিয়ে হয়নি এমন একটা মেয়ে এই সব কথা বলছে দেখে তুমি যেন আবার আমাকে সত্যিই নির্লজ্জ ভেবে বোসো না। আমি বড়ো ঘরের মেয়ে; রূপ বলো, বিদ্যা বলো, ব্যক্তিত্ব বলো, এমনকী টাকা-পয়সার কথাও বলতে পারো, কোনওটাই আমার কম নেই। এখন তুমিই বলো, কোন মেয়ে তার রূপ, বয়স অথবা বিদ্যা এবং আভিজাত্যে সমান একটা স্বামী না চায়—বিদ্যাবয়োদ্রবিণধামভিরাত্মতুল্যম্ ? এই নিরিখে আমার বিয়ের সময় তোমাকেই আমি পেতে চাই।

আমি মনে মনে তোমাকে আমার স্বামীর আসন দিয়েছি। এখন যা করবার তুমি করবে। এমনটি যেন আবার না হয় যাতে সিংহের খাবার শেয়ালে খেয়ে যায়। যা নিতান্তই তোমারই প্রাপ্য তাকে কি শিশুপালের মতো শেয়ালে নিয়ে যাবে তুলে ?
মনে রেখো, সামনেই আমার বিয়ে। সময় বেশি নেই। এ দেশের নিয়ম আছে, বিয়ে করতে হলে মেয়ের বাবাকেই পণ দেয় বিবাহার্থী পুরুষ। তুমি এখানে এসে শিশুপাল-জরাসন্ধের বাহিনীকে হারিয়ে দাও আর সেই শক্তিমত্তার পণ দিয়ে আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাও রাক্ষসের মতো। যদি বলো, আমার আত্মীয়-স্বজনকে না মেরে কেমন করে এই অন্তঃপুরচারিণীকে নিয়ে যাবে, তাহলে তার উপায় বলি শোনো। আমাদের রাজবাড়ির নিয়ম আছে—বিয়ের আগের দিন নগরের বাইরে যে ভবানী-মন্দির আছে, সেইখানে পুজো দিতে যায় বিয়ের কনে। সঙ্গে দু-চারজন বান্ধবী ছাড়া কেউ থাকে না। অতএব সেইখান থেকেই… কী বলো ? আর তুমি যদি না আসো, তাহলে তোমাকে অন্তত শত-জন্মে পাওয়ার আশায় শুকিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমায়। শতজন্মেও তো পাব – জহ্যামসূন্ ব্রতকৃশান্ শতজন্মভিঃ স্যাৎ।

চিঠির তলায় রুক্মিণীর নাম নেই। কে জানে, কেউ যদি রাস্তায় সরল ব্রাহ্মণকে প্রতারণা করে চিঠি কেড়ে নেয় ! রুক্মিণীর চিঠি পড়া হয়ে গেলেই ব্রাহ্মণ তাই কৃষ্ণকে বললেন—এই হল গোপন সংবাদ যা চিঠির মধ্যে লেখা আছে – ইত্যেতে গুহ্যসন্দেশঃ – এবং এটাই আমি বয়ে এনেছি এতদূর। সব বুঝে এখন আপনার যা করার করুন—বিমৃশ্য কর্তুং যচ্চাত্র ক্রিয়তাং তদনন্তরম্

সেই কত হাজার বছর আগে দূরদেশিনী এক প্রেমিকার কাছে এমন আধুনিক একটা প্রেমপত্র পেয়ে নায়ক-স্বভাব কৃষ্ণের মনে কী হয়েছিল, তা আমরা আন্দাজ করতে পারি। বার্তাবহ ব্রাহ্মণের হাত ধরে কৃষ্ণ বললেন—আমিও তাঁর কথাই ভাবছি নিশিদিন। তাঁর অবস্থা ভেবে রাত্রে আমার ঘুম হয় না। আমি জানি—আমার ওপর রাগে রুক্মী আমার সঙ্গে তাঁর মিলন রুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু তা হবে না, বিবাহার্থী রাজাদের বিদলিত করে রুক্মিণীকে হরণ করে নিয়ে আসব আমি। খবর নিয়ে ব্রাহ্মণ চলল বিদর্ভে। আসলে কৃষ্ণই নিয়ে চললেন ব্রাহ্মণকে। দারুকের রথে চড়ে এক রাতের মধ্যে কৃষ্ণ চলে এলেন বিদর্ভে।

এই কাহিনীর অন্তে যাবার প্রয়োজন নেই আমাদের, কিন্তু পূর্বরাগের প্রকরণে মেয়েরাও যে কতটা সাহসীভাবে অগ্রসর ভূমিকা গ্রহণ করে ফেলতে পারে, তার একটা রাজকীয় উদাহরণ দেখালাম আমরা। সেইকালে এক রমণী বলছে—আমাকে রাক্ষসদের নিয়মে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করো—মাং রাক্ষসেন বিধিনোদ্‌বহ বীর্যশুল্কাম্‌ । পূর্বরাগের ক্ষেত্রে মেয়েদের এই অগ্রণী ভূমিকাটুকু কিন্তু সেই বিখ্যাত তত্ত্বও কিন্তু নস্যাৎ করে দেয় যে, হাজার হাজার বছরের সামাজিক নিযন্ত্রণ মেয়েদের অন্তর্গত কামনাকে অদ্ভুত এক সাংস্কৃতিক আবরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে। কিন্তু রসতাত্ত্বিক পাণ্ডিতেরা –সেটা ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথ কবিরাজই হোন অথবা রূপ গোস্বামী-বিশ্বনাথ চক্রবর্তীরাই হোন—তাঁর কিন্তু বলবেন যে, ওই সাংস্কৃতিক আবরণের মধ্যে রমণীর লজ্জা, ভয়, ধৈর্য, কুলাচার এবং বামতাই কিন্তু পূর্বরাগের চারুতা সমধিক বাড়িয়ে তোলে, আরও বাড়িয়ে তোলে কবিগত বর্ণনার চারুতা।

পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি আপন অন্তর হতে

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী আনন্দচন্দ্রিকা টীকায় রূপগোস্বামীর হৃদয় ব্যক্ত করে এই কথাটাই লিখেছেন এবং আধুনিক যৌনতত্ত্ববিদেরা যেহেতু নারী-পুরুষের কামনার বিষয়টা সমান স্বতোৎসারিতার নিরিখেই বিচার করেছেন, তাই বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সিদ্ধান্তে আমরা পুরুষতান্ত্রিকতার গন্ধ পাই না। তিনি লিখছেন – মৃগাক্ষী ব্রজরমণীদের পূর্বরাগ যদি আগে বর্ণিত হয়, তাহলে সে বর্ণনা অনেক বেশী রাসগ্রাহী হবে রসিক ভাবুক সহৃদয়ের কাছে। বিশ্বনাথ চক্রবর্তী মনে করেন – প্রেম জিনিসটা স্ত্রীলোকের অন্তর্গত হলে তার প্রকাশের আধিক্য ঘটে, সেখানে সেটা বর্ণনা করার মধ্যেও আধিক্য আসবে স্বাভাবিক ভাবেই ।

এই আধিক্য আসে, তার কারণ হল—যুবতীর প্রেমাধিক্য লজ্জাভয় ইত্যাদির মাধ্যমে যত সংবৃত করার চেষ্টা হবে, ততই সেটা অখিল কবিকুলের বর্ণনার আধার হয়ে উঠবে—মেয়েদের পূর্বরাগ বর্ণনার চারুতা সেখানে সমাধিক—

তদপি মৃগাক্ষীণাং রাগে পূর্বরাগে আদৌ
প্রোক্তে বর্ণিতে চারুতেধিকেতি প্রেম্নঃ
স্ত্রীগতত্বেনাধিক্যেন বর্ণনৌচিত্যত্বাৎ
প্রেমাধিকাস্য চ লজ্জাদি-সংহারকত্বাদিতি ভাবঃ।

[উ. নী. তদেব পৃ ৫১২]

ঐতিহ্যবাহী রসশাস্ত্রীয় পরম্পরার সঙ্গে রূপ গোস্বামীর রসশাস্ত্রীয় বাস্তববোধ মিলিয়ে দেবার পর বিশ্বনাথ শেষ যুক্তি হিসেবে ভক্তিরসের কথা টেনে এনেছেন। বলেছেন—তার মধ্যে এটা হল ভক্তিশাস্ত্র। যেখানে ভক্তিটাই রস হয়ে ওঠে, সেখানে সেই ভক্তিরস কিন্তু ভক্তকেই আশ্রয় করে। আর ভগবান যেহেতু ভক্তের অনুরাগ দেখেই তবে ভক্তপরবশতায় ভক্তাধীন হয়ে পড়েন, সেই ভক্তিরসের যুক্তিতেও এই ব্রজরমণীদের পূর্বরাগের প্রসঙ্গ আগে আসবে। কেননা ব্রজরমণীরা কিন্তু শেষ জায়গায় ভক্ত-শব্দের অর্থনিরুক্তির চরম রস-চারুতার মধ্যেই অবস্থান করেন। প্রিয়তম কৃষ্ণ কীসে সবেচয়ে খুশী হবেন,এই ‘কৃষ্ণসুখৈক-তাৎপর্যময়ী সেবা’-ই যেখানে রাগনুগা ভক্তির নিদান, সেখানে রাগানুগা ভক্তির চরণ অধিষ্ঠান ব্রজরমণীদের পূর্বরাগই আগে বর্ণনা করা ঠিক হবে বলে কোনো কোনো রসিক মনে করেন—

কিঞ্চাত্র পুনর্ভক্তিশাস্ত্রে ভক্তেরেব রসত্বাৎ তস্য
চ ভক্তাশ্রয়ত্বাত্ তাসামেব প্রথমং পূর্বরাগ উচিত ইতি কোচিদাহুঃ।

[উ.নী., তদেব পৃ. ৫১২]

রূপ গোস্বামী এবং বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর মতের সম্পূর্ণ পর্যালোচনা করে অবশেষে এটাই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, পূর্বরাগের বিষয়ে এই যে সাধারণ স্বীকারোক্তি—প্রথমে কৃষ্ণেরই পূর্বরাগের কথা বলা উচিত ছিল —অপি মাধবরাগস্য প্রাথম্যে সম্ভবত্যপি –
এখানে নরলীল কৃষ্ণের পরম ঈশ্বরতার কারণে অথবা নরলীলার ক্ষেত্রেও তাঁর সর্বাতিশায়ী মাধুর্যের কারণেও তাঁর কথা আগে বলা উচিত ছিল—এমন ভাবনা রূপ গোস্বামী ভাবেননি বলেই মনে হয়। বরঞ্চ প্রেম-ভালবাসার ক্ষেত্রে পুরুষের লজ্জাহীন প্রকট পদচারণাই যে শাশ্বতিক সত্য, সেটাই এখানে কৃষ্ণের উপলক্ষণে বলা হয়েছে। এই সরল সত্য স্বীকারের মধ্যে সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজের প্রভুসম্মিত আদেশবাক্য নেই। নেই এমন পৌরুষেয় আনুশাসন যে, মেয়েদের পূর্বরাগ আগে দেখাতে হবে এবং মেয়েদের পূর্বরাগের ইঙ্গিত পেলে তবে পুরুষের অনুরাগ দেখাবে –
আদৌ রাগঃ স্ত্রিয়ো বাচ্যঃ পশ্চাৎ পুংসস্তদিঙ্গিতৈঃ

আমাদের আশ্চর্য লাগে সাহিত্যদর্পণকারের এই পৌরুষেয় আদেশ অথচ তাঁর সামনে সবেচয়ে বড়ো উদাহরণ ছিল অভিজ্ঞান-শকুন্তলের মতো কালীদাসের নাটক। প্রথমত নির্জন অরণ্যে তিনটি যুবতী মেয়ে দেখামাত্রই নায়ক দুষ্মন্তের মনের এই উল্লাস-আহা ! কী সুন্দর দেখতে এদের—অহো মধুরমাসাং দর্শনম্‌ –পৌরুষেয় যৌনতার এই মানসিক বিস্ফোরণের পরেই শকুন্তলার শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে নাগরক পুরুষ দুষ্যন্তের মনের মধ্যে অনুরাগ প্রায় আলোড়নের রূপ নিয়েছে—এই সহজ পৌরুষেয় প্রবৃত্তিকে কালিদাস সমস্ত পূর্বরাগের চিরন্তন তথা প্রথম সত্যের মতো উচ্চারণ করেছেন এবং আমরা বলবো—পৌরুষেয় প্রবৃত্তির এই প্রথমতার নিরিখেই রূপ গোস্বামী সে সত্যকে ‘অখিলরসামৃতমূর্তি’ কৃষ্ণের আবরণে প্রকাশ করে দিয়েছেন ‘মাধবরাগে’র প্রথমতা উল্লেখ করে।

সাহিত্যদর্পণকার অবশ্য সামান্য শুধরে নিয়েছেন নিজেকে এবং তা এই কথা বলেই যে, আগে পুরুষের পূর্বরাগের কথা কবিৃ-নাট্যকারেরা বর্ণনা করতেই পারেন, কিন্তু মেয়েদের বর্ণনা আগে করলে সেটা বেশী হৃদয়গ্রাহী হয়। একটা পৌরুষেয় আদেশ শোনানোর পর সাহিত্যদর্পণকার যখন সুর পালটে শুধু বর্ণনীয়ার খাতিরে মেয়েদের পূর্বরাগের কথা আগে বলতে পরামর্শ দেন, তাহলে রূপ গোস্বামী-বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সহ আমরা সকলেই সেটা কাব্যিক সৃষ্টির স্বার্থে মেনে নিতে পারি।

লোলাপাথৈর্যৈদি ন রমসে লোচনৈর্বষ্ণিতোসি

আসলে কাব্য-নাটকের স্বার্থে মেয়েদের পূর্বরাগ দেখানোর ব্যাপারটা যে, কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং রসগ্রাহী হতে পারে, সেটা সবচেয়ে বোঝা যায় যারা কাব্য-নাটকের প্রায়োগিক ব্যাপারগুলি অনুধাবন করেন। আপনাদের খেয়াল থাকবে—১৮৭৩ সালে ১৬ই আগস্ট সেই চিত্রিত দিনটির কথা। ৯ নম্বর বিডন স্ট্রিটে মাইকেল মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটকে অভিনয় করার জন্য বারাঙ্গনাদের অভিনেত্রী হিসেবে গ্রহণ করা হল। তার আগে তো পুরুষরাই মেয়ে সেজে নাটকের মহিলা-চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু মাইকেলের শর্মিষ্ঠা নাটকে অভিনয় করার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ সেই প্রথম চার জন বারাঙ্গণাকে নিযুক্ত করলেন—যাঁদের নাম শ্যামা, গোলাপ, এলোকেশী এবং জগত্তারিণী। গোলাপ যদিও পরবর্তীকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা, কিন্তু শর্মিষ্ঠা নাটকে দেবযানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এলোকেশী এবং শর্মিষ্ঠার সখী দেবিকার ভূমিকায় অভিনয় করেন জগত্তারিণী।

এই নাটকে বারাঙ্গনাদের অভিনয়ে নিযুক্ত করা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু নাটকের প্রয়োজনে বারাঙ্গনাদের হাব-ভাব, হাস্য-লাস্য দর্শকদের কাছে অনেক বেশী রসগ্রাহী হওয়ায় যাঁরা সমালোচনা করছিলেন, তাঁরা সমালোচনার মধ্যে নেতিবাচকভাবে বারাঙ্গনাদের প্রয়োজনটাকেও স্বীকার করে ফেলছিলেন।

১৯৩৫ সালে নবীনচন্দ্র বসুর শ্যামবাজারের বাড়িতে যে বিদ্যাসুন্দর অভিনীত হয়েছিল সেখানে পুরুষের পরিবর্তে স্ত্রীলোকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রাধামণি অথবা মণি নামে একটি ষোল বছর বয়সের হিন্দু মেয়ে। এই নাটকটির সমালোচনা করার সময় হিন্দু পায়োনিয়ার পত্রিকা লিখেছে –

গত পূর্ণিমা দিবস [৬ অক্টোবর] সন্ধ্যায় আমাদের একটি নাট্যাভিনয় দেখিবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। এই অভিনয় দেখিয়া আমরা অত্যন্ত আনন্দলাভ করিয়াছি, তাহা আমরা সর্ব্বান্তঃকরণে স্বীকার করি। অভিনয়কালে বাড়িতে এক হাজারের উপর হিন্দু, মুসলমান, কয়েকজন ইউরোপীয় ও অন্যান্য নানাজাতীয় দর্শকের ভিড় হইয়াছিল। ইহাদের সকলেই অভিনয় দেখিয়া সমভাবে আনন্দিত হইয়াছেন। রাত্রি বারোটার কিছু পূর্ব্বে অভিনয় আরম্ভ হয় এবং পরদিন ভোর সাড়ে ছয়টায় শেষ হয়। হিন্দু পায়োনিয়ার পত্রিকার সাংবাদিক এই নাটকের নায়ক থেকে আরম্ভ করে আর কোনো কিছুরই প্রশংসা করেননি এবং তাঁর মন্তব্যের নিরিখে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ভূয়োদর্শী গবেষকও লিখেছেন—‘এই লেখকের নিকট বাঙালী স্ত্রীলোকদের দ্বারা স্ত্রী-চরিত্র অভিনয়ই যে সর্বাপেক্ষা ভাল লাগিয়াছিল, তাহা তাঁহার লেখার ভঙ্গী হইতেই বোঝা যায়।’ এই নাটকে স্ত্রীলোকের অভিনয়ের বৈশিষ্ট্য যেগুলি হিন্দু পায়োনিয়ার-এর লেখক বলেছেন, তা এইরকম— এই নাটকে বিশেষ করিয়া স্ত্রী-চরিত্রের অভিনয় খুব চমৎকার হইয়াছিল। রাজা বীরসিংহের কন্যা ও সুন্দরের প্রণয়িনী বিদ্যার ভূমিকা রাধামণি বা মণি নামে একটি বৎসর ষোল বয়সের বালিকা অভিনয় করিয়াছিল। সে আগাগোড়া খুব নৈপুণ্য দেখাইয়াছিল। তাহার সুললিত অঙ্গভঙ্গী, মধুর কণ্ঠস্বর, সুন্দরের প্রতি প্রণয়সূচক হাবভাব দর্শকমণ্ডলীকে অতিশয় মুগ্ধ করিয়াছিল। অভিনয়কালে সে একবারও নৈপুণ্যের অভাব দেখায় নাই। আনন্দে ও দুঃখে মুখের ভাবের পরিবর্তন, প্রণয়ীকে বাঁধিয়া পিতার সম্মুখে লইয়া যাওয়া হইয়াছে শুনিয়া তাহার করুণ উক্তি ও ভাবব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গী, তাহার নিজের এবং নাট্যশালার উভয়ের পক্ষেই অত্যন্ত প্রশংসার বিষয়। সুন্দরের বধের আদেশ হইয়াছে। এই সংবাদ শুনিবার পর তাহার সখীরা তাহাকে প্রবোধ দিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু সে ভূমিতে পতিত হইয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িল। সখীদের যত্নে একবার জ্ঞানলাভ করিয়া আবার সে মূর্ছিত হইয়া পড়িল এবং কিছুক্ষণের জন্য দর্শকমণ্ডলী সভয়ে নীরব হইয়া রহিল। রাধামণির মত অশিক্ষিত এবং মাতৃভাষার সূক্ষ্ণ অর্থ সম্বন্ধে অজ্ঞ একটি বালিকা যে এরূপ কঠিন একটি অংশ এরূপ কৃতিত্বের সহিত অভিনয় করিতে পারিবে এবং সকলকে তৃপ্ত করিয়া ঘন ঘন করতালি লাভ করিতে পারিবে, তাহা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। অন্যান্য স্ত্রী-চরিত্রের অভিনয়ও খুব উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে রাণীর ও মালিনীর অভিনয়ের উল্লেখ না করা অন্যায় হইবে। জয়দুর্গা নামে একটি প্রৌঢ়া রমণী এই দুইটি ভূমিকাই গ্রহণ করিয়া উভয় অংশেই সমান কৃতিত্ব দেখাইয়াছিল। সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে তাহার অভিনয় লক্ষ্য করিবার মত হইয়াছিল। সে সঙ্গীত দ্বারা শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করিয়াছিল। রাজকুমারী বা রাজু নামে আর একটি স্ত্রীলোকও বিদ্যার সখীর ভূমিকা গ্রহণ করিয়া জয়দুর্গার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ না হইলেও সমান কৃতিত্ব দেখাইয়াছিল।

[ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস (১৭৯৫- ১৮৭৫), কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দির, ১৩৪৬ সাল( খ্রিষ্টাব্দ ১৯৩৯)। পৃ-১৪-১৫]

আমাদের প্রস্তাবিত গবেষণায় পায়োনিয়ার লেখকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল—‘তাহার সুললিত অঙ্গভঙ্গী, মধুর কণ্ঠস্বর, সুন্দরের প্রতি প্রণয়সূচক হাবভাব দর্শক মণ্ডলীকে অতিশয় মুগ্ধ করিয়াছিল।’ আমরা বলতে চাই—নাট্যভিনয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের ভূমিকায় স্ত্রীলোকেরই প্রয়োজন শুধু নয়—তার ‘সুললিত অঙ্গভঙ্গী, মধুর কণ্ঠস্বর’ এবং প্রণয়সূচক হাব-ভাব’ নাটক দর্শককুলের মুগ্ধতা তৈরী করে বলেই কাব্য-নাট্যে স্ত্রীলোকের ভূমিকা অধিকতর রসগ্রাহী এবং রসগ্রাহী বলেই হৃদয়গ্রাহী। তাহলে এটা বোঝা যায় যে, পূর্বরাগের আখ্যাপনেও কাব্য-শ্রোতা এবং নাট্যদর্শকের প্রয়োজনেই সাহিত্যদর্পণকার মেয়েদের পূর্বরাগ প্রদর্শন করাটাকে বেশী ‘হৃদয়ঙ্গম’ বলছেন আর রূপ গোস্বামী বলছেন—‘চারুতাধিকা’।

আসলে বিশ্বজনীন সমস্ত রসভাবনাতেই সমানভাবে যে-কথাটা স্বীকৃত হয়েছে, তা হল– নাটক তো কবি-সাহিত্যিক-সামাজিক কারও একার কোনও বিষয় নয়। নাট্যশাস্ত্রের টীকাকার অভিনবগুপ্ত তাণর অসামান্য টীকা অভিনবভারতীর মধ্যে এই মুহূর্তেই মন্তব্য করেছেন যে, নাটকীয় রস-ভাবের ভাবনা বস্তুটা হল এক পরম ব্যাপ্তির ভাবনা, এটা কবি-নাট্যকার, নট এবং সামাজিক দর্শকের হৃদয়-ব্যাপ্ত ভাবনা—রসানাং ভাবো ভাবনা কবি-নট-সামাজিক-হৃদয়ব্যাপ্তিঃ। দর্শক-শ্রোতার হৃদয় সংবাদের মধ্যেই যেহেতু নাট্য-কাব্যের সার্থকতা চরম হয়ে ওঠে, তাই দর্শক-শ্রোতার হৃদয় সংবাদের প্রয়োজনেই রসশাস্ত্রকারদের নির্দেশও পূর্বরাগের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের প্রাধান্য এবং প্রাথম্য দুটোই পুরুষানুরাগের পূর্ববর্তী হয়ে ওঠে।

সামাজিক সহৃদয় দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ব্যাপ্তির জন্য যেখানে কাব্য-নাটকের লেখককেই মেয়েদের আগে বর্ণনীয় করে তুলতে হয়, সেখানে অভিনয়ের জন্য মেয়েদের যে আগে প্রয়োজন, সেটা বলাই বাহুল্য। আর ওই যে হিন্দু পায়োনিয়ারের লেখক বলেছিলেন ‘সুললিত অঙ্গভঙ্গী, মধুর কণ্ঠস্বর এবং প্রণয়সূচক হাব-ভাব’, এগুলি এক কুলবতী রমণীর ‘নয়ানে-বয়ানে’ যত অভিব্যক্ত হয়, তার চাইতে বেশী অভিব্যক্ত হয় বারাঙ্গনার চোখে মুখে।

[Natyasastra of Bharatmuni, Ed. Ramakrishna Kavi, vol. I, 2nd ed. Baroda : Oriental Institute, 1995, 1.44, p. 22]

সেইজন্যই বেঙ্গল থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ দুই বারাঙ্গানাকে শর্মিষ্ঠা নাটকে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। বিশেষত সেই ১৯৩৫এ রাধামণি দেবীর পর গৃহস্থ ঘরের মেয়েরা কিন্তু তখনও তেমন করে অভিনয়ে প্রবেশ করেননি, আর যদি বা তাঁদের কেউ কেউ দর্শকদের সামনে অভিনয় করেও থাকেন, তাহলেও সেই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতায় তাঁদের মুখে-চোখে সেই হাব-ভাব যে সুষ্ঠু প্রকট হয়ে উঠত না, তা খুব ভাল বোঝা যায় শর্মিষ্ঠা নাটকে দুই বারাঙ্গনার সফল অভিনয়ের জন্য সংরক্ষণশীল সাংবাদিকের গালাগালি থেকে। ‘মধ্যস্থ’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন বসু শর্মিষ্ঠা নাটকে দুই বারাঙ্গনার অভিনয় প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দর্শকদের নাটক ভাল লাগাটা গিলতেও পারছেন না উপরোতেও পারছেন না। তিনি লিখছেন—

বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনয়। অথবা বিলাতী ধরণের মেয়ে যাত্রা।…বিলাতে রঙ্গভূমিতে স্ত্রীর প্রকৃতি স্ত্রীর দ্বারাই প্রদর্শিত হয়। বঙ্গদেশে দাড়ি গোঁপধারী (হাজার কামাক) জ্যেঠা ছেলেরা মেয়ে সাজিয়া কর্কশ স্বরে সুমধুর বামা-স্বরের কার্য্য করিতেছে। ইহা কি তাঁহাদের ন্যায় সমাজ-সংস্কারক সম্প্রদায়ের সহ্য হয় ? ইহার প্রতিবিধান আশু কর্ত্তব্য হইল। প্রতিবিধান আর কি, সত্যকার স্ত্রী লইয়া অভিনয় ! রব উঠিল ‘অভিনয় স্বভাবের প্রতিরূপ, পুরুষ দ্বারা পুরুষ ও প্রকৃতির প্রকৃতি প্রদর্শন স্বভাবের প্রতিরূপ না হইয়া স্বভাবের হত্যা করা হয়।’…

কিন্তু বোধ হয়, বঙ্গীয় কুলবতী কুল চিরকাল কঠিন নিয়মে অবরোধিতা থাকতে নিতান্ত লাজুক ও মুখচোরা হওয়া সম্ভব বিবেচনায় নবসংস্কারকগণ তাঁহাদিগকে অবহেলা করিয়াছেন। অর্থাৎ অযোগ্য ও অকর্ম্মণ্য ভাবিয়া অকুলবতী জগৎস্বামিনী বার-রমণী-তনয়াগণকে লইয়াই স্বভাবানুযায়ী উচ্চ অঙ্গের অভিনয় ব্যাপার সমাধা করিতেছেন। ইহাতে চতুর্দ্দিকে তাঁহাদের নামে ধন্য ধন্য রব উঠিয়াছে। আমরাও ধন্য ধন্য লিখিলাম, বাস্তবিক তাহা ধন্য রব নয়, ‘বাহবা’ রব। এই সহরময় তাঁহারা এত বাহবা খাইতেছেন, যে, উন্নতির চেলা ও সভ্যতার ভক্তবৃন্দের মধ্যে অন্য কেহ কখনো এত ভোগ করিতে পায় নাই !

এই মন্তব্যের দুটি কথা খেয়াল করার মতো। প্রথমত এটা স্বীকার করা যে, মেয়েদের অভিনয় ছেলেদের দিয়ে হয় না (যতই দাড়ি কামাক) এবং গৃহস্থঘরের কুলবতী রমণীদের ‘কঠিন নিয়মের অবরোধিতা’ স্ত্রীলোকের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ে বাধা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় কথা হল—‘ইহাতে তাহাদের নামে চতুর্দিকে ধন্য ধন্য রব উঠিয়াছে। আমরাও ধন্য ধন্য লিখিলাম।’ আমরা শুধু বলতে চাই—দৃশ্য কাব্যের দর্শক-সহৃদয়ের আস্বাদন-চমৎকারই কিন্তু একজন নাট্যকারের প্রধানতম লক্ষ্য হওয়া উচিত, আর সেই কারণে স্ত্রীচরিত্র অভিনয়ের জন্য স্ত্রীলোকেরই প্রয়োজন শুধু নয়, প্রয়োজন হাব-ভাব সমন্বিত কলাবতী রমণীদের, যাঁরা অভিনয়ের প্রয়োজন ভাবগুপ্তিও করতে পারেন। সেইজন্যই বেঙ্গল থিয়েটারের মালিক সঠিক প্রয়োজন বুঝেই বারাঙ্গনাদের নিয়োগ করেছিলেন এবং এই প্রয়োজনটা খ্রিষ্ট-পূর্ব শতাব্দীর কালেই বুঝেছিলেন ভরতমুনি—নাট্যশাস্ত্রের মূল প্রবন্ধকার, অথচ সেটা ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দেও লোকে বুঝতে চাইছে না। ভরতমুনির অভিনয়-ভাবনার কথা এখানে বলতেই হবে, কেননা তাতে অভিনয়ের প্রয়োজন, দর্শকের প্রয়োজনের সঙ্গে পূর্বরাগ মেয়েদের অগ্রগামিতার কথাও প্রমাণসহ হয়ে উঠবে।

কাব্য-নাটক যেহেতু কবি-নট-নাট্যকারের সঙ্গে অখিল শ্রোতা-দর্শক-সহৃদয়ের হৃয়সংবাদ, তাই সেই সংবাদ ঘটানোর জন্য আদিভরতের চেষ্টার অন্ত ছিল না। নাটকে কথা বা সংলাপের প্রয়োজন, তার জন্য তিনি কথার ব্যবস্থা করলেন—নাট্যশাস্ত্রের পারিভাষিকতায় সেটাকে বলা হয় ভারতী বৃত্তি। নাটকের মধ্যে বিভিন্ন অংশে উৎসাহ, উদ্দীপনা, ত্যাগ, শৌর্য, দয়া, সরলতা ইত্যাদি পরিবেশন করতে হবে বিভিন্ন রসের পরিপোষক হিসেবে— নাট্যচার্য ভরত তারও ব্যবস্থা করেছেন। দেখাতে হবে মায়া, ইন্দ্রজাল, সংগ্রাম, ক্রোধ, হিংসা, হত্যা, কারাগার—তারও ব্যবস্থা করেছেন ভারত। সব ব্যবস্থা করে ভারত যখন নাটক সৃষ্টি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ভগবান ব্রহ্মার কাছে বিদায় নিচ্ছেন, তখন সুরগুরু বৃহস্পতি তাঁকে বললেন — বাছা ! তুমি নাটকের মধ্যে কৈশিকী বৃত্তিটাও যোগ কর, সেটা নইলে নাটক হবে কী করে—অথাহ মাং সুরগুরুঃ কৈশিকীমপি যোজয়

‘কৈশিকী বৃত্তি’ কথাটাও পারিভাষিক। এই পরিভাষার সম্পূর্ণ পরিচয় দেবার আগে নাট্যশাস্ত্রে অসামান্য টীকাকার অভিনবগুপ্তের বক্তব্যটা বলে নিই। অভিনবগুপ্ত বলেছেন—নাটকের মধ্যে কোমল তথা ললিতগুণ সম্পন্ন যা কিছু আছে, তার সবটাই আছে কৈশিকী-বৃত্তির মধ্যে। ললিতগুণসম্পন্ন কোনও কিছু নাটকের মধ্যে আধান করতে হলে, তার জন্য দরকার নৃত্যগীত, অভিনয়, সুন্দর বেশ এবং কামোপভোগের অনুকূল বিলাস তথা উপচার। আসলে এগুলি সব স্ত্রীপুরুষের প্রেমভাবসমন্বিত শৃঙ্গাররসের উপাদান। যে কারণে অভিনবগুপ্ত বলেছেন—কৈশিকী বৃত্তি ছাড়া শৃঙ্গাররসের কোনো নাটকীয় প্রতিবেদনের কথা ভাবাই যায় না। আর শুধু শৃঙ্গার কেন, রৌদ্র বীর ইত্যাদি রসেও কৈশিকী বৃত্তিই হল প্রাণস্বরূপা। এবং যৎকিঞ্চিল্লালিত্যং তৎসর্বং কৈশিকী-বিজৃম্ভিতম্।

বেশ বোঝা যায়—কৈশিকী বৃত্তির মধ্যে যে ললিত-কলার বিলাস-কৌতূহল ছিল, সেটা শুধু পুরুষের দ্বার মেটানো সম্ভব নয়। অথচ প্রথম নাট্যকার ভরতের পক্ষে লোক-পিতামহ ব্রহ্মার কাছে এটাও বলা সম্ভব ছিল না যে, আপনি স্ত্রীলোকের ব্যবস্থা করুন, নইলে এই কৈশিকী বৃত্তির কাজটুকুই বাকী থেকে যাবে। অনেক বিবেচনা করে ভরতমুনি ব্রহ্মাকে বললেন—ঠাকুর ! আপনি এমন উপযুক্ত সুন্দর বস্তুর ব্যবস্থা করুন যাতে নাটকে কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটতে পারে, ব্যবস্থা হতে পারে নৃত্য-গীত-বৈচিত্রের, অভিনয়ে যোগ হতে পার মধুর-মন্থর আবর্তন, ভ্রবিক্ষেপ, কটাক্ষ। এগুলিকে ভরত এককথায় বলেছেন—রসভাব ক্রিয়াত্মিকা।

ভরতমুনি এইসব ভাসা-ভাসা কথা বলেই থামলেন না। তাঁকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে তিনি কী চান। একটু ভণিতা করে বললেন—আমি নটরাজ নীলকণ্ঠ মহাদেবকে নৃত্য করতে দেখেছি। নৃত্যকালে তিনি যেমন করে তাঁর জটাচূড় বেধেঁ নিয়েছিলেন, যেমন বিচিত্র অঙ্গহার ধারণ করেছিলেন, তাতে বোঝা যায় তিনি কৈশিকী বৃত্তি আশ্রয় করেছিলেন এবং শৃঙ্গার রসের অভিনয়-প্রয়োজনেই সেই বৃত্তির প্রয়োজন হয়। এবারে ভরতমুনি স্পষ্ট জানিয়ে বললেন—প্রভু আমার ! নাটকে যদি কৈশিকী বৃত্তির প্রয়োগ ঘটাতে হয়, তাহলে শুধু পুরুষ-মানুষ দিয়ে মোটেই কাজ হবে না, অভিনয়ের জন্য স্ত্রীলোক লাগবে, স্ত্রীলোক ছাড়া সম্ভবই নয়—অশক্যা পুরুষৈঃ স্থাতুং প্রযোক্তুং স্ত্রীজনাদৃতে। ব্রহ্মা ভরতমুনির নিবেদন শুনে সৃষ্টি করলেন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের। অপ্সরাদের নামের তালিকায় ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভার মতো নামী-দামী তারকারা ছিলেন না বটে, তবে মঞ্জুকেশী-মিশ্রকেশী অথবা সৌদামিনী-সুলোচনারা ছিলেন এবং তাঁরা প্রত্যেকেই নাট্যালঙ্কারের সমস্ত বৈচিত্র, সমস্ত লীলা-বিলাসের চতুর—ব্রহ্মা তাঁদের তুলে দিলেন নাট্যচার্য ভরতমুনির উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে—নাট্যলঙ্কার-চতুরাঃ প্রাদান্মহ্যং প্রয়োগতঃ

ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র যিনি নিঃশেষে বুঝেছিলেন, তিনি তো অভিনবগুপ্ত ছাড়া আর কেউ নয়। তিনি যখনই বললেন—‘কৈশিকী শ্লক্ষ্ণনৈপথ্যা’—সেখানে ‘শ্লক্ষ্ণ’ কথাটি ধরে অভিনবগুপ্ত বললেন ‘শ্লক্ষ্ণ’ মানেই তো কোমল, মধুর, উজ্জ্বল এবং সুকুমার আঙ্গিক সেখানে ব্যবহৃত হয় এবং এগুলি শৃঙ্গাররসের উপকরণ। ভারতী, সাত্ত্বতী ইত্যাদি চার রকমের অভিনয়ের আঙ্গিক প্রয়োগ করে যেভাবে শৃঙ্গাররসের অভিব্যক্তি ঘটাতে হয়, তারপরেও সেখানে মধুর মন্থর আঁখিপাতে ঘূর্ণন-আবর্ত-ভ্রক্ষেপ-কটাক্ষ—এসবের ছাড়া তো শৃঙ্গাররস আস্বাদনের নামই করা যাবে না—

শৃঙ্গারাভিব্যক্তৌ সুকুমারে চতুর্বিধেপ্যভিনয়ে যোজিতে
মধুর-মন্থর-বলনাবর্তনাভ্রক্ষেপ-কটাক্ষাদিনা বিনা
শৃঙ্গার-রসাস্বাদস্য নামাপি ন ভবতি।

আবার শৃঙ্গার রসের এই সব উপকরণ পুরুষের বিষয় নয় বলেই মেয়েদের ছাড়াও শৃঙ্গাররসেরই নাম করা যায় না, রসের আস্বাদন তো পরের কথা। ফলত মধুর-মন্থর ভ্রূক্ষেপ-কটাক্ষ ইত্যাদি ‘শ্লক্ষ্ণনৈপত্যঅ’ যে কৈশিকী বৃত্তি সেটা মেয়েদের ছাড়া অভিনয় করা সম্ভবই নয়। তারা থাকলেই নাট্যাভিনয়ে সেই বৈচিত্র্য আসবে যেখানে শৃঙ্গারোচিত আর্দ্রসিক্ত মধুররোজ্জ্বল ভাবগুলি কোনও মতে অভিনয় করা সম্ভব হবে –

শৃঙ্গাররসস্য নামগ্রহণমপি ন তয়া বিনা শক্যম্‌।
স্ত্রীজনাদৃতে ইতি। …অতঃ স্ত্রীণাং তাদৃগস্তি বৈচিত্র্যম্‌।
তৎসম্পর্ক-সম্ভবাদ্‌ আর্দ্রভাবাস্তু কদাচিচ্ছক্নুয়ুরিতি।

[নাট্যশাস্ত্র, তদেব, ১.৪৫-৪৬, আভিনবভারতী টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ২২-২৩]

অভিনবগুপ্ত লিখেছেন যে, নাটকের ‘অলঙ্কার’ বলে যদি কিছু থাকে, নাটকের বৈচিত্র্যহেতু’ বলে যদি কিছু থাকে, তা হল কৈশিকী। কৈশিকীর অভিব্যক্তিতে যারা চতুর, তারা তো মেয়েরাই—যাদের ছাড়া শৃঙ্গার রসের নামই করা যায় না—
নাট্যস্য যো’লঙ্কারো বৈচিত্র্যহেতুঃ কৈশিকী। তত্র চতুরাঃ। [তদেব]
শৃঙ্গার-চাতুর্যের এই লক্ষণ যেহেতু মেয়েদের হাব-ভাব এবং ‘মধুর-মন্থর-বলনাবর্তন’-মুখর ভ্রুক্ষেপ-কটাক্ষের মধুরতাতেই নিষ্পন্ন হয়, তাই কাব্যকার এবং নাট্যকারদের ভাবনা থাকে শৃঙ্গারাত্মক সমস্ত পর্যায়গুলোর মধ্যেই মেয়েদের ভাব-রসতা আগে প্রকট করে তোলার। কেননা তাতেই কাব্য-নাটকের ‘চারুতা’ দর্শক-শ্রোতার হৃদয়গম্য হয় বেশী—রূপ গোস্বামীর ভাষায় ‘চারুতাধিকা’, বিশ্বনাথ কবিরাজের ভাষায় ‘হৃদয়ঙ্গম’ হয় বেশী।

নয়নপ্রীতিঃ প্রথমং

আমরা পূর্বরাগের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে করতেই তার ভাব-বিশ্লেষণের ভিতরে ঢুকে পুড়েছি। বিশেষত মিলনের পূর্বে পরস্পরান্বেষণের মধ্যে একের কথা শুনে অপরের কিংবা একজনকে দেখে অপরজনের মনে যে অভিলাষ জেগে ওঠে, আমরা সেই হৃদয়-রাঙানো ভাব-বিলাসের মধ্যেই আছি এখনো। ফলত পূর্বরাগের সময় থেকে অভিলাষ-চিন্তা ইত্যাদি দশ রকমের কামদশার বিশ্লেষণে আর আমরা প্রবেশ করবো না। বিশেষত বিশ্বনাথ কবিরাজ দশ দশার যে বিবরণ দিয়েছেন অভিলাষ, চিন্তা, স্মৃতি, গুণকথন ইত্যাদি-ক্রমে, সেগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মন দিলে আমাদের কথা শেষ পর্যন্ত কথকতায় পৌঁছোবে। কিন্তু অবশেষে সাহস করে এটা বলবোই যে, বিশ্বনাথ কবিরাজ যেভাবে পূর্বরাগের বর্ণনা করার পরেই অন্য এক রসশাস্ত্রকারের কথা তুলে দশ দশা বিবরণ দিয়েছেন, সেটা যেন বেশী সুন্দর এবং বিজ্ঞানসম্মত। কেননা পূর্বরাগের দর্শন-শ্রবণজাত অনুরাগের পরে-পরেই দশটা ‘কামদশা’-র বর্ণনা কেমন যেন গদ্যজাতীয় লাগে, বরঞ্চ বিশ্বনাথ কবিরাজ যে পূর্বসূরির মত উদ্ধার করেছেন, তার প্রথম শব্দটিই সবচেয়ে উপযুক্ত। আসলে তিনি তাঁর দশ দশটি স্মরদশার বিবরণে প্রথমে যেন পূর্বরাগ-শব্দটাই প্রকারান্তরে বসিয়ে দিয়েছেন অভিলাসের জায়গায়। বিশ্বনাথের পূর্বজন্মা সেই রসবিদ বলছেন—নয়ন-প্রীতিঃ প্রথমম্—চোখের দেখাতেই প্রথম ভাল লাগার ঘটনাটাই পূর্বরাগের প্রথম অনুভূতি। তারপরেই যাকে ভাল লাগল তার ওপর মনের ‘আসঙ্গ’ অর্থাৎ আসক্তি তৈরী হতে থাকে। তবে কিনা ‘আসঙ্গ’ শব্দটার মধ্যে একটা শরীর-শরীর ব্যঞ্জনা আছে যেটা পুরোপুরি শরীরীইও নয়। কেমনে বুঝাই এটা ! অভীষ্ট জনের প্রতি এই চিত্তাসঙ্গ থেকেই অবশেষে সেই সংকল্প তৈরী হয়—যেমনটা রবীন্দ্রনাথ লেখেন—

এ ঘাটে বাঁধির মোর তরণী।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে এই একটা পংক্তি উদ্ধার করে শুধু সংকল্পের উদাহরণ দেওয়াটা আমার অন্যায় হল। আমার বলা উচিত যে, পূর্বরাগের প্রক্রিয়ার তিনটি স্মরদশা—নয়নপ্রীতি থেকে পর পর চিত্তাসঙ্গ এবং সংকল্পের যত উদাহরণ হতে পারে—সেখানে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণগুলি আছে সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথের নিজের কবিতাগুলিতে -–যদিও সেটা তাঁর স্বচিন্তিত ‘কামদশা’ অনুযায়ী, কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে নয়নপ্রীতি, চিত্তাসঙ্গ এবং সংকল্পের যত উদাহরণ হতে পারে—সেখানে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণগুলি আছে সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথের নিজের কবিতাগুলিতে — যদিও সেটা তাঁর স্বচিন্তিত ‘কামদশা’ অনুযায়ী, কিন্তু এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে নয়নপ্রীতি, চিত্তাসঙ্গ এবং সংকল্প যে অদ্ভুত ব্যঞ্জনায় মুখর হয়ে উঠেছে, সেটা সংস্কৃত রসশাস্ত্রীয় ব্যাকরণ মেনে করা হয়নি বলেই অনেক বেশী সহজ এবং স্বতঃস্ফুর্ত মধুরতায় ব্যঞ্জিত হয়েছে। কবি লিখছেন—

দিনশেষ হয়ে এল আঁধারিল ধরণী –
আর বেয়ে কাজ নাই তরণী।
‘হ্যাঁগো, এ কাদের দেশে বিদেশী নামিনু এসে’
তাহারে শুধানু হেসে যেমনি—
অমনি কথা না বলি ভরা ঘট ছলছলি
নতমুখে গেল চলি তরুণী
এ ঘাটে বাঁধিব মোর তরণী।

এখানে পূর্বরাগের প্রসঙ্গ পুরুষকে দিয়েই আরম্ভ হয়েছে, যেটা সবচেয়ে স্বাভাবিক, যেমনটা কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটকেও তপোবনবাসিনী শকুন্তলাকে দেখে রাজা দুষ্যন্তের ‘নয়নপ্রীতিঃ প্রথমম্’—প্রথম দেখেই তাঁর ভাল লাগা প্রকট হয়ে উঠছে অন্তত দুটি-তিনটি শ্লোকে। শকুন্তলাকে প্রথম ভাল করে দেখার পরেই দুষ্যন্ত বলছেন—আশ্রমবাসিনী এক রমণীর যদি এমন রূপ হয়, যা আমার রাজঅন্তঃপুরেও একান্ত দুর্লভ—তাহলে তো রাজোদ্যানের কৃত্রিমবর্ধিত উদ্যানলতা হেরে গেল এই বনলতার কাছে

শুদ্ধান্ত দুর্লভমিদং বপুরাশ্রমবাসিনো যদি জনস্য।
দূরীকৃতাঃ খলু গুণৈরুদ্যানলতা বনলতাভিঃ।।

শকুন্তলাকে খানিকক্ষণ দেখে নিলেন রাজা দুষ্যন্ত এবং লতা-গাছের আড়ালে থেকে, খানিক ক্ষণ সখীসঙ্গে শকুন্তলার অন্তরঙ্গ কথাবার্তাও শুনলেন চোরের মতো আড়ালে থেকেই—এবারে চিত্তের আসক্তি তৈরী হচ্ছে—শকুন্তলা সামান্য ঘট বয়ে এনে গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছেন, প্রিয়ারমণীর এই পরিশ্রমটুকুও দুষ্যন্তের সহ্য হচ্ছে না। তাঁর মনে হচ্ছে—কণ্ব মুনি যেন খাটিয়ে একশেষ করছেন এই ললিত-কোমলা রমণীকে। এটাই চিত্তের আসক্তি –চিন্তাসঙ্গ। শকুন্তলার রূপ-লাবণ্য বর্ণনা করে রাজা তাঁর চিত্তাসক্তির পরিচয় প্রকট করে তুলছেন আর‍ও বেশী করে। এর পরেই শকুন্তলাকে লাভ করার সংকল্প তৈরী হচ্ছে তাঁর মনে। স্বগতোক্তিতে বলছেন—আমার মতো এক ভদ্রজনের মন যখন চাইছে, তখন আমার মতো ক্ষত্রিয় রাজার সঙ্গেও এই কন্যার বিবাহ হতে পারে নিশ্চয় –

অসংশয়ং ক্ষত্রপরিগ্রক্ষমা
যদার্যমস্যমভিলাষি মে মনঃ।

নিঃসন্দেহে জানাতে পারি যে, রসশাস্ত্রের ব্যাকরণ মেনে কালিদাস এখানে পূর্বরাগের পর্যায় অনুলিখন করেননি, যেমনটি করেননি রবীন্দ্রনাথও। বরঞ্চ বলবো মহাকবিদের প্রকরণ দেখেই রসশাস্ত্রের ব্যাকরণ তৈরী হয়। এখানে অবশ্য পুরুষের পূর্বরাগ আগে প্রকট করেই এই মহাকবিরা জীবন এবং যৌবনের বাস্তব সত্যটুকু প্রকাল করেছেন। প্রতিতুলনায় বৈষ্ণবজগতের পূর্বরাগ-বিশ্লেষণে অন্যতর এক তাত্ত্বিক সত্য আছে, যেখানে মনে করা হয়—ব্রজবধূরা যে আত্মনিবেদনে কৃষ্ণকে ভালবাসতে পারেন, তা কৃষ্ণও পারেন না।
বৈষ্ণব রসভাবের তাত্ত্বিকতার শুরু এই বিশ্বাস থেকেই যে ভাগবত পুরাণের সর্বোত্তম লীলাখণ্ড রাসপঞ্চাধ্যায়ীতে কৃষ্ণের নিজমুখের স্বীকারোক্তি হল –কুল-শীলের সমস্ত বাঁধ ভেঙে যেভাবে তোমরা আমাকে ভালবেসেছো, তার ঋণ আমি কোনো দিনও পরিশোধ করতে পারবো না। এমনকী দেবতাদের মতো আয়ু পেলেও এই প্রেমের ঋণ শোধ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে—

ন পারয়ে’হং নিরবদ্যসংয়ুজাং
স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুষাপি বঃ।
যা মা’ভঞ্জন্ দুর্জরগহশৃঙ্খলা
সংবৃশ্চ্য তদ্‌বঃ প্রতিযাতু সাধুনা।।

আসলে বৈষ্ণবীয় প্রেমের রাজ্যে আমাদের রাধারাণীর জয়কার। রাধাপ্রেম এমনই, যা কৃষ্ণের প্রেমকে গৌণস্থানে প্রতিষ্ঠা করেছে। পাশ্চাত্যের পারিভাষিকতায় এটাকে cultic supremacy বলতে পারি, কেননা রাধা তথা রাধাপ্রেমের মাহাত্ম্য কৃষ্ণ নিজেই তৈরী করেছেন। কেননা রাধাপ্রেমের মাধ্যমে কৃষ্ণ নিজেকেই আস্বাদন করেন—বৈষ্ণবীয় ভাবনা কিন্তু এটাই।

বৈষ্ণব মহাজনেরা বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটা মহাবাক্য উদ্ধার করে বলেন—‘সেই পরম পুরুষের কিছুই ভাল লাগছিল না, কেননা একা-একা ভাল লাগে না—স বৈ নৈব রেমে। যম্মাদ্ একাকী ন রমতে। তিনি নিজের দ্বিতীয় চাইলেন। তারপর তিনি এমন ভাব লাভ করলেন—পরস্পর আলিঙ্গিত স্ত্রী-পুরুষ যেমন হয়—তিনি নিজের দেহকে দুই ভাগে ভাগ করলেন – স দ্বিতীয়মৈচ্ছৎ। স হৈতাবানাস—যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সম্পরিষবক্তৌ। স ইমমেবাত্মানং দ্বেধাপাতয়ৎ।

বৈষ্ণব রসশাস্ত্রকারেরা বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই পংক্তিটির ওপর ভিত্তি করেই এটা বলেন যে, ব্রজরমণীরা আসলে কৃষ্ণেরই স্বেচ্ছানির্মিত অন্য দেহ—তাঁরই একান্ত অন্তরঙ্গা শক্তি, যাকে পারিভাষিক ভাষায় বলা হল হ্লাদিনী শক্তি, সেই হ্লাদিনীর সার হলেন রাধাই আসলে এটা একভাবে নিজেকেই প্রোজেক্ট করে নিজেকে দেখা এবং ‘সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।’ জীব গোস্বামীর মতো দার্শনিক-ধুরন্ধর তাঁর কৃষ্ণসন্দর্ভের মধ্যে চুলচেরা দার্শনিক বিচার করে বলেছেন—কৃষ্ণের স্বরূপশক্তি বা তাঁর আনন্দিনী শক্তিকেই ব্রজদেবীদের মধ্যে প্রতিফলিত করেন। সেই প্রেমময়ী শক্তির সার হলে শ্রীরাধিকাই রূপ গোস্বামীর ভাষায় সেটাই হ্লাদিনীসার—

অথ বৃন্দাবনে তদীয়স্বরূপ-শক্তি-প্রাদুর্ভাবাশ্চ শ্রীব্রজদেব্যঃ
… তদেবং পরম-মধুর-প্রেমবৃত্তিময়ীষু তাষ্বপি
তৎ-সাংরাংসোদ্রেকময়ী শ্রীরাধিকা।

রাধাকে আমরা হ্লাদিনীই বলতে পারি এক কথায়। এই হ্লাদিনী রাধাই কৃষ্ণকে প্রেমের আস্বাদন দেন –

হ্লাদিনী করায় কৃষ্ণে রস-আস্বাদন।
হ্লাদিনী দ্বারায় করে ভক্তের পোষণ।।

(কৃষ্ণসন্দর্ভ প্রাণগোপাল গোস্বামী, নবদ্বীপ,
বঙ্গাব্দ ১৩৩২ (১৯৫২) পৃ.ল ৫৫৯, ৫৬৫)

হ্লাদিনী রাধারাণীর বিশেষত্ব হল—প্রেমের ব্যাপারে পরম ঈশ্বরের তরফ থেকেই তাকে অনন্ত স্বাধীনতা দেওয়া আছে এবং ঈশ্বরী যোগমায়ার শক্তিতে কৃষ্ণ নিজেও নিজেকে ঈশ্বর বলে জানেন না। ঠিক এইখানেই বিনোদিনী রাইকিশোরীর সুযোগ এসে গেছে রমণীর সমস্ত হৃদয়ব্যাপ্তি নিয়ে, সমস্ত হাব-ভাব, লাস্য, মান-অভিমান নিয়ে একমাত্র অভীষ্ট পুরুষকে প্রেমের সমস্ত মাধুর্য উপহার দেওয়ার। এই প্রেমের মধ্যে আবার পরকীয়ত্বের আবরণ থাকায় প্রেমের তীব্রতা যেমন বেড়েছে, তেমনই বাধা-বিপত্তি-সন্দেহে সে প্রেম হয়ে উঠেছে সমুদ্রের মতো গম্ভীর-গভীর, অথচ সেটা পরম বৈচিত্র্যময়।

এমনকী একটা চরম বিরহও সেখানে স্বেচ্ছায় প্রণোদিত, নিজের অজান্তেই আপন যোগমায়াশক্তি প্রভাবে এই অপূর্ব-নির্মাণ করতে হয়েছে সেই কবিকে, যিনি ‘অখিলরসামৃতমূর্তি’—যিনি আপনাকে আস্বাদন করতে চান রাধার প্রেম-প্রণয়, লিপ্সা, মান, বিরহের মাধ্যমে, আস্বাদন করতে চান শতেক বাধায়, এই রাধাপ্রেমের উত্তরণের মধ্যে। অথচ সেটা খুব সাধারণ, এই জগদ্‌ব্যাপারের মধ্যেই সেটা হয় এবং হয় যদি, তাহলে কপালে সান্ত্বনার হাত রাখলেও যন্ত্রণা আর বাড়ে। রবীন্দ্রনাথ শেষের কবিতায় এই যুক্তি দিয়ে লাবণ্যের ভাষায় বলেদিলেন –

লাবণ্য বললে, ‘‘প্রিয়শিষ্যা ললিত কলাবিধৌ।’’
অমিত বললে, ‘‘সেই ললিত কলাবিধিটা দাম্পত্যেরই। অধিকাংশ বর্বর বিয়েটাকেই মনে করে মিলন, সেইজন্য তারপর থেকে মিলনটাকে এত অবহেলা।’’
‘‘মিলনের অর্থ তোমার মনে কীরকম আছে বুঝিয়ে দাও। যদি আমাকে শিষ্যা কর চাও আজই তার প্রথম পাঠ শুরু হোক।’’
‘‘আচ্ছা, তবে শোনো। ইচ্ছাকৃত বাধা দিয়েই কবি ছন্দের সৃষ্টি করে। মিলনকেও সুন্দর করতে হয়। ইচ্ছাকৃত বাধায়। চাইলেই পাওয়া যায় দামি জিনিসকে এত সস্তা করা নিজেকেই ঠকানো। কেননা, শক্তি করে দাম দেওয়ার আনন্দটা বড়ো কম নয়।’’

এই ‘ইচ্ছাকৃত বাধা’-র জন্যই রাধার পরকীয় ভাব, যাতে দুর্জর গৃহশৃঙ্খল মুক্ত করে প্রাণাভীষ্ট পুরুষের কাছে যেতে হয়। সেখানে বৈষ্ণব মহাজনেরা পূর্বরাগ, মান ইত্যাদি যেসব হৃদয়ভাবের জটিল গ্রন্থি সৃষ্টি করেছেন, সেগুলি রাধার মতো এক রমণীর পরিসরেই প্রথম সাজিয়ে দেন, তাতে চারুতা বাড়ে।

বস্তুত যে আত্মারাম পুরুষ স্বগত মাধুর্য আস্বাদনের জন্য নিজের প্রতিফলিত শরীরকেই পরম আদর্শ বলে বুঝেছেন, সেখানে ব্রজবধূদেরই জয়কার। তার মধ্যে আবার হ্লাদিনীসার শ্রীরাধিকা। কৃষ্ণ তাঁরই প্রেমের মাধুর্যে আপন স্বগত মাধুর্য আস্বাদন করতে চান। রূপ গোস্বামীর ললিতমাধব নাটকে একটি স্বচ্ছ-মসৃণ প্রস্তরখণ্ডের ওপর নিজেকে প্রতিফলিত দেখে কৃষ্ণ বলতে থাকেন—এটা কেমন রূপ ! আমার এই আশ্চর্য মধুরতা আমি নিজেই তো কখনো দেখিনি। সত্যি বলতে কী, আমার মনে এখন লোভ হচ্ছে—আমি যেন রাধার মতো করে এই মাধুর্যটা আস্বাদন করতে পারি –

অপরিকলিতপূর্বঃ কশ্চমৎকারকারী
স্ফুরতি মম গরীয়ানেষ মাধুর্যপূরঃ ।
অয়মহমপি হন্ত প্রেক্ষ্য যং লুব্ধচেতা
সরভসমুপভোক্তুং কাময়ে রাধিকেব।।

দর্পণাদ্যে দেখি যদি আপন মাধুরী।
আস্বাদিতে সাধ হয় আস্বাদিতে নারি।।

অনেক মানুষই বলেন যে, রাধার মতো করে কৃষ্ণকে ভালবাসার আনন্দ আস্বাদন করার জন্যই ‘রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত কৃষ্ণস্বরূপ’ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবতার। আমরা শুধু বলবো, রাধাভাবের সেই বিরাট গরিমার জন্যই বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রের আগে রাধা, পরে কৃষ্ণ—পূর্বরাগ থেকে অভিসার সর্বত্র। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে রাধর মতো এক রমণীর পূর্ণ আত্মনিবেদনের ভঙ্গিমার মধ্যে রস-বৈচিত্র্য যে কতটা বিপ্রতীপ মোহে ধরা পড়ে, তার একটা নমুনা ভাগবত পুরাণে উল্লিখিত উদ্ধবসন্দেশ থেকে দেখাতে চাই; তাতে পূর্বরাগ থেকে দশ স্মরদশা রাধারাণীর প্রধানতা এবং প্রথমবর্ণনীয়তা সবচেয়ে বেশী সপ্রমাণ হয়ে উঠবে।

উদ্ধব কৃষ্ণের আত্মীয়, ভাই বললেও চলে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা, উদ্ধব কৃষ্ণের খুব কাছের লোক—দয়িতাঃ সখা। তাঁকে কৃষ্ণ হাত ধরে মিনতি করে বলেছেন—উদ্ধব ! তুমি একবার বৃন্দাবনে যাও। সেখানে নন্দবাবা আর মা যশোমতীর খবর নিয়ে এসো আমার কাছে। আর একবার গোপীদের কাছে যাবে। আমার কথা বলে তাঁদের মনের ভার মুক্ত করবে—মৎসন্দেশৈর্বিমোচয়। এতদিন গোপীদের ছেড়ে এসে তাঁদের কোনও খবর না দিয়ে কৃষ্ণ দুরন্ত পাপবোধে ভুগছেন। তিনি জানেন—তাঁদের মন-প্রাণ সব তিনিই। তিনি জানেন—তাঁর জন্য একদিন কুল-মান সব ছেড়ে গোপীরা তাঁর কাছেই আত্মনিবেদন করেছিল। কৃষ্ণ সে আত্মনিবেদনের মর্যাদা রাখতে পারেননি। ফিরে আসব বলে কথা দিয়েও তিনি আসতে পারেননি। আজকে তাঁদের জন্য কৃষ্ণের প্রাণ-মন কেঁদে উঠছে। বিশেষ সেই রাধার কথা।

কৃষ্ণ হাত ধরে উদ্ধবকে বলেছেন—একবারটি যাও ভাই, তাঁদের গিয়ে আমার খবর দাও। উদ্ধব গিয়েছেন। দ্বারকার নাগরিক পরিবেশ ছেড়ে বৃন্দাবনের রজোবিকীর্ণ পথ তাঁকে অন্যতর এক মুক্তি দিয়েছিল। তিনি যখন বৃন্দাবনের নন্দ-গ্রামে পৌঁছলেন তখন সূর্য অস্তাচলে। প্রেমে-নত নয়নের দীর্ঘচ্ছায়াময় পল্লবের মতো সন্ধ্যা নেমে এসেছে বৃন্দাবনের দিগন্তে। সারাদিন ধরে চরে বেড়ানো গোরুগুলি ঘুরে-ঘুরে ধুলো উড়িয়ে ফিরছিল, গোপীরা সেই ধূলি-পটলে উদ্ধবের রথ দেখতে পেলেন না—ছন্নযানঃ প্রবিশতাং পশূনাং খর-রেণুভিঃ। উদ্ধব প্রথমে এসে পৌঁছলেন কৃষ্ণের মাতা-পিতা যশোমতী-নন্দের কাছে।

এখানে নন্দ-যশোদার কথাবার্তায় যে কৃষ্ণের জন্য আকুতি ছিল, বৃন্দাবনের প্রত্যেক ধূলিকণায় কৃষ্ণের যে সুখ-স্মৃতি তাঁরা বুকে ধরে রেখেছিলেন, তা বোঝাতে গেলে ভাগবত পুরাণের কবির ভাবাংশও আমার পক্ষে অনুবাদ করা সম্ভব নয়। ক্ষোভ থেকে গেল—যদি অমানুষী ভাষা পাইতাম, নক্ষত্রদিগকে শ্রোতা পাইতাম। আমি এই কথোপকথনর মধ্যে যাচ্ছি না। রসলিপ্সু পাঠকেরা মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর উদ্ধব-সন্দেশ পড়ে দেখবেন। আমরা সোজাসুজি গোপ-রমণীদের প্রসঙ্গে চলে আসছি, কারণ সেখানে রাধা আছেন।

উদ্ধব বৃষ্ণিবংসেব প্রবর মন্ত্রী। বিচক্ষণ লোক। কৃষ্ণের সঙ্গে দিনরাত ওঠা-বসা করেন, বয়সটাও কৃষ্ণের মতোই। কৃষ্ণের কাছে অনুক্ষণ গোপীদের কথা শুনেছেন এবং কথায় কথায় এও শুনে থাকবেন যে, কৃষ্ণ একসময় পীত বসন পরে গোপীসমাজে ধূম ফেলে দিয়েছিলেন। উদ্ধব আজকে জামা-কাপড় পরেছেন কৃষ্ণেরই মতো করে। নাগরিকবৃত্তির মানুষ হিসেবে তিনি ভেবেছিলেন বুঝি কৃষ্ণের মতোই ‘পীতবসন-বনমালী’ হয়ে সরলা গোপিনীদেরতাক লাগিয়ে দেবেন একেবারে। উদ্ধব এখনও জানেন না, তিনি কাদের কাছে এসেছেন।

গোপীরা দূর থেকে দেখতে পেলেন উদ্ধবকে। কৃষ্ণের মতোই চেহারা, আজানুলম্বিত বাহু, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ, গলায় পদ্ম-ফুলের মালা, পীতাম্বর। কৃষ্ণ-কৃষ্ণ ভাব থাকলেও কৃষ্ণ যে নয় সেটা বুঝতে সরলা গোপিনীদেরও এক মুহূর্ত দেরি লাগেনি। বরঞ্চ তাঁরা খানিকটা আশ্চর্য হয়েই উদ্ধবকে ঘিরে ধরলেনে—হঠাৎ কোত্থেকে এল লোকটা ? কৃষ্ণের মতোই বেশ-বাস করে কেমন করে এখানে এসে পৌঁছল—কৃতশ্চ কস্যাচ্যুতবেষভূষণঃ ? পরিচয় পেয়ে গোপীরা সলজ্জে হাসলেন, ভ্র-বিলাসে অনভিজ্ঞ দৃষ্টিতে, নম্র-নেত্রপাতে আত্মীয়তার বাতাবরণ গড়ে তুললেন কয়েক মূহূর্ত।

গোপীরা সরলা হলেও সারা জীবন বিদগ্ধ কৃষ্ণের সঙ্গ-রঙ্গে, রাধাকে শতাধিকবার অভিসার করিয়ে কথা শিখেছেন ভালোই। তাঁরা বললেন—আপনি যে কৃষ্ণের অনুগত, পছন্দ-সই মানুষ, সে আমরা বেশ বুঝতে পারছি। আপনি যে এখানে কৃষ্ণের মা-বাবা যশোমতী আর নন্দবাবার খবর নিতে এসেছেন, সেটা ঠিকই আছে। কেননা তাঁরা ছাড়া এই ধূলি-ধূসর ব্রজমণ্ডলে তাঁর তো আর কিছুই স্মরণীয় আছে বলে মনে হয় না—

অন্যথা গোব্রজে তস্য
স্মরণীয়ং ন চক্ষ্মেহে।

এত বচ্ছর ধরে কৃষ্ণের ফিরে না আসা, একটা খবরও না নেওয়া—এই সব ব্যবহার গোপীদের মনে কাঁদবার মতো অভিমান তৈরি করেছিল কিন্তু তাঁরা কাঁদলেন না। নিজেদের কথা বলতে আরম্ভ করলেন অন্য সাধারণ মানুষের অনুকারে। ভাবটা এই—সাধারণে এই রকম করে। কৃষ্ণের মতো এমন মর্যাদার মানুষও কি এই ব্যবহার করতে পারেন ? গোপীরা বললেন—হ্যাঁ, মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে মুনিদেরও দুর্বলতা থাকে এবং কৃষ্ণও হয়তো সে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেই আপনাকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে পুরুষমানুষের যে বন্ধুত্ব, সে হল ফুলের সঙ্গে মৌমাছির বন্ধুত্ব, নিজের কাজটি হলেই সে বন্ধুত্ব শেষ—সুমনঃস্বিব ষট্‌পদৈঃ

গোপীরা ভাব দেখালেন—কৃষ্ণ আমাদের সঙ্গে কী করেছেন তা পরিষ্কার করে বলতে চাই না। কারণ, যা করেছেন, তা আরেকভাবে বলতে হলে নীতিশাস্ত্রের মতো বলতে হয়—পয়সা নেই এমন মানুষকে বেশ্যারা ত্যাগ করে, মুরোদ নেই এমন রাজাকে প্রজারা ত্যাগ করে, দক্ষিণা পেলে পুরোহিতরা যজমানকে ত্যাগ করে, আর উপপতিরা রতিলিপ্সু কামিনীকেও সম্ভোগের পর ছেড়ে দেয়—জারা ভুক্তা রতাং স্ত্রিয়ম্। গোপীরা কৃষ্ণের নাম না করেও তাঁকে যে সব তুলনীয়তার পরিসরে আবদ্ধ করেছেন, তাতে উদ্ধব খুব স্বস্তি-বোধ করছিলেন না। এই অস্বস্তির মধ্যে কোথা থেকে এক মধুকর উড়ে এসে গুণ্‌-গুণ্‌ করে গাইতে লাগল, আর ভাগবত পুরাণের কবি শতগোপীর মধ্যে অন্যতম এক রমণীকে দিয়ে কথা বলাতে আরম্ভ করলেন।

এই ভাগবত পুরাণে রাধার নাম নেই। কিন্তু গন্ধ আছে। পুরাণের টীকাকারেরা চিনিয়ে দিয়ে বলেছেন—এই একতমা হলেন রাধা—হ্লাদিনী শক্তির সার, বৃষভানুনন্দিনী রাধা। মনে মনে তিনি ভাবছিলেন—মথুরা-দ্বারকার যুবতীকুলের সঙ্গে কৃষ্ণ কীভাবে রমণ-সুখ অনুভব করছেন। ঠিক এই ইর্ষা আর আসূয়ার মধ্যে কৃষ্ণ-দূত উদ্ধবকে দেখে তাঁর মনে হল, এও এক ভ্রমর বটে। উদ্ধবের ওপর মধুকরের বৃত্তি আরোপ করে রাধা বললেন—মধুকর ! ফুলে ফুলে মধু খেয়ে এসেছ এখানে। এমন লোকের বন্ধু তুমি, যে কথা দিয়ে কথা রাখে না। তুমি যেন অনুনয়ে, বিনয়ে আমার পা দুটি ছুঁয়ো না। আমাদের সতীন-কাঁটার বুকে কৃষ্ণের বৃন্দাবনের বনমালা পিষে গেছে, তুমি মধুকর! তোমার শুঁড়ে সেই বনমালার রেণু দেখতে পাচ্ছি আমি। ছুঁয়ো না যেন আমাকে।

এই সামান্য অভিমান করেই রাধা উদ্ধব-দূতকে ছেড়ে দেননি। বলেছেন—মথুরার রাজা কৃষ্ণ এখন কত কত মানিনীদের খুশি করতে ব্যস্ত, তার মধ্যে তুমি তাঁর দূত হয়ে এলে, হয়তো কোনও মানিনীদের সম্ভোগ-চিহ্ন মুখে নিয়েই। যদুদের রাজসভায় এতে কি কৃষ্ণের মান বাড়বে ? মৌমাছি যেমন ফুলের মধুটি খেয়ে চলে যায়, কৃষ্ণও তেমনই একবার আমাদের চুম্বন করে অধর-সুধার আস্বাদ দিয়ে পালিয়েছেন। আমি কেবল ভাবি—সতী শিরোমণি লক্ষ্মীদেবী তবু এমন লোকের পদ-সেবা করেন কী করে ? বুঝি না। আমাদের মনে হয়, তিনি কৃষ্ণের মিথ্যে কথায় ভুলেছেন। মনে রেখো, আমরা কিন্তু সে পাত্তর নই।

রাধা কটু কথা বলেন। ভ্রমর তবু থামে না, রাধার ধ্যানে গুনগুন করেই চলেছে। এই গুন-গুন শুনে তিনি ভাবলেন—উদ্ধব কৃষ্ণের দোষ স্খালন করে কথা বলছেন। ভ্রমরের গুন-গুন তাঁর কাছে কৃষ্ণের গুণপনার ব্যাখ্যা বলে মনে হল। রাধা বললেন—আমরা বৃন্দাবনের বনবাসী আভীরিণী। আমাদের সামনে সেই পুরানো কৃষ্ণের কথা আর গান কোরো না তুমি। বরঞ্চ যে কৃষ্ণ এখন মথুরায় কংস-টংস ধ্বংস করে বিজয়রথে বসে আছেন, তাঁর সেই বিজয়রথের নতুন বান্ধবীদের কাছে কৃষ্ণের গুণ গাওগে তুমি। অথবা আলিঙ্গন করে যে সমস্ত রমণীদের স্তন-পীড়া শান্ত করেছেন কৃষ্ণ, সেই সব রমণীদের কাছে গিয়ে কৃষ্ণের গুণ গাওগে তুমি, তাঁরা তোমার ইচ্ছাপূরণ করবেন—ক্ষপিত-কুচরুজস্তে কল্পয়ন্তীষ্টমিষ্টাঃ। রাধা এতক্ষণ ভ্রমর-রূপকের চালে নিজের ক্ষোভ-দুঃখ এবং অবশ্যই আক্রোশও প্রকাশ করে চলেছিলেন। কিন্তু সময়ে এল নিজের কষ্টগুলি সক্ষোভে উচ্চারণ করে মনে মনে লঘু হওয়ার। তিনি এবার একেবারে সোজাসুজি বলে ফেললেন—তাঁর জন্য আমরা স্বামী-পুত্তুর ত্যাগ করে পথে নেমে এসেছিলাম; সেই অসংযত পুরুষ অমাদের যেভাবে ছেড়ে যেতে পারলেন, তাতে তাঁর সঙ্গে কীভাবে সন্ধি হতে পারে—কিং নু সন্ধেয়মস্মিন্‌ ? মুখে সন্ধি হচ্ছে না বটে, কিন্তু অভিমানের শেষ পর্বে সেই সন্ধির কথাই বেরিয়ে এসেছে রাধার মুখ থেকে। কৃষ্ণের প্রতি সম্ভ্রমের দূরত্ব দেখিয়ে –মনে রাখা দরকার নিতান্ত আপন প্রিয়তমার দিক থেকে যে সম্ভ্রম কৃষ্ণ পছন্দ করেন না—সেই সম্ভ্রম দেখিয়ে রাধা বললেন—আর্যপুত্র কি এখনও মথুরাতেই আছেন ? এখানকার সখাদের, বাবা-মাকে তিনি কি এখনও স্মরণ করেন ? আমরা যারা তাঁর দাসী হয়েই আছি, তাদের কথা কখনও কি একবারও উচ্চারণ করেন—ক্কচিদপি স কথাঃ নঃ কিঙ্করীণাং গৃণীতে ? কবে তিনি তাঁর সেই অগুরু-সুগন্ধী হাতখানি আবারও আমাদের মাথায় রাখবেন?

এই শেষ কথাটার মধ্যে সব দুঃখ-ক্ষোভের ওপরে রাধার সেই আত্মনিবেদন আবারও ধরা পড়ে গেল। বৈষ্ণব দার্শনিকরা আলংকারিকরা রাধার এই অদ্ভুত ভাবের মধ্যে চরম প্রেমের সন্ধান পেয়েছেন। আমি সেই সব তত্ত্ব এবং মহাভাবের স্বরূপ-লক্ষণের মধ্যে যাচিছ না, তবে কৃষ্ণদূত উদ্ধব এই ভাব দেখে এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে, পরে তিনি এই সরলা গোপিনীর পায়ের ধলো নিতে চেয়েছিলেন। রাধার মতো এমন এক হ্লাদিনী সত্তার কাছ থেকে কৃষ্ণ যে দূরে সরে যেতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে গভীর প্রেমের সেই যুক্তি, যাকে আমরা ‘শেষের কবিতা’র যুক্তি বলতেও রাজি আছি। অর্থাৎ চাওয়ার জিনিসটাকে সস্তা করে ফেলা নয়, এ হল স্বেচ্ছানির্মিত বাধায় নিতান্ত নিবেদিত প্রেমকে বাধা-বৈচিত্র্যে মহামূল্যবান করে তোলা।

রাধার মতো এক বিদগ্ধা রমণীর সঙ্গে যে মিলন, সেই মিলনের ব্যাপারে কৃষ্ণের যুক্তিটাও প্রায় একইরকম। কৃষ্ণ উদ্ধবকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন—আমি যে তোমাদের এত প্রিয় সত্ত্বেও তোমাদের চোখের সামনে থেকে দূরে চলে এসেছি, তার কারণ আছে। আমি দূরে থাকলে তোমরা শুধু আমার কথাই ভাববে। আমি এই ভাবনাটুকু চেয়েছি—মদনুধ্যান-কাম্যয়া। এবারে কৃষ্ণ প্রায় অমিতের আধুনিকতায় বলেছেন—আমি যদি নিয়ত তোমার চোখের সামনেই থাকতাম, তা হলে তোমার মনে এমন করে ঠাঁই পেতাম না আমি-ন তথা চেতঃ সন্নিকৃষ্টে’ ক্ষিগোচরে। তার চেয়ে এই আমার ভালো, আমি রইলাম দূরে দূরে, আর সারাক্ষণ তোমার মন পড়ে রইল আমার কাছে—যথা দূরচরে প্রেষ্ঠে মন আবিশ্য বর্ততে।

আমার সহৃদয় পাঠককুল ! কৃষ্ণের এই অসাধারণ কথাটার নিরিখে আপনাদের কি মনে হয় না—এও একরকম ইচ্ছাকৃত বাধায় মিলনকে সুন্দর করে তোলা। ইচ্ছাকৃত বাধায় সহজ প্রেমকে দামী করার যে পন্থা, সেইখানেই রাধিকার পূর্বরাগ, অভিসার, মান, তৃষ্ণা, বিরহ, জাগরণ এবং সেগুলি কৃষ্ণের আগে না দেখালে পূর্বরাগের মতো সমৃদ্ধ রাধাপ্রেমের অঙ্গহানি হবে।