বিদ্যাপতির বংশগত উপাধি ঠাকুর, যার অর্থ জমিদার ৷ বিদ্যাপতির জন্ম শুক্ল যজুর্বেদ শাখার কাশ্যপ গোত্রভুক্ত মাধ্যন্দিন শাখার অন্তর্গত মৈথিল ব্রাহ্মণ পরিবারে ৷ এই পরিবারের আদিবাস দ্বারভাঙার ১৬ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বিসপি নামের বর্দ্ধিষ্ণু গ্রামে ৷ বিদ্যাপতির জন্মভূমিও এইখানেই ৷ পরিবারটি সেইকারণে বিষৈবার বিসপি নামে পরিচিত ৷ এই পরিবারটির প্রসিদ্ধি ছিল বিদ্বান-রাজপুরুষের পরিবার হিসেবে, যাঁরা মিথিলায় স্বীয় শাস্ত্রীয় জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং কর্ণাট রাজার দরবারে বিশ্বস্ত ও উচ্চ দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন ৷ বিদ্যাপতির ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ কর্মাদিত্য ছিলেন মন্ত্রী এবং কর্মাদিত্যের পুত্র দেবাদিত্য, পৌত্র বীরেশ্বর ও প্রপৌত্র চণ্ডেশ্বর দায়িত্ব পেয়েছিলেন শান্তি ও যুদ্ধসংক্রান্ত বিভাগে মন্ত্রীত্বের ৷ দেবাদিত্যের অপর এক পুত্র গণেশ্বর ছিলেন মহাসামন্তাধিপতি , সামন্ত সমিতির অধ্যক্ষ এবং মহারাজাধিরাজের উচ্চপদস্থ সামন্ত গোষ্ঠীর নেতা। বিদ্যাপতি ‘পুরুষপরীক্ষা’ রচনায় বীরেশ্বর ও গণেশ্বরের জীবনকাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং এই রচনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় গণেশ্বর বিদগ্ধতার জন্য সারা ভারতে খ্যাতিমান ছিলেন ৷ দেবাদিত্যের ভাই ভবাদিত্য ছিলেন রাজার সভাসদ এবং বীরেশ্বরের সহোদর ও বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা সকলেই ছিলেন মন্ত্রীত্বের উচ্চপদাসীন যেমন রাজকোষাধ্যক্ষ, বদলিবিভাগের অধ্যক্ষ, মুদ্রাধ্যক্ষ প্রভৃতি ৷ বীরেশ্বর ছান্দোগ্য অর্থাৎ সামবেদ অনুগামীদের জন্য এক পদ্ধতি রচনা করেন এবং তাঁর তৃতীয় ভাই গণেশ্বরের পুত্র রামদত্ত, বাজসনেয়ি অর্থাৎ শুক্ল যজুর্বেদ অনুগামীদের জন্য এক পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যা আজও মিথিলায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মূল ৷ গণেশ্বর বহু স্মৃতিগ্রন্থের প্রণেতা যার মধ্যে ‘সুগতি-সোপন’ অধিকাংশ মৈথিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আচার নির্দেশক প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে আজও স্বীকৃত ৷ বিদ্যাপতির পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্বান ছিলেন বীরেশ্বরের পুত্র চণ্ডেশ্বর ৷ তিনি ধর্ম বা স্মৃতি সার সংগ্রহ ‘রত্নাকর’ প্রণয়ন করেন যা সাতটি ভাগে বিভক্ত ৷ এই গ্রন্থটি আইন ও রীতিনতি বিষয়ক এবং গত ছয় শতাব্দী যাবৎ মিথিলার জনসাধারণের কাছে সর্বাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের স্বীকৃতি পেয়েছে ৷ সাতটি ‘রত্নাকর’ ছাড়াও চণ্ডেশ্বর ঐনবরাদের সমর্থনকল্পে ‘রাজ-নীতি-রত্নাকর’ রচনা করেন ৷ প্রথমে মিথিলাবাসীরা ঐনবরাদের গ্রহণ করেনি কারণ ঐনবরাদের ছিল যথেষ্ট দিল্লীশ্বর-ভক্তি এবং এই গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ ছিলেন বলে রাজ্যাভিষেকের যোগ্য ছিলেন না ৷ চণ্ডেশ্বর নিজের মতাদর্শ অনায়াস দক্ষতায় নবীন ও প্রাচীন তথ্যের সাহায্যে পরিবর্তনশীল -সমাজের উপযোগী করে প্রকাশ করেন ৷ চণ্ডেশ্বর বিদগ্ধ রাজপুরুষদের মধ্যে সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যিনি এই নবজাগরণের সময় জনজীবনের ধারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ আর এই নবজাগরণের যুগে বিদ্যাপতি এক দুর্লভ প্রতিভা যিনি শাশ্বত প্রেমের গায়ক ও পূজারী এবং একই সঙ্গে ব্যক্তি হিসেবে ও রাজপুরুষ হিসেবেও সর্বতোভাবে সফল ৷