বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত প্রাচীন পুরাণগুলি থেকে উপাদান নিয়ে রচিত এক বিরাট লৌকিক কাব্য কাহিনী। এ কাব্যের অপৌরাণিক অংশ কোনও খানেই এর পৌরাণিক গুরুত্বকে তরল হতে দেয়নি। বৌদ্ধ চর্যাপদগুলি ছাড়া আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যেটুকু সাহিত্যকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা তাদের মধ্যে প্রাচীনতম বলেই মনে করা হয়। এ কাব্যের রচনাকাল আনুমানিক ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ। সমস্ত কাব্যটি মোট ১৩টি খণ্ডে বিভক্ত।। জন্মখণ্ড, তাম্বূলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, যমুনান্তর্গত কালীয়দমনখণ্ড, যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ড, যমুনান্তর্গত হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহখণ্ড। এখানে এক এক করে প্রতিটি খণ্ডের নিবিড়পাঠ নেওয়া গেল।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল পাণ্ডুলিপির শুরুতেই প্রথম দুই পাতা পাওয়া যায়নি। কাব্যের পরবর্তী অংশের গঠন দেখে অনুমান করা যায়, সেই অংশে অন্তত চারটি পদ ছিলো। এরপর দেখছি, কংসের অত্যাচারে সৃষ্টি বিনাশ হতে চলেছে দেখে বসুন্ধরা স্বর্গের দেবতাদের কাছে গেলেন সাহায্য চাইতে। দেবতারা সকলে মিলে একটা সভা করলেন। সেই সভায় ঠিক হলো সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য অবিলম্বে কংসকে বধ করতে হবে। কিন্তু কি করে? উপায় খুঁজতে সকলে মিলে উপস্থিত হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা দেবতাদের সব কথা শুনে তাঁদের নিয়ে গেলেন নারায়ণের কাছে। এবার নারায়ণ দেবতাদের সমস্যার কথা শুনে মৃদু হাসলেন। তারপর একটি শ্বেত ও একটি কৃষ্ণকেশ তাঁদের হাতে দিয়ে তিনি বললেন, বসুলের অর্থাৎ বসুদেবের ঔরসে এবং দেবকীর গর্ভে হলী অর্থাৎ বলরাম ও বনমালী অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ-রূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে তিনি কংসাসুরের বিনাশ করবেন। একথা শুনে দেবতারা আশ্বস্ত হলেন এবং সেই শুভক্ষণের জন্য অপেক্ষা করবেন ঠিক করলেন।

এদিকে দেবতাদের এই শলা-পরামর্শ শুনে নারদ কংসের দরবারে গিয়ে সমস্ত কিছু সবিস্তারে জানালেন এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করে দিলেন যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভে যে সন্তান জন্মাবে সেই মহাবল বীর কংসের কালস্বরূপ, অর্থাৎ মৃত্যুর কারণ হবে। এই শুনে কংস তাঁর মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন যে, দেবকীর গর্ভে এখন থেকে আর কোনও সন্তানকেই বাঁচতে দেওয়া যাবে না। এই সমস্ত কথা শুনে নারদ এবার গেলেন বসুদেবের কাছে। সেখানে গিয়ে তিনি কংসের এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে বসুদেবকে সাবধান করে দিলেন। এবং এর সঙ্গে তিনি এও জানাতে ভুললেন না যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভে স্বয়ং নারায়ণ জন্ম নেবেন; তাই বসুদেব ও দেবকী যেন নিরন্তর সতর্ক থাকেন।
এরপর কংসের হাতে দেবকীর পর পর ছয়টি গর্ভ বিনষ্ট হলো। এই সময় দেবতারা সকলে মিলে দেবকীর গর্ভে নারায়ণের দেওয়া কেশ দুটি সংবিষ্ট করে দিলেন। শ্বেত কেশটি দেবকীর গর্ভে প্রবিষ্ট হয়ে মহাপরাক্রমশালী বলভদ্রের রূপ গ্রহণ করে জননীর গর্ভপাতের ছল করে রোহিণীর গর্ভে আশ্রয় নিলেন ও বলশালী বলরাম জন্ম নিলেন। অন্যদিকে দেবকীর উদরে অবস্থিত কৃষ্ণ কেশটি শ্রীকৃষ্ণের রূপ নিলো। আর এটাই দেবকীর অষ্টম গর্ভ জেনে কংসও তাকে বধ করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।

রোহিনীনক্ষত্রযুক্ত অষ্টমী তিথির এক বর্ষণমুখর অন্ধকার রাত্রে কৃষ্ণের জন্ম হলো। দেবতাদের সহায়তায় বসুদেব সেই রাত্রেই গোকুলে গিয়ে নিদ্রিতা যশোদার কোলে কৃষ্ণকে রেখে তাঁর সদ্যজাতা শিশুকন্যাটিকে নিয়ে এলেন। আর এই কন্যাটিকেই দেবকীর অষ্টম সন্তান ভেবে কংস শিশুটিকে পাথরে আছাড় মেরে হত্যা করলেন। তখন সেই কন্যা অন্তরীক্ষ থেকে বলে উঠলো, তোমাকে যে বধ করবে, সেই বালক গোকুলে নন্দরাজার গৃহে বেড়ে উঠছে। এই শুনে কংস গোকুলবাসী সেই নিতান্তই শিশুটিকে হত্যার উদ্যোগ নিলেন এবং সেই উদ্দেশে একে একে পুতনা, যমলার্জুন, কেশী, ইত্যাদি অসুরদের পাঠাতে থাকলেন গোকুলে। কিন্তু কৃষ্ণও একে একে সব অসুরদের সংহার করে অবলীলায় বেড়ে উঠতে লাগলেন। বত্রিশ রাজ-লক্ষণযুক্ত অনিন্দ্যসুন্দর অঙ্গে পীত বসন ও নানাবিধ অলংকার পরে বাঁশী হাতে বৃন্দাবনে গোরু চরানো তাঁর নিত্য কর্ম হয়ে উঠলো।

কৃষ্ণের সন্তুষ্টির জন্য দেবতাদের অনুরোধে লক্ষ্মী সাগর গোয়ালার ঘরে পদ্মার গর্ভে রাধারূপে জন্ম নিলেন। অপূর্ব সুন্দরী রাধা চন্দ্রকলার মতো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকলেন। দেবতাদের চক্রান্তে সময়কালে নপুংসক আইহনের সঙ্গে রাধার বিয়ে হলো। রাধার অনন্যসাধারণ রূপ ও উদীয়মান যৌবন দেখে আইহন নিজের মা’কে বলে রাধার মা, পদ্মার পিসি, বৃদ্ধা বড়াইকে রাধার দেখাশোনা করার ব্যবস্থা করলো। অনেক বয়স এই বড়াইয়ের। সাদা চুল, দু’পাশে কপাল ভাঙা। ভুরুও সাদা। চোখ কোটরে বসা। গাল তোবড়ানো, নাকের মাঝখান বসে গেছে, তোবড়ানো গালের হাড় উঁচু। উটের মতো ঠোঁট, বিকট দাঁত, কাঠির মতো সরু হাত। নাভিদেশ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে দুই স্তন। কথাবার্তা তার কপটতায় ভরা। ঘন ঘন কাশতে থাকে সে। এই হলো বড়াইয়ের বাইরের আকৃতি। বড়াইয়ের চেহারার এই বর্ণনা কাব্যের শুরুতেই দিয়েছেন কবি। এই জন্মখণ্ডের শেষ শ্লোকটিতে রাধা বড়াইকে ডেকে বলছেন, মধুর ব্যবহারে নিপুণা, ওগো বড়াই, তুমি যে আমার দেখাশোনা করতে এসেছো, সে আমার পরম ভাগ্য; চলো তোমার পরামর্শ মতো আমরা মথুরায় যাই। এইখানেই বড়ুচণ্ডীদাস রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রথম পর্ব তথা প্রস্তাবনা তথা জন্মখণ্ডের সমাপ্তি সূচীত হয়েছে। এই পর্বে প্রাপ্ত পদের সংখ্যা মোট ৯টি, রাগরাগিণীর সংখ্যা ৫টি। এর পরের পর্বটির নাম তাম্বূলখণ্ড।