মিথিলার মধ্যোত্তর যুগে যাঁরা রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে শিবসিংহ অন্যতম হলেও মিথিলার মধ্যযুগে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন নান্যদেব। তিনি কর্ণাট-দেশ থেকে এসেছিলেন ১0৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সীতামঢ়ী রেল স্টেশন থেকে খানিক আগে হচ্ছে কোইলি গ্রাম। এই গ্রামের কাছেই সিমরাওগড়ে রাজধানী স্থাপন করেন নান্যদেব এবং তাঁর বংশের লোকেরা। এদেশে তাঁরা দুশো উনত্রিশ বছর রাজত্ব করেন বলে শোনা যায়। এই বৃহদ্‌বংশের রাজত্বশেষে মিথিলার রাজত্বভার ক্ষত্রিয় শাসকদের হাত থেকে ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যায়। অবশ্য তার অন্যতম কারণ হল—সেই সময় মিথিলা দিল্লীর ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে চলে গিয়েছিল। সেটা ১৩২৬ সাল। ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন মিথিলা আক্রমণ করলেন কর্ণাটী নান্যদেবের শেষ বংশধর হরিসিংহদেব পালিয়ে গেলেন নেপালে। ফলে উত্তর বিহারের সবটাই ফিরোজ শাহ তুঘলকের দখলে চলে গেল। এর পরেই ‘ওইনি’ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশ ঘটল মিথিলার শাসনে। সিমরাঁওগড়ের রাজাদের ক্ষত্রিয়-শাসনের বিপ্রতীপে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন ওইনি-গ্রামের ওইনিবার ব্রাহ্মণরা। বংশসূত্রে ওইনি গ্রাম পেয়েছিলেন ওইনি ব্রাহ্মণ শ্রীনাথ ঠাকুর বা নাহ্‌ ঠাকুর। এই গ্রাম সমস্তিপুর জেলায়। ওইনিবার ব্রাহ্মণরা যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে দিন কাটালেও এঁরা যুদ্ধক্ষেত্রেও যে শক্তি দেখাতে পারতেন, সেটা স্বয়ং বিদ্যাপতি তাঁর কীর্তিলতা গ্রন্থে লিখেছেন—
ওইনি বংস পসিদ্ধ জগকো তসু করই ন সেব। (কীর্তিলতাপল্লব, ১.৬৩)
দুহু এক্কত্থ ন পাবিঅই্‌ ভুঅবই অরু ভূদেব।।
এখানে ‘ভুজবলী’ (ভুঅবই) যোদ্ধা আর ‘ভূদেব’ ব্রাহ্মণ এই শব্দ-দুটিতেই ওইনি ব্রাহ্মণদের চরিত্র বুঝিয়ে দেয়। গ্রামোপার্জক নাহ্‌ ঠাকুরের বংশে কামেশ্বর ঠাকুর ছিলেন রাজপণ্ডিত এবং অতি-সদাশয় সাধু মানুষ। কোন রাজার সভাপণ্ডিত তিনি ছিলেন, তা স্পষ্ট বলা মুশকিল, কিন্তু শোনা যায় যে, মিথিলার অরাজক অবস্থায় তিনি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফিরোজ শাহ তাঁকেই মিথিলা থেকে রাজকর আদায় করার ভার দেন এবং তাঁকেই করদ রাজা (vassal king) হিসেবে মিথিলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
কিন্তু কামেশ্বর ছিলেন সাধুপ্রকৃতির মানুষ। রাজ্য শাসনের সঙ্গে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করে সুলতানের কাছে পাঠানোর কাজটা তাঁর পক্ষে তেমন সহজ এবং সুখকর হয়নি। কামেশ্বর তাঁর পুত্র ভোগীশ্বরকে রাজ্যভার সঁপে দিয়ে মুক্ত হলেন।
ভোগীশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গণেশ্বর (গএনেশ) রাজা হন বটে, তবে সেই রাজ্যের খানিক অংশ পেলেন কামেশ্বর ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র ভবসিংহ বা ভবেশ্বর সিংহ। গণেশ্বর মূলবংশধারায় রাজা হবার পরেও অবশ্য খুব বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেননি। তিনি আসলান নামে এক তুর্কী রাজপুরুষের হাতে অকালে হত হন। গণেশ্বরের পর মিথিলা-ত্রিহূতে রাজা হন তাঁর পুত্র কীর্তিসিংহ। কীর্তিসিংহের কোনও পুত্রসন্তান ছিল না, এবং যেহেতু দুইভাই – যাদের মধ্যে বীরসিংহ আসলানের সঙ্গে যুদ্ধে যারা গিয়েছিলেন, তাঁরও কোনও পুত্রসন্তান ছিল না, ছোটভাই রাজসিংহেরও কোনও পুত্রসন্তান ছিল না; কীর্তিসিংহের পিতামহ গণেশ্বর সিংহের ভাই ভবদেবসিংহ কিছুদিন রাজত্ব করেন মিথিলায় এবং তাঁর পরে তাঁরই পুত্র দেবসিংহ মিথিলায় রাজা হন।
দেবসিংহ মহারাজের দুই পুত্র–শিবসিংহ এবং পদ্মসিংহ। বড়ো ছেলে বলেই শিবসিংহ সিংহাসনে বসেন এবং সম্ভবত সেটা দেবসিংহের গঙ্গাপ্রাপ্তি হবার পরপরই ১৪0২ সালে। ১৩৬২ সালে শিবসিংহের জন্ম হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা। বস্তুত এই ধারণা উমেশ মিশ্রের লেখা ‘বিদ্যাপতি ঠাকুর’ নামক একটি গবেষণা গ্রন্থ থেকে মেলে। উমেশ মিশ্র বই লিখেছিলেন ১৯৩৭ সালে। কিন্তু ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে বিমানবিহারী মজুমদার বহুল গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, শিবসিংহের পূর্বান্বয়ী রাজা কীতিসিংহই সম্ভবত ১৪0২ থেকে ১৪0৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো সময় রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেশীদিন রাজত্ব করতে পারেননি। অন্যদিকে কীর্তিসিংহের মৃত্যুর পর ভবেশ্বর বা ভবেশের বংশধর দেবসিংহ যে রাজা হলেন, সেই রাজা হবার সময়েই তিনি বৃদ্ধ জরাজীর্ণ। এই কথার প্রমাণ মেলে ‘রাজনীতিরত্নাকর’-এর লেখক চণ্ডেশ্বরের কথায়।

চণ্ডেশ্বর তাঁর এই রাজনীতি-বিষয়ক গ্রন্থখানি লিখেছিলেন দেবসিংহের পূর্বপুরুষ ভবেশের বা ভবেশ্বরের আজ্ঞায়। তিনি এই গ্রন্থের চতুর্দশ প্রকরণে ‘রাজকৃত-রাজদান’-শীর্ষক রচনায় লিখছেন –দেবসিংহ যখন রাজা হন, তখনই তিনি জরাযুক্ত, রোগার্ত এবং রাজ্য পালনের বিষয়ে নিস্পৃহ ছিলেন। মৃত্যুর আর খুব বেশী দেরী নেই বুঝে তিনি পৌরজন এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে কুলধর্মপালনের তাগিদে জ্যেষ্ঠপুত্র শিবসিংহকে রাজ্যদান করেন। চণ্ডেশ্বর পরিষ্কারভাবে লিখেছেন —

যদা রাজা জরাযুক্তো রোগার্তো নিস্পৃহো’পি চ।
আসন্নমৃত্যুং বিজ্ঞায় কুলধর্মং বিচারয়ন্।।
তদা পৌরজনান্ সর্বান্‌ আহূয় মন্ত্রয়েচ্চ তৈঃ।
সপ্তাঙ্গানি চ রাজ্যানি জ্যেষ্ঠপুত্রায় দাপয়েৎ।।

পারিবারিক সম্বন্ধে দেবসিংহ কীর্তিসিংহের খুড়তুতো কাকা। তিনি যখন সিংহাসনে বসছেন, তখনই তিনি বৃদ্ধ জরাতুর এবং নানা রোগাক্রান্ত ফলত রাজ্যবিষয়েও নিম্পৃহ। সেইজন্যই অল্প কিছুদিন রাজত্ব করার পরেই তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র শিবসিংহের ওপর রাজ্যের ভার দেন। হয়তো এই তথ্য থেকেই বৈরাগ্যবান নরপতির নৈমিষারণ্য-বাসেরও একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। হয়তো বা এইজন্যই বিদ্যাপতির ভূপরিক্রমা গ্রন্থে একই শ্লোকের মধ্যে নৈমিষারণ্যবাসী দেবসিংহের নির্দেশে বিদ্যাপতি গ্রন্থ লিখছেন বটে, কিন্তু ততদিনে শিবসিংহ রাজার আসনে প্রায় বসে পড়েছেন বলেই শ্লোকের মধ্যে দেবসিংহের আর একটা বড়ো পরিচয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, তিনি শিবসিংহের পিতা।

বিদ্যাপতি তাঁর ‘পুরুষপরীক্ষা’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থটির রচনা আরম্ভ করেন সম্ভবত কীর্তিসিংহের আমলে। কেননা গ্রন্থশেষে এখানেই তিনি কীর্তিসিংহের পূর্বরাজা ভবদেব সিংহের স্বর্গপ্রয়াণের কথা লিখছেন, কিন্তু পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থটি তিনি শেষ করেছেন শিবসিংহের আমলে, অথচ তখনও কিন্তু শিবসিংহের পিতা জীবিত কিন্তু ততদিনে রাজশাসন তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। নইলে এমন কথা কবি লিখতেন না যে, তাঁর (শিবসিংহের) পিতা কিন্তু এখনও এই ধরাধামে বেশ উজ্জ্বলভাবে বসবাস করছেন —

ভাতি যস্য জনকো রণজেতা দেবসিংহ-নৃপতিঃ।

চণ্ডেশ্বর তাঁর রাজনীতি-রত্নাকর গ্রন্থে একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দেবসিংহের জীবৎকালেই শিবসিংহের রাজা হয়ে যাবার বৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁর রাজ্যভিষেকের সাধারণ ব্যবস্থার কথা লিখেছেন । বলেছেন–রাজা কুমারকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁর কপালে রাজতিলক এঁকে দিয়ে বলবেন– আজ থেকে এই রাজ্য আর আমার নয়, এই রাজা এখন থেকে প্রজাদের রক্ষা করবেন —

অদ্যারভ্য ন মে রাজ্যং রাজায়ং রক্ষতু প্রজাঃ।
ইতি সর্বপ্রজাবিষ্ণুং সাক্ষিণং শ্রাবয়েন্মুহুঃ।।

চণ্ডেশ্বর বৃদ্ধ জরাতুর রাজাদের যা করা উচিত, তার উদাহরণ দেবসিংহের আচরণের মধ্যে প্রত্যক্ষ দেখতে পেয়েছিলেন বলেই ভবদেবের আদেশে লেখা রাজনীতিরত্নাকরে চণ্ডেশ্বর দেবসিংহের ব্যবহারটুকু বিধি হিসেবে অর্থাৎ বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত রাজাদের উচিত কার্য হিসেবে সাধারণ নির্দেশ দিয়েছেন।

পণ্ডিত-গবেষকরা শিবসিংহের সিংহাসন-লাভের সময়টা মনে করেন ১৪১0 খ্রিষ্টাব্দ। কেননা সেখানে প্রায় অকাট্য একটা প্রমাণ পাওয়া যায় তর্কাচার্য শ্রীধর ঠাকুরের লেখা কাব্যপ্রকাশ-বিবেক নামে একটি টীকা থেকে। সবচেয়ে বড়ো কথা শ্রীধর শিবসিংহের কাল উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে কবি বিদ্যাপতি নামও করছেন যথেষ্ট গৌরবের সঙ্গে, কেননা মম্মটাচার্যের লেখা কাব্যপ্রকাশের ওপর টীকাটা তিনি লিখছেনই বিদ্যাপতির আজ্ঞায়।

সেকালের দিনে অনেকেই এমনটা করেছেন। মম্মটের কাব্যপ্রকাশ একটি রসশাস্ত্রীয় গ্রন্থ-কাশ্মীরী আলংকারিকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের ওপর অনেক নৈয়ায়িক-তার্কিকেরাই টীকা লিখতে প্রলুব্ধ হয়েছেন। শ্রীধর তর্কাচার্যও তাই। কিন্তু আমাদের কাছে ঠক্কুর শ্রীধর এইজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি তাঁর টীকাগ্রন্থ কাব্যপ্রকাশ -বিবেক লিখছেন–যখন শিবসিংহ নৃপতি গজরথপুরে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে রাজ্যশাসন আরম্ভ করেছেন এবং বিদ্যাপতির মতো এক সদুপাধ্যায়ের নির্দেশে তিনি গ্রন্থ লিখতে আরম্ভ করছেন–

সমস্ত-বিরুদাবলী-বিরাজমান-মহারাজাধিরাজ-শ্রীমৎ শিবসিংহদেব-সংভুজ্যমান-তীরভুক্তৌ শ্রীগজরথপুর-নগরে সপ্রতিষ্ঠ-সদুপাধ্যায়- ঠক্কুর-শ্রীবিদ্যাপতীনাম্‌ আজ্ঞায় …।

এই পুঁথির শেষে লিখিত তারিখ হল ২৯১ লক্ষ্মণ সংবৎ অর্থাৎ ১৪১0 সাল। তবে কিনা ‘তীরভুক্তি’র শাসন ভোগ করছেন এই সময়ে ‘সংভুজ্যমানে তীরভুক্তৌ’– এই ঘটমান বর্তমানের প্রয়োগ থেকে মনে হয়, শিবসিংহ আরও দু-তিন বছর আগেই বৃদ্ধ পিতার রাজ্যভার নিজের হাতে পেয়ে গেছেন। বিদ্যাপতিও তত দিনে রাজা শিবসিংহের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছেন এবং এতটাই যে তাঁর আজ্ঞায় ঠক্কুর শ্রীধর গ্রন্থ লিখছেন ।

১৪১0 খ্রিষ্টাব্দেই হোক অথবা তার কিছু পূর্ব থেকেই শিবসিংহ রাজত্ব আরম্ভ করে থাকুন, আমাদের কাছে এটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি রাজা হবার পরেই বিদ্যাপতিকে একেবারে নিজের পাশে নিয়ে নিয়েছেন। কথাটা বিদ্যাপতি নিজেই বলেছেন নিজের পিতৃপরিচয় এবং দেশনাম জানাবার সময়–

জন্মদাতা মোর গণপতি ঠাকুর, মিথিলা দেশ করু বাস।
পঞ্চগৌড়াধিপ সিবসিংহ ভূপতি, কৃপা করি লেল নিজ পাস।।

কামেশ্বর বংশের অধস্তন অনেক রাজারই সহায়তা এবং পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন বিদ্যাপতি, কিন্তু শিবসিংহের মতো সহৃদয় অনুরাগ তিনি কারও কাছে পাননি। বিদ্যাপতি অবশ্য সেই ঋণ অনেকটাই প্রতিশোধ করে দিয়েছেন রাজার প্রতিপদ-প্রশংসায়।

বিদ্যাপতির একটি অবহঠ্‌ঠি কবিতা থেকে জানতে পারি যে, দেবসিংহের মৃত্যুর পরপরই শিবংসিংহের রাজত্বকালে মিথিলা-তীরভুক্তিতে যবন আক্রমণ হয়েছিল। বস্তুত শিবসিংহের রাজত্বকালে দিল্লী, বাংলা এবং জৌনপুরে চরম রাজনৈতিক সংকট চলছিল, ফলত এই আক্রমণও অসম্ভাব্য ছিল না। বিদ্যাপতি লিখেছেন–রাজা শিবসিংহ পিতার অন্ত্যেষ্টিও সামলালেন দক্ষ হাতে অন্য দিকে মুসলমানদের আক্রমণও প্রতিহত করলেন শক্ত হাতে–

দুহুত্র দলহি মনোরথ পূরঅো।
গরুঅ দাপ সিবসিংহ করূ।।

শিবসিংহ রাজা হিসেবে যথেষ্ট পরাক্রমশালী ছিলেন এবং তিনি কোনোভাবেই দিল্লী কিংবা জৌনপুরের সামন্ত রাজা হিসেবে রাজত্ব করতে চাননি। এটাও অবশ্য ঠিক যে, হয়তো তাঁর এই স্বাধীনতার মধ্যে কিছু সত্য ছিল, কেননা দিল্লী কিংবা বাংলায় তখন যে মুসলমান রাজারা রাজত্ব করছিলেন, তাঁদের নিজেদেরই স্থায়িত্ব নিয়ে নানান সংশয় ছিল। এখানে বিদ্যাপতির বয়ানগুলিতে এবং পূর্ববর্তী চণ্ডেশ্বরের বর্ণনায় যে কথাগুলি বলা হয়েছে, তার মধ্যেও কিছু বিচার্য্য বিষয় আছে বলে আমরা মনে করি।

বিদ্যাপতি এবং শিবসিংহ

প্রথম জায়গাটা হল–বিদ্যাপতি তাঁর পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থের অন্তে লিখেছেন –যে, পিতা দেবসিংহের রাজ্যাধিকার চলাকালীন সময়েই শিবসিংহকে রাজা বলা হত–ভাতি যস্য জনকো রণজেতা দেবসিংহ-নৃপতিঃ। দ্বিতীয় তথ্যটা হল –বিদ্যাপতি তাঁর অন্যতম গ্রন্থ শৈবসর্বস্বসারে লিখেছেন –শিবসিংহ তাঁর আপন পরাক্রমে গৌড় এবং গজ্জন রাজাকে নম্রীকৃত করেছিলেন–

শৌর্যাবর্জিত-গৌড়-গজ্জন মহীপালোপনম্রীকৃতা।

স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় তথ্য নিয়েই প্রশ্নটা উঠেছে যে, কে সেই গৌড়ের রাজা আর কেই বা সেই গজ্জনের রাজা, যাঁদের নম্রীকৃত করেছিলেন শিবসিংহ । আবার এই শৌর্য-পরাক্রমের প্রতিতুলনায় আর একটি জনপ্রবাদ আছে যে, শিবসিংহকে কোন এক দিল্লীর সুলতান বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বিদ্যাপতির জন্যই তিনি নাকি মুক্তি পান আমাদের দৃষ্টিতে তৃতীয় প্রাবাদিক সংবাদ প্রথমেই মীমাংসিত হওয়া উচিত।

বস্তুত এটা যদি সত্য এক প্রবাদই হয়, তাতে এটা বেশ পরিষ্কার যে, শিবসিংহ পরাক্রমশালী পুরুষ ছিলেন এবং তিনি পিতার রাজ্যের ওপর মুসলমানদের আধিপত্য সইতে পারতেন না। তাঁর এই প্রতিবাদী এবং পরাক্রমী ভূমিকাতে ক্ষুব্ধ হয়েই তৎকালীন দিল্লীর মুসলমান শাসক মিথিলা আক্রমণ করেন এবং দেবসিংহ পরাজিত হন। দেবসিংহ অবশ্য মুসলমান শাসকের আধিপত্য স্বীকার করে নিয়ে সাময়িকভাবে সামন্ত রাজার অধিকার ফিরে পান। কিন্তু শাসকের বুদ্ধিতে দিল্লীর শাসক সুলতান এটা বুঝতে পারেন যে, যত সমস্যার মূলে এই শিবসিংহ। তাঁরা শিবসিংহকে বন্দি করে দিল্লী নিয়ে যান।

বিদ্যাপতির কানে এই খবর এল এবং শিবসিংহ যেহেতেু তাঁর পরম প্রিয় সখা এবং পৃষ্ঠপোষক, তাই তিনি বসে থাকতে পারলেন না। তিনি দিল্লী গিয়ে বাদশার সঙ্গে দেখা করলেন। দূর মিথিলা থেকে দিল্লী, কাউকে চেনেন না। তাঁর সম্বল শুধু বিদ্যা আর কবিপ্রতিভা। বাদশার কাছে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন এবং তাঁকে প্রসন্ন করার পথ খুঁজে বললেন– দেখুন মহারাজ! আমি না-দেখা জিনিসকে দেখার মতো করে বর্ণনা করতে পারি। বিদ্যাপতির পরীক্ষা আরম্ভ হল। বাদশা বললেন –একটি সদ্যস্নাতা রমণীর বর্ণনা করো দেখি! বিদ্যাপতি বললেন–

কামিনি করএ সনানে
হেরিতহি হৃদয় হনএ পঞ্চবানে।
চিকুর গরত্র জলধারা
জনি মুখ-সসি ডর রোঅএ অঁধারা।
কুচযুগ চারু চকেবা
নিঅ কুল আনি মিলায়ত কোনে দেবা।
তেঁ সঁকাঞে ভুজ পাসে
বাঁধি ধএল উড়ি জাএত আকাসে।
তিতল বসন তনু লাগএ
মুনিহুক মানস মনমথ জাগএ।
ভনই বিদ্যাপতি গাবএ
গুনমতি ধনি পুনমত জনি পাবএ।

এই পদের মেটামুটি অর্থ দাঁড়ায় এই রকম — রমণী স্নান করছে। তাকে দেখামাত্রই ভালবাসার দেবতা ফুলশরে আঘাত করেন যেন। দুরন্ত কেশপাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল, যেন মুখচন্দ্র অন্ধকারে কাঁদছে। রমণীর পীন পয়োধর যুগল যেন অনবচ্ছিন্ন চক্রবাক পক্ষী। তাদের বাহুপাশে বাঁধতে গেলেই আকাশে উড়ে যায়। ভেজা কাপড় লেপটে আছে গায়ে। দেখে মুনিদের মনেও কামনা তৈরী হয়। বিদ্যাপতি ভণিতা করে গাইছে–কোনো দিন কী এমন গুণবতী রমণী পাওয়া যাবে ?

কবিতা শুনে সুলতান খুশী হলেন বটে, কিন্তু পুরোপুরি তাঁর মন ভরল না। ফলত দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল তাঁকে। এবার বিদ্যাপতিকে একটা কাঠের সিন্দুকের মধ্যে পুরে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হল কুয়োর মধ্যে। সে কাঠের সিন্দুকের মধ্যে ফাঁকফোকর ছিল যথেষ্ট। এবার বিদ্যাপতিকে বলা হল– কুয়োর ভিতর থেকে তুমি ওপরে যা দেখতে পাবে, তাই তুমি বর্ণনা করবে। বিদ্যাপতি অপেক্ষা করছেন, এমন সময় সুন্দরী রমণী সেই কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে পড়ে হাতে রাখা কিছুর ওপর ফুঁ দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছিল। বিদ্যাপতি দেখতে পেলেন। তাঁর কবিকণ্ঠে কথা শুরু হল এবার। তিনি বললেন —

সুন্দরি নিহুরি ফুকু আগি।
তোহর কমল ভমর মোর দেখল
মদন উঠল জাগি।

সুন্দরী! একটু দেখেশুনে আগুন ফুঁ দাও। তোমার কমল কলি এবং ভ্রমর দুটোই আমি দেখে ফেলেছি, আমার ভিতরে কামনা জেগে উঠছে।

এখানে ‘কমল’ শব্দের ব্যঞ্জনায় রমণীর পীন পয়োধরের ব্যঞ্জনা এবং ভ্রমর-ব্যাজ্যে চঞ্চল চক্ষুর ব্যঞ্জনা শুনেই বাদশা অবহিত হয়ে বসলেন। তারপরেই বিদ্যাপতি বললেন — সুন্দরী! কেউ যদি কোনো সময় তোমার ঘরে যায় এবং তোমার দিকে একবার তাকিয়ে তারপরও যদি সে সংকট থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরতে পারে, তাহলে….

জোঁ তেহিঁ ভামিনি ভবন জএবহ
এবহ কোনহ বেলা ।
জোঁ ই সংকট সঞোঁ জী বাঁচত
হোয়ল লোচন মেলা।

বাদশা এইটুকু শুনেই বিদ্যাপতির কবিত্বের পূর্ণআস্বাদন পেয়ে গেলেন। কবিতার মাধুর্যে আপ্লুত বদশা বিদ্যাপতির কারণেই রাজা শিবসিংহকে মুক্ত করে দিলেন। বিদ্যাপতি মুগ্ধ হয়ে বাদশাকে সম্বোধন করেই নিজের নাম জুড়ে বললেন-বিধাতা যখন যেমন চান, তিনি সেই সেই লীলা করতে পারেন তখন, তখনই। রাজা শিবসিংহের বাঁধন ঘুচেছে, মুক্তি পেয়েছেন তিনি, তাই এখন বেঁচে আছে কবি বিদ্যাপতি–

ভন বিদ্যাপতি চাহথি জে বিধি
করথি সে সে লীলা।
রাজা সিবসিংহ বন্ধন মোচন
তখন সুকবি জীলা।

মুসলমান বাদশার হাত থেকে শিবসিংহের এই বন্ধন-মোচনের কাহিনী পণ্ডিত-গবেষকেরা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। বিশেষত পণ্ডিত বিমানবিহারী মজুমদার সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সৈয়দ বংশের শাহ আলমকে নির্দিষ্ট করেছেন। বলেছেন –শাহ আলমের মতো অপদার্থ সম্রাট জৌনপুরের সামন্তরাজ্য ত্রিহুতের অধিপতি শিবসিংহকে বন্দি করে নিয়ে যাবেন আর বিদ্যাপতি পদ রচনা করে তাঁকে মুক্ত করবেন, এটা অসম্ভব।

এখানে একটা কথাই বলার আছে। সেটা হল– বিমানবিহারী নিজেই যেখানে অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে শিবসিংহের রাজত্বকাল মোটামুটি ১৪১0 থেকে ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্তবর্তী সময়ের মধ্যে ধার্য করেছেন, সেখানে ১৪৪৪ থেকে ১৪৫১ সালের সাহ আলমের সময় ধরে তাঁর এত বিচার-আচারের প্রয়োজন ছিল না। এই প্রত্যাখ্যান-ভাবনা কি, শুধু এইজন্যই যে, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত জনৈক ব্রজবুলিতে লেখা একটি পদের ভণিতায় জনৈক শাহের নাম উদ্ধার করছেন। বলে-

দস অবধান ভন/ পুরব পেম গুণি/ প্রথম সমাগম ভেলা।
আলম সাহ প্রভু / ভাবিনি ভজিরহু / কমলিনি ভমর ভুললা।।

এই পদ থেকেই নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় বিদ্যাপতির অন্য নাম ‘দশাবধান’ হতে পারে বলে জানিয়েছেন এবং সেই দশাবধানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আলম শাহের নামও করেছেন।

আমাদের বক্তব্য হল– শিবসিংহ তো দূরের কথা, অতি-দীর্ঘজীবী বিদ্যাপতিও এই আলম শাহের কাল পর্যন্ত কতটা সক্রিয় ছিলেন? তাহলে বিমানবিহারী এই আলম শাহ কিংবা পদাবলীকার দশাবধানকে নিয়েই বা এত মাথা ঘামিয়েছেন কেন! আর যদি বা একজন আলম শাহ থেকেই থাকেন তাহলে তিনিই শিবসিংহকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বিদ্যাপতি পদরচনা করে তাঁকে মুক্ত করে আনেন, এটা ভাবারই বা প্রয়োজন কী ! এটা ধরেই নেওয়া যায় বিদ্যাপতির খ্যাতির নিরিখে কোনো এক দশাবধানে কবির অনুকরণে পদ লিখে কোনো এক আলমশাহকে খুশী করার চেষ্টা করেছেন বহুকাল পরে। আর বিদ্যাপতি যদি দশাবধান হতেন তাহলে তাঁর এতগুলি রচনার মধ্যে কোথাও না কোথাও তাঁর এই নামের উল্লেখ থাকত। হয়তো বা আছেও, তাতেই বা কী?

কিন্তু একই সঙ্গে জানাই যে, আমরা যারা বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার মধুরতায় নষ্টচৈতন্য হয়ে গেছি, তারা এই প্রবাদটাকেও অস্বীকার করতে চাইনা। কোন মুসলমান শাসক শিবসিংহকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার নাম তো কেউই জানে না, কিন্তু তিনি বিদ্যাপতির গীতি শুনে তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবংসিংহকে মু্ক্তি দিলেন, এ-কথা বিদ্যাপতির গরিমায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।

তবু এখন একটু ইতিহাসের পড়াশুনোটা করতে হবে। প্রথমে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে, মিথিলা-ত্রিহুত রাজ্যখানি অনেক কাল ধরেই জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শর্কির সামন্তপনা করে গেছে এবং রাজকর দিয়ে গেছে চিরকাল। কিন্তু দেবসিংহ রাজা হিসেবে শাসন করার সময়েই যখন শিবসিংহ প্রায় রাজা অথবা রাজাপ্রতিম প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, তখনই একটা সময় তিনি মুসলমান শাসকদের আধিপত্য সহ্য করতে না পেরে রাজকর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল- শিবসিংহের স্বনামে লিখিত মুদ্রা।

বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন — বিদ্যাপতি তাঁর একটি লিখিত পদে জনৈক ‘গ্যাসদীন সুরতান’-কে ভণিতায় ব্যবহার করে লিখেছেন —

বিদ্যাপতি কবি ভান
মহলম জুগপতি চির জিব জিবথু
গ্যাসদীন সুরতান।
(বিদ্যাপতি পদাবলী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সংস্করণ, পদসংখ্যা ২৬৮)

বিমানবিহারীর মতো অনেক পণ্ডিতই মনে করেন যে, এই ‘গ্যাসদীন সুরতান’ বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সফলতম সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ। বিমানবিহারী কোনো প্রমাণ-ট্রমান বেশী দেননি, কিন্তু এটা বড়ই সত্য কথা যে, বাংলার গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের সঙ্গে ইরানের শিরাজ শহরের কবি হাফিজের যোগাযোগ ছিল। হাফিজ তাঁর কবিতা বাংলার নাম উল্লেখ করে গিয়াসুদ্দিনের সাংস্কৃতিক মনের উচ্চতা স্থাপন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই মৈথিল বিদ্যাপতির কবিতায় গিয়াসুদ্দিনের নামাঙ্কিত ভণিতা থাকা খুব স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক এই কারণে যে গিয়াসুদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সৈফুদ্দিন হমজা শাহ যে বছরে (১৪১0-১৪১১) সিংহাসনে বসেন, মিথিলায় শিবসিংহও সিংহাসনে বসেন সম্ভবত সেই বছরেই। বিমানবিহারীর মত-সাম্যেই এ-কথা বলা যায়।

শিবসিংহ আনুষ্ঠানিক রাজা হবার পূর্বকাল থেকেই যখন পিতার রাজ্য সামলাচ্ছিলেন, সেই সময়ে বাংলার গিয়াসুদ্দিনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ অসম্ভব ছিল না এবং সেই সূত্রে বিদ্যাপতির পক্ষেও গিয়াসুদ্দিনের দীর্ঘ জীবন কামনা করাটাও অস্বাভাবিক ছিল না। কেননা গিয়াসুদ্দিন আজম সাহ কবি-সহৃদয় ব্যক্তি ছিলেন এবং বিদ্যাপতির মতো এক মহাকবির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল।

গিয়াসুদ্দিনের পুত্র সৈফুদ্দিন হামজা শাহ গৌড়-বাংলার শাসক হলেন বটে, কিন্তু ইলিয়াস শাহী বংশের পূর্বের তিন সুলতানের মতো তিনি অতটা শক্তিশালী না হলেও তাঁর সময়টা যখন ভালই চলছে, তখন মিথিলায় তাঁর সমসাময়িক শিবসিংহ কিন্তু খুব শান্তিতে ছিলেন। কিন্তু নিজ রাজ্যে জৌনপুরের অলক্ষ্য শাসন মেনে নিয়ে ইব্রাহিম শর্কিকে রাজকর দেওয়াটা তিনি পছন্দ করেননি বলে রাজকর দেওয়া তিনি আগেই বন্ধ করেন। তার মধ্যে নিজের নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করার ফলে ত্রিহুতের মতো সামন্ত-রাজ্যের ওপর ইব্রাহিম শর্কির রোষ সৃষ্টি হয়।

ওই যে বিখ্যাত প্রবাদ – বিদ্যাপতি কবিতার পদ শুনিয়ে শিবসিংহকে বন্ধনমুক্ত করে এনেছিলেন , এটা সম্ভবত ওই প্রথম দফায় যখন তিনি সামন্ত রাজা হিসেবে রাজকর দেওয়া বন্ধ করেন ইব্রাবিম শর্কিকে। হয়তো বা তখনও তাঁর পিতা দেবসিংহ জীবিত ছিলেন এবং বকলমে রাজত্ব করছিলেন শিবসিংহই। প্রবাদোক্ত ওই সুলতান যে জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কি, তাতে আমাদের সন্দেহ থাকে না। বিদ্যাপতি পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থে লিখেছেন — শিবসিংহ গৌড়েশ্বর এবং গজ্জনেশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে যশ লাভ করেছিলেন —

যো গৌড়েশ্বর-গজ্জনেশ্বর-রণ ক্ষৌণিষু লব্ধা যশঃ।

বিদ্যাপতি তাঁর শৈবসর্বস্বসারে পুনরায় এই গৌড়েশ্বর-গজ্জনেশ্বরের কথা লিখেছেন এবং সেখানে তাঁর উক্তিটি আরও বেশী প্রশস্তিমূলক –অর্থাৎ গৌড়েশ্বর আর গজ্জনেশ্বর এখানে শিবসিংহের দ্বারা নম্রীকৃত–

শৌর্যাবর্জিত-গৌড়-গজ্জন-মহীপালোপনস্রীকৃতান্

কবি হিসেবে এই দুই তথ্যনিবেদনের মধ্যে বিদ্যাপতির শব্দবন্ধের তীক্ষ্মতা প্রথমটির চাইতে দ্বিতীয়টিতে বেশী। প্রথমটিতে ব্যাপারটা এইরকম যে, গৌড়েশ্বর এবং গজ্জনেশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে কীর্তি লাভ করেছিলেন শিবসিংহ। শিবসিংহের প্রতি এই প্রশংসা-বাক্যের মধ্যে বিদ্যাপতির কবিজনোচিত অতিশয়োক্তি কিছু আছেই, কেননা গৌড়ের কোনো সুলতান বা হিন্দু রাজার সঙ্গে শিবসিংহের কোনো যুদ্ধ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু গৌড়দেশের কোনো শাসক যে তাঁকে আক্রমণ করেননি–এই সত্যের মধ্যে তাঁর গৌড়জয়ের তাৎপর্য আছে। বিশেষত কোনে এক গৌড়েশ্বরকে তিনি যুদ্ধ সহায়তা করেছেন– এই ঐতিহাসিক সত্যটাই হয়তো গৌড়েশ্বরকে নম্রীকৃত করার তাৎপর্যে গ্রহণ করা যায়।

অতএব সোজাসুজি গজ্জনেশ্বরের কথায় অসি। ‘গজ্জনমহীপাল’ বা ‘গজ্জনেশ্বর’ বলতে বিদ্যাপতি জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কিকেই বুঝিয়েছেন, সেকথা প্রমাণ করে দিয়েছেন ‘বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর-এর লেখক অধ্যাপক সুখময় মুখোপাধ্যায়। তিনি বিদ্যাপতির প্রায় সমসাময়িক কালে লেখা সঙ্গীতশিরোমণিনামে একখানি গ্রন্থের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থের আরম্ভে ইব্রাহিম শর্কি সম্বন্ধে যে প্রশস্তি আছে, সেখানে তাঁর নামের সঙ্গে ‘গজ্জন’- শব্দের প্রাকৃত রূপ ‘গাজন’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। কোনো ভাবে সুলতান মামুদ শাহের রাষ্ট্র ‘গজনী’-র সঙ্গে ইব্রাহিম শর্কির বংশগত যোগাযোগ ছিল। সেই গজনীর আরোপ ঘটেছে জৌনপুরের ওপর। লক্ষণীয়, বিদ্যাপতি এই গজনীকে সংস্কৃতায়িত করে ‘গজ্জন’ আখ্যা দিয়েছেন, আর সঙ্গীত শিরোমণির রচয়িতা সেটাকে প্রাকৃতায়িত করে বলেছেন ‘গাজন’–

আদক্ষিণোদধেরা চ হিমাদ্রেরা চ গাজনাৎ।
আগৌড়াদুজ্জ্বলং রাজম্ ইব্রাহিমভূভুজঃ।।

বিদ্যাপতি যেখানে শুধু তথ্যনিবেদনের জন্য একবার লিখেছেন —

গৌড়-গজ্জনের সঙ্গে যে যুদ্ধে শিবসিংহ যশলাভ করেছিলেন, সেই যুদ্ধতেই মনে হয় ইব্রাহিম শর্কি নিজে না আসলেও, তাঁর লোকজন সৈন্য-সেনাপতি শিবসিংহকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল । পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থটি শিবসিংহের রাজত্বকালের মধ্যে লেখা। ফলে ইব্রাহিম শর্কির সঙ্গে এই প্রথম মুখোমুখি হওয়ার সংগ্রামটাকেই বিদ্যাপতি খানিক অতিশয়িনী প্রশস্তিতে উচ্চারণ করেছেন। বিশেষত এইবারই হয়তো বিদ্যাপতি ইব্রাহিমকে পদগীতিমাধুরীতে তুষ্ট করে শিবসিংহকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন এবং হয়তো বা এই সময়েই প্রতিবাদী শিবসিংহের পরিবর্তে তাঁর পিতা দেবসিংহের হাতে ত্রিহুতের শাসনভার সমর্পণ করেছিলেন ইব্রাহিম শর্কি।

কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটে থাকবে ৮0৫ হিজরায় অর্থাৎ ১৪0২ সালে এবং এটা প্রমাণ করেছেন সুখময় মুখোপাধ্যায়। তাঁর যুক্তি হল– ইব্রাহিম শর্কি দুবার ত্রিহুত আক্রমণ করেছিলেন। প্রথমবার ১৪0২ সালে এবং দ্বিতীয় বার ৮১৮ হিজরায় অর্থাৎ ১৪১৩ সালে। এটা বিশ্বাস করার কারণ আছে। কেননা ১৪0১-১৪0২ খ্রিষ্টাব্দেই ইব্রাহিম শর্কি তাঁর ভাই মুবারক শাহের মৃত্যুর পর জৌনপুরের সুলতান হন এবং এ-ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের স্পষ্ট মত জানা গেছে। আর ইব্রাহিম হলেন সেই শক্তিমান মানুষ, যিনি টানা ৪৩ বছর রাজত্ব করছেন জৌনপুরে। ইসলাম ধর্মের পরিপোষক তো বটেই একজন সংস্কৃতিবান শাসক হিসেবেও তাঁর সুনাম হয়েছিল। ফলে প্রথম সেই ১৪0১ সালে প্রথম সুলতান হবার পর ইব্রাহিম শর্কির সাংস্কৃতিক দুর্বলতায় আঘাত করে বিদ্যাপতির পক্ষে বন্ধু শিবসিংহকে মুক্ত করে আনাটা খুব কঠিন হলেও অসম্ভব হয়নি হয়তো।

১৪0১/১৪0২ সালে ইব্রাহিম শর্কির জৌনপুরের সুলতান হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক সত্যটি এই মতও স্পষ্ট করে দেয় যে, ২৫২ লক্ষণাব্দে অর্থাৎ ১৩৭১ সালে কীর্তিসিংহের আসলান-প্রশমনের ক্ষেত্রে ইব্রাহিম শর্কি তো নয়ই, শর্কিবংশের কোনো প্রপিতামহও ছিলেন না, যিনি তাঁকে আসলান-বিজয়ে সাহায্য করে থাকতে পারেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতির লক্ষ্মণসংবৎ ২৫২ সংখ্যাটাকে যেহেতু আমরা কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারি না, তাহলে কী করে বিমানবিহারী মজুমদারের মতো প্রাজ্ঞ পণ্ডিতের এই মত মেনে নিই যে, ‘কীর্তিসিংহ ১৪0২ হইতে ১৪0৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো সময় রাজা হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি বেশীদিন রাজ্যভোগ করিতে পারেন নাই। কেন না ১৪১0 খৃষ্টাব্দে আমরা শিবসিংহকে তীরভুক্তি বা ত্রিহুতের মহারাজাধিরাজরূপে দেখিতে পাই।’

বিমানবিহারী একটি সৎ প্রমাণ দেবার সমস্যায় পড়েছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর সমস্যা তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন এইখানে যে, তিনি কীর্তিসিংহ এবং আসলানের সংঘর্ষের কাহিনীতে ইব্রাহিম শর্কির উপস্থিতি ধরেই নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি একদিকে ১৩৭১-৭২ এ গণেশ বা গণেশ্বরের মৃত্যুর পর বিদ্যাপতির কীর্তিলতায় বর্ণিত অরাজকতার বিবরণটিকে একটা বৃহৎ সময় – প্রায় ১৩৭১ থেকে ১৪0২ পর্যন্ত সময় ধরে নিজেই সন্দেহ করে বললেন — ”১৩৭২ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৪0২ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত এই ত্রিশ বৎসর মিথিলার অবস্থা কিরূপ ছিল ? কীর্তিলতায় দেখা যায় যে এ সময়ে মিথিলায় অরাজকতা দেখা দিয়াছিল–

ঠাকুর ঠক ভএ গেল, চোবেঁ চপুবি ঘর লিজ্‌ঝিঅ।
দাসে গোসাঞ নিগহিঅ, ধম্ম গএ ধন্ধ নিমজ্জিঅ।।
খলে সজ্জন পবিভবিঅ কোই নহি হোই বিচারক।
জাতি অজাতি বিবাহ, অধম উত্তম কাঁ পারক।।
অখ্‌খর–বস বুঝঝ নিহার নহি,
কই কুল ভমি ভিখ্‌খারি ভঁউ।
তিবহুত্তি তিরোহিত সব্বগুণে,
রাএ গএণেস জবে সগ্‌গ গঁউ।।

অর্থাৎ ঠাকুর বা সম্ভ্রান্ত লোক (barons)ঠক বা প্রবঞ্চক হইল; চোর ঘর দখল করিল। দাস প্রভুকে নিগৃহীত করিল; ধর্ম্ম ধন্ধে পড়িয়া নিমজ্জিত হইল। খল সজ্জনকে পরাভূত করিল। বিচারক কেহ থাকিল না। জাতি অজাতির মধ্যে বিবাহ হইল। অধম উত্তমেব উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিল। বিদ্যারস বুঝিবার লোক দেখা যাইল না। কুলীন ব্যক্তি ভিক্ষুকে পরিণত হইল। গএণেস স্বর্গগত হইল তিরহুতের সকল গুণ তিরোহিত হইল।

এই বর্ণনা পড়িয়া মনে হয় অরাজকতা বেশ কিছুদিন স্থায়ী হইয়াছিল। ২/৪ বৎসরের মধ্যে জাতি অজাতির মধ্যে বিবাহ হয় না, বিদ্যারস বুঝিবার লোক বিরল হয় না। এই অনুমানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন হইতে পারে যে এত দীর্ঘদিন অরাজকতা চলিলে কামেশ্বরের কনিষ্ঠ পুত্র ও ভোগীশ্বরের ছোটভাই ভবেশ বা ভবদেব সিংহ রাজ্য করিয়াছিলেন কখন? কীর্তিলতা বর্ণনা পড়িয়া তো মনে হয় যে প্রথমে কামেশ্বর, তৎপরে ভোগীশ্বর, তারপর গএণেস রাজা হন এবং গএণেসের পর ইব্রাহিম কীর্ত্তিসিংহকে মিথিলার সিংহাসনে দেন। অথচ বিদ্যাপতি পুরুষ পরীক্ষায় ভবসিংহের উল্লেখ করিতে যাইয়া শুধু ‘ভুক্তা রাজ্য সুখং’ বলেন নাই, স্পষ্টভাব তাঁহাকে নৃপতি আখ্যায় অভিহিত করিয়াছেন। শৈবসর্ব্বস্বশাবেও কবি তাঁহাকে ভূপতি বলিয়াছেন। মিসরু মিশ্র বিবাধচন্দ্রে ভবেশকে ‘সার্ব্বভৌম রাজা’ বলিয়াছেন।

বিমানবিহারী যে সমস্যায় পড়েছেন, সেটা অবশ্যই গবেষকজনোচিত সত্যরক্ষার তাগিদ, কিন্তু গবেষকের একই সত্যের ওপর নির্ভর করলে চলে না। বিমানবিহারী কীর্তিসিংকে ২৫২ লক্ষ্মণাব্দের (১৩৭১ খিষ্টাব্দের) জাতক জানা সত্ত্বেও আসলানের দণ্ডদাতাকে ইব্রাহিম শর্কি ভেবেই ভুল করছেন। এটাও কিন্তু একটা সত্য যে, বিদ্যাপতি আসলানের নাম করলেও কীর্তিসিংহের পরিত্রাতার নাম করেছেন ইব্রাহিম শাহ বলেই। তাঁকে শুধু সম্মানজনক ‘পাতিশা’ বা বাদশাহের সম্বোধন দিয়েই সম্মানিত করেছেন, এমন নয়, ইব্রাহিম কিংবা ইব্রাহিম শাহের নাম কীর্তিলতায় চারবার এসেছে। এখানে এটাই ভাবা দরকার যে, ১৩৭১ থেকে ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মিথিলার চার পাশে মুসলমান রাজা-বাদশা কম ছিলেন না। সবেচয়ে বড়ো কথা, শর্কিদের আগে তো জৌনপুরে দিল্লীর ফিরোজ শাহ তুঘলকের অধিকারে ছিল এবং সেটা ১৩৫৯-৬0 সাল থেকে ১৩৮৮ পর্যন্ত তাঁর অধিকার চলেছে এখানে। ফলত কীর্তিসিংহ আসলানকে দণ্ড দেবার জন্য ফিরোজ শাহ বা তাঁরই কোনো অনুগত কারও স্মরণ গ্রহণ করেননি, একথা কে বলতে পারে। হতেই পারে ইব্রাহিম শাহ নামে অন্য কেউ নিশ্চয়ই ছিলেন, কিন্তু জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কি নন। বিদ্যাপতিও কোথায় জৌনপুরের নাম করেননি।

বরঞ্চ ইব্রাহিম শর্কি অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মিথিলার রাজা শিবসিংহের কারণে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ইব্রাহিম শর্কি নিজে যথেষ্ট সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর ৪৩ বছরের রাজত্বকালে জৌনপুরের রাজনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক উন্নতিও ঘটেছিল প্রচুর। তাই রাজকর না – দেওয়া এক সামন্ত রাজাকে ধরে এনে তাঁর সভাসদ বিদ্যাপতির কবিতা শুনে শিবসিংহকে মুক্তি দেওয়াটা তাকেঁই মানিয়ে যায়। বিশেষত শিবসিংহের পরিবর্তে দেবসিংহের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাটাও ইব্রাহিম শর্কিরই কাজ।

প্রাজ্ঞ সুখময় মুখোপাধ্যায় আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সভাসদ মুল্লা তাকিয়ার বয়াজ উদ্ধার করে শিব সিংহের রাজ-পরিণাম সমন্ধে যে বক্তব্য উপস্থাপনা করেছেন, সেটা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য কিন্তু তারও একটা বড়ো ভুল হল– সেই কীর্তিসিংহ আসলান এবং ইব্রাহিম শর্কিকে একই সময়ের পংক্তিভুক্ত করা। তিনি মুল্লা তাকিয়ার বয়াজ বঙ্গানুবাদ করার সময় পাদটীকায় লিখেছেন –‘আসল কথা, মুল্লা তাকিয়া জানতেন না ইব্রাহিম শর্কি দুবার ত্রিহুতে এসেছিলেন –প্রথমবার রাজা কীর্তিসিংহের পিতৃরাজ্য-অপহরণকারী অসলানকে শাস্তি দিতে, যার বর্ণনা বিদ্যাপতির ‘কীর্তিসিংহের পিতৃরাজ্য-অপহরণকারী আসলানকে শাস্তি দিতে, যার বর্ণনা বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’য় পাওয়া যায়, আর দ্বিতীয়বার এই বাংলা আক্রমণের সময়। যা বোঝা যায়, ইব্রাহিমের প্রথমবারের ত্রিহুতে আগমনেই ৮0৫ হিজরায় ঘটেছিল, আর সেই সময়েই ইব্রাহিম এই শিলালিপি-সংবলিত মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।’

ত্রিহুতে ৮0৫ হিজরা বা ১৪0২ খিষ্টাব্দে ইব্রাহিম শর্কি যে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন , সেটা তাঁর রাজত্বের প্রথম বছর। সম্ভবত এই বছরেই দেবসিংহের রাজত্বকালেই শিবসিংহ স্বাধীনমনস্কতায় রাজকর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই সাহসিকতার ফলেই ইব্রাহিমের বন্দীদশা তৈরী হয়, আবার বিদ্যাপতির কাব্যিক সহায়তা তথা দেবসিংহের সামন্ত-রাজোচিত বিশ্বস্ততায় শিবসিংহের মুক্তিও ঘটে। ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দে ইব্রাহিম শর্কি সবে-সবে সুলতান হয়েছেন –তাঁর পক্ষে যেমন এক সামন্ত হিন্দুরাজার বেয়াদপি সহ্য করাটাও আদতের মধ্যে পড়ে না, তেমনই নতুন সুলতান হবার যে অন্তর্বিলাস থাকে, সেখানে বিদ্যাপতির কবিতা শুনে এক সামন্ত রাজাকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার উদারতাও তাঁর মধ্যে আশা করা যায়, এমনকী বৃদ্ধ সামন্ত দেবসিংহের হাতে রাজ্য ন্যস্ত করাটাও এই উদারতারই নামান্তর।

এবারে পুনরায় শিবসিংহের কথায় ফিরে এসে জানাই যে, শিবসিংহ যেমন ইব্রাহিম শর্কির সমসাময়িক, তেমনই তিনি বঙ্গদেশের ‘চারশ বছরের জমিদার’– রাজা না হলেও প্রায় রাজকল্প রাজা গণেশ বা দনুজমর্দন দেবেরও সমসাময়িক। রাজা গণেশ বিখ্যাত ছিলেন তাঁর মুসলমান রাজবিদ্বেষের জন্য এবং বাংলায় যাতে ইসলামের বৃদ্ধি না হয় তার জন্য মুসলমান দরবেশদের ব্যাপারে তাঁর অসহনীয়তার কথাও সুবিদিত ছিল। গণেশের এই প্রবল ইসলাম বিরোধিতা তাঁকে যে বন্ধুটি জুটিয়ে দিয়েছিল, তিনি অবশ্যই মিথিলার শিবসিংহ। গণেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বেশ কিছু কাল ধরেই তৈরী হয়েছিল বলে মনে হয়।

বিমানবিহারী মজুমদার শুধুমাত্র কাব্যপ্রকাশবিবেকের টীকার লেখনকাল ধরে শিবসিংহের রাজ্যারম্ভ-কাল নির্ণয় করেছেন, কিন্তু একথাটা তিনি একবারও ভাবলেন না যে,ঠক্কুর শ্রীধরের লেখায় ‘শিবসিংহের রাজশাসন চলাকালীন সময়ে তিনি শিবসিংহের বন্ধু, বিদ্যাপতির আজ্ঞায় তাঁর গ্রন্থ সমাপ্ত করছেন ২৯১ লক্ষ্মণ সংবতে অর্থাৎ ১৪১0 সালে’ — তার মানে এই নয় যে, ১৪১0 খ্রিষ্টাব্দেইে শিবসিংহের রাজত্বকাল শুরু হয়। ‘মহারাজাধিরাজ-শ্রীমৎ-শিবসিংহদেব-সংভুজ্যমান-তীরভুক্তৌ’–অর্থাৎ যখন মহারাজাধিরাজ শিবসিংহদেব ত্রিহুতের রাজ্য ভোগ করছেন— এই ঘটমান বর্তমানই বুঝিয়ে দেয় যে, শিবসিংহের রাজত্বকাল ১৪১0 খিষ্টাব্দের অনেক আগেই আরম্ভ হয়েছে এবং সেটা এতটাই আগে যাতে ক্রমপর্যায়ে এখন তাঁকে শুধু রাজা নয়, মহারাজ নয়, মহারাজাধিরাজ বলে সম্বোধন করা যাচ্ছে।

শিবসিংহের রাজ্যারম্ভকালের সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বিদ্যাপতির পদে শিবসিংহের পূর্ব রাজা দেবসিংহের নির্বাণ-কাল। বিদ্যাপতি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন — লক্ষ্মণ সংবৎ ২৯৩ (অনল-রন্ধ্র-কর) আর শকাব্দ ১৩২৪-এর (সমুদ্র-কর-অগিনি-সসী)–চৈত্র কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে বৃহস্পতিবার ৬ তারিখ দেবসিংহের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে। বিদ্যাপতি-লিখিত এই তারিখটি একটি প্রমাণ দেয় যে, শিবসিংহও ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দেই মিথিলা-ত্রিহুতের সিংহাসনে রাজা হয়ে বসেন এবং ঠক্কুর শ্রীধর যখন কাব্যপ্রকাশবিবেক নামে টীকা লিখছেন, তখনও সেই ১৪০০ সালেও তিনি তিরভুক্তির রাজ্য ভোগ করছেন– সংভুজমান-তিরভুক্তৌ–এটাই অর্থ দাঁড়ায়।

বিদ্যাপতির লেখা দেবসিংহের গঙ্গাপ্রাপ্তির যে তারিখটি, তাতে লক্ষ্মণ-সংবৎ নিয়ে একটু বোঝাপড়া আছে। বিদ্যাপতি শকাব্দ ১৩২৪ সংখ্যা উল্লেখ করায় ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দ নিশ্চিতই হয়ে যায় একপ্রকার, কিন্তু লক্ষ্মণাব্দ ২৯৩-এর সংস্কৃত প্রতীকগুলি সেখানে ব্যাখ্যাযোগ্য হয়ে ওঠে। বিদ্যাপতি লিখেছেন — ‘অনল-রন্ধ্র-কর’ তাতে তিন অগ্নি (৩), দেহের নব রন্ধ্র, নব দ্বার (৯) আর কর অর্থাৎ দুই হাত (২)। এটাকে প্রাচীন নিয়মে অঙ্কের বাসা গতিতে সাজালে ২৯৩ এর আপেক্ষিক খ্রিষ্টাব্দে দাঁড়াবে (২৯৩ + ১১১৯) = ১৪১২ খ্রিষ্টাব্দে — যেটা বিদ্যাপতির বৈকল্পিক শকাব্দ ১৩২৪ -এর সঙ্গে মেলে না বলেই এখানে ‘রন্ধ্র’ অর্থ নব দ্বার ভেবে ৯-সংখ্যাটা এত সহজে ধরে নেওয়া উচিত নয়। উমেশ মিশ্র অবশ্য বিদ্যাপতি ঠাকুর নামের গ্রন্থটিতে এই গোলমাল খেয়াল না করেই শুধু শকাব্দের প্রমাণে ১৪0২ সালেই দেবসিংহের গঙ্গাপ্রাপ্তির কথা লিখেছেন।

আমরা জানতে চাই যে, সাল-তারিখ উল্লেখ করার সময় বিদ্যাপতি প্রায় সময়েই লক্ষ্মণ সংবতের একক উল্লেখ করেছেন, শকাব্দের কথা বিকল্প হিসেবে অন্যত্র তিনি বলেনই নি প্রায়। এখানে লক্ষ্মৎ সংবৎ ‘অনল-রন্ধ্র-কর’ লেখার পরেই তিনি বুঝেছেন যে এই রন্ধ্র শব্দটা এখানে একটা সমস্যা তৈরী করবে। কেননা তার অন্য মানেও হয়। খুব সাধারণভাবে নব রন্ধ্র হল নয়টি ইন্দ্রিয় ছিদ্র যেমন- দুটি চোখ, দুই কান, দুটি নাকের ফুটো, মুখ, লিঙ্গ এবং গুহ্যদ্বার। এখান সমস্যা হল– এখানে এই নয়টি ইন্দ্রিয়রন্ধ্রের সঙ্গে ব্রহ্মরন্ধ্র যুক্ত করে অনেকে রন্ধ্রের সংখ্যা দশও বলেছেন । ফলে বিদ্যাপতি বোধ হয় রন্ধ্র বলতে নবদ্বার বোধক ইন্দ্রিয়ের কথা বলতেই চাননি। তিনি সম্ভবত ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে রন্ধ্রশব্দের চালু অর্থ গ্রহণ করে রন্ধ্র বলতে আট বলতে চেয়েছেন এবং সেটা দেবসিংহের মৃত্যুর সঙ্গেও অনেক বেশী সঙ্গত হয়।

জ্যোতিষ শাস্ত্রে লগ্ন থেকে অষ্টম স্থান থেকে মৃত্যুর বিচার হয় প্রধানত; আর এই অষ্টম স্থানকে বলে রন্ধ্র। জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর কবিতায় লিখেছেন–‘রন্ধ্রগত আছে শনি / সরোজিনীর প্রমাদ গণি।’ তার মানে শনি যদি লগ্নের অষ্টমে ‘রন্ধ্রে’ থাকে তাহলে মৃত্যুর কারণ হয়। এইরকম একটা ভাবনা থেকেই দেবসিংহের মৃত্যুদ্যোতক এই রন্ধ্র-শব্দের মানে এখানে আট। তাতে ‘অনল-রন্ধ্র-কর’ অঙ্কের বামা গতিতে হবে ২৮৩ লক্ষ্মণাব্দ; এবারে তার সঙ্গে ১১১৯ যোগ করলে ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দ হয়, বিদ্যাপতির শকাব্দ-পরিমাপের সঙ্গেও সেটা মিলে যায়, সার্থক প্রমাণ হয়ে ওঠে বিদ্যাপতির কবিতা–

‘অনল-রন্ধ্র-কর লক্‌খণ ণরবই / সক সমুদ্র কর অগিনি সসী।
চৈতকারি ছবি জেঠা মিলিআে বার বেহপ্পই জাউলসী।।
দেবসিংহ জী পুহমী ছড়্ড়ই অদ্ধসন সুররাঅ সরূ।
সতবলে গঙ্গা মিলিত কলেবর দেবসিংহ সুরপুর চলিঅ।।’

১৪0২ খ্রিষ্টাব্দে যেমন ইব্রাহিম শর্কি জৌনপুরের সুলতান হয়েছেন, তেমনই মিথিলা-ত্রিহুতেও ১৪0২ সালে রাজা হয়েছেন শিবসিংহ। সম্ভবত ইব্রাহিমের প্রথম ত্রিহুত-অভিযান দেবসিংহের মৃত্যুর আগেই ঘটেছে যখন প্রথমবারের জন্য শিবসিংহের বন্দিদশা ঘটেছিল এবং দেবসিংহের ওপর ত্রিহুতের রাজ্যভার ন্যস্ত হয় পুর্নবার। রাজা হবার সময়েই দেবসিংহ যথেষ্ঠ বৃদ্ধ ছিলেন এবং শিবসিংহের বিপর্যস্ত অবস্থার পর আর তিনি খুব বেশী দিন বাঁচেননি। ফলে ১৪0২-এর ৬ই চৈত্র, মানে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহেই তার গঙ্গাপ্রাপ্তি হয় ধরে নিলে শিবসিংহ রাজা হন বৈশাখেই অর্থাৎ এপ্রিল মাসেই।

১৪0২ খ্রিষ্টাব্দের পর দু-এক বছর পেরোতে না পেরোতেই জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কি নানা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ফলে শিবসিংহেরও সুযোগ হয় নিশ্চিন্তে শক্তি বাড়ানোর এবং এই শক্তি প্রদর্শন চরমে পৌঁছায় ১৪১0 খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ যখন তাঁকে মহারাজাধিরাজ বলে অভিহিত করছেন ঠক্কুর শ্রীধর। সম্ভবত এই সময়ের কিছু আগে থেকেই বঙ্গদেশের রাজা গণেশ বা দনুজমর্দন দেবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। ইসলাম- বিরোধিতায় তিনি তাঁর সঙ্গে সহযোগ দিতে থাকেন । পূর্বে শিবসিংহ রাজকর দেওয়া বন্ধ করেছিলেন এবার তিনি নিজের নামে মুদ্রা তৈরী শুরু করেন। (Annual Report ASI, 1913-1914, pp.548-549, Plate. LxVII Fig.13) মুদ্রাগুলির আকার বড়ো ছিল না বটে, কিন্তু তার একদিকে লেখা ‘শ্রী’ অন্যদিকে ‘শিবস্য’ (শিব-/-স্য)। এই ছোট্ট ছোট্ট স্বর্ণমুদ্রাগুলি যা ১৯১৩ সালে চম্পারন জেলা থেকে পাওয়া গেছে, এগুলি তাঁর স্বতন্ত্র স্বভাবের পরিচয় বহন করে। এই স্বতন্ত্রতা জৌনপুর-শাসক ইব্রাহিম শর্কির ভাল লাগেনি। বিশেষত বঙ্গদেশের রাজা গণেশের সঙ্গে শিবসিংহের যে একাত্মতা তৈরী হচ্ছিল, তার একটা বিপরীত বিস্ফোরণ ঘটেই গেল জৌনপুরে। ইব্রাহিম শর্কির সহ্যসীমা অতিক্রান্ত হল এবং তিনি যুদ্ধের জন্য তৈরী হলেন। তবে এই যুদ্ধের লক্ষ্য যতখানি ছিলেন শিবসিংহ তার চেয়ে অনেক বেশী ছিলেন রাজা গণেশ। তাই আক্রমণের সময় ইব্রাহিম শর্কি আগে পথের কাঁটা শিবসিংহকে সরিয়ে দিয়ে তারপর গণেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। সেই প্রমাণটা দাখিল করেছেন সুখময় মুখোপাধ্যায় এবং সেটা মুল্লা তাকিয়ার ‘বয়াজ’ থেকে।

ইব্রাহিম শর্কি বঙ্গীয় রাজা গণেশের ওপর কীভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং সেখানে মুসলমান ধর্মগুরু নূর কুৎব্‌ আলম এবং আশ্‌রফ সিম্‌নানীর চিঠি কী সাংঘাতিক ইন্ধন জুগিয়েছিল, সেটা সুখময় মুখোপাধ্যায় বিস্তারিত লিখেছেন এই কারণেই যে, ইব্রাহিম শর্কি এবার রাজা গণেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় বেরোলেন। এইখানেই মুল্লা তাকিয়ার বয়াজ, উল্লেখ করতে হবে আমাদের। বয়াজ কথাটার মানে ‘পাঁচ মিশেলি সংগ্রহ’। এই বয়াজে মুল্লা তাকিয়া তাঁর ভ্রমণের বিবরণ এবং ভ্রমণের সময়ে দেখা এবং শোনা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। মুল্লা তাকিয়ার বয়াজের ত্রিহুত সংক্রান্ত ইতিহাস পাটনার উর্দু পত্রিকা ‘মাসির’- এর মে-জুন এবং জুলাই-আগস্ট (১৯৪৯) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই অংশটাই প্রথম আলোচনা করেছেন সৈয়দ হাসাদ আসকারি। সুখময়বাবু সেই আলোচনা অংশগ্রহণ করে এটাই দেখিয়েছেন যে, ইব্রাহিম শর্কি গণেশের বিরুদ্ধে (ওঁদের অপভ্রষ্ট উচ্চারণে রাজা কান্‌স-এর বিরুদ্ধে) যখন যুদ্ধযাত্রা করবেন বলেই ঠিক করলেন,তখন ওই একই যাত্রায় তিনি ত্রিহুতে শিবসিংহকেও খানিক শাস্তি দিয়ে যাবেন বলে ঠিক করলেন।

মুল্লা তাকিয়া জানাচ্ছেন যে, বাংলার এক হিন্দু জমিদার – তার নাম রাজা কান্‌স (ইনি রাজা গণেশ)–তিনি বাংলার রাজনীতিতে যথেষ্ট শক্তি লাভ করার পর এখন তিরহুতের শিবসিংহকে (Sheo Singh)উসকে চলেছেন এবং মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করার অভিসন্ধি করছেন। এই শিবসিংহ হল সেই দেবসিংহের বিদ্রোহী ছেলে, যে নাকি মুসলমান দরবেশদের ওপর নানান অত্যাচার চালিয়েছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই গণেশই (কানস্‌) দরবেশ মখ্‌দুম শাহ সুলতান হুসেন-এর উদ্দেশে অনুরূপ অত্যাচার চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। এই মখদুম শাহ পাণ্ডুয়ার ধর্মগুরু আলা-উল-হকের শিষ্য ছিলেন।

আলা-উল-হকের সুযোগ্য শিষ্য নূর কুৎব্‌-আলমের নির্দেশ-পরামর্শে ইব্রাহিম শর্কি রাজা কান্‌স-কে (গণেশকে) দমন করার উদ্দেশে রওনা হলে ত্রিহুতের শিবসিংহ তাঁর যাত্রাপথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। শিবসিংহ এই যুদ্ধে পরাজিত হন এবং তিনি পালিয়ে গিয়ে তাঁর শক্ত ঘাঁটি লেহ্‌রা-তে আশ্রয় নিলে সেখানে থেকে তাঁকে ধরা হয় অথবা তিনি পালিয়ে যান।

সৈয়দ হাসান আসকারির এই বক্তব্যের পরে মুল্লা তাকিয়ার মূল বয়াজটি অনুবাদ করে দিয়েছেন সুখময় মুখোপাধ্যায়। সেটা এই রকম– ”যখন হিন্দু জমিদার কান্‌স সমগ্র বাংলা প্রদেশের উপর আধিপত্য অর্জন করলেন, তিনি মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার সঙ্কল্প করলেন এবং তাঁর রাজ্য থেকে ইসলামের মূলোচ্ছেদ করাই হয়ে দাঁড়াল তাঁর লক্ষ্য। এই সময়ে ত্রিহুতের জমিদার শিও সিং (শিবসিংহ) তাঁর পিতা ত্রিহুতের রাজা দেবসিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং রাজা কান্‌সের সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয়ে নিজে ত্রিহুত প্রদেশের স্বাধীন রাজা হয়ে বসেছিলেন। নিজের শক্তি বৃদ্ধি করে তিনি রাজা কান্‌সের প্ররোচনায় তাঁর রাজ্যের মুসলমানদের উপরে লুঠপাট চালাতে লাগলেন, দারভাঙ্গার অধিকাংশ ধর্মপ্রচারক ও ইসলামের নায়কদের শহীদীর পানীয়ের আস্বাদ গ্রহণ করালেন এবং পবিত্রাত্মা মখদুম শাহ সুলতান হোসেনকে আঘাতের পরিকল্পনা করলেন। এখন, মখদুম শাহ পাণ্ডুয়ার আল-উল-হকের শিষ্য ছিলেন। আলা-উল-হকের সুযোগ্য পুত্র নূর কূৎব্‌-উল্‌-ইসলামের অনুরোধে সুলতান ইব্রাহিম শর্কি বাংলার দুর্বৃত্ত কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে এবং রাজা কান্‌সকে দমন করার জন্যে ৮0৫ হিজরায় এক সৈন্যবাহিনী পাঠান।”

সুখময় মুখোপাধ্যায় এখানে পাদটীকায় লিখেছেন — ”এই তারিখ ভুল। এই অনুচ্ছেদের শেষে যে শিলালিপি উদ্ধৃত হয়েছে সেই শিলালিপিটি দেখেই মুল্লা তকিয়া স্থির করেছিলেন ইব্রাহিম ৮0৫ হিজরায় বাংলাদেশ আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু ইব্রাহিম যে ৮১৮ হিজরা বা ১৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা দেশ আক্রমণ করেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ৮0৫ হিজরায় সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ বাংলাদেশ শাসন করছিলেন, তখন ইব্রাহিমের বাংলা আক্রমণের কথা ওঠে না। অবশ্য ঐ শিলালিপির অকৃত্রিমতা সন্দেহের অতীত । আসল কথা, মুল্লা তকিয়া জানতেন না ইব্রাহিম শর্কি দুবার ত্রিহুতে এসেছিলেন প্রথমবার রাজা কীর্তিসিংহের পিতৃরাজ্য-অপহরণকারী অসলানকে শাস্তি দিতে, যার বর্ণনা বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’য় পাওয়া যায়, আর দ্বিতীয়বার এই বাংলা আক্রমণের সময়। যা বোঝা যায়, ইব্রাহিমের প্রথমবারের ত্রিহুতে আগমনই ৮0৫ হিজরায় ঘটেছিল, আর সে সময়েই ইব্রাহিম এই শিলালিপি সংবলিত মসজিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন।

আমাদের নিবেদন :
সুখময়বাবুও সম্ভবত একটি ভুল করছেন। কেননা, কীর্তিসিংহ এবং ইব্রাহিম শর্কি কোনভাবেই সমসাময়িক নন। ইব্রাহিম শর্কি ৮0৫ হিজরায় অবশ্যই এসেছিলেন ত্রিহুতে, কিন্তু তখন তিনি সবে সুলতান হয়েছেন ১৪0২ সালে অর্থাৎ ৮0৫ হিজরায়, আর শিবসিংহও তখন দেবসিংহের মৃত্যুর পর নতুন রাজা এবং সেটা ৮0৫ হিজরা অর্থাৎ ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দে। ইব্রাহিম শর্কি এই সময় রাজকর বন্ধ-করা শিবসিংহকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির কবিতা শুনে নতুন সুলতান নতুন রাজাকে মুক্তি দিলেও ত্রিহুতের শাসনভার ন্যস্ত করেছিলেন দেবসিংহের ওপর, যদিও তিনি স্বল্পকালের মধ্যে মারা গেলে শিবসিংহ আবার রাজা হন।

পূর্বোক্ত মুল্লা তাকিয়ার বয়াজের শেষাংশ হল–

”রাজকীয় সৈন্যবাহিনী যখন ত্রিহুতে পৌঁছোলো, শিও সিংহ তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। যদিও সুলতান বাংলার দিকে যাচ্ছিলেন, তিনি যখন খবর পেলেন শিও সিং তাঁর তাঁবুর কাছাকাছি পৌঁছেছেন, সুলতানের রোষানল দাউ দাউ শিখায় জ্বলে উঠল এবং তিনি খুব সাহস নিয়ে তাঁর দিকে মন দিলেন। শেষে শিও সিং বুঝলেন প্রকাশ্য সংগ্রামে ইব্রাহিমের বিরোধিতা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি পালিয়ে অন্যদিকে গিয়ে অবশেষে সেখানকার সবচেয়ে সুদৃঢ় দুর্গ লেহ্‌রায় পৌঁছে সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কিছু সময় পরে ঐ দুর্গের পতন ঘটল এবং তিনি বন্দী হলেন। সমগ্র ত্রিহুত রাজ্য আবার তাঁর পিতাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল সুলতানের অনুগত ভৃত্য হিসাবে। যে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, সেগুলি আবার খুলে দেওয়া হল, তার ফলে সুলতান রাজা কান্‌সকে দমন করার জন্য বাংলার দিকে রওনা হলেন। মখদূম শাহের বাসস্থানের কাছে একটি মসজিদ নির্মাণ করার আদেশ পালিত হল। এখনও সেটি বর্তমান আছে এবং তাতে এই শিলালিপি আছে :-
পরিত্রাত্মা রসূল বলেছেন, যে আল্লার নামে মসজিদ তৈরী করে, সে স্বর্গে প্রবেশ করে। এই মসজিদ বিশ্বাসীদের প্রধান আবুল ফতেহ্‌ ইব্রাহিম শাহ সুলতান ৮0৫ হিজরায় নির্মাণ করিয়েছিলেন।”

মুল্লা তাকিয়ার এই বিবরণ বহুলাংশেই সত্য। শুধু ৮0৫ হিজরার ব্যাপারটা অবশ্যই ৮১৮ হিজরা বা ১৪১৫ সালই হবে, যেমনটা সুখময় বলেছেন। আর দ্বিতীয় ভুলটা প্রথম ভুলের সূত্রেই এসেছে। কেননা ১৪১৫ সালে ইব্রাহিম শর্কি বাংলার যাত্রাপথে গণেশের সহযোগী শিবসিংহকে যেভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়ে যান, তারপর তাঁর কোন খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। বিশেষত এই যুদ্ধের পর মিথিলা সাময়িকভাবে পুনরায় ইব্রাহিম শর্কির হাতে চলে যায় এবং এখন শিবসিংহের পিতাকে রাজ্য ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নই ও্ঠে না। কেননা, সে ঘটনা ৮0৫ হিজরাতেই ঘটেছিল অর্থাৎ ১৪0২ সালে। দেবসিংহ তারপর মারা যান। ৮১৮ হিজরায় বা ১৪১৫ খিষ্টাব্দেই শিবসিংহের পতন ঘটে।

যুদ্ধটাও হয়েছিল সাংঘাতিক । কেউ কেউ মনে করেন যে, এই যুদ্ধের সময় বিদ্যাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রও না থাকলেও তিনি রাজা শিবসিংহের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেই যুদ্ধক্ষেত্রেও তার সঙ্গে বিদ্যাপতির সান্নিধ্য আমরা অস্বীকার করিনা। পরমেশ্বর ঝা-মশাই তাঁর মিথিলাতত্ত্ব বিমর্শে বিদ্যাপতির লেখা একটি কবিতায় যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থাটা এমন প্রত্যক্ষভাবে দেখার মতো করে লিখেছেন যাতে যুদ্ধের শেষ কাল পর্যন্ত শিবসিংহের সঙ্গে বিদ্যাপতির যোগাযোগ এবং অবস্থান যেন সত্য হয়ে ওঠে। বিদ্যাপতি লিখেছেন – সৈন্য-সেনাপতিদের মৃতদেহ হাতী-ঘোড়ার মৃত শরীরে পাহাড় হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্র। তরোয়ালের পারস্পরিক আঘাতে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল সর্বত্র । মনে হচ্ছিল যেন বর্ষাকাল নেমেছে এখানে —

মেরু কনক সুমেরু রম্পিয় ধরনি পূরিয় গগন ঝম্পিয়,
হাতি তুরয় পদাতি পয়ভর রমন সহি অোরে,
তরল তর তরবারি রঙ্গে বিজ্জুদাম ছটা তরঙ্গেঁ,
ঘোরঘন সংঘাত রারিস কাল দরস অোরে,
পারভই পরিপন্থি গজ্জিঅ ভূমি মণ্ডল মণ্ডে মণ্ডিঅ,
চারু চন্দ্রকলেব কীত্তি সুকেতকী তুলি অোরে।

অনেকেই মনে করেন যে, শিবসিংহ যুদ্ধক্ষেত্রে যথেষ্টই বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। কিন্তু তিনি ইব্রাহিমের হাতে বন্দি হলে সেটা সমসাময়িক সাহিত্যে উল্লিখিত হত। এমনকী তাঁর মৃত্যু হলেও সে সংবাদ বিদ্যাপতির কোনো লেখায় থেকে যেত। এই অদ্ভুত অনুল্লেখ থেকেই এটা মনে হয় যে, শিবসিংহ কোথাও পালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন যে, তিনি নেপালের জঙ্গল এলাকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং ইন্দোনেপাল সীমান্তে ‘শিবরাজগড়’ নামে একটি ছোট্ট গড়ের ধ্বংসাবশেষটিকে রাজা শিবসিংহের স্মারক হিসেবেই তাঁরা চিহ্নিত করেন। তাতে শিবসিংহের পালিয়ে যাবার কথাটা আরও সপ্রমাণ হয়।

মিথিলার ওইনিবার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা নিশ্চয়ই শিবসিংহ। বহুকাল ধরে দিল্লী অথবা জৌনপুরের সুলতানদের সামন্ত রাজ্য হিসেবে মিথিলার অবস্থান তৈরী হলেও শিবসিংহই বোধহয় প্রথম সেই স্বতন্ত্রতা দেখিয়েছেন, যাতে তাঁর রাজ্য স্বাধীন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বঙ্গদেশে রাজা গণেশ স্বতন্ত্রতার যে সুযোগটুকু পেয়েছিলেন, শিবসিংহ সে সুযোগ পাননি মিথিলা-ত্রিহুতের সঙ্গে জৌনপুরের নৈকট্যের কারণে। কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবনা এবং বীরতার সঙ্গে তিনি যেভাবে যুদ্ধ করেছিলেন ইব্রাহিম শর্কির সঙ্গে, তাতে সমগ্র ওইনিবার বংশের মধ্যে শিবসিংহের খ্যাতি সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। হয়তো এই কারণেই এখনও মিথিলার জনবাদে শিবসিংহী প্রশংসা শোনা যায় –শিবসিংহ ছাড়া অন্য সব মৈথিল রাজাদের তুচ্ছ করে দেয়। মধুবনী-দ্বারভাঙা থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে গেলে ‘পতৌল’ বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী পাওয়া যায়। শোনা যায়, রাজা শিবসিংহই এই পুষ্করিণী কাটিয়ে জনহিতে উৎসর্গ করেছিলেন। পুকুরটির নাম ‘রজোখরি’ এবং এই পুকুরের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। এই পুকুরটি দেখিয়ে মানুষ এখনও প্রাবাদিকভাবে বলে–পুকুর যদি বলতে হয় তো এই ‘রজোখরি’ হল পুকুর, আর সব সেই তুলনায় পানা। তেমনই রাজা যদি বলতে হয় তবে সেটা শিবসিংহ , আর সব ‘ছোকরা’। মিথিলার গ্রাম্যভাষায় এই প্রবাদ আরও শানিত —

পোখরি রজোখরি অউর্ সব পোখরা।
রাজা সিবসিংহ অউর্ সব ছোকরা।।
(Grierson Vidyapati p.187,Note 22)

একইভাবে বিদ্যাপতিও যে পুরুষাপরীক্ষা-গ্রন্থের প্রারম্ভিকে লিখেছিলেন–‘যিনি যুদ্ধে গৌড়েশ্বর আর গজ্জনেশ্বর, –দুই রাজর সঙ্গে যুদ্ধ করে কুন্দশুভ্র যশ নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিলেন –যো গৌর গর্জ্জন-ভূমিপাল-বিজয়াৎ ক্ষৌণীষ্ণু লব্ধা যশঃ’ –এই গৌড়েশ্বর অবশ্যই তাঁর সমসাময়িক বঙ্গদেশীয় রাজা গণেশ। যুদ্ধে না হলেও গণেশের সঙ্গী হওয়াটা তাঁকে জয় করার মতোই ঘটনা ছিল সেকালে। আর ইব্রাহিম শর্কির মতো এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সুলতানের সঙ্গে বিরোধিতা করে রাজকর বন্ধ করা কিংবা তাঁর সামন্ত রাজা হওয়া সত্ত্বেও স্বনামে মুদ্রা ছাপানো — এটাও তাঁর জয়ী হয়ে ওঠারই নামান্তর।

রাজা শিবসিংহের বীরত্ব এবং রাজমাহাত্ম্য যেরকমই থাক, তাঁর সবচেয়ে বড়ো খ্যাতি হল বিদ্যাপতির মতো এক মহাকবির পৃষ্ঠপোষকতা। এটা মানতেই হবে যে, অতি অল্প বয়স থেকে রাজসভার সঙ্গে বিদ্যাপতির পরিচয় ঘটেছে, বিশেষত এই ওইনিবার রাজবংশে প্রায় পুরুষানুক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা জুটেছে বিদ্যাপতির। এই রাজবংশে শিবসিংহ অবশ্যই সেই বিখ্যাত রাজা যাঁর সঙ্গে বিদ্যাপতির সম্পর্ক হয়েছিল, সবচেয়ে বেশী এবং এটাকে সম্পর্ক না বলে বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা বলাই ভাল। বিদ্যাপতি সংস্কৃত ভাষা এবং অবহঠ্‌ঠ মিলিয়ে কম কবিতা লেখেননি সেখানে শুধু বৈষ্ণব পদাবলীর সংখ্যা ধরলে রাজা শিবসিংহ রূপনারায়ণ কতবার যে উচ্চারিত হয়েছেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।