শিবসিংহ হচ্ছেন বিদ্যাপতির সেই পৃষ্ঠপোষক রাজা, যাঁর আমলে সবচেয়ে বেশী রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক প্রেমের পদ লিখেছেন তিনি। এমনকী অনেকে যেটা বলেন– যেসব পদগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক নয়, নিছক শৃঙ্গার -রসাশ্রিত সাধারণ পদ- সেগুলিও শিবসিংহের কালেই বিদ্যাপতি লিখেছেন বলে মনে হয়। বিদ্যাপতির জীবন সম্বন্ধে একটি স্বীকৃত সত্য হল–বিদ্যাপতি অত্যন্ত দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন এবং এই দীর্ঘ জীবনে ওইনিবার বংশের অনেক জন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন তিনি। শিবসিংহ এই বংশেরই অধস্তন পুরুষ। যে কোনো কারণেই হোক বিদ্যাপতির সঙ্গে শিবসিংহের ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, বিদ্যাপতির লিখিত রাজনামাঙ্কিত ২০৯ টি পদের মধ্যে শিবসিংহের নামে ভণিতা পাওয়া যায় অন্তত ২০২টি পদে। তাতেই বোঝা যায় বিদ্যাপতি শিবসিংহের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ এবং ঘনিষ্ঠতা কতটা ছিল। এই নিরিখেই বিমানবিহারী মজুমদার মন্তব্য করেছেন–

শিবসিংহের নামাঙ্কিত পদগুলির মধ্যে কবির মনের আনন্দ যেন স্বতস্ফূর্ত হইয়া উঠিয়াছে । ঐ সব পদের রূপ, রস,বর্ণের ইন্দ্রধনুচ্ছটা ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে বিভ্রান্ত করিয়া দেয়। চারিদিকে যেন একটা সুখের হিল্লোল বহিয়া যাইতেছে। চপলচঞ্চল গতিতে, তরলিত ভঙ্গীতে কবির পদগুলি নাচিয়া নাচিয়া চলিতেছে। কল্পলোকের সমস্ত সৌন্দর্য্য যেন নায়িকার মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। গগনের চাঁদ চুরি করিয়া লইয়াছে অভিযোগে সখীরা নায়িকাকে রাজদণ্ডের ভয় দেখাইতেছে; কিন্তু অন্য সখীরা বলিতেছে সে কি কথা, চাঁদে কলঙ্ক আছে, সে রাহুর কবলে পড়ে, আর আমাদের সখির মুখে যে আকাশের চাঁদ আর পাতালের কমল একসঙ্গে বাস করিতেছে। সে নায়ককে বলে রাহুর ভয়ে চাঁদ আমার নিকট সুধা গচ্ছিত রাখিয়া গিয়াছে, উহা যেন পান করিও না, আমার উপর চুরির দায় লাগিবে।

-তার মানে কাব্য-কবিতার যত ছন্দ-অলঙ্কার, যত্র বৈচিত্র্য এবং ভণিতার যত বৈদগ্ধ্য, সবটাই যেন আছে শিবসিংহের নামাঙ্কিত পদগুলিতে। রাজা শিবসিংহের ব্যাপারে বিদ্যাপতির অনুরক্তি এমনই যে, রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুলিতে লীলাপ্রসঙ্গ যতই থাকুক, যতই থাকুক গভীর রসতাত্ত্বিক ভাব-অনুভাব-বিভাব, সেই সমস্ত কবিতার শিবসিংহ রাজার চরিত্র, জীবন, জীবনচর্যা, এমনকী তাঁর রাজ্যশাসনের প্রকৃতি এবং ব্যক্তিগত চেহারা পর্যন্ত জায়গা করে নেয়। বিদ্যাপতি শিবসিংহকে অমর করেছেন, তাঁর প্রিয় রাজার মধ্যে অখিলরসামৃতমৃর্তি কৃষ্ণের চেহারা থেকে আরম্ভ করে তাঁর লীলা-বিশেষজ্ঞতার রেখাগুলি পর্যন্ত শিবসিংহের মধ্যে আরোপিত করেন বিদ্যাপতি। তাতে বুঝি, শুধু পৃষ্ঠপোষকতায় যে বিরাট কৃতজ্ঞতা তৈরী হয়, তার চেয়েও অনেক বেশী তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের উষ্ণতা ছিল রাজা শিবসিংহের জন্য। এই উষ্ণতা এতটাই যে, শিবসিংহের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর প্রিয়তম পত্নী লছিমা দেবীর সঙ্গে স্বয়ং রাজার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা মুহূর্তগুলি যেমন ধরা পড়ে, তেমনই এই রাজবধূটির সঙ্গে স্বয়ং কবি বিদ্যাপতির নান্দনিক সরসতার কথাও অস্ফুট ব্যঞ্জনায় প্রকট হয়ে ওঠে।

রাজা শিবসিংহ যত বড়ো রাজাই হোন না কেন, মূলস্থানে তিনি জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কির কাছে এক করদ রাজ্যের শাসনাধিকারে থাকা vassal king ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু বিদ্যাপতির সংস্কারে রাজা শিবসিংহ যেমন একদিকে ‘গৌড়-গজ্জন’ ভূপালকদের গর্ব খর্ব করে-দেওয়া এক মহামহিম রাজা–‘যো গৌড়েশ্বর-গজ্জনেশ্বর -রণক্ষৌণীষু লব্ধা যশঃ’, তেমনই অন্যদিকে পদাবলীর মধ্যে বিদ্যাপতি চিরকাল শিবসিংহকে যেভাবে দেখতে চেয়েছেন, তারই অন্তরানুভূতিতে লেখেন–রাজা শিবসিংহ হলেন এদেশের একছত্র রাজা–

রাত্র সিবসিংঘ একছত্র রাজা।
(বিমান. বিদ্যাপতির পদাবলী, পদ ১৩, পৃ. ১৩)

বিদ্যাপতির চোখে শিবসিংহ একটি দেশের একছত্র রাজা-মাত্রও নন, গীতগোবিন্দের দশাবতারস্তোত্রে ‘কেশব-ধৃত-দশবিধ-রূপ’ অতিক্রম করে তিনি একসময় ভগবান বিষ্ণুর একাদশ অবতার, আবার কখনো শিবের অবতার। বিদ্যাপতি তাঁর বিরহিণী নায়িকাকে তার প্রিয়তম নায়কের জায়গা প্রতিপূরণ করে দেন শিবসিংহকে প্রতিস্থাপিত করে। নায়িকাকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন–

ভনই বিদ্যাপতি সুন বর জউবতি
অছ তোকেঁ জীবন অধারে।
রাজা সিবসিংঘ রূপ নরাএন
একাদস অবতারে।।
(তদেব, পদ ৮৯, ১৭৫ এবং ১৯৮ পৃ. ৬৭,১২৭ এবং ১৪৩)

আবার কবিকণ্ঠহার বিদ্যাপতি রাজা শিবসিংহকে তাঁর পরমারাধ্য দেবতা দেবদেব মহাদেবেরও অবতার বলে পদ লিখেছেন—

ভনই বিদ্যাপতি কবি কণ্ঠহার।
রস বুঝ সিবসিংঘ সিব অবতার।।
(তদেব, পদ ১৪০, পৃ. ১০১)

শিবসিংহ রাজার গায়ের রঙ কালো ছিল কিনা, তার অন্য প্রমাণ খুব নেই, কিন্তু বিদ্যাপতির পদ থেকে বোঝা যায়, তিনি কৃষ্ণবর্ণের মানুষই ছিলেন। কৃষ্ণত্বক মানুষের আর্যগৌরবের হানি ঘটিয়ে দেয় বলেই বিদ্যাপতি তাঁকে শ্যামসুন্দর কুষ্ণের তুল্য করে দিয়েছেন আপন পদরচনায়–

রাজা সিবসিংঘ রূপনরাঅন
সাম সুন্দর কায়।
(তদেব, পদ ৩৪, পৃ. ২৮)

শুধু যে লীলাচতুর কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ আপন পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের ওপর আরোপ করে তাঁকে মহীয়ান করেছেন বিদ্যাপতি, তাই শুধু নয়, আমরা তাঁর এমন পদও দেখেছি যেখানে রাধাকৃষ্ণলীলাবিষয়ক পদে বিদ্যাপতি অখিল-রসধাম কৃষ্ণের জায়গায় নায়ক হিসেবে শিবসিংহ রূপনারায়ণের প্রতিস্থাপন ঘটাচ্ছেন। একটি পদে শ্যামলকিশোর কৃষ্ণ গোপীনায়িকার ঘরে আসার পর নায়িকার চতুর্বিধ সাত্ত্বিক বিকার ঘটেছে–স্বেদ, স্তম্ভ, রোমাঞ্চ এবং স্বরভঙ্গ। বিদ্যাপতির ধারণা কৃষ্ণের মতো শ্যামবর্ণ রাজা শিবসিংহ নায়িকার ঘরে এসেছিলেন বলেই এই বিকার কাহ্ন রূপসিরি সিবসিংহ আএল। কবি অভিনব জয়দেবা। (তদেব, পদ. ৭৭, পৃ ৫৮) একটি পদে সম্ভবত রাধারাণীর মুখেই শোনা যাচ্ছে যে,তিনি নন্দকুমার কৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখেছেন এবং আগে কোথাও কৃষ্ণকে তিনি দেখেছেন বলেই এখন তাঁকে স্বপ্নে ঠিক চিনতে পেরেছেন। এই স্বপ্নচর্চা এবং বাস্তবের গোলমালে বিদ্যাপতি তাঁর ভণিতায় নায়িকার উদ্দেশে বললেন–বরযুবতী গো ! শোনো আমার কথা, তোমার সব কথার মর্ম আমি বুঝে গিয়েছি। তোমার মনে আসলে রাজা শিবসিংহের রূপ জেগে উঠেছে, আর ভ্রমবশে তুমি ‘কানু-কানু’ করছো–

ভনই বিদ্যাপতি অরে বর জৌবতি
জানল সকল মরমে।
সিবসিংঘ রায় তোরা মন জাগল
কাহ্ন কাহ্ন করমি ভরমে।
(তদেব, পদ ৩৫, পৃ. ২৯)

সাধারণ ভণিতার মধ্যে পদাবলীর কবিরা সব ব্যক্তিগত জীবনের ব্যক্তিগত বিশ্বাসগুলিকে প্রকট কর দেন। কিন্তু সম্ভবত কোনো বৈষ্ণব কবির পদেই এমন রসশাস্ত্রীয় সাহস দেখিনি যেখানে এই রকম প্রাতিষ্ঠানিক অতিক্রম ঘটে যায় যাতে এক সামান্য করদ রাজা রসমূর্তি কৃষ্ণকে প্রতিস্থাপন করে দিতে পারেন। এই ভণিতা যদি একান্ত রসতাত্ত্বিক অতিক্রমও হয়, এমনকী হয় রসাভাসও, তাহলেও আমাদের প্রস্তাব সফল হয় এই কারণে যে, আমরা বোঝাতে চাই,-বিদ্যাপতি কতটা ভালবাসতেন তাঁর এই পৃষ্ঠপোষক রাজাটিকে কতটা মর্যাদা দিতেন যাতে করে কৃষ্ণের নায়কত্ব এক রাজার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বোধহয় কবি-সহৃদয়ের হৃদয়-সংবাদ। আপন পদাবলীর মধ্যে বিদ্যাপতি যে রসশাস্ত্রীয় ভাবনা প্রকাশ করেছেন অথবা প্রকট করেছেন রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহের গূঢ়াতিগূঢ় রসসন্দর্ভ, সেগুলির সবচেয়ে বড়ো সমঝদার বিদ্যাপতির দৃষ্টিতে সেই রাজা শিবসিংহ। স্বয়মাগতা কোনো রমণীর সঙ্গে সম্ভোগলিপ্ত হওয়ার তার চোখের কাজল কৃষ্ণের অধরে লেগে আছে, তার অধরের রাগ দাগ কেটেছে কৃষ্ণের চোখের ওপর, এমনকী চৌর্যমিলন সেরে ফিরে আসার সময় বসন পর্যন্ত বদল হয়ে গেছে কৃষ্ণের। খণ্ডিতা নায়িকার সামনে এই সব সম্ভোগ-চিহ্ন এবং বসন-বিপর্য্যাসের কোনো উত্তর দিতে পারছেন না কৃষ্ণ। বিদ্যাপতি তখন ভণিতায় সমাধান বাতলে দিয়ে বলছেন –বড়ো বড়ো অপরাধে কোনো উত্তর দেওয়া যায় না, আর এসবের মধ্যে যে রতিকলার রস আছে, তা একমাত্র জানেন শিবসিংহ–

বড় অপরাধ ফতর নাই সম্ভব
বিদ্যাপতি কবি ভানে।
রাজা সিবসিংঘ রূপনরায়ন
সকল কলারস জানে।।
(তদেব, পদ ৯৪, ১১৬, পৃ. ৭০,৮৫)

আসল কথা হল সমঝদারি। এক কবির কবিতা রাজা শিবসিংহ ধৈর্য ধরে শুনেছেন, কবিতার অন্তর্নিহিত রস নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং অবশেষে কবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছেন রাজা শিবসিংহ। বিদ্যাপতি তার প্রতিদান দিয়েছেন ভণিতায়। বার বার ফিরে এসেছে এই কথাকলি–

* রূপ নরাএন এহু রস জানে। (পদ ১১৪)
* রূপ নরায়ন নৃপ রস জানে। (পদ ১০৫)

সবচেয়ে বড় কথা, প্রেমে পড়লে এক রমণীর মনের মধ্যে যে কী সরস উথাল-পাথাল হয়, তা যেমন এক যোগ্য নায়ক পুরুষ অনুমান করতে পারে, তেমনই সেটা পারেন রাজা শিবসিংহ। বিদ্যাপতি লিখছেন –রমণীর মনের মধ্যে শত শত রহস্য তৈরী হয়, বিশেষত অভিমত পুরুষের ব্যাপারে — সেসব কথা বিদ্যাপতি গাইলেন আর সেটা বোঝেন শিবসিংহ ভূপ–

নারি মনোরথ অভিমত
সত সত রহস নিরূপ।
কবি বিদ্যাপতি গাওল
রস বুঝ সিবসিংহ ভূপ।।
(তদেব, পদ ১৮৭, পৃ. ১৩৬)

বিদ্যাপতি যত প্রেমের পদ লিখেছেন, বিশেষত যে পদগুলিতে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক অথবা পছন্দের মানুষের নাম উচ্চারণ করেছেন, তার মধ্যে শিবসিংহের নামই সবচেয়ে বেশী একথা আমরা আগেই জানিয়েছি। তাঁর কাব্য-কবিতার সঙ্গে শিবসিংহ যে সমাদরে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তাতেই ব্যক্তিগত জীবনে শিবসিংহের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অথবা এই দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা অতিগভীর পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলেই বিদ্যাপতির পদে শিবসিংহ মাত্রাতিরিক্ত মহিমায় উল্লিখিত হয়েছেন এবং পদসংখ্যাও সেখানে এতটাই মাত্রাছাড়া যে, বিদ্যাপতির অন্য সব পৃষ্ঠপোষকেরা সেখানে অল্পোল্লেখেই সৌভাগ্যবান হয়ে ওঠেন।