বৈষ্ণব পদাবলী শুধু কবিতা নহে, সংগীতও বটে৷ পদাবলীর বাঁধুনি দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, এগুলি গানের জন্যই কল্পিত হইয়াছিল৷ এই খণ্ড কবিতাগুলি সুর ও তালে গঠিত হইলেই কীর্তন নামের যোগ্য হয়৷ বৈষ্ণব কবিরা অসামান্য অধ্যবসায়ের সহিত সহস্র সহস্র কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন; গায়কেরা তাহাই গান করিয়া বঙ্গদেশের অসংখ্য নরনারীর প্রাণে রসপ্রবাহ সৃষ্টি করিতেছেন৷ এইসকল মহাজন-পদাবলীর অনুকরণে বহু কবি— বৈষ্ণব ও অবৈষ্ণব— পদ রচনা করিয়াছেন৷ যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, শিশিরকুমার ঘোষের ‘বলরাম দাসের পদাবলী’৷ কিন্তু প্রচলিত রসকীর্তনে সে-সকল সংগীত সুন্দর হইলেও গীত হয় না৷ অনেক আধুনিক পদ অবশ্য বহু গায়ক-গায়িকার মুখে শুনিতে পাওয়া যায় এবং সে-গুলিকে কীর্তনও বলা হয়, কিন্তু প্রাচীন পদ্ধতির কীর্তন গায়কদিগের গানে ইহাদের কোনও স্থান নাই৷
সুতরাং পদাবলী বলিতে বৈষ্ণব, ভক্ত, মহাজন-রচিত পদই বুঝিতে হইবে; যথা জয়দেবের কোমলকান্ত পদাবলী, চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদাবলী, জ্ঞানদাস গোবিন্দদাসের পদ ইত্যাদি ৷ প্রাচীন সংগ্রহগ্রন্থে এইসকল পদ সংকলিত হইয়া কীর্তনসমাজে গীত, আলোচিত, ও আস্বাদিত হইয়া আসিতেছে৷
এইসকল পদাবলী বৈষ্ণবসাহিত্য হিসাবেও আলোচিত হয়৷ শুধু কবিত্বের দিক দিয়া বিচার করিলেও এই সকল কবিতাকে উচ্চোঙ্গের গীতি কবিতারূপে গণ্য করিতে হয়৷ কিন্তু মনে রাখা আবশ্যক, গানের মধ্যেই ইহাদের চরম সার্থকতা৷ কীর্তনের সুরলহরী পর্দায় পর্দায় উঠিয়া ঐ সকল কবিতার অন্তর্নিহিত রসসম্পত্তিকে সজীব করিয়া তুলে, তখন গায়ক ও শ্রোতা উভয়েই সেই মাধুর্যতরঙ্গে আপনাদিগকে হারাইয়া ফেলেন৷ মহাজনদের সেই অপার্থিব সুধানিস্যন্দিত পদসৌন্দর্য লোকোত্তর জগতের আভাস বিকশিত করিয়া- তোলে৷ ইহাই পদাবলীর গূঢ় ব্যঞ্জনা৷ কবিতার অতীত,ছন্দের অতীত, সুরের অতীত এমন এক ভাবজগতের সন্ধান কীর্তনে পাওয়া যায় যাহার জন্য শতশত বৎসর ইহা ভগবদ্‌ভক্তগণের পরম আস্বাদ্য হইয়া রহিয়াছে৷
ভক্তগণ মনে করেন যে, কীর্তনগানে ভগবৎসান্নিধ্য লাভ করা যায়৷ সেইজন্য পদাবলী শুধু সাহিত্য নহে, আধ্যাত্মিক ভাবসম্পদে সম্পন্নও বটে৷ অতএব পদাবলীকে তিন দিক দিয়া বিচার করিতে পারা যায়— (১) সাহিত্যের দিক দিয়া ইহা গীতি-কবিতা(lyrics) (২) সংগীতের দিক দিয়া ইহা কীর্তন, (৩) আধ্যাত্মিক দিক দিয়া ইহা ভগবদ্‌ভজন৷ সুর-তান-লয়ের মধ্য দিয়া এই যে রাশি রাশি উৎকৃষ্ট ভগবৎসম্বন্ধীয় গীতকবিতা রচিত হইয়াছে, ইহার তুলনা অন্য কোথায়ও পাওয়া যায় না৷
ভগবৎ-বিষয়ক সংগীত বলিয়া সাহিত্যের প্রসিদ্ধ নবরসের উপরে আর পাঁচটি মুখ্য রস কথিত হইয়াছে৷ যথা— শান্ত, দাস্য সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর৷ ইহার মধ্যে শান্তরস স্থির ধীর অচঞ্চল, যোগিজনের আস্বাদ্য৷ রসিক ভক্তগণ অপর চারি রসের মধ্য দিয়াই ভগবানকে আস্বাদন করিতে ইচ্ছা করেন৷
দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার চারি রস৷
চারি ভাবে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার বশ৷৷
— চৈতন্যচরিতামৃত, আদি
পদাবলীতে এই চারি রসেরই প্রাচুর্য দেখা যায়৷ এই সকল রস অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পালা কীর্তনে গীত হইয়া থাকে৷ শৃঙ্গার, উজ্জ্বল বা মধুর রসই সর্বশ্রেষ্ঠ৷ বৃন্দাবনলীলায় ব্রজবাসিগণ কেহ দাসভাবে, কেহ সখাভাবে, নন্দ-যশোদা প্রভৃতি বাৎসল্যভাব এবং গোপীরা পতিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করিয়াছিলেন৷ কীর্তনে সেই সকল ভাবের পদাবলী গান করিয়া ভক্তের মনে দাস্য সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর রসের উদ্দীপন করা হইয়া থাকে৷ কৃষ্ণদর্শনে কৃষ্ণের সঙ্গলাভে ব্রজবাসিজনের যেরূপ বিবিধ চেষ্টা লক্ষিত হইত, ভক্তগণের হৃদয়ে কীর্তনগানে সেই সকল চেষ্টার আবির্ভাব হয়, ইহাই এই বিশেষ সংগীতরীতির চরম সার্থকতা৷ স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ প্রভৃতি সাত্ত্বিকভাব উদ্দীপন করাই কীর্তনের উদ্দেশ্য৷ অনেকেরই এই সাত্ত্বিক ভাবের সকলগুলি না হউক কতকগুলির যে উদ্রেক হয়, ইহা এখনও প্রত্যক্ষ করা যায়৷
পদাবলীর জন্যই কীর্তন এবং কীর্তনের জন্যই পদাবলী৷ পূর্বেই বলা হইয়াছে উচ্চাঙ্গের কীর্তনে মহাজন-পদাবলী ব্যতীত অন্য কোনও গীতি গান করিবার নিয়ম নাই৷ জয়দেব চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি হইতে আরম্ভ করিয়া চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব-কবিগণের পদাবলীই কীর্তনে ব্যবহৃত হয়৷ মহাজন-পদাবলীর সে সজীব স্রোত বহুদিন হইল রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, কীর্তনের ধারাও সুতরাং শীর্ণ হইয়া পুড়িয়াছে৷ তথাপি কীর্তন-গায়কেরা এই পদাবলীকে তুলসীতলার প্রদীপের মত সযত্নে বক্ষের আড়াল দিয়া নানা ঝঞ্ঝাবাতরে মধ্যেও জীবিত রাখিয়াছেন৷