বিদ্যাপতির জন্মকালে মিথিলায় এই রকম সামাজিক ও বুদ্ধিবাদী পুনর্জাগরণের সূচনা হয়েছিল ৷ বিদ্যাপতির পরিবার ছিল এই কৃ্ষ্টিগত পুনরুত্থানের হোতা কয়েকটি মুষ্টিমেয় পরিবারের অন্যতম এবং বিদ্যাপতি নিজেকে এই পরিবারের উপযুক্ত তরুণ বংশধর হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন ৷ তিনি নব প্রতিষ্ঠিত ঐনবরা রাজবংশের সঙ্গে সারাজীবন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এবং এই রাজপরিবারের চারপুরুষের সাতজন রাজার সভাকক্ষ অলংকৃত করেন ৷ বিদ্যাপতি সমসাময়িক জীবনধারার প্রতিনিধি লেখকদের মধ্যে উজ্জ্বলতম ৷ তাঁর রচনা নিয়ন্ত্রণ করেছে রাজদরবারের বিভিন্ন ঘটনা ৷ ঐনবরা রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে মিথিলাবাসীও ওয়াকিবহাল নয় ৷ সুতরাং সংক্ষেপে ঐনবরা শাসক গোষ্ঠীর ইতিহাস আলোচনা করলে বিদ্যাপতির জীবন ও রচনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব হবে ৷
১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে হরিসিংহদেবের পরাজয়ের পর মিথিলায় কর্ণাট শাসন শেষ হয় ৷ যদিও কামেশ্বর ঠাকুরের হাতে রাজ্যের ভার দেওয়া হয়, তবুও কিছুদিন পর্যন্ত ঐনবরা বংশের কাউকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজা হিসেবে স্বীকার করা হয়নি ৷ কামেশ্বরের পর রাজ্যলাভ করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ভোগীশ্বর কিন্তু তাঁর অনুজ ভবসিংহ রাজ্যাধিকার নিয়ে মনান্তরের সৃষ্টি করেন ও রাজত্ব ভাগ হয়ে যায় ৷ এই দুই শাখার মধ্যে বিবাদ বিসংবাদ চলতেই থাকে ৷ স্বল্পায়ু ভোগীশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গণেশ্বর সিংহাসনে বসেন কিন্তু ২৫২ লক্ষ্মণ সম্বতে তাঁকে ভবসিংহের সন্তানরা ষড়যন্ত্র করে হত্যা করে ৷ গণেশ্বরের দুই পুত্র বীরসিংহ ও কীর্তিসিংহ পালিয়ে যান এবং বহু জায়গা ঘুরে অবশেষে জৌনপুরে ইব্রাহিম শাহের কাছে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ ও রাজত্ব পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন ৷ ইতিমধ্যে ভবসিংহ সম্পূর্ণ রাজ্যই হস্তগত করে রাজা তিরহুত নাম গ্রহণ করেছেন, তাঁকে সক্রিয় সমর্থন করেছেন বৃদ্ধ ও প্রাজ্ঞ চণ্ডেশ্বর, ভবসিংহ ‘সিংহ’ উপাধি গ্রহণ করেছেন রাজউপাধি হিসেবে ৷ মিথিলার ইতিহাসে ভবসিংহই ঐনবরা রাজবংশের প্রথম রাজা ৷
ভবসিংহের মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর পুত্র দেবসিংহ কিন্তু তিনি পারিবারিক কলহে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুত্র শিবসিংহকে সিংহাসন অর্পণ করে অবশিষ্ট জীবনের জন্য নৈমিষারণ্যে (কানপুরের কাছে, বর্তমানে নিমষার অঞ্চল) বাণপ্রস্থে চলে যান; শিবসিংহ তখন ১৬ বছরের কিশোর ৷ শিবসিংহ নিজেকে সৎসাহসী ও লোকপ্রিয় রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন ৷ তিনি ছিলেন স্বাধীনতাপ্রিয় ৷ বাংলা ও পাটনার মুসলমান নবাবদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন ৷ দেবসিংহের মৃত্যু হয় ২৯৩ লক্ষ্ণণ সম্বতে এবং তারপর শিবসিংহ স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার ভার নিয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরের জন্য রাজ্য শাসন করতে পেরেছিলেন ৷ ২৯৬ – ২৯৭ লক্ষ্মণ সম্বতের শীতে সম্ভবত জৌনপুরের ইব্রাহিম শাহ্‌ কীর্তিসিংহের সঙ্গে তিরহুত আক্রমণ করেন – উদ্দেশ্য গণেশ্বর -হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ এবং শিবসিংহকে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় ৷ এই যুদ্ধে শিবসিংহ পরাজিত হন, তবে তাঁকে জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থাতেই খুঁজে পাওয়া যায়নি ৷ জয়ী নবাব তিরহুত ছেড়ে চলে যান শুধু এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে রাজা দিল্লীর সম্রাটের বদলে জৌনপুরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করবেন ৷ শিবসিংহের পত্নীরা সকলেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান সপ্তরিতে (বর্তমান নেপালে), সেখানকার নেতা পুরাদিত্যের আশ্রয়ে, উদ্দেশ্য নিরুদ্দিষ্ট রাজার জন্য ১২ বছর অপেক্ষা করার পর শাস্ত্রবিধান অনুযায়ী রাজার শেষৃকত্য করে বৈধব্য গ্রহণ ৷ এই সময়ে তিরহুতের রাজা হন পদ্মসিংহ, শিবসিংহের অনুজ ৷ পদ্মসিংহের মৃত্যুর পর রাজকার্যের দায়িত্ব নেন তাঁর পত্নী বিশ্বাস দেবী ৷ ৩০৯ লক্ষ্মণ সম্বতে যখন শিবসিংহের পারলৌকিক কাজ করা হয় ও তাঁর পত্নী ‘সতী’ হন, তখন তিরহুতের সিংহাসনে পুরুষ শাসক হিসেবে আসীন হন ভবসিংহের অন্য এক পত্নীর গর্ভজাত কনিষ্ঠতম সন্তান প্রৌঢ় হরসিংহ ৷ হরসিংহের পর রাজ্যলাভ করেন তাঁর পুত্র নরসিংহ কিন্তু তখন আবার পারিবারিক কলহের সূত্রপাত হয় ৷ নরসিংহের মৃত্যুর পর রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ধীরসিংহ কিন্তু ধীরসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রের পরিবর্তে রাজ্যলাভ করেন অনুজ ভৈরবসিংহ ৷ বিদ্যাপতির মৃত্য হয় ৩৩০ লক্ষ্মণ সম্বতের কোনো এক সময়, শিবসিংহের নিরুদ্দিষ্ট হবার ৩২ বছরেরও বেশী পরে, তখন তিরহুতের রাজা ধীরসিংহ ৷
বিদ্যাপতির জন্মসময় সঠিকভাবে জানা না গেলেও শোনা যায় তিনি শিবসিংহের চেয়ে দু-বছরের বড় ৷ শিবসিংহ তাঁর পিতার মৃত্যুর পর যখন সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বছর এবং তিনি নিজস্ব অধিকারে রাজ্যলাভ করেন ৷ ২৯৩ লক্ষ্মণ সম্বতের চৈত্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের যষ্ঠীতে, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার; ১৩২৪ শকাব্দে বা ১৪০২ খ্রিষ্টাব্দে ৷ এর থেকে অনুমান করা যায় বিদ্যাপতির জন্ম ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে বা তার কাছাকাছি অর্থাৎ কর্ণাট বংশ পতনের ২৭ বছর পর এবং জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের ‘বর্ণরত্নাকর’ রচনার ২৫ বছরের মধ্যে ৷ সুতরাং ষড়যন্ত্রকারীরা যখন গণেশ্বরকে হত্যা করে এবং ভবসিংহ সম্পূর্ণ তিরহুত রাজ্যের অধিকারী হন, বিদ্যাপতি তখন দশ বছরের বালক ৷ হিসেব করলে অনুমান করা যায় বিদ্যাপতির জন্মকালে তাঁর পিতামহের জ্ঞাতি ভ্রাতা চণ্ডেশ্বর জীবিত। বিদ্যাপতি ধীরেশ্বরের প্রপৌত্র ৷ ধীরেশ্বর পরিচিত ছিলেন ‘মহা-বর্তিক-নৈবন্ধিক’ হিসেবে, যদিও তাঁর রচনা এখন সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত ৷ তিনি ছিলেন বীরেশ্বর (চণ্ডেশ্বরের পিতা) ও গণেশ্বরের ভাই ৷ গণেশ্বর কর্ণাটবংশের শেষ রাজার মন্ত্রী ছিলেন,তাঁর খ্যাতি প্রবাদপ্রতিম ৷ বীরেশ্বর ও গণেশ্বরের বহু কাহিনী ‘পুরুষপরীক্ষা’য় বর্ণিত আছে ৷ ধীরেশ্বরের পুত্র ছিলেন জয়দত্ত এবং জয়দত্তের পুত্র গণপতিই বিদ্যাপতির পিতা ৷
একই নামের দারুণ একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে যে ধীরেশ্বরের পুত্র ও ‘বর্ণরত্নাকর’ রচয়িতা কবিশেখর জ্যোতিরীশ্বর হলেন জয়দত্তের ভ্রাতা এবং জয়দত্ত বিদ্যাপতির পিতামহ ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জ্যোতিরীশ্বরের পিতা ধীরেশ্বর রামেশ্বরের পুত্র এবং বিদ্যাপতির প্রপিতামহ ধীরেশ্বর দেবাদিত্যের পুত্র ৷ এছাড়া জ্যোতিরীশ্বর বাৎসগোত্রজ এবং বিদ্যাপতি কাশ্যপ গোত্রের ৷ একইভাব বিদ্যাপতির পিতা গণপতি এবং ‘গঙ্গা -ভক্তি -তরঙ্গিনী’র রচয়িতা গণপতিকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়; এই ধারণাটিও ভ্রান্ত ৷ কারণ, বিদ্যাপতির পিতা গণপতি জয়দত্তের পুত্র আর ‘গঙ্গা-ভক্তি-তরঙ্গিনী’র লেখক গণপতি ধীরেশ্বরের পুত্র ৷ এমনকি বিদ্যাপতি নামটিও মিথিলায় বহুল প্রচলিত ছিল, ঠাকুর উপাধিটিও ৷ একই নামে একাধিক ব্যক্তির রচনা আমাদের হস্তগত হয়েছে ৷ সুতরাং বিদ্যাপতির রচনা গবেষণাকালে আমাদের শুধুমাত্র নাম নয়, যথার্থ প্রামাণ্যতার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ৷ তা না হলে বিদ্যাপতির পিতা গণপতি ও ‘গঙ্গা-ভক্তি-তরঙ্গিনী’র লেখক গণপতির অভিন্নতা বা ‘বর্ণরত্নাকর’ রচয়িতার সঙ্গে বিদ্যাপতির পিতামহের ভ্রাতার অভিন্নতা জাতীয় ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হবে, যা আদপেই বাঞ্ছনীয় নয় ৷