খ্রীষ্টীয় ১০ম-১১শ শতকে ধর্মে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে ও অধ্যাত্মসাধনায় যে বৌদ্ধ-বজ্রযান ও সহজযান-সম্প্রদায়ের
প্রভাব ও ভাবধারা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে বাংলার সমাজে যে এক নূতন চিন্তাপ্লাবনের সৃষ্টি করেছিল সেকথা পূর্বে কিছু
আলোচনা করেছি৷ ঐ নূতন প্লাবন বা বিবর্তনের ফলস্বরূপ বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা,
গুরুসত্য প্রভৃতি সাধনমার্গে অধ্যাত্ম-পদগানের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল৷ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্যতম
জীবনালেখ্য-রচয়িতা ডাঃ শশীভূষণ ঘোষ (ইনি শ্রীরামকৃষ্ণের পরমসান্নিধ্য লাভ করেছিলেন৷ ) বাংলার র্ধমসাধনায়
বৌদ্ধ-সহজযান-ধর্মমতের অনুপ্রবেশ সম্বন্ধে যেকথা বলেছেন এখানে তার উল্লেখ করা সমীচীন মনে করি —
যদিও মতভেদ থাকা স্বাভাবিক৷ তিনি বলেছেন : “কর্তাভজা ও বাউল-সম্প্রদায়ের স্ত্রীলোক (শক্তি) লইয়া সাধনা
সহজিয়া -বৈষ্ণবমতেরই অনুকরণ৷ আবার সহজিয়ামত বৌদ্ধ-তান্ত্রিকমতের রূপান্তরমাত্র৷ মহাযানমতাবলম্বী
শূণ্যবাদী বৌদ্ধেরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করিলেও তাহাদের এক শাখা মহাযান ধর্মসেবীরা বুদ্ধ ও
বোধিসত্ত্বদিগের সাকারমূর্তির পূজা করিত৷ আবার মহাযানের আর এক সম্প্রদায় মন্ত্রযান বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের এক
একটি দিব্যশক্তি কল্পনা করিয়া শক্তিপূজার প্রচলন করিয়াছিল৷ এই শক্তিপূজা হইতেই বৌদ্ধতান্ত্রিকতার আরম্ভ৷”
প্রাচ্যবিদ্যার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনাপ্রসঙ্গে অনেকটা অনুরূপ মন্তব্যই করেছেন৷
তিনি বলেছেন ঃ “Thus Dr. Waddel says : “This intense mysticism of
the Mahayana let about the fifth century, to the importation
into Buddhism of the pantheistic idea of the sould(atman)and Yoga or the ecstatic union of the individual with the universal spirit-a doctrine which had been introduced into Hinduism by Patanjali (IIathayoga-pradipika)”. The Yogachara school also, in its later development, received and assimilated some magic circles with mantras or spells about 700 A.D., and hence received the new appellation of Mantrayana. But the Mahayana School did not stop there. Having once commenced the work of importation and assimilation, it went on with it, with all its zeal and vigour, and was before almost a new thing. About the seventh century A.D. the development of the infatuating Tantrikism, which practically verges on sorcery claiming a religious basis, attracted the notice of the Mahayana School and ere long the idolatrous cult of female energies was found grafted upon the theistic Mahayana and the pantheistic mysticism of Yoga. And this Tantrika phase of the Mahayana School reached its climax when it adopted and assimlated with itsefl the theory of the Kalachakre. * * It wants to establish a mysterious union between the terrible goddess Kali of the Tantrika system, and the Dhyani and Buddhas-the Adi-Buddha himself, of the Buddhistic system and attempts to explain creation and the secret agencies of nature in the light of this union. In the tenth century, the Kalachakra system of the Mantrayana School,as the result of further and further retrograde developments, passed into the system of the Vajrayana of the thunderbolt-vechile. This is the most depreaved form, that Buddhistic doctrine on its downward course of importation, assimilation and compromise, had ever assumed.” (The Archaeological Survy of Mayurabhanja, vol. 1 (1911), pp.cvi.cvil.)

বুদ্ধদেবের সময়েই স্ত্রীলোকদিগকে সন্ন্যাসে অধিকার দেওয়া হয়৷ “কালক্রমে সকল বৌদ্ধমঠে সহস্র সহস্র মুণ্ডিতমস্তক শ্রমণ ও শ্রমণীগণের অবাধ একত্র অবস্থানের কুফল উৎপন্ন হইয়াছিল৷ শীঘ্রই ইহাদিগের ভিতর বজ্রযান নামে নব-সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়৷ ইহারা এই মত গোপনে প্রচার করিলেন যে, তাঁহাদিগের সাধনপথে ভোগসুখ উপভোগ করিয়া সহজে নির্বাণপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়৷ * * কামিনী-কাঞ্চনাসক্ত সাধারণের আসক্তির অনুরূপ নির্বাণ লাভের এই “সহজতত্ত্ব” তাঁহাদিগের উপাস্য ভগবান বজ্রসত্ত্ব ও তাঁহার শক্তি বজ্রেশ্বরী একীভূত হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন বলিয়া বজ্রযান-সম্প্রদায় নানা “সহজ”-মতের তন্ত্রশাস্ত্র প্রচার করিলেন৷” (ডাঃ শশীভূষণ ঘোষ ঃ শ্রীরামকৃ্ষ্ণদেব (উদ্বোধন থেকে প্রকাশিত), পৃঃ ৬১০-৩১১৷ ) অবশ্য এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে৷ ) মোটকথা মহাযানের অন্তর্গত মন্ত্রনয় অথবা মন্ত্রযান-সম্প্রদায়ই বৌদ্ধতন্ত্রবাদের প্রবর্তন করে৷ মন্ত্রযানের অপরাপর শাখাই বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান প্রভৃতি৷
এখানে মনে রাখা উচিত যে, গৌতম -বুদ্ধের জীবদ্দশায়ই বৌদ্ধ ভিক্ষুণীরা ভিক্ষুদের মতো তাঁদের নিজেদের একটি পৃথক সঙ্ঘ সৃষ্টি করেছিলেন৷ বুদ্ধদেবের কঠোর অনুজ্ঞা ও অনুশাসন ছিল যে, কোন ভিক্ষুণীই কোনদিন কোন ভিক্ষুর সঙ্গে একত্র বিহার, একত্র কথোপকথন ও একত্র বাস করতে পারবে না৷ (ডঃ হাবম্যান ওল্ডেনবার্গ রচিত Buddha, His Life, His Doctrine, His Order-গ্রন্থে The Orders of Nuns শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব্য, পৃঃ ৩৭৭ – ৩৮১৷ ) কিন্তু বুদ্ধদেবের তিরোভাবের বহু পরে কঠোর শাসননীতির বজ্রবাঁধন কিছুটা শিথিল হয়েছিল এবং সেই শৈথিল্যের ফলে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী-সমাজে অবাধ মেলামেশায় সুযোগ দেখা দিয়েছিল৷ “ভিক্ষুপ্রাতিমোক্ষ” গ্রন্থে এই অবাধমিলনের কলঙ্ক-পরিণতির সাক্ষ্য আছে৷ হিন্দুতন্ত্রের বামাচার অনুপ্রবেশের ইতিকথাও তাই৷ তবে স্বেচ্ছাচারমূলক বামাচার হিন্দুতন্ত্রে আসল সাধনমার্গ নয়, তা অধ্যাত্মসাধনার বিকৃত রূপমাত্র৷ পরশুরাম কল্পসূত্র, কৌলাবলীতন্ত্র, কৌল-উপনিষৎ, কুলার্ণব প্রভৃতি তন্ত্রে বামাচারকে “বাম” অর্থে কালী, সুতরাং আদ্যাশক্তি দক্ষিণাকালীর আচার বা উপাসনাবিধি বলা হয়েছে৷ মহাকালী মহাশক্তির আরাধনা ও উপাসনাবিধিই আসলে বামাচার নামে প্রচলিত৷
ডাঃ শশীভূষণ ঘোষ তাঁর আলোচনাপ্রসঙ্গে পুনরায় বলেছেন ঃ “সহজিয়া-বৈষ্ণবগণ বজ্রযানের বজ্রেশ্বরীকে “বাশুলী” নামে পূজা করিতে লাগিলেন এবং শ্রীশ্যামসুন্দর ও শ্রীরাধারাণীর যুগলরূপ শক্তি বা নায়িকাতে অধিষ্ঠিত বিশ্বাস করিয়া পরকীয়াসাধনাই প্রবল রাখিলেন৷ ইহাদের মতে, মনুষ্যভজনই সাধনের প্রধান অঙ্গ৷ প্রথমে একটি পরকীয়া রমণী গ্রহণ করিয়া তাঁহারা সেই নায়িকার দেহই শ্রীবৃন্দাবন এবং তাঁহাতেই শ্রীশ্যামসুন্দরও শ্রীরাধারাণী বিরাজিত ভাবিয়া থাকেন৷ নায়িকাতে দেহ ও মন আরোপ করিয়া সাধন করিলে অচিরাৎ প্রেমরসসাধনে সিদ্ধিলাভ হয়৷ সহজিয়ারা আপনাদিগকে রসমার্গের পথিক রসিক ভক্ত বলিয়া থাকেন৷ তাঁহাদিগের মতে, বিল্বমঙ্গল, বিদ্যাপতি,চণ্ডীদাস, জয়দেব গোস্বামী, রায় রামানন্দ– এই পাঁচজন রসিক ভক্ত সহজিয়াধর্ম সাধন করিয়াছিলেন ৷” (“শ্রীরামকৃষ্ণদেব” –(উদ্বোধন” পৃঃ ৩১২)৷
অনেকের অভিমত যে, বৌদ্ধ-পালরাজাদের আমলে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের পূর্ণ-প্রাবল্য দেখা দিয়েছিল৷ বাংলার ইতিহাস থেকে একথাও আবার সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, অষ্টম শতকের শেষভাগে ধর্মপাল (১ম) গৌড়ের মসনদে যখন আরোহণ করেন তখন ধর্মাচারের মধ্যে অনেক-কিছু মালিন্য তিনি দূর করেছিলেন নূতন পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করে৷ খ্রীষ্টীয় ১০১৫ থেকে ১০৬০ শতকে বাংলার সমাজে ধর্মপাল (২য়), মহীপাল (১ম) ও নয়পাল প্রভৃতি পালরাজগণের যখন প্রভাব বিস্তৃত,তখন ধর্মের পরিবেশ বেশ শান্ত ও পবিত্র ছিল৷ শ্রীজ্ঞান-দীপঙ্কর বা অতিশ-দীপঙ্কর,রামাই পণ্ডিত, হাড়ি-পা বা হাঁড়িসিদ্ধ, কমলাকুশিল, নরেন্দ্র-শ্রীজ্ঞান, দান-রক্ষিত প্রভৃতি সাধকের সংস্পর্শে বৌদ্ধতন্ত্রাচার তখন সুনিয়ন্ত্রিত৷ বৌদ্ধতন্ত্রে প্রবৃত্তিমার্গের ধারা তখন বর্তমান থাকলেও নিবৃত্তির প্রসন্নতা ধীরে ধীরে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল৷ নেপালের বৌদ্ধগণ বজ্রযানমতাবলম্বী ছিলেন৷ তিব্বতে বৌদ্ধ-তান্ত্রিকাচারেরই বিশেষ প্রভাব ছিল৷ বাংলাদেশেও তান্ত্রিক বামাচারের পাশাপাশি সিদ্ধান্তাচার ও দিব্যাচার ও অন্যান্য তন্ত্রাচারের প্রবর্তন হয়৷ আচারবিলাসী তন্ত্রশাস্ত্র ছাড়া বেদান্তের সমপর্যায়ভুক্ত “মহানির্বাণতন্ত্র” প্রভৃতি গ্রন্থও সেইসময়ে লিখিত ও প্রচারিত হয়৷ ক্রমে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যূদ্বয় দেখা দিলেও বৌদ্ধতন্ত্রের সাধন ও চিন্তাধারা হিন্দুসমাজের শিরায় শিরায় অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল৷ ফলে নূতন রূপ ও নাম নিয়ে বৈষ্ণব-সহজিয়া, বাউল, গুরুসত্য, কর্তাভজা তথা মানুষরূপে গুরুপূজা কায় বা কায়াসাধন প্রভৃতি সাধনতত্ত্বের উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল একথা আগেই বলেছি৷ খ্রীষ্টীয় ১০ম-১১শ শতকের চর্যা ও বজ্রগীতির রচয়িতা সহজযানী ও বজ্রযানী বৌদ্ধসাধকরাও ছিলেন ঐ রহস্যসাধনারই পথচারী এবং বাংলার পরবর্তী বৈষ্ণব-সহজিয়া-সাধনাচারীরাও ঐ সহজযানী ও বজ্রযানী বৌদ্ধসাধকদের কতকাংশে অথবা বহু অংশে অনুসারী ছিলেন৷
ঐ সময়ে যোগপন্থানুসারী নাথধর্মও স্বতন্ত্রভাবে বাংলার সর্বত্র বিস্তারলাভ করেছিল বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাবকে অতিক্রম না করেও৷ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “But there were other forms of religions which the Buddhist community absorbed in itself. One of these is the Nath-marga or Nathism. * * Thus the Nathism of Matsyendra arose outside Buddhism, but was at last absorbed into it. On the otherhand, Ramana Vajra was a Buddhist of the Varayana School,but when he became Goraksanath, and was regarded as a hertic by Buddhists,so Goraksa”s Nathism was originally within Buddhism, but it was not incorporated into it”. (Vide Introduction to the Modern Buddhism and Its Followers in Orissa, p. 89.)
আসলে গুরু গোরক্ষনাথ, মীননাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য নাথ আচার্যদের প্রবর্তিত যোগসাধন, কায়াসাধন ও উল্টাসাধন প্রভৃতিও বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মে প্রবেশ লাভ করেছিল৷ “গোরক্ষসম্প্রদায়ে প্রচলিত হঠযোগের গ্রন্থে মৎস্যেন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত একটি কষ্টসাধ্য আসন ও তাহার ফলের কথা আছে, যথা —
বামোরুমূলার্পিতদক্ষপাদং
জানোর্বহির্বেষ্টিতবামপাদম্‌৷
প্রগৃহ্য তিষ্ঠেৎ পরিবর্তিতাঙ্গঃ
শ্রীমৎস্যনাথোদিতমাসনং স্যাৎ৷৷
-হঠযোগপ্রদীপিকা ১৷২৬

* * *

“আদিনাথ শঙ্কর হঠযোগের উপদেষ্টা ঃ “আদিনাথ শিবঃ সর্বেষাং নাথনাং প্রথমো নাথঃ৷ * * মৎস্যেন্দ্রাখ্যশ্চ আদিনাথ-শিষ্য৷”” * * গোরক্ষ-সংহিতায় গোরক্ষনাথের উপদেশ “আসনং প্রাণসংরোধঃ প্রত্যাহারাশ্চ ধারণা” এবং “যোগশাস্ত্রঞ্চ পরমং যোগিণাং সিদ্ধিদায়কম্‌৷” এতদ্ব্যতীত গোরক্ষনাথ কায় বা কায়াসাধনের প্রধান নেতা ছিলেন, যোগের কঠোর নিয়ম দ্বারা দেহসংযম ও চিত্তবৃত্তিনিরোধ ছিল মৎস্যেন্দ্র-গোরক্ষের পন্থা৷” ( ডঃ কল্যাণী মল্লিক ঃ “নাথসম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও সাধনপ্রণালী” (১৯৫০) পৃঃ ৬৫) এ থেকে প্রমাণ হয় যে, গোরক্ষনাথ, মৎস্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি নাথাচার্যদের যোগ পদ্ধতি বৌদ্ধধর্ম-সাধনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং চর্যারচয়িতা সিদ্ধাচার্যারাও সেই যোগপদ্ধতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন৷
পরে খ্রীষ্টীয় নবন শতকে সহজিয়াসম্প্রদায় যখন বৌদ্ধ-বজ্রযানধর্মমতের অনুসরণ করেছিলে তখন কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদ (কাহ্ন-পাদ) প্রভৃতি গাথা বা পদ-রচয়িতারা যে বহু সহজিয়াগান রচনা করে বাংলার গীতিভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলার ইতিহাস তার সাক্ষ্য দান করে৷ অচ্যুতানন্দের শূণ্যসংহিতায়ও আমরা এর কিছুটা প্রমাণ পাই৷ শূণ্যসংহিতার ১০ম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে,
নাগান্তক বেদান্তক যোগান্তক জেতে৷
নানা প্রতি বিধিরে কহিলে তোষ চিতে ৷৷
গোরক্ষনাথঙ্ক বিদ্যা বীরসিংহ আজ্ঞা৷
মল্লিকানাথঙ্ক যোগ বাউলী প্রতিজ্ঞ৷৷
লোহিদাস কপিলঙ্ক সাক্ষিসন্ত্র জেতে ৷
কহিলে জে যেমন্ত সে হোইক্কি গুপতে৷৷
অর্থাৎ নাগার্জুনের অনুসারী নাগান্তক বা সৌত্রান্তিক,যোগান্তিক বা যোগাচার প্রভৃতি বৌদ্ধসম্প্রদায় তাঁদের আপনাপন নিয়মপদ্ধতিকে অনুসরণ করে ও স্বধর্মে ও বিশ্বাসে নিষ্ঠ ছিলেন৷ তাছাড়া বীরসিংহের অনুশাসনে গোরক্ষনাথের ধর্মমত ও যোগানুষ্ঠান, মল্লিকানাথের যোগসাধন, বাউলী বা বাউলধর্ম এবং লোহিদাস ও কপিলের সাক্ষীমণ্ডল ছিল সর্বসাধারণের লোকচক্ষের অন্তরালে গুপ্ত ও রহস্যময়৷ আচার্য মীননাথের মন্ত্রশিষ্য গুরু গোরক্ষনাথ পরে মৎস্যেন্দ্রনাথ নামে পরিচিত হয়েছিলেন৷ তিব্বতের ইতিবৃত্ত থেকে জানা যায়, গোরক্ষনাথ তিব্বতের বৌদ্ধসম্প্রদায়ে বিশেষভাবে পূজিত ছিলেন৷ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের বিবরণ থেকেও জানা যায়, খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতকে গোরক্ষনাথ শৈবধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং তারজন্য তাঁর প্রবর্তিত যোগীসম্প্রদায়ের কাছে তিনি “শিবাবতার” বলে পরিচিত ও পূজিত ছিলেন৷ অচ্যুতানন্দ তাঁর শূণ্যসংহিতায় গোরক্ষনাথ ও মল্লিকানাথকে বৌদ্ধ-যোগাচারধর্মমতের অনুসারী ছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন৷
পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, চর্যা ও বজ্র-গীতি নির্দিষ্ট তালে ও রাগে গীত হোত এবং তাল ও রাগগুলি ছিল শাস্ত্রীয় অভিজাত সঙ্গীতপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত৷ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন ঃ “চৈতন্যদেবের অন্ততঃ ছয় শত বৎসর পূর্বে ভারতে বৌদ্ধসিদ্ধাচার্যগণ সংকীর্তনের গান (“সংকীর্তন” শব্দটির প্রয়োগ ঠিক নয়, কেননা চর্যাগুলি ছিল গীতি বা গান, বৈষ্ণব পদকীর্তন বা সংকীর্তন থেকে তারা প্রকাশেও গঠনে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল৷) বাঁধিয়া ও নানা রাগ-রাগিণীতে ঐ সমস্ত গান গাইয়া ভারতবাসীর মন বৌদ্ধধর্মের দিকে আকৃষ্ট করিতেন৷ তাঁহারা সচরাচর যে সমস্ত রাগিণীতে গান গাহিতেন তাহাদের নাম পঠমঞ্জরী, গবড়া, অরু, গুঞ্জরী, দেবক্রী, দেশাখ, ভৈরবী, কামোদ, ধনেশ্রী, রামক্রী, বরাড়ি, শীবরী (সাবেরী), মল্লারি, মালশ্রী, কহ্নূ, গুঞ্জরী, বাংগলা প্রভৃতি৷” (“বৌদ্ধ গান ও দোহা” (১৩২৩ সাল), পৃঃ ৬)৷ অবশ্য চর্যায় অনেক বিকৃত রাগনামের উল্লেখ আছে, যেগুলির সুসংস্কৃত নাম সঙ্গীতশাস্ত্রে পাওয়া যায়৷ মহামহোপাধ্যায় বলেছেন যে, বৌদ্ধসন্ন্যাসীরা অনেক সময় গাথা রচনা করতেন এবং গাধা বা গাথাগান রচনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ভাষা ছিল৷
কোন কোন পণ্ডিতের অভিমত যে, বৌদ্ধ-ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের আচরণমূলক অথবা আচরণের উদ্দেশ্যে রচিত গাথাগানই চর্যাগীতি৷ “চর্যা”-শব্দটির আভিধানিক অর্থ আচরণ (চর্‌-ধাতু থেকে নিষ্পন্ন), পালন, রক্ষণ, অনুষ্ঠান প্রভৃতি; যেমন ধর্মচর্যা, দেহচর্যা, ব্রতচর্যা৷ ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “ঐ “চর্যা” শব্দ থেকেই তপস্বীর আচরণ — তপশ্চর্যা, নটের আচরণ–নটচর্যা শব্দগুলির সৃষ্টি৷ এথেকে অনুমান হয় যে, খ্রীষ্টীয় ১০-১১শ শতকের বাংলার বৌদ্ধ সমাজে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের ধর্মাচরণমূলক বা অধ্যত্মকর্ম-আচরণের উদ্দেশ্যে রচিত গাথাগানই চর্যাগীতি”৷ এখানে “গাথা” গানেরই প্রতিশব্দ৷ বৈদিক যুগে যজ্ঞানুষ্ঠান বা যজ্ঞকর্মে “গাধা-নারশাংসী” গান করা হোত৷ ঠিক ঐ রকমভাবে বৌদ্ধযুগে নিষ্ঠাচারী ভিক্ষু ও নিষ্ঠাচারিণী ভিক্ষুণীরা অসংখ্য গাথা বা পদ রচনা করে শাস্ত্রীয় রাগে ও তালে তাদের সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে ও উৎসব -ব্যাপারে গান করতেন৷ তাছাড়া অধ্যাত্ম সাধনচর্যার গানের বিধি তো ছিলই ৷ (লেখকের “রাগ ও রূপ””, ১ম ভাগ (৩য় সংস্করণ), পৃঃ ৭৮ দ্রষ্টব্য)৷ অনেকে বলেন, চর্যাগীতিগুলি প্রধানত উৎসবে বা অবসর-বিনোদনে গান করা হোত৷ কিন্তু অবসর বিনোদনের কথা বাদ দিলে উৎসব-প্রসঙ্গে গীত হলেও চর্যাগীতি যে পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টির কারণ হোত তা “উৎসব”-শব্দ থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ হয়৷
আসলে চর্যা ও বজ্র-গীতিগুলি ছিল নিছক অধ্যাত্মপরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত ৷ চর্যা সহজিয়া ও বজ্রযান এই দুই বৌদ্ধ-সাধকসম্প্রদায়ের নির্ধারিত গীতি৷ কথিত যে, বজ্রগীতি গুহ্য যৌগিক ও তান্দ্রিক অনুষ্ঠানে মণ্ডলচক্রে গীত হোত৷ ডঃ সুকুমার সেন বলেন, এই মণ্ডলচক্র ছিল “অনেকটা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের যোগিনীচক্রের সমপর্যায়ভুক্ত৷ বৌদ্ধ-যোগিনীচক্র বা মণ্ডলচক্রের অনুষ্ঠানে বজ্রগীত গান করে বজ্রধর হেরুককে জাগ্রত করা হোত। এরই জন্য চর্যাগীতি বজ্রগীত থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির ছিল৷ চর্যার সাহিত্যরচনা প্রায় সম্পূর্ণ হোত যদি তার শেষপদে ও তৃতীয় পদে অথবা দ্বিতীয় পদরূপ ধ্রুবপদে ভণিতা সন্নিবেশিত থাকত৷ তবে এই ধ্রুবপদ “ধ্রুবপদের তস্যানুৎপাদং সূচয়তি,” “ধ্রুবপদের তমেবার্থমভিদ্যোতয়তি”, “ধ্রুবপদেনাসংগপরিহারং করোতি” প্রভৃতি নিবদ্ধ প্রবন্ধগীতিরূপ ধ্রুবপদ নয়, এটি গান বা পদের অংশ বা ধাতু৷ কারু কারু মতে, চর্যাগীতির ভাষায় দুইরকম অর্থের দ্যোতনা পাওয়া যায়৷ অদ্বয়বজ্র ও মুনিদত্তের ভাষ্যে এই দ্ব্যর্থক ভাষাকে বলা হয়েছে “সন্ধাভাষা”, বা “সন্ধাসংকেত” বা “সন্ধাবচন”৷ (সন্ধ্যাভাষার মধ্যে “সন্ধ্যা” শব্দটির মার্জিত রূপ “সন্ধা” (সম্‌ + ধা =সন্ধা), অর্থাৎ বা অভিসন্ধিসূচক বা আভিপ্রায়িক ভাষা তাই “সন্ধাভাষা”৷ ) যেমন (১) যথা বালৈঃ সন্ধাভাষণম-জনদভিম নপবনাদিনিরোধমাশ্রয়ঃ কল্পিতঃ; (২) বারুনীতি সন্ধাবচনেন * * (৩) “দুলি সন্ধাসংকেতে বোদ্ধব্যম্‌” প্রভৃতি৷
চর্যাগীতির প্রকৃতি, রচনা ও গীতরীতি বা গায়নশৈলীর ধারা আমরা পরবর্তী সঙ্গীতগ্রন্থগুলির মধ্যেও পাই৷ পূর্বেই বলেছি যে, খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতকের সঙ্গীতশাস্ত্রী শার্ঙ্গদেবের “সঙ্গীত-রত্নাকর” এবং ১৬শ শতকের গুণী বেঙ্কটমখীর “চতুদণ্ডীপ্রকাশিকা”-গ্রন্থে চর্যার গীতি ও গায়নশৈলীর পরিচয় আছে সম্পূর্ণ ক্ল্যালিক্যাল-পরিবেশ নিয়ে৷ হতে পারে যে, ৯ম-১১শ শতকের চর্যাগীতির গীতিরীতি হয়তো ১৩শ বা ১৬শ শতকের চর্যার উন্নত গীতিরীতির ঠিক সমপর্যায়ভুক্ত ছিল না৷ কিন্তু তাহলেও সঙ্গীত-রত্নাকর ও চতুর্দণ্ডীপ্রকাশিকায় বিশ্লেষিত চর্যার রূপ ও শৈলী থেকে ৯ম-১১শ শতকের সমাজে গীত চর্যার রূপ ও গায়নশৈলীর কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়৷ তাছাড়া একথা সত্য যে, খ্রীষ্টীয় শতকের আরম্ভ থেকে প্রায় ১৭শ-১৮শ শতক পর্যন্ত ভারতীয় সঙ্গীতের রাগরূপ তার মূলনিয়ন্ত্রক রাগ বা স্ট্যাণ্ডার্ড -স্কেল অনুযায়ী বর্তমান রাগরূপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল, আর তারইজন্য প্রাচীন গানে বা পদে রাগনামের উল্লেখ থাকলেই যে তা ঠিক বর্তমান রাগরূপ অনুযায়ী গীত হবে এমন কোন নিয়ম নেই৷ যেমন, সঙ্গীতশিক্ষাবিদ্‌-মাত্রেই জানেন যে, নাট্যশাস্ত্রকার ভরতের সময়ে মূলনিয়ন্ত্রক রাগ বা থাট (standard scale) ছিল অনেকটা এখনকার কাফীরাগ-অনুযায়ী অর্থাৎ স রি জ্ঞ ম প ধ ণ (= গান্ধার ও নিষাদ কোমল বা বিকৃত) এবং এই নিয়ন্ত্রক রাগ বা থাটরূপের প্রচলন ছিল প্রায় ১৭শ – ১৮শ শতক পর্যন্ত৷ বিদ্যারণ্য মুনি ছিলেন যেমন বিদগ্ধ দার্শনিক, তেমনি ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞানী৷ বিদ্যারণ্য মুনির আবির্ভাব-কাল খ্রীষ্টীয় ১৪শ – ১৫শ শতক৷ তাঁর মতে, তদানীন্তন সকল রাগের মূলনিয়ামক রাগ বা থাট ছিল মুখারী — যার স্বররূপ ছিল এখনকারই কাফীরাগের (থাটের) মতো — স রি জ্ঞ ম প ধ ণ ৷ অথচ ১৯শ শতকের শেষভাগ অথবা ২০শ শতকের প্রথম ভাগে সকল রাগের মূলনিয়ন্ত্রক বা নিয়ামক-রাগরূপে আত্মপ্রকাশ করলো বিলাবলরাগ বা বিলাবলথাট,–যার সকল স্বররূপ–স রি গ ম প ধ ন (অর্থাৎ সকল স্বরই শুদ্থ) সুতরাং প্রাচীন রাগগুলিকে পদ বা গানের রূপে প্রকাশ করতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন হয় স্বররূপের পরিবর্তন৷ যেমন, দ্বারভাঙ্গার রাগতরঙ্গিণীকার লোচন কবি (১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ) (অনেকে দারভাঙ্গা সংস্করণে উল্লেখ অনুযায়ী রাগতরঙ্গিণীর রচনাকাল নির্ণয় করেন ১১শ শতকে, কিন্তু তা ঠিক নয়৷ রাগতরঙ্গিণীর আলোচনাভঙ্গি ও রাগরূপসমাবেশ লক্ষ্য করলে তাকে খ্রীষ্টীয় ১৭শ শতকের মধ্যভাগের গ্রন্থ বলেই প্রতিপন্ন করা উচিত৷) ভৈরবরাগকে গৌরীসংস্থান বা গৌরীমেলের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। গৌরীমেলের রূপ বর্তমান হিন্দুস্থানী পদ্ধতির ভৈরবীমেলের মতো অর্থাৎ স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ (ঋষভ, গান্ধার, বৈধত ও নিষাদ কোমল বা বিকৃত )। কিন্তু ৯ম-১১শ শতকের সঙ্গীতশাস্ত্রী জৈন পার্শ্বদেব বলেছেন ঃ ভৈরব-শ্রীরাগৌ-রি-প-হীনৌ * * রাগাংগানি বিদুর্বুধাঃ ।” সুতরাং ভৈরব ও শ্রীরাগ পাঁচস্বরের ঔড়বজাতির রাগ। কিন্তু বর্তমান পদ্ধতির ভৈরব সম্পূর্ণজাতির। সুতরাং এই থেকে সহজেই আনুমান করা যায় যে, প্রাচীন কালে বর্ণিত (খ্রীষ্টীয় ১ম-১৩শ অথবা তারও বেশী ) রাগরূপগুলি হুবহু প্রাচীনের মতো প্রকাশ করতে গেলে অনেক সময় তা অসমীচীন হবে। তাছাড়া ভৈরবী, কল্যাণ, খামাজ (খম্বাজ বা খাম্বাজ বা খামাইচ্‌), আসাবরী, বিলাবল (বর্তমান পদ্ধতির) রাগগুলিরও রূপবিকাশ পেতে পারি। অবশ্য এ সমস্তই সঙ্গীতে গাণিতিক বিশ্লেষণের পরিণতি, সুতরাং সাধারণের পক্ষে তা সহজবোধ্য নয় বলে তার আলোচনা থেকে বিরত হলাম। কিন্তু চর্যাগীতিতে যে সমস্ত শাস্ত্রীয় রাগের উল্লেখ আছে, সেগুলি নিশ্চয়ই সাধক-শিল্পীরা সার্থকভাবে প্রকাশ করতেন তাদের রাগে, তালে , বসে ও ভাবে সম্পৃক্ত করে৷ বর্তমানে ঐ প্রাচীন কালের তথা ৯ম -১১শ শতকের চর্যা ও ব্রজ-গীতগুলিকে গানে প্রকাশ করতে গেলে একটি নিয়মকে আমাদের অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রেই এই সকল প্রাচীন ও নবীন সঙ্গীতপদ্ধতি তথা রাগপদ্ধতির আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে৷ ( এই সম্বন্ধে লেখকের “রাগ ও রূপ”, ১ম ভাগ, (৩য় সংস্করণ), পৃঃ ৮১ দ্রষ্টব্য৷) সুতরাং সহজ বোধ্যভাবে “গীতগোবিন্দ”-পদগীতিতে রাগরূপের প্রসঙ্গে এগুলির আলোচনা করার চেষ্টা করব৷
তবে একথা সত্য যে, প্রাচীন ভারতেও শাস্ত্রীয় রা ও তাল সম্পৃক্ত করে যে সকল গান গাওয়া হত তারা বেশীর ভাগই ছিল নিবদ্ধ-প্রবন্ধ শ্রেণীর গান৷ চর্যাসম্বন্ধেও ঠিক একথা বলা চলে৷ চর্যাপদগীতি সত্যই নিবদ্ধ, সতাল, ধাতুবদ্ধ ও রাগযুক্ত ছিল৷ শার্ঙ্গদেবও বেঙ্কটমখী “চর্যা”-প্রবন্ধগানকে অঙ্গযুক্ত তারাবলীজাতির গান বলেছেন ঃ “চর্যা রাহডী * * ৷ তারাবলী জাতিমন্তঃ প্রবন্ধাং পরিকীর্তিতাঃ৷” চর্যাপ্রবন্ধগীতির পরিচয়প্রসঙ্গে শার্ঙ্গদেব বলেছেন,
পদ্ধডীপ্রভৃতিচ্ছন্দাঃ পাদান্তপ্রাসশোভিতাঃ৷
আধ্যাত্মগোচরা চর্যা স্ব্যাদ্‌দ্বিতীয়াদিতালতঃ৷৷
সা দ্বিধা ছন্দসঃ পূর্ত্যা পূর্ণাপূর্ণাত্বপূর্তিতঃ৷
সমধ্রুবা চ বিষয়ধ্রুবেত্যেষা পুনর্দ্বিধা৷৷
(সঙ্গীত-রত্নকার (আডেয়ার সংস্করণ), ২য় ভাগ, পৃঃ ৩০৩-৩০৪ শ্লোকে “পদান্ত প্রাসশোভিতাঃ” শব্দ হবে “পাদান্তে অনুপ্রাস-শোভিত”৷ অবশ্য টীকায় এ সম্বন্ধে বলা হয়েছে)
সিংহভূপাল টীকায় বলেছেনঃ “পদ্ধডীতি রাহডীমুখ্যানি ছন্দাংসি৷ যস্যাং পাদানামন্তেঽনুপ্রাসযুক্তঃ; অধ্যাত্ম-বাচকৈঃ পদৈরুপনিবদ্ধা সা চর্যা৷ দ্বিতীয়াদিতালৈঃ সা কর্তব্যা৷ তৃতীয়াবহুবচনার্থে তল্‌প্রত্যয়৷ সা দ্বিপ্রকারা –ছন্দঃপূর্তৌ পূর্ণঃ ; অপূর্তাবপূর্ণঃ৷ পুনরপি দ্বিধা৷ সর্বেষাং পাদানামাবৃত্তৌ সমধ্রুবা, ধ্রুবসৈবাবৃত্তৌ বিষমধ্রুবেতি৷”((ক) সঙ্গীত-রত্নকার (আডেযার সংস্করণ), ২য় ভাগ, পৃঃ ৩০৪, (খ) লেখকের “রাগ ও রূপ” ,১ম ভাগ (৩য় সংস্করণ), পৃঃ ৮০ ) “কলানিধি”-টীকায় কল্লিনাথ আরও বিশদভাবে অর্থ দিয়েছেন৷ মোটকথা, পদ্ধডি,রাহডী প্রভৃতি ছন্দে রচিত চর্যাগীতির পাদের শেষে অনুপ্রাস থাকে৷ চর্যা পদনিবদ্ধ ও দ্বিতীয়াদি তালযুক্ত৷ পূর্ণ ও অপূর্ণভেদে চর্যা আবার দুইরকম ছিল৷ তাছাড়া সমধ্রুবা বিষমধ্রুবাভেদে চর্যা দুইশ্রেণীর ছিল৷ সকল পদ আবৃত্তিযুক্ত গীত হলে সমধ্রুবা এবং কেবল ধ্রুব বা ধ্রুবাধাতুর আবৃত্তি থাকলে বিষমধ্রুবাশ্রেণীর চর্যা বলা হত৷ চর্যায় বীররসের সমাবেশ করতে গেলে রাহডীছন্দে পদ তথা গীত রচনা করা হতঃ “যত্র বীররসেন স্যাৎ * * রাহডী পরিকীর্তিতা”৷ পদ্ধডীতে বিরুদ, স্বর ও পাট এই তিনটি অঙ্গ থাকত, আর তারিজন্য চর্যা পদ্ধডীছন্দযুক্ত এবং তিন ধাতুযুক্ত ছিল৷ কল্লিনাথ সেজন্য বলেছেন ঃ “তেনায়ং ত্রিধাতুঃ ছন্দস্তালনিয়মান্নির্যুক্তঃ ; পদতালবদ্ধত্বাদ্দ্যঙ্গ তারাবলীজাতিমান্‌”৷ “নির্যুক্ত” বলতে অঙ্গবদ্ধ তথা নিবদ্ধ-প্রবন্ধগীতশ্রেণীর ছিল চর্যাগীতি৷
শার্ঙ্গদেব ও বেঙ্কটমখীর এই বিবরণ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, ৯ম-১১শ শতকের বাংলাদেশে বৌদ্ধ-চর্যাগীতিগুলিও ক্ল্যাসিক্যাল তথা শাস্ত্রীয় ও ট্র্যাডিসনাল শ্রেণীভুক্ত ছিল৷ হতে পারে যে, ১৩শ থেকে ১৬শ শতকে গীত চর্যাগীতরীতি গঠনে ও প্রকাশভঙ্গিতে ছিল অনেকটা সহজ সরল, কিন্তু তা যে ৯ম-১১শ শতকের গীতিরূপ ও গীতশৈলীকে ভিত্তি করেই বিকাশলাভ করেছিল একথা সত্য৷ ৯ম-১১শ শতকের পরবর্তী “গীতগোবিন্দ”-পদগান বা অষ্টাপদীগান, কৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলগান, নামকীর্তন, পদাবলীকীর্তন ও অন্যান্য ভক্তিমূলক অভিজাত গানের যোগসূত্রও চর্যাগীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল৷ মোটকথা চর্যার গীতরীতি ও প্রেরণাই পরবর্তীকালে সকল গীতিশ্রেণীর সমৃদ্ধির পথে পাথেয়৷