কৃষ্ণের বাল্য-কৈশোরের নানা বীর-কাহিনীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং কৌতুহলোদ্দীপক কাহিনী হল কালিয়-দমন। কারণ কালিয় কংসের প্রেরিত কোনও অসুর-রাক্ষস নয়, সে নিজেই মূর্তিমতী বিপন্নতা। প্রবাহিনী যমুনার যে জল সমস্ত বৃন্দাবনবাসীর জীবনদায়িনী, সেই যমুনার জল বিষাক্ত করে তুলেছে কালিয়। কালিয়র পরিচয় হল – সে নাগরাজ। ভয়ঙ্কর বিষ তার মুখে, শরীরে। যেখানে সে থাকে, সেখানে জনমানব তো আসেই না, এমনকি কোনও পশু-পক্ষীও তার ধারে কাছে আসে না—ন গোপৈ-র্গোধনৈর্বাপি তৃষ্ণার্তৈরুপযুজ্যতে।
নাগরাজ কালিয়কে কৃষ্ণ প্রাণে মারেননি, তাঁকে ঘরছাড়া করেছিলেন। পৌরাণিকেরা কালিয়-দমনের বৃত্তান্ত নিয়ে বিচিত্র কাব্যশোভা তৈরি করেছেন, নাটকীয়তাও বাদ যায়নি। ভাগবত পুরাণে দেখছি—কৃষ্ণের বয়স তখন কৈশোরগন্ধি। গোরু চরানোর জন্য গোপ-বালকদের নিয়ে তিনি এ বনে সে বনে ঘুরে বেড়ান। এই গোচারণের সময় সদা-সর্বদা তাঁর সঙ্গী থাকেন দাদা বলরাম, যিনি রোহিণীর গর্ভজাত বসুদেবের পুত্র। যেদিন কৃষ্ণ কালিয়ের আবাসের কাছাকাছি হলেন, সেদিন বলরাম তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। বিষ্ণুপুরাণও তাই বলেছে – একদা তু বিনা রামং কৃষ্ণো বৃন্দাবনং যযৌ। বিষ্ণুপুরাণে দেখছি—কালিয়ের বিষময় অত্যাচারের কথা কৃষ্ণের জানা ছিল এবং কালিয়ের আবাস দেখামাত্রই তাঁকে শাস্তি দেবার কথা মনে হয় তাঁর—তদস্য নাগরাজস্য কর্তব্যো নিগ্রহো ময়া।
ভাগবত পুরাণে ঘটনাটা একটু নাটকীয়—কৃষ্ণ তাঁর সখাদের সঙ্গে গোরু চরাতে চরাতে যমুনার জল-ধোয়া এক নির্জন বনপ্রান্তে এসে পড়েছেন। গরমের সময়। সকলেই তৃষ্ণায় কাতর। এমনকি গোরুগুলোরও জল খাওয়া প্রয়োজন। অবশ্য এদের কাউকেই আর জল খাবার নির্দেশ দিতে হয়নি। আকুল তৃষ্ণাই তাদের যমুনার জলে জল খেতে নামিয়েছে—দুষ্টং জলং পপুস্তস্য-তৃষ্ণার্তা বিষদূষিতম্‌। আর যায় কোথা ! কালিয় নাগের বিষে সেই জায়গার জলরাশি বিষদগ্ধ হয়েই ছিল। জলপান করতেই গোরু-বাছুর এবং কৃষ্ণ-সখারা ঢলে পড়ল যমুনার তীরে। তাদের দেহ থেকে প্রাণই চলে গেছে। গোরু এবং গোপালক বন্ধুদের অবস্থা অন্তরের যোগবিভূতিতে বুঝতে পারলেন কৃষ্ণ। অমৃতবর্ষিণী দৃষ্টির প্রসাদে কৃষ্ণ তাঁদের বাঁচিয়ে তুললেন—ঈক্ষয়ামৃতবর্ষিণ্যা সনাথান্‌ সমজীবয়ৎ।
আসলে ঘটনা সত্যিই খুব বিপজ্জনক ছিল। কৃষ্ণ একা কালিয়র আবাসে এসেছেন এবং আমরা আগেই দেখেছি কালিয়র বাসস্থান সাধ্যমতো ঘেরা ছিল । সহজপথে তিনি কালিয়র আবাসে প্রবেশ করতে পারেননি বলেই গাছে উঠে তাঁকে কালিয়র শাসন-সীমা অতিক্রম করতে হয়েছে। তারপর কদমগাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিয়র কাছে যেতে হয়েছে। এটা সত্যি মনে হয়, কারণ এইভাবে শত্রু-শিবিরে প্রবেশ করার অভ্যেস কৃষ্ণের আছে। কৃষ্ণ যখন কদম গাছের ওপর থেকে কালি-দহে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, তখন কালিয় জল ছেড়ে ওপরে চলে এল—উদতিষ্ঠজ্জলাৎ সর্পো রোষ-পর্য্যাকুলেক্ষণঃ। ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশির মতো তার শরীর। ক্রোধে চোখ লাল হয়ে গেছে এবং পঞ্চমুখে সে বিষাগ্নি উদ্‌গিরণ করছে। নাগরাজের স্ত্রীরা, পুত্রেরা এবং তাঁর অনুগত সাপেরাও নাগরাজের সঙ্গে যোগ দিল কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য। তারা সকলে মিলে কৃষ্ণকে কামড়াতে লাগল বটে, কিন্তু হরিবংশঠাকুর মন্তব্য করেছেন যে, কৃষ্ণ তাতে মারা গেলেন না—ন মমার চ বীর্যবান।
কৃষ্ণ কালিয়র ডেরায় ঢুকে যাবার পর বৃন্দাবনের মানুষ এবং তাঁর রাখাল বন্ধুরা নন্দরাজ এবং যশোমতীকে খবর দিল, খবর দিল অন্যান্য সবাইকে। তাঁরা ভয়ত্রস্ত হয়ে আকুলি-বিকুলি করতে লাগলেন যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে। গোপরমণীরা কৃষ্ণকে যথাসাধ্য বারণ করতে লাগলেন, কিন্তু যতই এই বারণ-বাণী তীব্র হতে থাকে কৃষ্ণের সংকল্প তত বাড়তে থাকে। কৃষ্ণ কালিয়ার আবাসে প্রবেশ করলেন।
আমারা জানি—কালিয়র মাথার ওপরে কৃষ্ণের একটা নৃত্যরঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে অনেক পুরাণেই। কালিয়র পাঁচটি ফণার ওপর ক্রমান্বয়ে নৃত্য করতে করতে একেবারে মধ্য ফণাটির ওপর তাঁর নাচটা ‘সিটল’ হয়ে যায় এবং তখনি সেটা ছবি এবং ভাস্কর্যের বিষয় হয়ে পড়ে। ভাগবতপুরাণে এই নৃত্যভঙ্গির মধ্য দিয়েই কালিয়-দমন সম্পূর্ণ হয় এবং সেখানে শত্রুর দর্পমোচনের সঙ্গে নাগপত্নীদের স্তব কবি-দার্শনিকের হৃদয় বিগলিত করবে। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এভং সব পুরাণেই এমনকি বালচরিত নাটকেও কালিয়র মাথার ওপর কৃষ্ণকৃত এই নৃত্যের কথা আছে এবং সোজা কথায় এই নৃত্যের অর্থ একদিকে যেমন শত্রুদমনের সম্পূর্ণতা সূচনা করে, তেমনি অন্যদিকে শত্রুদমনে কৃষ্ণের নান্দনিক স্বাতন্ত্র্য রচনা করে ।
বালচরিত নাটকে বা অন্যান্য পুরাণে যেমন দেখছি, তাতে নৃত্যপর ভঙ্গিতে কৃষ্ণ তাঁর পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন কালিয়র মাথায়। কালিয়র বসবাস ছিল সমুদ্রে, কিন্তু তিনি সর্পভোগী গরুড়ের ভয়ে যমুনার আবাস বেছে নিয়েছেন। কৃষ্ণ তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছেন—তোমার মাথায় আমার পদচিহ্ন আঁকা রইল, নাগরাজ ! গরুড় যদি এই পদচিহ্ন দেখেন তবে কোনওদিন তোমার প্রতি বিরূপ হবেন না।
মম পাদেন নাগেন্দ্র চিহ্নিতং তব মূর্ধনি।
সূপর্ণ এব দৃষ্‌ট্বৈবং অভয়ং তে প্রদাস্যতি।।
কৃষ্ণকে যাঁরা অবতার হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তাঁরা বলেন কৃষ্ণাবতারের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল শত্রুর প্রতি করুণা-প্রকাশ। কিন্তু লক্ষণীয়, শত্রুর প্রতি করুণা প্রকাশের এই বৈশিষ্ট্য যতই উজ্জ্বল হয়ে উঠুক প্রায় সর্বত্রই কৃষ্ণের শত্রুরা কিন্তু সশরীরে হত হয়েছে। এমনকি রূপ গোস্বামী কৃষ্ণকে যে ‘হতারিগতিদায়ক’ (শত্রু হত হেলও তাকে তার প্রাপ্যের চেয়েও ঊর্ধ্ব গতি যিনি দান করেন) বলে একটা জব্বর বিশেষণ দিয়েছেন, এই নিরিখে কালিয় কিন্তু এক অসাধারণ ব্যতিক্রম। কৃষ্ণ তাকে মারেননি এবং কালিয়কে তিনি নিজের জন অথবা পরম ভক্তের মর্যাদা দান করেছেন। ভাগবত পুরাণে কালিয় নাগের পত্নীরা স্বয়ং জানিয়েছে যে, কালিয়র মাথায় কৃষ্ণের পদচিহ্ন হল তাঁর অপরিসীম করুণারই অম্লান প্রকাশ। যে পরম পদ লাভ করার জন্য লক্ষ্মী অযুত বৎসর তপস্য করেন—যদ্‌বাঞ্ছায়া শ্রীর্ললনাচরত্তপঃ—সেই পদচিহ্ন তিনি স্বয়ং এঁকে দিয়েছেন কালিয়র মাথায়।
কৃষ্ণের কথা শুনে কালিয় যমুনা ছেড়ে চলে গেলেন কৃষ্ণের পদচিহ্ন মাথায় নিয়ে। গূহা মূধ্না তু চরণৌ কৃষ্ণস্যোরগপুঙ্গবঃ। কৃষ্ণ যখন কালিয়-হৃদ অথবা আমাদের বিপর্যগ্নী ভাষায় কালিদহ থেকে ব্রজের মানুষদের সামন এসে উপস্থিত হলেন, তখন সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন গোপকুলপতি নন্দের। তাঁরা বলেন—ধন্য মশাই, আপনি ধন্য যাঁর এইরকম একটি ছেলে আছে। আজ থেকে এই ছেলে হবে আমাদের বিপদের আশ্রয়, আমাদের প্রভু। শুধু আমাদেরই নয়, আমাদের জীবিকা এই গোরুগুলি এবং আমাদের বাসস্থান এই গোষ্ঠভূমিরও রক্ষক, আশ্রয় এবং অধিকারী প্রভু হবে এই তোমার ছেলে –
অদ্য প্রভৃতি গোপানাং গবাং গোষ্ঠস্য চানঘ।
আপৎসু শরণং কৃষ্ণঃ প্রভুশ্চায়তলোচনঃ।।