কেহ কেহ অনুমান করেন— প্রাকৃত জনকে লীলাধর্মের পথে আকর্ষণ করার জন্য তাদের রুচির অনুগত কামলীলার বর্ণনার রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার মধ্যে উপন্যস্ত হয়েছে ৷ শ্রীচৈতন্যের জীবনে রাধাবিরহ পরিপূর্ণভাবে বিলসিত হয়েছিল ৷ এই রাধাবিরহই পদাবলী-সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ ৷ রাধাবিরহের পদাবলীর দ্বারা ভোগাসক্ত লোকদের লীলাধর্মে দীক্ষা দেওয়া যায় না ৷ সম্ভোগলীলার সাহায্যে তাদেরকে আকৃষ্ট করে শেষে বিরহরসের রসিক করে তোলাই সম্ভোগের পদকর্তাদের হয়ত উদ্দেশ্য ছিল ৷
যাহারা মাংসভোজনলুব্ধ তাহাদিগকে প্রাচীন মনীষীরা বলিয়াছিলেন, ‘মাংস খাইবে খাও, দেবতার কাছে বলি দিয়া কিংবা দেবতাকে নিবেদন করিয়া খাও ৷ ”
অশুচি আমিষও তাতে শুচি হবে ৷ বৈষ্ণব পদাবলীর কামকেলি বর্ণনা কি সেইভাবে পরিকল্পিত ? কবিরা হয়ত বললেন— সাহিত্যের মধ্যবর্তিতায় শুধু কামকেলির কথাই ত তোমরা শুনতে চাও ? তাই যদি উপভোগ করতে চাও— তবে রাধাকৃষ্ণকে নিবেদন করে উপভোগ কর ৷ পদকর্তারা তোমাদেরই ভোগ্য বস্তু, তাঁদের উপাস্য চরণে নিবেদন করে রেখেছেন ৷ রাধার উরোজযুগল কনকশম্ভুত্ব লাভ করে যেমন কৃষ্ণার্পিত পঞ্চ-বিল্বদলবাসিত হয়েছে— তার সম্ভোগলীলা তেমনি হরিচরণে নিবেদিত হইয়া তুলসীপত্রবাসিত হয়েছে ৷
বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন— ‘পদাবলীর ব্রজলীলা মদনমহোৎসব ৷’ মদনমোহনের মহোৎসব কেন যে মদনমহোৎসবে পরিণত হল তা সংস্কারমুক্ত মনে ভেবে দেখার প্রয়োজন ৷
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ বলেছেন — ”মনে রাখতে হবে যিনি এই রসের প্রধান স্রষ্টা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, তিনি সন্ন্যাসী, শ্রীরূপ ও শ্রীসনাতন বিষয়বিরক্ত মহাপুরুষ, জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস অসামান্য প্রেরণার অধিকারী ৷ এঁরা কোন ষড়্‌যন্ত্র করে লোকের রুচিকে পীড়া দেবেন এবং জন্মার্জিত সংস্কারের মূলচ্ছেদন করবেন, এমন-ত মনে হয় না ৷”
রবীন্দ্রনাথ সম্ভোগাংশের কোন আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, কিন্তু এর জন্য পদাবলীর গৌরব ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা মনে করেননি ৷ তিনি বলেছেন— ”বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে এমন অংশ আছে যাহা নির্মল নয় …..বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে রাধার খণ্ডিতা অবস্থার বর্ণনা আছে৷ আধ্যাত্মিক অর্থে ইহার কোন বিশেষ গৌরব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্য হিসাবে শ্রীকৃষ্ণের এই কামুক ছলনার দ্বারা কৃষ্ণরাধার প্রেমসৌন্দর্যও খণ্ডিত হইয়াছে , তাহাতে সন্দেহ নাই ৷ রাধিকার এই অবমাননায় কাব্যশ্রী অবমানিত হইয়াছে ৷ কিন্তু প্রচুর সৌন্দর্যরাশির মধ্যে এ সকল বিকৃতি আমরা চোখ মেলিয়া দেখি না— সমগ্রের প্রভাবে ইহার দুষণীয়তা অনেকটা দূর হইয়া যায় ৷ লৌকিক অর্থে ধরিতে গেলে বৈষ্ণব কাব্যে প্রেমের আদর্শ অনেকস্থলে স্খলিত হইয়াছে ৷ তথাপি সমগ্র পদাবলীপাঠের পর যাহার মনে একটি সুন্দর ও উন্নত ভাবের সৃষ্টি হয় না, সে হয় সমস্তটা ভালো করিয়া পড়ে নাই, নয়ত সে কাব্যরসের রসিকই নয় ৷”
এখানে কবিগুরু কবিভূকিাতেই বিচার করেছেন— বৈষ্ণবভাবে আবিষ্ট হয়ে বিচার করেননি ৷ পদাবলীকে অবিমিশ্র কবিতা ধরেও উত্তরে বলা যেতে পারে—
কেবল ব্রজবুলি ভাষার দ্বারা নয়, প্রভূত আলঙ্কারিকতার দ্বারা কবিরা সম্ভোগাংশের রুচিবিগর্হিত ভাবকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন এবং তদ্দ্বারা ঐ অংশের পদগুলিকে রসসাহিত্যের পদবীতে উন্নীত করে কেবলমাত্র বিদগ্ধজনেরই উপভোগ্য করে রেখেছেন— সাধারণের ঐগুলিতে প্রবেশাধিকার নাই ৷ কলাসরস্বতীর পাদমূলে রতিদেবী দাসীর আসনটুকু পেয়েছেন৷ তাঁর মরালের শ্বেতপক্ষবিস্তারে রাগোৎফুল্লকণ্ঠ কপোতকপোতীর কলকেলি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে ৷
সাহিত্যের দিক্‌ থেকে বৃন্দাবনের সম্ভোগলীলা চিরবিচ্ছেদের আগে আদিকবিবর্ণিত ক্রৌঞ্চমিথুনের প্রণয়কেলিরই মত৷ বিচ্ছেদ-কারুণ্যের গভীরতার আস্বাদ দেবার জন্যই যেন মিলন-নিবিড়তার অবতারণা ৷ ক্রৌঞ্চীর করুণ আর্তনাদে কোথায় ডুবে গেছে তার ক্ষণিক সম্ভোগের স্মৃতি ৷