নৃসিংহ অবতারের প্রথম প্রয়োজনটা কিন্তু ‘পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাম্’—এই প্রতিজ্ঞাত ঐশ্বরিকতার মধ্যেই ধরা আছে। তার জন্য এক অসম্ভব সুন্দর এক কাহিনিও তৈরি হয়েছে। দৈত্য হরিণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছে বর চাওয়ার সময়েই বুঝে গিয়েছিলেন যে, তিনি অমরত্বের বর পাবেননা। অতএব তিনি অদ্ভুত একটা বর চেয়ে বলেছিলেন—দেবতা-দানব-মানব কেউ যেন আমাকে মারতে না পারে। আমি বাইরেও মরব না, ঘরের মধ্যেও মরব না, দিনেও মরব না, রাতেও নয়। আমি এই মাটির উপর মরব না আকাশেও মরব না, কোনও অস্ত্রাঘাতেও যেন মৃত্যু না হয় আমার। এমনকী অনেকেই নিজের বলদর্পিতায় যে ভুল করেছে, আমি সে ভুল করব না, কোনও মানুষ কিংবা পশুও যেন আমাকে কিচ্ছুটি না করতে পারে—ন ভূমৌ নাম্বরে মৃত্যু ন নরৈ ন মৃগৈরপি। এত জটিল বর যে বরদ পিতামহেরও ঘুলিয়ে যাচ্ছিল সব, হয়তো বা ভাবারও চেষ্টা করছিলেন যে, এতসব প্রতিষেধকের মধ্য দিয়ে কোরও ফাঁকে অমরত্ব এসে যাচ্ছে না তো। তিনি আমতা আমতা করে বলেও ফেললেন—এসব বর কী কেউ পায় ? ঠিক আছে তবু দিচ্ছি আমি—তথাপি বিতরাম্যঙ্গ বরান্‌ যদ্যপি দুর্লভান্‌।
বর লাভ করার পরেই আপন শক্তিবলে দুর্দমনীয় হয়ে উঠলেন হিরণ্যকশিপু। আপনে শাসনে তো নানা অত্যাচার আরম্ভ হলই, আস্তে আস্তে তিনি স্বর্গ অধিকার করে দেবতাদের এমনহাল করলেন যে, তাঁরাও দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর পায়ে ধরে জীবন এবং জীবিকা যাপন করতে থাকলেন—রেমে’ভি বন্দ্যাঙ্ঘ্রি-যুগঃ সুরাদিভিঃ/ প্রতাপিতৈরুর্জিত-চণ্ডশাসনঃ। বহুকাল চলল এইভাবে , তারপর একটা সময় এল যখন দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ভগবান শ্রীহরির শরণ গ্রহণ করলেন। তাঁদের আর্তি শুনে ভগবান তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন—আমি জানি সব, জানি দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর অন্যায়-অত্যাচারের কথা, তোমরা আর একটু অপেক্ষা কর—তথ্য শান্তিং করিয্যামি কালং তাবৎ প্রতীক্ষত।
নারসিংহ উপাখ্যানের একটা বড় সুবিধে হল—হিরণ্যকশিপুর একটা ব্যক্তিজীবন পেয়ে যাই তাঁর অহংকারপূর্তির সাংসারিক কেন্দ্র হিসাবে। এখানে একদিকে যেমন স্বর্গ-মর্তপাতাল জুড়ে হিরণ্যকশিপুর তাণ্ডব চলছে—এটা যেমন তাঁর চরম ঋদ্ধি-কামিতার একটা দিক—ঠিক তেমনই একটা ব্যক্তি-সংসারের মধ্যেও তিনি কিন্তু এক প্রশাসক প্রভু হয়ে উঠছেন প্রতিনিয়ত। আমারা দেখেওছি তো এরকম কতশত জীবন-বৃত্ত, যেখানে প্রভুত্ব-কামীর জীবিকা-জীবনের বিশাল প্রভুত্ব সংসারের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার উপরেও ক্রিয়া করতে থাকে। স্বর্গ-মর্ত-পাতালের প্রভু-দেবতাদেরও তিনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। এই হিরণ্যকশিপুর চার ছেলে—কনিষ্ঠ প্রহ্লাদ—তিনি দৈত্যকুলের ব্যতিক্রমী পুরুষ। তিনি আজন্ম বিষ্ণুভক্ত। খুব সংক্ষেপে একটুকু জানাই যে, তাঁর পড়াশোনা হল না, অসুর ঘরের বিদ্যাপাঠ, শুক্রনীতি তাঁর মাথায় কাজ করল না। বর্ণপরিচয় থেকেই তাঁর ঐশ্বরী ভাবনা সাংস্কারিকভাবে ভগবদ্‌ভক্তির আধারে প্রোথিত হল এবং যুবক বয়সে তাঁকে আমরা এমন একটা চেহারায় দেখছি, যাতে অন্য মানুষ তাঁকে পাগল বলবে—তিনি হাসেন, কাঁদেন, নাচেন, তিনি তন্ময়, তিনি ভক্তিসমাহিত—তাঁর দ্বিতীয় কোনও অভিনিবেশ নেই—বস্তুত ভক্তিভাবনাতেও ব্রহ্মসমাধির মতোই এই ব্যাপ্ত বোধসম্পন্ন হয় এবং প্রহ্লাদের এই ভাবনাটাকে মধ্যযুগীয় বৈষ্ণবদের ভাষায় বললে এইরকম দাঁড়াবে—
স্থাবর-জঙ্গম দেখেনা, দেখে তাঁর মূর্তি।
সর্বত্রই হয় তাঁর ইষ্টদেব স্ফূর্তি।।
দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের পাল্লায় পড়ে নিতান্ত বিমূঢ়। এক্কেবারে নিরুপায় হয়ে গেছেন তিনি সংশোধনের বহু চেষ্টার বিফল হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রহ্লাদকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করলেন বারবার। প্রহ্লাদ মরলেন না। শরণাগত পালক বিষ্ণু অলৌকিক উপায়ে দৈত্যের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে রাখলেন বৃহত্তর প্রয়োজনে। অবশেষে সেই দিন এল যেদিন হিরণ্যকশিপু শেষ প্রশ্ন করলেন পুত্র প্রহ্লাদকে। বললেন—আমি ক্রুদ্ধ হলে এই তিন ভুবনের ঈশ্বর-প্রভুরাও কেঁপে ওঠেন, সেখানে কোন সাহসে তুমি আমার আদেশ মানো না। প্রহ্লাদ বললেন—যাঁর অদেশে এই তিন ভুবনের সৃজন-পালন-সংহার, আমি তো তাঁরই আদেশ মেনে চলি—স এব বিশ্বং পরমঃ স্বশক্তিভিঃ/সৃজত্যবত্যক্তি গুণত্রয়েশঃ। আমি বরং বলব—আপনি এই অসুর-ভাব ত্যাগ করুন। সকলের প্রতি সমদৃষ্টিদিন, দেখবেন—শত্রু বলে কিছু থাকবে না আপনার—দেখবেন, তিনিই সর্বত্র আছেন—জহ্যাসুরং ভারমিমং ত্বমাত্মনঃ / সমংমনো ধৎস্‌ব ন সন্তি বিদ্বিষঃ ।
হিরণ্যকশিপু একথা কেমন করে সহ্য করবেন যে, তিনি সর্বত্র আছেন। অহংকারী মানুষ নিজেকেই সবার উপরে দেখতে পায়, আর কিছু সে দেখতেই পায় না। হিরণ্যকশিপু বললেন—অনেক বড় বড় কথা বলছ তুমি—অতিমাত্রং বিকত্থসে। তোমার কপালটা খুবই খারাপ, এতই খারাপ যে, আমি ছাড়াও এই পৃথিবীর অন্য কোনও প্রভু আছেন বলে বলছ তুমি—যস্ত্বয়া মন্দভাগ্যোক্তো মদন্যো জগদীশ্বরঃ—আবার বলছ—তিনি নাকি সর্বত্র আছেন। তা এতই যদি তিনি সব জায়গায় থাকেন, তাহলে এই রাজসভার স্তম্ভের মধ্যে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না কেন—ক্কাসৌ যদি স সর্বত্র কস্মাৎ স্তম্ভে ন দৃশ্যতে ? অনেক বড় বড় কথা শুনছি তখন থেকে, এবার তোমার গলাটি নামিয়ে দেবার সময় এসেছে তোমার শরীর থেকে—শিরঃ কায়াদ হরামিতে।
হিরণ্যকশিপু খড়্গ হাতে নেমে এলেন সিংহাসন থেকে, উদ্যত হলেন পুত্র প্রহ্লাদকে মারবার জন্য। আর রাগটা তাঁর এমনই চণ্ড হল যে, রাগের চোটে প্রথমে একটা ঘুষি কষালেন সেই সভা-স্তম্ভের উপর—স্তম্ভং ততাড়াতিবলং স্বমুষ্টিনা। আর সেই মুষ্ট্যাঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই এক বিরাট সর্বভেদী শব্দ হল যেন এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ড-কটাহ ফেটে গেল—বভূব যেনাণ্ড- কটাহমস্ফুটৎ। পুত্রবধের জন্য যে হিরণ্যকশিপু দৌড়ে আসছিলেন, তিনি এমন বজ্রভেদী শব্দ কোনও দিন শোনেননি। তিনি ফিরে তাকালেন সেই স্তম্ভের দিকে, কিন্তু তখনই দেখতে পেলেন না সে দিব্য চরণখানি, যা দেখে ভয়ে কাঁপেন অসুর রাক্ষস দানবেরা। এবার দেখা গেল সেই স্তম্ভ বিদীর্ণ-চূর্ণ হয়ে গেছে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে এক অদ্ভুত আকৃতির রূপপুঞ্জ- যিনি মানুষও নন আবার পশুও নন—ন মৃগং ন মানুষম্। তাঁর স্বরূপ যাই হোক না কেন, যতই অদ্ভুত হোক তাঁর দর্শন, তিনি এসেছেন। এসেছেন কেন ? দুটো কারণ—এক, তাঁর অতিপ্রিয় ভক্ত প্রহ্লাদ চেয়েছেন যে, এটা প্রমাণ হোক—তিনি আছেন। আরও প্রমাণ হোক—প্রহ্লাদ যেমনটা বোঝাতে চেয়েছিল—তিনি অগ্নিতে, তিনি জলেতে, তিনি তৃণতরুময় স্থলেতে—সর্বত্র তিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, এই সত্য প্রমাণ করার জন্যই তাঁর এই অদ্ভুত আবির্ভাব—সত্যং বিধাতুং নিজভৃত্যভাষিতং/ব্যাপ্তিঞ্চ ভূতেস্বখিলেষু চাত্মনঃ। এখানে ‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের মতো একটা ‘প্রাইমারি মোটিফ’ যদি অবতার গ্রহণের অন্যতম নিদান হয়, তবে তার জন্য অর্ধেক সিংহ-বপু এবং তাঁর ‘মিলিট্যান্সি’ ব্যাপারটা সার্থক হয়ে ওঠে। আর অর্ধেক যে মনুষ্যরূপ, সেখানে থেকে আমাদের অবতার-তত্ত্বে রসের সঞ্চার ঘটে—ভক্তের জন্য প্রভুর মান্যতা, মানুষের জন্য তাঁর মনুষ্যোচিত প্রতিক্রিয়া—নৃসিংহের অর্ধেক মনুষ্যতা এইখানে তাৎপর্যবাহী করে তোলে। আর সত্যি বলতে কী, ভূভার-হরণের জন্য দুষ্ট-ধ্বংস-লীলায় ‘মিলিট্যান্সি’ অথবা তাঁর সংহার-মাত্রাটা এমন একটা বিন্দুতে এসে পৌঁছয়, যেখানে গদা-হাতে দৈত্যরাজাধিরাজ হিরণ্যকশিপুর শেষ শত্রু-ধাবনের ক্রিয়াটাও হাস্যকর হয়ে ওঠে। বিশাল গরুড় যেমন অনায়াসে একটি সাপ ধরে ফেলে, ঠিক সেইভাবে বিশালবপু নরসিংহ ধরে ফেরলেন হিরণ্যকশিপুকে।
এই সেই কাল ছিল যখন দিনও নয়, রাত্রিও নয়, এ এক অকাল-সন্ধ্যা। এই সে সাংহারিক অবতার মূর্তি, যিনি সাধারণ কোনও দেবতাও নন, দানবও নন, এবং তিনি মানুষও নন, পশুও নন, নির্মোহ পাশ্চাত্যেরা বলেন, ‘হাইব্রিড ফর্ম’। আর এই সেই স্থান যা ভূমিও নয়, অন্তরীক্ষ-আকাশও নয়। মহাবল নৃসিংহ হিরণ্যকশিপুর শরীর তুলে নিলেন আপন ঊরুপ্রদেশে এবং জায়গাটা কিন্তু ঘরেও নয়, আবার ঘরের বাইরেও নয়, সভাস্থলের দরজার মাঝে বসে হিরণ্যকশিপুকে তিনি আঘাত করলেন অস্ত্রেও নয়, শস্ত্রেও নয়—পুরো সিংহনখ বসিয়ে দিলেন হিরণ্যকশিপুর বুকে—দ্বার্যূরুমাপত্য দদার লীলয়া/নখাঙ্কুরোৎপাটিত –হৃৎ-সরোরুহম্।
মহাকবিরা তো বটেই, আমার সবচেয়ে মধুর লাগে—যখন আমাদের ধনি-ব্যঞ্জনার সর্বময় আচার্য আনন্দবর্ধন ধন্যালোকের প্রথমেই ব্যঞ্জনা বৃত্তির প্রথম পাঠটি উচ্চারণ করেন নৃসিংহের তীক্ষ্ণ-দারুণ নখগুলিকে মানুষের আর্তিনাশী প্রসন্নতায় বর্ণনা করে। পৌরাণিকী বর্ণনায় হিরণ্যকশিপুর দেহ-বিদারী নখগুলি যতখানি নৃশংসতায় বর্ণিত, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই সংবাদ যে, নৃসিংহদেবের এই নখগুলি প্রপন্ন এবং বিপন্ন মানুষের আর্তিহরণ করেছে। হিরণ্যকশিপুর উপর তাঁর নিয়তি নেমে এল মৃত্যুর পথ ধরে—কিন্তু দুষ্ট দমনের জন্য বর্ধিত ক্রোধ ত্যাগ করতে পারছিলেন না নৃসিংহদেব, হিরণ্যকশিপুকে মেরে ফেলার পরেও তাঁর ক্রোধ শান্ত হল না, স্তব্ধ হল না তাঁর সিংহমুখের গর্জন। স্বর্গের দেবতারা কত স্তব করলেন, বৈকুণ্ঠ থেকে লক্ষ্মী নেমে এলেন ভুঁয়ে,তাঁর প্রশান্তি বাক্যেও ফল হল না কোনও। শেষে প্রহ্লাদের মুখে ধ্বনিত হল সেই পৃথিবী-শান্তির স্তুতি-নতি। ক্রোধোদ্দীপ্ত নৃসিংহের ক্রোধ শান্ত হয়ে গেল বালকপ্রায় প্রহ্লাদকে দেখে। পদাবনত বালককে মাটি থেকে তুলে তাঁর মাথায় দিলেন অখিল-শান্তি-বিধায়ী তাঁর করস্পর্শ—উত্থাপ্য তচ্ছীর্জ্ঞ্যদধাৎ করাম্বুজম্।
লৌকিক চিত্রকরেরা আর থাকতে পারনেনি, তাঁরা আর প্রহ্লাদকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেননি, তাঁকে তুলে দিয়েছেন নৃসিংহের মনুষ্যহস্তের ক্রোড়ে এবং সিংহের কেশর মুখের জিহ্বা লেহন করছে তার গাল পুত্রস্নেহে। ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন এই লৌকিক চিত্র তাঁর সময়ে দেখেছিলেন কিনা জানি না—কিন্তু আর্তিহর নৃসিংহের নখশৃঙ্গে তিনি হিরণ্যকশিপুর রক্ত দেখতে পাননি, দেখেছেন—তাঁর নখগুলিতে চন্দ্রকৌমুদীর ছায়া – ব্যতিরেকে চাঁদের জোৎস্না সেখানে লজ্জা পায় নখচ্ছায়া দেখে –স্বচ্ছয়য়া আয়াসিতেন্দবঃ। আর বেশ তো, বোকা লৌকিক চিত্রকর প্রহ্লাদকে না হয় নরসিংহ ক্রোড়ে স্থাপন করে বড় গ্রাম্যতার পরিচয় দিলেন। না হয় ধ্বনিপ্রস্থান গুরু আনন্দবর্ধন সিংহের হিংসাবৃত্তিকে ঢেকে দিয়েছেন প্রপন্নার্তিহরণের ব্যঞ্জনায়। কিন্তু ওই ফরাসি গবেষক ভদ্রমহিলার কথাটা কীভাবে নেবেন ! আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নাদলেন বিয়ার্দো-কে নিয়ে কী করবেন ? তিনি নরসিংহের ‘মিথ’ ঘেঁটে যে অসামান্য প্রবন্ধটি লিখলেন, সে ‘নরসিংহঃ মিৎ এ ক্যুলত্’ তো নরসিংহের মহামহিম জয়পত্র হয়ে গেছে।
তিনি লিখেছেন—এই সেই অবতার, যেখানে অবতার পুরুষের দুষ্ট-দমনের ‘প্রাইমারি মোটিফ’ অতিক্রান্ত হয়ে একটা ‘আলটেরিয়র মোটিফ’ তৈরি হয়েছে—এই প্রথম আমরা দেখলাম অবতারের মধ্যে সেই করুণা-গুণ সেই মানুষোচিত অনুকম্পা। যে সভাস্তম্ভে হিরণ্যকশিপু মুষ্ট্যাঘাত করেছিলেন, সেটি যদি প্রতীকীভাব ভগবতী ধরিত্রীর প্রতিভূ হয়ে থাকে, তাহলে সেই ভূভার-হরণের জন্য হিরণ্যকশিপুকে বধ করাটা তো নিতান্ত সাধারণ কর্ম হয়ে ওঠে। এমনকী স্তম্ভের মধ্যেও তিনি আছেন—এই অদৃশ্য,অচাক্ষুষ, অপ্রত্যক্ষ সর্বব্যাপকতা প্রমাণ করার জনও বিদীর্ণ স্তম্ভ থেকেই নৃসিংহের আবির্ভাব ঘটছে—আমরা বলব এই বিশাল বিরাট ব্রাহ্মী ব্যাপ্তিও আমাদের কাছে নিতান্ত চর্বিত কথা। তার চেয়েও বড়—সেই বিরাট, বিশাল যখন এক সংহার মূর্তি ধারণ করে এক ভয় নিরাকরণ করে অন্য ভয়ের উদ্রেক ঘটাচ্ছেন, সেই মুহূর্তে তাঁর ঐশ্বরিকতার ভূমি খণ্ডিত হচ্ছে। অনত ভক্তকে তিনি কোলে তুলে নিচ্ছেন অনুকম্পায়, তাঁর রক্তোচ্ছল সিংহচক্ষু নিমীলিত হয়ে আসছে করুণায়, তাঁর পশুরসনার লেহনীতে ফুটে উঠেছে শাবক-বাৎসল্য। মাদাম বিয়ার্দোর মতো ফরাসিনী পর্যন্ত বুঝেছেন—পরম-মহিম রাজাধিরাজের মানবায়ন ঘটে যাচ্ছে—ঈশ্বরের আপন প্রয়োজন ঘটছে নিজেকে সেই মর্তভূমিতে নামিয়ে আনার—যেখানে নিজের দ্বিতীয় ভক্তসত্তার মাধ্যমে নিজেকেই ভোগ করতে পারেন তিনি।
ভাগবতের টীকাকার ধীর-সমাহিত শ্রীধরস্বামী—তিনি এত বড় কৃষ্ণভক্ত হয়েও কুলবিগ্রহ নৃসিংহের নিত্য উপাসক। নৃসিংহের শরীরের ধ্বনি আমাদের শ্রীধর স্বামীর কানেও পৌঁছায়। বৃদ্ধ-সাধক বন্দনা করেন—তুমি শুধু নিজের ভক্তের উপর পক্ষপাতে বিপক্ষের বক্ষ বিদারণ করেছ, তুমি অদ্ভুত, তুমি পরম আনন্দময়—আমরা সেই পক্ষপাতী নৃসিংহের বন্দনা করি—
স্বভক্ত-পক্ষপাতেন পরপক্ষ বিদারণম্‌।
নৃসিংহমদ্ভুতং বন্দে পরমানন্দ বিগ্রহম্‌।।