বিষ্ণুর বরাহ-অবতার অবস্থানেই প্রথম আমরা পৃথিবীর সুরক্ষা এবং শিষ্ট-জন-পালনের সঙ্গে দুর্জন-বিনাশের আদ্য উদ্দেশ্যটা প্রকট দেখতে পাচ্ছি। এই প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি—কশ্যপ –পত্নী দিতির গর্ভে দুই ছেলে জন্মেছে—হিরণ্যাক্ষ এবং হিরণ্যকশিপু। অন্যান্য দু-চারটি পুরাণে হিরণ্যাক্ষ দৈত্য সম্বন্ধে খুব বড় কোনও বিবরণ নেই বটে, কিন্তু ভাগবত পুরাণে বেশ কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে হিরণ্যাক্ষের কাহিনি বর্ণিত। এই পুরাণের ভাষা ব্যবহারে যেহেতু মহাকবির মনচ্ছায়া থাকে, তাই আমি অন্তত খুব ভালো করে বুঝিনি যে, হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু-বড় ভাই না ছোট ভাই ! তবে কিনা অবতার-পর্যায়ে যেহেতু বরাহ-অবতার নৃসিংহের আগে তাই হিরণ্যাক্ষকেই আমরা বড় ভাই বলে ভাবতে চাই। ভাগবৎ পুরাণ আদি-বরাহে প্রতিপক্ষ হিরণ্যাক্ষকে আদি-দৈত্য বলেছে বলেই নয়—আদিদৈত্যো হিরণ্যাক্ষঃ—তাঁর জন্মপ্রসঙ্গেও এই শব্দ-প্রমাণ আছে যে, দিতি হিরণ্যাক্ষকে আগে জন্ম দিয়েছিলেন—যং তং হিরণ্যাক্ষমসূত সাগ্রতঃ। যাই হোক, এই দুই দৈত্য নাকি বৈকুণ্ঠে ভগবান বিষ্ণুর পার্ষদ ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল জয়-বিজয়। ব্রহ্মাশাপে তাঁদের এই অধোগতি হয় এবং তাঁরা কশ্যপের ঔরসে দিতির পুত্র দৈত্য হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
হিরণ্যাক্ষ এক সময় বলদর্পে ভয়ংকর হয়ে উঠলেন। এক সময় তিনি গদা-হাতে চললেন স্বর্গ জয় করতে। তাঁর বল-বিক্রম দেখে ভয়ে লুকিয়ে পড়লেন দেবতারা। ঠিক যেমন গরুড়-পক্ষীকে দেখে পালায় সাপেরা—ভীতা নিলিল্যিরে দেবা স্তার্ক্ষ্য-ত্রস্ত ইবাহয়ঃ। স্বর্গের অধিকার করায়ত্ত হলে জলাধিপতি বরুণ ভগবন্নারায়ণের কাছে দৈত্যবধের জন্য প্রার্থনা করলেন। হিরণ্যাক্ষকে বধ করার জন্যই ভগবান বিষ্ণু-নারায়ণ আদি-বরাহের রূপ ধারণ করে হিরণ্যাক্ষ-দৈত্যকে বধ করলেন। লক্ষণীয়, এই পুরাণেও কিন্তু হিরণ্যাক্ষ-বধের সঙ্গে রসাতল-গতা পৃথিবীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার কাহিনিটা একত্র গ্রথিত নয়। শুধু দু-এক জায়গায় আমরা দেখেছি –হিরণ্যাক্ষ দৈত্যই পৃথিবীকে জলের তলায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল এবং বিষ্ণুরুপী সেই আদিশূকর দৈত্য বধ করে আপন বরাহ-দন্তে পৃথিবীকে তুলে এনেছিলেন সাগরের অতল থেকে।
মহাভারত বরাহ অবতারের যে স্বরূপ বর্ণনা করছে, মৎস্য পুরাণের মধ্যেও তার সম্পূর্ণ অবভাস আছে। আমরা বলব—মহাভারতীয় বর্ণনার মধ্যেই বরাহ-অবতারের বৈদিক উৎসমূলও প্রোথিত। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মধ্যে অতি-উৎসাহী একজন ঋগ্‌বেদের দুটি সূক্ত থেকে দুটি মন্ত্র উদ্ধার করেছেন, যেখানে প্রধানত ইন্দ্রের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু প্রসঙ্গত সেখানে বিষ্ণুর কথাও আসছে এবং বরাহের কথাও আসছে—এই বরাহের নাম এমূষ। তবে ঋগবেদের এই মন্ত্রগুলিতে বিষ্ণুসহায় থাকলেও বিষ্ণুই যে সেই আদিবরাহ, সেটা তেমন ভালো করে বোঝা যায় না। কিন্তু শতপথ ব্রাহ্মণ, যেটাকে আমরা প্রায় বেদের সমান মর্যাদায় দেখি সেখানে কিন্তু এই এমুষ-বরাহই প্রজাপতি। ব্রাহ্মণ-গ্রন্থে প্রজাপতি বিশ্বস্রষ্টা আদিপুরুষ। তিনি বরাহরূপ ধারণ করে পৃথিবীকে তুলে এনেছিলেন, এটাই শুধু শতপথের সংবাদ নয়। বলা হয়েছে—এই এমুষ ইতি বরাহ উজ্জঘান সো’স্যাঃপতিঃ প্রজাপতিঃ, তন্মিথুনেন প্রিয়েন ধাম্না সমর্ধয়তি কৃৎস্নাম্। আমরা মহাভারতের বরাহ-কাহিনীতে বৈদিক সূত্র-পরম্পরায় একটি জব্বর কথা পেয়েছি। শতপথ ব্রাহ্মণ বলছে—এই আদিবরাহেই তো পৃথিবীর স্বামী, তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ আছে, মিথুন-সম্বন্ধ আছে—তন্‌মিথুনেন প্রিয়েন ধাম্না সমর্ধয়তি কৃৎস্নাম্। খেয়াল করতে হবে—মহাভারত যখন এই বরাহ অবতারের কাহিনি শুনিয়েছে, তখন বসুবতী পৃথিবীর সঙ্গে ভগবান বিষ্ণুর একটা প্রিয়ত্বের মধুর সম্পর্ক সিদ্ধ করেই কথা বলেছে এবং সেখানে যুক্ত হয়েছে এক মানবিক রূপ। ভারাক্রান্তা বসুমতী ব্যথিক হয়ে আর্তি জানালেন ভর্তা স্বামীর কাছে, তখন তাঁকে অভয় দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে চলে গেলেন স্বস্থানে। কিন্তু সেই যাওয়ার মধ্যে যে মানবী মূর্তিটি ধরা পড়ল, সে এক শৃঙ্গারিণী সুন্দরীর রূপ, তাঁর দুই কানে পর্বতের কুণ্ডল—বসুধাং শৈলকুণ্ডলাম্‌। আবার বিষ্ণুকে সেই মুহূর্তেই আমরা যখন পরিবর্তিত বরাহরূপে দেখতে পাচ্ছি, তখন তিনি একশৃঙ্গী, অর্থাৎ একদন্ত বরাহ—ততো বরাহঃ সংবৃত্ত একশৃঙ্গো মহাদ্যুতিঃ।
একশৃঙ্গী বরাহদেবও কিন্তু বিষ্ণুরই অবতার, যেমন শৃঙ্গার-রসের অধিদেবতা বিষ্ণু। মহাভারতে বিষ্ণুরূপী বরাহ যখন তাঁর কান্তা-শক্তি কান্তিমতী বসুমতীকে শৃঙ্গাধারে বসিয়ে তুলে আনছেন, তখন মহাভারতের কবি সেই শৃঙ্গের বিশেষণ দিয়েছেন ‘ভাস্কর’—স গৃহীত্বা বসুমতীং শৃঙ্গনৈকেন ভাস্বতা। মহাভারতের ‘ভাস্কর’ আর নাট্যশাস্ত্রীয় শৃঙ্গার রসের ‘উজ্জ্বল’ বেশের তফাত কোথায়। তফাত কোথায় মহাভারতের বারাহী বর্ণনায়—একশৃঙ্গোমহাদ্যুতিঃ। আমাদের রসশাস্ত্র, আমাদের ভাস্কর্য, আমাদের চিত্রশিল্প এবার বরাহ অবতারের রসশাস্ত্রীয় তাৎপর্যটুকু বুঝিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়—অবতার গ্রহণের তাৎপর্য শুধুমাত্র শুষ্ক ভূ-ভাব-হরণ অথবা দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালন-মাত্র নয়, এই বসুমতীর সঙ্গে তাঁর প্রিয়ত্বের নিত্যসম্বন্ধ আছে। প্রিয়া পত্নীতে উদ্ধার করে নিয়ে আসার মধ্যে তাঁর নিজেরও উৎসাহ আছে। অতএব বরাহ-স্বরূপে তিনি শৃঙ্গার-মূর্তি ধারণ করেছেন—একশৃঙ্গী মহাদ্যূতি। পৃথিবীকে দন্ত-শৃঙ্গে বসিয়ে তুলে আনার সময় প্রবাসিনী বধূর সঙ্গে মিলন ঘটছে তাঁর।
মহাকবি কালিদাস পর্যন্ত তাঁর সূক্ষ্ম কবিদৃষ্টিতে এই মিলন দেখতে পেয়েছেন। রঘুবংশের ত্রয়োদশে রামচন্দ্র যখন সীতাকে নিয়ে লংকা থেকে ফিরছেন, তখন বিরাট সাগর-জলরাশি সৌন্দর্য সীতার কাছে বর্ণনা করছিলেন তিনি। কালিদাসী উপমায় সেই সাগরের সৌন্দর্য একের পর এক ফুটে উঠছে রামচন্দ্রের মুখে। হঠাৎই রামচন্দ্র প্রসঙ্গ তুললেন বরাহদেবের। বললেন—রসাতল থেকে পৃথিবী-সুন্দরীকে তুলে আনছিলেন সেই আদিপুরুষ বরাহদেব। সাগরে তখন প্রলয়ের জলোচ্ছ্বাস চলছে। এক তরঙ্গ অন্য তরঙ্গের সংঘাতে যখন উঁচু হয়ে উঠেছে তখন তার স্বচ্ছ জল হালকা অথচ চওড়া এক সূক্ষ্ম বস্ত্রের মতো লাগছে। ধরণীকে তুলে আনার এই ক্রিয়াটাকে কালিদাস বলেছেন উদ্‌বহন – অর্থাৎ উপরে উঠিয়ে আনা। আবার উদ্‌বহন মানে উদ্‌বাহ অর্থাৎ বিবাহ। আদিভব পুরুষ বরাহদেব তাঁর যথার্থ ভর্তা বলেই তাঁর সঙ্গে ধরণীর বিবাহও সম্পন্ন হচ্ছে এই উদ্‌বহন ক্রিয়ার মধ্যেই। বিয়ের সময় নববধূর মাথার উপর স্বচ্ছ-সূক্ষ্মতন্তু লজ্জাবস্ত্র দেওয়া হয়—যেটা অবগুণ্ঠন হিসাবে কাজ করে কবি লিখছেন—আদিবরাহ যখন রসাতল থেকে তুলে আনছেন পৃথিবীকে, তখন প্রলয়ে বেড়ে-ওঠা জলোচ্ছাস মুহূর্তের জন্য বসুমতী-বধূর মাথায় যেন লজ্জাবস্ত্রের অবগুণ্ঠন তৈরি করে দিল—অস্যাচ্ছমম্ভঃ প্রলয়-প্রবৃদ্ধং/মুহূর্ত-বস্ত্রাভরণং বভূব।
আদিবরাহের সঙ্গে রসাতলগতা পৃথিবীর সম্বন্ধটা এই প্রীতির সম্বন্ধে ভেবেছি আমরা। এখানে হাল-লাঙল-শৃঙ্গের গবেষণাটুকুও নেহাত জ্ঞানের তৃপ্তি ঘটায় মাত্র। আমাদের জিতেন ব্যানার্জি সপ্তম-শতাব্দীকালীন পল্লব-যুগের একটি অসামান্য ভাস্কর্যের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার পর লিখেছেন—আদিবরাহ তাঁর দুটি উদ্গত দন্তশৃঙ্গে ধরে রসাতল থেকে উঠিয়ে আনছেন পৃথিবীকে—মহাবল্লীপুরমের এই ভাস্কর্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল—দন্ত-ধৃত পৃথিবীর দিকে অপাঙ্গে তাকানো বরাহ-মুখের স্মিত হাসিটি। আদিভব পুরুষের এই বরাহ স্মিতের জন্য পল্লব ভাস্করের পৃথক এক সরস-চেতনা কাজ করেছে এখানে। পশুসম্মিত এক বরাহ-শরীরের মধ্যেও এই সরসতার ভাবনা আমাদের শুষ্ক অবতার-তত্ত্বকে ‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’-এর মতো কাল-বদ্ধ চর্চিত বিশ্বাসের বাইরে নিয়ে আসে। আমাদের পরম ঈশ্বর তখন আর অন্তরীক্ষ লোকের অদৃশ্য মহিমায় বসে থাকেন না। তার আপন আন্তরিক প্রয়োজনে তিনি এমন করে আসেন বলেই তাঁর ভূ-ভার হরণের কাজটি আমাদের বিপৎ-ত্রাতা রাজার মতো এক গৌণ প্রয়োজনমাত্র।