বিদ্যাপতির জন্ম বিসপি গ্রামে, এখানেই তাঁর পরিবারের আদি বসতি ৷ নতুন সমাজব্যবস্থা প্রচলিত হবার পর এই পরিবার নিজেদের ‘বিষৈবার’ নামে অভিহিত করত ৷ বিদ্যাপতি সারাজীবন বিসপি গ্রামে বাস করেছেন এবং শিবসিংহ সিংহাসন লাভ করার পর এই গ্রামের স্বত্ব বিদ্যাপতিকে সম্মানমূল্য হিসেবে প্রদান করেন ৷ বিদ্যাপতির বংশধরেরা এই বিসপিতেই দীর্ঘকাল বসবাস করে গেছেন ৷ ৩০০ বছর আগে অবশ্য তাঁরা মধুবনীর কাছে সৌরথ গ্রামে চালে যান এবং এখনও সেইখানেই আছেন ৷ ব্রিটিশ আমলের আগে পর্যন্ত বিদ্যাপতির বংশই ছিল বিসপি গ্রামের স্বত্বাধিকারী ৷
বিসপিকে বলা হত ‘গড়’ বা দুর্গ যা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে এটি অন্যতম প্রভাবশালী রাজপুরুষের বংশানুক্রমিক আবাসস্থল ৷ এই গ্রামটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী এবং যেহেতু এইসব রাজপুরুষদের পরিবার কৃষ্টিসম্পন্ন, তাই গ্রামটি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ৷ বিশেষত ‘ঠাকুর’ পরিবারের উপাধি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় বিশাল ভূসম্পত্তির পরিমাণ এবং এই পরিবারটির অন্যতম প্রধান পুরুষ গণেশ্বর মহাসামন্তাধিপতির আসনটি অলংকৃত করেছিলেন ৷
বিদ্যাপতির পরিবারের সঙ্গে তিরহুত রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ৷ সুতরাং সহজেই নব প্রতিষ্ঠিত রাজপরিবারে বিদ্যাপতি প্রবেশাধিকার পান এবং শৈশবে তাঁর সঙ্গীরা ছিলেন কীর্তি সিংহ, পদ্ম সিংহ, হরসিংহ-যাঁরা প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে তিরুহুতে ‘ঐনবরা’ রাজবংশের শাসক হিসেবে পরিচিত লাভ করেছিলেন ৷ তবে বিদ্যাপতির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন শিবসিংহ, বিদ্যাপতি ছিলেন শিবসিংহের সখা, নিঃস্বার্থ উপদেষ্টা, সর্বক্ষণের সঙ্গী ও বিশ্বস্ত সচিব ৷ এই দুই ব্যক্তিত্বের মিলন তদানীন্তন ইতিহাসে বিশেষত সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল নিদর্শন কারণ শিবসিংহের স্বতঃস্ফূর্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহব্যঞ্জক প্রশস্তি বিদ্যাপতির সাহিত্যকৃতির মূল ভিত্তি ছিল ৷

বিদ্যাপতির ছাত্রাবস্থা সম্বন্ধে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি ৷ যতদূর জানা যায় তিনি বিখ্যাত শিক্ষক হরিমিশ্রর কাছে কিছুদিন শিক্ষালাভ করেন ৷ হরিমিশ্র ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত নৈয়ায়িক জয়দেব মিশ্রর পিতৃব্য ও শিক্ষাগুরু ৷ জয়দেব মিশ্র পরিচিত ছিলেন ‘পক্ষধর’ নামে এবং তিনি তাঁর পিতৃব্যকে গঙ্গেশ রচিত ‘তত্ত্ব চিন্তামণি’র টীকাগ্রন্থ বা শব্দকোষ ‘আলোক’ -এ অমরত্ব দান করেন ৷ কিন্তু বিদ্যাপতি দীর্ঘকাল কোনো গুরুর অধীনেই শিক্ষালাভ করেননি কারণ পরবর্তীকালে ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আমরা তাঁকে নৈমিষারণ্যে দেবসিংহের অনুগামী হিসেবে পাই, তখন যুবরাজ শিবসিংহের রাজত্বকাল ৷ এই নৈমিষারণ্যেই বিদ্যাপতির প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা ‘ভূপরিক্রমা’ ৷ এটি সংস্কৃত গদ্য ও কাব্যের সংকলন, পৌরাণিক ধাঁচের রচনা — নৈমিষারণ্য থেকে তিরুহুতের দীর্ঘ যাত্রাপথের বিবরণের সঙ্গে সংকলিত হয়েছে আটটি কাহিনী — তাদের উপক্রমণিকা অবিকল ‘পুরুষ পরীক্ষার’ মতো ৷ ‘ভূপরিক্রমা’ পঁয়ষট্টিটি কাহিনী বর্ণনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও প্রথম অধ্যায়ের বেশী অগ্রসর হতে পারেনি ৷ প্রথম অধ্যায়ে আছে আটিট দেশের বিবরণ ও আটটি কাহিনী ৷ পরবর্তীকালে অবিকল এই কাহিনীগুলিকেই আমরা আবার পাই ‘পুরুষপরীক্ষা’তে, তবে তাতে পৌরাণিক পটভূমিকা আর নৈমিষারণ্য ও তিরুহুতের বিশদ বিবরণ নেই — যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে ‘ভূপরিক্রমার’ পরিকল্পনা বিদ্যাপতি পরিত্যাগ করেছিলেন কারণ তাঁর পক্ষে আর ভ্রমণ সম্ভব ছিল না বা নৈমিষারণ্যেও থেকে যাওয়া অসম্ভব ছিল ৷ তাঁকে শিবসিংহের রাজদরবার থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং বিদ্যাপতি তৎকালীন রাজনীতিতে তরুণ রাজা শিবসিংহের বিশ্বস্ত সভাসদ হিসেবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েন ৷
বিদ্যাপতি গুরুর কাছে যা শিক্ষালাভ করেছিলেন তা কিন্তু তাঁর শিক্ষাজীবনের সামান্য অংশমাত্র ৷ মিথিলায় তখন সংস্কৃত শিক্ষার স্বর্ণযুগ, সারা আর্যাবর্ত থেকে শিক্ষার্থীরা মিথিলায় আসছে বিদ্যার্জনের আশায় ৷ বিদ্যাপতির মতো সৃজনশীল ব্যক্তিত্বকে নির্দিষ্ট শিক্ষার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না ৷ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর ভাবগ্রাহী মন নিয়ে বিদ্যাপতি পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করেছিলেন, বিধিবদ্ধ পুঁথিগত শিক্ষার জগৎ তাঁকে আকর্ষণ করতে পারেনি ৷ বিদ্যাপতির নিজের আবাসস্থলই ছিলেন জ্ঞানের আলোর উৎস, সারা পৃথিবীর ধীমান ব্যক্তিরা বিদ্যাপতির বাড়িতে সমবেত হতেন শাস্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি, দেশাচার ও সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে আলোচনার জন্য এবং বিদ্যাপতির শ্বাসবায়ুর সঙ্গে চেতনায়, অবচেতনে প্রত্যেক মুহূর্তে মিশে থাকত শিক্ষার সৌরভ ৷ আসলে শিক্ষার সংস্কৃতির মুক্ত ও দীপ্ত আবহাওয়ায় তাঁর জ্ঞানার্জন হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যেখানে অন্য শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পরিশ্রম করে তবেই উপযুক্ত গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করতে পারে ৷ উপরন্তু বিদ্যাপতির ছিল তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসু মন, যা একটি বিষয়কেই , একটি তত্ত্বকেই আঁকড়ে ধরত যতক্ষণ না শিক্ষায় সম্পূর্ণতা আসে ৷ তাঁর বিদ্যানুরাগের ক্ষেত্র ছিল বিস্তৃত ও বিশাল, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার ৷ শাস্ত্র সম্বন্ধে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর অর্থাৎ শাস্ত্রবিদ্যা অনুধাবন করবার শিক্ষা অর্জন করার পরই তিনি নিয়মিত ছাত্রাবস্থা ত্যাগ করে পিতৃপিতামহের বংশানুক্রমিক বৃত্তি গ্রহণ করেন ও জীবন ও কর্ম নিয়োজিত করেন নিজের দেশ ও দেশবাসীর উদ্দেশে ৷
ছাত্রাবস্থার ইতি হলেও তাঁর বিদ্যার্জন কিন্তু থেমে থাকেনি ৷ সারাজীবন ধরে তিনি নানাবিষয় পাঠ করে গেছেন অক্লান্ত ঐকান্তিকতায় এবং বিদ্যাপতির বৃদ্ধ অবস্থার রচনা থেকে বোঝা যায় কতখানি খুঁটিয়ে তিনি মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ, আগম, তন্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন ৷ এছাড়া কাব্য, নাটক ইত্যাদি তো ছিলই যা থেকে অনবরত অনুরণন ধ্বনিত হত তাঁর ছন্দগীতির ছত্রে ছত্রে ৷ এ ছাড়াও শিবসিংহের রাজসভায় বিদ্যাপতি সভাপণ্ডিতের পদ অলঙ্কৃত করেন ৷ এ সূত্রে তাঁর সঙ্গে বহু জ্ঞানীগুণীর ঘনিষ্ঠতা হয়, যাঁরা রাজসভায় আসতেন ৷ তীক্ষ্ণ ধী আর অপার স্মৃতিশক্তির দৌলতে বিদ্যাপতি যা পড়তেন, তাই মনে রাখতে পারতেন এবং প্রয়োজনে তার সঠিক প্রয়োগ করতে পারতেন ৷ অর্থাৎ বিদ্যাপতির পাণ্ডিত্যের পরিধি ছিল বিস্তৃত, তিনি কোনো একটিমাত্র বিশেষ বিষয়ে গভীর বিদ্যার্জনে আস্থাশীল ছিলেন না ৷ তৎকালীন ইতিহাসে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে পরিপূর্ণ শিক্ষালাভ পাণ্ডিত্যের অন্তিম সোপান বলে গণ্য হত, কিন্তু সেই পরিবেশে বিদ্যাপতির উদার বহুমুখী প্রতিভা কোনো বিশেষ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি ৷
পাঠের অভ্যাসের তুলনায় বিদ্যাপতি অনেক বেশী আকৃষ্ট ছিলেন সৃজনশীল সাহিত্যে ৷ ‘কীর্তিলতা’য় তিনি লিখেছেন, ”অক্ষররূপী দণ্ড দিয়ে মণ্ডপসজ্জা না হলে যশোবল্লরী কেমন করে কাকে আশ্রয় করে ত্রিভুবন বিস্তৃত হবে ?” বিদ্যাপতি দেখেছিলেন যে তাঁর খ্যাতিমান পূর্বপুরুষেরা রাজনীতির সাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও বিখ্যাত লেখকও ছিলেন, তাই তিনিও কৈশোর অতিক্রান্ত হবার আগেই সাহিত্যরচনায় তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন ৷ চণ্ডেশ্বরের পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যাপতি সংস্কৃত ভাষায় প্রথম সাহিত্য রচনা শুরু করেন ৷ সংস্কৃতে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল খুব অল্প বয়স থেকেই এবং কুড়ি বছর বয়স হবার আগেই তিনি পৌরাণিক ধাঁচে ‘ভূপরিক্রমা’ রচনার পরিকল্পনা করেন — যেটি দৈশিক বিবরণ ও লোককথার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ ৷ এই রচনা থেকে বিদ্যাপতির জীবনাদর্শ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যায় ৷ তবে ‘ভূপরিক্রমা’র আগে তিনি একটি নাটক রচনার চেষ্টা করেন, ‘মণিমঞ্জরী’ — নাটক হিসেবে এটি নেহাতই অপটু হাতের রচনা হলেও ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ ‘উত্তর-রাম-চরিতম্‌’ ও ‘রত্নাবলী’র প্রতিধ্বনিস্বরূপ অর্থাৎ চিরন্তন নারীমনের আকুতির বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টির প্রকাশ যা পরবর্তীকালে বিদ্যাপতির প্রেমকাব্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে ৷ এইভাবে জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিদ্যাপতি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন রচনার কাজে ৷ তাঁর শেষ সৃষ্টি ‘দুর্গা-ভক্তি-তরঙ্গিনী’ তে ধীরসিংহের রাজত্ব করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ লেখক তখন অশীতিপর বৃদ্ধ ৷ বিদ্যাপতির সহস্রাধিক গীতের কথা বাদ দিলেও তাঁর বাকী আরও অন্তত বারোটি রচনা আছে যা একজন সফল রচয়িতার এক জীবনের সম্পদ ৷ কিন্তু বিদ্যাপতি তো শুধু লেখক নন, তাঁর মনন বহুমুখী, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে তিনি তৎকালীন রাজনীতি নিয়ে চর্চা করেছেন, সুতরাং ‘কীর্তিলতা’য় যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ‘যশোবল্লরী ও মণ্ডপসজ্জা’ নিয়ে তা নিঃসন্দেহে তাঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিচায়ক ৷ তিনি ছিলেন যশোপ্রার্থী এবং জীবিতকাল তো বটেই মৃত্যুর পরও আজ পর্যন্ত তিনি অসীম যশ ও সম্মানলাভ করেছেন ৷