লক্ষ্মণ সেন – বিদ্যাপতি

শিবসিংহ যখন রাজা হলেন, তখন বিদ্যাপতির পদাবলী স্ফুরিত হচ্ছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি শৈব ছিলেন বলেই মনে হয়। কেননা একদিকে শৈব সর্বস্বসার, আর অক প্রান্তে দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী –এর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ যেভাবে নেমে এলেন, তার কারণ বোধ হয় বাংলার কবি জয়দেব। এমনকী বাংলার জয়দেব কবির পৃষ্ঠপোষক লক্ষ্মণসেনও বিদ্যাপতির পছন্দের মানুষ ছিলেন। আসলে লক্ষ্মণসেনের সময় পর্যন্তও মিথিলা সেন রাজাদের অধীন ছিল। যে দ্বারভাঙায় ওইনিবার বংশের শাসন নিয়ে রাজনৈতিক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল সেই দ্বারভাঙা তো আসলে বঙ্গদেশের দ্বার—দ্বারবঙ্গ। একই রাজার অধীনে থাকায় মিথিলা এবং বঙ্গদেশের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নৈকট্যও তৈরী হয়েছিল গভীরভাবে। সেটা এতটাই যে লক্ষ্মণসেন-এর রাজত্ব শেষ হবার এক-দেড়শ বছর পরেও মিথিলায় তাঁর সাংস্কৃতিক প্রভাব কমেনি । স্বয়ং বিদ্যাপতি যখনই তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা বা রাজবংশীয়দের কথা বলেছেন, তখন সময়নিরূপণের ক্ষেত্রে সবসময় লক্ষ্মণাব্দ ব্যবহার করেছেন, হয়তো বা অধিকন্তু কখনো শকাব্দ, কিন্তু সেখানেও লক্ষ্মণাব্দ আগে। আর নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের সংকলিত বিদ্যাপতির পদে দেখা যাচ্ছে তিনি ভণিতায় লক্ষ্মণসেনের নাম করছেন তাঁর পত্নীর নাম সহ—

কবি রতনাই ভানে
সঙ্ক কলঙ্ক হুঅঅো অসমানে
মিলু রতি মদন সমাজা
দেবল দেবি লক্ষণদেব রাজা।
(বিদ্যাপত ঠাকুরের পদাবলী,
নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পাদিত, কলিকাতাঃ
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ,
সাল ১৩১৬(১৯0৯), ১৬ সংখ্যক পদে রাগতরঙ্গিণী-ধৃত পাঠভেদ, পৃ. ১১-১২)

শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত এই পদ সংকলন করার পর পদের অর্থ বিচার করার সময় লিখেছেন—‘রতি (যেমন) মদনের সহিত মিলিত হইয়াছিলেন, দেবল দেবী (সেইরূপ) লক্ষ্মণ দেব রাজার (সহিত মিলিত হইয়াছেন)। লক্ষ্মণদেব বোধ হয় মিথিলার সমীপবর্তী কোন ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ছিলেন।
এটা একদিকে ঠিক যে, বিদ্যাপতি অনেকানেক ক্ষুদ্র সামন্ত রাজারও মহিমা কীর্তন করেছেন, এই লক্ষ্মণ দেব হতেই পারেন তাঁদের একজন। অপরদিকে এটাও মনে হয় যে, বিদ্যাপতি বঙ্গ-গৌড়াধিপতি লক্ষ্মণসেনেরও যথেষ্ট গুণগ্রাহী ছিলেন। বিশেষ করে যিনি জয়দেব কবির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং যিনি এক সময় মিথিলারও শেষ হিন্দু রাজা, সেই লক্ষ্মণসেনও উল্লিখিত হয়ে থাকতে পারেন (বিদ্যাপতি ঠাকুর পৃ. ৪৪) তাঁর পদে। পণ্ডিত উমেশ মিশ্র তাঁর চর্চায় লিখেছেন—‘য়হ রাজা লক্ষ্মণসেন কে সম্বন্ধ সে কহা হৈ’।

বিদ্যাপতির পক্ষে বিদ্যাপতি

কবিরাই কবির শক্তি-ক্ষমতা জানেন সবচেয়ে বেশী। তাতে এটা এক প্রমাণিত সত্য যে, আদিকবি বাল্মীকি না থাকলে রঘুবংশীয় রামচন্দ্রের কথা এতভাল করে যেমন জানতাম না, তেমনই দ্বৈপায়ন ব্যাস না থাকলে আমরা তেমন মধুর রসে বুঝাতাম না শত গোপীর লীলাগুরু কৃষ্ণকে কিংবা মহাভারতের সূত্রধর কৃষ্ণকে। যদি বলি নায়ক যেখানে নরচন্দ্রমা রামচন্দ্র, কিংবা নায়ক যেখানে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ, সেখানে তাঁদের লোকাতিশায়ী কর্ম, গুণ, লীলা ঠিক জানতে পারত লোকে, তাহলে বলবো –কবি আর মহানায়ক এখানে পরস্পরের প্রতিপূরক, এখানে একে অন্যের গুণ বাড়িয়েছে।
কিন্তু অন্য জায়গায় এরকম নয়। রাজারাও সকলেই রঘুপতি রাঘব নন, কবিরাও সকলে বাল্মীকি-ব্যাস নন। কিন্তু এই পক্ষ যদি সমান-সমানও হয় তবু রাজারও পক্ষে কবির প্রয়োজন যত বেশী, কবির পক্ষে রাজার তত প্রয়োজন নেই। কবির কাছে রাজার প্রয়োজন যতখানি তাঁর কাব্যের সমঝদারি নিয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশী প্রয়োজন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা—যার ফল হল অর্থ আর সম্মান। কিন্তু যে রাজা নিজের যশ-কীর্তি মানুষের মধ্যে অক্ষয় করে রাখতে চান, তাঁর কাছে কবির মতো সহায় আর কেউ নেই—একথা লিখেছেন সংস্কৃত ভাষার এক কবি। তিনি রাজাদের সৎপরামর্শ দিয়ে বলেছেন – রাজারা শ্রদ্ধেয় সবাই ! বড়ো বড়ো কবিরা যে সব প্রেমমধুর কবিতাবন্ধ তৈরী করেছেন, তার মধ্যে দোষ দেখার চেষ্টা করবেন না এবং কবিদের সঙ্গে লড়াই করারও চেষ্টা করবেন না। আপনি যদি নিজের শুদ্ধ কীর্তি এই জগতে আখ্যাপন করতে চান তাহলে কবির অনুগ্রহেই সেটা হবে—শুদ্ধা কীর্তিঃ স্ফুরতি ভবতাং নূনমেতৎ প্রসাদাৎ।
সংস্কৃতের আর এক কবি—তাঁর নাম জানা যায় না—তিনি একবারে ব্যাস-বাল্মীকি-কালিদাসের নাম নিয়ে বললেন—বড়ো বড়ো রাজাদের যে এত কীর্তিগাথা, যশোগান—এই খ্যাতির প্রচার কিন্তু স্ববিষয়ে চীৎকার করেও হয়না কিংবা তুরী-ভেরী-ঢাক পিটিয়েও হয় না, তাঁদের সবার কীর্তি-যশ, নাম-ডাক সবটাই মহা-মহা কবিদের জন্যই সম্ভব হয়েছে—খ্যাতিং যান্তি নরেশ্বরাং কবিবরৈঃ স্ফারৈর্ন ভেরীরবৈঃ। এই লোককবি কতগুলি কবির নাম নিয়েছেন যাঁদের কারণে রাজারা বিখ্যাত হয়েছেন। তিনি বলেছেন—বাল্মীকির জন্যই রামচন্দ্রের এত খ্যাতি, যেমনটা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের খ্যাতি ব্যাসের জন্য। কালিদাসের মতো মহাকবির প্রশ্রয়েই বিক্রমাদিত্যের এত নাম। ধারাধিপতি ভোজরাজের নাম ছড়িয়েছে চিত্তপ আর বিহ্‌লনের জন্য। আর কর্ণ নামে সেই রাজার নামটা কেউ জানতও না, যদি ওই বিদ্যাপতি বিহ্‌লন তাঁর নাম না করতেন—ভোজশ্চিত্তপ-বিহ্‌লন-প্রভৃতিভিঃ কর্ণো’পি বিদ্যাপতেঃ।
অনামা এক কবির মুখে পূর্বতন কবিদের এই ক্ষমতার কথা—অর্থাৎ কবিরাই রাজাদের যশঃকায় নির্মাণ করে তাঁদের কীর্তিখ্যাতি দান করেন—এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্লোকশেষে বিদ্যাপতির নাম শুনে আমরা পুলকিত হয়ে ভেবেছিলাম—ইনিই সেই বিদ্যাপতি নাকি যিনি, কর্ণ নাম এক অখ্যাত রাজাকে বিখ্যাত করেছেন। বিশেষত বৈষ্ণব পদাবলীর রচয়িতা মৈথিল কোকিল বিদ্যাপতি বহু রাজার রাজত্ব দেখেছেন, বহু রাজা পরম্পরাক্রমে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাই কর্ণ নামে কেউ তাঁর পৃষ্ঠপোষক থাকবেন নিশ্চয়, যাঁকে তিনি বিখ্যাত করে দিয়েছেন।
অনিশ্চয়ের মধ্যে গবেষণা করতে করতে যখন নিশ্চয়াত্মক প্রতীতির দিকে এগোচ্ছি, তখন দেখলাম—‘বিক্রমাঙ্কদেবচরিত’নামে বিখ্যাত সেই ঐতিহাসিক কাব্যের লেখক বিহ্‌লনেরই উপাধি ছিল ‘বিদ্যাপতি’। চালুক্যরাজ কল্যাণমল্লদেব বিহ্‌লনের কবিত্বশক্তি দেখে তাঁকে বিদ্যাপতি উপাধি দেন। এবারে প্রশ্ন ওঠে তাহলে এই কর্ণ মানুষটা কে এবং কেমন করেই বা বিদ্যাপতি বিহ্‌লনের প্রখ্যাপনে বিখ্যাত হলেন তিনি। গবেষণার দৌলতে বুঝলাম—এর উত্তরটা দিয়েছেন বিদ্যাপতি বিহ্‌লন নিজেই।
বিহ্‌লন তাঁর কাব্যারম্ভে চালুক্য রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অনেক গুণ গাওয়ার পরেও কবিদের যেন একটু বেশী প্রশংসা করলেন। তিনি বলছেন—পৃথ্বীপতি রাজাদের পাশে যদি বড়ো বড়ো মহাকবিরা না থাকেন, তাহলে কে তাঁদের যশোগান করত। নইলে পৃথিবী রাজা-মহারাজারা কম আছেন নাকি? তাঁদের কার নাম কজনে জানে-

ভূপাঃ কিয়ন্তো ন বভূবুরুর্ব্যাং
জানাতি নামাপি ন কো’পি তেষাম্‌।

বিহ্‌লনের এই গর্বোক্তি যে এক্কেবারে, ঠিক, তার প্রমাণ ওই কালিঞ্জর রাজ্যের পার্শ্ববর্তী দেশ দাহালার রাজা কর্ণ। কাশ্মীর থেকে বিদায় নিয়ে শেষে চালুক্য রাজ কল্যাণমল্লের সভাকবি হবার আগে বিহ্‌লন যখন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছেন, তারই একটা সময়াংশে দাহালা নামে একটি জায়গায় রাজা কর্ণের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছুদিন বাস করেছেন তিনি। বিহ্‌লন তাঁর সম্বন্ধে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করে তিন থেকে চারটি শ্লোকমাত্র লিখেছেন, তাও সেটা বিক্রমাঙ্কদেবচরিতের মধ্যে। তাতেই কিন্তু কর্ণের সম্বন্ধে যতটুকু জানার, ততটুকু জেনেছে মানুষ; তা নইলে কেউ এই কর্ণের কথা জানতেই পারত না। আমাদের আশ্চর্য লাগে যে কবি লিখেছিলেন—কর্ণ বিখ্যাত হয়েছেন বিদ্যাপতির জন্য—কর্ণো’পি বিদ্যাপতেঃ –তিনি কিন্তু বিহ্‌লনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কল্যাণের রাজা চালুক্য রাজ ত্রিভুবনমল্লের নাম করলেন না, নাম করলেন কর্ণের। তাতে মনে হয়—এই কবি দাহালা বা আধুনিক বুন্দেলখণ্ডেরই লোক ছিলেন। নয়তো বা তিনি কর্ণের পরিচিত ছিলেন। এই কবি কিন্তু এটাও জানেন যে, বিদ্যাপতি উপাধিটি ত্রিভুবনমল্লেরই দেওয়া অথচ সেই বিদ্যাপতির জন্য বিখ্যাত হলেন দাহালা রাজা কর্ণ ।
আমরা এই বিদ্যাপতির সূত্র ধরেই মৈথিল বিদ্যাপতির কাব্যবোদ্ধা শিবসিংহ এবং তাঁর স্ত্রী লছিমা দেবীর কথা বলতে চাই। সবচেয়ে বড়ো কথা—এই বিদ্যাপতির লেখনীতে দাহালার রাজা কর্ণ যেমন খ্যাতি লাভ করেছেন, তেমনই মৈথিল বিদ্যাপতি না থাকলে রাজা শিবসিংহ এবং তাঁর স্ত্রী লছিমা দেবীও এত বিখ্যাত হতেন না।

বিদ্যাপতি এবং ভোগীশ্বর

মিথিলার মধ্যোত্তর যুগে যাঁরা রাজত্ব করেছেন, তাঁদের মধ্যে শিবসিংহ অন্যতম হলেও মিথিলার মধ্যযুগে সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা ছিলেন নান্যদেব। তিনি কর্ণাট-দেশ থেকে এসেছিলেন ১0৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সীতামঢ়ী রেল স্টেশন থেকে খানিক আগে হচ্ছে কোইলি গ্রাম। এই গ্রামের কাছেই সিমরাওগড়ে রাজধানী স্থাপন করেন নান্যদেব এবং তাঁর বংশের লোকেরা। এদেশে তাঁরা দুশো উনত্রিশ বছর রাজত্ব করেন বলে শোনা যায়। এই বৃহদ্‌বংশের রাজত্বশেষে মিথিলার রাজত্বভার ক্ষত্রিয় শাসকদের হাত থেকে ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যায়। অবশ্য তার অন্যতম কারণ হল—সেই সময় মিথিলা দিল্লীর ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে চলে গিয়েছিল। সেটা ১৩২৬ সাল। ফিরোজ শাহ তুঘলক যখন মিথিলা আক্রমণ করলেন কর্ণাটী নান্যদেবের শেষ বংশধর হরিসিংহদেব পালিয়ে গেলেন নেপালে। ফলে উত্তর বিহারের সবটাই ফিরোজ শাহ তুঘলকের দখলে চলে গেল। এর পরেই ‘ওইনি’ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশ ঘটল মিথিলার শাসনে। সিমরাঁওগড়ের রাজাদের ক্ষত্রিয়-শাসনের বিপ্রতীপে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন ওইনি-গ্রামের ওইনিবার ব্রাহ্মণরা। বংশসূত্রে ওইনি গ্রাম পেয়েছিলেন ওইনি ব্রাহ্মণ শ্রীনাথ ঠাকুর বা নাহ্‌ ঠাকুর। এই গ্রাম সমস্তিপুর জেলায়। ওইনিবার ব্রাহ্মণরা যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা নিয়ে দিন কাটালেও এঁরা যুদ্ধক্ষেত্রেও যে শক্তি দেখাতে পারতেন, সেটা স্বয়ং বিদ্যাপতি তাঁর কীর্তিলতা গ্রন্থে লিখেছেন—
ওইনি বংস পসিদ্ধ জগকো তসু করই ন সেব। (কীর্তিলতাপল্লব, ১.৬৩)
দুহু এক্কত্থ ন পাবিঅই্‌ ভুঅবই অরু ভূদেব।।
এখানে ‘ভুজবলী’ (ভুঅবই) যোদ্ধা আর ‘ভূদেব’ ব্রাহ্মণ এই শব্দ-দুটিতেই ওইনি ব্রাহ্মণদের চরিত্র বুঝিয়ে দেয়। গ্রামোপার্জক নাহ্‌ ঠাকুরের বংশে কামেশ্বর ঠাকুর ছিলেন রাজপণ্ডিত এবং অতি-সদাশয় সাধু মানুষ। কোন রাজার সভাপণ্ডিত তিনি ছিলেন, তা স্পষ্ট বলা মুশকিল, কিন্তু শোনা যায় যে, মিথিলার অরাজক অবস্থায় তিনি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফিরোজ শাহ তাঁকেই মিথিলা থেকে রাজকর আদায় করার ভার দেন এবং তাঁকেই করদ রাজা (vassal king) হিসেবে মিথিলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
কিন্তু কামেশ্বর ছিলেন সাধুপ্রকৃতির মানুষ। রাজ্য শাসনের সঙ্গে প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করে সুলতানের কাছে পাঠানোর কাজটা তাঁর পক্ষে তেমন সহজ এবং সুখকর হয়নি। কামেশ্বর তাঁর পুত্র ভোগীশ্বরকে রাজ্যভার সঁপে দিয়ে মুক্ত হলেন। বিদ্যাপতি তাঁর কীর্তিলতায় ভোগীশ্বরের তেজ এবং রূপ দুয়েরই প্রশংসা করে একটা বড়ো খবর দিয়ে বলেছেন—সুলতান ফিরোজ শাহ ভোগীশ্বরকে ‘প্রিয় সখা’ বলে সমাদর প্রদর্শন করতেন—

পিয় সখ ভণি পিঅরোজ সাহ সুরতান সমানল।
(কীর্তিলতাপল্লব, ১.৭৩)

ভোগীশ্বর প্রায় তেত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর মৃত্যুবরণ করেন। বিদ্যাপতি ভোগীশ্বরের অশেষ গুণের কথা বলেছেন এবং তাঁরই একটি কথা থেকে জানতে পারি যে ভোগীশ্বরের পত্নী ছিলেন পদ্মা। বিদ্যাপতি ভোগীশ্বরের সাংস্কৃতিক বোধের কথা উল্লেখ করে এক জায়গায় লিখেছেন—যে, ভোগীশ্বর নাগরিক-গুণসম্পন্ন ব্যক্তি, তিনি পদ্মার অতিপ্রিয় স্বামী—

রাউ ভোগিসব গুণ নাগরা রে পদ্মাদেবি রমান।

বিদ্যাপতি এবং গণেশ্বর

ভোগীশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গণেশ্বর (গএনেশ) রাজা হন বটে, তবে সেই রাজ্যের খানিক অংশ পেলেন কামেশ্বর ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র ভবসিংহ বা ভবেশ্বর সিংহ। রাজ্য ভাগ-বাটওয়ারা হলেও গণেশ্বর ভালই রাজ্য শাসন করছিলেন। দান, মান, বল এবং যশস্বিতা তাঁর রাজত্বকাল এগারো বছর পর্যন্ত প্রসারিত করেছে। কিন্তু ১৩৭১ খ্রিষ্টাব্দে আসলান নামে এক তুর্কী নেতা রাজ্যের লোভে গণেশ্বরকে হত্যা করলেন। এই হত্যা সাধারণ ছিল না, আসলান বুদ্ধি, বিক্রম, বল দিয়ে গণেশ্বরেকে কিছুই করতে পারেননি, কিন্তু চতুরপনা করে আসলান গণেশ্বরের বিশ্বাস উৎপাদন করে প্রায় পাশে বসিয়েই গণেশ্বরকেহত্যা করলেন—

রজ্জ লুদ্ধ অসলান বুদ্ধি বিক্রম বলে হারল।
পাস বইসি বিসওয়াসি রাএ গত্রনেসর মারল।
(কীর্তিলতাপল্লব, ২. ৬-৭)

বিদ্যাপতি এবং কীর্তিসিংহ

কীর্তিলতা কীর্তিসিংহের জয়গাথা। বিদ্যাপতি মুখর হয়েছেন তাঁর অল্পবয়সের রাজসান্নিধ্যে। কীর্তিসিংহের পর মিথিলা-ত্রিহুতে তাঁর বংশকর পুত্র ছিল না বলেই তাঁর পিতামহের ভ্রাতুষ্পুত্র দেবসিংহ পাকাপাকিভাবে রাজা হন বটে, তবে তাঁর আগে তাঁর পিতামহের ভাই ভবদেব সিংহ কিংবা ভবেশ্বর সিংহ কিছুকাল রাজত্ব করেন বলে মনে হয়। কেননা পুরুষপরীক্ষার গ্রন্থশেষে বিদ্যাপতি শিবসিংহের সর্বময়ী প্রশংসা করার আগে তাঁর পিতামহ বলে আখ্যাত করে ভবদেব সিংহের নাম করছেন এবং জানাচ্ছেন যে, তিনিও বেশ কিছুদিন রাজ্যসুখ ভোগ করার পর শত্রুবধের পাশাপাশি যাগযজ্ঞও করেছিলেন অনেক। অর্থপ্রার্থীদের অনেক দান-ধ্যানও করেছেন তিনি। কবি বিদ্যাপতি অল্প সময়ের জন্য তাঁরও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন—

ভুক্ত্বা রাজ্যসুখং বিজিত্য হরিতো হত্বা রিপুন্‌ সঙ্গরে
হুত্বা চৈব হুতাশনং মখবিধৌ ভৃত্বা ধনৈরর্থিনঃ।
বাগ্‌বত্যাং ভবদেবসিংহনৃপতি স্ত্যক্ত্বা শিবাগ্রে বপুঃ
পূত যস্য পিতামহঃ স্বরগমদ্‌ দ্বারদ্বয়ালংকৃতঃ।।

আসলান গণেশ্বরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকা করলেন বটে। কিন্তু তিনি রাজ্য অধিকার করতে পারলেন না। গণেশ্বরের তিন পুত্র ছিলেন ভীষণ সাহসী এবং বীর। তাঁদের নাম বীরসিংহ, কীর্তিসিংহ এবং রাজসিংহ। অনেকেই মনে করেন যে, জৌনপুরের শাসক ইব্রাহিম শর্কির সাহায্য নিয়ে এই তিন বীর-পুত্র আসলানকে তাড়িয়ে ছাড়লেন বটে, কিন্তু এই যুদ্ধে বীরসিংহ মারা গেলেন। কিন্তু ইব্রাহিম শর্কি সাহায্য করেছিলেন বলেই তাঁর নির্দেশেই রাজা হলেন কীর্তিসিংহ। আমরা অবশ্য কীর্তিসিংহের এই ত্রাতাকে ইব্রাহিম শর্কি মনে করিনা। তার কারণ, ১৩৭১ সালে, অর্থাৎ ২৫২ লক্ষ্মণাব্দে যখন আসলানের আক্রমণ ঘটে, সেই সময় ইব্রাহিম শর্কি জৌনপুরের ক্ষমতা-কেন্দ্রে আসেননি। ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দে খাজা জাহান ফিরোজ তুঘলকের নাতি মামুদ তুঘলকের কাছ থেকে জৌনপুরের অধিকার পান। শর্কিবংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। অথচ বিদ্যাপতি নিজে ২৫২ লক্ষ্মণাব্দ বা ১৩৭১ সালে আমলানের আক্রমণের কথা বলেছেন। ফলে জৌনপুরের ইব্রাহিম শর্কির কাছে তিনি সাহায্যের জন্য গিয়েছিলেন, এমনটা নাও হতে পারে। তাঁর সাহায্যকারী অন্য কেউ ছিলেন। বিদ্যাপতি লিখেছেন –বান্ধবজনের অনেক উচ্ছ্বাস হল, কারণ তিরহুত (মিথিলার অন্য নাম) পেলেন কীর্তিসিংহ। পাৎশা যশের তিলক পরিয়ে দিলেন, কীর্তিসিংহ ভূপতি হলেন—

বান্ধবজন উচ্ছাহ কর তিরহুতি পাইঅ রূপ।
পাতিসাহ জসু তিলক করু কিত্তিসিংহ ভউঁ ভূপ।।

এই কীর্তিসিংহর রাজ দরবারের দিকে তাকিয়েই রাজা শিবসিংহের পূর্ব-বংশপরম্পরার কথা আপাতত বন্ধ রাখতে হরে। কেননা, কীর্তিসিংহের পৃষ্ঠপোষকতাতেই বিদ্যাপতির বিখ্যাত লেখা ‘কীর্তিলতা’-র পল্লব বিকসিত হতে থাকে। কীর্তিলতায় প্রধানত কীর্তিসিংহের আসলান—বিজয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কীভাবে, কত অসহায় অবস্থায় ইব্রাহিম শর্কির দরবারে গিয়েছিলেন তিনি, বাজার-হাট ঘুরে রাজার কাছে পৌঁছোতে তাঁর যে-সব সমস্যা হয়েছিল এবং পরিশেষে ইব্রাহিম শর্কির সৈন্য-সাহায্য নিয়ে আসলানকে তিনি দেশছাড়া করলেন কীভাবে সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে সমকালীন সমাজের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থায় অসামান্য চিত্র এঁকেছেন বিদ্যাপতি।
কীর্তিসিংহের গুণজ্ঞাপক কীর্তিলতা নামের পুস্তকখানি বিদ্যাপতি লিখেছিলেন কীর্তিসিংহ বেঁচে থাকার সময়েই এবং সম্ভবত তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায়। কেননা কীর্তিলতার প্রত্যেক পল্লবের অন্তশ্লোকে পুষ্পিকা লেখার সময় কবি কোথাও অনুজ্ঞাবোধক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে লিখছেন—কীর্তিসিংহ যেন চিরকাল এই পৃথিবী রক্ষা করেন—চিরমবতু মহীং কীর্তিসিংহো নরেন্দ্রঃ। আবার কোথাও বর্তমান-কালিক ক্রিয়াপদে বিদ্যাপতির প্রার্থনা—সদাসর্বদা যাঁর শক্তি-সাহস সফল হয়ে থাকে, সেই কীর্তিসিংহের জয় হোক—সদা সফলসাহসো জয়তি কীর্তিসিংহো নৃপঃ। তবে, এখানে সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বোধ হয় কীর্তিলতার অন্তিম শ্লোক যেখানে বোঝা যায় – বিদ্যাপতি নিজের কবিত্বগুণে কীর্তিসিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন এবং তখন তার বয়স যথেষ্ঠ কম।
কীর্তিলতার শেষ শ্লোকে দুটি ভাগ আছে। একভাগে আসলান-বিজয়ী কীর্তিসিংহের প্রশংসা, অন্যভাগে তাঁর নিজের পরিচয়—যেখানে কবি তাঁর নিজের পরিচয় দিচ্ছেন ‘খেলন-কবি’ বলে। বিদ্যাপতি লিখেছেন—এইভাবে যিনি সংগ্রামভূমিতে শত্রুদমন করে রাজশাসনের উদয়লক্ষ্মী লাভ করেছিলেন, সেই রাজা কীর্তি সিংহ যশঃ পুষ্টিলাভ করুন তত দিন, যত দিন আকাশে এই চাঁদের ভেলাটি আছে—

এবং সঙ্গর-সাহস-প্রমথন-প্রালব্ধ-লব্ধোদয়াং
পুষ্ণাতু শ্রিয়মাশশাঙ্কতরণীং শ্রীকীর্তিসিংহো নৃপঃ।

এই শ্লোকের দ্বিতীয় ভাগে কবি লিখছেন—আর বিদ্যাপতির এই শব্দ-সরস্বতী –যা নাকি সদামাধুর্যের জন্ম দেয় এবং তাঁর যশোবিস্তার শিক্ষার ক্ষেত্রে সখীর মতো সহায়তা করে—সেই কবিভারতীও যেন খেলতে থাকে এই বিশ্বজগৎ যত দিন আছে –

মাধুর্য্য-প্রসবস্থলী গুরু যশোবিস্তারশিক্ষাসখী।
যাবদ্‌ বিশ্বমিদঞ্চ খেলতু কবের্বিদ্যাপতের্ভারতী।।

এই শ্লোকে ‘খেলতু’—খেলা করুক—এই ক্রিয়াপদটি না ব্যবহার করে একটি বিশেষ পুঁথিতে ‘খেলন কবেঃ’ পাঠ থাকায় অনেকেই এই কীর্তিলতা গ্রন্থটিকে খুব অল্পবয়সের রচনা বলে সিদ্ধান্ত করেছেন, কিন্তু এঁরা একবারও ভাবেননি যে, ‘খেলন’ পাঠ ধরলেও—তখনও তাঁর খেলার বয়স যায়নি, এমন আভিধানিক অর্থ যাঁরা করেন, তাঁরা আর যাই হোক, কবির কবিত্ব তাঁরা বোঝেন না। খেলন-কবি শব্দের অর্থ-যিনি শব্দ নিয়ে খেলা করেন। তবে সবার ওপরে আছে—কবিপ্রয়োগ-পদ্ধতি। উপরি উক্ত শ্লোকের প্রথম ভাগে যেহেতু একটি প্রার্থনা-বাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার, করে কবি যখন কীর্তিসিংহের যশঃপুষ্টি প্রার্থনা করেছেন ‘পুষ্ণাতু’ বলে, তেমনই অনুরূপ প্রার্থনা-বাচক শব্দে বিদ্যাপতির শব্দমাধুর্য্য বিশ্বচরাচরে খেলা করুক—খেলতু কবের্বিদ্যাপতের্ভারতী—এই পাঠই সমীচীন। আমরা এখানে অবশ্য কীর্তিসিংহের সবচেয়ে বড়ো কীর্তি মনে করছি বিদ্যাপতির মতো কবির পৃষ্ঠপোষকতা তিনি আরম্ভ করেছেন বলে।
সেই কীর্তিসিংহের সময় থেকে বিদ্যাপতির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয়েছিল এবং তা শেষ হয়েছে শিবসিংহের মৃত্যু বা অন্তর্ধানেরও অনেক পরে। কীর্তিসিংহের ক্ষমতা এবং কীর্তির কতা বারংবার এসেছে কীর্তিলতা গ্রন্থে এবং তাঁর সময়েই বিদ্যাপতির প্রতিভা প্রথম শাখা-বিস্তার করতে আরম্ভ করে। কীর্তিসিংহের পিতা গণেশ্বর যখন আসলানের হাতে মারা গেলেন, সেই অবস্থায় রাজনীতি-সমাজনীতির বাইরে সাংস্কৃতিক জীবনের কী গতি হয়েছিল, সে কথা বিদ্যাপতি কীর্তিলতাতেই লিখেছেন। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিদ্যাপতি লিখেছেন—কাব্য-সাহিত্য বোঝে এমন মানুষ আর কেউ ছিল না। কবিরা সব ভিখারির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল এখানে-সেখানে। রাজা গণেশ্বর স্বর্গে চলে যাবার পর ত্রিহুতের সমস্ত গুণই তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল –

অখ্‌খর বুজ্ঝনিহার নহি কইকুল ভমি ভিক্‌খারি ভঊঁ।
তিরহুতি তিরোহিত সব্ব গুণে রা গণেস জবে সগ্গ গউঁ।।
(কীর্তিলতা ২.১৪-১৫ পৃ. ৪১)

এই অবস্থায় পরিবর্তন এল যখন গণেশ্বরের হত্যাকারীকে দূরে হঠিয়ে কীর্তিসিংহ রাজা হলেন ত্রিহুতে। বিদ্যাপতি তখন অনেক ছোট, সম্ভবত বয়ঃসন্ধির কাল পেরিয়েছেন তখন। কিন্তু তখনই কীর্তিলতার অবহঠ্য ভাষা এবং সংস্কৃত শ্লোকরচনা আলোড়ন তুলেছে সমস্ত কবিতার জগতে। যে কালে সংস্কৃতে কবিতা লেখার দস্তুর ছিল, সেই সংস্কৃত ভাষা বিদ্যাপতি যথেষ্টই ভাল জানতেন। কিন্তু বিদ্যাপতি বেছে নিলেন এমন একটা ভাষা যাকে তিনি নিজে অবহঠঠ বললেও সেখানে তাঁর নিজের কারিগরি আছে। তিনি লিখলেন বটে যে, দেশী ভাষা সকলের কাছে মিঠে লাগে বলেই তিনি অবহঠঠ ভাষায় লিখেছেন—‘দেসিল বয়ণা সব জন মিঠ্ঠা / তে তইসন জম্পউ অবহঠ্ঠা’—(কীর্তিলতা ১.৩৫-৩৬) কিন্তু তাঁর অবহঠ্ঠা ভাষা সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহঠ্ঠ, দেশী, প্রাচীন মৈথিল ভাষা এমনকী আরবী-ফার্সীকেও তিনি ছেড়ে দিলেন না, অথচ ব্যাকরণের ঠাটে কোনো সমস্যা রইল না। এক্কেবারে মিশ্রভাষায়, মিশ্র ব্যাকরণের শুদ্ধতা।
কীর্তিলতার চতুর্থ পল্লবে কীর্তি সিংহের কথা শুনে যখন ইব্রাহিম শাহ সুলতান খেলা নিয়ে এগোচ্ছেন, তখন ভৃঙ্গীর মুখে জিজ্ঞাসার ভাষা ছিল এইরকম—ওহে কান্ত আমার ! সত্যিটা বলো, চার দিক দিয়ে সৈন্য-সনা কেমন চলল, তিরহুতের অবস্থাটা কী হল, আর আসলান কী করল তখন—

কহ কহ কন্তা / সচ্চু ভণন্তা / কিমি পরি সেনা সঞ্চরিঅ।
কিমি তিরহুতি / হোঅউঁ পবিত্তী / অরু অসলান কিক্করিঅ।।
(কীর্তিলতা পৃ. ৮0)

যেভাবেই হোক কীর্তিসিংহ রাজ্যটা যেভাবেই বাঁচান, তাতে বিদ্যাপতির মতো এক নাগরিক কবি তো লিখবেনই—জয় হোক কীর্তিসিংহের। তাঁর সাহস, বল, যশ আর স্ত্রীলাভে সফল হয়েছেন কীর্তিসিংহ। তাঁর বল যুদ্ধকালে শত্রুর গর্ব সংহার করে। তাঁর যশ এই জগৎকে আপ্লুত করেছে কুমুদ আর কুন্দকলি যেমন চাঁদের জ্যোৎস্নায় আপ্লুত হয়। আর কীর্তিসিংহরে রাজলক্ষ্মী বসে আছেন তাঁর ঘোড়ার ওপর যার দুই পাশে দুটি চামর শোভা পায় বলেন, –

রিপুমণ্ডলী-সমর-দর্প-সংহারিণা।
যশোভিরমিতো জগৎকুমুদ-কুন্দ-চন্দ্রোপমৈঃ।
শ্রিয়া বলিত-চামরদ্বয়-তুরঙ্গ রঙ্গস্থয়া
সদা সফলসাহসো জয়তি কীর্তিসিংহো নৃপঃ।।
(কীর্তিলতা ৩.১৬৪ পৃ. ২0৭-২0৮)

কীর্তিসিংহের মৃত্যুর পর কবিদের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে একটা ছেদ পড়ার সম্ভাবনা হয়ে গিয়েছিল। কেননা তিন ভাই কীর্তিসিংহ, বীরসিংহ এবং রাজসিংহ—কারোরই কোনো সন্তান ছিল না। ফলে কীর্তিসিংহের সেই যে পিতামহ ছিলেন ভোগীশ্বর—যাঁর ভাই ভবসিংহ, ভবদেবসিংহ বা ভবেশ্বর সিংহ –সেই ভাবেশ্বরের ছেলে দেবসিংহ এবার রাজ্য পেলেন কীর্তিসিংহের পর।

বিদ্যাপতি এবং দেবসিংহ

ভবদেবসিংহের পরে তো দেবসিংহ। বিদ্যাপতির অতিপ্রিয় শিবসিংহ তখন রাজা না হয়েও রাজা। দেবসিংহ অত্যন্ত ভাল মানুষ তা বটেই এবং জনহিতের জন্য যে সব কাজ করেছেন, তা মুখরিত হয়েছে বিদ্যাপতির প্রশংসায়। বিদ্যাপতি অবশ্যই তাঁর রাজসভার অলঙ্কার ছিলেন; দেবসিংহের আদেশে যেমন তিনি ‘ভূপরিক্রমা’ নামে বইখানা লিখেছিলেন, তেমনই লেখক এবং কবি হিসেবে তাঁর ওপর আস্থা রাখার ফল হিসেবে বিদ্যাপতিও প্রচার করেছেন তাঁর রাজমহিমা। বিহারের সমস্তিপুর আর নির্মলীর পথে সকুরী সরোবর, সকুরীর হাট এখনও আছে, এই সরোবর নির্মাণ ছাড়াও আরও অনেক জনহিতকর কাজ এবং দান-মান দেওয়াটা দেবসিংহের স্বভাবের মধ্যে ছিল বলেই বিদ্যাপতিকে দেবসিংহের সুখ্যাতি করে বলতে হয়েছে—দেবসিংহ আসলে দেবতা, এই দেশের রাজা হিসেবে তিনি প্রত্যেকটি লোকের নমস্য হয়ে রয়েছেন—

দেবো’সৌ দেবসিংহঃ ক্ষিতিপতিতিলকঃ কস্য ন স্যান্নমস্যঃ।

বিদ্যাপতি তাঁর শৈবসর্বস্বসার এবং পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থে দেবসিংহের অসংখ্য প্রশংশা করেছেন বলেই এটা মনে হয় যে, দেবসিংহর সময় থেকেই বিদ্যাপতি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছেন পুরোপুরি এবং এই খাতিরের আরও একটা কারণ হল – দেবসিংহ জীবিত থাকতেই তাঁর ছেলে শিবসিংহের ‘নামে রাজা’ হয়ে যাওয়া—বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষার মধ্যে তাঁর বয়ান সেটা প্রমাণ করে দেয়- ভাতি যস্য জনকো রণজেতা দেবসিংহনৃপতিঃ। এমনকী দেবসিংহকে যখন মাতৃভাষায় ‘নৃপ নাগর’বলে সম্বোধন করেন বিদ্যাপতি, তখন শিবসিংহের ছোঁয়া লেগে যায় আর একটি শব্দে—দেবসিংহ হাসিনি দেবীর প্রিয় স্বামী—দেবসিংহ নৃপনাগর রে হাসিনি দেবিকন্ত। এই কথাটা কিন্তু বিদ্যাপতির পদের মধ্যে এসেছে। অর্থাৎ যে সময়ে শৈবসর্বস্বের ভূপরিক্রমা সেরে বিদ্যাপতি ব্রজবুলি—মৈথিলীতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের জগতে প্রবেশ করেছেন বিদ্যাপতি, তখন তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজাদের ব্যক্তিজীবনের মেদুরতাও ধরা পড়েছে তাঁর পদাবলীতে। বিদ্যাপতি বোধ হয় তাঁর প্রভুদের সখ্যতায় সিক্ত হচ্ছেন এই সময় থেকেই।
দেবসিংহ কীর্তিসিংহের পিতৃব্য অর্থাৎ কাকা। দেবসিংহ ওইনি রাজধানী ছেড়ে দ্বারভাঙার কাছে নিজের নামে রাজধানী বানান, যার নাম দেবকুলী। দেবসিংহ যখন রাজত্ব করছেন, তখনই বিদ্যাপতি তাঁর পুরুষপরীক্ষা নামে বিখ্যাত গ্রন্থটি লেখা আরম্ভ করেন এবং এই থেকেই এটা জানা যায় যে, দেবসিংহ বেশ ভাল রকম দানী মানুষ ছিলেন—হেমহস্তিরথদানবিদগ্ধঃ। দেবসিংহের সামরিক পরাক্রম এবং প্রজাদের সুখ-সুবিধের জন্য তাঁর ভাবনার কথা বিদ্যাপতি বারবার বলেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা দেবসিংহও যথেষ্ট বিদ্যেৎসাহী পুরুষ ছিলেন। স্বয়ং বিদ্যাপতিও তাঁর কাছে পৃষ্ঠপোষকতা, লাভ করেছেন বলে মনে করি। দেবসিংহের নির্দেশেই তিনি ‘ভূপরিক্রমা’ নামে একখানি গ্রন্থ লেখেন, যদিও ভূপরিক্রমার বিদ্যাপতির দেওয়া একটা তথ্য থেকে দেবদিংহের জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো একটি প্রমাদের কথাও যেন পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
বিদ্যাপতি লিখছেন—আমি মহারাজ শিবসিংহের পিতা দেবসিংহের নির্দেশে এই ভূপরিক্রমার গ্রন্থ লিখছি। দেবসিংহ এই সময় নৈমিষারণ্যে বাস করছেন এবং তিনি আছেন সূতপিঠ নামক একটি স্থানে। সেই দেবসিংহের নির্দেশেই পঁয়ষট্টিটি দেশের বিবরণ সহপঁয়ষট্টিটি কাহিনী লিখছি। এই গ্রন্থে চারটি খণ্ড বা ভাগ আছে—

দেবসিংহ-নিদেশাচ্চ নৈমিষারণ্যবাসিনঃ।
শিবসিংহস্য চ পিতুঃ সূতপিঠনিবাসিনঃ।।
পঞ্চষষ্ঠি-দেশযুক্তাঃ পঞ্চষষ্টি কথান্বিতাম্‌।
চতুঃখণ্ড-সমাযুক্তামাহ বিদ্যাপতিঃ কবিঃ।।

এই শ্লোক থেকে দুটি তথ্য আমরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। প্রথমটা হল—দেবসিংহ হঠ্যৎ তাঁর সাধের রাজধানী দেবকুলী ছেড়ে মহাভারত-পুরাণের কথকঠাকুরদের পিঠস্থান নৈমিষারণ্যে বাস করতে গেলেন কেন ? সেই সময় তাঁর রাজ্যে কি কোনো রাজনৈতিক সমস্যা হয়েছিল –যে কারণে তিনি কিছুদিন নৈমিষারণ্যের মতো তীর্থে গিয়ে বাস করছিলেন। দ্বিতীয়ত শিবসিংহের নাম এখানে উল্লিখিত হয়েছে এমনভাবেই যাতে মনে হয় শিবসিংহের সঙ্গে বিদ্যাপতির পরিচয় তৈরী হয় শিবসিংহের কুমার-কাল থেকেই। বিশেষত যে শিবসিংহ বিদ্যাপতির জবানীতে ‘রূপনারায়ণ’ বলে আখ্যাত হবেন, সেই শিবসিংহের পিতা দেবসিংহও কিন্তু উপনামে ‘গরুড়নারায়ণ’ ছিলেন।
যাই হোক, বিদ্যাপতি যেমন লিখেছেন তাতে বোঝা যায় যে, তিনি দেবসিংহ নৃপতির কম প্রিয়পাত্র ছিলেন না ভবিষ্যতে তাঁর কবিত্বগুণ যেমন শিবসিংহের অন্দরমহল লছিমা দেবী পর্যন্ত পৌঁছাবে, তেমনই এটাও বুঝতে হবে যে, বিদ্যাপতির গুণগ্রাহিতা দেবসিংহের আমলেই তাঁর অন্দরমহলে পৌঁছে গিয়েছিল। দেবসিংহের স্ত্রীর নাম ছিল হাসিনি দেবী। বিদ্যাপতি হাসিনি দেবীকে সোজাসুজি তাঁর লেখাগুলির সমঝদার বলেননি বটে, তবে দেবসিংহের প্রসঙ্গে যখন তাঁকে হাসিনি দেবীর প্রিয় রাজা বলে উল্লেখ করতে হয়, তখন বোঝা যায় বিদ্যাপতির গুণগ্রাহিতায় হাসিনি দেবীও অন্তরালে আছেন –

দেবসিংহ নৃপনাগর রে হাসিনি দেবিকন্ত।
হাসিনি দেবিপতি, দেবসিংহ নরপতি, গরুড়নারায়ণ রঙ্গে ভুললি।

রাজা গরুড়নারায়ণ দেবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতার রঙ্গে যিনি একসময় ভুলেছিলেন, সেই দেবসিংহ গতায়ু হয়েছিলেন ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দে এবং বিদ্যাপতি লিখেছেন যে, লক্ষ্মণ-সংবৎ ২৯৩ সালে দেব সিংহ গঙ্গালাভ করে সুরধামে গমন করেছেন—
সতবলে গঙ্গা, মিলিত কলেবর, দেবসিংহ সুরপুর চলিঅো।
বিদ্যাপতির ভণিতায় শিবসিংহ আষ্টেপৃষ্ঠে সর্বত্র জড়িয়ে থাকলেও তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান পেয়েছেন শিবসিংহের পিতা দেবসিংহ। পরমা প্রকৃতি শিবশক্তির বন্দনা দিয়ে প্রথম যে পদটি খগেনবাবু এবং বিমানবিহারী ধরেছেন, সেখানে বিদ্যাপতি দেবসিংহের মতো অধিগুণসম্মন্ন মানুষকে ‘যাচক-জনের গতি’ বলে পদ লিখেছেন বিদ্যাপতি –

বিদ্যাপতি কবিবরে এহো গাওল
জাচক জনকে গতী।
হাসিনি দেইপতি গরুড় নারায়ণ
দেবসিংহ নরপতি।
(বিদ্যাপতির পদাবলী (বিমানবিহারী), পদসংখ্যা ১, পৃ. ১)

বিদ্যাপতির শব্দ-নির্বাচন থেকে বোঝা যায় যে, দেবসিংহের পত্নী হাসিনী দেবীও কবির গুণগ্রাহী ছিলেন। দেবসিংহের কথা যখনই ভণিতা ব্যবহার করেছেন বিদ্যাপতি, তখনই হাসিনীদেবীর প্রিয় নায়ক হিসেবেই তাঁর পরিচয় দিয়েছেন কবি। তাতে বোঝা যায়—বিদ্যাপতির কাব্যকৃতির ব্যাপারে হাসিনী দেবীরও কিছু উৎসাহ ছিল। বিদ্যাপতি লিখেছেন-

ভনে কবি বিদ্যাপতি / অরে বর জৌবতি
মধুকরে পাউলি মালতী ফুললী।
হাসিনি দেবি পতি/ দেবসিংহ নরপতি
গরুড় নরায়ণ রঙ্গে ভুললি।।
(বিদ্যাপতির পদাবলী (বিমানবিহারী), পদসংখ্যা ৩, পৃঃ ৪)

একটি পদে বিদ্যাপতি বলছেন—রসিক-নাগরের প্রতি শেষ পর্যন্ত এক বিলাসিনী রমণীর আকর্ষণ ঘটে গেল। অতএব এবার মুরারি কৃষ্ণ প্রসন্ন হোন হাসিনীদেবীর প্রিয়পতি দেবসিংহের ওপর—

ভনে বিদ্যাপতি / যে জন নাগর / তাপর রতলি নারী।
হাসিনী দেবিপতি / দেবসিংহ নরপতি / পরসন হো মুরারী।।

শিবসিংহের মতো তাঁর কাব্যের সমঝদার বিদ্যাপতি পাননি, এটা মেনে নিয়েও বলবো যে, এই সমঝদারি আরম্ভ হয়েছিল শিবসিংহের পিতার সময় থেকেই। সেই জন্যই এমনতর ভণিতা বিদ্যাপতির পদে এসেছে—রসমন্ত মানুষই রস বোঝেন। বোঝেন হাসিনী দেবীর কান্ত রাজা দেবসিংহ নাগর—

বিদ্যাপতি কবি গাওল রে রস বুঝএ রসমন্ত।
দেবসিংহ নৃপ নাগর রে হাসিনিদেবি কন্ত।।

আবার যখন দার্শনিক বৈরাগ্যে এক রমণী যৌবন হারানোর বিলাপ করে, তখন —‘রস নাই রস নাই’ বলতে বলতেও এক সময়ে নৈমিষ্যারম্যকাসী দেবসিংহের কথা মনে করে বিদ্যাপতি লেখেন—

ভনহি বিদ্যাপতি রস নাহি ছেও।
হাসিনি দেইপতি দেবসিংঘ দেও।

বিদ্যাপতি এবং হরিসিংহ

দেবসিংহের পর শিবসিংহের নামাঙ্কিত ভণিতা নিয়েই কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু তার সংখ্যা অনেক বেশী বলেই আর যেসব পদে বিদ্যাপতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, সেই পদগুলি আগে নির্দেশ করার চেষ্টা করি। পূর্বোক্ত দেবসিংহের এক ভাই ছিলেন হরিসিংহ—যিনি ভবদেবসিংহের দ্বিতীয় পুত্র এবং শিবসিংহের সম্পর্কে হরিসিংহ হলেন তাঁর কাকা। দেবসিংহের তত্ত্বাবধানে থাকতে-থাকতে হরিসিংহের সঙ্গেও বিদ্যাপতির খানিক ঘনিষ্ঠতা হয়ে থাকবে; তারই চিহ্ন রয়ে গেছে একটি পদে, যেখানে বিদ্যাপতি একনিষ্ঠ এবং নিবেদিত প্রাণ রাধাপ্রেমের সম্বন্ধে কৃষ্ণেক সচেতন কবে দেবার পর ফুলে-ফুলে মধু –খাওয়া মধুকরের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে হরিসিংহদেবকে সাক্ষী মেনে লিখলেন—

ভনই বিদ্যাপতি এহ রস ভান।
সিরি হরিসিংঘ দেবই রস জান।।
(নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী, পদ ৭৬৩, পৃ. ৪৫৬)

বিদ্যাপতি এবং গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ

বঙ্গদেশের রাজাদের প্রতি বিদ্যাপতির যে খানিক দুর্বলতা ছিল, সেটা শুধুই হিন্দু রাজা বলেই নয়, মুসলমান রাজারাও তাঁদের বিদগ্ধতার গুণে বিদ্যাপতির কৃতজ্ঞতা লাভ করেছেন। যেমন ১৩৯২ খিষ্টাব্দ থেকে ১৪১0 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যিনি বঙ্গভূমিতে রাজত্ব করেছেন, সেই গিয়াসউদ্দীন আজম শাহকে নিয়ে বিদ্যাপতি ভণিতা করেছেন –

মহলম জুগপতি চিরে জীবে জীবথু
গ্যাসদীন সুরতান।
(বিদ্যাপতির পদাবলী(বিমানবিহারী), পদসংখ্যা ২, পৃ. ৩)

ভণিতায় ‘গ্যাসদীন সুরতানে’র নাম দেখে বিমানবিহারী মজুমদার বিদ্যাপতির দ্বিতীয়সংখ্যক পদেই ভণিতা ব্যাখ্যা করে বলেছেন —

গ্যাসদীন – নগেনবাবু ষ্টুয়ার্টের ইতিহাসের উপর নির্ভর করিয়া গ্যাসউদ্দীনের মৃত্যুর তারিখ ১৩৭৩ খ্রীষ্টাব্দ লিখিয়াছেন, কিন্তু ডাঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালী স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা পর্যালোচনা করিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে, গিয়াসুদ্দীন ১৩৯২ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার পিতা সিকন্দরকে যুদ্ধে নিহত করিয়া গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ উপাধি ধারণ করেন এবং ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। শিবসিংহের পিতা দেবসিংহ অল্পদিন রাজত্ব করিয়া ১৮১৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চমাসে পরলোকগত হন, সুতরাং গিয়াসুদ্দীন শিবসিংহ ও দেবসিংহের মিথিলায় রাজত্ব করার পূর্বে বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন। কিন্তু এই পদটি দেবসিংহের রাহ্যাধিরোহণের পূর্বে কি পরে লিখিত হইয়াছিল, তাহা বলা যায় না।

তবে বিমানবিহারীর এই তথ্যও ঠিক নয় যে, দেবসিংহ ১৪১৩ খ্রীষ্টাব্দে গতায়ু হন। তিনি ১৪০২ সালেই মৃত্যুবরণ করেন এবং সেই সালেই শিবসিংহ সিংহাসনে বসেন। এসব কথা আমরা শিবসিংহ শীর্ষক প্রবন্ধে আলোচনা করবো।