বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের চতুর্থ খণ্ডের নাম ‘নৌকাখণ্ড’। মূল পাণ্ডুলিপির ৭১ পৃষ্ঠার ২ নম্বর শ্লোক থেকে খণ্ডটি শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ৮৬ পৃষ্ঠার ২ নম্বর শ্লোকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পর্বটি অখণ্ডিত, অর্থাৎ, এই পর্বের সবকয়টি শ্লোক পাওয়া গিয়েছে।
পূর্ববর্তী খণ্ড, অর্থাৎ দানখণ্ডের শেষে আমরা দেখি, কৃষ্ণকে অনিচ্ছায় আত্মদান করে অপমানে, ক্ষোভে, গ্লানিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রাধা অকপটে কৃষ্ণের অত্যাচারের কথা বড়াইয়ের কাছে ব্যক্ত করেন। এবং এই ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ রাধা আবার মথুরায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। আর রাধার শাশুড়িও তাঁকে মথুরায় যেতে বারণ করে দেন।
এদিকে দীর্ঘদিন রাধাকে না দেখে কৃষ্ণ অস্থির হয়ে ওঠেন। দিনে রাতে ঘুম নেই, রাধা-বিরহে তিনি যেন আর প্রাণ-ধারণ করতেই পারছেন না। এমতাবস্থায়, কৃষ্ণ আবার বড়াইয়ের সাহায্য চাইলেন। দুজনে মিলে এবার নতুন ফন্দি আঁটলেন।
বড়াই আবার গেল রাধাকে মথুরায় যাওয়ার কথা বলতে। রাধা তখন কৃষ্ণের অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মথুরায় যেতে অসম্মত হলে, কৃষ্ণের সঙ্গে পূর্ব পরামর্শ মতো, বড়াই রাধাকে অন্য পথে মথুরায় নিয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করলো। কিন্তু রাধা রাজি হলেই তো হবে না, রাধার শাশুড়ির অনুমতিও তো চাই। বড়াই কৌশলে সেটিও যোগাড় করলো। এইভাবে বড়াই পরদিন সকালে ষোলশো সখীসহ রাধাকে নিয়ে আবার মথুরার পথে যাত্রা করলো।
এদিকে মথুরার ঘাটে তখন কৃষ্ণ একটি বড় নৌকা জলের নিচে ডুবিয়ে রেখে আর একটা ছোটো নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। ঘাটে এসে কাউকে দেখতে না পেয়ে রাধা ডাকাডাকি করছেন শুনে কৃষ্ণ এবার ঘাটিয়াল বেশে এসে উপস্থিত হলেন। রাধার অনুরোধে তিনি সকলকে যমুনা পার করে দিতে সম্মতও হলেন। কিন্তু নৌকা তো খুবই ছোটো। তাই সকলকে এক এক করে পার করাতে লাগলেন। রাধার সমস্ত সখীরা এবং বড়াই পার হয়ে গেলে এবার রাধাকে নদীর পাড়ে একা পেয়ে কৃষ্ণ স্বমূর্তি ধারণ করলেন। রাধাও কৃষ্ণের দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে ভয় পেলেন। যথারীতি কৃষ্ণ আবার রাধার কাছে আলিঙ্গন চেয়ে বসলেন। আবার শুরু হলো যুক্তি-তর্কের চাপান-উতর। শেষে অনেক বচসার পর বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে রাধা দুধ-দইয়ের পসরা নিয়ে নৌকায় উঠলেন।
নৌকা একটু এগোতেই এবার নদীতে ঝড় উঠলো। উঁচু উঁচু ঢেউ। এমনকি পাটাতনের ভেতর কিছুটা জলও ঢুকে এল। কৃষ্ণ জানালেন, রাধার দুধ-দইয়ের পসরা, এমনকি রাধার গুরুভার পয়োধর, তার ওপর কাঁচুলি, তার ওপর গজমোতির হার, তাঁর গুরু নিতম্ব, গুরু জঙ্ঘা – এত কিছু ছোটো এই নৌকাটি বইতে পারছে না। রাধা ভয় পেলেন এবং কৃষ্ণের কথা মতো পসরা-সহ নিজের সমস্ত আবরণ-আভরণ যমুনায় বিসর্জন দিলেন। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণের সন্তুষ্টি নেই। মাঝ নদীতে গিয়ে নৌকা প্রচণ্ড দুলতে লাগলো। ভয়াতুরা রাধিকা এবার কৃষ্ণকেই দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন। কৃষ্ণ তখন প্রবল উৎসাহে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে রাধিকাকে কোলে নিয়ে ভাসতে থাকলেন ও তীব্র চুম্বনে আবিষ্ট করলেন। আর তাতেই ‘রাধার মনত তবেঁ জাগিল মদন’।
ইতিমধ্যে দুধ-দই বেচে রাধার সখীরা ও বড়াই ফিরে এসেছে। বড়াই রাধার এই হাল দেখে কারণ জানতে চায়। রাধা জানান, মাঝ যমুনায় প্রচণ্ড ঝড় উঠে নৌকা তলিয়ে গেছে। সেই সময় কৃষ্ণ না থাকলে তিনি ডুবেই মরে যেতেন। কৃষ্ণই তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছেন। এইখানেই রাধার এক মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের ইঙ্গিত পাই আমরা। দানখণ্ডে রাধা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৃষ্ণকে আত্মদান করে অসম্মানিত বোধ করেছেন। বড়াইয়ের কাছে কৃষ্ণের এই আচরণকে ‘অত্যাচার’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু নৌকাখণ্ডের এই দ্বিতীয় মিলনকালে রাধা প্রথমবার দেহসুখ উপভোগ করেছেন। আর এই দৈহিক সম্পৃক্তিই কৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রেমকে অঙ্কুরিত করেছে। তাই এবার কৃষ্ণকে আড়াল করে তিনি বড়াইয়ের কাছে সত্য গোপন করেছেন।
যাই হোক, সম্ভোগ সুখে সন্তুষ্ট কৃষ্ণ এবার জলের তলায় লুকিয়ে রাখা বড় নৌকাটি তুলে এনে বড়াই ও রাধাকে তাঁর সকল সখী-সহ যমুনা পার করিয়ে দেন। এই সুযোগে রাধাও তাঁর হৃত আবরণ ও আভরণ চেয়ে নেন কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণ তাঁকে সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দিলে তিনি সকলের সঙ্গে আনন্দ মনে বাড়ি ফিরে যান। আর কৃষ্ণও বড়াইয়ের চরণ বন্দনা করে বাড়ি ফেরেন।
এই হলো নৌকাখণ্ডের অখ্যানভাগ। এই খণ্ডে মোট ৩০ টি শ্লোক পাই। রাগরাগিনীর নাম পাই ১১ টি। এর পরবর্তী খণ্ডের নাম ‘ভারখণ্ড’।