বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের দ্বাদশখণ্ডের নাম ‘বংশীখণ্ড’। এই খণ্ডটি সম্পূর্ণ পাওয়া গিয়েছে। শুধু ৬ নম্বর শ্লোকের ৮টি অক্ষর পাঠযোগ্য নয়। মূল পুঁথির ১৬৮ পৃষ্ঠার ২ নম্বর শ্লোক থেকে শুরু করে এই পর্ব শেষ হয়েছে পুঁথির ১৮৯ পৃষ্ঠার ২ নম্বর শ্লোকে।
এই পর্বের শুরুতে দেখি বড়াই আর সখীদের সঙ্গে রাধা যমুনায় স্নান করতে গেলে কৃষ্ণ রাধাকে ভোলানোর জন্য করতাল, মৃদঙ্গ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকেন। কিন্তু কিছুতেই রাধার মন পাননা। তখন কৃষ্ণ সাতটি ছিদ্রযুক্ত, সোনার সামি লাগানো, হীরকখচিত মোহন-বাঁশী তৈরী করেন। সে বংশী ধ্বনি শুনতে শুনতে মুগ্ধা রাধিকা জল নিয়ে বাড়ী ফেরেন।
রাধিকা বাড়ী ফিরে আসেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণের বাঁশী শুনে রাধিকা এতই ব্যাকুল হন যে, কিছুতেই আর গৃহকর্মে মন দিতে পারেননা। বাঁশী শুনে আপনিই চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে রাধার। রাধা বড়াইকে বলেন, তিনি এই মুরলীবাদকের পায়েই আত্মসমর্পণ করবেন।
এই বলে রাধা বড়াইকে সঙ্গে নিয়ে যমুনার তীরে এলেন। বড়াইকে বললেন কৃষ্ণকে খুঁজে এনে দিতে। কিন্তু কৃষ্ণকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। তখন কৃষ্ণকে খুঁজতে বৃন্দাবনে যেতে চান রাধা। এবার বড়াই রাধাকে তিরস্কার করতে থাকে। বলে, রাধার মতো উত্তমকুলজাত মেয়ের পরপুরুষের প্রতি এমন ব্যাকুলতা শোভন নয়। কিন্তু রাধার সেই একই কথা, কৃষ্ণকে ছাড়া তাঁর জগৎ অন্ধকার, সংসার শূন্য; কৃষ্ণকে না পেলে তিনি আর বাঁচবেননা।
এমনই সময় কৃষ্ণের বাঁশী বেজে ওঠে। অস্থির হয়ে ওঠেন শ্রীরাধিকা। বড়াই বিরক্ত হয়। মনে করিয়ে দিতে চায় কৃষ্ণের প্রতি রাধার পূর্ব-ব্যবহারের কথা। রাধিকা এবার জানান, তিনি আর এমন ব্যবহার করবেন না কৃষ্ণের সঙ্গে।
অনেক খোঁজার পরেও কৃষ্ণকে না পেয়ে বড়াই এবার রাধাকে বাড়ী ফিরে যেতে বলে। রাধাকে বড়াই বোঝায়, কৃষ্ণ রাধার মন পরীক্ষা করছেন। কিছুদিন দেখা না হলে কৃষ্ণও বিরহ কাতর হবেন এবং রাধার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
শ্রীরাধিকা বাড়ী ফিরে আসেন। কিন্তু আরও কাতর হয়ে পড়েন। এই সময় আবার বেজে ওঠে পোড়া বাঁশী। রাধা কাঁদতে থাকেন। রাধার কষ্ট দেখে আর বড়াই স্থির থাকতে পারে না। বড়াইয়ের পরামর্শে ও সহযোগিতায় এবার রাধা কৃষ্ণের মোহন-বাঁশীটি চুরি করেন। পরিকল্পনা মতো বড়াই নিদ্রাউলী মন্ত্রে কৃষ্ণকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আর রাধা কলসীর মধ্যে করে বাঁশীটি চুরি করে নিয়ে এসে এক গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখেন।
এদিকে ঘুম ভাঙলে কৃষ্ণ দেখেন তাঁর সাধের বাঁশীটি অন্তর্হিত। কৃষ্ণ প্রথমে জোরে জোরে কাঁদতে থাকেন। তারপর সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজেন এবং অবশেষে রাধার কাছে এসে সরাসরি বাঁশীটি ফেরত চান। রাধা বলেন, তিনি জানেন না, বড়াই জানে। কৃষ্ণ বড়াইয়ের কাছে গেলে বড়াই বলে, সেও জানে না কৃষ্ণের বাঁশী কোথায়।
এবার কৃষ্ণ খুব রেগে যান। রাধা কৃষ্ণের মধ্যে শুরু হয় চরম বচসা। অবশেষে বড়াই মধ্যস্ততা করে। বড়াই বলে, কৃষ্ণ যদি রাধা ও তাঁর ষোলশো সখীর প্রত্যেকের কাছে করজোড়ে বাঁশীটি ফিরত চান, তবে কৃষ্ণ সেটি ফিরে পেতে পারেন।
এই প্রস্তাবে প্রথমে রাজি না হলেও, পরে কৃষ্ণ রাজি হন এবং বাঁশীটিও ফেরত পান প্রতিশ্রুতি মতো। শ্রীরাধিকা জানান, কৃষ্ণের বিরহে তিনি বড়োই দগ্ধ হচ্ছেন। কৃষ্ণ রাধাকে ক্ষমা করে দেন ও খুশী মনে বাড়ী ফিরে যান। বংশীখণ্ডের আখ্যান পর্বের এখানেই সমাপ্তি।
বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো একটি পুরাণাশ্রয়ী লৌকিক কাব্য এই বংশীখণ্ডে এসে বিরহবিধুরা রাধার আর্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি সার্থক গীতিকাব্য হয়ে উঠেছে। এই খণ্ডে রাধিকা অনেক বেশী করে কৃষ্ণগতপ্রাণা। এই কাব্যে এর আগে এমন কৃষ্ণসর্বস্ব ভাবময়ী রূপে রাধাকে আমরা পাইনা।
মূল পুঁথিতে বংশীখণ্ডে মোট ৪১টি শ্লোক পওয়া যায়। রাগরাগিণীর নাম পাই ১৬টি। এই কাব্যের পরবর্তী এবং অন্তিম পর্বটির নাম ‘রাধাবিরহখণ্ড’।