‘ব্রজবুলি’ শব্দটি শুনলেই মনে হয়, এ যেন ব্রজবাসীর মুখের বোলি, নন্দলালার আপনজনের ভাষা। কিন্তু আমাদের এই মরমী ভাবনা আসলে ভ্রান্ত। ‘ব্রজবুলি’ বৃন্দাবনের ভাষা নয়, রাধাকৃষ্ণও এ ভাষাতে কথা বলতেন না। আসলে পদাবলী বিশেষ কোনো একটি ভাষায় বা কোনো বিশেষ অঞ্চলের ভাষায় লেখা নয়। বরং নানা ভাষার মিশ্রণ রয়েছে এখানে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ-এর ভাষা সংস্কৃত হলেও সহজ-সরল, কিছুটা বাংলার কাছাকাছি। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই ভাষাকে Sanskritised Vernacular বা Vernacularised Sanskrit বলে বিশেষিত করেছেন। ছন্দের ক্ষেত্রেও গীতগোবিন্দ সংস্কৃত অপেক্ষা প্রাকৃতের অধিক অনুগামী। জয়দেব লক্ষ্মণসেন-এর সমসাময়িক বলেই অধিকাংশ গবেষকের মত । সে হিসেবে ১১৭৯ থেকে ১২০৬ (লক্ষ্মণসেন-এর রাজত্বকাল) খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে গীতগোবিন্দ রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আবার, চৈতন্যচরিতামৃতের রচনাকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন –
চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগীবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রদিনে
গায় শুনে পরম আনন্দ।।
গীতগোবিন্দ, রায়ের জগন্নাথ-বল্লভ নাটকের সঙ্গে চন্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদ মহাপ্রভু আস্বাদন করেছিলেন। ফলে সহজেই বোঝা যায়, মধ্যযুগের ঐশ্বর্যময় বৈষ্ণবপদাবলী চণ্ডীদাসের আকুল হৃদয়াবেগ আর বিদ্যাপতির মধুময় ব্রজবুলির পদলালিত্যের মধ্য দিয়ে বাংলা-বিহার–ওড়িশা-আসাম তথা সমগ্র পূর্ব্বভারত জুড়ে ঝঙ্কৃত হয়ে চলেছে সুদীর্ঘ কাল জুড়ে।

উৎস সন্ধানে

‘ব্রজবুলি’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে নানা মত আছে। দীনেশ্চন্দ্র সেন বলেছেন, “রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদে এই ভাষা ব্যবহৃত হয় এবং ব্রজ বা বৃন্দাবন রাধাকৃষ্ণের লীলাস্থলী, এই জন্যই বোধ হয় এই ভাষার নাম ব্রজবুলি হইয়াছে”। ‘ব্রজবুলি’ নামটিতে অবশ্য প্রাচীনত্ব নেই। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কবি ঈশ্বরগুপ্ত বৈষ্ণব পদাবলীর এই মিশ্র-মৈথিল কাব্য ভাষাকে ‘ব্রজবুলি’ নাম দেন। এই ভাষা বাংলা নয়, হিন্দিও নয়। বৃন্দাবন অঞ্চলে যে বাংলা মিশ্রিত হিন্দি প্রচলিত তার সঙ্গেও এর মিল নেই। এ হল কৃত্রিম মৈথিলী, যা বাংলা ও মৈথিল ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি। প্রাকৃতপৈঙ্গলে এই ভাষার প্রাথমিক নমুনা আছে। সুনীতিকুমার এই ভাষাকে “ a curious jargon, a mixed Maithili and Bengali with a few Western Hindi form, … entairely different form the Western Hindi dialect, called Braj-bhakha, current round about Mathura” বলে পরিচয় দিয়েছেন। সুকুমার সেনের মতে নেপালের তীরহুত মোয়দের রাজসভায় ব্রজবুলির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। তুর্কী আক্রমণের ফলে বাংলা- বিহারের বহু পণ্ডিত ভদ্রাসনচ্যুত হয়ে নেপাল ও অন্যান্য প্রান্তীয় রাজেদের আশ্রয় নেন। সেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলীর চর্চা হয়েছে। এমনকি সেখানকার রাজারাও ব্রজবুলিতে পদ লিখতেন। অনেকের ধারণা ছিল বিদ্যাপতির পদের বিকৃত বাংলাদেশীয় রূপটি ব্রজবুলি। সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে এই কৃত্রিম সাহিত্যিক উপভাষার খ্যাতিই প্রমাণ করে , ধারণাটি সঠিক নয়। সুকুমার সেন এক সময় প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু ও ভাষাতাত্ত্বিক গ্রীয়ারসনের এ মত সমর্থন করলেও পরে নিজের অভিমত খণ্ডন করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, “সংস্কৃতে ও প্রাকৃতে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কবিতা খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত আর্যাবর্তের সর্বত্র প্রচারিত ছিল, বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে। এই চার-পাঁচশ বছর ধরে আর্যাবর্তে অর্থাৎ পশ্চিমে গুজরাট থেকে পূর্বে কামরূপ পর্যন্ত সমসাময়িক কথ্য ভাষার সর্বভূমিক সাধুরূপ অবলম্বন করে একটি সাহিত্যিক ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। এই ভাষাকে সেকালের ও একালের পণ্ডিতেরা নানা নামে অভিহিত করেছেন – প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অর্বাচীন অপভ্রংশ, অপভ্রষ্ট, অবহট্‌ঠ, দেশী ভাষা ইত্যাদি। …এই অবহট্‌ঠ থেকেই ব্রজবুলির উৎপত্তি হয়েছে”।

বিদ্যাপতি ও ব্রজবুলি

বিদ্যাপতির রচনার মাধ্যমেই ব্রজবুলির প্রসার। ১৩৮০ থেকে ১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যাপতির জীবনকাল বলে নানা তথ্য সহ প্রমাণ করেছেন শ্রদ্ধেয় বিমানবিহারী মজুমদার। সুদীর্ঘ জীবদ্দশায় বিদ্যাপতি ভূপরিক্রমা, কীর্তিলতা, পুরুষপরীক্ষা, কীর্তিপতাকা, লিখনাবলী, ভাগবত-অনুলিপি, শৈবসর্বস্বসার, গঙ্গাবাক্যাবলী, বিভাগসার, দানবাক্যাবলী,দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী সহ বহু বৈষ্ণব ও শৈব পদ রচনা করেছেন। এসকল গ্রন্থাদিতে তিনি মূলত সংস্কৃত, অবহট্ঠ ও মৈথিল ভাষার ব্যবহার করেছেন। কীর্তিলতা রচনার ক্ষেত্রে দেশি ভাষার মিষ্টতার কথাও বলেছেন –

সক্কয় বাণী বুহঅণ ভাবই
পাউঅ রস কো মন্ম না পাবই।
দেসিল বঅনা সব জন মিঠ্‌ঠা।
তেঁ তৈসন জম্পঞও অবহট্টা।।

অর্থাৎ বুধগণের ভাবনার বিষয় সংস্কৃত বাণী, কিন্তু প্রাকৃত ভাষার মর্ম কেউ বোঝেনা, দেশীয় কথা সকলের কাছেই মিষ্টি, তাই অবহট্ঠে কথা বলছি। সুতরাং অনেকেই মনে করেন প্রাকৃতজনের রসবোধের কথা মনে রেখেই তিনি পদাবলীতে মৈথিল ভাষার ব্যবহার শুরু করেন। বিমানবিহারী মজুমদার এবিষয়ে বলেছেন, “মনে হয় যে সব বিষয়ে কবিতা পড়িবার আগ্রহ কেবলমাত্র মিথিলাবাসীদেরই হইবার কথা, এরূপ বিষয় লইয়া কবি অবহট্ঠ ভাষায় রচনা করিয়াছেন ; পূর্ব্বভারতের কাব্যরসিকেরা যেরূপ কবিতা শুনিতে উৎসুক হইবার সম্ভবনা তাহা তদানীন্তন বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া ও অসমিয়া ভাষার সহিত বিশেষ সাদৃশ্যযুক্ত মৈথিলী ভাষায় লিখিয়াছেন ; সমগ্র ভারতের পণ্ডিত সমাজের জন্য যখন ভূপরিক্রমা, পুরুষপরীক্ষা, বিভাগসার, শৈবসর্বস্বসার, প্রভৃতি রচনা করিতে চাহিয়াছেন, তখন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন”। আমরা দেখতে পাই মিথিলা থেকে প্রাপ্ত বিদ্যাপতির পদ খাঁটি মৈথিল ভাষাতেই লেখা, আর বাংলায় প্রাপ্ত পদে রয়েছে সংমিশ্রণ। কৃত্রিম অথচ মধুর এ ভাষার লালিত্য, মাধুর্য্য ও ধ্বনিঝঙ্কার পাঠক ও শ্রোতার মন সহজেই হরণ করে।

ভাষার রূপ

ব্রজবুলির মধুর কোমল ধ্বনিতরঙ্গ যেমন শ্রুতিমধুর তেমনি সহজবোধ্য। ব্রজবুলিতে যুক্তব্যঞ্জনের পরিবর্তে স্বরধ্বনির বাহুল্য, নাসিক্যব্যঞ্জনের আধিক্য এ ভাষার মাধুর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে স্বরান্ত উচ্চারণ, রুদ্ধদল, দীর্ঘস্বর ও যৌগিক স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণে তৈরি হওয়া ছন্দলহরী মন মাতিয়ে দেয়। এ ভাষার “পদাবলীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হইবার আসল কারণ ব্রজবুলির ছন্দের সুভগতা। ব্রজবুলির পদ … ছন্দে মাত্রাগত বলিয়া শব্দের অক্ষরের মাত্রা-নিয়মনে স্বাধীনতা আছে। মাত্রাছন্দে ধ্বনিঝঙ্কার তোলা অনেক সহজসাধ্য ছিল”(সুকুমার সেন)। ব্রজবুলির ভাষাতাত্ত্বিক বিশেষত্বটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে –
১। ব্রজবুলিতে তৎসম ও অর্ধতৎসম শব্দের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়।
২। অ-এর উচ্চারণ হয় সংবৃত, বিবৃত আর অতিসংক্ষিপ্ত।
৩। ই, ঈ-এর দুপ্রকার অর্থাৎ হ্রস্ব ও দীর্ঘ উচ্চারণ হয়।
৪। দ্বিত্বব্যঞ্জন লোপ পায় – ধিক্কার > ধিকার, উত্তর > উতর, উন্মত্ত > উনমত ইত্যাদি।
৫। দ্বিবচনের বিভক্তিহীনতা লক্ষ্যনীয়।
৬। বহুদচন বোঝাতে সব, কুল, সমাজ, মেলি প্রভৃতি ব্যবহার হয়। যেমন – সখী সব, সখি সমাজ।
৭। শব্দের মাঝে থাকা ঘ, থ, ধ, ভ অনেক সময় ‘হ’ হয়ে যায় – মেঘ > মেহ, নাথ > নাহ।
৮। ‘ম’ ছাড়া অন্য সব স্পর্শ বর্ণের পূর্বে থাকলে শ,ষ,স প্রায়শই লোপ পায়। যেমন- নিশ্চয় > নিচয়,
অস্থির > অথির, দুস্তর > দুতর
৯। প্রথমার একবচনে বিভক্তি প্রায়শই থাকে না ; দ্বিতীয়ার বিভক্তি লুপ্ত ; তৃতীয়ায় এ, হি, হিঁ – বিভক্তি যুক্ত হয়।
১০। পঞ্চমীতে দেখা যায় সেঁ, সঞে বিভক্তি
১১। সপ্তমীতে বিভক্তি লোপ অথবা তৃতীয়া বিভক্তির রূপ দেখা যায়।
১২। সমাস-বন্ধনের তেমন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
১৩। উত্তম পুরুষে ‘হাম, মঞি, মো, মুঝে, মোহে, মঝু, হামক প্রভৃতি প্রয়োগ পাওয়া যায়। .
১৪। ‘অব’ যোগে ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াপদ গঠিত হয় –কহব, চলব। বর্তমানকালে – ছঁ, উ, ওঁ, সি, ই, অই, ই, অত
ইত্যাদি সহযোগে ; অতীতকালের ক্রিয়াপদ – অল, ই, ও, উ, লা- যোগে ক্রিয়াপদ গঠিত।
এগুলি ছাড়াও আরও নানাবিধ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ব্রজবুলিতে রয়েছে। ব্রজবুলিতে লেখা বিদ্যাপতির একটি পদ উদ্ধৃত করলে এর ললিত-মধুর রূপটির পাশাপাশি ভাষাতাত্ত্বিক চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে –

ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্ততি ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ সঘনে খর শর হন্তিয়া।।
কুলিশ কত শত পাত মোদিত ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওত ছাতিয়া।।
তিমির দিগ্‌ভরি ঘোর যামিনী অথির বিজুরিক পাতিয়া।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া।।

বিকাশের কাল

বিদ্যাপতির পদের মধ্য দিয়েই ব্রজবুলির সর্বাধিক প্রচার ও খ্যাতি। বাংলাদেশের পদাবলীতে এই ভাষার অবদান বর্ণনাতীত। একথা সত্য যে, “ব্রজবুলির বীজ হইতেছে ‘লৌকিক’ অর্থাৎ অবহট্ঠ ।… ব্রজবুলি বীজ অঙ্কুরোদ্ভিন্ন হইয়াছিল সম্ভবত মিথিলায়। বাঙ্গালায় তাহা প্রতিরোপিত হইয়া বৃদ্ধি পাইয়াছিল”(সুকুমার সেন)। বিদ্যাপতি স্বয়ং
অবহট্ঠ ভাষা সম্পর্কে বলেছিলেন –
বালচন্দা বিজ্জাবই ভাষা। দুহুঁ নহি লগ্‌গই দুজ্জন হাসা।।
ও পরমেশ্বর হরশির সোহই। ঈ নিচ্চয় নায়র মন মোহই।।
অর্থাৎ শিশুচন্দ্র ও বিদ্যাপতির ভাষা দুর্জনের পরিহাসের বিষয় হতে পারে না। কারণ চন্দ্র পরমেশ্বরের শিরে যেমন শোভা পায়, তেমনি এ ভাষাও নিশ্চয়ই বিদগ্ধ রসিক জনের মনমোহিনী হবে। বিদ্যাপতির এ কথা অবহট্টের মতো ব্রজবুলির ক্ষেত্রেও সমান সত্য। সর্বোপরি এ ভাষার সর্বাতিশায়িতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু বিদ্যাপতি মৈথিল কবি রূপে পরিচিত হলেও ব্রজবুলির আদি রূপকার ছিলেন না। মিথিলাবাসী উমাপতি উপাধ্যায় এ ভাষার প্রথম কবি বলে জানা যায়। এঁর আবির্ভাব ঘটে বিদ্যাপতির একশো পঁচিশ বছর আগে, চতুর্দশ শতকে। তাঁর ‘পারিজাতহরণ’ নাটকে সত্যভামার সংলাপে ব্যবহৃত পদটিতে ব্রজবুলির প্রয়োগ দেখা যায়। ‘অরুণ পূরব দিশিবহলি সগর নিশি, গগন মগন ভেল চন্দা …’। তবে ব্রজবুলির শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি। চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা, আসাম, ও ওড়িশায় ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচিত হয়েছে। যশোরাজ খান রচিত –
এক পয়োধর চন্দনে লেপিত
আরে সহজেই গোরা ।
পদটি বাঙালি রচিত প্রথম ব্রজবুলি ভাষার পদ। এই পদে হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৮) নাম দেখে অনুমান করা যেতে পারে পদটি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে বা ষোড়শের প্রারম্ভে রচিত। ওড়িশাতে পাওয়া রায় রামানন্দের ‘পহিলহি রাগ নয়নভঙ্গ ভেল’ ব্রজবুলির একমাত্র নমুনা–এই পদখানি তিনি গেয়েছেন মহাপ্রভুর সঙ্গে প্রথম মিলনকালে(১৫১০)। অসমিয়া পদকর্তা শঙ্করদেবও ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছিলেন –
হরি হরি পিয় মোরি বৈরি অধিক ভেলি, করলি অতয়ে অপমানা।
চৈতন্য-উত্তরকালে ব্রজবুলির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। গোবিন্দদাস, ‘ছোট বিদ্যাপতি’ নামে খ্যাত কবিরঞ্জন, বলরাম দাস, অনন্তদাস, যদুনন্দন, রায়শেখর, নরোত্তম দাস, কবিবল্লভ প্রমুখ অনেকেই ব্রজবুলিতে পদ রচনা করেছেন।
ব্রজবুলির শ্রুতির মধুরিমা, শব্দের রণন, ছন্দের ঠমক, অনুপ্রাসের ঝঙ্কার – রসিক ও সাধক উভয়কেই ভাবসাগরে ডুব দিয়ে ‘সিনান’ করতে শেখায়। এই মিঠা দেশী বচনের টানে অসংখ্য বৈষ্ণব মহাজন, এমনকি হাল আমলে তরুণ রবীন্দ্রনাথও পদ রচনা করেছেন – মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান। একলা মনের গোপনে জমে ওঠা প্রেমের মধুকথার প্রকাশে ব্রজবুলি বড়ই উপযোগী। এ ভাষা কোমল, কান্ত, মধুর, শ্রুতিমধুর। কীর্তনের রসমূর্চ্ছনা ও সুরের অঙ্গসজ্জায় ব্রজবুলির ছটা সর্বাধিক। এ ভাষায় রাধাকৃষ্ণের লীলা মাধুরীর রহস্যময়তা অধিক মনোগ্রাহী।