বিদ্যাপতি ঐনবরার রাজসভায় যোগদান করেন দেবসিংহের আমলে বা তারও আগে এবং নৈমিষারণ্যে দেবসিংহের অনুগামী হন কিন্তু ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শিবসিংহ যখন রাজ্য সূদৃঢ় করার চেষ্টা করছিলেন, তখন তিরহুত থেকে বিদ্যাপতির কাছে আহ্বান আসে ৷ সেই থেকে শিবসিংহের রাজত্বকালের শেষ দিনটি পর্যন্ত বিদ্যাপতি তাঁর সঙ্গে ছিলেন — অতি বিশ্বস্ত বন্ধু ও বিজ্ঞ মন্ত্রণাদাতা হিসেবে ৷ সরকারীভাবে তাঁকে ঘোষণা করা হয় রাজপণ্ডিত হিসেবে, অন্যান্য পণ্ডিতদের নেতার পদে ৷ তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পণ্ডিতদের অভ্যর্থনা ও দেখাশুনো করার –তাঁদের দান করা ও পুরস্কৃত করার বিষয়ে বিধিব্যবস্থা নেওয়ার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন রাজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা, সর্বক্ষণের সাথী ও আস্থাভাজন কর্মচারী ৷ বিদ্যাপতি রাজার সম্পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং বিনিময়ে তিনিও বন্ধুত্ব ও বশ্যতা স্বীকার করেন ৷ কথিত আছে, একবার রাজস্ব দিতে না পারায় নবাব শিবসিংহকে বন্দী করেন ৷ বিদ্যাপতি তখন দেওয়ানের তরুণপুত্র অমৃতাকরের সহযোগিতায় নবাবকে কাব্য পাঠ করে এতই প্রীত করেন, যে রাজা মুক্তি তো পানই উপরন্তু কবিদের গুণগ্রাহিতার জন্য নবাবের ভুয়সী প্রশংসা অর্জন করেন, বিদ্যাপতি ভূষিত হন ‘কবিশেখর ‘ উপাধিতে ৷ রাজ্যলাভ করে শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে তাঁর আদিগ্রামের স্বত্ব প্রদান করেন ও নতুন উপাধি দেন ‘অভিনব জয়দেব’ ৷ শিবসিংহ যখন যুদ্ধযাত্রা করেন, যে যুদ্ধ থেকে তিনি আর কোনোদিনই প্রত্যাবর্তন করেননি, বিদ্যাপতিকে তাঁর ছয় পত্নীর রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে যান ৷ বিদ্যাপতির প্রতি শিবসিংহের ছিল এমনই অগাধ আস্থা এবং বিদ্যাপতিও তার যোগ্য ছিলেন ৷
শিবসিংহের সভায় বিদ্যাপতি ছিলেন ৩৬ বছর ৷ মিথিলার ইতিহাসে শিবসিংহের মতো এত সর্বগুণান্বিত রাজা আর কেউ ছিলেন না, ক্ষমতাশালী কিন্তু সদাশয়, শক্তিমান কিন্তু জনপ্রিয় এবং মিথিলায় জনশ্রুতি আছে :
‘পোষরী রজোষরী অর সব পোষর
রাজা শিবই সিংহ অর সব ছোকর ৷’
অর্থাৎ ”মিথিলায় একটিই সরোবর আছে রাজোখর, আর সবই ডোবা, তেমনই একজনই রাজা শিবসিংহ আর সকলেই বালখিল্যের দল ৷”
‘কীর্তিপতাকা’র শেষ স্তবকে বিদ্যাপতি লিখেছেন প্রতিটি শহরের প্রতিটি দিকের প্রতিটি গৃহের ঘরণী যুদ্ধজয়ী বীর শিবসিংহের গুণকীর্তন করে ৷ ‘পুরুষ পরীক্ষা’র শেষ স্তবকে বিদ্যাপতি লিখেছেন রাজা শিবসিংহ গজ্জন ও গৌড় — দুইয়ের অধিপতিদের যুদ্ধে পরাস্ত করেন ৷ সুতরাং মনে হয় প্রথম জীবনে শিবসিংহ দিল্লীশ্বরের বশ্যতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে (অর্থাৎ বিহারের রাজ্যশাসকের মধ্যস্থতায়) মেনে নিলেও পরবর্তীকালে সম্র্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেন ও সম্মানদক্ষিণা দিতে অস্বীকৃত হন ৷ অর্থাৎ স্বাধীন ভূস্বামী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন ৷ এর ফল হিসেবে তাঁকে বহু যুদ্ধ করতে হয়, যার অধিকাংশতেই তিনি জয়লাভ করেন ৷ সম্ভবত এইরকমই কোনো একটি যুদ্ধজয় বিদ্যাপতিকে ‘কীর্তিপতাকা’ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল ৷ এই ধরনেরই একটি যুদ্ধে শিবসিংহের অন্তিম যাত্রা হয় ঠিক যেভাবে কর্ণাট বংশীয় তেজস্বী হরিসিংহ মৃ্ত্যুমুখে পতিত হন ৷ যুদ্ধ করা, বিশেষত মুসলমানদের সঙ্গে, কখনোই মিথিলার রাজন্যবর্গের নীতি ছিল না ৷ তাঁরা মুসলমান শাসকদের উদগ্র রাজ্যজয়ের নীতিকে প্রশমিত করার চেষ্টাই করে গেছেন ৷ কিন্তু কর্ণাটবংশীয় হরিসিংহ ও ঐনবরার রাজা শিবসিংহ যুদ্ধনীতিকেই কাম্য বলে গ্রহণ করেন এবং দুজনেই প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষের কাছে পর্যুদস্ত হন ৷
বিদ্যাপতি শিবসিংহের চরিত্র নানা বিশেষণে ভূষিত করেছেন যা অনেকক্ষেত্রে হয়তো তোষামোদের পর্যায়েও চলে গেছে ৷ ‘পুরুষ পরীক্ষা’র তৃতীয় অধ্যায়ের শেষে দুটি স্তবকে শিবসিংহকে ভগবান বিষ্ণু ও শিবের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, শুধু আকৃতিগত সাদৃশ্যে নয়, চারিত্রিক বা গুণগত বৈশিষ্ট্যেও ৷ বিদ্যাপতি লিখেছেন, ”তিনটি গুণ—স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, বীরোচিত আচরণ ও বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান –এর অপূর্ব সমন্বয় ত্রিভুবনে মাত্র তিন জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে”— দুজন হলেন দেবলোকের বিষ্ণু ও মহেশ্বর আর একমাত্র মর্ত্যলোকবাসী রাজা শিবসিংহ, রূপনারায়ণ ৷ বিদগ্ধকথায় বিদ্যাপতি লিখেছেন রাজা শিবসিংহ কাব্য ও নারীর প্রেমপূজারী, রাজা ভোজের মতোই ৷ একই কথা বারবার ফিরে এসেছে তাঁর গীতরচনায় ৷ শিবসিংহকে বলা হয়েছে ধরিত্রীর মদনদেব, সৌন্দর্যের পরম প্রেমিক, শিল্পী, বিদ্যার পৃষ্ঠপোষক ৷ বিদ্যাপতি এমনও বলেছেন যে রাজা শিবসিংহ বিষ্ণুর একাদশতম অবতার এবং ভগবান কৃষ্ণের মতো প্রেমিক ৷ একথা অনস্বীকার্য যে শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে জীবনকে পরিপূর্ণ ও সুখী করার জন্য যা যা উপকরণ দরকার সবই দিয়েছিলেন আর বিদ্যাপতিও বিনিময়ে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য বিশেষত গীতের মধ্য দিয়ে শিবসিংহকে অমরত্ব দান করে গেছেন ৷ ‘পুরুষপরীক্ষা’র তৃতীয় অধ্যায়ের ২৬নং কাহিনীতে বিদ্যাপতি এক কবি ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজার সম্পর্কের কথা বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন কবির সৃষ্টির মধ্য দিয়েই যুগ যুগ ধরে রাজা জনমানসে অমর হয়ে থাকেন ৷
১৩৭০ থেকে ১৪০৬ (অর্থাৎ কুড়ি বছর থেকে ছাপান্ন বছর বয়স পর্যন্ত) অথবা যুবক থেকে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত বিদ্যাপতি শিবসিংহের সঙ্গে থেকে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন ৷ নবজাগরণের ধীমান পথিকৃৎ বিদ্যাপতি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এবং তিনি এমন মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন যা নারীপুরুষের চিত্তকে সমানভাবে অন্দোলিত করবে আবহমানকাল ৷ শিবসিংহের মতো একজন রাজার আস্থা অর্জন করেছিলেন তিনি এবং শিবসিংহের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের আদর্শে অবিচল থেকেছেন যা আমাদের সপ্রশংস বিস্ময়ের বস্তু ৷

এই সময়ে বিদ্যাপতি অধিকাংশ গীত রচনা করেন যা তাঁকে অমরত্ব দান করেছিল ৷ এ ছাড়াও ছিল ‘আরও চারটি রচনা– অবহট্টে রচিত ‘কীর্তিপতাকা’ ও ‘কীর্তিলতা’, সংস্কৃত গদ্য ও কাব্যের সংমিশ্রণে ‘পুরুষপরীক্ষা’, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত একটি নাটক ‘গোরক্ষবিজয়’ ৷ এই ‘গোরক্ষবিজয়’ নাটকেই বিদ্যাপতি মৈথিলী ভাষায় গীত রচনা করেন অনেকটা অপভ্রংশে রচিত কালিদাসকৃত নাটক ‘বিক্রমোর্বশী’র চতুর্থ অঙ্কের নৃত্য-গীতির অনুকরণে ৷ আমরা যদি বিদ্যাপতির পরিণত বয়সের রচনাগুলি দেখি বিপুলসংখ্যক প্রেমগীতসহ, তাহলে স্পষ্টই বুঝতে পারব নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তিনি সর্বত্র অনুসরণ করেছেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি হল ”প্রকৃত পুরুষের মধ্যে সমস্ত দেহলক্ষণ ছাড়াও যা থাকে তা হল এক আদর্শ কল্পনা, যা ব্যতীত পুরুষ লাঙ্গুলবিহীন পশু মাত্র ৷” মনুষ্য দেহধারী জীবদেহ খুঁজে পাওয়া সহজ, কঠিন হল সত্যিকারের মানুষের সন্ধান পাওয়া ৷” পুরুষ পৌরুষের আদর্শের অধিকারী হলে তবেই সে প্রকৃত পুরুষপদবাচ্য, পুরুষের জন্মগত দেহলক্ষণ পৌরুষের পরিচায়ক নয় ৷ মেঘকে তখনই ফলপ্রসূ বা বারিদ বলা যায় যখন সে বৃষ্টি দেয়; তা না হলে মেঘ শুধুই ধূম্রজাল মাত্র ৷ এমন কি তাঁর প্রেমগীতিতেও নারীর প্রেম ও কামনার উৎস সত্যিকারের পুরুষ অর্থাৎ বিদ্যাপতির ভাষায় ‘সুপুরুষ ‘ ৷
বিদ্যাপতির মতে প্রকৃত পুরুষের তিনটি লক্ষণ — বীরোচিত আচরণ যাতে সুষম সংমিশ্রণ ঘটেছে বিচারবুদ্ধি ও শৌর্যের, তীক্ষ্ণ ধীশক্তি ও বিশেষ দক্ষতা এবং সেইসঙ্গে প্রকৃত পুরুষ অর্জন করবে জীবনের চারটি প্রধান লক্ষ্যবস্তু — ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষতা, রতিসুখ ও মোক্ষলাভ ৷ এর থেকে মনে হয় বিদ্যাপতি সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য দেহ ও মনের সুষম বিকাশ সমর্থন করতেন ৷ নবজাগরণের প্রকৃত দিশারী হিসেবে বিদ্যাপতি জীবনকে উপভোগ করতে বলেছেন সম্পূর্ণভাবে এবং জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ উদার কারণ তিনি জীবনকে উপলব্ধি করতে বলেছেন প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষেত্রে এবং তাঁর মতে সবদিক থেকে জীবনচেতনা উপলব্ধি করা উচিত, কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ অনাবশ্যক ৷ এই সুষম জীবনদর্শন প্রথম থেকেই বিদ্যাপতির মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল ৷
তাঁর প্রথম রচনা ‘ভূপরিক্রমা’য় ‘মানুষের পরীক্ষা’র কথা সারার্থ হিসেবে বলা হয়েছে এবং এই সময়ের শেষ রচনা ‘কীর্তিলতা’য় ‘প্রকৃত পুরুষ’কে প্রকাশ করা হয়েছে ৷
কিন্তু সব রচনাতেই বিদ্যাপতি অনুসরণ করেছেন তাঁর পূর্বপুরুষদের ৷ যদিও তাঁরা সকলেই প্রকৃত বিদ্বান ও সফল লেখক, মূলত তাঁরা কিন্তু রাজপুরুষ এবং তাঁদের প্রচেষ্টা ছিল সমাজের বিভিন্ন শাখার মেলবন্ধন যাতে মিথিলা একটি একক দেশ হিসেবে মুসলমান বহিঃশত্রুর আক্রমন প্রতিহত করতে পারে ৷ তাঁরা নতুন সমাজের ভিত্তি এতই সুদৃঢ় করেন যে উত্তরপূর্ব ভারতের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে মিথিলা এবং বহু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও দোলায়মান অবস্থাতেই মিথিলার কৃষ্টিগত অগ্রগতি অব্যাহত ছিল ৷ এই রাজপুরুষদের বিশ্বস্ততা ছিল প্রশ্নাতীত, যতটা না তিরহুতের রাজাদের প্রতি, তার থেকেও অনেক বেশী মিথিলা ও মিথিলাবাসীর প্রতি ৷ পুরুষপরম্পরায় এই মহান নেতারা পরিকল্পিতভাবে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে গেছেন এবং বিদ্যাপতি এই গোষ্ঠীর সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম বিরল প্রতিভা, মিথিলাভূমি যাঁকে নবজাগরণের পুণ্যলগ্নে সন্তান হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল ৷
বিদ্যাপতি ব্যক্তিগত চরিত্র গঠনে ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশসাধনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন কারণ সমাজ যদি প্রকৃত মানুষ তৈরী করতে পারে, তবে প্রকৃত মানুষ তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত সমাজও তৈরী করে নেয় ৷ এটি প্রত্যেক মানুষের কাছে সহজসাধ্য লক্ষ্য, সমাজে তার স্থান যাই হোক না কেন ৷ ‘পুরুষপরীক্ষা’র চতুর্থ অধ্যায়ের ভূমিকায় বিদ্যাপতি লিখেছেন ”সেইপথই অনুসরণ কর যা তোমার জাতি পুরুষপরম্পরায় অনুসরণ করেছেন, যে পথে বিধাতার বিধানে তোমার জন্ম ৷” সুতরাং যদি প্রকৃত মানুষেরা সমাজ সৃষ্টি করে এবং সমাজের প্রতিটি মানুষের মধ্যে জাতি, জন্ম, ধর্ম, লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে মৈত্রীবন্ধন হয় সুদৃঢ়, তাহলে সমাজ সৃষ্টি করবে এমন এক দেশ যা প্রত্যেকটি মানুষের কাছে তার নিজস্ব আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়েই জীবনের পরিপূর্ণতার স্বাদ এনে দেবে ৷ আর কি সে মহামন্ত্র যা একটি দেশের মানুষকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রাখতে পারে ? তা হল ভাষার বন্ধন ৷ তাই বিদ্যাপতি জনপ্রিয় গীতগুলি রচনা করেছিলেন মিথিলার প্রচলিত ভাষায় এবং ভাবমাধুর্যে ও মোহময়তায় এই ভাষাকে করে তুলেছিলেন দেবভাষা সংস্কৃতের সমকক্ষ ৷ সংস্কৃত তখনও পর্যন্ত ছিল মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিতসংস্কৃতিবান মানুষের নিজস্ব ভাষা, পণ্ডিত সমাজের ভাষা এবং সত্যকারের কাব্যের রসমাধুরী আস্বাদন করতে তাই বিদ্বৎসমাজই ছিলেন একক অধিকারী ৷ বিদ্যাপতি এই ভাবরসের ডালি পৌঁছে দিয়েছিলেন সকলের কাছে এবং পরবর্তী আলোচনা থেকে এও স্পষ্ট হবে যে বিদ্যাপতির রচনার বিষয়বস্তু ছিল এমনই যে তা সমাজের নিম্নতর পর্যায়ের মানুষ থেকে উচ্চতম ও মহত্তম ব্যক্তি পর্যন্ত সর্ব স্তরের মানুষকে সমান আকর্ষণ করতে পারত ৷ সর্বসাধরণের বোধগম্য একটি ভাষা একক দেশ গঠনের পিছনে অগ্রণী ভূমিকা নেবার চেষ্টা করেছিল এবং মিথিলাতে এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ সমাজগঠনের প্রথম পদক্ষেপ সূচিত হয়েছিল ৷ আজ পর্যন্ত মিথিলাবাসীরা সামাজের একটি বিশেষ ঐক্যবদ্ধ অংশ, যার কারণ তার ভাষা এবং এই ভাষা তার নিজস্বতা এবং সৌকুমার্যে সাহিত্য রসধারায় বিদ্যাপতির কবিহৃদয়কে আপ্লুত, সিক্ত করেছে এবং যাঁরা সেই বাণী শ্রবণ করেছেন, তাঁদের সকলেরই কাছেই এ এক পরম প্রাপ্তি, শুধু মিথিলাতে নয়, দেশে দেশান্তরে ৷
বিদ্যাপতি সত্যই অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন এবং তিনি যে যুগের তাতে তাঁকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ বললেও অত্যুক্তি হয় না ৷ নারীশিক্ষার কট্টর সমর্থক ছিলেন তিনি ৷ সে সময় সংস্কৃতিবান পরিবারে নারীশিক্ষা প্রচলিত ছিল এবং ঐনবরার রাজঅন্তঃপুরিকারা ছিলেন বিদূষী ৷ শিবসিংহের পত্নী লখিমা, চণ্ডেশ্বরজায়া লখিমা এবং বিদ্যাপতির পুত্রবধূ চন্দ্রকলা নামী কবি ছিলেন ৷ নারীশিক্ষার স্বপক্ষে বিদ্যাপতি যথেষ্ট ওকালতি করেন এবং ‘পুরুষপরীক্ষা’ রচনার নেপথ্যে আছে তাঁর সদিচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা যে এমন একটি পাঠ্যপুস্তক প্রয়োজন যা ”নগরের নারীদের, যারা প্রেমের দেবতার আনন্দক্রীড়ার সমর্থক, তাদের যথোচিত আনন্দদান করবে ৷” বিদ্যাপতির প্রেমকাব্যের অপর উদ্দেশ্য ছিল নারীদের যৌনশিক্ষা দান ৷ একটি গীতে বিদ্যাপতি বলেছেন যে তিনি ‘নাগরী’র গুণ বর্ণনা করতে চান এবং গ্রীয়ারসনের অনুবাদে নাগরী শব্দের অর্থ ‘নগরের রমণী’ হলেও সংস্কৃত কাব্যে এবং বিদ্যাপতির গীতে নাগরী শব্দের অর্থ কামকলানিপুণা রমণী ৷
শিক্ষার বিষয়ে বিদ্যাপতির ধারণা ছিল খুবই স্বচ্ছ ৷ ষোড়শতম কাহিনীর অর্থাৎ শস্ত্রকলানিপুণের কাহিনীর প্রাথমিক স্তবকে বিদ্যাপতি বলেছেন, ‘স্বভাবতই পুঁথিগত বিদ্যা শস্ত্রকলার তুলনায় হীনতর কারণ শস্ত্রবিদ্যা দ্বারা রাজ্য সুরক্ষিত হলে পরে তবেই পুঁথিগত বা শাস্ত্রগত বিদ্যার বিচার সম্ভব ৷” সুতরাং পরিষ্কার ভাষায় বিদ্যাপতি শস্ত্রবিদ্যাকে আবশ্যকীয় করার কথা চিন্তা করেছেন ৷ আমরাও অনুভব করতে পারি এ অনুভূতির যাথার্থ্য কারণ তখন ক্রমাগত মুসলমান বহিঃশত্রুর আক্রমণে আমাদের দেশ হয়েছে বিধ্বস্ত এবং মিথিলা হাজার বছরের ওপর দুর্বল সুরক্ষানীতির শিকার হয়েছে ৷
ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে বিদ্যাপতিকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে অনুদার সাম্প্রদায়িক নীতিবাদী হিসেবে ৷ কেউ তাঁকে বলেছে বিষ্ণুর উপাসক, কেউ বলেছে শৈব কিন্তু বিদ্যাপতি একটি অতি সাধারণ ধর্মমত পোষণ করতেন যে, ”একজনই আছেন যিনি সর্বশক্তিমান এবং ত্রিভূবনে এমন কিছুই নেই যা তিনি সৃষ্টি করেননি” এবং ”শুধুমাত্র নামেই তাঁদের স্বতন্ত্র মহিমা ৷” তাঁর গানেও বিদ্যাপতি হর ও হরির” মধ্যে বিভেদ রাখেননি ৷ শিবের উপাসনা বিষয়ক রচনা ‘শৈবসর্বস্বসার’এর ভূমিকাতে বিদ্যাপতি তাঁর নিজস্ব মত সমর্থনে শাস্ত্রের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে হর ও হরি অভিন্ন এবং একের উপাসনা অন্যের উপাসনাই সূচিত করে মাত্র ৷ প্রত্যেক মানুষ বিভিন্নরূপে পরমাত্মার উপাসনার অধিকারী এবং বিদ্যাপতি নিজে ছিলেন শৈব কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি হরির প্রতি অভক্তি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন বা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন ৷
যদিও বিদ্যাপতি শিবভক্তির ওপর বিপুলসংখ্যক গীত রচনা করেন, তবুও একথা স্বীকার না করলে ভুল হবে যে তিনি বিষ্ণু, দেবী, গঙ্গা ও অন্যান্য বহু হিন্দু দেবদেবীর ওপরও পদ রচনা করেছিলেন ৷ বিদ্যাপতি মনের দিক থেকে শৈব হলেও ধর্মগত ঐতিহ্যে অন্য যে কোনো স্মার্ত্য মৈথিলের মতো পঞ্চদেবোপাসক ছিলেন ৷ বিদ্যাপতির শিববিষয়ক অসংখ্য পদ রচনার মূল কারণটি হল এই যে হিন্দু শাস্ত্রে শিবই হল পরমাত্মার সেই রূপ যাঁকে নারীপুরুষ নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল সবাই ভজনা করতে পারে ৷ সুতরাং শিবভক্তির পদই একমাত্র ভক্তিগীত যা সাধারণ নারীপুরুষকে জাতিধর্মনির্বিশেষে আবেদন জানাতে পারে এবং বিদ্যাপতি নিজে সর্বসাধারণের কবিই হতে চেয়েছিলেন ৷
এই সময়েই বিদ্যাপতি অধিকাংশ গীত রচনা করেন এবং এখনও তাঁর খ্যাতি মূলত এই গীত রচনাতে– সুতরাং এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা পরে হবে ৷ এই সময়ে তিনি আরও যে চারটি মৌলিক সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন, তার মধ্যে প্রথম হল ‘কীর্তিপতাকা’, পুরাতন মৈথিলী বা অবহট্ট ভাষায় রচিত স্তুতিগাথা, যাতে কোনো অনামী মুসলমানের বিরুদ্ধে শিবসিংহের যুদ্ধজয়ের কথা বর্ণনা করা হয়েছে ৷ এই রচনাটির একটি মাত্র ভূর্জপত্র পাণ্ডুলিপি নেপালের কাঠমাণ্ডুতে বীর পুস্তকাগারে আছে, যার আবিষ্কর্তা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ৷ এটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ , অসমাপ্ত, দুর্বোধ্য ও ভ্রান্তিপূর্ণ ৷ পরলোকগত মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রী এটিকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করওে বিফল হন ৷ এলাহাবাদের ডাঃ জয়কান্ত মিশ্র সম্প্রতি এই পাণ্ডুলিপির একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন, যদিও তা তেমন কাজের নয় ৷ ভূর্জপত্রের ক্রমিক সংখ্যা হারিয়ে গেছে, তবে শেষ পৃষ্ঠাটি অক্ষত আছে, যা থেকে বোঝা যায় এটি শিবসিংহের যুদ্ধজয়ের ওপর বিদ্যাপতির রচনা কিন্তু পাণ্ডুলিপির ভিতর মঙ্গলাচরণের সঙ্গে দুটি প্রস্তাবনা আছে ৷ একটি থেকে মনে হয় এটি পরবর্তী ঐনবরা আমলের প্রসিদ্ধ কবি ভীষ্ম বিরচিত আর অন্যটি দেখে মনে হয় — এটি অর্জুনের মনোরঞ্জনের জন্য অভিনব জয়দেব (বিদ্যাপতির অপর নাম) রচিত প্রেমকাব্য ৷ এটি ‘কীর্তিপতাকা’ নয় কারণ কীর্তিপতাকা বীরগাথা, প্রেমকাব্য নয় ৷ সুতরাং মনে হয় এই ভূর্জপত্র সংকলনে প্রাচীন মৈথিলীর তিনটি বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি মিশ্রিত আছে, যা পৃষ্ঠার ক্রমিকসংখ্যার অনুপস্থিতির জন্য পৃথক করা অসম্ভব ৷ একটি ভীষ্মরচিত কাব্য, অন্যটি অর্জুন রায়ের মনোরঞ্জনার্থে বিদ্যাপতি বিরচিত প্রেমকাব্য এবং তৃতীয়টি ‘কীর্তিপতাকা’, যার প্রথম পাতাটি নেই কিন্তু শেষ পাতাটি পরিষ্কারভাবে পাঠযোগ্য ৷ এতে বহু লোক বিভ্রান্ত হয়েছেন যে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপিটি আসলে একটি মাত্র কাব্যের, ‘কীর্তিপতাকা’র ৷ ভীষ্ম বিরচিত কোনো পাণ্ডুলিপির সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, অর্জুন রায়ের জন্য বিদ্যাপতির রচনাও আর কোথাও পাওয়া যায় না ৷
দ্বিতীয় রচনাটি হল ‘পুরুষ পরীক্ষা’ যা ‘গোরক্ষবিজয়ের’ সমসাময়িক এবং তখন শিবসিংহ সিংহাসনে আসীন ৷ মানুষ হিসেবে বিদ্যাপতির মূল্যায়নের জন্য এই রচনার মূল্য ও ভূমিকা অনস্বীকার্য; তাছাড়াও এটি তৎকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি ৷ এটির পরিকল্পনা করা হয় অনেক আগে, যখন বিদ্যাপতি প্রথম সাহিত্য রচনা করতে মনস্থ করেন এবং এটি সমাপ্ত হয় যখন তাঁর বিচারবুদ্ধি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং লেখক হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ৷ এই রচনার ভূমিকায়, যা ‘ভূপরিক্রমায়’ নেই, বিদ্যাপতি বলেছেন তিনি এই রচনাটির পরিকল্পনা করেছিলেন নীতিকথার মধ্যে দিয়ে ”যাতে অপরিণতমনস্ক অপ্রাপ্তবয়স্করা নীতি উপদেশ লাভ করতে পারে এবং প্রেমপূজারিনী নারীদের যথার্থ মনোরঞ্জন হয়” এবং আরও বলেন ”যে সব জ্ঞানী ব্যক্তির বিদগ্ধতা শাস্ত্রনৈপুণ্যে উজ্জ্বল, তাঁরা এই নীতিশিক্ষা সম্বলিত সুভাষিত কাহিনীগুলিতে মনঃসংযোগ করে আমার রচনাকে সমাদর করবেন কি ? ” এই কাহিনীগুলি পঞ্চতন্ত্র বা হিতোপদেশের মতোই, শুধু পার্থক্যটুকু এই যে পঞ্চতন্ত্র বা হিতোপদেশের কাহিনীগুলি উপকথা বা লোককাহিনী আর বিদ্যাপতির রচনায় কাহিনীগুলি সত্য ঘটনানুসারী বা জনশ্রুতি ৷ ‘পুরুষ-পরীক্ষা’য় মোট চুয়াল্লিশটি কাহিনী আছে, যা চার অধ্যায়ে বিভক্ত এবং প্রথম অধ্যায়ের আটটি কাহিনী অবিকৃত অবস্থায় গৃহীত হয়েছে তাঁর প্রথম জীবনের রচনা ‘ভূ পরিক্রমা’ থেকে ৷ কিছু কিছু কাহিনী ঐতিহাসিক এবং অলৌকিক কাহিনীগুলি জনসাধারণের দীর্ঘ দিনের বিশ্বাসের ফলে জাত ৷ এই বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন শ্রীরামপুরের জনৈক এইচ. পি. রায় ১৮১৫ সালে; আর একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে লন্ডন থেকে ১৮২৬ সালে যার রচয়িতা স্যার জি. হাটন ৷ এটি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের প্রবেশিকা পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল ৷
‘পুরুষ পরীক্ষা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সহজবোধ্যতা ও ভাষামাধুর্যের জন্য ৷ ‘ভূপরিক্রমা’ ও ‘পুরুষপরীক্ষা’র মধ্যে সময়ের ব্যবধান কমপক্ষে কুড়ি বছর কিন্তু ‘পুরুষপরীক্ষা’র প্রথম অংশটি যে বিদ্যাপতির প্রথম যৌবনের রচনা ‘ভূপরিক্রমা’র অবিকল প্রতিলিপি এবং শেষাংশ তাঁর পরিণত বয়সের রচনা তা বোঝাই যায় না ৷ এর থেকে বোঝা যায় সংস্কৃত ভাষায় বিদ্যাপতির ব্যুৎপত্তি আজন্ম ৷ এই রচনা বহুক্ষেত্রে পাণিণির ব্যাকরণ বিধি অনুসরণ করেনি, বহু জায়গায় মৈথিলী ভাষা প্রাধান্য পেয়েছে ৷ অবশ্য তাতে ভাবপ্রকাশের হানি হয়নি, ভাষার সরলতা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৷ এর থেকে মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে বিদ্যাপতি সাধারণ সহজবোধ্য সংস্কৃত ভাষা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যা হবে সরল ও সরস, দীপ্ত অথচ মাধুর্যময় — যে ভাষাটি জনপ্রিয় হলে নতুন ধরনের সংস্কৃত ভাষার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে, যে ভাষাটিকে গ্রহণ করবে সেই সব নারী ও পুরুষ যারা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পেরেছে এর মাধুর্য ৷ বিদ্যাপতির উদাহরণটি অনুসৃত হলে মিথিলার সমাজে প্রচলিত হত এক নতুন আঙ্গিকের সংস্কৃত ভাষা ৷ বিদ্যাপতি অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতোই এই বিষয়টি নিয়েও যথেষ্ট প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা করেছিলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সংস্কৃতির ভাঙন শুরু হয় এবং মিথিলার কৃষ্টিগত ঐতিহ্য চলে যায় গোঁড়া পণ্ডিতদের হাতে, বিদ্যাপতি উপহাসের পাত্র হন, তাঁর আধুনিকীকরণের চেষ্টাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়, তাঁর সৃজনশীল সাহিত্যকে অবহেলা করা হয় তবে মৈথিলী গীতসম্ভারকে অশ্রদ্ধা করা সম্ভব হয়নি কারণ ছয় শতক ধরে মিথিলার লক্ষ লক্ষ রমণীর কণ্ঠে এই গীত ধ্বনিত হয়েছে ৷
‘গোরক্ষবিজয়’ নাটকের রচনাকালও রাজা শিবসিংহের আমলে ৷ এটি একটি ছোট নাটক, সহজেই অভিনয় করা যায় ৷ এই সময় সংস্কৃত ভাষায় বহু ছোট ছোট নাটক রচনা করা হয়েছিল, যেগুলির মধ্যে শংকর মিশ্র রচিত কৌতুক প্রহসন ‘গৌরী-দিগম্বর’ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ৷ কিন্তু বিদ্যাপতি সেখানেও নতুন ধারার প্রবর্তন করেন এবং যদি বিদ্যাপতির মানসিকতাকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করা হত, তাহলে মৈথিলী গীতের মতো নব্য ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে মৈথিলী ভাষাও প্রথম নাট্য ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠা করতে পারত ৷ বিদ্যাপতি সংস্কৃত ও প্রাকৃত গদ্য ও কাব্য সম্বলিত নাটকে সংযোজিত করেছিলেন মৈথিলী গীত ৷ পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারত সম্পূর্ণ মৈথিলী ভাষায় রচিত নাটক যা পরবর্তীকালে আসামে শংকরদেব ও তাঁর শিষ্য মাধবদেবের রচনায় অথবা নেপালের মল্লরাজাদের রাজসভার বিভিন্ন কবিদের রচনায় দেখা যায় ৷ বিদ্যাপতি অবশ্য এ বিষয়ে খুব বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেন নি কারণ এই সময়েই শিবসিংহ নিরুদ্দিষ্ট হন এবং বিদ্যাপতির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে, তাঁর প্রধান উৎসাহের উৎসধারা শুষ্ক হয়ে যায় এবং বিদ্যাপতির প্রতিভার সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে থাকে ৷ তাঁর উত্তরসূরীরা অবশ্য তাঁকে অনুসরণ করে ঐতিহ্য বজায় রাখেন এবং শুরু হয় বিদ্যাপতির অনুকরণ ৷ পরবর্তী কয়েক শতকে বেশ কিছু সংখ্যক এই ধরনের নাটক রচিত হয়েছে ৷ তবে সবগুলিতেই গীত রচনা করা হয়েছে মৈথিলীতে ৷ সম্পূর্ণ মৈথিলী নাটক মিথিলায় রচিত হয়েছে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ৷
এই সময়কার সর্বশেষ ও সর্বাধিক বিতর্কিত রচনা ‘কীর্তিলতা’ ৷ এটি প্রাচীন মৈথিলী বা অবহট্ট ভাষায় রচিত গদ্য ও কাব্যের সমন্বয় এবং এতে ঐনবরা রাজত্বের প্রথম দিকের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে ৷ কি করে কীর্তিসিংহ জৌনপুরের নবাব ইব্রাহিম শাহের সহায়তায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন তা বর্ণিত হয়েছে এই রচনায় ৷ কিন্তু ‘কীর্তিলতা’র বর্ণনার সঙ্গে অন্য সূত্রে পাওয়া একই ঘটনার অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায় ৷ গণেশ্বরের হত্যা সংঘটিত হয়েছে ২৫২ লক্ষ্মণ সম্বতে যা কীলহর্ণ-এর গণনা অনুযায়ী ১৩৭১ খ্রিষ্টাব্দে কিন্তু বিদ্যাপতির রচনা অনুযায়ী (তিনি বলেছেন শিবসিংহের সিংহাসনে আরোহণকাল ২৯৩ লক্ষ্মণ সম্বতে বা ১৩২৪ শকাব্দে) এটি ঘটেছে ১৩৬১ খ্রিষ্টাব্দে ৷ কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া হয় যে গুপ্তঘাতকের হাতে গণেশ্বর নিহত হন ১৩৭১ খ্রিষ্টাব্দে, তা হলেও ইব্রাহিম শাহের জৌনপুরের নবাব হওয়ার মধ্যে ৩০ বছরের ফারাক থেকে যাচ্ছে ৷ এই কালটি ‘কীর্তিলতা’ অনুযায়ী চরম অরাজকতার কাল কিন্তু আমরা জানি এই সময় মিথিলাধিপতি ছিলেন শিবসিংহ এবং তাঁর দৃপ্ত শাসনে মিথিলায় শান্তি ও সমৃদ্ধি পূর্ণমাত্রায় বজায় ছিল ৷
‘কীর্তিলতা’ কীর্তিসিংহের বীরত্বের কাহিনী ৷ কীর্তিসিংহ সহনশীল, পরিশ্রমী, তেজস্বী ও দৃঢ়সঙ্কল্প ৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই রচনায় ইব্রাহিম শাহের উদ্দেশে গগনচুম্বী প্রশংসা করা হয়েছে — তিনি সবচেয়ে শক্তিমান নবাব এবং সেই আমলের সর্বাপেক্ষা সাহসী ও যুদ্ধজয়ী বীর ৷ কাব্য হিসেবে ‘কীর্তিলতা’য় বিদ্যাপতির স্বকীয়তার সুর খুঁজে পাওয়া যায় না এবং সেই কারণেই অনুমান করা হয় হয়তো এটি বিদ্যাপতির প্রথম জীবনের রচনা; কিন্তু ইব্রাহিম শাহ্‌ জৌনপুরের নবাব হন ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে এবং ইতিহাস অনুযায়ী বিদ্যাপতির বয়স তখন পঞ্চাশ ৷ সুতরাং তথ্য দুটি পরস্পরবিরোধী ৷ ভাষাগত দিক থেকে ‘কীর্তিলতা’ বহু জায়গায় দুষ্পাঠ্য ৷ আংশিক কারণ হল এই যে একটি মাত্র পাণ্ডুলিপি যেটি থেকে বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে সেটি ভ্রান্তিপূর্ণ ও স্থানে স্থানে দুষ্পাঠ্য ৷ আর এ ছাড়াও যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে সেটি প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মিশ্রণ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৈথিলী শব্দ ও শব্দসমষ্টি, কখনও বা বাক্যও এবং জায়গায় জায়গায় ফরাসী ও আরবী শব্দ এসেছে বিশেষত যেখানে মুসলমান রাজদরবার ও সেনাবাহিনীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে ৷ এই রচনাটির পাঁচটি বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিদগ্ধ ব্যক্তিরা এটি পাঠ করে ব্যক্তিগত মতামতও দিয়েছেন ৷ এ বিষয়ে বিশদ বিতর্কের অবতারণা করা সম্ভব নয় ৷ আমার নিজস্ব মতামত এ বিষয়ে আমি যে সংকলনটি সম্পাদনা করেছি তাতে জানিয়েছি এবং সংক্ষেপে এখানে তা লিখছি ৷
এ কথা ঐতিহাসিক সত্য যে শিবসিংহ যখন তিরহুতের রাজা, ইব্রাহিম শাহ তখন সিংহাসনে বসেছেন ৷ এ কথাও সত্য যে শিবসিংহ সিংহাসন লাভের চার বছর সঠিক ভাবে বলতে গেলে তিন বছর ন’মাস পর ১৪০৫-০৬ এর শীতকালে যুদ্ধে পরাস্ত হন ৷ তবে ইতিহাস বা জনশ্রুতি কোনো উৎস থেকেই জানা যায় না যে শিবসিংহের এই পরাজয়ের জন্য কে দায়ী বা কেন এবং কার বিরুদ্ধাচরণ করে ইব্রাহিম শাহ্‌ মিথিলা আক্রমণ করেন, তবে ইব্রাহিম শাহের আক্রমণ এবং শিবসিংহের পতন প্রায় একই সময়ে ঘটেছিল এবং যেহেতু শিবসিংহ তখন তিরহুতের রাজা এবং উত্তরাধিকারসূত্রে কীর্তিসিংহও সিংহাসনের দাবীদার , এই ঘটনা ঘটা সম্ভব যে কীর্তিসিংহকে সাহায্য করবার অভিপ্রায়ে ইব্রাহিম শাহ্‌ যুদ্ধযাত্রা করেন ও শিবসিংহ পরাস্ত হন ৷ এ ঘটনা যদি সত্যই ঘটে থাকে তাহলে মিথিলা নিশ্চয়ই জৌনপুরের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল এবং বিজয়ী সেনাদলের আক্রমণের ফলে লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়েছিল কিন্তু মিথিলা জৌনপুরের অধীনস্থ হয়নি এবং এও প্রমাণ আছে যে শিবসিংহের পর সিংহাসনে বসেন তাঁর ভাই পদ্মসিংহ ৷ ইব্রাহিম শাহ্‌ ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের যথার্থ অনুরাগী এবং বিদ্যাপতির শিবভক্তিমূলক পদ ‘নাচারি’ জৌনপুরে ইব্রাহিম শাহের দরবারে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল ৷ এর থেকে আমি অনুমান করি যে শিবসিংহের অন্তর্ধান বিষয়ে মূলত ‘কীর্তিলতা’ রচিত হয়েছিল এবং শিবসিংহের পরাজয়ের পর এটি দেখিয়ে বিদ্যাপতি নবাবকে সন্তুষ্ট করেন এবং মিথিলাকে বহিঃশত্রুর লুণ্ঠন ও অবাঞ্ছিত বশ্যতাস্বীকারের গ্লানি থেকে মুক্ত করেন ৷
বিদ্যাপতির পক্ষে একজন মুসলমান সুলতানের প্রশস্তি করা, বিশেষত যিনি বিদ্যাপতির পৃষ্ঠপোষক বন্ধুর পতন ও জীবনের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য দায়ী, খুবই দুঃখজনক হয়েছিল ৷ কিন্তু বিদ্যাপতি ছিলেন যথার্থ দেশপ্রেমিক রাজনীতিক যাঁর কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিল জন্মভূমি ও স্বদেশবাসীর স্বার্থ এবং সেজন্য তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হননি ৷ সেই কারণেই মিথিলাকে রক্ষা করতে তিনি নিজের সৃজনী-প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছিলেন যেভাবে রাজা শিবসিংহকে তিনি একদা রক্ষা করেন, যখন রাজাকে রাজস্ব অনাদায়ের অভিযোগে বন্দী করা হয়েছিল ৷ এইভাবে বিচার করলে ‘কীর্তিলতা’ বিষয়ে যাবতীয় সন্দেহের উপশম ঘটে ৷ কেন কাব্যটি এত প্রশস্তি ও কাল্পনিক বর্ণনায় অতিরঞ্জিত, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ৷ শিবসিংহের অনুল্লেখ এবং কীর্তিসিংহের অনামী পিতৃহন্তাকে আক্রমনই যে ইব্রাহিম শাহের লক্ষ্য ছিল, এই বিষয়টিরও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মেলে ৷ এই সঙ্গে বহু সংখ্যক ফারসী ও আরবী শব্দের উপস্থিতি এবং বিদ্যাপতির স্বকীয়তার অনুপস্থিতির কারণও খুঁজে পাওয়া যায় কারণ পৃষ্ঠপোষক-সুহৃদের পরাজয় ও নিরুদ্দেশ যাত্রা বিদ্যাপতিকে বেদনায় উদ্বেল করে তুলেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছ থেকে স্বাভাবিক উচ্চমানের রচনা আশা করা অযৌক্তিক ৷ এই অনুমান অনুযায়ী ‘কীর্তিলতা’র রচনাকাল ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মকালের প্রথমাংশে ৷ এটি মূলত ঐতিহাসিক কল্পকথা যাতে কেবলমাত্র সারাংশটি ঐতিহাসিক আর অবশিষ্ট সবই বিজয়ী মুসলমান নবাবের গুণকীর্তন ৷

১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে শিবসিংহের পরাজয় ও নিরুদ্দেশ হবার ঘটনা বিদ্যাপতির জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনে ৷ জীবনের আলো ও উৎসাহের উৎস তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন ৷ রাজার নিরুদ্দেশের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাপতির স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ৷ বিদ্যাপতির মনোকষ্টের অন্ত ছিল না কারণ রাজার সম্বন্ধে কোনো সংবাদ এমনকি তিনি জীবিত না মৃত তাও জানতে পারা যায়নি ৷ রাজা বিদ্যাপতির প্রতি এতটাই আস্থাশীল ছিলেন, বিদ্যাপতির চরিত্রের প্রতি এতই তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিদ্যাপতির সততা ও দূরদর্শিতার ওপর এতই ভরসা ছিল যে শেষ যুদ্ধে যাত্রা করার আগে তিনি তাঁর ছয় পত্নীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বিদ্যাপতির ওপর দিয়ে যান এবং যেহেতু রাজার মৃতদেহের কোনো সন্ধান শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, সেই কারণে রাজার শ্রাদ্ধ ও বৈধব্য গ্রহণের আগে রাণীদের ১২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল, শাস্ত্রমতে তাই রীতি ৷ বহিঃশত্রুর আক্রমন ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে বিদ্যাপতি রাজমহিষীদের শিবসিংহের এক বিশেষ বন্ধু ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তির নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠান ৷ এই বন্ধুটি হলেন–বর্তমানে নেপালের তরাই অঞ্চলের অন্তর্গত ও সেইসময় রাজবনৌলি নামে পরিচিত সপ্তরির দ্রোণবরা রাজা পুরাদিত্য ৷ বিদ্যাপতি নিজেও মিথিলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান পুরাদিত্যর আশ্রয়ে, সেখানে রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং সকলে মিলে দীর্ঘ বারো বছর রাজার অপেক্ষায় থাকেন ৷
রাজবনৌলিতে স্বেচ্ছানির্বাসনের এই সময়টুকু বিদ্যাপতির জীবনে তমসাচ্ছন্ন ৷ তাঁর সামনে তখন শুধুই ব্যর্থতা ও স্বপ্নভঙ্গ ৷ সৃজনশীল প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেছে, কবিত্বশক্তি নিশ্চিহ্ন প্রায় ৷ এই সময় তিনি সপ্তরির রাজার জন্য পত্র, দস্তাবেজ ইত্যাদির লিখনবিধি নিয়ে সংস্কৃতে একটি পুস্তিকা লেখেন এবং এই নির্বাসনকালে এটিই বিদ্যাপতির একমাত্র রচনা ৷ পত্রের ওপর লেখা যাবতীয় তারিখই ২৯৯ লক্ষ্ণণ সম্বতের, যা থেকে বোঝা যায় সম্পূর্ণ রচনাটি এই সময়ে রচিত সংকলিত হয়েছিল ৷ এই রচনাটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় এবং পত্রাবলী ও অন্যান্য দলিল থেকে তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা যায় ৷
রাজবনৌলিতে বিদ্যাপতির জীবন ছিল নিষ্ক্রিয়, এই সময়ে তিনি বিশদভাবে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি পাঠ করেন ৷ তখন তাঁর মনে সম্ববত অনুশোচনা জেগেছিল এই কারণে যে শিবসিংহ ও তাঁর শক্তিকে তিনি ভগবান কৃষ্ণ ও কৃষ্ণের শক্তির সঙ্গে তুলনা করে পাপ করেছেন এবং সেই পাপেই রাজা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন ৷ প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ বিদ্যাপতি শ্রীমদ্ভাগবতের অনুলিপি করতে আরম্ভ করেন ৷ শ্রীমদ্ভাগবত হল কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদের ধর্মগ্রন্থ ৷ এই অনুলিপি বিদ্যাপতি ৩০৯ লক্ষ্মণ সম্বতের শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চদশতম দিনে সমাপ্ত করেন ৷ দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ততদিনে রাজবনৌলিতে ১২ বছরের প্রতীক্ষাও সমাপ্ত হওয়ার পথে ৷ এই অনুলিপিটি ৫৭৬টি ভূর্জপত্রে লেখা, প্রতিটি ভূর্জপত্র ২৭ ইঞ্চি লম্বা, ৫ ইঞ্চি চওড়া, প্রতি পৃষ্ঠায় পাঁচটি পংক্তি ও প্রতি পংক্তিতে ১১২টি চমৎকার বর্ণমালা, পরিষ্কার হরফে লেখা, অতি সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে অনুলিপিতে, যা আবার সংশোধন করা হয়েছে ৷ এ থেকে বোঝা যায় কতখানি সাবধানতা ও মনঃসংযোগ এই অনুলিপির কাজটি করার সময় বিদ্যাপতি অবলম্বন করেছিলেন ৷ সম্পূর্ণ অনুলিপিটি দ্বারভাঙার সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সুরক্ষিত আছে এবং এটি অবশ্যই দর্শনীয় বস্তু ৷ এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত কবির হস্তলিপির এটিই একমাত্র নিদর্শন ৷
১২ বছরের বেদনাদায়ক অপেক্ষার পর রাজা শিবসিংহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয় ৷ অন্যান্য মহিষীদের সম্বন্ধে কিছু জানতে না পারা গেলেও রাণী লখিমা, রাজার কুশপুত্তলিকা দাহ করার জন্য যে চিতা জ্বালানো হয়, তাতে প্রাণ বিসর্জন দেন ৷ বিদ্যাপতির ওপর রাণীদের রক্ষণাবেক্ষণের যে গুরুদায়িত্ব অর্পন করেছিলেন রাজা শিবসিংহ, তার সমাপ্তি ঘটে ৷ বিদ্যাপতি ফিরে যান স্বদেশে, সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে, ব্যথাতুর বৃদ্ধ, তখন বয়স তাঁর সত্তর বছর ৷ সেই সময় মিথিলার শাসনভার শিবসিংহের অনুজ পদ্মসিংহের পত্নী বিশ্বাস দেবীর হাতে ৷ বিদ্বান ব্যক্তিরা বলেন শিবসিংহের পর রানী লখিমা দেবী ১২ বছর রাজ্যশাসন করেন, তার পরের ১৩ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন পদ্মসিংহ ও বিশ্বাস দেবী ৷ এটি ভ্রান্ত তথ্য ৷ যেহেতু নিরুদ্দিষ্ট শিবসিংহকে ১২ বছর মৃত হিসেবে ঘোষণা করা যায়নি, সুতরাং পরবর্তী উত্তরাধিকারীর প্রশ্নই ওঠে না ৷ শিবসিংহ ও পদ্মসিংহ দুজনেই ছিলেন সন্তানহীন ৷ আইনত শিবসিংহের পত্নী লখিমা রাজার অবর্তমানে রাজ্য শাসনের অধিকারিণী হলেও রাজবনৌলি ছেড়ে তিনি মিথিলায় আসেননি ৷ দেবর পদ্মসিংহের হাতে রাজ্যশাসনের ক্ষমতা দিয়েছিলেন ৷ অল্প কিছুদিন পরেই পদ্মসিংহ পরলোকগমন করেন ও তাঁর বিধবা পত্নী বিশ্বাসদেবী মিথিলার শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন ৷ কিন্তু অনির্দ্দিষ্টকাল কোনো মহিলার অধিকার নেই রাজ্যশাসন করবার; তাই রাজা শিবসিংহের পারলৌকিক ক্রিয়ার পর সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে এবং পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে ভবসিংহের কনিষ্ঠ পুত্র হরসিংহকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তবে তিনি তখন জীবিত না মৃত তা জানা ছিল না; ফলে জীবিত উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর পুত্র নরসিংহ সিংহাসন লাভ করেন ৷ যাই হোক, প্রতীক্ষার ১২ বছর আলাদা আলাদা ভাবে লখিমা এবং পদ্মসিংহ ও বিশ্বাসদেবীর শাসনকাল হিসেবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক চিহ্নিত করেছেন ৷ উল্লেখযোগ্য আর একটি ঘটনা হল দেবসিংহ থেকে শুরু করে ঐনবরা রাজবংশের প্রত্যেক রাজা সিংহাসনে আরোহণের পর একটি করে উপাধি ধারণ করেছেন ৷ দেবসিংহ ছিলেন গরুড়নারায়ণ, শিবসিংহ রূপনারায়ণ, নরসিংহ দর্পনারায়ণ প্রভৃতি ৷ এই ধরনের কোনো উপাধি পদ্মসিংহের ছিল না যা থেকে বোঝা যায় তিনি শুধুমাত্র রাজার প্রতিনিধি ছিলেন, রাজচক্রবর্তী ছিলেন না ৷ হরসিংহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, সেই করণেই সন্দেহ জাগে যে শিবসিংহের পারলৌকিক কাজের পর যখন উত্তরাধিকারী মনোনয়নের প্রশ্ন ওঠে তখন হরসিংহ জীবিত ছিলেন কি না ৷
বিদ্যাপতি ছিলেন কর্মপটু এবং কর্তব্যে অবহেলা করেননি কখনও ৷ স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিরহুতের রাজদরবারে কুড়ি বছরের বেশী সময় তিনি তিনজন রাজার সভা অলঙ্কৃত করেন ৷ এই রাজারা হলেন হরসিংহ, তাঁর পুত্র নরসিংহ ও নরসিংহের পুত্র ধীরসিংহ ৷ রাজপরিবারের চারজন সদস্যের জন্য তিনি সাতটি রচনা সংকলিত করেন, দুটি বিশ্বাস দেবীর জন্য, একটি নরসিংহের জন্য, একটি নরসিংহ জায়া ধীরমতি ও শেষটি ধীরসিংহের জন্য ৷ সব কটিই স্মৃতি সংকলন, সংস্কৃত ভাষায় রচিত, কোনোটিই সৃষ্টিমূলক সাহিত্যকৃতি নয় ৷ সুতরাং অনুমান করা যায়, বিদ্যাপতি রাজদরবারে যোগ দিয়েছিলেন বয়োবৃদ্ধ কূটনীতিক রাজপুরুষ হিসেবে, সক্রিয় অমাত্য হিসেবে নয় ৷ বিদ্যাপতি আইন, নীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিষয়ে পরামর্শদাতার ভূমিকায় প্রস্তুত থাকলেও কিন্তু কোনোরকম দায়িত্বপূর্ণ পদ স্বাধীনভাবে নিতে অস্বীকার করেন ৷ বিদগ্ধজনেরা বলেন এইসময় তিনি কিছু ভক্তিগীতি রচনা করেন যা প্রধানত বার্ধক্যের অবসাদ ও মোহমুক্তির পরিচায়ক ৷ এই রচনাগুলিতে এত সুন্দর ও বিশ্বস্ত ভঙ্গিমায় ঈশ্বরভক্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে বলার নয়, তবে তার অর্থ এই নয় যে সব গীতরচনার মধ্যেই কবির ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতার ছায়া ছিল ৷ বিদ্যাপতি অবিবাহজ বা পরকীয়া প্রেমের ওপর শতাধিক গীত রচনা করেছেন ৷ কিন্তু তা পরস্ত্রী সংসর্গজাত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, যা বাংলার সহজিয়া সম্প্রদায় প্রচার করে থাকেন ৷ সংস্কৃতের মতো মৈথিলী সাহিত্যেও কাব্য হৃদয়ের অভিব্যক্তি মাত্র, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ নয় ৷ কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পলোকের সঙ্গে যে মেলবন্ধন অনুভব করেন ও লিপিবদ্ধ করেন, তাই কাব্য ৷
যে দুটি রচনা বিশ্বাসদেবীর নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা শিবের উপাসনামূলক ‘শৈবসর্বস্বসার’ ও পবিত্র গঙ্গা তীর্থের কাহিনী ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ ৷ ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’-তে গঙ্গাতটের বিভিন্ন তীর্থস্থান ও তাদের বিশেষ ধর্মীয় দিকে সম্বন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে ৷
‘শৈবসর্বস্বসার’-এ শৈবধর্মের যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ৷ মিথিলায় সাধারণ লোকের কাছে এটি বিখ্যাত ও পরমাদৃত গ্রন্থ ৷ এটি এখনও গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়নি এবং এর পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ৷ গঙ্গাসম্বলিত বইটিও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিশেষত এই কারণে যে এতে ব্রাহ্মণের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কর্তব্য যেমন আহ্নিক ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা আছে ৷ এই বইটি স্বর্গত ডঃ জে বি. চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘কনট্রিবিউশনস্‌ অব উইমেন টু স্যান্সক্রিট লিটারেচার’ শীর্ষক পুস্তকমালার অন্তর্গত ৷ এই দুটি বইয়ের, সমকালীন অন্যান্য বইয়ের মতোই, বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল প্রতিটি বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে বহুমূল্যবান উদ্ধৃতি দেওয়া আছে ৷ এর থেকে বোঝা যায় কত বিশদভাবে বিদ্যাপতি শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করেছিলেন এবং তাঁর স্মৃতিশক্তি কতখানি প্রখর ছিল যে বক্তব্যের উপযোগী উদ্ধৃতি তিনি ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন কারণ সেইসময় বেশীরভাগ বই, পাণ্ডুলিপি এবং বিশেষ ক্ষেত্রে আবশ্যক হলেও সে সম্বন্ধে বইয়ের পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না ৷
আরও একটি বিশেষ শ্রমসাধ্য রচনা হল ‘দানবাক্যবলী’, এটি বারাণসীতে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং দীর্ঘদিন অপ্রকাশিত অবস্থায় ছিল ৷ রাণী ধীরমতির জন্য এটি সংকলিত ৷ ধীরমতি ছিলেন নরসিংহের দ্বিতীয়া পত্নী, বইটি রাণীকে উৎসর্গ করা হয়েছে ৷ এখানে বিভিন্ন দানের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং সংকল্পবাক্য সম্বন্ধেও বিস্তৃত আলোচনা আছে ৷ প্রতিটি বক্তব্যের সমর্থনে শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি ও উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ৷
বিদ্যাপতি রচিত সর্বশেষ গ্রন্থ ‘দুর্গা-ভক্তি-তরঙ্গিণী’ ৷ এটিও শিব, গঙ্গা, দান ইত্যাদি বিষয়ের মতোই একটি সংকলন গ্রন্থ এবং বিষয়বস্তু হল মিথিলার জনপ্রিয় দুর্গোৎসব ৷ মিথিলাধিপতি ধীরসিংহর ভাই ভৈরবসিংহের আদেশানুযায়ী এই বইটি সংকলিত হয় ৷ এই সময় বিদ্যাপতির বয়স আশিরও বেশী ৷ বিদ্যাপতির আর কোনো রচনার সন্ধান পাওয়া যায়নি যার রচনাকাল ‘দুর্গা-ভক্তি-তরঙ্গিণীর’ পরবর্তী সময় ৷
সব কটি রচনাই বিধি ও বিধান সম্বলিত, সামাজিক ধর্ম সম্বন্ধীয়, কিন্তু এই সময়কার একটি রচনা ‘বিভাগসাগর’ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত ৷ এটি নরসিংহ দর্পনারায়ণের আদেশানুসারে সংকলিত ৷ সময়ের বিচারে এটির রচনাকাল গঙ্গা ও দান সম্পর্কিত সংকলন গ্রন্থ দুটির অন্তর্বতী ৷ বিদ্যাপতির ৮০ বছর বয়সে এই ধরনের গ্রন্থ সংকলনের দায়িত্ব নেওয়ার কি এমন গুরুতর কারণ থাকতে পারে,যেখানে তখন এই বিষয়ে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ সুলভ ছিল ? এই সংকলনটি এখনও মুদ্রিত হয়নি এবং যথোপযুক্ত মনোযোগও আকর্ষণ করেনি ৷ এই পাণ্ডুলিপিটি ভাল করে পাঠ করলে দেখা যায় একটি বিশেষ বিষয় এখানে সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে , আর অন্য সবই সাধারণ বিষয়বস্তু যা যে কোনো এই ধরনের সংকলনেই পাওয়া যায় ৷ বিষয়টি হল রাজ্য অবিভাজ্য ভূখণ্ড এবং জ্যেষ্ঠত্বের ক্রম অনুযায়ী উত্তরাধিকারবলে অধিকৃত হওয়া উচিত ৷ এই ধারণাই করা যায় যে যখন নরসিংহ পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন, তখন তাঁর অন্যান্য বৈমাত্রেয় ভাইরা রাজ্য বিভক্ত করে নিতে চান ও তাঁদের মধ্যে একজন, রণসিংহ, দুর্লভনারায়ণ উপাধিও গ্রহণ করেন ৷ নিজের আত্মজদের থেকেও বিশ্বাসভঙ্গের আশঙ্কা ছিল নরসিংহের এবং কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় নরসিংহের তিন পুত্রই রাজত্ব অধিকার করে ৷ সুতরাং এই ঘটনা ঘটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক যে নরসিংহের পিতামহ ভবসিংহ যেমন বিদ্যাপতির পিতামহ বৃদ্ধ বিবেচক চণ্ডেশ্বর সমর্থন ও আস্থা কামনা করেছিলেন যাতে ভবসিংহ নিয়মিত রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান ছাড়াই সীমিত রাজত্ব অধিকার ও ভোগ করতে পারেন, তেমনই নরসিংহও নিজের সময়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব চণ্ডেশ্বরের উত্তরসূরী ও পৌত্র বিদ্যাপতির সমর্থন লাভ করার চেষ্টা করেন এবং সম্পূর্ণ তথ্যাবলী প্রামাণ্য সংকলনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করতে মনস্থ করেন ৷ তথ্যটি হল রাজত্বের উত্তরাধিকার জ্যেষ্ঠতা ক্রম অনুযায়ী ঘটে, সাধারণ বংশগত উত্তরাধিকার সূত্রে নয় ৷ বিদ্যাপতি সমস্ত তথ্যই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে নানা শাস্ত্র এমন কি চণ্ডেশ্বরের পিতা ও বিদ্যাপতির প্রপিতামহের সহোদর বীরেশ্বর রচিত গ্রন্থ ‘নীতিসার’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ৷ ঐনবরা বংশের এই প্রজন্মে পারিবারিক কলহ হয় ৷ এই বিষয়ে অনুমতি দেবীর শিলালিপিতে (৩৯৪ লক্ষ্মণ সম্বতে বা ১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দে) উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এই রানী ছিলেন ভৈরবসিংহের পুত্রবধূ, রামভদ্রর পত্নী এবং ঐনবরা বংশের শেষ রাজা কংসনারায়ণের মাতা ৷ এই শিলালিপিতে অনুমতি দেবীর এভাবে প্রশস্তি করা হয়েছে যে তিনি নম্রতা ও কূটনীতির সহায়তায় বন্ধুমহলে সৌভ্রাতৃত্ববোধের সৃষ্টি করেছিলেন ৷ অনুমান করা যায় বাংলার মুসলমান নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলা করবার জন্য রানী অনুমতি ঐনবরা রাজবংশের পুরুষদের মধ্যে মতদ্বৈধ দূর করেন, যে পারিবারিক মতবিরোধ নরসিংহের সময় থেকে তিন প্রজন্ম ধরে রাজবংশের একতাকে নষ্ট করে চলেছিল ৷ এইভাবে বিদ্যাপতির এই গ্রন্থটি রাজনৈতিক কারণে রচিত এবং এটি থেকে প্রকাশ পায় যে তিনি নিজের সময়ে বিদ্বৎসমাজের কাছে কতখানি সম্মানের পাত্র ছিলেন ৷
বিদ্যাপতির আরও দুটি গ্রন্থ আছে যা সুপরিচিত হলেও দুষ্প্রাপ্য ৷ এগুলি হল ‘গয়াপত্তলক’ বা গয়ায় করণীয় সংস্কার সম্বন্ধীয় এবং ‘বর্ষকৃত্য’ গ্রন্থটি সারা বছরের বিভিন্ন উৎসব সংক্রান্ত ৷ এই দুটি গ্রন্থের সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি এবং যেটুকু অংশ পাওয়া গেছে, তাতে মুখবন্ধ নেই এমন কি মঙ্গলাচরণও নেই, যেটি প্রত্যেক রচনার ভূমিকায় বিদ্যাপতি ব্যবহার করেছেন ৷ সুতরাং মনে হয় বিচ্ছিন্ন অংশগুলি গ্রন্থাকারে ছিল না, বিদ্যাপতি সময়ে সময়ে কিছু টীকাভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন ৷ সেইকারণেই রচনার সময় সম্পর্কেও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয় ৷
এই প্রসঙ্গে একটি প্রয়োজনীয় কথা জানানো দরকার ৷ বিদ্যাপতির রচনার পাণ্ডুলিপি মিথিলায় অতি দুষ্প্রাপ্য ৷ ‘পুরুষপরীক্ষা’ ছাড়া অন্য কোনো পাণ্ডুলিপিই সুলভ নয় ৷ ‘কীর্তিলতা’, ‘কীর্তিপতাকা’ ও ‘গোরক্ষবিজয়’ এর পাণ্ডুলিপি নেপালে পাওয়া যায়, তাও কেবলমাত্র একটি করে পাণ্ডুলিপি, যা অত্যন্ত জীর্ণ ৷ ‘ভূ পরিক্রমা’র একমাত্র পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ৷ ‘লিখনাবলী’র কোনো পাণ্ডুলিপি এখন পাওয়া যায় না, যদিও দ্বারভাঙা থেকে ৭০ বছর আছে বইটি মুদ্রিত হয়েছিল, তারও কোনো সংস্করণ এখন সুলভ নয় ৷ ‘শৈবসর্বস্বসার’-এর একটি অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি আছে দ্বারভাঙায়, অখণ্ডটি আছে নেপাল ৷ মনে হয়, একমাত্র ‘পুরুষপরীক্ষা’ ছাড়া বিদ্যাপতির অন্যান্য সাহিত্য কর্ম মিথিলায় জনপ্রিয় ছিল না ৷ এ বিষয়টি স্পষ্ট যে বিদ্যাপতির গীত অসাধারণ জনপ্রিয়তার দিক থেকে অন্যান্য সব রচনাকে ম্লান করেছিল এবং বিদ্যাপতির সর্বাধিক সাফল্য সঙ্গীত রচনায় ৷ পণ্ডিতবর্গ অত্যন্ত অনিচ্ছুকভাবে তাঁর মতবাদের উল্লেখ করেন এবং তা প্রামাণ্য বলে স্বীকার করেন না ৷ বিখ্যাত নৈয়ায়িক কেশব মিশ্র (ব্যবহার শাস্ত্রজ্ঞ বাচস্পতির পৌত্র) তাঁর ‘দৈবতপরিশিষ্ট’ রচনায় বিদ্যাপতির ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’র ভূয়সী প্রশংসা ও সম্মানজনক উল্লেখ করলেও তিনিও বিদ্যাপতির শিবসিংহের কাছ থেকে আদিগ্রাম বিসপির দানস্বীকারকে কটাক্ষ করে বিদ্যাপতিকে ‘অতিলুব্ধ-নগর-যাচক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ৷ আশ্চর্যের বিষয় হল আজও মিথিলায় দুর্গোৎসব বিদ্যাপতির সংকলিত সংহিতা অনুযায়ী হয় না ৷ স্পষ্টতই বিদ্যাপতির মতাদর্শ তাঁর নিজস্ব কালের দৃষ্টিভঙ্গিকে অতিক্রম করে গিয়েছিল এবং সেই কারণেই পণ্ডিতসমাজ তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন ৷
সুতরাং বিদ্যাপতির জীবনে চারটি পর্ব দেখা যায়, যেগুলির একটি অন্যটির থেকে স্বতন্ত্র এবং তাঁর সাহিত্যের মধ্যেও এই বিভিন্নতা স্পষ্ট ৷ তাঁর জীবনের চারটি বিভিন্ন পর্ব সাহিত্য কর্মকেও প্রভাবিত করেছিল ৷ প্রথম পর্বটি কুড়ি বছরের, এটি প্রস্তুতি পর্ব, যার শেষে আমরা তাঁকে দেবসিংহের সঙ্গে নৈমিষারণ্যে ভ্রাম্যমান অবস্থায় দেখতে পাই ৷ পরবর্তী ছত্রিশ বছর পূর্ণতাপ্রাপ্ত বয়সকাল, এই সময় তিনি অতিবাহিত করেন শিবসিংহের রাজদরবারে ৷ এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখদায়ক সময়, সৃজনী প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হয়েছিল তাঁর এবং বিদ্যাপতির সাহিত্য যা এই ছত্রিশ বছরের রচনা, তা তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে ৷ পরবর্তী বারো বছরের স্বেচ্ছানির্বাসন বিদ্যাপতির জীবনের সর্বাধিক তমসাচ্ছন্ন অধ্যায় কারণ এই সময় নীরবে তিনি অবসাদ, মনোকষ্ট ও মোহভঙ্গের বেদনা সহ্য করে গেছেন ৷ শেষ পর্বের কুড়ি বছর তাঁর কেটেছে শান্ত গৃহকোণে, বয়োবৃদ্ধ অমাত্য হিসেবে যখন তিনি পাঠে মনোনিবেশ করেছেন, শাস্ত্রাদি থেকে নানা বিষয় সংকলনে ব্রতী হয়েছেন ৷ জীবনের বিস্তৃত সময়ে ভাগ্য পরিবর্তনের সময়, সুদিনে ও দুর্দিনে , বিদ্যাপতি তাঁর একটি কাজের কথা কখনও ভোলেননি, যা একদিনের জন্যও বন্ধ করেননি তা হাল লেখনীচালনা ৷ বিদ্যাপতির নিজের কথাতেই বলতে গেলে বলা উচিত তিনি সারাজীবন অক্লান্ত অধ্যবসায়ে যশোবল্লরীর জন্য বর্ণলিপির মণ্ডপসজ্জা করে গেছেন ৷
বিদ্যাপতির দুই বিবাহ, যদিও আমরা জানি না প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করেন কিনা ৷ প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে তাঁর দুই পুত্র, দুই কন্যা এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একটি পুত্র ও দুইকন্যা জন্মায় ৷ বিদ্যাপতির জ্যেষ্ঠপুত্র হরপতি উত্তরকালের কোনো ঐনবরা রাজার মুদ্রকাষ্টক ছিলেন এবং তিনি জ্যোতিষবিদ্যার ওপর একটি গ্রন্থ ‘দৈবজ্ঞবান্ধব’ রচনা করেন ৷ বিদ্যাপতির বংশধরেরা আজও জীবিত কিন্তু বর্তমানে আর বিসপি গ্রামের বাসিন্দা নন ৷ তাঁরা চলে যান মধুবনীর কাছে সৌরাঠ গ্রামে যেখানে লক্ষ লক্ষ মৈথিল ব্রাহ্মণ নিজেদের পুত্রকন্যার বিবাহের ব্যবস্থাদির জন্য সমবেত হন ৷ বিদ্যাপতির অধস্তন সপ্তম পুরুষ হলেন নারায়ণ ঠাকুর যিনি ‘পুরুষ পরীক্ষা’র প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন ৷ এই প্রতিলিপিটি কলকাতার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’এ সংরক্ষিত আছে ৷ বিদ্যাপতির ‘পুরুষপরীক্ষা’র ওপর আমি যে সংস্করণটি প্রকাশ করি তা ঐ প্রতিলিপির ওপর ভিত্তি করে রচিত ৷ এই প্রতিলিপিটির রচনাকাল কীলহর্ণের মতে ৫০৪ লক্ষ্মণ সম্বতে অর্থাৎ ১৬১৩ বা ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে, রচনাস্থান বিসপি গ্রামে যেখান থেকে নারায়ণের পৌত্ররা সৌরাঠে চলে যান ৷ বর্তমান সৌরাঠের বাসিন্দা হলেন বিদ্যাপতির বংশের ষোড়শতম পুরুষ ৷ মিথিলার বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার দাবী করেন তাঁরা বিদ্যাপতির কন্যাদের, বিশেষত প্রথমা পত্নীর কন্যাদের বিবাহজাত বংশের সন্তান ৷
মিথিলায় বিদ্যাপতির সম্বন্ধে নানা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে ৷ কথিত আছে যে বিদ্যাপতির অর্চনায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব, উগনা-র ছদ্মবেশে, তাঁর পরিচারক হিসেবে আবিভূর্ত হন কিন্তু এই নামটি আবার ‘শুক্ল যর্জুবেদের’ সংহিতায় প্রসিদ্ধ রুদ্রাধ্যায় তে ভগবানের উদ্বোধক হিসেবে উল্লিখিত আছে ৷ এটিও জনশ্রুতি যে অন্তিম সময়ে বিদ্যাপতি গঙ্গাতট পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি ৷ রাত্রে দেখা যায় গঙ্গা স্বয়ং নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে শেষশয্যায় শয়ান বিদ্যাপতির পাশে আসেন ও পরদিন প্রভাতে গঙ্গাবক্ষে বিদ্যাপতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৷ একথা স্মরণে রাখা দরকার এই ধরনের ঘটনা ‘পুরুষপরীক্ষা’র ৩০নং কাহিনীতে কায়স্থ বোধি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ‘সত্যকারের ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ’-এর উল্লেখ প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন বিদ্যাপতি নিজেই ৷ প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন, মিথিলাবাসীর কাছে বিদ্যাপতি ঋষিতুল্য পবিত্রতম ব্যক্তিত্ব, যাঁর অলৌকিক দিব্যশক্তি বহু অঘটন ঘটাতে সমর্থ ৷
বিদ্যাপতির রচনা হিসেবে প্রচলিত একটি সঙ্গীতে বলা হয়েছে বিদ্যাপতি শিবসিংহকে নিরুদ্দেশ হওয়ার বত্রিশ বছর পর স্বপ্নে দেখেন এবং তিনি সম্ভবত তার পরের কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পরলোকগমন করবেন বলে স্বপ্নাদেশ পান ৷ যে কোনো মানুষের পক্ষেই জীবিতকালে নিজের মৃত্যুকাল পূর্বনির্ধারণ করা অলৌকিক ক্ষমতার বিষয় এবং যদি ধরেও নেওয়া হয় এই গীতটি বিদ্যাপতির পরবর্তীকালের কোনো কবির রচনা তা স্বত্ত্বেও এই গীতটি বহু প্রাচীন এবং বহু ব্যক্তি এই তারিখটিকে বিদ্যাপতির মৃত্যুদিবস হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন, যার ফলে এই দিনটি ‘বিদ্যাপতি দিবস’ হিসেবে বিদ্যাপতির ভক্ত সমাজ পালন করে থাকেন ৷ উত্তর পূর্ব রেলওয়ের হাজিপুর শাখার বারাউনি জংশনের কাছে ‘বিদ্যাপতি নগর’ রেলস্টেশনের কাছেই গঙ্গাতটে বিদ্যাপতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বলে শোনা যায় ৷ বিদ্যাপতি এইভাবেই তাঁর জীবনের অন্তিম আকাঙ্ক্ষা ‘মোক্ষ’ লাভ করেছিলেন ৷ গঙ্গাবক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা মোক্ষলাভের পরিচায়ক ৷ বিদ্যাপতির জীবন পরিপূর্ণতার স্বাদ পেয়েছিল, সত্যকারের সার্থক জীবন ছিল তাঁর, যে সার্থকতার কথা সারাজীবন ধরে তিনি মানবসমাজের কাম্য বলে ঘোষণা করে গেছেন, যে সার্থকতা অসে জীবনে সিদ্ধকাম হলে, পুরুষকার দ্বারা যশোলক্ষ্মীর বরলাভ করলে ৷