বিদ্যাপতির পদাবলীতে রাজনামে যত ভণিতা আছে, তার বহুলাংশেই প্রায় রাজা শিবসিংহের কথা আছে। কবির প্রতি রাজার পৃষ্ঠপোষকতাই শুধুমাত্র এই বহুল ভণিতা -উচ্চারণের নিদান নয়। কবির সঙ্গে রাজার এতটাই প্রিয়ত্বের পরিমাণ ছিল, যেখানে রাজার দেওয়া দান-মানের ঊর্ধ্বে এমনই এক সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল কবির সঙ্গে রাজার, যা প্রিয়ত্বের রূপ ধারণ করেছে বিদ্যাপতির ভণিতায়।

শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে প্রচুর সম্পত্তি দিয়েছেন, বাসস্থান হিসেবে একটা গোটা গ্রাম দিয়েছেন, তাতে কবির সাংসারিক জীবন-যাপনের যন্ত্রণা নিতান্তই লঘু হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এইসব জাগতিক দানের কৃতজ্ঞতায় বিদ্যাপতি তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজাকে দিয়েছেন এমন এক খ্যাতি, যা তাঁর রাজত্বের শাসন গরিমাকে সংস্কৃতির মহিমায় মণ্ডিত করেছে। শিবসিংহ রাজা হবার পর বিদ্যাপতির যে কাব্যস্ফূর্তি ঘটেছিল, তাতে কীর্তিলতার মতো ইতিহাস -জাতীয় গ্রন্থ, কিংবা ভূপরিক্রমার মতো ভৌগোলিক গ্রন্থ থেকে সরে এসে বিদ্যাপতি পদাবলী রচনায় অধিকতর মনোনিবেশ করেন। শিবসিংহের কাব্যপ্রীতি যাই থাকুক, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শিবসিংহের সঙ্গে বিদ্যাপতির সৌহার্দ। বিশেষত মিথিলার এই রাজবংশের প্রতি বিদ্যাপতির আনুগত্য বংশানুক্রম নেমে আসছিল নিজে রাজা হবার পর শিবসিংহই সেই তাগিদ অনুভব করেন যাতে করে বিদ্যাপতিকে দানমান দিয়ে রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাঁর সাংসারিক জীবন নিশ্চিন্ত করা যায়।

এই ভাবনা থেকেই আনুমানিক ১৪২২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শিবসিংহ বাগমতী নদীর তীরে বিদ্যাপতিকে একটি গ্রাম দান করেন– গ্রামের নাম বিসপী । এই গ্রামদান সম্বন্ধে একটি তাম্রপত্র আবিষ্কার করেন G.A.Grierson–তিনি ১৮৮৫ সালে Indian Antiquary পত্রিকায় এই তাম্রপত্রের লিখিত বস্তুর প্রতিলিপি মুদ্রিত করে বলেন–‘এই হল বিদ্যাপতিকে বিসপী গ্রাম দান করার দলিল। নানা কারণেই এই দলিল-বিষয়ে বিশদে কোনো কথা বলতে চাই না এখানে। এই গ্রামদান বিষয়ে যে মূল তাম্রপত্রটি আছে, সেটির পূর্ণ অধিকার আমি পাইনি। কিন্তু সেই তাম্রপত্রের প্রতিলিপিটি যথাসম্ভব শুদ্ধ অবস্থায় আমি পেয়েছি এবং আমার বিশ্বাস–এটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি ।’

‘নানা কারণে’ যার বিস্তারে যেতে চাননি গ্রিয়ার্সন–তার একটা বড়ো কারণ বোধহয় বিদ্যাপতির বংশধরদের ব্যবহারে কিছু অস্বস্তি। শোনা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বিদ্যাপতির বংশধরেরা বিসপী গ্রামের ভোগ দখল করতেন। ভোগ দখলের এই সত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য তাঁরা দলিল হিসেবে যে তাম্রপত্রটি সরকারের কাজে পেশ করেন, সেটি জাল বলে নানান প্রশ্ন ওঠে সেইকালে। কেননা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবার পর বিদ্যাপতির বংশধরেরা আসল তারিখ গোপন করে বিভিন্ন বর্ষপঞ্জী উল্লেখ করে কী প্রমাণ করতে চেয়েছেন, সেটা স্পষ্ট নয় বটে, কিন্তু বিভিন্ন বর্ষপঞ্জীর কাল সম্বন্ধে সংখ্যাগণনা ভুল হওয়ায় তাম্রপত্রটির সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠেছে।

গ্রিয়ার্সন ১৮৮৫ সালে পূর্বোক্ত বক্তব্য উচ্চারণ করার পর যে প্রতিলিপি দিয়েছেন, তা এইরকম দাঁড়ায় তর্জমায়–
গজরথপুর থেকে এই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হচ্ছে যে, বহুযুদ্ধ জয়ী মহারাজাধিরাজ রূপনারায়ণ শিবসিংহ–যিনি রামেশ্বরী দুর্গার প্রসন্নতা লাভ করেছেন এবং ভবানী দেবীর ভক্তি-ভাবনাপরায়ণ–তিনি সমস্ত নিয়ম-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বমহিমায় বিরাজিত হয়ে জরৈল পরগণার অন্তর্গত বিসপী-গ্রামের অধিবাসী এবং ভূমিকর্ষক চাষীদের আদেশ-নির্দেশ দিয়ে বলছেন– আপনারা এটা জানুন যে, এই গ্রামখানি রাজকীয় শাসন জারি করে মহাপমণ্ডিত ঠক্কুর বিদ্যাপতি–স্বমহিমায় যিনি অভিনব জয়দেব–সেই বিদ্যাপতি –স্বমহিমায় যিনি অভিনব জয়দেব–সেই বিদ্যাপতি ঠাকুরকে দেওয়া হচ্ছে। গ্রামবাসী জনেরা, এখানকার ভূমিকর্ষক চাষীরা এখন থেকে এঁদের কথা শুনেই চাষবাাদের কাজ করবে।
লসং ২৯৩ শ্রাবণ সুদি ৭ বৃহস্পতিবার।

(Indian Antiquary,1885, p.190-191)

সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগরী হরফে এই তাম্রপত্রের মূল লেখাটি বাংলা লিপিতে এইরকম–

শ্রীগজরথপুরাৎ সমস্ত প্রক্রিয়া বিরাজমান-শ্রীমদ্রাসেশ্বরীবর–
-লব্ধপ্রসাদ-ভবানীভক্তিভাবনাপরায়ণ-রূপনারায়ণ মহারাজাধিরাজ -শ্রীমচ্ছিবসিংহদেবপাদাস্সমরবিজয়িনো
দৈরল-তপ্পায়াং বিসপীগ্রামবাস্তব্য সকললোকান্‌ ভূকর্ষকাংশ্চ সমাদিশন্তি । জ্ঞাতমস্তু ভবতাম্‌। গ্রামোয়সম্মাভিঃ
সপ্রক্রিয়াভিনবজয়দেব-মহাপণ্ডিত-ঠক্কুর-শ্রীবিদ্যঅপতিভ্যঃ শাসনীকৃত্য প্রদত্তো। গ্রামকস্থা যূয়মেতেষাং বচনকরী
ভূকর্ষকাকির্ম করিষ্যথেতি।

লংসং ২৮৩ শ্রাবণ সুদি ৭ গুরৌ।
[G. A. Grierson,’Vidyapati and his Contemporaries.’ In Indian Antiquary,1885, p.190-191]

উপরিউক্ত, এই তাম্রপত্রটি নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, তার সবটাই গ্রিয়ার্সন সাহেবের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। এই তাম্রপত্রের শুদ্ধি-অশুদ্ধি, তথ্য এবং আলোচনা সর্বৈব আবর্তিত হয়েছে এই বিদ্বান তথা পরিশ্রমী পণ্ডিত গ্রিয়ার্সনের দেওয়া সূত্র থেকেই। ফলত এই গ্রিয়ার্সন সাহেবের কথাগুলি আমাদের আগে বুঝে নেওয়া দরকার। প্রথমে জানাই –দেবনাগরী হরফে যে সংস্কৃত প্রতিলিপি গ্রিয়ার্সন In Indian Antiquary(1885) সংখ্যায় ছাপিয়েছেন, সেখানে লক্ষ্মণ সংবৎ মুদ্রাকরের ভুলে ২৮৩, যদিও গ্রিয়ার্সনের ইংরেজী অনুবাদে সেটি ২৯৩। তাঁর লেখায় ইংরেজী গণনায় এটি– L. S. 293(=A.D. 1400)

আমাদের মতে ইংরেজী খ্রিষ্টাব্দও মুদ্রাপ্রমাদ, কেননা লক্ষ্মণ সংবতের সঙ্গে ১১১৯ যুক্ত হলেই তবে খ্রিষ্টাব্দ-গণনা ঠিক হয়। তাতে এই সাল ১৪১২ হবে, বিমানবিহারী মজুমদারও তাই ধরেছেন। দ্বিতীয়ত গ্রিয়ার্সনের বয়ান যেটা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রসিডিংস-এ ১৮৯৫ সালের সংখ্যায় ধরা আছে সেখানে আবার লক্ষ্মণ সংবৎ বলা হচ্ছে ২৯২, সেটা খ্রিষ্টাব্দের হিসেবে ১৪১১ হয়। সোসাইটির প্রসিডিংস-এ যে ‘মিনিটস’লেখা হয়েছে , তা এইরকম— লক্ষণীয়, এখানে লক্ষ্মণ সংবৎ ২৯২ হলেও ১৪00 খ্রিষ্টাব্দের কালমান ব্যাপারটা গ্রিয়ার্সন একই বলছেন, কিন্তু ইতিহাসের বিচারে ১৪0২ সালের আগে শিবসিংহ মিথিলার রাজাই হননি। এটা ঠিক যে, প্রমাণ হিসেবে তাম্রপত্রটির প্রতিলিপি যেটা ফোটো হিসেবে প্রসিডিংসে দাখিল করেছেন গ্রিয়ার্সন, সেখানে সংখ্যায় লক্ষ্মণ সংবৎ ২৯২ আছে। দশ বছর আগে ১৮৮৫ সালে Indian Antiquaryতে দেবনাগরী প্রতিলিপিতে গ্রিয়ার্সন ছাপিয়েছেন –লসং ২৮২ শ্রবণ সুদি ৭ গুরৌ। কিন্তু তাঁর পেশ করা মূল তাম্রপত্রে পাঠ হল — লসং ২৯২ শ্রাবণ শুক্ল ৭ ৭ গুরৌ। অর্থাৎ শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষে সাত তারিখ গুরুবার, মানে বৃহস্পতিবার।

যা দেখা যাচ্ছে, গ্রিয়ার্সনের প্রবন্ধে (১৮৮৫) মুদ্রাকরের প্রমাদ, লক্ষ্মণ সংবৎ থেকে খ্রিষ্টাব্দ গণনার ভ্রান্তি, কিংবা তাঁর দাখিল-করা অবশেষ প্রমাণও পরবর্তী কালের গবেষকদের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরী করে থাকতে পারে। কিন্তু লক্ষ্মণ সংবৎ ২৯৩ সংখ্যাটা মিছে নয়, সেটা সত্য। এটাও মানছি, তাম্রপত্রের শেষে পুনরায় যে নানান কিসিমের অব্দ-গণনা করা হয়েছে, সেটা শেষ পর্যন্ত তাম্রপত্রটির মূল সত্যটাই ভ্রান্ত করে তোলে যেন, কিন্তু আমরা প্রাচীন পদ্ধতিতে লেকা শ্লোকের মধ্যে ‘অঙ্কস্য বামা গতিতে’ যে লক্ষ্মণ সংবতের সংখ্যা পাই, সেটার প্রামাণ্য সব দিক থেকেই অভ্রান্ত বলে মনে হয়। তার আগে পূর্বে উল্লিখিত প্রতিলিপির যে অংশ আমরা বাংলায় এবং সংস্কৃতে এখানে উদ্ধার করেছি, তারপরের অংশটি গ্রিয়ার্সনের ১৮৮৫ সালের লেখা থেকেই উদ্ধার করবো–পূর্বোক্ত গদ্যাংশের পর অন্তত আটটি শ্লোক আছে, যার মধ্যে প্রথম দুটি হল–

অব্দে লক্ষ্মণসেন ভূপতি মতে বহ্নি গ্রহদ্ব্যঙ্কিতে
মাসে শ্রাবণসংজ্ঞাকে মুনিতিথৌ পক্ষে’বলক্ষে গুরৌ।
বাগবত্যাঃ সরিতস্তটে গজরথে ত্যাখ্যাপ্রসিদ্ধে পুরে
দিৎসোৎসাহ-বিবৃদ্ধি-বাহুপুলকঃ সভ্যায় মধ্যে শুভম্।।
প্রজ্ঞাবান্‌ প্রচরোর্বরং স বিসপীনামানমাসীমতঃ।
শ্রীবিদ্যাপতিশর্মণে সুকবয়ে পুত্রাদিভি র্ভুঞ্জতাম্‌
স শ্রীমান্‌ শিবসিংহদেবনৃপতি র্গ্রামং দদে শাসনস্‌ ।।

প্রথম শ্লোকে এটা পরিষ্কার যে, লক্ষ্মণ সংবৎ ছাড়া অন্য কোনো সাল গণনার কথা এখানে নেই এবং সংস্কৃত অঙ্কগণনা পদ্ধতিতে ডান দিকে থেকে বাঁয়ে এলে (অঙ্কস্য বামা গতিঃ) বহ্নি = ৩ (তিন প্রকারের প্রসিদ্ধ অগ্নি), গ্রহ = ৯ (নয়ে নবগ্রহ) এবং তার পর ২, এই সংখ্যা যদি আঁকা থাকে (দ্ব্যঙ্কিতে), এই সম্পূর্ণ লক্ষ্মণাব্দ দাঁড়াবে নিঃসন্দেহে ২৯৩, গদ্যে অঙ্ক সংখ্যা লেখার সময়–বলা উচিত, খোদাই করার সময় যেটা ভুলক্রমে ২৯২ হয়েছে। আর তাম্রপত্রে একবার ভুল হলে সেটা কেটে লেখা বা নতুন করে তাম্রপত্র তৈরী করে ব্যবসায়িক বুদ্ধি প্রকট করার মতো অসরল জীবন তখন ছিল না। বিশেষত শ্লোকে লেখা প্রাচীন গণনাপদ্ধতিতে যে অঙ্ক লেখা হয়েছে, সেটা দ্ব্যর্থহীনভাবে নির্ভুল থাকায় শেষের কটা লাইনে যে শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ এমনকী পরবর্তীকালের আকবর-শাহ-প্রচলিত ফসলী সন নির্দেশ করাটাকে সমস্ত গবেষকেরাই এত খারাপ ভাবে নিয়েছেন যাতে বিদ্যাপতির বংশধরেরা জালী-মানুষ বলে সিদ্ধান্তিত হয়েছেন।

স্বয়ং গ্রিয়ার্সন কিন্তু তাম্রপত্রের এই শেষ জায়গায় যে সনগুলি উল্লিখিত আছে, সেগুলির ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলছেন না কিছুতেই । ১৮৮৫ সালের লেখায় তিনি বলেছেন ‘এব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলতে চাই না –‘for reasons which need not be detailed ‘here’পুনরায় এশিয়াটিক সোসাইটির মিটিংএ ১৮৯৫ সালে এই তাম্রপত্র সম্বন্ধে Philogical Secretary হিসেবে তিনি রিপোর্ট করার সময় বলছেন — ‘For reasons which it is unnecessry to state, I was unable then to get hold of the original plate…’ এবং শেষ পর্যন্ত যে original plate-খানি তিনি দেখতে পেলেন সেটি কিন্তু সেই শকাব্দ, সংবৎ এবং ফসলী সন দেওয়া plateটাই – যেটা তিনি অল্প সময়ের জন্য হাতে পেয়েই করিয়ে photo-zinograph Asiatic Society-র proceedings-এ বার করেছেন।

গ্রিয়ার্সনের এই কথাগুলি ধরেই মনোমোহন চক্রবর্তী থেকে বিমানবিহারী মজুমদার সকলেই তাম্রপত্রটিকে জাল বলে প্রমাণ করার তাগিদ আরম্ভ করলেন। একবারও তাঁরা ভাবলেন না যে, বিদ্যাপতির বংশধরদের এই দলিলটিকে জাল করার প্রয়োজন হল কেন। তাম্রপত্রের শেষে অতগুলি বিচিত্র অব্দসংখ্যা শকাব্দ, বিক্রমাব্দ এমনকী হিজরা সন পর্যন্ত নতুন করে খোদাই করে সরকারের কাছে নিজেদের দখলী সত্ত্ব প্রমাণ করার দায় এল কেন ? আমরা মনে করি, এই তাম্রপত্রের মধ্যে কোনো জালিয়াতি নেই। বিদ্যাপতির যে বংশধরেরা ঊনবিংশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিসপী গ্রামের দখল হাতে রেখেছিলেন, তাঁদের জমি-সম্পত্তি কিন্তু বাজেয়াপ্ত করেছে ব্রিটিশ সরকার, ঠিক যেন ভারতবর্ষের অন্যত্র ছোট্ট ছোট্ট রাজা এবং রাজোপাধিযুক্ত মানুষদের সম্পত্তি উপযুক্ত বংশধরের অভাবমাত্রই সরকার বাজেয়াপ্ত করত।

বিদ্যাপতির গবেষকেরা লর্ড ডালহৌসির ‘Doctrine of Lapse’মনে রাখেননি; তাঁদের স্মরণে আসেনি ১৮৩৪ সালের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ‘কোর্ট অব ডিরেকটরস্’দের ফতোয়া। ফতোয়া অনুযায়ী ছোট-বড়ো রাজকীয় সম্পত্তিগুলি সামান্য অজুহাতে বাজেয়াপ্ত করার অধিকার এসেছিল সরকারের হাতে। সম্পত্তির অধিকারী হিসেবে যেসব রাজকীয় পরিবারে পুত্র সন্তান ছিল না, দত্তক নিতে গেলেও তাঁদের আপিল করতে হচ্ছিল সরকারের কাছে। আর এই আপিলে অনুমতি দেবার আগেই তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাটা ব্রিটিশ সরকারের এতটাই ইচ্ছাকৃত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে ১৮৩৯ সালে মাণ্ডবী এবং ১৮৪0 এ কোলাব এবং জরাউন রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ এবং বাজেয়াপ্ত করেছিল। ডালহৌসির আমলে পূর্বাধিকৃত ছোট্ট ছোট্ট জমিদারি বাজেয়াপ্ত করাটা লাট সাহেবের মনোরোগে পরিণত হয়েছিল।

[P. N. Chopra, Puri, Das and Pradhan, A Comprehensive History of Modern India, New Delhi: Sherling Publishers, 2005(2003), P. 74]

এটা মানি যে, বিদ্যাপতির বিসপী গ্রাম কোনো রাজকীয় সম্পত্তি ছিল না। কিংবা মাণ্ডবী; সাতারা, সম্বলপুর, বাঘতের মতো রাজকীয় সম্পত্তিও ছিল না, তবু দেখুন এই গ্রামও সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। আমরা মনে করি, বিদ্যাপতির বংশধরদের মধ্যে এই তাগিদ তৈরী হয়েছিল যাতে বাজেয়াপ্ত হবার ভয়েই তাম্রপত্রের মধ্যে আকবর শাহ প্রবর্তিত ফসলী সন থেকে আরম্ভ করে শকাব্দ, বিক্রমাব্দ সব চুকিয়ে দিয়ে সরকারের কাছে তাম্রপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করা যায়। এই ধরনের কোনো ঘটনা না হলে গ্রিয়ার্সন সাহেবের অমন আমতা -আমতা ভাব হত না। ব্রিটিশ সরকারের দিক থেকে কোনো রকমের আগ্রাসনের নীতি থাকলে এখানে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার প্রশ্ন উঠত না।

বিমানবিহারী যেভাবে বলেছেন–”দানপত্র যে জাল তাহা Proceedings of the Asiatic Society, Bengal, August 1895, vol. LxVII, প্রথম খণ্ড পৃ. ৯৬ ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩0৭ বঙ্গাব্দের প্রবন্ধে প্রমাণ করিবার চেষ্টা হইয়াছে।” এখানে প্রথম জানাই বিমানবিহারী মজুমদার–উল্লিখিত Asiatic Societyর Proceeding-এ ৯৬ পৃষ্ঠায় এই তাম্রপত্র নিয়ে কোনো কথা নেই। যা আছে, তা ১৪৩-১৪৪ পৃষ্ঠায় যেখানে গ্রিয়ার্সন নিজে এই তাম্রপত্র সম্বন্ধে report করছেন এবং তাম্রপত্রটির প্রতিলিপিও ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন Plate-III এ। এখানে তিনি অন্তত কোথাও এই তাম্রপত্রটিকে জাল বলেননি, শুধু সাল-সনের বিসংবাদটুকু উল্লেখ করেছেন। তাম্রপত্রটির আরও বিচার হোক , এটা গ্রিয়ার্সন চেয়েছেন, কিন্তু ভারতীয় গবেষকদের মধ্যেও অনেক Colonial hangover ছিল, ফলে গ্রিয়ার্সন যদি একটি শব্দও নান্দনিক দূসরতায় উচ্চারণ করেন থাকেন ,তবে গবেষকেরা চতুর্গুণ ব্যাখ্যা করে বলেন –তাম্রপত্রটিই জাল। আমরা যারা ইতিহাসের টিপ্পনীটুকু বুঝতে পারি, তারা জানি যে, গ্রামদানের জন্য রাজা যদি তাম্রপত্র খোদাই করে থাকেন, তবে তার দুটি/তিনটি অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরী করেননি বা করাননি। আর গ্রিয়ার্সনও কোথাও বলেননি যে, তিনি প্রথমে একটি তাম্রপত্র পেয়েছিলেন, তাতে শুধুই লক্ষ্মণ সংবৎ ছিল আর পরে আবার একটি তাম্রপত্র পান, যেখানে অনেকগুলি তারিখ শকাব্দ, বিক্রমাব্দ এবং ফসলী সন দেওয়া আছে এবং সেটি জাল। কেননা বিমানবিহারী লিখেছেন–‘সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত পর বিদ্যাপতির বংশধরেরা ঐ তারিখগুলি গোপন করার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়াছিলেন।’

আমাদের জিজ্ঞাসা হয়, সম্পত্তি যদি বাজেয়াপ্তই হয়ে গেল, তখন আর জাল তারিখ গোপন করেই বা কী হবে! বরঞ্চ তাঁরা দলিলটির মহত্ত্ব-গুরুত্ব বোঝাবার জন্যই বিদ্বান এবং গণিতজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা না করে মূর্খ খোদাইকর এবং আপন গ্রাম্যবুদ্ধিতেই বিভিন্ন অব্দসংখ্যা ভুলভাবে বসানোর চেষ্টা করেছেন তাম্রপত্রের মধ্যে। বলতে পারে এইখানেই তাঁদের জমি বাজেয়াপ্ত হবার ভয় ঢুকেছে এবং সেই ভয়বশতই তাদের গোপনীয়তা; অন্যদিকে অজ্ঞাতার ফলে ভুল সংখ্যার সঙ্গে ফসলী সনের আড়ম্বর। ১৮৩৪-এর ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ফতোয়া আর ১৮৩৯-৪0 থেকেই যেভাবে প্রাদেশিক রাজা-জমিদারদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছিল সামান্য ছুতোয়, লর্ড ডালহৌসি সেটাকে নিয়ে যান ১৯৪৮-এ তাঁর নিজের সময় থেকে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ছুতো এবং বাহানা যে কেমন অত্যাচারে দাঁড়িয়ে সেটার ব্যাপারে যদি খানিক বিস্তৃত ধারণা থাকত, তাহলে আমাদের ধারণা বিদ্যাপতির বংশধরদের ওপর এই জালিয়াতির আরোপটুকু লাগত না।

আমরা শুধু বলবো–গ্রিয়ার্সন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রসিডিংসে তাম্রপত্রের যে প্রতিলিপি প্রকাশ করেছেন সেখানে শ্লোকাকারে লিখিত লক্ষ্মণাব্দের কথাটাই সবচেয়ে জরুরী এবং সেটা যেহেতু ২৯৩, তাই কোনো সন্দেহ থাকে না যে, শিবসিংহ তাঁর শাসনের চূড়ান্ত সময়ে বিদ্যাপতিকে এই গ্রামটি দান করেছিলেন এবং বিদ্যাপতির বংশধরেরা সেই সম্পত্তি ভোগ করেছেন ঊনবিংশ খ্রিষ্টাব্দের অর্ধেক কাল পর্যন্ত।

বিমানবিহারী যেভাবে ১৩0৭ সালে বঙ্গীয়, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করে লিখছেন– ‘দানপত্র যে জাল তাহা Proceedings of the Asiatic Society, Bengal, August 1895, vol. LxVII, প্রথম খণ্ড পৃ. ৯৬ ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ১৩0৭ বঙ্গাব্দের প্রবন্ধে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে– তাতে এই আমাদের মিথ্যাচার বলে মনে হচ্ছে। গ্রিয়ার্সন যেমন কোথাও এই তাম্রপত্রকে জাল বলেননি, তেমনই ১৩0৭ বঙ্গাব্দের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার প্রবন্ধেও কোথাও তাম্রপত্রটিকে জাল বলেননি লেখক। বিমানবিহারী মজুমদারের মতো বিখ্যাত নয় বলেই বিমানবিহারী প্রাবন্ধিকের নাম উল্লেখ করেননি, এমনকী তাঁর প্রবন্ধের নামও জানাননি। আমরা সেটা জানিয়ে বলছি–শ্রী বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ একজন পণ্ডিত গ্রিয়ার্সনের মতো করেই ‘বিদ্যাপতিও তৎসাময়িক বৃত্তান্ত’ নামে একটি প্রবন্ধে গ্রিয়ার্সনের সে তাম্রপত্র থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন, নাম স্বীকার না করে। কিন্তু তাম্রপত্রটির সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করেই তিনি গ্রিয়ার্সনের ১৮৮৫ সালে, Indian Antiquary-তে লেখা ‘Vidyapati and his Contemporaries প্রবন্ধ থেকে তাম্রলিপির বক্তব্য অবিকল উদ্ধার করে লিখেছেন — বিদ্যাপতি এইরূপে শিবসিংহের কীর্ত্তি গাহিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। শিবসিংহ রাজা হইলেন। দান যে কতই হইল তাহার আর ইয়ত্তা নাই। যে অব্দে শিবসিংহ রাজা হইয়াছিলেন সেই অব্দেই বিদ্যাপতিকে তিনি তাঁহার স্বগ্রাম বিষয়িবার বিস্ফী গ্রামটী শাসনরূপে দান করিয়াছিলেন। তিনি একখানি তাম্রময় শাসনপত্রে লিখিয়া দিলেনঃ-
স্বতি গজরথেত্যাদিসমস্ত প্রক্রিয়াবিরাজমানশ্রীমদ্‌রামেশ্বরীবরলব্ধপ্রসাদ-ভবানীভবভক্তিভাবনপরায়ণ-রূপনারায়ণ-মহারাজাধিরাজ-শ্রীমৎ-শিবসিংহ- দেবপাদাঃ সমরবিজয়িনঃ। জরইল তপ্পায়াং বিসপীগ্রামবাস্তব্যসকললোকান্‌ ভূকর্ষকাংশ্চ সমাদিশন্তি মতমস্তু। ভবতাং গ্রামোহয়মস্মাভিঃ সপ্রক্রিয়াভিনবজয়দেবমহারাজপণ্ডিতঠককুরশ্রীবিদ্যঅপতিভ্যঃ শাসনীকৃত্য প্রদত্তোহতো যূয়মেতেষাং বচনকরীভূয় কর্ষণাদিকং কর্ম্ম করিষ্যথেতি

লসং ২৯৩ শ্রাবণ শুদি সপ্তম্যাংগুরৌ। শ্লোকাস্তু।
অব্দে লক্ষ্মণসেনভূপতিমতে বহ্নিগ্রহদ্ব্যঙ্কিতে।
মাসি শ্রাবণসংজ্ঞকে মুনিতিথৌ পক্ষেহবলক্ষে গুরৌ।
বাগ্‌বত্যাঃ সরিতস্তটে গজরথেত্যাখ্যা প্রসিদ্ধে পুরে
দিৎসোৎসাহবিবৃ্দ্ধবাহুপুলকঃ সভ্যায় মধ্যেসভং।।

ইত্যাদি আরও ৭টী শ্লোক আছে। তাম্রশাসনে আমরা দেখিতে পাইলাম মহারাজ শিবসিংহের রাজধানীর নাম গজরথপুর; উহা বাগ্‌বতী নদীর তীরবর্তী। এখনও গজরথপুর বলিয়া একটি গ্রাম দ্বায়ভাঙ্গার নিকটবর্তী স্থানে আছে; উহাও বাগ্‌বতী নদীর তীরে; উহাই যে সেই গজরথপুর তাহা মিথিলা প্রদেশে সকলেই বলেন।
[বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ, ‘বিদ্যাপতি ও তৎসাময়িক বৃত্তান্ত’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩0৭, ১ম সংখ্যা, পৃ. ৩১-৩২] পণ্ডিত বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থের লেখায় বিদ্যাপতির বিসপী গ্রাম লাভের কথা এইটুকু মাত্রই আছে, তাম্রপত্রটি জাল না সঠিক, সে সম্বন্ধে কোনো কথা সম্পূর্ণ প্রবন্ধে আর কোথাও নেই। আর প্রবন্ধের শেষে প্রবন্ধকার নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছেন — বিদ্যাপতির স্বগ্রাম বিস্ফী দেখিতে গিয়াছিলাম। এখন আর তথায় তাঁহার বংশীয়েরা কেহই নাই;–আজ চারি পুরুষ হইল, তাঁহার বংশধরেরা সে গ্রাম ছাড়িয়া সৌরাট নামক গ্রামে আসিয়া বাস করিয়াছেন। বিস্ফীতে এখন আর কিছু নাই। আছে কেবল তাঁহার বাস্তুভিটার ভগ্নাবশেষ; ভগ্নাবশেষই বা কেন, কেবল স্মৃতি চিহ্ন। খানিকটা খুব উচ্চ ভূমি দেখিতে পাওয়া যায়, লোকে বলে উহাতেই তাঁহার বাটী ছিল; বাটী বোধ হয় মেটেই ছিল। তাহার পর দেখিতে পাওয়া যায় একটী সুড়ঙ্গ–এখন অনেক বুজিয়া আসিয়াছে। জঙ্গলও হইয়াছে। প্রবাদ – এই অন্ধকার স্থানে বসিয়াই নাকি তিনি চরমের আলোকের অনুসন্ধান করিতেন। আর আছেন এক লিঙ্গমূর্তি মহাদেব। বিদ্যাপতি স্বয়ং ইঁহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। আগে ইঁহার পাকা মন্দির ছিল; এখন আর সে মন্দিরের কিছুই নাই; চারিদিকে মাটীর দেওয়াল আর উপরে চাল। লিঙ্গটী যেখানে আছেন, তাহা একটী অন্ধকারময় কূপ সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না; –সিঁড়ি আছে, নামিয়া আলো জ্বালিয়া দেখিতে হয়। এখনও তাঁহার নিত্য পূজা হয়। বিদ্যাপতির ভিটার ধারে কমলানদী প্রবাহিতা ; এখন নদীর বেগ মন্দ হইয়া গিয়াছে।

[বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪]

বিনোদবিহারী এই মত আমরা মানিনা যে, শিবসিংহ রাজা হবার পর একই বছরে তিনি বিদ্যাপতিকে বিসপী বা কথাভাষায় বিস্ফী গ্রাম দান করেছিলেন। আমরা মনে করি শিবসিংহ রাজা হয়েছেন আরও আগে ১৪0২ খ্রিষ্টাব্দে এবং ‘অনল-রন্ধ্র-কর’ ব্যাখ্যা ঠিক ভাবে বুঝতে হবে। বিসপী গ্রামের দানপত্র অবশ্য একেবারেই স্বতন্ত্র কথা এবং সেখানে শ্লোকমধ্যস্থিত লক্ষ্মণাব্দ ২৯৩ সংখ্যাটাই সবচেয়ে বেশী নিশ্চিন্তি দেয় এবং বিদ্যাপতির সঙ্গে শিবসিংহের সৌহার্দ সবেচেয়ে বেশী প্রমাণিত হয়। বিদ্যাপতিও এই গ্রামদানের কথা ভোলেননি এবং শিবসিংহকে তিনি কতটা ভালবাসতেন–তা একটি কবিতায় অমর হয়ে আছে। লোচন কবির রাগতরঙ্গিনীতে সংকলিত একটি ভণিতা উমেশ মিশ্র উদ্ধার করে তাঁর ‘বিদ্যাপতি ঠক্কুর’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে বিসপী গ্রাম দান করে কতটা আপন করে নিয়েছেন এবং বিদ্যাপতিও তাঁর কৃতজ্ঞতা ভুলতে না পেরে লিখেছেন —

পঞ্চগৌড়াধিপ সিবসিংহ ভূপ / কৃপা করি লেল নিজ পাস।
বিসপীগ্রাম দান কএল / মোহি রহইত রাজসনিধান।।

[উমেশ মিশ্র, বিদ্যাপতি ঠক্কুর , ইলাহাবাদঃ হিন্দুস্থানী একেডেমী, ১৯৩৭, পৃ. ৪১-এ পাদটীকা বিবরণ দিয়ে লিখেছেন–‘লোচন-রাগতরঙ্গিনী, পৃ. ৩৭ (দরভঙ্গা রাজসংস্করণ)]

শেষ করার আগে বিদ্যাপতির পাওয়া বিসপীগ্রাম নিয়ে আরও দু-চার কথা নিবেদন করতে চাই। আমরা মনে করি– বিমানবিহারী মজুমদারের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ গবেষক যখন স্বযুক্তিতে আত্মলাভ করার জন্য পূর্বতন গবেষকদের সমস্ত মতই ধূলিসাৎ করতে থাকেন, তখন সেটিকে এক বৈকারিক দুরাগ্রহ বলে মনে হয়। গ্রিয়ার্সন সাহেবের পরেই শ্রদ্ধেয় নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বিদ্যাপতির পদাবলীর ওপর ‘পায়োনিয়ারিং’ কাজ করেন। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনিই সবচেয়ে বেশী ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বিদ্যাপতির হাতে। আমরা শুধু জানাতে চাই যে , তিনিই কিন্তু সমস্ত ঔপনিবেশিক আবিষ্টতা কাটিয়ে ব্রিটিশ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে আরম্ভ ‘Doctrine of Lapse’-এর ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে। আমরা পরিশেষে তাঁর কথনভঙ্গী এবং বিষয় উপস্থাপনে তাঁর দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করেই বিদ্যাপতি-লব্ধ বিসপী-গ্রামের প্রসঙ্গে ইতি টানবো–

”রাজা শিবসিংহ রাজপণ্ডিত কবি বিদ্যাপতিকে বিসপী গ্রাম দান করেন। সেই দানপত্রের যে তাম্রলিপি বিদ্যমান আছে সেখানি কৃত্রিম প্রমাণিত হইয়াছে। ডাক্তার গ্রিয়ার্সন উহাকে জাল বলিয়াছেন। এ কথাটা ভাল করিয়া বুঝিয়া দেখিতে হইবে । তাম্রলিপি জাল বলিলে এরূপ অর্থ হইতে পারে যে, শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে আদৌ গ্রাম দান করেন নাই, জাল দানপত্রের বলে বিদ্যাপতি ঠাকুর ও তাঁহার বংশধরগণ উক্ত গ্রাম ভোগদখল করিয়া আসিতেছিলেন। অথবা বিদ্যাপতি স্বয়ং এমন কর্ম্ম করেন নাই, তাঁহার বংশধরেরা এইরূপ করিয়া আসিতেছিলেন। দলিল জাল করিয়া যে একখানা গ্রাম চুরী করা যায় এ কথা কিছু নূতন রকমের । প্রসিদ্ধ আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েন যখন ভারতবর্ষে আগমন করেন তখন হাতী দেখিয়া তাঁহার বড় লোভ হইয়াছিল, কারণ ওই জানোয়ারটা তাঁহাদের দেশে বড় একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। মার্ক টোয়েন লিখিলেন যে যখন তিনি দেখিলেন হাতীর কাছে কেহ নাই তখন তিনি এদিক ওদিক দেখিতে লাগিলেন, নিকটে পাহারাওয়ালা আছে কি না, কারণ হাতীটা চুরী করিবার ইচ্ছা বড় প্রবল হইয়াছিল; একবার চুরী করিতে পারিলে হাতী লইয়া পলায়ন করা নিতান্ত সহজ। এমন রসিক লোকও আছেন যাঁহাদের বিবেচনায় একটা হাতীর অপেক্ষা একখানা গ্রাম চুরী করা আরও সহজ। প্রকৃত কথা এই যে, মূল দানপত্র খানি নাই। তাম্রলিপি খানি বিদ্যাপতির কোন বংশধর প্রস্তুত করাইয়া থাকিবেন, লিপিকরের অতিরিক্ত বুদ্ধিতে প্রমাদ ঘটে। হিন্দু, মুসলমান, ইংরাজ দান সম্বন্ধে কোন সন্দেহ করেন নাই। তবে ষাট বৎসরের অধিক হইল গ্রাম আর ব্রহ্মোত্তর নাই। সে ঘটনা কবীশ্বর চন্দ্রঝা কর্ত্তৃক সম্পাদিত পুরুষপরীক্ষা গ্রন্থে বিবৃত আছে। সন ১২৫৭ সালে দয়ভঙ্গা জেলায় জমির বন্দোবস্ত হয়। সেই সময় কোন ব্যক্তি বন্দোবস্তবিভাগে সংবাদ দেয় যে বিদ্যাপতি ঠাকুর সিদ্ধপুরুষ, গ্রাম ও ধনের তাঁহার কোন প্রয়োজন ছিল না। ভৈয়া ঠাকুর বিদ্যাপতির বংশধর বলিয়া পরিচয় দিয়া গ্রাম ভোগ করিতেছে। তখন বিদ্যাপতির বংশধর ভৈরা ঠাকুর বর্তমান। তদারকের সময় ভৈরা ঠাকুর তাম্রপত্র ও বংশাবলী পেশ করেন ও দখল প্রমাণ করেন। পঞ্জীকারগণ ও অপর অনেক লোক তাঁহার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। তাহারা কহে, বিসপী গ্রাম বিদ্যাপতি ঠাকুরের লাখেরাজ ব্রহ্মোত্তর, তাঁহার বংশধরেরা ভূমি কর না দিয়া বরাবর ভোগ করিযা আসিতেছেন। আদালতে পণ্ডিত বিদ্যাকর মিশ্র স্বয়ং এই কথা বলিলেন। সাহেব সনদের তর্জ্জমা শুনিতে চাহিলেন। দানপত্রে এই শ্লোকটি আছেঃ-

গ্রামে গৃহ্নন্ত্যমুম্মিন্‌ কিনপি নৃপতরো হিন্দুবোন্যেতুরুস্কা
গো কোল স্বাত্মমাংসৈ সসহিত মনুদিনও ভুঞ্জতে তে স্বধর্ম্মম্।

যে সকল হিন্দু বা মুসলমান নৃপতি উক্ত গ্রাম হইতে কিছু আদায় করিবেন তাঁহারা (যথাক্রমে) গো এবং শূকরের মাংসের সহিত স্বধর্ম্ম ভোজন করিবেন।

শুনিয়া ইংরাজ কহিলেন, গো এবং শূকর উভয় মাংসই আমাদের ভক্ষ্য, অতএব এই শপথ লঙ্ঘন করিলে আমাদের কোন দোষ হইবে না। গ্রাম রাজা শিবসিংহের প্রদত্ত, বাদশাহের নয়, সুতরাং খাজনা নির্ধারিত হইবে।
বিসপী গ্রাম এখন আর বিদ্যাপতির বংশধরদিগের নাই, হস্তান্তরিত হইয়াছে।”

[বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কর্তৃক সঙ্কলিত এবং সম্পাদিত, সারদাচরণ মিত্র কর্তৃক নিজ ব্যয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত, ১৩১৬ সাল (১৯0৯), ‘বিদ্যাপতি ঠাকুরের জীবন বৃত্তান্ত’]