সদা এই অনুসারে ভাবনা করিয়া।
সরসচা তুরী আর আত্ম নিবেদিয়া।।
তোমারে ভজনা করে সেই লাভ হয়।
তাহারে তোমার কিছু শুভদৃষ্টি হয়।।
যাহারে দেখিলে চমৎকার সেই মরে।
ইহার বিশেষ কথা কহিব তোমারে।।
ইহার প্রমাণ দেখ আছে কুমারিয়া।
মাটি ঘরে কিডা মারি রাখএ মুদিয়া।।
পূর্ব জন্ম ছাড়ি চমৎকার জন্ম হয়।
যেহি মত ভাবে সেহি ত মিলয়।।
এতেক জানিয়া ভাই ভজনে কর মন।
ভজনে সকল সিদ্ধি জানিবা কারণ।।
ত্রিধামত ভজন কর দ্বিবিধা মত দৃষ্টি।
আপন প্রভাব লইয়া একমত প্রাপ্তি।।
গুরু কৃষ্ণ বৈষ্ণব তিনেতে সাধিব।
তিনে একতা হইলে এক আত্মা হইব।।
আর কোনো দেহে না পাইব কৃষ্ণরে।
আত্মা সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র মিলেন তাহারে।।
কৃষ্ণ সঙ্গে গুরু জানিবা কারণ।
গুরু আর কৃষ্ণ করহ ভাবন।।
আত্মা ছাড়িয়া জীব জীবা কেমনে।
শরীর নহিলে আত্মা রহিব কেমনে।।
অতএব এই তিন সাধনের গতি।
পঙ্ক হইতে নীর যেন পদ্ম পত্রে স্থিতি।।

এহি সব দ্বারে যখন সাধন করিব।
উপাসনা আরোপেতে বসতা হইব।।
যেমত ভাব তেমত লাভ না জানিহ অন্য।
ব্রজ অনুসারে ভাব জানহ কারণ্য।।
উপাসনা আরোপেতে যেমন মিশ্রতা।
তথাকার ভাব দেখ কি কব একথা ।।
সাধুসঙ্গ যখন আসিয়া মিলিব।
তথাকার ভাব লঞা সাধুরে লইব।।
কৃষ্ণভক্ত ধর্ম কর্ম সব ত্যাগ করে।
বিহরএ প্রেমানন্দে আনন্দ সাগরে।।
দিবানিশি গণনা করিব মনে মনে।
যখন যে দৃষ্টি তাহা করিবেক গানে।।
নাটেতে করিব নৃত্য গায়নে গায়ন।
রসেতে করিব রস শয়নে শয়ন ।।
সেবাতে করিব সেবা আজ্ঞা অনুসারি।
এমত করিলে ভক্ত নাম হয় তারি।।
এমন সঙ্গে থাকিতে যদি করে মন।
সেই ভক্ত নাম ধরে অকথ্য কথন।।
অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করি সাধু সঙ্গ ধর।
অন্য অভিলাষ ছাড়ি মন দঢ় কর।।

বিশেষে ভাই সব ভক্তে কর ভক্তি।
ভক্তি অনুসারে দেখ পূর্ণ হবে মতি।।

প্রাণের হরি হরি কি ভেল সংসার বিষয়।
শুনিলে না শুনে কান জানিলে না জানে প্রাণ
দঢ়াইতে না পারি নিশ্চয়।।
স্ত্রীপুত্র কুটুম্ব জন অবিদ্যা সম্বন্ধ মন
কৃষ্ণ সুখে না করি আরতি।
সাধুসঙ্গ নাঞি করে মিথ্যা সুখে সদা ফেরে
তার সার না দেখিএ গতি।।
গোপীজন দুর্লভ দাস মনে আর নাহি আশ
রাধাকৃষ্ণ সদাই ধেয়ান।
নাহি কর জ্ঞান কর্ম নানাবিধ বেদধর্ম
রাধাকৃষ্ণ পরাণের পরান।।

মঙ্গলমঞ্জরী রাষ

প্রাণের হরি হরি হেন দিন হইব আমার।
দুহু মুখ নিরখিব দুহু অঙ্গ হেরিব
সেবন করিব দুহাঁ কার।।
ললিতা বিশাখা সঙ্গে সেবন করিব রঙ্গে
মালা গাঁথি দিব নানা ফুলে।
কনক সম্পুট করি কর্পূর তাম্বুল ভরি
যোগাইব বদন কমলে।।
রাধাকৃষ্ণ বৃন্দাবন সেই মোর জীবন
প্রণতি করিব তার পায়।
জয় রূপ সনাতন সেই মোর প্রাণধন
তাহা বিনু অন্য নাহি ভায়।।

শ্রীগুরুকরুণাসিন্ধু অধম জনার বন্ধু
লোকনাথ লোকের জীবন।
গণসঙ্গে কর দয়া দেহ মোরে পদছায়া
নরোত্তম লইল শরণ।।

অতএব সাধুসঙ্গ ভজনের মূল।
সাধুসঙ্গ হইলে মিলয়ে সকল।।
অন্য অভিলাষ ভাই সব কর দূর।
ভক্তিভাবে সেবা কর যুগল কিশোর।।
ভক্তিতে সাধনে হয় প্রেমভক্তি।
সদাই আনন্দ তার প্রেমের পিরিতি।।
সদা নাম গুণ গান করহ ভাবেতে।
গুরুমন্ত্র আপ্ত মন্ত্র জপহ জিহ্বাতে।।
সেই সব অনুষঙ্গ মনে ঘটাইয়া ।
এ সব প্রেমের কথায় বেড়াব কান্দিয়া।।
সভারে করিব ভাই প্রেম দিয়া বন্দী।
ভক্ত রাখ আপনা দিয়া প্রেমভক্তি ।।
শুনরে সুবুদ্ধি ভাই ভক্ত সঙ্গ গুণ
কতেক উদয় হয় না হয় বিগুণ।।
সার চন্দন আছিল যেই ঠাঁই।
শেওড়া নামেতে বৃক্ষ আছিল তথাই।।
সঙ্গগুণ সৌরভ সুগন্ধি ধরিল।
এইমত সাধুসঙ্গ জানিহ সকল।।
যেই সঙ্গ যে করে সেই সঙ্গ ধরে।
অন্যথা নহে ভাই দেখহ বিচারে।।
ভক্ত সব বিনু আর সঙ্গ নাঞি।
শ্লোকার্থে বিচারিয়া বুঝহ সভাই।।
সাধুসঙ্গে বসি সদা কহ কৃষ্ণ কথা।
আপন স্বভাব উপস্থিত হবে তথা।।
জাহাঁ জাহাঁ থাক ভাই সে বল লঞা।
তবে ত পাইবে নিত্য সখী সঙ্গ যাঞা
লীলা আস্বাদন নিত্য নিত্য কর গতি।
ব্রজমণ্ডলে কর বাস নিকুঞ্জেতে স্থিতি।।
চারিদ্বারে চারি ঘাট তাহার দরশন।
চারি ঘাটে চারি নাম শুনহ লিখন।।
পশ্চিম ঘাটের নাম সখিবিলাস।
(মণিকর্ণিকা ঘাট পূর্ব্বেত প্রকাশ)।।
উত্তর ঘাটের নাম সিদ্ধচন্দ্রিকা হয়।
দক্ষিণ ঘাটের নাম সারদ নিশ্চয় ।।
পশ্চিমদ্বারে জল পরশিলে ভক্তি হয়।
পূর্ব্বদ্বারে জল পরশিলে গুরু প্রাপ্তি হয়।।

উত্তর দ্বারের জলে অঙ্গ নির্মল হয়।
দক্ষিণ দ্বারের জলে দিব্য চক্ষু হয়।।
এইমত সদাই সব নির্মল হয়।
ইহা বই সাধনের নাহিক উপায়।।

হরি হরি আর ক এমন দশা হব।
এ ভব সংসার তেজি পরম আনন্দে মজি
করে আর ব্রজভূমে যাব।।
সুখময় বৃন্দাবন কবে পাব দরশন
গড়াগড়ি কবে দিব তায়।
প্রেমে গদগদ হঞা রাধাকৃষ্ণ গুণ গাঞা
কান্দিয়া বেড়াব উভরায়।।
নিভৃতে কুঞ্জেতে যাঞা অষ্টাঙ্গ প্রণাম হঞা
কবে ডাকিব অনাথের নাথ বলি।
যাইয়া যমুনা তীরে পরশ করিব নীরে
কবে করপুটে খাব তুলি।।
হেন দিন কবে হব শ্রীরাসমণ্ডলে যাব
সে ধুলি মাখিব কবে গায়।
বংশীবট ছায়া পাঞা পরম আনন্দ হঞা
পড়িয়া থাকিব কবে তায়।।
কবে গোবর্ধন গিরি দেখিব নয়ান ভরি
শ্রীকুণ্ডে করিব প্রণাম।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে কবে এ দেহ পতন হবে
এই আশা করে নরোত্তম ।।
অতএব জান সার সদা দৈন্য ভাব।
সদাই করিহ মন প্রেমের প্রভাব।।
প্রেমভাব ভক্তি বিনে নাহিক সুসার।
এই মন আস্বাদিতে সাধক সিদ্ধ তার।।
প্রেমকথা মধূ জান মধুবৈরি কোপে।
মধু পাইলে সব জেন পিপীলিকা নাশে।।
ভক্তি জানিবা পাঞা ঐরি তারে ডাকে।
অমনি নাশে ভক্তি কটু উক্তি হইলে।।
প্রবল ধন জেন ভাবের অভিপ্রায়।
অলক্ষীর প্রভাবে লক্ষ্মী ছাড়ি যায়।।
এমতি নাশয়ে ভাব কামে মত্ত হইলে।
তিন আস্বাদন পড়ে প্রভাবে পড়িলে ।।
প্রভাবে থাকিয়া ভাব যবে হয়।
সেই সে উত্তম সাধু জানিহ নিশ্চয় ।।
প্রকট প্রকৃতি দুই জন করে বাস।
প্রকট হই প্রকট নাঞি ছাড়ে বাস।।

আপনার স্বভাব প্রকৃতি তেমতি জানিবা ।
তিন বইআ স্বভাব হইলে ঐমতি পাইবা।।
সাধব করিবে যারে প্রাপ্তি সেই হয়।
সাধিয়া করিলে ভক্তি সাধক সেই হয়।।
সাধকের নাম প্রাপ্তি দেখহ বিচারে।
ধন সাধ্য করিলে জেন নানা ভোগ করে।।
এমতি সাধক ভাই করিতে পারিলে।
প্রেমভাব ভক্তি সাধন স্বভাব করিলে।।
সেই পাএ কেবল কৃষ্ণ জানিহ নিশ্চয় ।
এমতি সাধন করে হইয়া নির্ভয়।।

হরি হরি হেন দয়া আর কবে হবে।
শ্রীরাধাকৃষ্ণের পায় মন কবে রবে।।
ছাড়িয়া প্রকট দেহ হইব আর কবে।
প্রকৃতি দুহাঁর অঙ্গে চন্দন দিব করে।।

টানিয়া বান্ধিব চুড়া নব গুঞ্জা তাহে বেড়া
নানা ফুলে গাঁথিয়া দিব হার।
পীত বসন অঙ্গে পরাইব সখি সঙ্গে
বদনে তাম্বুল দিব আর।।
তাঁহার রূপ মনোহারী দেখিব নয়ান ভরি
নীলাম্বরে তাহাঁরে সাজাইয়া ।
রতনের রজ্জু আনি বান্ধিব বিচিত্র বেণী
দিব্য কাঁচুলী মনেতে করিয়া।।
হেন রূপ লাবণ্য সদাই দেখিব দন্য
এই করহ মনে আশ।
জয় রূপ সনাতন দেহ মোরে এই ধন
নিবেদএ নরোত্তম দাস।।

অতএব জান ভাই সাধিলে সেই পাই।
ভক্তিরূপে জান ভক্ত আর মত নাঞি।।
কালাকাল দোষ বেদের প্রমাণ।
দুঃখসুখ অন্যগীতা না কর সন্ধান।।
এসব করিয়া নাশ মন কর ভাল।
সাধুর স্মরণ লেহ এহ দিন গেল।।
তথাহি —
ক্ষান্তিরব্যর্থ কালর্থং বিরক্তির্মানশূন্যতা।
আশাবন্ধ সমূৎকণ্ঠা নামগানে সদারুচি।।
এই শ্লোকার্থ ভাই বিচার করিয়া।
ব্রজ অনুসারে হয় আপনা দেখিয়া।।
ধনজন কোথা রবে পাপিষ্ঠ সংসার।
সাধন ভজন পরে গতি নাহি আর।।

সুজনের সঙ্গ কৈলে মতি হয় ভাল।
কায়মন বাক্যে ভাই সাধুসঙ্গ চল।।
অমূল্য রতন এই সাধন ভজন।
পিরিতি করিয়া থাকে বৈষ্ণবের গণ।।
উত্তমের দোষ ভাই না করিবা মনে।
কদর্য হইতে রত্ন তুলি আনে ।।
ইহার পর অতিরিক্ত
মক্ষিকা মলমিচ্ছন্তি দুর্জনাঃ।
ভ্রমরা পুষ্পমিচ্ছতি গুণামিচ্ছত্তি সজ্জনাঃ ।।

যে জন যেমত ভাবে সেই তার সার।
ইহা জানি মনে কিছু না ভাবিহ আর।।
ভ্রমরা পড়িয়া পুষ্পে মধু করে পান।
কিসেতে কেমন মধু নাহি করে জ্ঞান।।
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুন শ্রবণ ভরিয়া।
দেখিলে বৈষ্ণব ঠাকুর আনিহ ডাকিয়া।।
বৈষ্ণব দেখিলে হয় কৃষ্ণ প্রেম কথা।
ঘুচএ সকল তাপ দূর যায় ব্যথা।।
এমতি করিতে কার্য সাধনের সাধন।
সেই এই করিবেক মনেতে সাধন।।

খুঁজিয়া করিব কৃষ্ণ কথা আলাপন।
নাহিক তাহার বিধ অকথ্য সাধন।।
কহিনু এ সব কথা শুন সর্ব জন ।
হরি গুরু বৈষ্ণব পায় দঢ় কর মন।।
কর্ম হইতে পার এই দেখিব বিচারে।
শ্রীবৃন্দাবন দয়া করিবেন ইহারে।।
সদা কৃষ্ণ গুণ গাথা যাহার বদনে।
গীতি বাদ্য নাট সদা যার হয় মনে।।
জানিব উত্তম সেই থাকিব তার সঙ্গে।
অমৃত পুরিয়া ভাই আছে তার অঙ্গে।।
সদা করিব তাঁর সঙ্গে সাধ্য সাধন।
না ছাড়িব তাঁরে কর প্রেমের বন্ধন।।
অসৎ ক্রিয়া কুটিনাটি সকল ছাড়িয়া।
করিব বৈষ্ণব সঙ্গ কায়মন বাক্য হঞা।।
উত্তমের রীত বুঝিবে বিদ্যমান।
এমত রীত হইলে যায় নিত্যস্থান।।
এই মত কর মন ভজন ভাবনা।
তবে সে রাধাকৃষ্ণ করিবেন করুণা।।
রাগানুগা কর ভক্তি প্রেমের সিঞ্চন ।
হেথা গুরু বৈষ্ণব তথা দুইজন।।

সাধক সিদ্ধক (হয়) এই দুইজন।
তিনেতে একতা করি করহ ভজন।।
বৈষ্ণবে দ্বেষী যে কৃষ্ণেতে আস্থা নাহি।
না করি তাহার সঙ্গ মুখ নাহি চাহি।।
পতিতপাবন মোর গৌর অবতার।
এবার করুণা করি কর অঙ্গীকার।।

হাহা প্রভু কর দয়া করুণা তোমার।
মিছা মায়াজালে তনু দগধে আমার।।
কবে হবে এমন দশা সখী সঙ্গ পাব।
বৃন্দাবনে হার গাঁথি দুহাঁরে পরাব।।
সমুখে দাণ্ডাইয়া কবে চামর করিব।
অগোর চন্দন দুহাঁর অঙ্গেতে লেপিব।।
এমনি দুহাঁরে তাম্বুল যোগাইব।
সিন্দুর তিলক আর দুহাঁরে পরাইব ।।
দুহাঁর বিলাস কৌতুক দেখিব নয়ানে।
নিরখিব চাঁদমুখ বসাইয়া সিংহাসনে।।
সদা করে সাধ দেখি দুহাঁর বিলাসে।
কতদিনে হবে দয়া নরোত্তম দাসে।।

(অতএব দেখ ভাই প্রেমের কথন ।
আসিয়া বৈষ্ণবগণ করয়ে আসন।।
যেই পুষ্পে থাকে মধু তাহে ভ্রমরের গতি।
এই মত জানিবা বৈষ্ণব ভ্রমর আকৃতি ।।
যাহার আলয়ে বৈষ্ণব করে গতাগতি।
সেই সে উত্তম হয় নিত্য হয় স্থিতি।।
বৈষ্ণবের অল্পবুদ্ধি আর অপরাধ।
কহন না যায় ভাই বড় পরমাদ।।

বৈষ্ণব চরণ রেণু ভূষণ করিয়া।
সেই সব ভাবখানি মনেতে আনিয়া ।।
এই সব কথা ভাই রাখিহ মনেতে ।
কদাচিৎ প্রকাশ না করিহ অজ্ঞানেতে।।
কারো বোলে না ভুলিবে সদাই ধেয়ান।
রাধাকৃষ্ণ জান ভাই পরাণের পরান।।
গভীর শীতল হঞা করহ ভজন।
আপন স্বভাবে কর সাধ্য সাধন।।
প্রেমের করুক দয়া রতি ভক্তি দিয়া।
ভাবে কর সদা কাল না দিব ছাড়িয়া।।
স্মরণ মনন এই জান দঢ় চিতে।
গোপন ভাবেতে সদা রাখিহ মনেতে।।
শ্রীগুরু পাদপদ্ম মনে করি আশ।
সাধ্যপ্রেমচন্দ্রিকা কহে নরোত্তম দাস।।
-ইতি সাধ্যপ্রেমচন্দ্রিকা সমাপ্ত।
(ক.বি. ২0৩৪ পুথি হইতে আদর্শ পাঠ গৃহীত)