বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ পদাবলীকীর্তন ভারতীয় অভিজাত বা ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতধারার এক অপরিচ্ছেদ্য রূপ৷ এর গীতরীতি, সাহিত্য ও সুরবিকাশের পিছনে ক্রমবিকাশ ও ঐতিহাসিক অভিব্যক্তির ধারা কিভাবে লীলায়িত তা সঙ্গীত-অনুসন্ধিৎসুমাত্রেরই জানার বিষয়৷ বিভিন্ন শ্রেণীর পদের সংগ্রহগ্রন্থের অসচ্ছ্বলতা নেই, প্রতিটি পদের সঙ্গে সাহিত্য, সুর,তাল ও ছন্দের সমাবেশ সুস্পষ্ট এবং সেই সমাবেশের মধ্যে তাদের পারস্পরিক সঙ্গতিও লক্ষ্য করার বিষয়৷ বর্তমানে বিচিত্র শৈলীর কীর্তনগান তাদের পূর্ববিকাশভঙ্গী থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন একথা যদি ধরে নেওয়া যায়, তাহলেও আসল কীর্তনগীতিরূপের বিলাস ও সমাদর বাংলার সমাজে আজও অব্যাহত আছে এবং চিরদিন থাকবে বলে বিশ্বাস করি৷ তবে সাধারণে তো বটেই, বিদগ্ধসমাজেও ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কীর্তনকে আলোচনা করে দেখার আগ্রহের এখনো অভাব আছে বলে মনে করি৷ কেননা সেভাবে আলোচনার আগ্রহ অব্যাহত থাকলে সঙ্গীত-সমীক্ষকগণের সমাজে আজ কীর্তন কোন্‌ জাতির বা কোন্‌ শ্রেণীর,অভিজাত– কি দেশী এ ধরনের সন্দেহের অবকাশ কোনক্রমেই থাকত না৷
পদাবলীকীর্তন বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ, কিন্তু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মস্থান ও দেবায়তনগুলিকে কেন্দ্র করে ভক্তিরসাত্মক “কীর্তি”-গাথারূপ কীর্তনগানের প্রচলন এখনো অব্যাহত রয়েছে৷ বাংলাদেশের কীর্তনের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণলীলা কথা বা কাহিনীর অনুরূপ ঐ সকল কীর্তনগানের সাহিত্যও রসভাবসমৃদ্ধ৷ উৎকলে বা উড়িষ্যায়, মহারাষ্ট্রে,রাজস্থানে,মধ্যভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ও দক্ষিণ-ভারতে কীর্তনগানের যথেষ্ট প্রচলন আছে৷ তবে বাংলাদেশের বৈষ্ণব-পদকীর্তন বা পদাবলীকীর্তনের ধারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কীর্তনগান থেকে বেশ স্বতন্ত্র৷ মণিপুরে নৃত্যছন্দের সঙ্গে কীর্তনের প্রচলন আছে এবং তার সাহিত্যসম্পদও রাধাকৃষ্ণলীলামাধুর্যে রসায়িত৷ অনেকের অভিমতে, মণিপুরীকীর্তনের শৈলী ও উপাদান অনেক পরিমাণে ঋণী বাংলার ঠাকুর নরোত্তমদাসের কাছে এবং তা অসম্ভব নয় এজন্য যে, তখন বৃহত্তরবঙ্গের চতুঃসীমা ছিল অখণ্ড বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও সমগ্র আসাম ও তীব্হুত প্রভৃতিকে নিয়ে বিস্তৃত৷ কিন্তু একথা সত্য যে, বর্তমান রীতির মণিপুরীকীর্তন ঠাকুর নরোত্তম-প্রবর্তিত রীতি ও রূপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ তবে সকল দেশের কীর্তনের আবেদন যে সমান ও সর্বজনীন একথা সত্য৷
বৈষ্ণব-পদাবলীকে সাধারণভাবে বলে গীতিকবিতা, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, বৈষ্ণব-কবিতাকে সুরে ছড়ার মতো করে আবৃত্তি করা হয়৷ পদাবলী আসলে গান, গীতি বা সঙ্গীত৷ তাছাড়া পদের মুখ্য অর্থই গান৷ খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত ভরতের নাট্যশাস্ত্রে “পদ”-শব্দে গান বা গীতিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে৷ খ্রীষ্টপূর্ব চারশো-দুশো শতকের মহাকাব্য রামায়ণ-,মহাভারত ও হরিবংশে এবং এমনকি খ্রীষ্টীয় শতকের প্রথমভাগের পঞ্চরাত্র-সংহিতা ও পুরাণ-সাহিত্যগুলিতে গান বা গীতির দ্যোতক “পদ”-শব্দের ব্যবহার দেখা যায়৷ রামায়ণে (বালকাণ্ড, ৪র্থ সর্গ) “বিচিত্রার্থপদং সম্যগ্‌ গায়কৌ সমচোদয়ৎ” বা “অবগায়তং মার্গবিধানসংপদা” শ্লোকাংশে “পদ”-শব্দে গানকে বুঝিয়াছে৷ রামায়ণে পাঠ্য ও গান্ধর্ব-শব্দ-দুটিও গান বা গীতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ঃ “পাঠ্যে চ মধুরম্‌”(রামায়ণ ১.৪.৮), “তৌ তু গান্ধর্বতত্ত্বজ্ঞৌ”(রামায়ণ ১.৪.১০) ৷ নাট্যশাস্ত্রে নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ কিংবা সতাল ও অতাল পদগুলি গান বা গীতি অর্থেই ব্যবহৃত ৷ যেমন —
যৎকিঞ্চিদক্ষরকৃতং তৎসর্বং পদসংজ্ঞিতম্‌৷
নিবদ্ধঞ্চানিবদ্ধঞ্চ তৎপদং দ্বিবিধং স্মৃতম্‌৷৷
অতালঞ্চ সতালঞ্চ দ্বিপ্রকারঞ্চ তদ্ভবেৎ ৷
* * *
অতালমণিবদ্ধঞ্চ পদং তু জ্ঞেয়মেব চ৷৷
– নাট্যশাস্ত্র (কাশী সংস্করণ)(৩২.২৬-২৮)
অথবা —
গান্ধর্বং যন্ময়া প্রোক্তং স্বরতালপদাত্মকম্‌৷
পদং তস্য ভবেদ্বস্তু স্বরতালানুভাবকম্‌ ৷৷
– নাট্যশাস্ত্র (কাশী সংস্করণ)(৩২.২৪)
তাছাড়া আচার্য ভরত নাট্যশাস্ত্রের ২৮ অধ্যায়ে (কাশী সংস্করণ) “গান্ধর্বমিতি বিজ্ঞেয় স্বরতালপদাশ্রয়ম্‌” (নাট্যশাস্ত্র (কাশী সংস্করণ), ২৮.৮) ও “গান্ধর্বং ত্রিবিধং বিদ্যাৎ স্বরতালপদাত্মকম্‌” (নাট্যশাস্ত্র (কাশী সংস্করণ), ২৮.১২) শ্লোকাংশ-দুটিতেও গীতির অবয়ব বা গীতি অর্থে গ্রন্থকার “পদ”-শব্দ ব্যবহার করেছেন৷ স্বর, তাল ও পদ এই তিন রকম আকারে ভরত গান্ধর্বগানের প্রকাশ ও অনুশীলন স্বীকার করেছেন ও তারি জন্য তিনি বলেছেন ঃ “গান্ধর্বং ত্রিবিধং বিদ্যাৎ,” –যদি ও পদের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি পুনরায় বলেছেন ঃ “ব্যঞ্জনানি স্বরাবর্ণাঃ * * ছন্দো বৃত্তানি জাত্যশ্চ নিত্যং পদগতাত্মকাঃ”৷
অনেকে ভরতোক্ত “স্বরতালপদাশ্রয়ম্‌” শ্লোকাংশের “পদ-শব্দকে ছন্দায়িত নৃত্যের প্রতিফলন বলেন৷ কিন্তু “পদ অর্থে নৃত্য না বোঝানোই সঙ্গত৷ আর যদিই বা “পদ” অর্থে লাক্ষণিকভাবে “নৃত্য”-শব্দ বোঝায়, তাহলেও নৃত্য ত্রৌর্যত্রিক সঙ্গীতেরই অবিচ্ছেদ্য বা অপরিহার্য অংশ, সুতরাং “পদ” -শব্দ গীতের অনুবর্তী বা গীতির অবয়ব অথবা গানেরই দ্যোতক৷ কবি কালিদাসের (খ্রীষ্টীয় ১ম-৪র্থ শতক ) কাব্য ও নাটক-গ্রন্থগুলির অনেক জায়গায় “পদ” -শব্দে গান, গীতি বা সঙ্গীত অর্থে ব্যবহৃত দেখা যায়৷ মেঘদূতে (উত্তরমেঘ ৯১ শ্লোক ) বিয়োগবিধুরা যক্ষপত্নী যখন বীণার তন্ত্রীতে গোত্রাঙ্কিত মূর্ছনার প্রয়োগ করে আলাপ করতে উদ্যতা তখন সেই আভিচারিক প্রয়োগ নিষ্ফল হয়েছিল তাঁর চোখের জলে বীণার তন্ত্রী সিক্ত হয়ে৷ কালিদাস বীণাশব্দের প্রসঙ্গেই “পদ”-শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তা গান, সুর বা সঙ্গীতের প্রকাশক৷ টীকাকার মল্লিনাথও সেকথা স্বীকার করেছেন৷ মেঘদূতে কালিদাসের বর্ণনা হ”ল,
উৎসঙ্গে বা মলিনবসনে সৌম্য নিক্ষিপ্য বীণাং
মদ্‌গোত্রাঙ্কং বিরচিতপদং গেয়মূদ্‌গাতুকামা৷
তন্ত্রীরার্দ্রা নয়ন-সলিলৈঃ সারয়িত্বা কথংচি–
দ্ভুয়ো ভূয়ঃস্বয়মধিকৃতাং মূর্ছানাং বিস্মরয়ন্তী৷৷
মল্লিনাথ টীকায় প্রকাশ করেছেন যে, গন্ধর্বকুলসম্ভূতা যক্ষপত্নী গান্ধারগ্রামের প্রয়োগরহস্য অবগত ছিলেন৷ “বিরচিতপদং” শব্দের বিশ্লেষণ করে তাই তিনি বলেছেন ঃ “”বিরচিতানি পদানি যস্য তত্তথোক্তং গেয়ং গানার্হং প্রবন্ধাদি৷ * * দেবযোনিত্বাদ্‌গান্ধারগ্রামেণ গাতুকামেত্যর্থঃ””৷ তাছাড়া অন্যত্র কালিদাস “পদ”-শব্দ গান বা গীতির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন ঃ “ত্বামুৎকণ্ঠাবিরচিতপদম্‌”৷ মল্লিনাথ টীকায় “পদ” অর্থে বলেছেন প্রবন্ধ (প্রবন্ধ বা প্রবন্ধগান অর্থে অঙ্গনিবদ্ধ গান৷ সিংহভূপাল বলেছেন : “”চতুর্ভির্ধাতুভিঃ ষড়্‌ভিশ্চাঙ্গৈর্যস্মাৎপ্রবধ্যতে তস্মাৎপ্রবন্ধঃ কথিতো গীতলক্ষণকোবিদৈঃ””৷ ) বা প্রবন্ধগান বা গান৷
খ্রীষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকের রচিত নাথগীতি গাথা-প্রবন্ধগানের নিদর্শনঃ “আর্যা গাথাদ্বিপথকঃ”৷ ( শার্ঙ্গদেব -রচিত সঙ্গীতরত্নাকর ৪.২৬ এবং ৪.২৩৩) শার্ঙ্গদেব সূঢ়, আলি বা আলিসংশ্রয় ও বিপ্রকীর্ণ এই তিন রকম প্রবন্ধের মধ্যে বর্ণ, বর্ণস্বর, তাল প্রভৃতি ভেদে আলি বা আলিসংশ্রয়-প্রবন্ধগানের রূপ চব্বিশ রকম বলেছেনঃ “বর্ণাদয়স্তালার্ণবান্তাশ্চতুর্বিংশতিঃ” ৷ (সিংহভূপালের টীকা দ্রষ্টব্য৷ আসলে চর্যা “পদ” নয়- “গান” এবং গান ও পদ সমানার্থক নয়৷ তবে সঙ্গীতে পদ গান অর্থেও ব্যবহৃত হয়৷ ) সুতরাং মীননাথ, গোরক্ষনাথ প্রভৃতি যোগীসাধক-রচিত নাথগীতি অভিজাত প্রবন্ধগানেরই রূপ৷
বাংলাসাহিত্যে পদাবলীপ্রসঙ্গে আমরা দু”রকম ধারার সন্ধান পাই ঃ একটি আধ্যাত্মগীতি ও অপরটি নাথগীতি৷ নাথগীতির পর ব্রজযানী বৌদ্ধচর্যাপদগুলি আধ্যাত্মগীতির নিদর্শন৷ সঙ্গীতরত্নাকরে শার্ঙ্গদেব বলেছেন ঃ “অধ্যাত্মগোচরা চর্যা”(৪.২৯২) ৷ নাথগীতির কিছুটা নিদর্শন পাই কবি জয়দেবের অষ্টপদীপ্রবন্ধে বা গীতিগোবিন্দগানে৷ পরবর্তী রাগাত্মিক গান, বাউল এবং কর্তাভজাদি গানও অধ্যাত্মশ্রেণীর৷ দাশরথি রায়ের পাঁচালী, গোবিন্দ আধিকারীর যাত্রা এবং মধুসূদন কিন্নর বা মধুকানের ঢপ্‌কীর্তন পদাবলীকীর্তনভাঙা, কাহিনীমূলক নাটগানের নিদর্শন হলেও সেগুলি ভক্তিরসাত্মক রাধাকৃষ্ণ-লীলাগান ছাড়া অন্য কিছু নয়, সুতরাং অধ্যাত্মগীতি শ্রেণীর অন্তর্গত৷ খ্রীষ্টীয় ১১শ – ১২শ থেকে ১৮শ-১৯শতকে রচিত এ” ধরনের বিচিত্র শ্রেণীর বাংলাগানকে অধ্যাত্মগীতির পর্যায়ভুক্ত করা অসঙ্গত নয়৷