শ্রীরাধাকৃষ্ণেভঃ নমঃ।
সেবা সাধকরূপেণ সিদ্ধরূপেণ চাত্রহি।
তদ্ভাব লিপ্সুনা কার্য্যা ব্রজলোকানুসারতঃ।।
অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।

জয় জয় শ্রীগুরুর চরণারবিন্দ।
যার কৃপাঞ্জনে ঘুচে ভব কূপ অন্ধ।।
সংস্কার দীক্ষা নিয়া মন্ত্র দিয়া শেষে।
ভবসিন্ধু পারাইতে করেন উপদেশে।।
এমন শ্রীগুরু পদে অনন্ত প্রণাম।
যাহার কৃপায় প্রাপ্তি হয় কৃষ্ণধাম।।
জয় জয় বৈষ্ণব গোসাঞি পতিত পাবন।
যার উপদেশে জানি ভজন সাধন।।
বৈষ্ণব সঙ্গ বিনা চিত্তের মলা নাহি যায়।
গুরুকৃষ্ণ তত্ত্ব জানি যাহার কৃপায়।।
অনন্ত বৈষ্ণব গুণ অনন্ত আশয়।
বৈষ্ণব হৃদয়ে কৃষ্ণ বসতি সর্বদায়।।
জয় জয় রাধাকৃষ্ণ জগতের আর্য্য।
অনন্ত আদি দেবগণে করে শিরোধার্য্য।।
জয় জয় কৃষ্ণচন্দ্র মূল বৃক্ষ হয়।
শিব আদি চতুর্মুখে যাহারে ভজয়।।
জয় জয় ঈশ্বরের অবতারগণ।
জয় জয় প্রকাশ আদি করিল বন্দন।।
জয় জয় শক্তিগণ করিব বন্দন।
অনন্ত কৃষ্ণের শক্তি না যায় বর্ণন।।
তার মধ্যে তিন শক্তি সভার প্রধান।
সভার পূজিত হয় কহিল বিধান।।
জয় জয় সরস্বতী যাহার আখ্যান।
তুণ্ডাগ্রে থাকিয়া দেবী করেন ব্যাখ্যান।।
বন্দিব বৈকুণ্ঠপতি লক্ষ্মীর সহিত
লক্ষ্মী আশ্রয় হৈলে হয় জগতে পূজিত।।
জয় জয় যোগমায়া ব্রজের পূজিত।
বিরা বৃন্দা দুই শিষ্য যাহার নিশ্চিত।।
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ
জয় জয় শ্রীজীব রঘুনাথ করিল বন্দন।।
জয় জয় শ্রীরঘুনাথ ভট্টাচার্য।
তাঁর পাদপদ্ম বন্দো করি শিরোধার্য।।
জয় জয় গোপাল ভট্ট পতিত পাবন।
ভক্তি করি বন্দিল আমি তাঁহার চরণ।।
জয় জয় লোকনাথ ভূগর্ভ ঠাকুর।
জীব নিস্তারিতে যার করুণা প্রচুর।।
বৃন্দাবনবাসী যত গৌড়ের ভক্তগণ।
অনন্ত প্রণতি করি সভার চরণ।।
জয় জয় শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোসাঞি।
এমন কবীন্দ্র দয়াল আর হবে নাই।।
যার কবি গ্রন্থ শুনি আনন্দ হৃদিপুর।
অজ্ঞজন বিজ্ঞ হয় সিন্ধান্তে হয় শূর।।
জয় জয় প্রভু মোর লোকনাথ গোসাঞি।
তোমার মহিমা গুণ কহিতে অন্ত নাই।।
গৌড়ে উৎকলে যত আর বৃন্দাবন।
স্থানে স্থানে করি তোমার মহিমা বর্ণন।।
পরম দয়াল তুমি পতিত পাবন।
জগত ব্যাপিয়া আছে মহিমা ঘোষণ।।
করুণায় জগৎ ত্রাণ করিলা গোসাঞি।
এমন দয়াল ঠাকুর আর হবে নাঞি।।
আমি হেন দুষ্ট মতি (দর্শন) করিলা।
পতিত পাবন নাম জগতে রাখিলা।।
মুঞি অতি দুষ্ট মতি দুর্গত পামর।
এমন পাপিষ্ঠ নাহি পৃথিবী ভিতর।।
কামী ক্রোধী লোভী বড় দুরন্ত আশয়।
ছয় রাগের বশ চিত্ত কেবল নিশ্চয়।।
তাতে নীচ নীচাচার ক্রিয়া বিবর্জিত।
দুষ্কৃত অধম অতি পামর চকিত।।
বেদবিধি শাস্ত্রমত তাতে অনাচারি।
ত্রিতাপে তাপিত সদা বুঝিতে না পারি।।
শরীরের মধ্যে মোর যত দোষ হয়।
তাহা বা কহিব কত করিয়া নির্ণয়।।
কলি মধ্যে পাপীর (সংজ্ঞা) জগাই মাধাই হয়।
তাহা হৈতে সহস্রগুণ মুঞি দুরাশয়।।
এক লব কৃষ্ণ প্রেম নাহি মোর অঙ্গে।
স দা কাল ডুবিলু মুঞি বিষয় তরঙ্গে।।
এ মন আমার নষ্ট দুষ্ট অতি।
পাপের তাপে মায়াজালে স্থির নহে মতি।।
এ সব আশয় আমার চরিত্র দেখিয়া।
লোকনাথ গোসাঞি মোরে দিল পদছায়া।।
গোমূত্রে পূর্ণিত কুম্ভ আছে ভাল মতে।
তার মধ্যে দুগ্ধের ঠাঞি হয় কোনমতে।।
তথাপি করুণা করি কৈল কৃপাঞ্জন।
অন্ধকার ঘরে দীপ করিল সিঞ্চন।।
ভগ্ন ঘরে দীপ যেন স্থির নাহি হয়।
তেমতি আমার (অন্তরে) ভক্তি স্থির নয়।।
তথাপি মহৎগুণ সিঞ্চনের বলে।
ভগ্ন ঘরে দীপ যেন কিন্তু কিছু জ্বলে।।
আপনার যত দোষ যতেক বিষয়।
তার অন্ত নাহি বলি শুন মহাশয়।।
সাধুসঙ্গ নাহি তাথে নাহি ভক্তি লেশ।
শাস্ত্র শব্দার্থে কিছু নাহিক প্রবেশ।।
তবে যে বচন কহি প্রভু (র) কৃপায়।
পঙ্গু হইয়া গিরি যেন লঙ্ঘিবারে চায়।।
সেই কথা সত্য হয় শুন মহাজন।
প্রভু কৃপাঞ্জনে অন্ধে দেখে তারাগণ।।
তথাহি–
মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্‌।
যৎ কৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দ মাধবম্‌ ।।
এবে আরম্ভ করি গ্রন্থ বিবরণ।
দোষাভাস ক্ষেমা দিবে শুন শ্রোতাগণ।।
শ্রোতা পদতলে মোর এহি নিবেদন।
দোষ ক্ষেমি রসগুণ করিবে গ্রহণ।।
এবে আরম্ভ করি ভজন প্রয়োজন।
যাহারে শুনিলে পাবে যুগল চরণ।।
শ্রীগুরু চরণ আশ্রয় করিব দড় করি।
সংস্কার দীক্ষা মন্ত্র বুঝিব বিচারি।।
হরিনাম কৃষ্ণ মন্ত্র আশ্রয় করিব।
নামমন্ত্র অর্থতত্ত্ব ভেদিয়া বুঝিব।।
যদি তাতে সন্দেহ হয় বুঝিতে না পারে।
সেই জন মুক্ত নহে কহিল বিচারে।।
তথাহি পাদ্মে —
তদ্দৃঢ়ঞ্চ হতং জ্ঞানং প্রমাদেন হতং শ্রুতম্ ।
সন্ধিগ্ধিহি হতো মন্ত্র ব্যগ্রচিত্তে হতং জপঃ ।।
তটস্থ রূপে জপ্য দৃঢ় ভাব করি।
চিত্ত নির্মল কর এসব আচরি।।
তারপরে অন্তর্গত ভক্তি কর সার।
চতুষষ্ঠী অঙ্গ ভক্তি করিবা বিচার।।
তার মধ্যে নবধা ভক্তি মুখ্য অঙ্গ গণি।
শ্রবণাদি করি হয় কহিলা বাখানি।।
তথাহি —
শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণো স্মরণং পাদসেবনম্‌ ।
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্‌।।
তার মধ্যে পঞ্চবিধা সর্ব মুখ্য হয় ।
অল্প করিলে ভক্তি প্রেমের উদয়।।
সাধুসঙ্গ নামকীর্তন ভাগবত শ্রবণ।
মথুরা বাস শ্রীমূর্তির শ্রদ্ধায় সেবন।।
তথাহি —
ন সাধয়তি মাং যোগেন সাঙ্খ্যং ধর্ম্ম উদ্ধব।
ন সাধ্যয়স্তু যথা ভক্তি মামার্জিত ।।
তটস্থ রূপে বাহ্য দশায় এসব আচরণ।
দৃঢ়মতি হৈঞা ইহাঁ করিব সাধন।।
কিন্তু ইহাঁ মর্য্যাদ মার্গে করিব স্মরণ।
সাধন অঙ্গে করিলে অন্য ধামেতে গমন।।
সাধুসঙ্গে ইহাঁর বিচার দড় করি সার।
সাধক সিদ্ধির ভাব বুঝিব বিচার।।
শ্রীগুরুচরণারবিন্দে ভাবনা অনুসার।
সাধনচন্দ্রিকা লক্ষণ করিব বিচার।।
স্থানে স্থানে এসব বিচার সর্ব গ্রন্থে হয়।
কবিরাজ গোসাঞি তাহা করিছে নির্ণয়।।
পুনরপি সেই কথায় নাহি প্রয়োজন।
গ্রন্থ বাঢ়ে পুন তাহা করিলে বর্ণন।।
এবে শুন অন্তর্দশায় যে রূপে সাধিব।
তাহার লক্ষণ কিছু সংক্ষেপে কহিব ।।
দেশকালপাত্র মনে বিচার করিয়া।
সাধকরূপে অন্তদশায় উপস্থিত হৈঞা।।
দেশ শ্রীবৃন্দাবন কাল দিব্য দ্বাপর।
পাত্র শ্রীরাধাকৃষ্ণ জানিব অন্তর।।
শ্রীরূপমঞ্জরীর আজ্ঞায় করিব সেবন।
সিদ্ধের স্বভাব হৈঞা উল্লসিত মন।।
শ্রীরূপমঞ্জরী মোরে কর দয়া।
চরণে স্মরণ লৈলু দেও পদছায়া ।।
শ্রীরূপ(৫ক) মঞ্জরী পাদপদ্ম করি আশ।
সেবা অভিলাষ মাগে নরোত্তম দাশ।।
কাতর হইঞা নরোত্তমে কিছু বুলি ।
কৃপা করি পদছায়া দেও মঞ্জলালি।।
অষ্টকাল সময় বুঝি করিব নিরূপণ।
সখিগণ সঙ্গে সেবা যখনে যেমন।।
প্রাতঃকাল অবধি সেবা শুন মন দিয়া।
যেরূপে করিব সেবা সাধক রূপ হৈঞা।।
প্রাতঃকালে বস্ত্র অলংকার মার্জনা করিব।
পাত্র আদি তাম্বুল জল সংস্কার করিব।।
চন্দন কুঙ্কুম পিষি করিব সঞ্চন ।
দন্ত কাষ্ঠ শ্রীমতিকে করিব সমর্পণ।।
তার পরে ডাবর দিব মুখ প্রক্ষালিতে।
আম্রপল্লব পট্‌টি দিব কর্পূর সহিতে।।
উদ্ধর্তন সয্য তবে নির্মাণ করিব।
কাপড়ে কানিয়া মএদা কর্পূর তাহে দিব।।
তার সঙ্গে কস্তুরি দিব মিশাল করিয়া।
উদ্ধর্তন সয্য এই কহিল বিবরিয়া।।
তারপরে চতুসম করিব নিয়োজন।
তাহার লক্ষণ কহি করিয়া বর্ণন।।
চন্দন চারিভাগ দিব কুঙ্কুম তিন ভাগ।
কস্তুরি দুই ভাগ দিব কর্পূর এক ভাগ।।
এই চারি দ্রব্য পিষি একত্রে মিশন।
চতুসম সয্য এহি কহিল লক্ষণ।।
তারপরে বর্ণক দিব নির্মাণ করিয়া।
যে যে দ্রব্য লাগে তাহে শুন মন দিয়া।।
রক্ত চন্দন সাদা চন্দন সুপারি কসায়ন।
কুঙ্কুম কস্তুরি খএর প্রথেক নিয়োজন।।
হরিতাল সিন্দূর আ(র) কজ্জ্বল করিব ।
নব প্রকার বর্ণক হয় বিধানে বুঝিব।।
নারায়ণ সুগন্ধি তৈলে করিব মর্দন।
তৈল সেবা করি অঙ্গে করিব চিক্কণ।।
উদ্ধর্তন দিয়া অঙ্গে মার্জন করিব।
মার্জন করিয়া অঙ্গের তৈল উঠাইব।।
তার পরে শ্রীমতীর স্না(ন) সয্য করি।
অমলকির কল্‌কা দিয়া মাজিব কেশোপরি।।
অমলকির কল্‌কা হয় শুন বিবরণ।
সান্দা সিথি ঘিনা তৈল একত্র মিলন।।
তাহা দিয়া শ্রীমতীকে স্নান করাইব।
চীন বস্ত্রে অঙ্গের কেশের জল উঠাইব।।
বস্ত্র আনি তারপরে করিব সমর্পণ।
নীল ষোড়ন পট্ট সাড়ি করিব সাজন।।
ইহা পরে আউস্তাতে করি অগ্নি জ্বালাইব।
তার মধ্যে আগোর চন্দনাদি দিব।।
কেশ সংস্কার করি বেণী বন্ধ করিব।
তারপরে বেশভূষা শ্রীমতীর করিব।।
বেশ আদি যে যে দ্রব্য শুন দিয়া মন।
নূপুর পঞ্চম পদে যাবক রঞ্জন।।
জ্বড়ি রাঙ্গা নীল শাড়ি সোনার বুটা তায়।
সোনার কিনারি নীল উড়ানি দিব গায়।।
ক্ষুদ্র … … মোতি মুকুরাদি দিব।
ছাপ কলি মোহন মালা অঙ্গে পরাইব।।
চন্দ্রহার কস্তুর মণি ধুকধুকি দিয়া।
হিরাজোর বেষ্টিত নীল চুড়ি পরাইয়া।।
খাষিয়া কঙ্কন পঠি আসি মুদ্রার ক্ষটনি।
সোনার জিজীরা গজ মুক্তার নখনি।।
সিথি সিরিষী ফুল মোতি করকা দিব।
বিনিমূলে পট্ট ডোরে বন্ধ করিব।।
কপালে সিন্দুর মধ্যে স্তীকা চন্দন বেষ্টিত ।
ঝলকে কোটি চন্দ্র সূর্য দেখিতে শোভিত।।
সংক্ষেপ কহিল শোন (শৃঙ্গার ?) নির্ণয়।
কার শক্তি আছে তাহা বিস্তারিয়া কয়।।
এহি রূপে কৃষ্ণচন্দ্রের রূপবেশ নিরক্ষিব।
যে কিছু বেশ হয় তাহা সংক্ষেপে কহিব।।
নবজলধর জিনি অঙ্গের বরণ।
রক্তোৎপল জিনি তাঁর দুখানি চরণ।।
দুই পদে দশ চন্দ্র ঝলমল করে।
দেখিতে নয়নে সুখ আনন্দ বিহরে।।
দুই হস্তে দশ চন্দ্র অতি শোভা তায়।
গণ্ডস্থলে দুই চন্দ্র ঝলকে সদায়।।
দুই চক্ষে দুই চন্দ্র দেখিতে সুন্দর।
ললাটে অর্দ্ধ চন্দ্র তাঁর করে ঝলমল।।
সার্দ্ধ চর্তুবিংশতি চন্দ্র কৃষ্ণ শোভা সনে।
সে রূপ দেখিয়া গোপীর বিদরে পরাণে।।
পীতাম্বরধর কৃষ্ণ শ্রীঅঙ্গে (বিহরে)।
ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা ঠাম বংশী দুই করে।।
মস্তকেতে চুড়া তাঁর বামেত টালনি।
ময়ূরের পুচ্ছ তার চুড়ার সাজনি।।
নবগুঞ্জা মালা তাতে করিয়া বেষ্টিত।
বৈজয়ন্তী মালা গলে দেখিতে শোভিত।।
চরণে নূপুর পরে চন্দ্রহার গলে।
সোনার তোড়ন মোহন মালা কণ্ঠে দোলে।।
ক্ষুদ্র … … কিঙ্কিণী মণিহার।
কস্তুব মণি ধুক ধুকি অতি শোভা যার।।
কর্ণে লাল কুণ্ডল দুই ঝলমল করে।
দেখিয়া রমণী মন অন্তর বিদরে।।
এহিরূপে কৃষ্ণ রূপ করিব নিরক্ষণ।
এবে কহি সময় অনুরূপ সেবা যখনে যেমন।।
শ্রীরূপমঞ্জরীর পাদপদ্ম করি আশ।
সেবা অভিলাষ মাগে নরোত্তম দাস।।
বেশভূষার পরে সূর্য পূজার সয্য করিব।
শ্রীমতীর আজ্ঞায় বিস্মৃত মুক্তামালা আনি দিব।।
তারপরে নন্দীশ্বরে পাকের কারণ।
তাম্বুল পাত্র আদি সঙ্গে করিব গমন।।
নন্দীশ্বরে যাইয়া যদি হৈব উপস্থিত ।
লঘুপাক গুরুপাক যে সব হএ বিহিত।।
লঘুপাক খিরাদি (রন্ধন) করিয়া।
ভোজন মাত্র এ দ্রব্য যায় ভস্ম হৈঞা।।
গুরুপাক লুচি পুরি মলুফা কচুরি।
পিঠা পলো নাড়ু আদি যত কহি বিবরি।।
যে যেই কার্যের সন্ধান জানে সখিগণ।
সেইরূপে কার্য করে হৈঞা সাবধান।।
সাতদণ্ড বেলা যা(ই)তে রসুই হইল।
সখাগণ সঙ্গে কৃষ্ণ ভোজনে বসিল।।
রোহিণী দেবী পরিবেশে শ্রীমতী দেয় আগুসারি।
ভোজন কালে যত সুখ কহিতে না পারি।।
ভোজন (কৌতুক ?) সখি করে দরশন।
শ্বেত চামরে শ্রীমতীকে করেন বিজন।।
ভোজন করি কৃষ্ণচন্দ্র আচমনে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ অবশেষ পাত্রে শ্রীমতী বসি খায়।
পটোলাদি বাসিত জল তাতৈ লবঙ্গ ঘর্ষণ।
শ্রীমতীর আগে সখী করে সমর্পণ।।
ভোজন পরে আচমন পাত্র আনিয়া।
দন্তকাষ্ঠ দেয় তবে সাবধান হৈঞা।।
আসনে আসিঞা যদি হয় উপস্থিত।
তাম্বুলের পাত্র আনি করে বিদিত।।
তাম্বুলের বাটীকাতে যে যে দ্রব্য হয়।
তাহার বিধান কহি শুনহ আসয়।।
কাপড় কানা মএদা তাতে কর্পূর মিশাইব।
সুপারি দুগ্ধের মধ্যে প্রক্ষালন করিব।।
খদির কেঞা পত্রে শুখাব দড় করি।
তাম্বুলের শিরা ফেলি লবঙ্গাদি ভরি।।
কর্পূরাদি তার মধ্যে বিটিকা বন্দন।
এহি রূপে তাম্বুল সয্য করিব সখিগণ।।
রাত্রিশেষে দোহঁ বস্ত্র পরিবর্তাইঞা থাকেন।
সেই বস্ত্র সুবলের দ্বারায় সখি দেন।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদ পদ্ম করি ধ্যান ।
সংক্ষেপে কহিল প্রথম কালের আখ্যান।।
শ্রীমঞ্জলালি পাদপদ্ম করি আশ।
সেবা অভিলাষ মাগে নরোত্তম দাস।।
দশ দণ্ড বেলা যা(ই)তে পূর্বাহ্নের কালে।
গোচারণ ছলে কৃষ্ণ বিপিনেতে চলে।।
সেই কালে শ্রীমতী যায় পথ আগুয়ান।
ঠারাঠারি দোহজন নয়ানে সন্ধান।।
তবে যাবট গ্রামে করিলা গমন।
তাম্বুল পাত্র জল পাত্র সঙ্গে সখিগণ।।
পথে যাইতে কৃষ্ণচন্দ্র করে দরশন।
ভঙ্গি হাস্য কথা কহে যত সখিগণ।।
তাহা দেখি রাধাকৃষ্ণ আনন্দ হইলা।
সখিগণ সঙ্গে রাই জাবটে আসিলা।।
উপস্থিত মাত্র তবে জটিলা তখন।
সূর্য পূজার হেতু তুমি করহ গমন।।
কহিতে লাগিলা তবে সব বিবরণ।
বৃদ্ধ লোক সঙ্গে যাও সূর্যের পূজন।।
বৃদ্ধ বাল্যা সখী তুমি সঙ্গে করি যাবে।
সূর্য পূজা করি তুমি শীঘ্র গৃহে আসিবে।।
পুনর্বার পাত্রাদি সঙ্গে যত সখিগণ।
সূর্য পূজা করিবারে করিলা গমন।।
সূর্যপূজার যত দ্রব্য শুন দিয়া মন।
নারিকেল তণ্ডুল যাব আদি যত হয়েন।।
ধান্য তিল ধূপ দীপ মধু আদি যত।
সূর্য পূজার সামগ্রী কে বর্ণিবে কত।।
এহি (সব) সামগ্রী সয্য করিয়া।
সূর্যালয় গেলা সব সখিগণ নিঞা।।
দশদণ্ড বেলা (যাইতে) উপস্থিত হৈলা।
সূর্যের মণ্ডপে সবে তখনে মিলিলা।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল পূর্বাহ্ন কালের আখ্যান।।
শ্রীমঞ্জলালী সখী কর মোরে দয়া।
চরণে স্মরণ নিলাঙ দেও পদছায়া।।
এবে কহি শুন মধ্যাহ্ন কালের বিবরণ ।
শুনিতে শ্রবণ সুখ কর্ণে রসায়ন।।
বৃদ্ধলোক সূর্যস্থলে করিয়া বঞ্চন।
পুষ্প তুলিবার ছলে যায় সখিগণ।।
গোবর্ধন সখাগণে বঞ্চনা করিঞা।
জল খাবার ছলে কৃষ্ণ আসিল চলিয়া।।
সুবল মধুমঙ্গল সঙ্গে মিলন হইল।
প্রেমরস সমুদ্রে দোহে ভাসিতে লাগিল।।
তার মধ্যে পুষ্পশয্যা নির্মাণ করিঞা।
দোহাকার হস্তে ধরি বসাইল নিঞা।।
সুবাসিত জলে দোহার পাদ প্রক্ষালিল।
নিজ কেশে সখিগণে জল উঠাইল।।
স্বর্ণদণ্ড পাখা আর শ্বেত চামর নিঞা।
দোহাকে বিজন করে হরষিত হৈঞা।।
তারপরে মধু আনি সংস্কার করি।
চসমার পাত্রে পূর্ণ সম্মুখে দিল ধরি।।
তবে কর্পূরাদি তাম্বুল করিল সমর্পণ।
তাম্বুল চর্বিত প্রসাদ সখি আস্বাদন।।
রসপ্রেম দোঁহাকার উদয় হইল।
মন্দির হইতে সখিগণ বাহিরে আসিল।।
মন্দির ভিতরে দুঁহার রস যুদ্ধ হৈল।
বাহিরে থাকিয়া সখিগণ শুনিতে লাগিল।।
চরণে নূপুর বাজে হস্তের কঙ্কণ।
যে আনন্দ হইল তাহা না যায় বর্ণন।।
তারপরে বিপরীত শৃঙ্গার আরম্ভন।
ধ্বজ বজ্র গোষ্যা আদি করে নিরক্ষণ।।
সম্ভোগের পরে কুঞ্জে প্রবেশ করিয়া।
পা(দ) সম্বাহন কৈল সখিগণ যাঞা।।
পটোলাদি বাসিত জল কৈল সমর্পণ।
তারপরে চিত্র করিতে হৈল আরম্ভন।।
বাহুতে গণ্ডদেশে কপালে চিত্র করে।
দোহাকার চিত্র করে আনন্দ বিহরে।।
তারপর তিলক দোহারে করিল নির্মাণ।
কামচন্দ্র শ্রীমতীর তিলক হৈল মূর্তিমান।।
শ্রীকৃষ্ণের তিলক হইল মকর আকৃতি।
যাহা দেখি যুবতীর স্থির নহে মতি।।
তারপর চতুসম দেহে অঙ্গে দিলা।
(পুষ্প) হার আনি সখী গাথিতে লাগিলা।।
কোন সখী পুষ্প আনি করিল সঞ্চন।
বৈজয়ন্তী মালা যাতে করিল গুম্ফন।।
হার মালা পুষ্প মালা গুম্ফন করিয়া।
কৌতুকে দোহার হস্তে সখি দিল গিয়া।।
তবে দোঁহে উভয় মালা দোঁহ গলে দিল।
প্রেমরসে দোহ জন মগন হইল।।
স্বর্ণ কাঁকুই দিঞা কেশ সংস্কার কৈল।
চিবুকে কস্তুরি বিন্দু নির্মাণ করিল।।
দোঁহ দোঁহ রূপ দেখি বাহ্য পসারিল।
রস আস্বাদন লাগি সুস্থির হইল।।
তারপরে পঞ্চামৃত বটিকা সমর্পণ।
বটিকার কথা কহি শুন বিবরণ।।
কদল কুণ্ডল মাষ নারিকেল আদি শস্য।
গোল মরিচ ঘন দুগ্ধ করিব অবশ্য।।
লবঙ্গ এলাইচ জাতিফল কর্পূর।
ঘৃত ভাজা খণ্ড পঙ্ক করিব প্রচুর ।।
এহি দশ দ্রব্য একত্র করিয়া।
অমৃতা কলি বটিকা বান্ধে আনন্দিত হৈঞা ।।
সামিক্ষ শনি চূর্ণ ছেনা দধি মরিচ।
সিতা মিশ্র নারিকেল শস্য তাহাতে পূরিত।।
জাতিফল এলাইচ লবঙ্গ তাতে দিঞা।
অমৃত কলা মুগ্ধ ফেণী ঘৃত পঙ্ক করিয়া।।
এই সব সামগ্রী মধুতে ভিজাইব ।
ঘন দুগ্ধ করি তার মধ্যেত রাখিব।।
এহি পঞ্চদশ দ্রব্য কর্পূরা কলি নাম।
এবে কহি পীযূষ গ্রন্থি করিঞা বিধান।।
কর্পূরা কলির সর্ব দ্রব্য একত্র করিব।
গ্রন্থির বটিকা পঞ্চামৃতে ভিজাইব।।
এহি বিংশতি দ্রব্যে পীযুষ গ্রন্থি হৈল।
অনঙ্গ গুটিকা এবে কহিতে লাগিল।।
ক্ষীর সরে কর্পূর তণ্ডুল চূর্ণ করিব।
নারিকেল জাতিফল লবঙ্গ তাতে দিব।।
গোল মরিচ সিতা মিশ্রি রম্ভা তাতে দিব।
এলাইচ আর এ সব দ্রব্য ঘৃতেতে ভাজিব।।
এহি একাদশ দ্রব্য অনঙ্গগুটিকা নাম।
সিধু বিলাসের এবে কহি এ বিধান।।
ঘন দুগ্ধ গোল মরিচ কদল কুণ্ডল।
খণ্ড গোধূম তাতে দিব ভুরি জাতি ফল।।
নব প্রকার মধু তাথে যত কিছু হয়।
সিধু বিলাসবটিকা এহি কহিল নিশ্চয়।।
এহি পঞ্চামৃত বটিকা কহিল বিবরণ।
যাহার শ্রবণে হয় কর্ণ রসায়ন।।
তারপরে মনোহর নাড়ু শীতল জল দিল।
কোন সখী যাইঞা মধফল উঠাইল।।
সংস্কার করি জল করিল সমর্পণ।
আনন্দে ভোজন তাঁহা করিল দুইজন।।
কখন সুদেবীর কুঞ্জে পাক সেবা হয়।
পরস্পর দুই জন হাস্য কথা কয়।।
বনবিহারে দুইজন করিল গমন।
তার মাঝে বসন্তলীলা হিন্দোলা দোলন।।
জল ক্রীড়া করে তাথে পাসা আদি খেলা।
বীণা যন্ত্র সঙ্গে করি সখিগণ গেলা।।
সেই স্থানে দোহার পদ কৈল প্রক্ষালন।
নিজ কেশে দোহার পদ মোছে সখিগণ।।
তারপরে পুষ্প দিয়া যন্ত্র সাজাইল।
শ্রীমতীর হস্তে আনি সখী সমর্পিল।।
হিন্দোলাতে রাধাকৃষ্ণ দোলিতে লাগিল।
যন্ত্র বাদ্য করি দোঁহ গান আরম্ভিল।।
এই মতে কতক্ষণ রসবেশ কৈল।
তারপর শ্রীকুণ্ডে আসি উপস্থিত হৈল।।
তা র আগে কোন সখী বস্ত্র অলঙ্কার নিঞা।
কুণ্ড তীরে আসি তিহোঁ থাকেন বসিঞা।।
তারপরে পাসা খেলা করিতে লাগিল।
হাস্যরসে দুই জনে বাক্য পণ কৈল।।
শ্রীমতী করেন পণ আমি যদি হারি।
মৃগী ময়ূরী হংসী কঙ্কণাদি করি।।
গলের গজমোতি হার দিবেক তোমারে।
তুমি হারিলে কি কি দিবে কহত আমারে।।
কৃষ্ণচন্দ্র বলে আমি যদি পরাভব হব ।
মৃগী ময়ূর কিঙ্কিণী বংশী বেণু দিব।।
তারপরে দোহ জন খেলিতে লাগিল।
খেলিতেই কৃষ্ণচন্দ্র পরাভব হৈল।।
শ্রীমতীর ইঙ্গিত পাঞা যত সখিগণ।
হরিণ ময়ূর আনি করিলা বন্ধন।।
কেহ নিল বংশী কেহ নিল বেণী।
স্তব্ধ হৈল কৃষ্ণচন্দ্র পরাভব মানি।।
অনেক প্রণতিএ কৃষ্ণ সব ছাড়াইল।
দেখি শুনি সখিগণ আনন্দে ভাসিল।।
তারপরে সূর্যালয় করিল গমন।
পুষ্প তুলসী আদি পূজার সয্য যত হন।।
সর্ব দ্রব্য লৈঞা তবে সূর্যালয় আইলা।
ব্রহ্মচারী আসি পূজার বিধান করিলা।।
সর্ব দ্রব্য আনি দিল যত সখিগণ ।
পূজার আরম্ভ তবে কতিল ব্রাহ্মণ।
সূর্য পূজার পরিপাটি করিল ব্রহ্মচারী।
শীঘ্র পূজা সম্ভবিল বিলম্ব না করি।।
সেইকালে চব্বিশ দণ্ড বেলা পরিমাণ।
ব্রহ্মচারী সূর্য পূজা কৈল সমাধান।।
মোরে যদি দয়া করে শ্রীমঞ্জলালি।
তবে সে দেখিতে শক্তি দোহাঁ রস কেলি।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল তৃতীয় কালের আখ্যান।।
তারপর সখি সঙ্গে শ্রীমতী চলি গেল।
দিন অবসানে তবে জাবটে আসিল।।
পক্বান্ন মিষ্টান্ন সজ্জ করিতে লাগিল।
যার যেই অনুরূপ সেই কার্যে গেল।।
ত্রিশ দণ্ড পরে তবে শ্রীমতী আপনে ।
কৃষ্ণ লাগি মালা গাথে আনন্দিত মনে।।
তারপরে কৈল রাই স্নান আচরণ।
কিঞ্চিৎ পরে মিঠাই করিল ভক্ষণ।।
তারপরে বেশভূষা কৈল সখিগণ।
পূর্ববৎ বেশ কৈল যেখানে যেমন।।
শ্রীমঞ্জলালি সখী মোরে কর দয়া।
চরণে শরণ লইল দেও পদছায়া ।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদ পদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল অপরাহ্ন কালের আখ্যান।।
সন্ধ্যাকালে মিষ্টান্ন পক্বান্ন পুষ্পমালা।
তাম্বুল বিটিকা লৈঞা নন্দালয়ে গেলা।।
শ্রীরতিমঞ্জরী গেলা দ্রব্য আহরণে।
শ্রীকস্তুরী সঙ্গে করি করিল গমনে।।
মিষ্টান্ন পক্বান্ন মালা তাম্বুলাদি করি।
সুবল দ্বারায় দিল শ্রীরতিমঞ্জরী।।
সুবলের দ্বারা তবে সংকেত কথা হৈল।
কৃষ্ণ অবশেষ প্রসাদ সঙ্গে করি লৈল।।
জা বটে আসিয়া তবে শ্রীরতিমঞ্জরী।
প্রসাদ বাটিয়া দিল সমস্ত বিবরি।।
তারপরে আউস্তের (?) ধামের সাজন।
পটোলাদি শীতল জল কৈল সমর্পণ।।
আচমনাদি পাত্র তবে দিল সখিগণ।।
কর্পূর তাম্বুল বিটিকা জল করিল সমর্পণ।।
তারপরে শ্রীমতীর প্রসাদ যত সখিগণ।;
খাইল সমস্ত সখি করিয়া বন্টন।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহি অন্যকালের (?) আখ্যান।।
তারপরে সময়ানুরূপ বেশভূষা করিব।
বস্ত্র অলঙ্কার পরি যত বৃন্দাবনে যাব।।
সময়ানুরূপ বেশ তাহা শুন বিবরণ।
শুক্ল পক্ষে শুক্ল বস্ত্র করয়ে ধারণ।।
গলে গজমোতি হার দেয় সর্বজন।
শুক্ল ঘাঘরা পরে প্রতি জনে জন।।
গজ্ব দন্তে চুড়ি হস্তে চন্দন চর্চ্চিত।
শুক্ল পক্ষের বেশ এই জানিবে নিশ্চিত।।
কৃষ্ণ পক্ষে নীল চুড়ি নীলবস্ত্র পরিয়া।
কস্তুরির চর্চা তবে সভার অঙ্গে দিয়া।।
নীলমণি হার গলে জনে জন।
কৃষ্ণপক্ষের বেশ এহি কহিল নিরূপণ।।
এহি রূপে বেশভূষা করি সখিগণ ।
দশ দণ্ড রাত্রি পরে যায় বৃন্দাবন।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদ পদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল নক্ত কালের আখ্যান।।
রাত্রিকালে বৃন্দাবনে করিল গমন।
শ্রীমতীকে সঙ্গে করি যত সখিগণ।।
নিভৃত নিকুঞ্জবনে করিল প্রবেশন।
সেই স্থানে রাধা কৃষ্ণের হইল মিলন।।
মিলন সময় যত আনন্দ হইল।
আনন্দ সাগরে সব ভাসিতে লাগিল।।
বাহু বাহু দুইজনে করিল মিলন।
হাস্য রস করি কৃষ্ণ করেন চুম্বন।।
কখন বক্ষেতে রাখে ক্ষেণে উরুপর।
অঙ্গে অঙ্গে মিশামিশি হএ একত্তর।।
অঙ্গে অঙ্গে হাতে হাত হয় মুখে মুখ।
এইরূপে কতক্ষণ করি(ল) কৌতুক।।
যন্ত্রাদি লইয়া কুঞ্জ হইতে বাহিরিল।
নিধুবনে রাসস্থলে প্রবেশ করিল।।
রাসস্থানে গিঞা রাই নৃত্য আরম্ভিল।
চরণে নূপুর পঞ্চম বাজিতে লাগিল।।
কৃষ্ণচন্দ্র তাল বাদ্য বাজান আপনে।
সেই বাদ্যে শ্রীরাধিকা করেন নর্তনে।।
তথাহি তালবাদ্যং —
তথথৈ তথথৈ থৈ থৈ তথৈঞা তথৈঞ।
ধাঁ ধাঁ নুক নুক চঙ চঙ ততু কতুং তুং।।
গুড়ু গুড়ু গুড়ু দ্রাং ধৈক ধৈক থি থি নটতি।
ঝননং ঝঁ ঝঁ দুগতাং দুগতাং তাং তাং তি।
ধিকতাং ধিকতাং ধিং ধিং ধী।।
এহি রূপে কৃষ্ণচন্দ্র করে বাদ্য তান।
সেই বাদ্যে শ্রীমতী নাচে করিঞা সুঠান।।
তারপরে শ্রীমতী তাল আ(লা)প ধরিল।
সেই বাদ্যে কৃষ্ণচন্দ্র নাচিতে লাগিল।।
তথাহি —
বিতাতাং বিতাতাং তাং তাং তা।
রুণু রুণু ঝুনু ঝুনু ধিকতাং ধা।
ত্রা ত্রা থৈ থৈ দৃগতাং দৃগতাং তা বিং বিং।।
দ্রীং দ্রীং থৈ থৈয়া থৈ থিয়া থা।।
এহি মতে শ্রীমতী তাল বাদ্য করিল।
সেই বাদ্যে কৃষ্ণচন্দ্র নর্তন করিল।
বংশীতে গান করে তবে তালের সহিত।
তাহা শুনি শ্রীমতীর চিত্ত হইল স্থগিত।।
তারপরে শ্রীমতীর হাতে যন্ত্র দিল।
যন্ত্র বাদ্য শুনি কৃষ্ণ মোহিত হইল।।
এহিরূপে দোহ দোহার হইল নর্তন।
তারপরে আজ্ঞা দিল যত সখিগণ।।
সখিগণ নর্তন গান করে সর্বজন।
শ্রীরূপমঞ্জরিকার তাম্বুলা সেবন।।
তবে স্বর্ণ দণ্ড পাংখা চামর বিজন।
ভক্ষ দ্রব্য আদি কুল দেয় সখিগণ।।
পুরী ক্ষীর আর পিঠাপানা।
পানষ খর্জুর আম মিষ্ট ফল নানা।।
রাধাকৃষ্ণ একস্থানে করিল ভোজন।
সখিগণ দোহার প্রসাদ করিল ভক্ষণ।।
রত্ন মন্দিরে কৈল শয্যার রচন।
শ্রীরূপমঞ্জরিকার তাম্বুল সেবন।।
বিশ দণ্ড রাত্রি যখন হৈল পরিমাণ।
রত্ন মন্দিরে দোহ করিল শয়ন।।
যার যেই কুঞ্জ তবে গেলা সখিগণ।
তবে দোহ সম্ভোগ রস কৈল প্রকটন।।
যার যত মনের বাঞ্ছা হইল পূরণ।
দুঃখ সুখ কথা তাহাঁ কহে দুইজন।।
এহিরূ(পে) চারি দণ্ড রসপুষ্টি হইল।
চব্বিশ দণ্ড পরে দোহে নিদ্রায় পড়িল।।
মোরে যদি কৃপা করে শ্রীমঞ্জলালি।
তবে সে দেখিতে শক্তি দোহা রসকেলি।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল নিশাকালের আখ্যান।।
দুই দণ্ড নিদ্রা পরে আল্য সখিগণ।
শ্রমালসে পড়ি নিদ্রা যায় দুই জন।।
বক্ষে বক্ষে উরু উরু অধরে অধর।
নীল অঙ্গে গৌর অঙ্গে দেখিতে সুন্দর।।
নীল পর্বত যেন কনকে বেষ্টিত।
দুইজন জড়াজড়ি দেখিতে (শোভিত)।।
বৃন্দা দেবী পক্ষীগণে (তবে) আজ্ঞা দিল।
দোঁহা জন জাগাইল করি কোলাহল।।
জাগিলেন দোহজন আলসে পূর্ণিত।
নিদ্রায় আকুল তনু হঞাছে ঘূর্ণিত।।
তবে দোহ আরম্ভ কৈল বেশ করিতে।
দোহার বস্ত্রে মুখ লাগিলা মুছিতে।।
সখিগণ তুলি বর্ণক দিল আগুসারি।
দোহ দোহার চিত্র কৈল অতি শীঘ্র করি।।
মঙ্গল আরতি করে যত সখিগণ।
কাতর বচনে কহে শ্রীমতী (তখন)।।
শাশুড়ী দুর্জন (বড়) ননদী কুটীল।
বাক্য কথা কটু বাণী দুষ্ট হাসিল।।
এত বলি হাতাহাতি বাহিরে আসিল।
দোহা বস্ত্র পরিবর্তন কেহ না জানিল।।
স্বর্ণহার মুক্তাহার ছিণ্ডাইঞা ছিল।
বস্ত্রের অঞ্চলে বান্ধি সখিগণ দিল।।
তাম্বুল চর্বিত দোহার বন্টন করিল।
তাম্বুল পাত্র জলপাত্র সঙ্গে করি নিল।।
নন্দীশ্বরে কৃষ্ণচন্দ্র করিল গমন।
যাবটে মন্দিরে প্রবেশিলা সখিগণ।।
রত্ন সিংহাসনোপর করিল শয়ন।
নিশ্চিন্ত হইঞা নিদ্রা যায় সর্বজন।।
শ্রীমঞ্জলালি সখী মোরে কর দয়া।
চরণে শরণ লইলাঙ দেও পদছায়া।।
শ্রীরূপমঞ্জরী পাদপদ্ম করি ধ্যান।
সংক্ষেপে কহিল রাত্রান্ত কালের আখ্যান।।
এহি রূপে অষ্ট কাল স্মরণ মনন।
সাধক রূপে কর সেবা যখনে যেমন।।
সিদ্ধের স্বভাব হৈঞা করিব মনন।
অন্তর্দশায় উপস্থিত হবে বৃন্দাবন।।
এরূপ ভাবে না উদয় যে রূপে হইব।
তাহার লক্ষণ কিছু সংক্ষেপে কহিব।।
তালযন্ত্র বৈনীক চিত্তে করে সঞ্চয়ন।
ক্রমে ক্রমে লাগে বাদ্য হএত পুরণ।।
এহি রূপে সাধকে করে সিদ্ধের সংজ্ঞাশ্রয়।
দেশকাল পাত্র ভেদ মনেতে ভাবয়।।
বিনিকের চিত্তে গান থাকে অনুক্ষণ।
তেমতি সাধকরূপে করিব ভাবন।।
যদবধি বীণা যন্ত্রে ভেদ নাহি হয়।
তদবধি গান যন্ত্রে সুখ না জন্ময়।।
দাসের অন্তর্ভূতে যদি সাধক না বাসিব।
সেই জন ব্রজের ভাব কোথা হৈতে পাব।।
বিনিকের অন্তর্ভূতে সদা থাকে গান।
যন্ত্র বাদ্য নাহি হয় কখন বাজান।।।
তেমতি সাধকে করিব (একান্ত) ভাবন।
ক্রমে ক্রমে (লাঘব কৈলে) পাবে প্রেমধন।।
সদা কাল লাঘব কর সাধন ভজন।
(অবশেষে হবে) প্রাপ্তি শ্রীবৃন্দাবন।।
শ্রীলোকনাথ গোস্বামীর পাদপদ্ম আশ।
(সাধন চন্দ্রিকা কহে) নরোত্তম দাস।।

ইতি শ্রীসাধনচন্দ্রিকা সমাপ্ত।

(সা. প. ৫১৩ হইতে গৃহীত পাঠ)