“পদ” শব্দে গান বা গীতিকবিতা বোঝায় কিনা এ প্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেন বলেনঃ “বৈষ্ণব-গীতিকবিতাকে এখন “পদ” বলা হয়৷ এই অর্থ অষ্টাদশ শতকের পূর্বে প্রচলিত হয় নাই৷ আগে “পদ” বলিতে দুই ছত্রের গান অথবা গানের দুই ছত্র বুঝাইত৷ চৈতন্যভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতিতে “তথাহি পদম” বলিয়া সাধারণত দুই ছত্র উদ্ধৃত হইয়াছে৷”” ( ডঃ সেন : “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস,” ১ম খণ্ড,১৩৪৭ সাল, পৃঃ ২৭৮)৷”” সঙ্গীত-রত্নাকরে শার্ঙ্গদেব (১৩শ শতকের প্রথমার্ধ) “পদ”-শব্দকে অন্য অর্থে ব্যবহার করেছেন৷ তিনি বলেছেন, অর্থপ্রকাশক শব্দ-বিশেষের নামও “পদ” হতে পারে৷ “”তাতাঽন্যদ্বাচকং পদম”” (রত্নাকর ৪.১৬)৷ টীকাকার মল্লিনাথ ঐ প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “অর্থপ্রকাশকং পদম্‌,” — অর্থাৎ যা অর্থ প্রকাশ করে তাই পদ৷ কিন্তু শার্ঙ্গদেব ও মল্লিনাথ বা সঙ্গীত-রত্নাকরের অন্যান্য টীকাকাররা এই “পদ” শব্দের অর্থ-বিশ্লেষণ করেছেন রত্নাকরের প্রবন্ধ তথা প্রবন্ধগানের অধ্যায়ে৷ প্রবন্ধে ছটি অঙ্গের মধ্যে “পদ” একটি অঙ্গ৷ সুতরাং “পদ” শব্দ বা অঙ্গ সেখানে গানের প্রকৃতি -নিদের্শক, সুতরাং গানাঙ্গ তথা গান — একথাই বোঝ যায়৷
“পদাবলী” শব্দ প্রসঙ্গেও ডঃ সুকুমার সেন বলেছেনঃ “পদাবলী -শব্দটির প্রথম ব্যবহার পাই গীতগোবিন্দে — “মধুরকোমলকান্তপদাবলীং শৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম্‌” (শ্রদ্ধেয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়-সংকলিত “বঙ্গীয় শব্দকোষ” (শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশিত, ১৩৫১ সাল) গ্রন্থেও পদাবলীপ্রসঙ্গে গীতগোবিন্দের এই শ্লোকাংশটি উদ্ধৃত হয়েছে। পৃঃ ১৭৩৪ ) ৷ পরে যখন “পদাবলী”-শব্দের অর্থ দাঁড়াইল গীতিকবিতার সমষ্টি, তাহার পূর্বে “পদ”-শব্দের অর্থ-পরিবর্তন ঘটিয়াছে৷ বৈষ্ণব-গীতি-কবিদের অধিকাংশই “মহাজন” বা “মহান্ত (অর্থাৎ সাধু-পুরুষ বা গুরু) ছিলেন৷ এইজন্য অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ হইতে বৈষ্ণব-গীতিকবিতা “মহাজন-পদবলী” নামে খ্যাত হয়৷””(“বাঙ্গালা-সাহিত্যের ইতিহাস”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১৭৮)
পদাবলী-সাহিত্যের মধ্যে বৈষ্ণব-পদাবলীকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ঃ (১) রাধাকৃষ্ণ-পদাবলী, (২) গৌর-পদাবলী, (৩) ভজন-পদাবলী, (৪) রাগাত্মিক-পদাবলী ৷ সুতরাং “পদাবলী”-শব্দটির বিশেষভাবে প্রচলন হয় সম্ভবত চর্যাপদগীতির কিছু পরে খ্রীষ্টীয় ৯ম-১২শ শতকে৷ ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন মোট ১৫৪ জন মহাজনের (পদকর্তার) নাম উল্লেখ করেছেন ৷ তাদের মধ্যে এগার জন মুসলমান কবি ও তিনজন মহিলা কবি৷ এই ১৫৪ জন হিন্দুপদকর্তা মহাজনদের মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, লোচনদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরামদাস, যদুনন্দনদাস, যদুনন্দন চক্রবর্তী, প্রেমদাস, বসন্তরায়, রায় শেখর, বাসু ঘোষ, শশিশেখর প্রভৃতি আছেন৷
এখন বাংলাসাহিত্যের ক্রমবিকাশের দিক থেকে “পদ” শব্দে হয়তো ১০ম-১১শ শতকেও couplet অর্থাৎ গানের মাত্র দুটি ছত্র (লাইন) বোঝানো হত ও তা গীতি বা গানের বোধক হয়েছিল সম্ভবত খ্রীষ্টীয় ১২ শতকের গোড়ার দিকে এবং তখনই ঠিক পরিপূর্ণভাবে “পদ”-শব্দে গীতিকবিতা ও গানকে বোঝানো হত৷ কিন্তু আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, খ্রীষ্টীয় ২য় শতকে নাট্যশাস্ত্রকার ভরত “পদ”-শব্দে গীতি বা গানকে বুঝিয়েছেন (যদিও অবশ্য গীতি ও গান এই শব্দ-দুটির মধ্যে কিছু অর্থগত পার্থক্য আছে৷) অভিনবগুপ্ত নাট্যশাস্ত্রের “অভিনবভারতী”-টীকায় “পদ” অর্থে গানকে লক্ষ্য করেছেন৷ প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও নাটকগুলিতে “পদ” শব্দে অধিকাংশ স্থানেই গানকে বুঝিয়েছে৷ সুতরাং প্রাচীন ধারার অনুবর্তনকারী বাংলার সাহিত্যিক ও কাব্যরচয়িতারা অন্ততঃ ৯ম-১২শ শতকের চর্যাপদগুলিকে “গীতি”-পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে মনে হয়৷ হতে পারে যে, বাংলাসাহিত্যের গতি ও রূপায়ণভঙ্গি প্রাচীন সংস্কৃত নাটক, কাব্য ও সাহিত্যগুলির রচনাশৈলী ও প্রকৃতি থেকে বেশ একটু ভিন্ন এবং তারই জন্য ১০ম-১১শ শতকের অথবা তারও পূর্ববর্তী বাংলাসাহিত্যের রচয়িতারা নূতনতার স্রষ্টা ও পথিকৃৎ হিসাবে পুরোপুরিভাবে প্রাচীনতার অনুসরণ করেন নি৷ কিন্তু ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষণে বিচার করলে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, “পদ”-শব্দের সাঙ্গীতিক দ্যোতনা পূর্বে একবার ভারতীয় সাহিত্যে, কাব্যে বা নাটকে প্রচলিত হয়ে থাকলে পরে তার অনুবর্তন হওয়াই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত৷ তবে বাংলার সাহিত্যরচনার দৃষ্টি, সাহিত্যচিন্তা ও সাহিত্য-মন যে কিছুটা বৈশিষ্ট্যাবগাহী হবে না তা আমাদের বক্তব্য নয়৷
একথা স্বীকার করতেই হবে যে, নবম-দ্বাদশ শতকে চর্যাপদরচনা পদসাহিত্যের জগতে এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল৷ বাংলাসাহিত্য বিকাশের তা চলমান যুগ৷ প্রাচীন বাংলায় সংস্কৃত-সাহিত্যেরও অপ্রাচুর্য ছিল না৷ বাংলাভাষার রূপসজ্জায় স্মৃতিসংহিতা, পুরাণ, তন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বাংলা সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাংলা অনুবাদগ্রন্থ, অলংকারশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র প্রভৃতি ছাড়াও সন্ধ্যাকরনন্দীর “রামচরিত” বা রামপালচরিত, গোবর্ধন আচার্য-রচিত “আর্যাসপ্তশতী” ও শ্রীধরদাসের “সদুক্তিকর্ণামৃত” প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য৷ হাল-রচিত “গাথাসপ্তশতী” খ্রীষ্টীয় ১ম বা ১ম-২য় শতকের গ্রন্থ৷ ন্যায়াচার্য ও বেদান্তবিদ্‌দের রচিত ন্যায়দর্শন ও বেদান্তদর্শনের গ্রন্থ যেমন একদিকে প্রাচীন সাহিত্য ও দর্শনরীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল, তেমনি অপরদিকে নব্য-সাহিত্য ও দর্শন-আলোচনা বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিল৷ গুপ্ত ও পালযুগে বৌদ্ধসাহিত্য ও বৌদ্ধধর্মের প্লাবন ও বিস্তৃতি বাংলার সংস্কৃতি-প্রতিভায়, শিক্ষায়, ধর্মে ও অধ্যাত্ম-জীবনে এক নূতন উজ্জীবন ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷ একথা সত্য যে, গৌতম-বুদ্ধের পরিনির্বাণের অনেক পরে বিভিন্ন বৌদ্ধধর্মমত ও সাধনধারার সৃষ্টি হয়েছিল বুদ্ধ-আদর্শ ও বুদ্ধবাণীকে কেন্দ্র করে৷ সৃষ্টি হয়েছিল বোধিসত্ত্বযান ও বুদ্ধযান প্রভৃতি তত্ত্বমার্গ বুদ্ধ-জীবন বা বুদ্ধ-ব্যক্তিত্বকেই লক্ষ্য করে৷ সৃষ্টি হয়েছিল হীনযান ও মহাযান ধর্মমতদুটি মহারাজ কণিষ্কের সময়ে চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতির অধিবেশনকালে এবং উদ্ভুত হয়েছিল বিচিত্র দর্শনমত, আচার-বিচার, ধর্মানুষ্ঠান ও সাধনা৷ হীনযানের ছায়াতলে দেখা দিল একদিকে যেমন বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক দর্শনমতবাদ, অপরদিকে তেমনি মহাযানের অনুসরণে আবির্ভূত হয়েছিল মাধ্যমিক ও যোগাচার দর্শনমত৷ এই সকল দার্শনিক মতবাদের বৌদ্ধিক বিচার ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্ববিশ্লেষণের পশ্চাতে একদিকে মহাযান-ধর্মমতে দেখা দিল যেমন বিচিত্র দেবদেবী, তাদের ধ্যানচিন্তা, আচার-উপাসনাপদ্ধতি ও তত্ত্ববোধপ্রবৃত্তি, অপরদিকে তেমনি হিন্দুপুরাণ, তন্ত্র ও শৈবশাস্ত্রসমর্থিত দেবদেবী এবং তাদের আচার ও সাধনতত্ত্বের হোল উদ্ভব প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক এক সংঘাত সৃষ্টি করে৷ ক্রমে আত্মপ্রকাশ করলো মন্ত্রযান ও তার শাখা কালচক্রযান, বজ্রযান প্রভৃতি ৷ হিন্দুতন্ত্রের মন্ত্র ও আচার অনুষ্ঠানের অনুকরণে নববৌদ্ধধর্মে প্রবর্তিত হোল দেবদেবীদের পূজা-অর্চনা ও তত্ত্বচিন্তা৷ বৈদিক ওঙ্কারের পাশাপাশি হূং প্রভৃতি তান্ত্রিক মন্ত্রবীজের সহযোগে জপ, অষ্টাঙ্গযোগসাধনা ও ধ্যানের অর্ন্তপ্রবেশ ঘটলো৷ বাংলার সাধক সমাজে ও দার্শনিক-সমাজেও দেখা দিল এক অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচনা৷ তবে এই দ্বন্দ প্রবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আবার আবির্ভূত হোল হিন্দু ও বৌদ্ধ-সমাজে এক পারস্পরিক সমন্বয়ী দৃষ্টি ও মৈত্রীভাব৷ ক্রমে আত্মপ্রসারণের পথ ও প্রবৃত্তি হল প্রশস্ত৷ ফলে বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রবেশ করলো যেমন হিন্দুধর্মের সূক্ষ্ম ও স্থূল অনেক উপাদান, হিন্দুধর্মও আত্মসাৎ করেছিল তেমনি বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধতত্ত্বের কিছু সামগ্রী৷ অবশ্য এই গ্রহণপ্রচেষ্টা দেখা দিয়েছিল উভয়েরই মধ্যে৷ কিন্তু মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, বিনয়তোষ ভট্টাচার্য প্রভৃতি বিদগ্ধ পণ্ডিতদের মতে, হিন্দুধর্মই নাকি পরিপুষ্ট করেছিল তার কলেবর বৌদ্ধধর্ম থেকে বিচিত্র তত্ত্ব ও উপাদান আহরণ করে৷ তাঁদের মতে,ছদ্মবেশী হিন্দু-দেবীদেবীরা বেশীর ভাগই ছিলেন বৌদ্ধদেবদেবী৷ হিন্দুদের সরস্বতী, কালী, ব্রজবারাহী, গণেশ, অপরাজিতা -দুর্গা প্রভৃতি তার নিদর্শন৷
অবশ্য এই সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করার পক্ষে ও বিপক্ষে নূতন করে অনুশীলন ও বিচার করার দিন আবার এসেছে বলেই আমরা মনে করি, কেননা হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি ঠিক একই সময়ে হয় নি,বরং ঐতিহাসিক তথ্য যে, হিন্দুতন্ত্রের বহুকাল পরে বৌদ্ধতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছিল সমাজে প্রচলিত হিন্দুধর্মচিন্তার প্রতিক্রিয়ারূপে৷ হিন্দুতন্ত্র বেদের সমসাময়িক না হলেও বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানই ভিন্নভাবে তন্ত্রাচাররূপে তন্ত্রসাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। বৈদিক ধর্মাচার ও দেবদেবী যেমন পুরাণের যুগে কিছুটা ভিন্নভাবে রূপগ্রহণ করেছিল, তেমনি প্রকাশ্য বৈদিক যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠান ও তার সিদ্ধিসাফল্যও বৈদিকোত্তর যুগে অপ্রকাশ্য গুপ্তানুষ্ঠান ও শক্তিসিদ্ধিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল৷ বেদ ও হিন্দুতন্ত্রের মধ্যে তখন এতটুকু বিরোধচিন্তা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না, বরং ছিল মৈত্রীসম্পর্কেরই বন্ধন৷ বৌদ্ধতন্ত্রের আচার-অনুষ্ঠান ও দেবদেবীচিন্তার বিকাশ হিন্দু-আচার ও দেবদেবীচিন্তারই অনেকটা প্রতিকূল এবং বৌদ্ধতন্ত্রে সিদ্ধিনাশক গণেশ ও হিন্দুতন্ত্রের সিদ্ধিদাতা গণেশই তার সামান্য একটি নিদর্শন৷ তবে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যের ইঙ্গিতও যে ছিল না,তা নয়, কেননা হিন্দুতন্ত্রের মন্ত্র, তন্ত্র, মুদ্রা ও মণ্ডলের অনুরূপ প্রতিকৃতি ও অনুষ্ঠানই পাই আবার বৌদ্ধতন্ত্রের ভিতর৷
হিন্দুতন্ত্রের মতো বৌদ্ধতন্ত্রের উদ্দেশ্যও ছিল ঐহিক সিদ্ধিলাভের মতো পারলৌকিক পরমসিদ্ধিলাভ, তা সে সামবস্য শিবশক্তি-সাযুজ্যই হোক, শিবত্বপ্রাপ্তিরূপ ব্রহ্মজ্ঞানস্থিতিই হোক, অথবা নির্বাণ বা শূণ্যতায় প্রতিষ্ঠালাভই হোক৷ বজ্রাচার্যগণ বজ্রবারাহীর কিংবা শূণ্যতার প্রতিফলন অবধূতিকা নৈরাত্মাদেবীর উপাসনার অঙ্গরূপে সন্ধা বা অভিসন্ধিসূচক ভাষায় রচনা করেছিলেন ব্রজগীতি ও চর্যাগীতি (প্রকৃতপক্ষে বজ্রযানেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল চর্যা ও বজ্র-গীতি)। চর্যা ও বজ্র গান-রচনার পটভূমিকায় বিচিত্র বৌদ্ধধর্মমত ও বৌদ্ধসাধনচিন্তার একটি প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই স্বীকার্য৷ সমাজে, জীবনে, সকল রকম চিন্তায়, ধর্মে কর্মে ও দর্শন-চিন্তায় যেমন দেখাযায় একটি প্রভাব ও সামঞ্জস্য,তেমনি আবার ধর্মে ও দর্শনচিন্তার উপরও দেখা যায় সমাজ, সামাজিক ধর্মসংস্কার ও মানুষের জীবনচিন্তার একটি প্রভাব৷ পারস্পরিক এই আদান-প্রদান বা দেওয়া-নেওয়ার ভিতর দিয়েই চিরদিন মানুষের বাহ্যিক ও আন্তরজীবনের হয় সংগঠন ও শুদ্ধপরিণতি সমাজে৷
শোনা যায়, তিব্বতের সিদ্ধাচার্যরাই ছিলেন বৌদ্ধ-সহজযানের প্রবর্তক ও প্রচারক এবং খ্রীষ্টীয় ৯ম-১২শ শতকে বা তার পূর্বে বৃহত্তর-বাংলায় ঐ সহজযান-মতবাদের হয়েছিল অনুপ্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা৷ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বৃহত্তর-বঙ্গের চতুঃসীমা ছিল তখন অখণ্ড বঙ্গদেশ বা বাংলা, গিরিব্রজ বা বিহার, উৎকল বা উড়িষ্যা ও কামরূপ বা আসামকে নিয়ে সার্থক৷ বৃহত্তর-বাংলার সমাজ-বিবর্তনে, ধর্মাচারে ও দৈনন্দিন জীবনচর্যায়, সাহিত্যে,নাটকে, কাব্যে, দর্শনচিন্তায় ও এমন কি অধ্যাত্মসাধনায় সহজযান-ধর্মমত এনেছিল এক নূতন আলোড়ন ও প্রেরণা৷ যদিও সেই আলোড়ন ও প্রেরণা বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ ছিল বৌদ্ধ-সাধনাশ্রয়ী আচার্যদেরই ভিতর, তবুও হিন্দু-সর্বসাধারণের জীবনে, মনে ও তত্ত্বচিন্তায় সৃষ্টি হয়েছিল এক বিবর্তনী প্রবৃত্তি৷ ফলে হিন্দুসমাজ-মানসের কোন কোন অংশে প্রবেশলাভ করেছিল সেই বৌদ্ধ-সহজযান-ধর্মচিন্তা ও ধর্মসাধনার উপাদান ও সৃষ্টি হয়েছিল ক্রমে বৈষ্ণব-সহজিয়া, বাউল, গুরুসত্য, কর্তাভজা প্রভৃতি গুরুবাদী কায়-সাধকদের ধর্মমত ও সাধনা৷ ( (ক) ডঃ শ্রী শশিভূষণ দাশগুপ্ত Obscure Religious Cults(কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৬), পৃঃ ১৮৭-২০২ এবং পঞ্চম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৩২-১৮২। (খ) ডঃ শ্রী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ঃ “বাংলা-সাহিত্যের ইতিবৃত্তি” , ১ম খণ্ড, ১৯৫৯, পৃঃ ১৪৯-১৫৬)৷ আচারী তান্ত্রিক বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যদের পদগানের (চর্যা ও ব্রজগীতির) বহিরঙ্গ স্থূলচিত্রকল্পের অনুরূপ আন্তর ও রহস্যময় গুপ্তসাধনা ও তত্ত্ববোধের অন্তর্নিবেশও ঘটেছিল সহজ সরল সাধারণ হিন্দুসমাজের অন্তর্ভূক্ত বৈষ্ণব-সহজিয়া, বাউল ও কর্তাভজা-সম্প্রদায়ের ভিতর৷ বৌদ্ধ ও হিন্দু এই উভয় রচয়িতাদের গূঢ়-দ্বৈতার্থবোধক পদ ও গানের ভাষা ছিল তাই প্রায় একই ধরনের ৷ যেমন লুইপাদ রচিত পাদ–
মূল — কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল৷
চঞ্চল চীএ পইঠা (বা পাইঠো) কাল৷৷
দিঢ় (বা দিট) করিঅ মহাসুহ পরিমাণ৷
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান ৷৷– প্রভৃতি
অনুবাদ– (কায়ারূপ তরুবর পাঁচ তার ডাল৷
চঞ্চল চিত-মাঝে পশে আসি কাল৷৷
দৃঢ় করি মহাসুখ কর পরিমাণ৷
লুই ভণে গুরুকে পুছিয়া ইহা জান ৷৷) — প্রভৃতি
কথবা গুণ্ডরীপাদ-রচিত —
মূল — তিঅড্ডা চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী৷
কমলকুলিশ ঘাণ্টি (বা ঘান্ট) করহু বিআলী৷৷
জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি৷
তো মুহ চুম্বী কমলরস পিবমী৷৷–প্রভৃতি
অনুবাদ — (ত্রিনাড়ী যোগিনী চাপি দেয় অঙ্কবালী৷
কমলকুলিশ যোগ করহ বিকালী৷৷
তোমা বিনা যোগিনি গো, ক্ষণ নাহি জীব৷
তোর মুখ চুম্বি রস কমলের পিব ৷৷ ) — প্রভৃতি
বাউল-কবি-রচিত পদগান–
(আট) কুঠারি নয় দরজা আঁটা,
মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা৷
(তার) উপরে আছে সদর-কোঠা
আয়না-মহল তায়৷
খাঁচার মাঝে অচিন-পাখি
ক্যামনে আসে যায়৷৷–প্রভৃতি
তান্ত্রিক আচারী বৌদ্ধসাধনাত্মক গানদুটির অন্তবার্থ বা সাধনমর্মকথা প্রায় একই রকমের৷ চর্যাগানে “ডোম্বী” “বহুড়ী”, “জোইনী বা “যোগিনী” প্রভৃতি শব্দে নৈরাত্মাদেবী৷ (এখানে অধ্যাপক মণীন্দ্রমোহন বসুর চর্যাপদ -টীকা থেকে “বহুড়ী” শব্দের অর্থ উদ্ধৃত হল : “”বহুড়ী ঃ “অবধূতিশব্দসন্ধ্যায়া” –টীকা৷ অভিপ্রায় বা অভিসন্ধিসূচক সন্ধাভাষায় নৈরাত্মা-অবধূতিকাকেই বহুড়ী বা “বধূ” বলা হইয়াছে৷ অন্যত্র তাহাকে “যোগীন্দ্রস্য গৃহিনী নৈরাত্মা” বলা হইয়াছে৷ তিনিই “অনাদিভববিকল্পঞ্চ ধূত্বা প্রকৃতি পরিশুদ্ধাবধূতিরূপেন অহর্নিশ জাগরণং কুর্বন্তি”৷) পরিশুদ্ধ অবধূতিকা নৈরাত্মাদেবী শূন্যতা কিংবা সত্তাপক্ষে তথতার প্রতিচ্ছবি৷ বাউলগানের অচিনপাখী ভগবানও সহজ মানুষ৷ বাউল ও চর্যা-সাধনতত্ত্বে সহজ-মানুষ সর্বমলনির্মুক্ত দেহবাসী পরিপূর্ণ মানুষ এবং এই পরিপূর্ণ বা সহজ-মানুষই ভগবান কিংবা আত্মা বা পরমাত্মা৷ কায়-সাধনায় স্থুলশরীরের মধ্যেই অচিন-পাখি সহজ-মানুষের (সহজানন্দের) আসন প্রতিষ্ঠিত৷ সুতরাং কায়াকে বা স্থুল রক্তমাংসের শরীরকে পরিশুদ্ধ করে শরীরের দুঃখ- দৈন্য- জ্বরা- মরণ- বিহীন যে সহজ আনন্দ তার প্রতিষ্ঠা বা প্রাপ্তিই সহজিয়া-সাধক বাউলের উদ্দেশ্য৷ সহজদেবতাই সাধককে পরমপরিশুদ্ধির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ চর্যাগানে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের উদ্দেশ্যেও বলা হয়েছে ঃ “”পরিশুদ্ধ-অবধূতিকা নৈরাত্মার প্রকৃতি এই যে, তিনি ললনা -বসনা-অবধূতিকা নাম্নী শরীরের মধ্যে প্রধান তিনটি নাড়ীকে চাপিয়া নিরাভাস করিয়া অর্থাৎ গ্রাহ্য-গ্রাহক-গ্রহণ-ভাব বিলীন করিয়া সাধককে নিজের অভিজ্ঞান অর্থাৎ নৈরাত্মতা প্রদান করেন৷” যোগ ও বেদান্ত-সাধনায় মুক্তির সঙ্গে সহজসাধনার নৈরাত্মাপ্রাপ্তির অনৈক্য সামান্য৷
চর্যাগীতির ভাষা, শব্দযোজনা ও ধ্বনিতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, তা প্রাচীন বাংলাভাষা৷ অনেকের মতে, সংস্কৃত ও অবহটঠ্‌-প্রভাবিত প্রাকৃত-বাংলাই চর্যার ভাষা৷ অনেকে আবার বলেন, চর্যা, গৌড়বঙ্গ বা শৌরসেনী-অপভ্রংশ-পদগীতির নিদর্শন৷ কিন্তু একথা মোটেই অস্বীকার করার উপায় নাই যে, বর্তমান বাংলাসাহিত্যের মার্জিত বা সুসংস্কৃত ভাষার পূর্ব বা প্রাচীন রূপই চর্যাপদ বা চর্যাকবিতা অথবা চর্যাগান৷
পদাবলীকীর্তনের ঐতিহাসিক বিকাশসম্পর্কে বৌদ্ধ- বজ্রযান ও সহজযান প্রভাবিত চর্যাগানের আলোচনায় আমরা চর্যার গায়নরীতি ও রাগরূপেরও পরিচয় দেবার চেষ্টা করব৷