বিদ্যাপতির ব্যক্তিত্ব ছিল এইরকমই; কিন্তু বিদ্যাপতি অমরত্ব লাভ করেছেন গীতিকার হিসেবে, তিনিই প্রথম কবি যিনি প্রাদেশিক ভাষাকে আনন্দবিহ্বল সাঙ্গীতিক মাধুর্য ও অপার সৌন্দর্যসুষমায় মণ্ডিত করে ভারতীয় কাব্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন ৷ আমি অবশ্য বরাবরই মনে করি বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভা যত বড়ই হোক না কেন তা নিশ্চয়ই বিদ্যাপতির সমগ্র ব্যক্তিত্বের একটি অংশমাত্র, সুতরাং বিদ্যাপতিকে অনুভব করতে হবে মানুষ হিসেবে , তাহলেই আমরা তাঁর কবিপ্রতিভা মূল্যায়নে সুবিচার করতে পারব ৷ বিদ্যাপতির অসাধারণ মৌলিক প্রতিভাই তাঁকে সমসাময়িক ইতিহাসের ও জীবনযাত্রার স্পন্দন অনুভব করতে শিখিয়েছিল এবং সেই সামাজিক পটভূমিকায় তাঁর প্রতিভাকে সম্যক বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল ৷ বিদ্যাপতির নতুন ধরনের কাব্যশৈলী যে ভিত্তি স্থাপন করে তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী কবিরা হয়েছিলেন সেই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ৷ স্বয়ং বিদ্যাপতি নিজের বংশ, নিজের প্রাদেশিক বাতাবরণ, নিজের যুগ, নিজের সমাজ ও নিজের পরিবারের একজন প্রতিভূ কারণ এই সব কটি ক্ষেত্রই বিদ্যাপতির প্রতিভার রূপ পরিগ্রহণের বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল ৷ কবির মূল্যায়নে আমরা দিগভ্রান্ত হতে পারি যদি আমরা যে সীমারেখার ভেতর কবি কাজ করেছিলেন তার বাইরে পৃথকভাবে কবির অস্তিত্ব বিচার করতে যাই এবং অতি উৎসাহের আতিশয্যে হয়তো বা এমন অনেক বিষয়ে কবির মূল্যায়ন করি যা স্বয়ং কবির স্বপ্নেরও অগোচর ছিল ৷
একটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া যাক ৷ বিদ্যাপতি নিজের কাব্যের অভিব্যক্তির জন্য তৎকালীন লোকভাষার প্রয়োগ করেছিলেন কিন্তু একমাত্র গীতরচনা ছাড়া অন্য কোথাও এই ভাষাটির প্রয়োগ করেননি ৷ ঐতিহাসিক রমন্যাস ‘কীর্তিলতা’ ও’কীর্তিপতাকা’য় এবং শিবসিংহের সিংহাসনে আরোহন ও জয়গানেও যা হয়তো ‘কীর্তিপতাকা’র জন্যই রচিত হয়েছিল, তিনি এমন ভাষা ব্যবহার করেন যা সুদূর অতীতে ব্যবহৃত হত ও সর্বমান্য ভাষা হিসেবে প্রয়োগ করা হত ৷ যখন ‘কীর্তিলতা’য় বিদ্যাপতি বলেন, ”বিদ্যাপতির ভাষা নবচন্দ্রকলার মতো, যা ভগবান শিবের মস্তক বিভূষিত করে ও কাব্যরসপিপাসুর মনকে উন্মত্ত করে তোলে”, তখন আমরা বিদ্যাপতির সঙ্গীতে ব্যবহৃত লোকভাষার বিরুদ্ধে প্রাচীন পন্থীদের আক্রমণের ফলস্বরূপ বিদ্যাপতির আত্মপক্ষসমর্থনের ইঙ্গিত পাই ৷ কিন্তু বিদ্যাপতি তাঁর নাটকেও কেবলমাত্র সঙ্গীতের অংশেই মৈথিলী ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং ‘লিখনাবলী’তে তিনি বর্ণমালা, বিধি ও নিয়মাবলী সবই রচনা করেছেন শুধুমাত্র সংস্কৃতে, মৈথিলীতে নয়, যা কার্যক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী ও বাঞ্ছনীয় বলে গণ্য হত ৷ কিন্তু সেই সময়কার শিক্ষাবস্থা বিষয়েও মনে রাখা দরকার কারণ তখন প্রাচীনপন্থী শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষভাবে পুরুষসমাজেই কেন্দ্রীভূত ছিল এবং প্রাচীনপন্থী পুরুষেরা সংস্কৃতকেই মর্যাদা দিয়েছেন, নারীকুলের শিক্ষার অগ্রগতি ছিল নগন্য৷ বিদ্যাপতি সঙ্গীতরচনায় মৈথিলীভাষা ব্যবহার করেছিলেন কারণ এইসব সঙ্গীত পাঠ করবার জন্য লেখা হয়নি, ‘শোনবার জন্য ও কন্ঠস্থ করবার জন্যই লেখা হয়েছিল ৷ বিদ্যাপতির সঙ্গীতে আমরা দুইপ্রকার মৈথিলী ভাষা পাই ৷ এক শ্রেণীর ভাষা হল রাজদরবারে ব্যবহৃত মার্জিত ভাষা যেখানে তৎসম শব্দের আধিক্য এবং নিখুঁত শব্দবিন্যাস ও অলঙ্কারমণ্ডিত এবং অন্যটি সহজ সরল সাধারণ মানুষের ভাষা, যাতে তদ্ভব বা দেশী শব্দেরই প্রাধান্য ৷ স্পষ্টতই শ্রোতার চরিত্র অনুযায়ী বিদ্যাপতি গীতরচনায় মনোযোগ দিয়েছিলেন, জনারণ্যে তাঁর সঙ্গীত জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দুই ধরনের মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল — একটি শিক্ষিত মার্জিত সমাজের মাধ্যম ও অন্যটি সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার মাধ্যম ৷ তাঁর সঙ্গীত প্রচারিত হবে রাজদরবার বা রাজসভার সদস্যমণ্ডলীর দ্বারা, আপন পরিজন দ্বারা বা আপন মিত্রবর্গ ও গুণগ্রাহীর সহায়তায় ৷ বিদ্যাপতি পৃথক পৃথক শ্রোতৃবর্গের কথা চিন্তা করে গীতরচনার ভাষা নির্বাচন করেছিলেন, স্বাধীনভাবে নিজের মনের চাহিদা দ্বারা চালিত হননি ৷ পরবর্তী কালে যখন সঙ্গীতকার হিসেবে বিদ্যাপতির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, তখন রাজা শিবসিংহ জয়ত নামের এক পেশাদার সুরকারকে রাজদরবারে নিযুক্ত করেছিলেন, যিনি বিদ্যাপতির সঙ্গীতে সুর সংযোজন করতেন এবং যথাসময়ে রাজদরবারে বা অন্যত্র তা পেশ করতেন ৷ এটিই বিদ্যাপতির সঙ্গীতের বিষয়ে মৌলিক তথ্য এবং আমরা এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তবেই তাঁর সঙ্গীতের পূর্ণ রসাস্বাদন করতে পারব ৷
আর এই করণেই বিদ্যাপতির গীত সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে গেলে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির সম্মুখীন হতে হয় তা হল বিদ্যাপতির নামে উদ্ধৃত গীতটির প্রামাণ্যতা ৷ এই প্রামাণ্যতার বৈশিষ্ট্য হল গীতটির অন্তিম চরণ দুটিতে কবির নামের উল্লেখ, যাকে বিশেষভাবে ‘ভণিতা’ বলা হয় এবং এই ধরনের পদাবলীর এটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য, কিন্তু কয়েক শতক ধরে লোকমুখে পদাবলী প্রচার হতে হতে, বিশেষত অবিশেষজ্ঞ সঙ্গীতজ্ঞ, তার মধ্যেও মূলত যাঁরা স্ত্রীলোক তাঁদের মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে ভণিতাগুলি ভ্রান্তিপূর্ণ, বিস্থাপিত ও অকারণ সংযোজিত হয়েছে ৷ উপরন্তু সব পদাবলী বা গীতে ভণিতাও নেই ৷ বহু সংকলনে, বিশেষত নেপালে, স্থানাভাবের কারণে ভণিতাগুলি বাদ গেছে ৷ এমন কি অষ্টাদশ শতাব্দীতে পণ্ডিতবর্গ যে সংকলন প্রকাশ করেন, তাতেও এই ধরনের ভ্রান্তি দেখা যায় ৷ এখনও মিথিলায় পদাবলীর শেষে বিদ্যাপতির নাম সংযোজনের প্রথা প্রচলিত আছে ৷ বহু স্বল্পখ্যাত কবি সজ্ঞানে নিজেদের পদরচনার শেষে রচনাকার হিসেবে বিদ্যাপতির নাম লিখেছেন যাতে তাঁদের রচনা প্রসিদ্ধিলাভ করতে পারে ৷ বাংলার অন্তত একজন কবির কথা আমরা জানি যিনি তাঁর সমস্ত পদ রচনার রচয়িতা হিসেবে বিদ্যাপতির নাম ব্যবহার করেছেন ৷
সুতরাং বিদ্যাপতির পদাবলীর সম্পূর্ণ সংকলন করা সম্ভব হয়নি এবং কখনও করা যাবে কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ৷ বিদ্যাপতি নিজে কখনও নিজের রচনা সংগ্রহ করে রাখেননি, লোকমুখে তাঁর পদাবলী ছড়িয়ে গেছে মিথিলায়, বাংলায়, নেপালে ৷ এই বিষয়ে সর্বপ্রথম, প্রচেষ্টা হয়েছে বাংলায়, যেখানে ভগবান কৃষ্ণ ও গোপিনীদের লীলাবর্ণনার কারণে এই পদাবলীর বৈষ্ণব সংকলন সযত্নে ও সাবধানতা অবলম্বন করে সংগৃহীত হয়েছে ৷ বিদ্যাপতির পদাবলীর সর্বাধিক আলোচনাত্মক ও বিস্তৃত সংস্করণ প্রস্তুত করেছেন পাটনার ডঃ বি. বি. মজুমদার ৷ বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদও বিদ্যাপতির পদসংকলন প্রকাশে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন ৷ আমার বন্ধু ডঃ সুভদ্র ঝা নেপাল সংরক্ষিত এক ভূর্জপত্র পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন, যা বিদ্যাপতির পদসংকলন ৷ এরও আগে পণ্ডিত শিবনন্দন ঠাকুর মিথিলায় খুঁজে পাওয়া বিদ্যাপতির পদাবলীর একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেন ৷ অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে লোচন কর্তৃক ‘রাগতরঙ্গিনী’ শীর্ষক মৈথিল সঙ্গীতের একটি সংকলন প্রকাশিত হয় যাতে ৫৩টি পদাবলীর রচয়িতা বিদ্যাপতি ৷ আমি নিজে নেপাল থেকে পাওয়া ‘ভাষা গীত সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছি যাতে ৭৭ টি গীতের পদকর্তা বিদ্যাপতি, যার মধ্যে ৩৭টি একেবারেই অশ্রুতপূর্ব ৷ কিন্তু এই সব বাদ দিলেও বিদ্যাপতির রচিত গীত আরও আছে ৷ আমি মিথিলায় আরও দুটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পেয়েছি যাতে ৩০০টি পদ আছে এবং তার মধ্যে অন্তত ৮০টি অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি ৷ বর্তমানে এই ‘মিথিলা পদাবলী’র একটি সমালোচনামূলক সংস্করণ প্রকাশের কাজে ব্যস্ত আছি যেটি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৈথিলী ডেভালপমেন্ট ফাণ্ড প্রকাশ করবে ৷ কিন্তু এই সংকলনগুলি অধিকাংশই ভ্রান্তিপূর্ণ পাঠজনিত কারণে ত্রুটিপূর্ণ, একমাত্র ২০০ বছর আগের এক পণ্ডিত ব্যক্তির সংগ্রহ ‘ভাষা গীত সংগ্রহ’ বহু যত্নে ও পরিশ্রমে সংকলিত ৷ এর কারণও স্পষ্ট ৷ অধিকাংশ সংগ্রাহক ও সংকলকই মৈথিলী ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা লিখিত বক্তব্যের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনে অসমর্থ ৷ এই কারণেই আমি মনে করি বিদ্যাপতি পদাবলীর বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন ও বিচারের জন্য প্রমাণ্যতা ও পাঠশুদ্ধতার বিশেষ প্রয়োজন আছে ৷
আমরা জানি না কবে বিদ্যাপতি প্রথম পদ রচনা শুরু করেন ৷ ভণিতা বিচার করে বহু পণ্ডিত বলেছেন প্রাচীনতম পদটিতে রাজা ভোগীশ্বরের উল্লেখ আছে ৷ পদটি কন্দর্পপূজা উপলক্ষ্যে রচিত কিন্তু এটি অবাস্তব, কারণ ভোগীশ্বরের পুত্র গণেশ্বর যখন গুপ্তঘাতকের হাতে ২৫২ লক্ষণ সম্বতে নিহত হন, বিদ্যাপতি তখন অনধিক বারো বছরের বালক মাত্র ৷ সুতরাং এটি কি করে সম্ভব যে যখন বিদ্যাপতির বয়স মাত্র দশ বা তার কাছাকাছি তখন তিনি কামাতুর বিরহিণীর ব্যথা বিষয়ক এই পদটি রচনা করেন, তাও আবার রাজা ভোগীশ্বরকে তার সঙ্গে যুক্ত করে, যে রাজা বিদ্যাপতির পিতামহের বয়সী ? প্রথম সংস্কৃত রচনা ‘ভূপরিক্রমা’ তে তিনি প্রেমের কথা কিছু বলেন নি, কিন্তু ‘পুরুষপরীক্ষা’র পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে প্রেমই প্রধান উপজীব্য বিষয় এমনকি যেসব কাহিনীতে মানবচরিত্রের অন্যান্য দিক বর্ণনা করা হয়েছে, তাতেও ৷ সুতরাং অনুমান করা যায় সংস্কৃতিবান পরিবারের শিক্ষিত সন্তান বিদ্যাপতি কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পন করে তবেই প্রেমপদাবলী রচনা শুরু করেন ৷
বিদ্যাপতির গীত মূলত তিন শ্রেণীর, প্রত্যেকটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, তবে একটি বিষয়ে মিল আছে তা হল ভাষা ৷ এই ভাষায় সেই সময়ে মিথিলাবাসী নারী ও পুরুষ কথা বলত ৷ এদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হল সামাজিক অনুষ্ঠানের পক্ষে উপযুক্ত পদগুলি এবং শুভকাজের আগে পারিবারিক দেবতার মঙ্গলস্তোত্র সম্বলিত পদ, যা লক্ষ লক্ষ মৈথিল নারীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ৷ এর পরেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভগবান শিবসংক্রান্ত পদাবলী, এর মধ্যে শিবের বিবাহ ও পারিবারিক জীবনও বর্ণিত আছে ৷ বিদ্যাপতি এই জাতীয় পদের এক বিশেষ ধরন প্রবর্তন করেন যার নাম ‘নাচারি’ এবং এই পদগুলি এত বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে জৌনপুরের একজন কবি তাঁকে ‘নাচারির সৃ্ষ্টিকর্তা হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে আবুল ফজল বিদ্যাপতির যাবতীয় পদ এমন কি যাতে তীব্র প্রেমোন্মাদনার প্রাধান্য, তাদেরও সাধারণভাবে লাচারি হিসেবে বর্ণনা করেছেন ৷ সারা দেশে শিবের উপাসকেরা আজও এই পদগুলিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান দিয়েছেন এবং যে কোনো শিবমন্দিরে এই পদ প্রত্যহ গীত হয় ৷ সর্বশেষ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি, যার ওপর ভিত্তি করে বিদ্যাপতির খ্যাতি গগনচুম্বী, তা হল সেই সব পদ যাতে শৃঙ্গারের বিচিত্র রূপ-রূপান্তর, ভাব ও পরিস্থিতির চিত্রণ আছে, এর মধ্যে কিছু কৃষ্ণ ও গোপিনীদের লীলা সংক্রান্ত আর কিছু সাধারণ নরনারীর প্রেমঘটিত।
বিদ্যাপতির ছন্দোবদ্ধ আবেগমথিত পদাবলীর বিভিন্ন বিভাগে প্রবেশ করার আগে এইসব পদগুলির পটভূমিকা ও রচনাগতক্ষেত্রে বিদ্যাপতির পরীক্ষা নিরীক্ষার সাফল্য সম্বন্ধে কিছু আলোচনা প্রয়োজন ৷ গত কয়েক শতাব্দী ধরে বিদ্যাপতিকে যে যে শিরোপায় ভূষিত করা হয়েছে, তার মধ্যে দুটি সম্মানজনক উপাধির উল্লেখ আছে তাঁর নাটক ‘গোরক্ষবিজয়ে’ বিসপি-দান সংক্রান্ত তাম্রপত্রে, লোকপরম্পরা এবং সর্বোপরি তাঁর ভণিতা দ্বার সমর্থিত; এগুলি হল ‘অভিনব জয়দেব’ অর্থাৎ ‘এক আধুনিক জয়দেব’ এবং ‘কবিকণ্ঠহার’ ৷ এই দুই উপাধি তিনি জীবদ্দশাতেই অর্জন করে গেছেন ৷ বিদ্যাপতির সম্বন্ধে যা যা উপাধি আছে তা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার পর ডঃ বি. বি. মজুমদার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে কেবলমাত্র এই দুইটি উপাধি বিদ্যাপতির নিজস্ব ও জীবদ্দশায় প্রাপ্ত ৷ এই দুই উপাধি সার্থক এবং আমরা যদি এর অর্থ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করি তাহলে স্পষ্টই দেখব বিদ্যাপতির আদর্শকে যা তাঁকে পরীক্ষামূলক রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল ও এক অভূতপূর্ব উন্মাদনায় আপ্লুত করেছিল, যার অনুরণন প্রত্যেক শ্রোতা ও পাঠকের হৃদয়কে মোহাচ্ছন্ন করে তুলেছে ৷
এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং বারবার উল্লেখও অনাবশ্যক যে বিদ্যাপতির কাব্যমঞ্চে আবির্ভাবের বহু আগে থেকে কাব্যের দুটি ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছিল সমগ্র উত্তর পূর্বভারতে এবং বিশেষ করে মিথিলায় ৷ এই দুই ধারাই ছিল রসাত্মক, উপদেশাত্মক নয় ৷ একটি হল সুদূর অতীতকাল থেকে প্রচলিত লৌকিক সংস্কৃতের কাব্যধারা যার সর্বাধিক বিখ্যাত নিদর্শন ‘অমরুশতক’ যার সম্বন্ধে বলা হয় যে একটি স্তবক শত স্তবকের সমান ।এই কাব্যধারা সংস্কৃত ভাষাবাহী, সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র দ্বারা আধারিত, সংস্কৃত কবি কর্তৃক সংস্কৃত ছন্দে রচিত এবং সারা দেশের শিক্ষিত সমাজ ও রাজদরবারে সমাদৃত ও সংরক্ষিত ছিল ৷ সারা ভারতের রাষ্ট্রভাষা সংস্কৃত হওয়ার জন্য এই কাব্যধারার একটি সার্বজনীন প্রভাব ছিল যদিও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ব্যক্তিরাই ছিলেন এই কাব্যধারার গুণগ্রাহী, এই কাব্যধারা গীতিময় ও অধিকাংশই শৃঙ্গার রসাশ্রয়ী, যদিও স্তুতিজ্ঞাপক ও ভক্তিমূলক নীতিরও প্রচলন ছিল ৷ দ্বিতীয় কাব্যধারাটি লোকসাহিত্যের মৌখিক কাব্যধারা যা শিল্পপ্রয়োগের দ্বারা ক্রমশ পরিমার্জিত হয়েছে এবং যার প্রথম নমুনা বা নিদর্শন আমরা পাই ‘গাথাসপ্তশতী’তে কিন্তু যা কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশী’ নাটকের চর্চারি নৃত্যগীত থেকে শুরু করে পালবংশের রাজত্বকালে ব্রজযান সিদ্ধাদের গীত হিসেবে আর্যাবর্তের পূর্ব ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছে এবং যার একটি সংগ্রহ ‘বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশিত হয়েছে , তার বিশেষত্ব হল এই যে এগুলি আর্যাবর্তের এই অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে কোনো না কোনো রাগাশ্রয়ী এবং রচনার শেষে কবির নামের উল্লেখ পাওয়া যায় যা পরবর্তী কালে ‘ভণিতা’ হিসেবে পরিচিত হয়েছে ৷
জয়দেবই প্রথম কবি যিনি এই দুই কাব্যধারার মেলবন্ধনে প্রয়াসী হন এবং এক নতুন ধারার সংস্কৃত কাব্য রচনা করেন ৷ এই নতুন কাব্যধারার ভাষা সংস্কৃত, বিষয়বস্তু হল শ্রীমদ্ভাগবতে চিত্রিত কৃষ্ণলীলা, যা গাথার সময় থেকেই প্রকৃতকাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে; রীতি শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি সবই অবশ্য প্রচলিত সংস্কৃত কাব্যানুযায়ী ৷ কিন্তু জয়দেব লোকগীতি রচনার ধারাটিকে ব্যবহার করেন এই নতুন কাব্যধারায় ৷ এই পদগুলি গাইবার জন্য, লৌকিক রাগ এবং এই প্রথম সংস্কৃত কাব্যে ভণিতার প্রয়োগ করা হয় ৷ এই নতুন কাব্যধারায় কাব্যরস ও মোহময় উন্মাদনার ছন্দ এতই মন্ত্রমুগ্ধকর মেলবন্ধন সৃষ্টি করে যে এই কাব্যধারা অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং আজও সকলের হৃদয় ‘গীতগোবিন্দ’-র পদাবলীর ললিত মাধুর্যে ও মধুর ছন্দে, অর্থ উপলব্ধি না করেও, উদ্বেল হয় ৷
কর্ণাটদের আগমনের পর মিথিলায় সঙ্গীত ও নৃত্যের যথার্থ প্রেরণা মেলে এবং জ্যোতিরীশ্বর প্রণীত ‘বর্ণরত্নাকর’ থেকে আমরা জানতে পারি যে তৎকালীন সামাজিক জীবনে কর্ণাটদের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৷ সঙ্গীত হয়ে ওঠে মিথিলার সমাজজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং আজও মিথিলায় এমন কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা ষড় ঋতুকালীন উৎসব হয় না যাতে বিশেষ বিশেষ সুর ও ছন্দের সঙ্গীত পরিবেশিত না হয় ৷
বিদ্যাপতি জয়দেবের উত্তরসূরী ছিলেন ৷ পাল যুগ থেকে প্রচলিত রচনাবিধি তিনি গ্রহণ করেন যা জয়দেব প্রায় দু’শ বছর আগে স্বীকার করে নিয়েছিলেন ৷ যে ভাষা ব্যবহার করেন বিদ্যাপতি, তা ছিল তখনকার লৌকিক বহুল প্রচলিত ভাষা, বিদ্যাপতি তার পরিমার্জনা অন্তত পদাবলীর ক্ষেত্রে করেননি, যদিও তাঁর ঐতিহাসিক রমন্যাসে পরিমার্জিত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ৷ বিদ্যাপতির পদ্যের বিষয়বস্তু ছিল প্রাচীন লৌকিক সংস্কৃত কাব্য; তার রীতি, শৈলী, ধ্বনিবৈশিষ্ট্য ইত্যাদিও তিনি অবিকৃত রাখেন, কাব্যের দুইধারার সার্থক মিলন হয়েছিল ৷ আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যাপতি জয়দেবের তুলনায় বেশী অগ্রসর হয়েছিলেন এবং সংস্কৃত কাব্যের রসসাম্রাজ্যে তিনি সেইসব পাঠকের হৃদয়ে সংস্কৃত কাব্যের স্থান করে দেন যাঁরা সংস্কৃতবিশারদ ছিলেন না ৷ বিদ্যাপতির রচনার ধ্বনি ও অর্থ দুই-ই সাধারণ স্ত্রী পুরুষের মনকে আন্দোলিত করত, কেবলমাত্র ধ্বনি নয় ৷ এই কারণেই বিদ্যাপতি ‘অভিনব জয়দেব’ আখ্যা পেয়েছিলেন কারণ জয়দেব শুধুমাত্র নতুন কাব্যধারার ধ্বনিমাধুর্যকে লোকপ্রিয় করে তোলেন কিন্তু বিদ্যাপতি ধ্বনি ও অর্থ দুটিকেই সমানভাবে জনপ্রিয় করে তুলে আধুনিকীকরণকে বাস্তবায়িত করেন ৷
মৈথিলী কাব্যের আকাশে বিদ্যাপতি দীপ্তিমান সূর্যসমান, যাঁর উজ্জ্বল উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জোতিষ্করা প্রেক্ষাপটে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ৷ বিদ্যাপতির পূর্বগামীদের সমস্ত রচনা, তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য অধিকাংশ রচনা এবং উত্তরসূরীদেরও বেশ কিছু রচনা কলাপ্রেমিকদের মুখে মুখে উচ্চারিত ও প্রচারিত হতে হতে নষ্ট হয়ে গেছে অথবা যা রয়ে গেছে তার ভণিতা থেকে লোকে রচয়িতার নাম জেনেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা জগৎ আজ বিদ্যাপতির নাম জানে ৷ আমরা কল্পনা করে নিতে পারি যে বিদ্যাপতি ছিলেন সুকণ্ঠ এবং সুগায়ক ৷ নিজের পরিবারের রমণীদের কণ্ঠে গান শুনবার পর তিনি কিশোর বয়স থেকেই সঙ্গীত রচনায় উৎসাহী হন ও সেই সঙ্গীত অন্তঃপুরিকাদের গাইবার জন্য দান করেন ৷সুতরাং তিনি নিশ্চয়ই সামাজিক উৎসবাদির গীত রচনা দিয়ে পদকর্তার জীবন শুরু করেন এবং বয়োপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সুহৃদবর্গের জন্য, তাদের পত্নীদের জন্য ও নিজের ভার্যাদের উদ্দেশে কামদ পদাবলী রচনা করেন যা শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ মহলেই সীমাবদ্ধ ছিল ৷ বিদ্যাপতি তাঁর বেশীরভাগ গীত রমণীদের জন্য রচনা করেন, যাঁরা সঙ্গীতচর্চা করতেন এবং সেই কারণে তাঁদের পদেরও আবশ্যকতা ছিল ৷ বিদ্যাপতি ব্যবসায়িক কবি ছিলেন না, তিনি রাজসভার সদস্য ছিলেন, কিন্তু যখন তাঁর খ্যাতি প্রসার পেতে শুরু করে তখন তিনি পৃষ্ঠপোষক রাজার জন্য সঙ্গীত রচনা শুরু করেন এবং তখন রাজ অন্তঃপুরিকারাও এই গীত সোৎসাহে শিখতে শুরু করেন ও পদাবলীর আরও চাহিদা বাড়তে থাকে কারণ পুরুষরা তো সঙ্গীতের আনন্দ সংস্কৃত কাব্য থেকেও আহরণ করতে পারতেন, কিন্তু এই সঙ্গীতে যে আনন্দ ও উন্মাদনা আছে তা একবার অনুভূতিগোচর হবার পর রমণীরা বিদ্যাপতির কাছ থেকে আরও পদাবলীর রসাস্বাদন করতে উৎসুক হন ৷ নারীহৃদয় সম্বন্ধে বিদ্যাপতির সহজাত অদ্ভুত অনুভূতি ছিল এবং স্ত্রীলোকের ব্যক্তিগত গোপন চিন্তাধারা এত প্রামাণ্যতার সঙ্গে, যথার্থতা ও সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে তিনি কাব্যে চিত্রিত করতেন যে রমনীরা মনে করত এ তাদেরই একান্ত নিজস্ব অনুভূতিগ্রাহ্য হৃদয়ের বাসনা ৷ সেই কারণেই যতদিন না কোনো পুরুষ এই পদগুলি পুস্তকাকারে সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ করেননি, এই পদগুলির গায়িকা ও প্রচারকারিণীরা বেশীর ভাগই ছিলেন স্ত্রীলোক ৷ কিছুদিন আগে পর্যন্তও মিথিলার প্রত্যেক সংস্কৃতিবান পরিবারে একটি করে পারিবারিক সঙ্গীতপুস্তিকা থাকত এবং এই সঙ্গীতের আধুনিক সংস্করণের উৎসই হল প্রাচীন পারিবারিক সঙ্গীত সংকলন ৷ বিদ্যাপতি স্বহস্তে বোধ করি কোনো পদই লিপিবদ্ধ করে রাখেননি; এখনও পর্যন্ত অন্তত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি ৷ আর যেহেতু এই পদাবলী আজ পর্যন্ত সঙ্গীত প্রেমিকদের কণ্ঠভূষণ, বিদ্যাপতির জন্য সঠিক সপ্রেম সম্ভাষণ হল ‘কবিকণ্ঠহার’ ৷