খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষভাবে বাংলার মাটিতে ঠাকুর জয়দেবের অভ্যূদয় হয়েছিল এ”কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি৷ কবি জয়দেব-রচিত অষ্টপদী বা “গীতগোবিন্দ”-পদগান শ্রীরাধাকৃষ্ণের অপার্থিব লীলামাধুর্যসম্পৃক্ত৷ বাংলার ঠাকুর শ্রীচৈতন্যদেব চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির “কৃষ্ণকীর্তন”, রামানন্দ রায়ের “জগন্নাথবল্লভনাটক,” লীলাশুক বা বিল্বমঙ্গলের “শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত”-এর মতো জয়দেব-রচিত “গীতগোবিন্দ”- পদগানের পরমানুরাগী ছিলেন৷ “চৈতন্যচরিতামৃত” গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন —
চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি,
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ৷
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে
গান শুনে পরম-আনন্দে৷৷
পুরী তথা পুরুষোত্তমে রাজগুরু কাশীমিশ্রের আবাসবাটীর ক্ষুদ্র কক্ষের নাম “গম্ভীরা”৷ প্রতিদিন নীলাচলে বাসের সময় বৈষ্ণবসাধক স্বরূপ-দামোদর ও রায় রামানন্দের সঙ্গে গম্ভীরার গুপ্তকক্ষে মহাপ্রভু ঐ গ্রন্থগুলির পাঠ শুনতেন৷ স্বরূপ-দামোদর ও রায় রামানন্দ বিদগ্ধ শাস্ত্রজ্ঞানী ও পরমভক্ত ছাড়াও ভারতীয় সঙ্গীতবিদ্যায় ও সঙ্গীতশাস্ত্রে পারঙ্গম ছিলেন৷ কবি জয়দেবের মধুর-কোমলকান্ত পদাবলী শ্রবণ করে শ্রীচৈতন্যদেব মুহুর্মুহুঃ মহাভাবে সমাধিস্থ হতেন৷ শোনা যায়, সমুদ্রের গভীর গর্জনও সেই সমাধি ও মহাভাবকে ভঙ্গ করতে পারত না৷
মরমী বৈষ্ণব-সাধকগণের মতে, গীতগোবিন্দ একটি মহাকাব্য; কারণ, ইহার নায়ক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এবং নায়িকা পরমেশ্বরী শ্রীরাধা বা রাধিকা৷ শোনা যায়, লীলাশুক বা বিল্বমঙ্গল ঠাকুর-রচিত “শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত” অমৃতগ্রন্থের অনুকরণে কবি জয়দেব গীতগোবিন্দের পদসম্ভার রচনা করেছিলেন মহারসে ও ভাবে সমৃদ্ধ করে৷ গীতাগোবিন্দ দ্বাদশ সর্গে বিভক্ত৷ এতে আশিটি শ্লোক ও চব্বিশটি গীতের সমাবেশ আছে৷ এদের মধ্যে বাহাত্তরটি শ্লোক বিভিন্ন বৃত্তছন্দে, একটি শ্লোক জাতিছন্দে ও অবশিষ্ট দুটি শ্লোক ও চব্বিশটি গীত অপভ্রংশ ছন্দে রচিত৷ ( অধ্যাপক শ্রীসুধীভূষণ ভট্টাচার্য এম. এ. :”জয়দেবের ছন্দ” (পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়-লিখিত “কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ”, ৩য় সংস্করণ, পৃঃ ২০৯) দ্রষ্টব্য৷) পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় সর্গবন্ধ-নিবন্ধে গীতগোবিন্দের দ্বাদশ সর্গের নাম ও প্রকৃতি-সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন৷ বিশেষভাবে বাংলার চক্ষুষ্মান বৈষ্ণব-কবিগণ এই সর্গনাম ও তাদের অর্থ-সার্থকতা স্বীকার করেন৷ আমরা পণ্ডিত মুখোপাধ্যায়-বর্ণিত সর্গনাম-সার্থকতার কথঞ্চিৎ এখানে উল্লেখ করবো৷ তার প্রথম কারণ হল, বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনপ্রসঙ্গে বিদগ্ধ বৈষ্ণব-সাধকগণ সমর্থিত গীতগোবিন্দের সর্গনামের আলোচনা অপরিহার্য এবং দ্বিতীয় কারণ, গীতগোবিন্দপদগান ভক্তিরসানুভূতিরই মধুরোজ্জ্বল প্রশান্ত প্রতিচ্ছবি এবং অধ্যাত্মসাধক ও সৌন্দর্যরসলিপ্সু সাহিত্যিক ও কবিমাত্রেই গীতগোবিন্দের ঐ ভক্তিরসসম্পর্কিত বিবৃতির একান্ত অনুগামী৷
পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতির সারমর্ম হোল ঃ (১) গীতগোবিন্দের প্রথম সর্গের নাম “সামোদ-দামোদর” শ্রীরাধার শ্রীকৃষ্ণ-দামোদর-বিরহের স্মৃতিচ্ছবি৷ (২) গীতগোবিন্দের দ্বিতীয় সর্গের নাম “অক্লেশকেশব”৷ নবকেশব শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করার জন্য মহাপ্রকৃতিময়ী শ্রীরাধার যেমন আকুলতা, শ্রীকৃষ্ণেরও শ্রীরাধাকে লাভের জন্য তেমনি ব্যাকুলতা৷ পারস্পরিক অপার্থিব প্রেমের বিরহের জন্য ব্যাকুলতা এবং মিলনের আবেগ ও উৎকণ্ঠা এই সর্গের বর্ণনাকে রসসিঞ্চিত করেছে৷ মুক্তিকামী ভক্ত ও মুক্তিকেন্দ্র ভগবানের পারস্পরিক বিরহ ও মিলনের প্রতিচ্ছবিও এই সর্গের বিষয়বস্তু৷ (৩-৪) গীতগোবিন্দের তৃতীয় ও চতুর্থ সর্গের নাম “মুগ্ধ-মধুসূদন” ও “স্নিগ্ধ-মধুসূদন”৷ শ্রীমুখোপাধ্যায় মহাশয় বলেছেন ঃ “মধুসূদন নামের অর্থ “ভ্রমর”৷ জয়দেব শ্লিষ্ট প্রয়োগে অনেক স্থানেই মধুরিপু, মধুসূদন প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন৷” যেমন -” “অক্লেশ- কেশব” নামাঙ্কিত দ্বিতীয় সর্গের ৯ম শ্লোকে জয়দেব বলেছেন ঃ “শ্রীজয়দেবভণিত-মতিসুন্দর-মোহন-মধুরিপুরূপম্‌”৷ ঐ দ্বিতীয় সর্গের সপ্তদশ শ্লোকে আছে ঃ “নিঃসহনিপতিত তনুলতয়া মধুসূদনমুদিতমনোজম্‌” এবং অষ্টাদশ শ্লোকে আছে ঃ “শ্রীজয়দেবভণিতমিদমতিশয়-মধুরিপু-নিধুবনশীলম্‌” প্রভৃতি৷ তৃতীয় “মুগ্ধ-মধুসূদন -সর্গে” পরমনায়ক শ্রীকৃষ্ণ পরমনায়িকা শ্রীরাধিকার জন্য ব্যাকুল ও চিন্তান্বিত, আর চতুর্থ সর্গে শ্রীরাধিকার সখী শ্রীকৃষ্ণের নিকট শ্রীমতীর অবস্থার কথা নিবেদন করেছে৷ (৫) গীতগোবিন্দের পঞ্চম সর্গের নাম “সাকাঙ্খ-পুণ্ডরীকাক্ষ”৷ এই সর্গে পদ্মলোচন শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার অভিসারের আগমন -আকাঙ্খায় অপেক্ষায় অপেক্ষামান৷ (৬) ষষ্ঠ সর্গের নাম “ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ”৷ এই সর্গে কবি জয়দেব নায়ক শ্রীকৃষ্ণকে বলেছেন — ধৃষ্ট, কেননা নায়িকা পথিকের দ্বারা যে সঙ্কেত -বাণী পাঠিয়েছিলেন, তা গোপরাজ নন্দের সম্মুখে ব্যক্ত করলেও শ্রীকৃষ্ণ অপ্রতিভ না হোয়ে বরং পথিকের প্রশংসাই করেছিলেন৷ (৭) সপ্তম সর্গের নাম “নাগর-নারায়ণ”৷ বহুনায়িকাবল্লভ শ্রীকৃষ্ণের জন্য শ্রীরাধা ব্যাকুল এবং তাঁর বিপ্রলব্ধ অবস্থা। শ্রীকৃষ্ণের অদর্শনে শ্রীরাধার যে বাসকসজ্জা ব্যর্থতায় পরিণত সেকথাই কবি জয়দেব রসপূর্ণ সাবলীল ছন্দে বর্ণনা করেছেন৷ (৮) গীতগোবিন্দের অষ্টম সর্গের নাম “বিলক্ষ-লক্ষ্মীপতি”৷ এই সর্গে শ্রীরাধার প্রেমের পরম-উৎকর্ষ সাধিক হয়েছে৷ শ্রীকৃষ্ণ সজ্জিত কুঞ্জে আগমন না করায় শ্রীরাধা মানিনী এবং সেখানে তাঁকে “খণ্ডিতা নায়িকা” বলে কবি জয়দেব বর্ণনা করেছেন ঃ “শ্রীজয়দেবভণিতরতিবঞ্চিত খণ্ডিতযুবতিবিলাপম্‌”৷ (৯) নবম সর্গের নাম “মুগ্ধ-মুকুন্দ” ৷ এ সর্গে কবি জয়দেব শ্রীকৃষ্ণের চিন্তাকুল অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন, কেননা শ্রীরাধিকা এখানে মানক্লিষ্ট এবং তারি জন্য শ্রীকৃষ্ণ সেই মনোপশমনের চিন্তায় আকুল৷ (১০) গীতগোবিন্দের দশম সর্গের নাম “মুগ্ধ-মাধব”৷ এখানে কবি জয়দেব শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধার পদ ধারণ করিয়ে তাঁর মান অপসারণ করিয়েছেন৷ শ্রীকৃষ্ণের অনুনয় এখানে ঃ “বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী,হরতিদরতিনিরমতিঘোরম্‌”৷ মান অপসারণ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ চারুশীলা প্রিয়া শ্রীরাধাকে কাতরে বার বার অনুনয় জানিয়েছেন৷ (১১) একাদশ সর্গের নাম সানন্দ-গোবিন্দ৷ এই সর্গে জয়দেব নায়ক ও নায়িকা যে উভয় উভয়কে লাভের সম্ভাবনায় আনন্দিত এই ভাব রসসিঞ্চিত ভাবস্নিগ্ধ ভাষায় বর্ণনা করেছেন৷ (১২) গীতগোবিন্দের দ্বাদশ সর্গে নাম “সুপ্রীত-পীতাম্বর”৷ এই সর্গে জয়দেব শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীরাধার মান ভঞ্জন করে তাঁর সেবাধিকার লাভে কৃতকৃতার্থ এইভাব সাবলীল ছন্দে বর্ণনা করেছেন৷ সুতরাং গীতগোবিন্দের সমগ্র পদ পরমনায়ক ও পরমা নায়িকা শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার অপার্থিব লীলামাধুর্যবর্ণনায় মুখরিত৷ (পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় “কবি জয়দেব ও শ্রীগীতগোবিন্দ” (৩য় সংস্করণ, ১৩৬২)- গ্রন্থে “সর্গবন্ধ” আলোচনায় (পৃঃ ১৭ -১৭৭) যে সর্গনাম-সার্থকতার বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছেন তা দ্রষ্টব্য ৷) দ্বাদশ সর্গের সপ্তবিংশতি শ্লোকে ভক্তকবি নিজেই নিজের শ্রীকৃষ্ণৈকতানতার বর্ণনা করেছেন এবং এই শ্রীকৃষ্ণগত চিত্ত শ্রীলাভের জন্য রসিক ভক্তজনের নিকটও নিজের আবেদন জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন,
যদ্‌গান্ধর্বকলাসু কৌশলমনুধ্যানঞ্চ যদ্বৈষ্ণবং
যচ্ছৃঙ্গারবিবেকতত্ত্বমপি যৎ কাব্যেষু লীলাযিতম্ ৷
তৎ সর্বং জয়দেবপণ্ডিতকরেঃ কৃষ্ণৈকতানাত্ননঃ
সানন্দাঃ পরিশোধয়ন্তু সুধিয়ঃ শ্রীগীতগোবিন্দতঃ৷৷
পদগানে লীলায়িত উজ্জ্বলবেশ দিব্যশৃঙ্গাররস মহাপ্রেমরস-রূপে বিদিত৷ বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের মুখ্য বা আদি রসই শৃঙ্গার৷ এই আদিরস শৃঙ্গারের চরম ও পরম লক্ষ্য কামগন্ধবিহীন পরমোজ্জ্বল পুরুষ-প্রকৃতি -তত্ত্বাববোধ৷ শ্রীকৃষ্ণরতি, শ্রীকৃষ্ণপ্রেম ও শ্রীকৃষ্ণমিলনই বৈষ্ণব-পদাবলীগানের মূল-উদ্দেশ্য৷ গীতগোবিন্দের দ্বাদশ সর্গের সপ্তবিংশতি শ্লোকে আলোকপাত করে টীকাকার পূজারী গোস্বামী তাই বলেছেন ঃ “তৎ কিমিত্যাহ৷ যৎ গান্ধর্বকলাসু সংগীতশাস্ত্রোক্ত গীতরাগতালাদিসু যন্নৈপুণ্যং তদেব নির্বন্ধনানুসারেণ জানন্তু ইত্যর্থঃ৷ * * তত্রালি দুরূহগতেঃ শৃঙ্গারস্য মহাপ্রেমরসস্য বিচারে যৎ তত্ত্বংদুরূহব্রজলীলাগতং তদপ্যেতদনুসারেণ নিশ্চিন্বন্তু৷ কাব্যেসু যল্লীলায়িতং রসলীলাদিব্যঞ্জকবিশেষগ্রথনং তদপ্যেতদনুসারেণ নিশ্চিন্বন্তু৷ সর্বত্র হেতুঃ, –শ্রীকৃষ্ণে একতানঃ একাগ্রোঽনন্যবৃত্তিরাত্মা মনো যস্য তস্য শ্রীকৃষ্ণৈকান্তভক্তস্যৈব সর্বগুণাশ্রয়ত্বাদিত্যর্থঃ৷ যস্যাস্তি ভক্তির্ভগবত্যকিঞ্চনেত্যুক্তেঃ৷””
সুতরাং পদাবলীকীর্তনের পাদভূমি বা অধিষ্ঠান “গীতিগোবিন্দ”-পদগান মানবীয় কামরসসম্পৃক্ত নয়৷ অবশ্য গীতগোবিন্দের পাদপীঠ বা উৎসক্ষেত্র বৌদ্ধ-বজ্রযানী আচার্যগণ-রচিত চর্যাগীতি৷ তবে চর্যাগীতি অপেক্ষা গীতগোবিন্দের কল্যমাধুর্য ও সাহিত্যপ্রসারতা আরও অধিক৷ অপার্থিব শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব বা বিশ্বকারণ পুরুষের স্বরূপাবগতির ক্ষেত্রে পার্থিব রসস্পর্শের কোন সার্থকতা থাকে না৷ কাজেই কবি জয়দেব-রচিত গীতগোবিন্দকে যাঁরা মানবীয় প্রেম তথা কন্দর্প-কামগন্ধজর্জরিত বলেন, তাঁরা “গীতগোবিন্দ”-পদগানই শুধু নয়, মহাজন -বৈষ্ণব-পদকর্তাগণ-রচিত কোন পদাবলী ও পদাবলীকীর্তনের রসসম্ভোগ করার মোটেই অধিকারী নন৷ তন্ত্রে শৃঙ্গাররসপীঠ কামকলা কুণ্ডলিনীশক্তিকে সর্ববন্ধনাতিরিক্ত পরমশিবের প্রসুপ্ত বা অব্যক্ত রূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে৷ জাগ্রতা শক্তিই নিষ্কল শিব বা মায়ালেশশূন্য পরব্রহ্মের স্বরূপ৷ কাম সেখানে বিশ্বাতীত কামনাগন্ধহীন পরমপ্রেমে উন্নীত এবং এই প্রেমাস্বাদন বা প্রেমপরিণতি মানুষের পরম-আকাঙ্খিত সামগ্রী ও চরমলাভ৷ অদ্বৈতবেদান্তবাদী মধুসূদন সরস্বতী “ভক্তিরসায়ণ” -গ্রন্থে শৃঙ্গার-রসোদ্ভুত প্রেমের পরমপ্রকাশেকে “ব্রহ্মাস্বাদসহোদরা” বলে বর্ণনা করেছেন৷ সুতরাং গীতগোবিন্দে শৃঙ্গাররস ও শৃঙ্গারবেশসেবিত রাধাকৃষ্ণলীলাতত্ত্বকে পার্থিব কামগন্ধহীন অধ্যাত্মতত্ত্বেরই প্রতিচ্ছবি-রূপে আমাদের দেখা ও গ্রহণ করা উচিত৷ “চৈতন্যচরিতামৃত”-গ্রন্থে গোস্বামী কৃষ্ণদাস কবিরাজ রায়-চৈতন্য-সংবাদে শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব ও শ্রীরাধাতত্ত্বের অবতারণা করে বলেছেন —
প্রভু কহে যাঁহা লাগি আইলাম তোমা স্থানে৷
সেই সব রসতত্ত্ব বস্তু হইল জ্ঞানে৷৷
এবে সে জানিল সেব্য সাধ্যের নির্ণয়৷
আগে আর কিছু শুনিবারে মনে হয়৷৷
কৃষ্ণের স্বরূপ কহ রাধার স্বরূপ৷
রস কোন্‌ তত্ত্ব প্রেম কোন্‌ তত্ত্ব রূপ৷৷
রায় রামানন্দ শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব-বিশ্লেষণের পর রাধাতত্ত্ব-সম্বন্ধে বলেছেন
কৃষ্ণকে আহ্লাদে তাতে নাম আহ্লাদিনী৷
সেই শক্তি-দ্বারে সুখ আস্বাদে আপনি৷৷
সুখরূপ কৃষ্ণ করে সুখ আস্বাদন৷
ভক্তগণে সুখ দিতে হ্লাদিনী কারণ৷৷
হ্লাদিনীর সার অংশ প্রেম তার নাম৷
আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের আখ্যান৷৷
প্রেমের পরমসার মহাভাব জানি৷
সেই মহাভাবরূপ রাধা ঠাকুরাণী৷৷
* *
সেই মহাভাব হয় চিন্তামণি সার৷
কৃষ্ণ-বাঞ্ছা পূর্ণ করে এই কার্য তাঁর৷৷
মহাভাব চিন্তামণি রাধার স্বরূপ৷
ললিতাদি সখী তাঁর কায়ব্যুহরূপ৷৷
রাধা প্রতি কৃষ্ণ-স্নেহ সুগন্ধি উদ্ধর্তন৷
তাতে অতি সুগন্ধি দেহ উজ্জ্বস বরণ৷৷
* *
কৃষ্ণের বিশুদ্ধ প্রেম রত্নের আকর৷
অনুপম গুণগণে পূর্ণ কলেবর৷৷
* *
যার সদ্‌গুণগণের কৃষ্ণ না পান পার৷
তাঁর গুণ গণিবে কেবনে জীব ছার৷৷
প্রকৃতপক্ষে শ্রীরাধিকার মহাভাব কৃষ্ণরতি ও কৃষ্ণপ্রেমের চরমপরিণতি৷ বৈষ্ণব লীলা বা রসকীর্তনের চরম-আস্বাদন যাঁরা করতে চান তাঁদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, গীতগোবিন্দ ও তৎপরবর্তী যাবতীয় পদগানের নায়ক-নায়িকা শ্রীরাধাকৃষ্ণের অবিনাভাবসত্তা-সম্বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পরমতত্ত্বজ্ঞানের অনুভূতিলাভই সাধক-জীবনের উদ্দেশ্য, কেবলই বৌদ্ধিক শুষ্ক বিচার ও মানসিক ধারণার বিষয় পদগানতত্ত্ব নয়৷ তারি জন্য বৈষ্ণব আলঙ্কারিক ও পদকর্তারা পদাবলী বা পদগানের মধ্যে নিগূঢ় শ্রীরাধাকৃষ্ণের অপার্থিব প্রেমতত্ত্বের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন বিশ্বাতীত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে৷ কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” পদগানের মর্মকথাও তাই৷ স্বর্গীয় প্রেমতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই গীতগোবিন্দের পাদগানগুলি আমাদের বিশ্লেষণ করা উচিত এবং তাদের তত্ত্বাবরোধ ও রস-সম্ভোগই শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাধকজনের মুখ্য-উদ্দেশ্য৷