গীতগোবিন্দের পদগানগলি যে রস-ভাবানুবিদ্ধ অপার্থিব ঐশ্বরিক অনুভূতি ও স্পন্দনের সঞ্চার করে এবং তার রস-ভাব-উৎসই যে পরবর্তী বৈষ্ণব-পদাবলী-কীর্তনের সাহিত্যে ও সুরে রস-মন্দাকিনী প্রবাহিত করেছিল তার কিছুটা আভাস দেবার এখানে চেষ্টা করবো৷
গীতগোবিন্দের গানগুলি প্রায়ই আটটি পদে বা কলিয়ায় রচিত বলে একে অনেকে “অষ্টপদী” নামে অভিহিত করেন৷ অষ্টপদীর প্রথম ও দ্বিতীয় পদদুটি পরবর্তী পদগুলির রস ও ভাবের উদ্বোধক এবং প্রতিষ্ঠাও বটে৷ এই দুটি পদে শ্রীকৃষ্ণ-ভগবানের দশাবতার রূপের বর্ণনা করেছেন কবি জয়দেব অপরূপ রসনিবিড় ভাববিদগ্ধ ভাষায় ও ছন্দে৷ মীন, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রামচন্দ্র, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি এই দশবিধ রূপ প্রথম পদ বা গানের পঞ্চম থেকে চতুর্দশ শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে এবং এই অবতারদের বলা হয়েছে “বেদানুদ্ধবতে জগন্তি বহতে” প্রভৃতি অর্থাৎ তাঁরা বেদের উদ্ধারকারী ও ত্রিলোক-ভাববহনকারী৷ পূজারী-গোস্বামী (পূজারী গোস্বামী “চৈতন্যদাস” নামেও পরিচিত ছিলেন৷ তিনি নাকি “ভাবার্থদীপিকা” নামে গীতগোবিন্দের আর একটি টীকা রচনা করেছিলেন৷ তিনি ছিলেন বাঙালী ও শ্রীচৈতন্যদেবের কিছু পরবর্তী৷ পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ঃ “কবিরাজ গোস্বামী কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত প্রণয়নকালে শ্রীধামস্থ যে কয়জন প্রধান প্রধান বৈষ্ণবদের অনুমতি গ্রহণ করিয়াছিলেন, চৈতন্যদাস তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম এবং এই চৈতন্যদাসই শ্রীগীতগোবিন্দের টাকাকার পূজারী-গোস্বামী৷ * * শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অষ্টম পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে ) তাঁর “বালবোধিনী” টীকায় শ্রীকৃষ্ণের “দশাবতার”-রূপকে দশবিধ রসের প্রতিষ্ঠা বা আকর বলেছেন৷ তিনি বলেছেন ঃ “অথ তৎকেলীনাং সর্বোৎকর্ষপ্রতিপাদনায়াদৌ সর্বরসাশ্রয়স্য শ্রীকৃষ্ণস্য মৎস্যাদ্যবতারত্বেন সর্বসাধিষ্ঠাতুবখিলনায়ক শিরোরত্নতাং প্রতিপাদয়ন * * বসন্তে বাসন্তীত্যন্তেন৷ * * অনেন্যৈব মীনস্য বীভৎসরসাধিষ্ঠাতৃত্বং বিজ্ঞাপিতম৷” পূজারী-গোস্বামীর মতে, সর্ববসাশ্রয় সর্বভাবঘন শ্রীকৃষ্ণের মীনরূপ বীভৎসরসেব প্রকাশক৷ সেইরকম কুর্মাবতার অদ্ভুতরসের আশ্রয় (“অনেনৈব কূর্মস্যাদ্ভুতবসাধিষ্ঠাতৃত্বং বিজ্ঞাপিতম্‌”), বরাহ ভয়ানকরসের অধিষ্ঠাতা, নৃসিংহ বৎসলরসের, বামন সখ্যরসের, পরশুরাম রৌদ্ররসের,রামচন্দ্র করুণরসের, হলধর বলরাম হাস্যরসের, বুদ্ধ শান্তরসের এবং কল্কি -অবতার বীররসের আকর বা আশ্রয়৷ দশাবতাররূপাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণকে কবি জয়দেব তাই সর্বসসোত্তম শৃঙ্গার বা শৃঙ্গারস্বরূপ বলে বর্ণনা করেছেন৷ তাছাড়া পূজারী
পণ্ডিত গোসাঞিঁর শিষ্য ভূগভ গোসাঞিঁ৷
পৌরকথা বিনা আর মুখে অন্য নাঞি৷৷
তার শিষ্য গোবিন্দপূজক চৈতন্যদাস৷
চৈতন্যদাসই যে পূজারী-গোস্বামী শ্রদ্ধেয় মুখোপাধ্যায় মহাশয় তার প্রমাণ দিয়েছেন গদাধর শিরোমণির দৌহিত্রবংশীয় বাঁকুড়া সোনামুখীর জমিদার স্বর্গত তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহ রক্ষিত একটি প্রাচীন বালবোধিনী-টীকার সূচনাশ্লোক থেকে৷ শ্লোকটি হোল–
* *
স্বয়ং বৌদ্ধ মভিপ্রায়ং জয়দেব-মহামতেঃ৷
টীকা চৈতন্যদাসেন প্রখ্যতে বালবোধিনী৷৷
* *
পুঁথির সমাপ্তিশ্লোক —
গোবিন্দ-পাদ-সেবায়াঃ প্রভাবাদুদিতা স্বয়ম৷
চৈতন্যদাসত্যে বালবোধিনী স্যাৎ সতাং মুদে৷৷
কিন্তু অধুনামুদ্রিত “বালবোধিনী”-টীকার সূচনাশ্লোকের অংশ হোল —
স্বয়ং বৌদ্ধ মভিপ্রাযং জয়দেব মহামতেঃ৷
ক্রমেণোপক্রমাদেষা গ্রথ্যতে বালবোধিনী৷৷
তাছাড়া “অত্র ব্যাকরণাদীনাং গ্রন্থবাহুল্য ভীতিতঃ” থেকে শেষচরণ “ভাবার্থদীপিকাযাঞ্চ ভাবো ভাবার্থলোলুপৈঃ” এই এক রকম পাঠই আছে৷ সুতরাং বিশেষ বিচার করে দেখলে “সুবোধিনী”-টীকাকার পূজারী-গোস্বামী ও চৈতন্যদাস এক ও অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে হয়৷ তবে একথাও সত্য যে,বৈষ্ণব-সাহিত্যে কয়েকজন চৈতন্যদাসেরও নাম পাওয়া যায়৷ গোস্বামী দ্বিতীয় গীত– “শ্রিতকমলাকুচমণ্ডল৷ ধৃতকুণ্ডল” প্রভৃতির প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “দশাবতারান্‌ কুর্বতে শ্রীকৃষ্ণায় সর্বাকর্ষণানন্দায়তুভ্যং নমোহস্তু৷ ** শ্রীকৃষ্ণস্য সর্বনায়কশিরোরত্নতাপ্রতিপাদনায় ধীরোদাত্তত্বাদিচতুর্বিধনায়কগুণ-সমন্বয়েন সর্বোৎকর্ষাবিভাবনং প্রার্থয়তে শ্রিতকময়লত্যাদিভিঃ৷” এ প্রসঙ্গে ডক্টর শ্রীসুশীলকুমার দে Early History of the Vaishnava Faith and Movement in Bengal (1942)-গ্রন্থে বলেছেন ঃ “The opening Dasavatra Stotra, as well as the second Jaya-Jaya-Deva-Hare Stotra,presents Krishna in his Aisvarya aspect, not as an Avatrara, but as the veritable supreme deity of many incarnations (dasakritikrite krishnaya tubhyam namah), omitting all reference to Radha but mentioning Sri or Lakshmi. As the poem proceeds the Dhirodatta-Nayaka becomes Dhiralalita, and all the erotic Madhurya implications of the theme are developed to their fullest extent”.
নাট্যশাস্ত্রে ভরত আটটি রসের ও বর্ণের নামোল্লেখ করেছেন এবং শৃঙ্গারকে স্থায়ী ভাবসম্পন্ন শুচি ও উজ্জ্বলবেশাত্মক রস বলে বর্ণনা করেছেন ঃ “তত্র শৃঙ্গারো নাম রতিস্থায়িভাবপ্রভবঃ৷ উজ্জ্বলবেশাত্মকঃ৷ “যৎকিঞ্চিল্লোকে শুচি মেধ্যমুজ্জ্বলং দর্শনীয়ং তচ্ছৃঙ্গারেনোপমীয়তে”৷ যস্তাবদুজ্জ্বলবেশঃ স শৃঙ্গারবানিত্যুচ্যতে৷”
অভিনবগুপ্ত প্রভৃতি ভাষ্য ও টীকাকারগণ শৃঙ্গারের লৌকিক অর্থেরই পরিচয় দিয়েছেন নাট্যশিল্পীজীবনে রূপায়ণের জন্য ও তারি জন্য তাঁরা নির্বেদসূচক শান্তরসের অবতারণা করেছেন পবিত্রতার দ্যোতকরূপে৷ অভিনবগুপ্ত “অভিনবভারতী”-টীকায় বলেছেন ঃ “অথ শান্তো নাম শমস্থায়িভাবাত্মকো মোক্ষপ্রবর্তকঃ”৷ কিন্তু কবি জয়দেবের অভিপ্রায় এসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কেননা যেখানে তিনি সর্বরসাশ্রয় ও সর্বভাবকেন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকে আদিরস শৃঙ্গারের প্রতিমূর্তি এবং অধিষ্ঠাতারূপে বর্ণনা করেছেন, সেখানে শৃঙ্গাররসময় শ্রীকৃষ্ণ কখনই লৌকিক অথবা জাগতিক সম্ভোগরসের প্রতিমূর্তি ও নায়ক বলে গণ্য হতে পারেন না৷ জয়দেবের শ্রীকৃষ্ণ তাই সর্বোত্তম ও সর্বসাধকারাধ্য “কৃষ্ণ ভগবান”৷ তিনি দিব্যলীলার কেন্দ্রদেবতা, এবং তাঁর লীলাসঙ্গিনী পরমানায়িকা শ্রীরাধাও দিব্যশক্তিরূপিণী৷ গীতগোবিন্দের এই শ্রেষ্ঠ নায়ক-নায়িকাই তন্ত্রসাহিত্যের শিব-শক্তি-রূপের দিব্যপ্রতিমূর্তি৷
তন্ত্রে শিবকে কল্পনা করা হয়েছে নিষ্কল ব্রহ্ম ও পরমানন্দ বিশুদ্ধচৈতন্যরূপে৷ তিনি পরমোজ্জ্বল্ দিব্যজ্ঞানপীঠ সহস্রাবকমলে আসীন এবং তাঁরি অভিন্নপ্রকাশ শক্তি কামকলা বা কুণ্ডলিনী আধারপদ্মে আসীনা৷ একটি ব্যক্ত ও জাগ্রত এবং অন্যটি অব্যক্ত ও সুপ্ত৷ একটি কেন্দ্রে শক্তি চৈতন্যঘন পরমশিব-রূপে সপ্রকাশ এবং অপর কেন্দ্রে শক্তি অব্যক্তচৈতন্য রূপে অপ্রকাশ , কিন্তু পূর্ণ চৈতন্যরূপিণী৷ ৷
তন্ত্রপ্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সাধারণ মানবীয় “কাম”-রূপ সিসৃক্ষাকে তন্ত্রে সৃষ্টি-ইচ্ছার প্রতীকরূপে বর্ণনা করেছে৷ উপনিষদে উল্লিখিত আদিকামও সগুণব্রহ্মের সৃসৃক্ষা বা সৃষ্টি-ইচ্ছা, কেননা উপনিষদে পাই, তিনি (সগুণব্রহ্ম) কামনা করলেন “বহু” হবার জন্য, সুতরাং সেই কাম বা কামনাই তার “এক” ও অখণ্ড রূপকে বহুতে বিবর্তিত করলো৷ সেই কাম বা কামনাই দিব্যস্পন্দনরূপিণী কলা বা কামকলা কুণ্ডলিনী৷ সেই কাম, কলা বা কামকলাই শক্তি বা শক্তিস্বরূপিণী৷ তন্ত্রসৃষ্টিতে শক্তি চিৎ বা জ্ঞানস্বরূপ৷ স্যার জন্‌ উডবফ্‌ তান্ত্রিক “যন্ত্র”বিশ্লেষণে এই সম্বন্ধে যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য৷ তিনি শক্তি, কামশক্তি বা কামকলার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেছেন ঃ “Consciousness is Power. As this is an identity, its simple converse is also true-Power is Consciousness, Consciousness is of Being and Becoing. So Power is to Be and Become. Power posits itself as will. Hence Will-to-be and Will-to-become. This is Kala which, as Basic Desire, is Kama-Kala. Cosmically, it is what informs, formulates,shapes, patterns. * * But Chit-Sakti is Vimarsa also. That is to say, It not only is and manifests Its own being, but It also becomes and manifests what It becomes. Prakasa and Vimarsa are not isolable. This is shown in God Mother Kali. There Kali, in this fundamental context, is Kali” in this fundamental context, is Kali” (Cf. Swami Pratyagatmananda Saraswati and Sir John Woodroffe : SAdhana for Self-realization (1963), p.43 এবং The Serpent-Power-গ্রন্থ দ্রষ্টব্য ৷)
মোটকথা তন্ত্রে কামকলা বা কুণ্ডলিনীকে coiling energy বা অব্যক্তশক্তি বলা হয়েছে কুণ্ডলিনীর স্বরূপবিকাশের অভাবের জন্য৷ স্যার জন উডরফ-তন্ত্রতত্ত্ব ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে মূলাধারে কুণ্ডলিনী-সম্বন্ধে বলেছেন ঃ “The Kundalini at the muladhara is the whole primordial Sakri in monad or germ or latency : that is why it is coiled. The Kundalini that mounts up the nadi is also the whole Sakti in a secially dynamic form-and eject likeness of the Eternal Serpent. The result of the last fusion (there are successive fusions in the various centres also) in the sahasrara is also the Whole, or purna”.উপনিষদের “পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে” মন্ত্রের এটি প্রতিধ্বনি৷ এথেকে আমরা বুঝি যে, potential বা সূক্ষ্মাবস্থায় শক্তি কুণ্ডলিনী শুধু ব্যষ্টি জীবেই নয়, বিশ্বের সর্বত্র সকল জীব ও জিনিসের মধ্যে নিহিত৷ তন্ত্রে এই শক্তি তেজোময় “বিদ্যুৎলতাকারা”৷ “কামকলাবিলাস” তন্ত্রে কামকলা কুণ্ডলিনী সম্বন্ধে বলা হয়েছে ঃ “কাম কমনীয় তথা কলা চ দহনেন্দু বিগ্রহৌ বিন্দু”৷ “কাম” অর্থে তাই কামেশ্বর শিব এবং তিনি তেজোময় প্রকাশস্বরূপ৷ এই “কাম-শিবই” “অগ্নি” নামে পরিচিত৷ এঁকে ইন্দু বা চন্দ্র-রূপেও কল্পনা করা হয়েছে ঃ “অগ্নষোমরূপিণী”৷ অগ্নি ও চন্দ্রের মিথুন রূপ “বিন্দু”৷ তন্ত্রে বিন্দু মহাত্রিপুরসুন্দরী কামকলা৷ “কলা” অর্থে বিমর্শশক্তি৷ “বিমর্শশক্তিই” কামেশ্বরী “ষোড়শী” ঃ “বিমর্শরূপিণী বিদ্যা ষোড়শী যা প্রকীর্তিতা”৷ বিন্দু, নাদ ও বীজরূপে কামকলার প্রকাশ৷ আবার বিন্দু শিব ও বীজ শক্তি এবং এদের মিলিত রূপেই নাদের সৃষ্টি৷ নাদ বা কুণ্ডলিনীই শব্দব্রহ্ম স্ফোট ৷ সারদাতিলকতন্ত্রে(১.১১-১২) এবং প্রপঞ্চসারতন্ত্রে(১.৮৮) শব্দব্রহ্ম নাদের বা স্ফোটের সৃষ্টিপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
(ক) ভিদ্যমানাৎ পরাদ্‌ বিন্দোবব্যক্তাত্মা বরোঽভবৎ৷
শব্দব্রহ্মেতি তং প্রাহুঃ সর্বাগমবিশারদাঃ ৷৷
(খ) বিন্দোস্তস্মাদ্‌ ভিদ্যমানাদ্‌ রবোঽব্যক্তাত্মকো ভবেৎ৷
স স্বঃ শ্রুতিসংপ+ন্নৈঃ শব্দব্রহ্মেতি কথ্যতে৷৷
ভাষ্যকার উমাপতি স্বতন্ত্রতন্ত্রের ২৪শ কারিকায় বলেছেন ঃ “কুণ্ডলিনী শব্দবাচ্যা তু ভুজঙ্দগকুটিলাকারেণ নাদাত্মনা স্বকার্যেন প্রতিপুরুষং ভেদেনাবস্থিতো, ন তু স্বরূপেণ প্রতিপুরুষমবস্থিতা৷” স্বতন্ত্রতন্ত্রের কারিকাটি হোল —
যথা কুণ্ডলিনী শক্তির্মায়াকর্মানুসারিণী৷
নাদবিন্দ্বাদিকং কার্যং তস্যা ইতি জগতস্থিতিঃ৷৷
“ললিতাসহস্রনাম” গ্রন্থে নাদরূপী কুণ্ডলিনী “কমলা”-দেবী৷ এর টীকাকার ভাস্কররায় নাদরূপী কুণ্ডলিনী বা কামকলার “কাম” অর্থে বলেছেন ইচ্ছা বা শিব ও শক্তির মিথুনমূর্তি এবং “কলা” অর্থে তাদের প্রকাশ বা manifestation৷ তন্ত্রশাস্ত্রে তাই কামকলা কুণ্ডলিনী সর্ব মন্ত্র তথা শব্দের ও বিশ্বপ্রপঞ্চের বীজ বা কারণরূপে পরিচিত৷ সুতরাং তন্ত্রদৃষ্টিতে সৃষ্টিবিলাসিনী কাম বিমর্শ (বিমর্শশক্তি) এবং নিষ্কল চিৎ বা শিব প্রকাশ (প্রকাশশক্তি)৷ এই বিমর্শ ও প্রকাশ একই শক্তির উন্মীলন ও নিমীলন রূপ৷ কাম সাধারণ মানুষের কাছে পার্থিব সংসারসৃষ্টির কারণ এবং অপার্থিব মহামানবের কাছে সমষ্টি বিশ্বসৃষ্টির কারণ৷ পুনরায় মানুষের বিকৃত দৃষ্টির কাছে কাম (Id)অকল্যাণরূপে প্রতীত হলেও মহামানব বা দেবমানবের কাছে কল্যাণময় ইচ্ছা রূপেই প্রতিভাত হয়৷ গীতগোবিন্দের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ রসপ্রতিষ্ঠারূপী শৃঙ্গার অর্থে অপ্রাকৃত রসলীলার স্রষ্টা ও দ্রষ্টা৷ কবি জয়দেব তাই শৃঙ্গারকে মানবীয় প্রেমের পরিবর্তে শাশ্বত আনন্দসত্তায় প্রতিষ্ঠিত কামকে ঈশ্বরীয় প্রেম-রূপে অনুভব ও বর্ণনা করেছেন৷ তারি জন্য কবি দশাবতারের রূপবর্ণনার শেষে শৃঙ্গাররসরূপী সর্বরসকেন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম জানিয়ে বলেছেন ঃ “কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ”৷
এখানে রস-নির্ধারণের ব্যাপারে “রসিকপ্রিয়া”-টীকাকার রাণা কুম্ভা পূজারী-গোস্বামীর ব্যাখ্যাকে মোটেই অনুসরণ করেন নি৷ যেমন, মীনাবতারকে রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “উৎসাহস্থায়িভাবো বীরো রসঃ ৷ দশস্বপি পদেষু ধীরললিতো নায়কঃ”৷ বামন-অবতারকে রাণা কুম্ভা বলেছেন ঃ “অত্রাদ্ভূতো রসঃ”৷ পরশুরামকে বলেছেন ঃ “অত্র বীভৎসো রসঃ”৷ “প্রলয়েত্যাদিপদষট্‌কে ধীরোদ্ধতো নায়কঃ” ৷ রামচন্দ্রকে বলেছেন ঃ “ধীরোদাত্তো নায়কঃ”৷ বলরামকে বলেছেন ঃ “ধীরললিতো নায়কঃ” বা “শৃঙ্গারী নায়কঃ” এবং বুদ্ধাবতারকে বলেছেন ঃ “ধীরশান্তো নায়কঃ” এবং তিনি শান্তরসের প্রতিষ্ঠা বা কারণ। আবার যেখানে জয়দেব শ্রীকৃষ্ণকে বর্ণনা করেছেন ঃ “শৃণু সুখদং শুভদং ভরসারম্‌”, সেখানেও শ্রীকৃষ্ণ শান্তরসের প্রতিমূর্তি বা আশ্রয়, এবং যেখানে বলেছেন ঃ “কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ”, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ শৃঙ্গাররসের প্রতীক৷ (টীকাকার পূজারী-গোস্বামী গীতগোবিন্দের অধিকাংশ পদব্যাখ্যায় নায়ক-নায়িকাগুণের পরিচয় দিয়েছেন৷ যেমন (১) “বসন্তে বাসন্তীকুসুমসুকুমারৈবরযবৈর্ভ্রমন্তী, প্রভৃতি পদের (১.২৭) ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ শ্রীরাধিকায়াঃ সর্বোৎকষমাবিষ্কর্তুং তত্র তত্র তস্যা অষ্টনায়িকাবস্থাং বর্ণযন সম্ভোগপোষকবিপ্রলস্তশৃঙ্গারবর্ণনায় প্রথমং বিরহোৎকণ্ঠিতামাহ বসন্ত ইতি”৷ (২) “অথাগতাং সাধ মস্তরেণ * দৃষ্টবদেবদাহ” (৭.১২) পদব্যাখ্যায় বলেছেন ঃ “চন্দ্রোদযেন শ্রীকৃষ্ণাগমনপ্রতিবন্ধে সতি তং বিনা সখ্যা আগমনে তস্যা বিপ্রলব্ধাবস্থাং বর্ণায়িতুমাহ অথেতি”৷ (৩) “সমুদিতমদনে রমণীবদনে” প্রভৃতি (৭.২২) পদব্যাখ্যায় বলেছেন ঃ “পুনস্তস্যা এবং স্বাধীনভর্তৃকাত্বসূচকপূর্বকং তল্লীলাবিশেষমাহ * * ৷ ” (৪) “অথ কথমপি যামিনীং প্রভৃতি (৮.১) পদব্যাখ্যায় খণ্ডিতাবস্থার বর্ণনা করেছেন৷ ) রাণা কুম্ভা তাঁর “সংগীতরাজ”-গ্রন্থ থেকে রস ও নায়কের রূপবর্ণনা করেছেন৷ (রাণা কুম্ভা-কৃত “সংগীতরাজ” গ্রন্থে রস-বর্ণনা দ্রষ্টব্য৷ বারাণসী মহাবিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ও ডক্টর প্রেমলতা শর্মা-সম্পাদিত Sangitaraja,১ম ভাগ৷ )
মোটকথা পূজারী-গোস্বামী ও রাণা কুম্ভার মধ্যে রস-নির্ধারণ-ব্যাপারে কিছু-কিছু মতভেদ থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ যে সর্বরসনায়ক ও পরমরসরূপী একথা উভয়েই স্বীকার করেছেন এবং এই স্বীকৃতি থেকে একথাও নিঃশংসয়ে প্রমাণ হয় যে, সর্বরসাশ্রয়ী গীতগোবিন্দপদগান যে পরবর্তী কালের রসমন্দাকিনীর আশ্রয় বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের “পটভূমি ” এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই৷ তাছাড়া গীতগোবিন্দের অন্যান্য পদ বা গানগুলির পর্যালোচনা করলে একথা স্পষ্ট প্রমাণ হয়৷
উদাহরণরূপে বলা যেতে পারে যেমন, গীতগোবিন্দের তৃতীয় গান ললিতলবঙ্গলতা- পরিশীলনকোমলমলয়সমীরে” প্রভৃতি নববসন্তের পরিবেশ ও সৌন্দর্যকে আবাহন জানিয়ে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের রসলীলার অপরূপ রূপ-বর্ণনায় মুখর৷ এই সরসবসন্ত সময়ে শ্রীরাধা-কৃষ্ণের সম্ভোগলীলাচিত্র স্মরণে যদি কারো মনে কোন ব্যভিচারী ভাবের সঞ্চার হয় তার জন্য কবি জয়দেব বলেছেন ঃ “শ্রীজয়দেবভণিতামিদমুদযতি হরিচরণস্মৃতিসারম” প্রভৃতি অর্থাৎ শ্রীজয়দেব রচিত এই সরসবসন্তকালের বনশোভা ও তদনুগত মদনবিকারের বর্ণনা সকলের চিত্তে যেন সারভূত হরিচরণের পবিত্র স্মৃতি জাগ্রত করে৷ দৃষ্টি ও ভাবনা এখানে বিশ্বোত্তীর্ণ ও আনন্দাভিমুখী, পার্থিব সংসারসুখের দিকে তা মোটেই নমিত নয়৷ অধিকাংশ ব্যাখ্যা ও টীকাকাররা এখানে ধীরোদাত্ত, ধীরললিত, ধীরশান্ত ও ধীরোদ্ধত এই চার রকম নায়কগুণের বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন৷ রস, ভাব ও নায়ক-নায়িকার বিস্তৃত পরিচয়ের উল্লেখ আমরা পরে করার চেষ্টা করবো এখানে আলোচনা উদ্দেশ্য হল, কীভাবে গীত-গোবিন্দাশ্রিত রস, ভাব ও নায়ক-নায়িকাগুণকে আশ্রয় করে পরবর্তী মহাজন-পদাবলীকীর্তন রস ও ভাবসমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছিল তা প্রদর্শন করা৷
বৈষ্ণবশাস্ত্রবেত্তা পণ্ডিত শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বিবৃতিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য৷ তিনি বলেছেন ঃ “ভগবদুপাসনার দুইটি আছে ঃ একটি ঐশ্বর্যের ও অপরটি মাধুর্যের ৷ * * কবি জয়দেব প্রথম জীবনে ঐশ্বর্যের — বিধিমার্গের উপাসক ছিলেন এবং সেই ভাব হইতে সাধনার ক্রমবিকাশে রাগের পথে তিনি মাধুর্যের ব্রজকুঞ্জে প্রবেশলাভ করিয়াছিলেন৷ * * শ্রীগীতগোবিন্দের আরম্ভভাগে দশাবতারস্তোত্রে এবং “শ্রিতকমলাকুচমণ্ডল” (গীত ২) সঙ্গীতটিতে শ্রীকৃষ্ণের এই ঐশ্বর্যরূপই প্রকাশিত হইয়াছে৷ দশাবতারস্তোত্রে শ্রীকৃষ্ণ সর্বাবতারের কেন্দ্ররূপে বর্ণিত হইয়াছেন৷ কবি বন্দনা করিতেছেন “দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ”৷ * * “শ্রিতকমলাকুচমণ্ডল” পদগানটি ঐশ্বর্যদ্যোতক, কারণ তাহার মধ্যে একবারও শ্রীরাধার নাম উল্লিখিত হয় নাই, আদাবন্তে শ্রী-র নামই কীর্তিত হইয়াছে৷”
তাছাড়া “জনকসুতাকৃতভূষণ জিতদূষণ সমবশমিতদশকণ্ঠ অভিনবজলধরসুন্দরবধৃতমন্দর শ্রীমুখচন্দ্রচকোর” প্রভৃতি গীতটির প্রসঙ্গেও শ্রীমুখোপাধ্যায় বলেছেন ঃ “কবি শ্রীরাধার প্রেমের উৎকর্ষ দেখাইবার জন্য শ্রী ও সীতার প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নায়কতন্ত্রের দুইটি দিক প্রদর্শন করিয়াছেন ৷ * * টীকাকার বলিতেছেন — এই সঙ্গীতে ধীরলম্বিত, ধীরশান্ত, ধীরোদ্ধত এবং ধীরোদাত্ত নায়কের লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে৷ কিন্তু ধীরললিত নায়ক শ্রেষ্ঠ বলিয়া আদি ও অন্তে তিনি শ্রীপতিরূপেই উল্লিখিত হইয়াছেন৷ * * শ্রীমদ্ভাগবত বলেন সৌন্দর্যসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী শ্রীদেবীও গোপীপ্রেমের আকাঙ্ক্ষা করিতেন৷ সুতরাং বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, কবি এই দুইটি সঙ্গীতে ঐশ্বর্যের পরিপূর্ণ ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া লইয়াছেন, এইবার ধীরে মাধুর্যের রাজ্যে অগ্রসর হইবেন৷” পরবর্তী পদাবলীকীর্তনেও শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও মাধুর্যের বিকাশ সুস্পষ্ট৷
কবি জয়দেব শ্রীরাধা-কৃষ্ণের বিচিত্র ভাবময় রসলীলার বর্ণনায় সাধকের রসানুভূতির ক্ষেত্রে যে এক অনির্বচনীয় ভাবমন্দাকিনীর প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই৷ পরবর্তী লীলাকীর্তন বা রসকীর্তনে বিদগ্ধ মহাজনগণ যে বৃন্দাবন, দ্বারকা, মথুরা ও অন্যান্য স্থানবিলাসী শ্রীরাধা-কৃষ্ণের অপার্থিব লীলাকাহিনীর পটভূমিকায় বিচিত্র পালাগানের অবতারণা করে কীর্তনের সুর ও সাহিত্য-ভাণ্ডারকে রসসমৃদ্ধ করেছেন তার ধারণা, আদর্শ ও উদ্দীপনায় বীজ বা উপকরণও তাঁরা সংগ্রহ করেছেন কবি জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” থেকে৷ যেমন, শ্রীকৃষ্ণের লীলাবর্ণনাচ্ছলে জয়দেব বলেছেন ঃ “কালিয়বিষধরগঞ্জন”(১.১৯), “বৃন্দাবনবিপিনে পরিসরপরিগতযমুনাজলপূতে” (১.৩৪), “গোপবধূরনুগায়তি কাচিদুদঞ্চিতপঞ্চমরাগম্‌” (১.৪১),”রাসরসে সহনৃত্যপরা হরিণাঃ যুবতিঃ প্রশশংসে” (১.৪৫), “রাসোল্লাসভরণে বিভ্রমভৃতামাতীরবামভ্রুবাম্‌” (২.৬), “বিহরতি বনে রাধা সাধারণপ্রণয়ে হরৌ” (২.১), “গোপকদম্বনিতম্ববতীমুখচুম্বনলম্বিতলোভম্‌” (২.৪), “পীতবসনমনুগতমুনিমনুজসুরাসুরবরপরিবারম” (২.৬), “বিশদকদম্বতলে মিলিতং” (২.৮), “গোবিন্দং ব্রজসুন্দরীগণধৃতং” (২.১৯),”বৃষ্টিব্যাকুল- গোকুলাবন- রসাদুগ্ধত্যগোবর্দ্ধনং * * শ্রেয়সি কংসদ্বিষঃ” (৪.২৩), “ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী” (৫.০), “পততি পতত্রে বিচলিত পত্রে * * রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং, পশ্যতি তব পন্থানম্‌” (৫.১১) প্রভৃতি এগুলি যে পরবর্তী পদাবলীকীর্তনের রসধারাসিক্ত মান, খণ্ডিতা, মাথুর,দান,নৌকাখণ্ড, রাস, কলহান্তরিত প্রভৃতি পালারূপ লীলাভিনয়ের বিষয়বস্তুতে গৃহীত হয়েছিল একথা সূক্ষ্মদর্শীমাত্রেই স্বীকার করেন৷ রাগ, তাল প্রভৃতির বেলায়ও তাই৷
এর পর এইপ্রসঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু হবে গীতগোবিন্দ-মহাকাব্যে নৃত্যলক্ষণসম্পৃক্ত অভিনয়পদ্ধতি — যে অভিনয়পদ্ধতি অব্যাহত আছে এখনো বিশেষভাবে দক্ষিণ-ভারতে তাঞ্জোর-অঞ্চলে ভরত-রচিত নাট্যশাস্ত্রের ধারাকে অনুসরণ করে ৷ যদিও বাংলার পদাবলীকীর্তনে অভিনয়ের সহযোগ একান্তভাবে পাওয়া যায় না, তবুও প্রাচীন গীতিনাট্য গীতগোবিন্দের নৃত্যাভিনয়ের কিছুটা প্রাচীন ধারার ইঙ্গিত পাওয়া সম্ভব হবে৷ তাছাড়া একথা সত্য যে, গীতগোবিন্দ-গীতনাট্যের বা গেয়নাটকের অনুপ্রেরণা লাভ করে ভারতেই এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-ভারতের ও বাংলার গীতিনাট্য ও সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যনাট্যগুলির বিকাশ পরবর্তীকালে সম্ভব হয়েছিল৷