এটি একটি স্বীকৃত তথ্য যে বিদ্যাপতির কবি হিসেবে বিশ্বজনীন আবেদন মুখ্যত তাঁর প্রেম পদাবলীর জন্য৷ তিনি সত্যিই অমর প্রেমের মধুর পদাকর্তা–দেহজ বা কামজ প্রেমের, যার জন্য নারী ও পুরুষ পরস্পরকে কামনা করে৷ সমস্ত মানবিক অনুভূতিগুলির মধ্যে এটিই সবচেয়ে মৌলিক ও আদিম, সৃষ্টির রহস্যপ্রক্রিয়া এতে আধারিত এবং সারা পৃথিবীতে কাব্য জগতে সর্বাধিক জনপ্রিয় বিষয়বস্তু৷ সংস্কৃত সাহিত্য শৃঙ্গার রসাত্মক রচনায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং এই প্রকার কাব্যের প্রারম্ভ খ্রীষ্ট জন্মের আগে প্রাকৃত গীতির মধ্যে দিয়ে ঘটে৷ কিন্তু বিদ্যাপতি এই কাব্যধারাকে গ্রহণ করেন জয়দেবের রচনা থেকে যাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ শ্রীকৃষ্ণ ও ব্রজবালাদের দেহজ প্রেমের বিবিধ প্রকাশ৷
বিদ্যাপতির প্রেমপদাবলীর জনপ্রিয়তার কারণ কিন্তু কেবলমাত্র প্রেমের সার্বজনীন অনুভূতি নয়, তাঁর রচনার উৎকর্ষও৷ এই গানগুলিতে তিনটি বিভিন্ন তত্ত্ব আছে যা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং এই তিনটি ধারা একত্রে মিলিত হয়ে এই অনুপম লোকপ্রিয়তার সৃষ্টি করেছে যা স্থানকালের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে৷
সর্বপ্রধান দিকটি হল বিষয়বস্তু৷ তাঁর সব পদই ছন্দোবদ্ধ ও গীতিধর্মী যা সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের ভাষায় ‘মুক্তক-কাব্য’ আখ্যা পেয়েছে; যাতে প্রত্যেক গীতই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল৷ এই গীতগুলি স্ত্রীপুরুষের দেহজ প্রণয়ের বিভিন্ন ভাব ও অনুভূতিকে চিত্রিত করে৷ নিজের কল্পনাশক্তির সহায়তায় বিদ্যাপতি এই অনুভূতি বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন এবং এত সত্যাশ্রয়ী, বাস্তব ও সহানুভূতিসম্পন্ন কাব্য রচনা করেন যে প্রত্যেকে মনে করে এতে বিদ্যাপতির নিজের অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিত্বেরই পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে৷
দ্বিতীয়ত এই পদগুলি এমন ভাষায় রচিত যা মধুর লয়াত্মক ও সুরেলা৷ শব্দনির্বাচনে বিদ্যাপতি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন৷ সঠিক স্থানে সঠিক, প্রাসঙ্গিক , সরল , প্রত্যক্ষ এবং স্নিগ্ধ শব্দচয়ন তাঁর কাব্যে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে৷ হ্রস্বস্বর ও তরল ব্যঞ্জনবর্ণের অতি ব্যবহারের কারণে বাংলাভাষার মতোই মৈথিলী ভাষা অত্যন্ত মিষ্টত্ব লাভ করেছে এবং এই জন্য বিদ্যাপতির কৃতিত্ব সর্বাধিক, যিনি শব্দের রূপকে এমনভাবে সুসজ্জিত করেছিলেন যে অপভ্রংশ কালের সমস্ত রুক্ষতা চলে গিয়ে শব্দপ্রবাহ মৃদুল লয়াত্মক হয়েছিল৷ বিদ্যাপতির পদে শব্দের নির্বাচন শ্রোতার মানসিকতার অনুকূল কিন্তু শব্দ তৎসম, তদ্ভব বা দেশী যাই হোক না কেন তা সুকোমল, মধুর, সরল ও শ্রুতিমধুর এবং সেইসঙ্গে হৃদয়ে দ্রুত প্রভাব বিস্তারে সমর্থ৷ বিদ্যাপতির মধ্যে ধ্বনি দ্বারা অর্থ অনুসরণ করানোর ক্ষমতা ছিল যাতে আমরা যদি পদের অর্থ নাও বুঝতে পারি, অন্তর্নিহিত ভাবনাটির অনুভব নিশ্চিত ভাবেই করতে পারব৷
তৃতীয়ত,সব কটি গীতই পূর্ব ভারতের বিশিষ্ট রাগ রাগিনীর ওপর ভিত্তি করে রচিত৷ বৌদ্ধ সিদ্ধ সম্প্রদায় দ্বারা নিজেদের গানে প্রযুক্ত রাগ, জয়দেব দ্বারা গীতগোবিন্দে প্রযুক্ত রাগ, জ্যেতিরীশ্বর রচতি ‘বর্ণরত্মাকর’-এ উল্লিখিত রাগ সবই সেই প্রকার,যা বিদ্যাপতি নিজের পদাবলীতে প্রযুক্ত করেছিলেন৷ কর্ণাটদের আমলে মিথিলায় সঙ্গীতের গুণগ্রাহিতা ছিল যার ফলে এই সঙ্গীতকলা যথোচিত সমৃদ্ধি লাভ করে এবং লোচন যা কিছু তাঁর ‘রাগ তরঙ্গিনী’তে উল্লেখ করেছেন, তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় মিথিলায় সঙ্গীতপ্রেমী এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিল যাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল উল্লেখযোগ্য–সঙ্গীত বিলম্বিত লয়ে সমবেত কণ্ঠে গীত হত ইত্যাদি৷ এই সঙ্গীতের বিকাশে বিদ্যাপতির যথেষ্ট অবদান ছিল৷ তিনি রাগরাগিনীকে ব্যবহার করেন ও পদাবলীতে এমন মধুর সুর প্রদান করেন যাতে একই রাগের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন সুরলহরীর সৃষ্টি হয়৷ একটি শব্দ গাইতে যত সময় লাগে, তার ওপর নির্ভর করে সম্পূর্ণ পদের ছন্দকরণ আধারিত করা হত এবং ফলস্বরূপ হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বর ছিল যথার্থ পাঠনির্ভর অর্থাৎ স্থায়ী নয়৷ লোচন তাঁর ‘রাগতরঙ্গিনী’তে বলেন,বিদ্যাপতির যে কোনো পদে ব্যবহৃত ছন্দ রাগাশ্রয়ী ও রাগনামাঙ্কিত কিন্তু যদি আমরা পংক্তিনিবদ্ধ শব্দসমষ্টির ওপর ছন্দরূপ আরোপিত করি, তাহলে তা লোচনের মতকে সমর্থন করে না, কারণ গায়নভঙ্গি অনুযায়ী একই গানকে বিভিন্ন সঙ্গীতগুরু বিভিন্ন রাগের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এই কারণে শব্দসমষ্টির একই প্রকার শব্দসজ্জাকে বিভিন্ন ছন্দের মাত্রা দিয়ে সূচিত করা যায় না যদিও গীতধ্বনির পৃথক পৃথক বৈচিত্র্যময় রূপকে আমরা বিভিন্ন রাগাশ্রয়ী করে তুলতে পারি৷ বিদ্যাপতি তাঁর গানে একই রাগকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করেছেন এবং যেহেতু এর অধিকাংশই নতুন আবিষ্কার, কেবলমাত্র বিষয়বস্তুর কারণে এগুলি লোকপ্রিয়তা অর্জন করেনি, নতুন সুর ও সাঙ্গীতিক বৈচিত্র্যের কারণেও জনপ্রিয় হয়েছে৷
বিদ্যাপতি নিজের পদাবলীকে রাগ অনুযায়ী ভাগ করেছিলেন৷ যখনই এগুলির মধ্যে কোনো একটি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তখনই বিদ্যাপতির উত্তরসুরীরা তারা অনুসরণ করেছেন এবং এইভাবে বিদ্যাপতির অনেক লোকপ্রিয় গীত নমুনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে৷ একটি উদাহরণ আলোচনা করলেই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা করা যাবে৷ সংস্কৃত সাহিত্যে ‘খণ্ডিতা’ এক প্রকৃতির নায়িকাকে বলা হয় যে প্রেমিককে পরনারীর প্রতি প্রণয়াসক্ত দেখে ক্রুদ্ধা এবং প্রেমিক সর্বতোভাবে তার মানভঞ্জনের চেষ্টায় ব্যস্ত৷ বিদ্যাপতি নিজের কিছু পদাবলীতে বর্ণনা করেছেন কিভাবে সারা রাত মান ভাঙাবার প্রচেষ্টার পর নায়ক শেষে বলছে যে রাত্রি সমাপ্তপ্রায়, তবু প্রেমিকার মানভঞ্জন হচ্ছে না৷
এই রকম গানই খুব জনপ্রিয় এবং এগুলি প্রভাতী রাগাশ্রয়ী৷ পরবর্তী কালের কবিরাও এই ধরনের উদাহরণ অনুসরণ করেছেন এবং কালক্রমে এই জাতীয় পদাবলী ‘মান’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে৷ এই ‘মান’ মৈথিলী গীতের জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে এবং প্রত্যেক কবি একই সুরে এগুলি রচনা করেছেন৷ এইভাবে বিভিন্ন গীত বিভিন্ন নামে বিকশিত হয়েছে — বিষয়বস্তু অনুযায়ী সুরলহরীর স্বতন্ত্রতা বজায় থেকেছে — কিন্তু বিদ্যাপতির কাছে এগুলি অজ্ঞাত ছিল৷ তাঁর কাছে রাগই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ন্যায্য কারণেই তাই তাঁর পদ অবিলম্বে লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল৷ সুরের এই মায়াজাল শ্রোতাকে আবিষ্ট করে তুলত, শব্দলহরীর মধুর লয়পূর্ণ প্রবাহ তাদের হৃদয়কে আপ্লুত করে তুলত এবং শব্দের যাদু বা অর্থের সরলতা যখন তারা উপলব্ধি করত, তখন সত্যকারের কাব্যানন্দ তাদের আত্মাকে করে তুলত পরিপূর্ণ ৷ বিদ্যাপতির গীত সম্পূর্ণ সানন্দ উপলব্ধির জন্য শ্রোতারা তখনই অধীর হয়ে উঠত যখন গায়নভঙ্গি হত সঠিক৷ বিদ্যাপতির পদাবলী পাঠ করলে সম্পূর্ণ আনন্দের কেবলমাত্র দুই-তৃতীয়াংশ অনুভব করা যায় এবং অনুবাদ পাঠ করলে আমরা সম্পূর্ণ আনন্দের শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ উপলব্ধি করতে পারি৷
এই বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া দরকার যে বিদ্যাপতির শৃঙ্গার রসাত্মক পদের উপজীব্য হল প্রেম, দৈহিক প্রেম, কামজ প্রেম যা স্ত্রী পুরুষের ঘনিষ্ঠ মিলনকে ত্বরান্বিত করে এবং এতে কোনো আধ্যাত্মিক বা রহস্যময় অনিশ্চয়তার সন্ধান করা নিরর্থক৷ বিদ্যাপতির প্রতিভা এইখানেই যে বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁর শব্দচয়নের বিভিন্ন অর্থ করেছেন৷ চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুগামীদের কাছে এই পদ ভগবান কৃষ্ণের লীলাবর্ণনা এবং যেহেতু ভগবানের লীলাবর্ণনা তাঁদের সাধনার অঙ্গ, বাংলার বৈষ্ণবজনেরা এই পদাবলী বিশুদ্ধ ভক্তিরসাশ্রয়ী বলে মনে করে৷ গ্রীয়ারসন ও তাঁর মতো অন্য ব্যক্তিরা মনে এগুলি কবীরের দোঁহার মতোই যাতে রহস্যময়তার ইঙ্গিত আছে এবং যাতে কামজ প্রেমের রূপে আত্মাও পরমাত্মার মিলনের ইঙ্গিত করা হয়৷ ইঙ্গিত করা হয়৷ কিন্তু বিদ্যাপতি রচিত অর্ধেকেরও কমসংখ্যক পদে রাধা ও কৃষ্ণের উল্লেখ আছে এবং তাও কেবলমাত্র নামেরই উল্লেখ৷ চৈতন্যদেবের অনুগামীরা এই সব গানকে কৃষ্ণ ও রাধার লীলাবর্ণনা হিসেবে বিবেচনা করেন, যেখানে আমরা দেখি যে অনেক পদে বিদ্যাপতি কাহ্না, মাধাঈ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে আপন পৃষ্ঠপোষক শিবসিংহের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যিনি বিষ্ণুর একাদশতম অবতার হিসেবে বিদ্যাপতির দ্বারা উল্লিখিত ৷ যাই হোক, কৃষ্ণ মূলত সংস্কৃত সাহিত্যের নায়কের এবং রাধা বা গোপিনীরা সংস্কৃত সাহিত্যের নায়িকার প্রতীক মাত্র৷
বস্তুত বিদ্যাপতি এই সব প্রেমপদাবলী সংস্কৃত সাহিত্যের উদাহরণ অনুযায়ী রচনা করেছিলেন৷ ‘কীর্তি পতাকা’ নামক খণ্ড রচনার একটি অংশে বলা হয়েছে যে ত্রেতাযুগে সীতার সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে দ্বাপর যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রূপে আবির্ভূত হন এবং গোপবালকের রূপে চারপ্রকার নায়কের একীভূত রূপ হিসেবে আটপ্রকার নায়িকারূপের একীভূত রূপ গোপিনীদের সঙ্গে লীলাসঙ্গমে রত হন৷ এই বক্তব্যটি বিদ্যাপতির কুশলতাই প্রকাশ করে৷ তিনি সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের চার প্রকার নায়ক ও আট প্রকার নায়িকাকে গ্রহণ করে তাঁর গীত রচনা করেন৷ নায়ক কৃষ্ণই হোন বা অন্য কেউ, নায়িকা গোপী, রাধা বা অন্য কোনো রমণী যেই হোন না কেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ শৃঙ্গাররসের অভিব্যক্তির জন্য নায়ক নায়িকা, প্রেমিক প্রেমিকার আবশ্যক কারণ তা হলেই সাধারণীকরণ সম্ভব, অ্যারিস্টটলের মতে, ”পাত্রের ব্যক্তিকরণ করে কাব্যের উদ্দেশ্যের সাধারণীকরণ করা হয়৷” মানবজীবনের সার্বজনীন তত্ত্বের অভিব্যক্তিই কাব্য৷ অথবা অন্য কথায় কাব্য মানবজীবন, চরিত্র, মন ও কার্যের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের অদর্শীকৃত প্রতিবিম্ব৷ ”কাব্যের শক্তি এতটাই সীমিত যে তা বিশ্বজনীন দিকটিকে তার নিজস্ব রূপে নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতিবিম্বের মাধ্যমে ব্যক্ত করে৷” এই আঙ্গিকে বিদ্যাপতি আমাদের সামনে সত্যকারের কাব্যকে উপস্থিত করেছিলেন এবং যখন আমরা তাঁকে কবির স্বীকৃতি দিই তখন কে তাঁর কাব্যের নায়ক আর কেই বা নায়িকা সেই প্রশ্নটি গৌণ হয়ে পড়ে৷
এইভাবে বিদ্যাপতির পদাবলীতে রহস্যময় তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টা নিরর্থক৷ তাঁর কাব্যে প্রেমিকাই শুধু ভগবানের জন্য উৎকণ্ঠিতা নয়, ভগবানও প্রণয়িনীর জন্য উৎকণ্ঠিত৷ একথা সত্য যে বিদ্যাপতির কাব্যের নায়িকার আত্মসমর্পনাত্মক প্রেমই চৈতন্যদেবের মতে ভগবানের সঙ্গে মিলনের অভিপ্রায়ে ভক্তের উৎকণ্ঠা, যাকে বৈষ্ণব মহাজন মধুর রসের সংজ্ঞা দিয়েছেন, অথবা কবীর একেই অসীমের জন্য আত্মার মিলনকামনার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করেছেন৷ কিন্তু বিদ্যাপতি যখন কাব্যরচনা করেন, তখন তাঁর এ বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না এবং বিদ্যাপতি যে সংস্কৃত শৃঙ্গাররসাশ্রয়ী কাব্যধারা আহরণ করে তাকে মিথিলার কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠিত করেন তার কোনো গ্রহনযোগ্য ঐতিহ্য এই মতাদর্শের ছিল না৷ বিদ্যাপতি প্রেম-পদাবলীর কবি ছিলেন কারণ তাঁর কাছে কামজ প্রেম ও সম্ভোগ সন্তুষ্টি — ধার্মিকতা, ধনশালীতা ও চরমে মোক্ষলাভের মতোই মহত্ত্বপূর্ণ আবশ্যিকতা৷
একথা বলা হয় যে কাব্যের যাবতীয় ব্যাখ্যা সাধারণত অ্যারিস্টটল বা বেকনের মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত৷ যে দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা বিদ্যাপতিকে দেখি না কেন, তিনি নিজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল ছিলেন৷ অ্যারিস্টটল কাব্যকে অনুকরণাত্মক কলা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন৷ কিন্তু তিনি এ কথা স্বীকার করেছিলেন যে কবির কাজ হল যা সত্য সত্য ঘটছে তার বর্ণনা নয়, যা ঘটা সম্ভব তার বর্ণনা করা৷ কাব্য-সত্যর বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, অননুমেয় কিন্তু সম্ভাব্য ঘটনার চেয়ে অনুমেয় অসম্ভবতাই কাম্য কারণ অসম্ভবতা শ্রেয় যেহেতু মননশীলতার সামনে উপস্থিত আদর্শ বাস্তবের তুলনায় বৃহত্তর হওয়া প্রয়োজন৷ যুবতী নায়িকার অঙ্গসৌন্দর্য বা তার মনোদশা, যারই বর্ণনা করা হোক না কেন, প্রেমিক প্রেমিকার মিলন বা বিচ্ছেদ যাই আলোচিত হোক না কেন,বিদ্যাপতি সর্বদাই আধুনিকীকরণের স্বপেক্ষ ছিলেন, যা অনুভূতিক যথার্থতা নয়,বাস্তবের অনুভূতি নয়, এক মহত্তর বাস্তবের প্রতিফলন৷ প্রকৃতির বহু সৌন্দর্যতত্ত্ব তিনি একত্রিত করেছিলেন৷ কেবলমাত্র নির্বাচন, একত্রীকরণ, সজ্জা এবং সংযোজনই সৃষ্টির পক্ষে পর্যাপ্ত নয়৷ বিদ্যাপতি এই সব কটি কাব্যগুণের আদর্শ সুষম সংমিশ্রণে পারদর্শী ছিলেন৷
অপরদিকে বেকনের মতে কাব্য হল ‘অনৃতাশ্রয়ী ইতিহাস’ এবং ‘মিথ্যা ইতিহাসের উপযোগিতা এই যে তা মানুষের মনে এমন এমন বিষয়ে সন্তুষ্টি সৃষ্টি করে যা প্রকৃতি প্রদান করতে অসমর্থ, আত্মা ও সংসার সমানুপাতিক নয়, সংসার হীনতর, যে কারণে মানুষের আত্মার কাছে প্রকৃতি অপেক্ষা বিস্তৃততর মহত্ত্ব, যথার্থতর শিবত্ব এবং পূর্ণতর বিবিধতাই কাম্য৷” এইভাবে বেকন কাব্যসত্যকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন এবং কাব্যকে কল্পনাশক্তির অবাধ অভ্যাস হিসেবে ধার্য করেছেন৷ তাঁর কাছে কাব্য শুধুমাত্র মনের ‘নাট্যশালা’ যেখানে যে কেউ বিশ্রাম ও মনোরঞ্জনের জন্য গমন করতে পারে কিন্তু সেখানে ”অধিক সময়ের জন্য অবস্থান কাম্য নয়” কারণ সেটি শুধুই ‘অনৃতাশ্রয়ী’৷
বিদ্যাপতির কাব্য ”মানব জীবন, চরিত্র, মনোদশা ও কার্যের আদর্শীকৃত প্রতিরূপ” এবং ম্যাথু আনর্ল্ড ওয়ার্ডসওয়ার্থ সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, একই মন্তব্য বিদ্যাপতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে তিনি প্রেমময় জগতের ”আশ্চর্যময়তা ও বিকাশ” আমাদের প্রদান করেছেন৷ কাব্যচর্চা বিদ্যাপতির জীবিকা ছিল না৷ এটি ছিল তাঁর মনসিজ উপলব্ধি এই অর্থে যে যখন তাঁর গীতিচর্চার শখ হত, তখন তিনি তাঁর প্রশংসক বিশেষত রমণীকুলের উদ্দেশে পদ রচনা করতেন৷ সুতরাং সেই অর্থে তিনি পদ রচনার সময় ‘অনৃতাশ্রয়ী’ হয়েছিলেন৷ পূর্ণ যুবকাবস্থায় তিনি এই গীতরচনা করেন যখন তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উদার রাজা শিবসিংহ৷ বিদ্যাপতি ছিলেন জীবিকায় ‘পণ্ডিত’, রাজপণ্ডিত, সর্বদা রাজ্য ও জীবনদর্শনের গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে ব্যস্ত৷ সেই কারণে তিনি যখন পরকীয়া প্রেম,অভিসার, গুপ্ত মিলন ইত্যাদি বিষয়ে লেখেন, তখন আমরা একথা বলতে পারি না যে বিদ্যাপতি একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিকে কাব্যে ব্যক্ত করেছেন এবং একথাই স্পষ্ট যে বিদ্যাপতি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ বস্তুত এই গীতগুলি বিশেষ অবসরে কেবল মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং যেমন বেকনের মত–এগুলি বাস্তবে মননের নাট্যশালার অনুরূপ যেখানে শ্রোতারা বিশ্রাম আর মনোরঞ্জনের উদ্দেশে সমবেত হয়৷
বিদ্যাপতির কাব্যের অন্যতম গুণ হল উদঘাটন শক্তি৷ তাঁর রচনা নারী ও প্রকৃতির লোভনীয় সৌন্দর্য নিমেষেই আমাদের চোখের সামনে উন্মোচিত করে৷ সেই কারণে বিদ্যাপতির কাব্যপরিসর সীমিতও বটে৷ তিনি কেবল রমণীজীবনের কামজ আনন্দের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন কিন্তু সেই স্বল্প পরিসরে তাদের দেহবল্লরীর অনুপম মাধুর্য এমন কি হৃদস্পন্দনও তাঁর কাব্যে ধরা পড়েছে৷ একই সঙ্গে যা তিনি দেখেছেন বা অন্তরে অনুভব করেছেন তা এইভাবে ব্যক্ত করতে বা আমাদের উপলব্ধি করাতেও সমর্থ হয়েছেন৷ আমাদের মননশীলতাকে তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন এবং দেহজ প্রণয়ের ”সৌন্দর্য ও আশ্চর্যময়তার প্রতি মনকে চালিত করতে পেরেছেন৷” ফ্রা লিপ্পো লিপ্পীর মুখে ব্রাউনিং এর উক্তিটি মনে পড়ে :
”তোমার কি চোখে পড়ে না? আমরা সৃষ্ট হয়েছি প্রেম করবার জন্য,
প্রথম যখন আমরা তাদের চিত্রিত হতে দেখি, সেই সব বস্তুকে যাদের পাশ দিয়ে আমরা
শতবার চলে গেছি, দেখবার চেষ্টাও করিনি,
তাই তারা আরও সুন্দর, আমাদের চোখে সুন্দরতরভাবে চিত্রিত হয়েছে,
যা একই কথা, এইজন্যই তো শিল্পকলা৷”
এটি চিত্রকরের ক্ষমাপ্রার্থনা কিন্তু বিদ্যাপতিও ছিলেন শব্দচিত্রকর৷ কৈশোরে পদার্পণকারিণী কন্যাদের তিনি দেখেননি কিন্তু তাদের প্রতিদিন উদ্ভাসমান পরিবর্তনের বিভিন্ন রূপ চিত্রণ করেছিলেন এবং অনেক পদে তিনি সেই সৌন্দর্য উদ্ঘাটিত করেছিলেন যা নতুন ও বিস্ময়জনক৷ তিনি সৌন্দর্যকে বিচার করতেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এবং আপন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কল্পনার সাহায্যে সেই সৌন্দর্যকে কাব্যের ভাষায় রূপায়িত করতেন এবং তাঁর এই ভাষা ছিল সরল, মনোমুগ্ধকর ও আবেগপূর্ণ৷ প্রারম্ভিক কিশোরাবস্থার বিষয়ে যা কিছু সত্য তা কিশোরী ও তার বয়োপ্রাপ্ত প্রেমিকের প্রথম মিলনের বিষয়েও তেমনই সত্য৷ এখনও মিথিলায় সংস্কৃতিবান পরিবারে পঁচিশ বছরের যুবক দশ বছরের কন্যার পাণিগ্রহন করে এবং এই প্রদেশের সামাজিক জীবন এইভাবে বিদ্যাপতির প্রেম পদাবলীতে আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিফলিত৷ প্রারম্ভিক কিশোরাবস্থাসংক্রান্ত পদগুলিতে ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্তা কন্যার দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিশদ বিবরণ আমরা বিদ্যাপতির পদে পাই এবং এগুলি অনুভব করা হয়েছে অন্তর দিয়ে, আর প্রথম মিলনসংক্রান্ত পদগুলিতে প্রথমবার নিজের প্রেমিকের সঙ্গে মিলনোৎসুক কন্যার মনোবৈজ্ঞানিক চিত্র, মানসিক পরিবর্তনের সূক্ষ্ম বিবরণ আমরা পাই৷
বিদ্যাপতির প্রেম পদাবলীর বিষয়ে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কথা হল তিনি সর্বদাই প্রণয়কে রমণীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন ৷ এটি তাঁর ব্যবহারগীতি ও শিবভক্তিমূলক গীতির ক্ষেত্রেও সত্য কিন্তু প্রেমগীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একটি আলাদা মাত্রা পেয়েছে৷ এই বিষয়টিতে তিনি জয়দেব ও গোবিন্দদাস এবং অন্যান্য বৈষ্ণবকবির ভাবধারা থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে পৃথক৷ বিদ্যাপতি সর্বদাই পূর্বরাগের বিষয়ে উল্লেখ করার সময় প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার আকর্ষণের কথাই বলেছেন, প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের আকর্ষণের কথা নয়৷ নিজের একটি পদে বিদ্যাপতি ”নারী হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্থলে শতসহস্র উৎকণ্ঠা ও কামনাকে কল্পনা করেই গান গেয়েছেন৷” প্রারম্ভিক কিশোরাবস্থা থেকে শুরু করে পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তি পর্যন্ত নারীজীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই যাকে কেন্দ্র করে বিদ্যাপতি বিশদ চিত্র অঙ্কন করেননি এবং সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি প্রকৃতি ও চারুকলার সাহায্য নিয়েছেন৷ কেশভার থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি গ্রীক সৌন্দর্যানুসারী এবং তাঁর কাব্যচিত্রের বর্ণময়তা এতই সত্য ও অন্তর্ভেদী যে তা সুন্দর, আকর্ষক ও মোহময় হয়ে ওঠে৷ একইভাবে নারীহৃদয় ও মননশীলতার বিষয়েও তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী৷ বিদ্যাপতির যে কোনো পদের বিশ্লেষণ এই মূল তথ্যটির স্বপক্ষে যাবে কিন্তু তাঁর প্রেমপদাবলী কতদূর অন্তর্ভেদী ও উন্মোচক তা বোঝাবার জন্য আমি তিনটি উদাহরণ উদ্ধৃত করতে চাই ৷ তাঁর একটি সংকলন আপন প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছে এমন কিশোরী প্রেমিকাকে তার সখী পরামর্শ দেয় এবং সেই পরামর্শ সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ও যথার্থ কিশোরীসুলভ৷ দ্বিতীয় একটি গীতে কিশোরী নিজের অসহায় অবস্থার বর্ণনা করে — যখন সে একলা তার প্রেমিকের মুখোমুখি উপস্থিত হয়, তখন তার মানসিক অবস্থা কি হয়, এই বর্ণনাটিও অত্যন্ত স্বাভাবিক, সহজভাবে ব্যক্ত, কামনাপূর্ণ ও ভাবোন্মত্ত ৷ তৃতীয় একটি পদে একটি কিশোরী সম্পূর্ণভাবে সুসজ্জিত হয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হতে৷ প্রেমিকাটি এই ভেবে মিলনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে রাতটি হবে অমাবস্যার রাত কিন্তু এখন সে দেখে যে আকাশে পূর্ণচন্দ্র প্রকাশিত৷ সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়৷ সে নিজের প্রেমিককে নিরাশ করতেও চায় না আবার পথে অবাঞ্ছিত লোকজনের মুখোমুখি হতেও ভয় পায়৷ সম্পূর্ণ পদটি তার প্রেম এবং সম্মানহানির সম্ভাবনার মধ্যে যে দোটানা, তারই সফল চিত্রকল্প৷ বিদ্যাপতির প্রতিভার এই বৈশিষ্ট্যটিই তাঁকে রমণীসমাজের প্রিয়কবি হিসেবে নির্বাচিত করেছে এবং নারীসমাজ তাঁকে পদাবলীর ভেতর দিয়ে কণ্ঠে ও হৃদয়ে স্থান দিয়েছে৷ রমণীর দেহজ প্রেমের এমন কোনো অধ্যায় নেই যেমন মিলন বা বিচ্ছেদ, দুঃখ বা সুখ, উৎকণ্ঠা বা হতাশা, আশা বা নিরাশা, দ্বিধা বা নিশ্চয়তা, যা বিদ্যাপতি চিত্রিত করেননি এবং প্রত্যেক পর্যায়ে তিনি আপন কল্পনাশক্তির সহায়তায় স্ত্রীহৃদয়ের স্পষ্টরূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন৷ সুতরাং আমরা বলতে পারি যে বিদ্যাপতির কাব্যে দেহজ প্রেমের দুটি উপজীব্য–রমণী ও তার প্রেমিক যা বিদ্যাপতি গীতোল্লাসে প্রকটিত করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির প্রকৃত মূল্যায়ন করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন যে বিদ্যাপতি যৌবনের আনন্দের বা প্রণয়ীযুগলের মিলনানন্দের কবি৷
বিদ্যাপতির চোখের সামনে নরনারীর যৌনজীবনের পূর্ণ চিত্র ছিল; দেহজ প্রেমের দর্শন বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণার অধিকারী ছিলেন তিনি৷ তাঁর কাছে এটি মানবহৃদয়ের একটি মূলভাবনা মাত্র নয় বা মানবজীবনের মূল উদ্দেশ্যও নয়; এটি জৈবিক আবশ্যিকতা৷ তাঁর কাছে প্রেম হল আনন্দহীন জীবনের আনন্দস্রোত ৷ বিদ্যাপতি রচিত রমণীর যৌনজীবনের চিত্রাবলী এতই বাস্তবিক, এতই স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিচিত্র ও বর্ণময়, কল্পনাযুক্ত ও অনুভূতিপূর্বক ব্যক্ত, মধুর শব্দাত্মক ও চিত্তাকর্ষক সুরসমৃদ্ধ যে এই পদাবলী কামিনীবিলাস বা রীতিশিক্ষার জন্য এবং প্রণয়ীদের যৌনজীবনের সন্তুষ্টি প্রদানের জন্য রমণীদের সম্ভোগ শিক্ষা দেবার কাজ করত৷
বিদ্যাপতির প্রেমচিত্রণের এক বিচিত্র পরিনাম হল যে এই পদাবলী অতি সহজেই চৈতন্যদেবকে অকৃষ্ট করেছিল৷ আমরা জানি যে শ্রীচৈতন্যের একটি নিজস্ব বিশিষ্ট ভক্তিমার্গ ছিল যা বাঙালী বৈষ্ণব সম্প্রদায় সৃষ্টি করে এবং চৈতন্যদেবের বিদ্বান শিষ্যদের মাধ্যমে ভক্তিবাদের এক নববিপ্লবের সূচনা করে; তাঁরাই সংস্কৃত কাব্যে বর্ণিত মধুর রসের উদ্ভাবক৷ শ্রীচৈতন্য নিজেকে রাধিকা অর্থাৎ কৃষ্ণের প্রেমিকা হিসেবে মনে করতেন, তিনি ছিলেন প্রেমে সমর্পিতপ্রাণ, এবং চৈতন্যানুগামীরা নিজেদের বৃন্দাবনের ব্রজবালা হিসেবে কল্পনা করে, যারা ঈশ্বর মিলনে সদাই উন্মুখ৷ সত্য ও শুদ্ধ ভক্তির কারণে প্রেমানুভূতিপূর্ণ এই ভাবনা রমণীসুলভ৷ সেই কারণে বিদ্যাপতির প্রেমপদাবলী তাঁদের কাছে সেই প্রেমানুভূতি ও আবেগ, উন্মাদনা ও কামনারই বহিরঙ্গ রূপ৷ এই গীতগুলি তাঁদের হৃদয়বীণার ঝঙ্কার কারণ এগুলি তাদের অন্তরের সত্য ও প্রামাণ্য চিত্ররূপ যা ভগবান কৃষ্ণের ভক্তের মনে অতীব প্রভাব বিস্তারকারী৷ সুতরাং এটি একেবারেই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে বিদ্যাপতির প্রতিটি প্রেমগীত সেই অনুভূতি চিত্রিত করে যা প্রত্যেক গোপিনীর বা ভক্তপ্রেমিকার নিজস্ব উপলব্ধিজাত৷ সেই কারণেই চৈতন্যদেব এই প্রেমগীতিতে এতই আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং মধুর সুরেলা এই গীতি তাঁর হৃদয়ের স্পন্দন ছিল যা তাঁকে দিব্যোন্মাদনার আস্বাদ দিত ৷ এইভাবে যা ছিল শুধু সাংসারিক জীবনের কাব্য, চৈতন্যদেবের ভক্ত সম্প্রদায়ের কাছে তা ভক্তিগীতিতে রূপান্তরিত হয়৷ স্ত্রীসৌন্দর্য ও অনুভূতির গীতিকার বিদ্যাপতি বৈষ্ণব মহাজন হিসেবে পরিচিত হন৷ সেই জন্য বিদ্যাপতির প্রেমগীতি বিনা বাধায় বাংলায় প্রবেশাধিকার পায় এবং এই পদাবলী পবিত্র সাহিত্য হিসেবে চৈতন্যসম্প্রদায়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ আর্যাবর্তে প্রসিদ্ধি লাভ করে৷
সেই কারণে কবিরূপে বিদ্যাপতি একজন দ্রষ্টা এবং নারীসৌন্দর্য ও নারীভাবনার প্রেক্ষাপটে তিনি মানবজীবনের কামজ প্রেমের অন্তহীন রহস্যের আবরণ উন্মোচক ৷