সংগীতশাস্ত্রে নৃত্য এবং বাদ্যকেও সংগীতকলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে – তা যেকোন শ্রেণীর সংগীতই হোক না কেন৷ খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতকের সংগীতশাস্ত্রী শার্ঙ্গদেব “সংগীত-রত্নাকর” গ্রন্থে “সংগীত”-শব্দের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এই কথাই বলেছেন৷ খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতকের পরবর্তী সংগীত গ্রন্থকাররা “সংগীত” শব্দের ব্যাখ্যায় বা বিশ্লেষণে শার্ঙ্গদেবকে অনুসরণ করেছেন৷ তবে এই প্রসঙ্গে এই কথাও এখানে উল্লেখযোগ্য যে, “সংগীত”-শব্দটি গীতিকলার বোধক-রূপে ১৩শ শতকের পূর্ববর্তী সময়ে এবং এমন কি খ্রীষ্টপূর্ব যুগেও বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ দেখা যায়৷ রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ ছাড়া পুরাণগুলির স্থানে স্থানে “সংগীত” শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ তবে “সংগীত” বলতে তখন নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমবেত রূপকেই যে বোঝাত এমন কোন বাঁধাধরা নিয়মের উল্লেখ পাই না৷ প্রাচীন ভারতে দেবদাসীপ্রথার প্রচলন যখন থেকে হয়, মনে হয় তখন থেকেই “সংগীত”-শব্দ কলা-রূপে ত্রৌর্যত্রিক তথা নৃত্য, গীত ও বাদ্যকলার সমন্বিত রূপকে নিয়ে সার্থক ছিল৷ বাংলাদেশে পাল ও সেন রাজাদের রাজত্বের সময়ে শিব কিংবা কার্তিকের মন্দিরে দেবদাসিদের সংগীতের ব্যবস্থা ছিল এবং তাতে নৃত্য ও বাদ্যের সহযোগে গীত পরিবেশনের ব্যবস্থা ছিল — একথা “রাজতরঙ্গিনী”-গ্রন্থে কহ্লন এবং “পবনদূত”-গ্রন্থে কবি ধোয়ী স্বীকার করেছেন৷ শ্রদ্ধেয় জি. এস ঘুরে (G.S.Ghurye)তাঁর Bharatanatya and Its Costume (Poona 1958) গ্রন্থে বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় নৃত্যপ্রসঙ্গে লিখেছেন : “The Kashmiri royal patron and employer of Damodaragupta,Jayapida,it would appear, was proficient in Bharata”s Natyasastra even before he took Damodaragupta in his service. Kalhana, while describing the intinerary of that King, tells us that he once entered the city of Pundravardhana in “Gauda-Desa”, Bengal. While there, he once chanced to see a dance being performed to the accompaniment of vocal and instrumental music, and being “versed in the historic arts of the dance, song and the like in accordance with Bharata, sat himself down for a while”. Jayapida”s reign, according to R.S. Pandit, extended from A.D.,751 ot 782″. তিনি আরো লিখেছেন ঃ “Another Kashmiri King, Jayapida (A.D. 751-782) while he was in the town of Paundravardhana in Gauda. Bengal, once saw in the temple of Kartikeya a dance”lasya” beign performed. The dance “nartaki”, was one Kamala by name. Kamala, on her part, looking at him and seeing his hand stretching to his shoulder-top at intervals, concluded that he must be a royal person. Her reasoninig was that the hand was stretched over the shoulders behind to catch hold of the “tambula” or the betel nut-leaves-packet from his attanedants, * * Eventually Jayapida took Kamala with him to Kashmir”৷ এখানে “লাস্য” নৃত্যছন্দ স্ত্রীলোকদের ও দেবদাসীদের নৃত্যকেই লক্ষ্য করা হয়েছে এবং পুরুষ-নৃত্য ছিল “তাণ্ডব”৷ নাট্যশাস্ত্রে ভরত এবং নাট্যদর্পণে রামচন্দ্র তাণ্ডব ও লাস্যনৃত্যের উল্লেখ করেছেন৷
তাছাড়া বাংলার ইতিহাস থেকে একথা প্রমাণ হয় যে,গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের আমলে শাস্ত্রনির্দিষ্ট গান ও নৃত্যের পাশাপাশি দেশীগান এবং আঞ্চলিক নৃত্যেরও প্রচলন ছিল এবং গুপ্ত, পাল ও সেন রাজারা সে-সকল গান ও নৃত্যের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন৷ কথিত আছে, রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে “সেকশুভোদয়া”-গ্রন্থ রচিত হয়৷ সেকশুভোদয়ার রচয়িতার নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে৷” তবে গ্রন্থনামের সঙ্গে “সেখ”-শব্দটির সংযোগ থাকায় গ্রন্থকার ইসলামধর্মসেবী ছিলেন এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন অধিকাংশ পণ্ডিত এবং সেদিক থেকে জলালুদ্দিন তাব্রিজি এর রচয়িতা- এই অভিমতও পণ্ডিতেরা গ্রহণ করেছেন৷ ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে ডঃ সুকুমার সেন-সম্পাদিত “সেকশুভোদয়া”-গ্রন্থে (হৃষীকেশ-সিরিজ, নং ১১, আর. এন.শীল বি এ প্রকাশিত) ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-লিখিত মুখবন্ধের (l”oreword) বিবৃতিও প্রণিধানযোগ্য৷৷ তিনি লিখেছেন ঃ “The work, inspite of its being attributed to Halayudha Misra of the court of King Lakshmanasena, is to a large extent of Mohammedan inspiration in its contents ৷” অবশ্য ডক্টর সুনীতিবাবু এখানে স্পষ্ট করে গ্রন্থকারের নাম উল্লেখ করেন নি৷ ডঃ সুকুমার সেন গ্রন্থের মুখবন্ধে (Introduction) যে মন্তব্য করেছেন তা থেকে সেখ জলালুদ্দিন (তাব্রিজিই) যে মধ্যযুগীয় সাহিত্য “সেখশুভোদয়া”-র রচয়িতা এই কথা অনুমান হয়৷ তিনি লিখেছেন ঃ “The authorship has been ascribed to Halayudamishra, who is well-known as a courtier of Lakshmanasena, author of the Brahmansarvasia, a popular Smriti work, so that its authenticity might not be quentioned” ৷ প্রকৃতপক্ষে বাংলা-সংস্কৃত-প্রাকৃতমিশ্রিত অথবা বিকৃত-সংস্কৃতে লিখিত “সেখশুভোদয়া”-গ্রন্থটির রচনার ও প্রচারের পিছনে মুসলমান তথা ইলসামধর্মের প্রতিষ্ঠাপ্রচেষ্টারই মর্মকাহিনী সুস্পষ্ট৷ তাছাড়া ধর্মপ্রচার ও সমাজসংগঠন প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিলে “সেখশুভোদয়া”, “কবীন্দ্রসমুচ্চয়”, “সদুক্তিকর্ণামৃত”, “রামচরিত” প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের ঐতিহাসিক কাহিনীসমূহের সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তন বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের “অনেক-কিছু তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়৷ গীতিনাট্য (Vide Rajatarangini by Kalhana (or Kashmir), edited and translated by M.A. Stein (1961), Vols I & II.) “গীতগোবিন্দ”-পদগানের নৃত্যসম্বলিত নাট্যরূপের পরিচয়দানের পরিপ্রেক্ষণসামগ্রী বা কাহিনীগ্রন্থ হিসাবে সেখ জলালুদ্দিন-রচিত সেখশুভোদয়ার অন্ততঃ ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ কিছুটা প্রয়োজনীয় বলে মনে করি৷
গুপ্ত , পাল ও সেন-রাজাদের আমলে বাংলায় (বৃহত্তর বাংলায়) নৃত্যগীতের যে সচ্ছ্বল অনুশীলন ছিল সেকথা পূর্বেই আলোচনা করেছি৷ লোকগীতি ও লোকনৃত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় করণ, অঙ্গহার ও চারি-সম্বলিত নৃত্যকলার অনুশীলন তখন অব্যাহত ছিল রাজ-অন্তঃপুরে, রাজদরবারে রাজপ্রসাদসংলগ্ন নাট্যগৃহে বা রঙ্গমঞ্চে, দেবায়তনে ও বিভিন্ন পার্বণ-উৎসবাদিতে৷ অভিজাত নৃত্যকর্মের আঙ্গিক ও বিকাশ নাট্যশাস্ত্রকার ভরতের নির্দেশানুযায়ী ছিল এবং নৃত্য, নাট্য ও বাদ্যের সহচারী ছিল অভিজাত ও দেশী গান৷ “সেখ শুভোদয়া”-গ্রন্থের কাহিনী কিছু-কিছু বিকৃত ও অতিরঞ্জিত হলেও তা রাজা লক্ষ্মণসেন ও তৎপরবর্তী সমাজে শিল্পরুচি ও সাধারণ জীবনচর্চা”-র উপকরণ সামগ্রী জোগাতে কার্পণ্য করেনি৷ সেকশুভোদয়ায় বর্ণিত গঙ্গোনটবধূ বিদ্যুৎপ্রভা, বুঢন মিশ্র, জয়দেবসতী পদ্মাবতী ও কবি জয়দেবের নৃত্যগীত সম্পৃক্ত কাহিনীর কিছুটা পরিচয় দেব গীতগোবিন্দ নাট্যরূপের পরিচয় দেবার আগে৷
“সেকশুভোদয়া”-র ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে নৃত্যসম্পৃক্ত গীতিকাহিনীটি হল ঃ
(ক) “বিদ্যুৎপ্রভানাম্নী নর্তকীবিশেষা তামানয় ৷ সা নর্তযতু, লোকাঃ পশ্যন্তু”৷ এতচ্ছত্বা রাজা তামানয়ামাস শশিকলযাসহ৷ (খ) ইতি ভূতে সতি কশ্চিদ ব্রাহ্মণো বূঢননামামিশ্রঃ (বূঢনমিশ্রনামা ?) রাজসভায়াং গত্বা বাজানমবাদীৎ৷ “বাজন্‌ মহাগায়নেঽহঃ পুনঃ পণ্ডিতশ্চ৷ * * “৷ “হে বিপ্র, কশ্চিদ ধ্বনিরুদগীয়তাম৷ ততো দ্বিজঃ পঠমঞ্জরীরাগমুদগীবিতবান৷ উদগীবিতে সতি পিপ্পলবৃক্ষতলে তস্য পিপ্পলস্য পত্রাণি সমস্তান্যপতৎ৷ * * তদা সর্বানানীতে সতি জয়দেবমিশ্রশ্য পদ্মাবতী নামী তচ্ছব্দমশ্রৌষীৎ৷ গঙ্গাস্নানং গতে সতি ত্ববয়া রাজসভায়াং সমায়াতা (:)চ ৷ পুনরুক্তবতী চ৷ * * ততঃ পদ্মাবতী জয়দেবস্য ব্রাহ্মণী গান্ধারনামা ধ্বনিরুদগায়তা চ৷ তদুদগীবিতে সতি নৌকাঃ গঙ্গায়াং যদ বিদ্যন্তে, শ্রূত্বা, তৎসন্নিধানং সমায়াতা (:) চ ৷ * * তদা পদ্মাবতী জয়দেবস্য ব্রাহ্মণী গান্ধারনামা ধ্বনিরুদগায়তা চ ৷ তদুদগীবিতে সতি নৌকাঃ গঙ্গায়াং যদ বিদ্যন্তে, শ্রূত্বা, তৎসন্নিধানং সমায়াতা (:) চ৷ * * তদা জয়দেবমিশ্রোঽবদ্যৎ”৷ “অস্য ধ্বনিনা নিষ্পত্র বৃক্ষোঽভবৎ কিন্তু বসন্তসময়ে সামান্যেন বৃক্ষস্য পত্রাণি পতন্তি৷ মহানিতি কথম্‌ ? * * “পূর্ণগীয়তাম্‌৷ নিষ্পত্রবৃক্ষাঃ সপত্রো ভবতু”৷ বূঢনমিশ্রোঽবদৎ “অহং ন শক্নোমি৷ ত্বমপি সপত্রং কর্তুং শক্নোমি? পশ্যতাং কুরু ত্বম্‌” * * ৷ ততো জয়দেবমিশ্রঃ বসন্তরাগমুদ্‌গীরতবান্‌৷ উদ্‌গীরিতে সতি অস্য বৃক্ষস্য কমনীয়ানি নবপত্রাণি ভূতানি৷ ততো জয়শব্দঃ সর্বত্র অশ্রৌষীৎ৷ * * ইতি হলায়ুধমিশ্রকৃতৌ সেকেশুভোদয়ায়াম্‌ মিশ্রোপাখ্যানে ত্রয়োদশঃ পরিচ্ছেদঃ ৷ ”
কাহিনীমূলক গ্রন্থবিবৃতি এই, কিন্তু অতিশয়োক্তি ও অলৌকিকতায় পূর্ণ৷ তবে ফেনায়িত অতিরঞ্জিত কাহিনীসামগ্রীর মধ্যে বাস্তব উপাদানও যে নাই –তা নয়৷ শাস্ত্রীয় অভিজাত সুহৈ বা সুহা, পঠমঞ্জরী, গান্ধার বা গান্ধারী, বসন্ত প্রভৃতি রাগের পরিচয় আমরা এই আখ্যানে পাই, যদিও তাদের কয়েকটির প্রভাবের ও কার্যকরিতার প্রতিফলনে ঠিক সত্যতা নাই৷ তবে “বসন্তসময়ে সামান্যেন বৃক্ষস্য পত্রাণি পতন্তি” প্রসঙ্গে বসন্তকালে জয়দেব মিশ্রের বসন্তরাগের প্রতিফলন সার্থক হয়েছে৷ তাছাড়া বিদ্যুৎপ্রভা, পদ্মাবতী ও জয়দেবের সংগীতকুশলতার নিদর্শন পাওয়া যায় এই কাহিনী থেকে৷ উড়িষ্যা বা উৎকলের মনীষীরাও পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরে জয়দেব (মিশ্র?) ও পদ্মাবতীর গীতগোবিন্দগানের সঙ্গে ছন্দায়িত নৃত্যের উল্লেখ করেছেন৷
সেকশুভোদয়ায় ত্রয়োদশ পরিচ্ছদ থেকে বিশেষ করে পদ্মাবতী ও জয়দেবের সংগীতপ্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়, আর নৃত্যের কিছুটা পরিচয় পাই বিদ্যুৎপ্রভা ও শশিকলার প্রসঙ্গে (“বিদ্যুৎপ্রভানাম্নী নর্তকী বিশেষা”)৷ ষোড়শ পরিচ্ছেদে কবি ধোয়ীর পরিচয়ও দিয়েছেন জলালুদ্দিন তাব্রিজ ঃ “অয়মপি ধোয়ী সেবকত্বেন * *”, “অয়ং ধোয়ী তন্তুবায়ঃ “তচ্ছ ত্বা ধোয়ী তানব্রবীৎ৷ (কবি জয়দেবও ধোয়ীর নামোল্লেখ করেছেন গীতগোবিন্দে ঃ “শ্রুতিধরো ধোয়ী কবিক্ষ্মাপতি”৷) পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ধোয়ী “পবনদূত”-গ্রন্থে পাল ও সেন-রাজাদের গৌরবকাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তন বাংলাদেশের নগর ও পল্লীসমাজের জীবনচর্চার কাহিনীর উল্লেখ করেছেন৷
তাব্রিজির “সেকশুভোদয়া” নাভাজীর “ভক্তমাল” প্রভৃতি গ্রন্থের কাহিনী থেকে অনেকে জয়দেবকে নট ও পদ্মাবতীকে নটী শ্রেণীভুক্ত করেছেন৷ “ভক্তমাল”-গ্রন্থকার পদ্মাবতীকে পুরীধামে জগন্নাথ-মন্দিরে নৃত্যশীলা নটী বা দেবদাসী বলে বর্ণনা করেছেন এবং কবি জয়দেব নাকি পদ্মাবতীর নৃত্য ও গীতছন্দে তাল রক্ষা করতেন এবং তারি সাক্ষ্য হিসাবে কবি গীতগোবিন্দে “পদ্মাবতীচরণচারণ চক্রবর্তি” বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন৷ কাহিনী বা কথার পিছনে ঐতিহাসিক মূল্য কতটুকু তা নির্ণয় করবেন বিচক্ষণ ঐতিহাসিকগণ৷ তাঞ্জোর সরস্বতীমহল-গ্রন্থমালার অন্তর্গত Gitagobinda with Abhinaya(1963) গ্রন্থের সম্পাদক বিদগ্ধ সংস্কৃতজ্ঞ ও শিল্পকলারসিক পণ্ডিত কে. বাসুদেব শাস্ত্রী গ্রন্থ-বিবৃতিতেও ঐ কথার উল্লেখ করেছেন৷ আমরা নৃত্যসম্বলিত গীতিনাট্যরূপ “গীতগোবিন্দ” – পদগানের পরিচয় দেব ঐ গ্রন্থকেই অনুসরণ করে৷ শ্রদ্ধেয় শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন ঃ “He (Jayadeva) was born in Bengal, but he made Puri his home. * * This is indicated by the reference in the text of the Ashtapadi to the accompaniment of Nritya by his devoted wife, Padmavati. He calls himself in introductory verse No. 2 an expert in directing the feet of Padmavati in her dance (Padmavati-charana-charana-chakratarti), and again he refers to the collaboration of Padmavati in his recital in Ashtapadi 21 (Vihita-Padmavati-sukha-samaji bhanati Jayadeva Kavirajaraye).
এই প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা সমীচীন যে, সেকশুভোদয়ার অনুসরণে কবি জয়দেব ও পদ্মাবতীকে নট ও নটী অথবা সংগীতকলানিপুণ ও নিপুণা কিনা তা প্রমাণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য, গীতিনাট্য “গীতগোবিন্দ”-পদগানকে পৃষ্ঠ বা উৎসক্ষেত্র (back-ground)করে যে পরবর্তী রসসমৃদ্ধ পদাবলীকীর্তনের সার্থক সৃষ্টি হয়েছিল তারই আভাস দেওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে বৈষ্ণব-পদাবলীকীর্তনের রূপ, বিকাশ, সৌন্দর্য, আধ্যাত্মতত্ত্ব ও রসধারার পরিচয় দান করা ঐতিহাসিক দৃষ্টির সহায়তা নিয়ে৷ বিদগ্ধ বৈষ্ণব-মহাজন পদকর্তা ও গ্রন্থকারদের বিবরণ থেকে কীর্তনেও যে মৃদঙ্গ ছন্দে ও গীতিভঙ্গীর তালে তালে নৃত্যের প্রচলন এবং তার সঙ্গে বিচিত্র বাদ্যের সহযোগ ছিল একথা আমরা জানতে পারি৷ নৃত্য কীর্তনের প্রধান অঙ্গ না হলেও ভাবসমৃদ্ধি ও ছন্দমাধুর্য সৃষ্টির পক্ষে যে পরমসহায়ক ছিল এবং এখনো আছে একথা কীর্তনরসিকমাত্রেই স্বীকার করবেন৷ আমরা বৈষ্ণবপদ গ্রন্থে কীর্তনের সঙ্গে নৃত্যের উল্লেখ পাই৷
এবার দক্ষিণ-ভারতে গীতগোবিন্দের গীতিরূপ ছাড়াও যে নৃত্যনাট্যের রূপ গড়ে উঠেছিল এবং এখনো কিছু কিছু তার ধারা সঞ্জীবিত আছে তার পরিচয় দেব৷ পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, তাঞ্জোরের সরস্বতীমহল প্রকাশন থেকে Gitgovinda with Abhinaya নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে সেটির সম্পাদনা করেছেন বিদ্বান শ্রীবাসুদেব শাস্ত্রী৷ তিনি গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন ঃ “Abhinaya, given here, agrees well with the practice of the art in the Tanjore District which is now the home of the purest tradition of Bharatanatya, is itself sufficient to conclude that the work is pretty old * * It is extremely probable that, this work was composed by the direct disciples of Sri Jayadeva himself or those just after them”৷ তিনি আরো বলেছেন যে, তামিল দেশের প্রাচীন “শিলপ্পাধিকবম্‌”-গ্রন্থে মণ্ডলাকারে বাসনৃত্যের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সাধারণ গোপবালা বা আভীর রমণীদের কৃষ্ণ ও গোপীগণের ভূমিকা নিয়ে সম্পন্ন করতো এবং সে নৃত্যের নাম ছিল “অয় চিয়র-কুরবৈ” (Aychiyar Kuravai) ৷ এই তাঞ্জোর-গ্রন্থমালায় প্রকাশিত গীতগোবিন্দ গ্রন্থে মুনি ভরত-প্রণীত “নাট্যশাস্ত্র”-সম্মত ২৬ প্রকার অসংযুক্ত হস্ত, ১৩ প্রকার সংযুক্ত হস্ত, ৪ প্রকার হস্তকরণ, ১৩ রকম শিবকর্মের উল্লেখ আছে৷ নাট্য শাস্ত্রের ৮ম, ৯ম ও ১০ম অধ্যায়ে এবং নন্দিকেশ্বর-রচিত অভিনয়দর্পণে এদের পরিচয় দেওয়া আছে৷ আমরা এই গ্রন্থ থেকে “গীতগোবিন্দ”-পদগানের একটির নিদর্শন দেব নৃত্যনাট্যের সার্থক রূপায়ণ হিসাবে৷
গীতগোবিন্দের প্রথম সর্গের প্রথম গানটি হোল —
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং
বিহিতবহিত্র চরিত্রমখেদন ৷
কেশব ধৃতমীনশবীর, জয়জগদীশ হরে৷
এই গানটি মালবরাগে ও রূপকতালে গান করার রীতি ছিল৷ মালবরাগের ধ্যানশ্লোক–
নিতম্বিনীচুম্বিতবক্তবিম্বঃ শুভদ্যুতিকুণ্ডলবান্‌ প্রমত্তঃ ৷
সঙ্গীতশালাং প্রবিশন্‌ প্রদোষে মালাধরো মালবরাগরাজঃ ৷৷
এবং রূপকতালের পরিচয় ঃ “বিরামান্তর্দ্রুতদ্বন্দ্বো রূপকঃ স্বাদ্বিলক্ষণ ইতি”৷ (কীর্তনে রাগনাম, রাগরূপ, ধ্যানরূপ ও তালকমের বিস্তৃত পরিচয় পরে দেওয়া হবে৷) “প্রলয়পয়োধি জলে” প্রভৃতি গানের নৃত্যনাট্যরূপের পরিচয় দিয়েছেন “অভিনয়” – গ্রন্থকার,
(১) প্রলয় – পতাকোপরিমর্দিত পতাকেন গগনদৃষ্ট্যা চ ৷
(২) পয়োধিজলে – অধঃস্বস্তিকীকৃতবিচ্যুতোর্ধ্ব তলপতাকাভ্যাম্‌ ৷
(৩) ধৃতবানসি –অধোদেশাদুদ্বৃপ্তদৃষ্টিনা৷
(৪) বেদং — পুবস্তলনিকুঞ্চকেন৷
(৫) বিহিত — শনৈবধস্তলীকৃতপতাকেন৷
(৬) বহিত্র — চালিতাঙ্গুষ্ঠকরপ্রসারিতপুষ্পপুটেন৷
(৭) চরিত্র — প্রসারিতেতার্ধ্ব তলপতাকেন ৷
(৮) অখেদং — হৃদ্‌গতপতাকেন মুকুলয়া দৃষ্টা চ৷
(৯) কেশব — কেশবন্ধেন ৷
(১০) ধৃত — আবর্তনেন কৃতমুষ্টিনা ৷
(১১) মীনশরীর — মকরহস্তকেন ৷
(১২) জয় — উদ্ধৃতহস্তকেন ৷
(১৩) জগদীশ– ললাটস্থাঞ্জলিনা ৷
(১৪) হরে — বৈষ্ণবস্থানকেন ৷

গানের প্রতিটি কথা বা শব্দ নৃত্যসম্পর্কিত হস্ত, চরণ, গ্রীবা, দৃষ্টি প্রভৃতি সঞ্চালনকর্মের দ্বারা প্রকাশিত এবং এইগুলি বিচিত্র রস ও ভাবের উদ্বোধক বা প্রকাশক৷ এখানে হস্ত, দৃষ্টি, অঙ্গকরণ হিসাবে পতাক, পুষ্পপুট , মুকুলদৃষ্টি, মকরহস্ত, অঞ্জলি, কৃতমুষ্টি প্রভৃতি নৃত্যহস্তকরণ নাট্যশাস্ত্রে ও অভিনয়দর্পণে দ্রষ্টব্য৷ নৃত্যনাট্যপরিচায়ক এই গীতগোবিন্দের সংস্করণে প্রতিটি গানের এরূপভাবেই নৃত্যাঙ্গিকের বিবরণ দেওয়া আছে৷ গীতগোবিন্দের গীতিরূপ ছাড়াও নৃত্যরূপ যে শাস্ত্রসম্মত তারই পরিচায়ক এই অভিনয়-গ্রন্থ ও আলোচনা৷