বর্হাপীড়ং নটবরবপুঃ কর্ণয়োঃ কর্ণিকারং
বিভ্রদ্‌বাসঃ কনককপিশং বৈজয়ন্তীঞ্চমালাং৷
রন্ধ্রান্ বেণোরধরসুধয়া পূরয়ন্‌ গোপবৃন্দৈ-
র্বৃন্দারণ্যং স্বপদরমণং প্রাবিশদ্‌ গীতকীর্ত্তিঃ ৷৷
– শ্রীমদ্‌ভাগবত

এ স্থলে শ্রীকৃষ্ণের বিপিনবিহারী বেশ বর্ণিত হইয়াছে : শ্রীকৃষ্ণের সুন্দর দেহ, মস্তকে ময়ূরপুচ্ছের শিরোভূষণ,কর্ণে কর্ণিকার কুসুম, পরিধানে সুবর্ণের ন্যায় উজ্জ্বল পীতবাস, গলে আজানুলম্বিত পঞ্চবর্ণময়ী মালা, অধরে ন্যস্ত বেণু, গোপগণ চারিদিকে তাঁহার প্রশংসা গান করিতেছেন— এইভাবে তিনি তাঁহার লীলাভূমি রমণীয় বৃন্দাবনে প্রবেশ করিলেন।
এখানে ব্রজবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের যে বিচিত্র সৌন্দর্য-বৈদগ্ধ্যাদি প্রশংসারূপা গীতি গান করিলেন,তাহাই ‘কীর্তন’ শব্দের অর্থ৷ কৃৎ ধাতুর অর্থ প্রশংসা৷ সাধারণতঃ মৃত ব্যক্তির যে যশঃ তাহাই কীর্তি বলিয়া কথিত হয়, জীবিত ব্যক্তির সম্বন্ধে যশঃ খ্যাতি প্রভৃতি শব্দ প্রযোজ্য হয়৷ কিন্তু এখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখেই তাঁহার যে যশোগাথা গীত হইল তাহাকেই ভাগবতকার বলিলেন ‘কীর্তি’৷ কীর্তি এবং কীর্তন একই ধাতু হইতে উদ্‌ভূত হইয়াছে৷ কীর্তন বলিতে যে সংগীতবিশেষ বুঝায়, তাহা এই কীর্তি— বিশেষভাবে শ্রীকৃষ্ণের কীর্তি— গান করিবার পদ্ধতি হইতে আসিয়াছে৷
কীর্তন অর্থে সংগীত না বুঝাইয়া শুধু গুণানুবাদ বুঝাইতেও পারে৷ যেখানে নবধা ভক্তির লক্ষণ-বর্ণনায় কীর্তনের উল্লেখ আছে,

শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনং৷
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্‌৷৷

সেখানে গানই যে বুঝিতে হইবে, এমন নহে৷ কিন্তু ভগবদ্‌ভক্তির জন্য যে গুণকথন,লীলাবর্ণন প্রভৃতির প্রয়োজন,তাহা হইতেই সংগীতের নাম হইয়াছে ‘কীর্তন’৷ সুতরাং ভগবদ্‌বিষয়ক সংগীত ব্যতীত অন্য সংগীতকে কীর্তন নামে অভিহিত করা যায় না৷ কীর্তন মুখ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণের লীলা-বিষয়ক সংগীত হইলেও বর্তমানকালে কালী -বিষয়ক সংগীতও কালীকীর্তন নামে পরিচিত হইতেছে৷ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, রামপ্রসাদের এবং তাঁহার প্রবর্তিত সুরে শ্যামা- বিষয়ক যে সকল গান লইয়া কালীকীর্তন গীত হয়, তাহাতে ভক্তিরই প্রাধান্য লক্ষিত হয়৷
‘কীর্তন’ বলিতে আমরা বাংলাদেশেরই একটি বিশিষ্ট সংগীত-পদ্ধতি বুঝি ; কিন্তু ‘কীর্তন’ শব্দ বাংলাদেশেরই একচেটিয়া নহে৷ দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পারে যে মহারাষ্ট্রদেশে সাধক কবি তুকারাম যে সংগীত করিতেন তাহাও কীর্তন নামে কথিত হইয়াছে৷ তিনি তাঁহার একটি অভঙ্গে বলিয়াছেন, যে, জাহ্নবীর ধারা যেমন ভগবানের পাদপদ্ম হইতে উত্থিত হইয়া মরধামে নামিয়াছে, কীর্তনের ধারা তেমনি মানুষের হৃদয় হইতে উৎসারিত হইয়া ভগবৎ-পাদপদ্মে গিয়া মিশিয়াছে৷ উভয় ধারাই পতিতপাবনা৷ মানুষের হৃদয় পবিত্র করিতে, পাপরাশি ধৌত করিতে কীর্তন গঙ্গারই মত ফলপ্রদ৷
তবে বাংলার বাহিরে আমাদের কীর্তন-সংগীতের মত কোনও সংগীত নাই৷ ভগবৎ-সংগীত ভজন নামে অনেক স্থলে পরিচিত৷ কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরিয়া বাংলার মাটিতে কীর্তন নামে যে এক অভিনব সংগীতপদ্ধতি জন্মলাভ করিয়াছিল, অন্য কোনও দেশে তাহার তুলনা পাওয়া যায় না৷
এই নূতন পদ্ধতি অন্য অনেক ক্ষেত্রে অনুকৃত হইয়াছে৷ কীর্তনগানের সুকোমল আবেদন ও বৈশিষ্ট্য লইয়া বহু ব্রহ্মসংগীত রচিত হইয়াছে৷ যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতিতেও কীর্তনের ভঙ্গী বহুল পরিমাণে গৃহীত হইয়াছে৷ বলা বাহুল্য এ সব স্থলে কীর্তনসংগীতের আভিজাত্য রক্ষিত না হইলেও, ইহা বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে, তাহাতে কীর্তনের প্রভাব সুস্পষ্ট৷ রবীন্দ্রনাথের সংগীত-প্রতিভা ছিল অনন্যসাধারণ৷ ভারতীয় সংগীতের মাধুর্য তিনি যেরূপ ভাবে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, এরূপ খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে৷ কীর্তনের বৈশিষ্ট্যও তিনি অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং সেই জন্যই তাঁহার রচিত কীর্তনগানগুলিতে সুরের কারুকলা যেরূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে, তেমন আর কাহারও গানে হইয়াছে কিনা সন্দেহ৷ অবশ্য তিনি উচ্চাঙ্গের কীর্তনের সহিত সুপরিচিত হইলেও তাঁহার গানগুলিতে তিনি কীর্তনের আধুনিক সুরই যোজনা করিয়াছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আমাদের দেশের আরও বহু কবি কীর্তনের ছাঁচে পদ রচনা করিয়াছেন এবং তাহাতে কীর্তনের অনুকরণে আখর দিবারও ব্যবস্থা হইয়াছে৷ এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর উল্লেখ করিতে হয়৷ কবি এই পদাবলীতে বিদ্যাপতি ঠাকুর ও অন্য বৈষ্ণব-কবির অনুসরণে ব্রজবুলি-ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন৷ ইহা হইতে বুঝা যায় যে বর্তমান কালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবির উপর কীর্তনের প্রভাব কতখানি পড়িয়াছিল৷