পূর্বেই বলিয়াছি কীর্তন বলিতে ভগবদ্‌বিষয়ক সংগীত বুঝায় এবং বিশেষভাবে শ্রীকৃষ্ণলীলা অবলম্বন করিয়া যে সংগীত তাহাকেই কীর্তন নামে অভিহিত করা হয়৷ প্রথমতঃ ইহাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় : নামকীর্তন ও লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন৷
নামকীর্তনে ভগবোনের নাম গীত হয়৷ সুরে ভগবানের নাম করিলেই তাহা নামকীর্তন-পদবাচ্য হয়৷ নববিধা ভক্তির প্রধান সাধন নামকীর্তন৷ ‘নববিধা ভক্তি পূর্ণ হয় নাম হৈতে’৷ বৈষ্ণবদের মধ্যে এই নামকীর্তনের যেরূপ প্রভাব দেখা যায় অন্য কোনও ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সেরূপ নহে৷ বৈষ্ণবেরা মনে করেন যে, ‘কলিযুগে ধর্ম নামসংকীর্তন সার’৷ সংকীর্তন ও কীর্তন সমার্থক৷ উচ্চস্বরে হরিনাম করার নাম সংকীর্তন৷ নাম হইতেই প্রেম হয় এবং নাম করিতে করিতে ভক্ত কখনও কখনও বহির্জগতের সত্তা ভুলিয়া যান৷ ইহার নাম ‘আবেশ’৷ যোগী যোগসাধনার দ্বারা যে সমাধির অবস্থা প্রাপ্ত হন, ভক্ত নামগানের দ্বারাও সেইরূপ ভাব সমাধি লাভ করিয়া থাকেন৷ এইজন্য বৈষ্ণবেরা উচ্চকণ্ঠে নামসংকীর্তনের প্রশংসা করিয়াছেন৷ নামের সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে এইরূপ উক্ত হইয়াছে :

কেহ বলে নাম হৈতে হয় পাপক্ষয়৷
কেহ বলে নাম হৈতে জীবের মোক্ষ হয়৷৷
হরিদাস কহে নামের এ দুই ফল নয়৷
নামের ফলে কৃষ্ণপদে মন উপজয়৷৷
– চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্যলীলা ৩য় পরিচ্ছেদ

ইহার নাম রতি বা প্রেম৷ নামসংকীর্তনের মুখ্য উদ্দেশ্য প্রেম, এবং হৃদয়ে এই প্রেম-সঞ্চারই বৈষ্ণবধর্মের প্রধান লক্ষ্য৷ বহু লোক একসঙ্গে নামসংকীর্তন করিতে পারেন৷ শ্রীচৈতন্যদেব যখন প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া নামসংকীর্তন করিতেন, তখন সহস্র সহস্র লোক সেইসঙ্গে যোগদান করিতেন এইরূপ শুনা যায়৷
অনেকে মনে করিতে পারেন যে, নামসংকীর্তনে সংগীতের ভাগ অল্প৷ কারণ কোনও একটি নাম বা নামসমূহ উচ্চকণ্ঠে অধিকক্ষণ গান করিলে তাহা ক্রমেই একঘেয়ে হইয়া পড়ে৷ কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তাহা হয় না যাঁহার চতুষ্প্রহর, অষ্ট প্রহর বা চব্বিশ প্রহর নামকীর্তন শুনিয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে এই নামগান বিভিন্ন রাগরাগিণীতে এবং ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে বা তালে করা হয়৷ প্রভাতে ভৈরব, ভৈরবী, মধ্যাহ্নে বাগেশ্রী, সন্ধ্যায় পূরবী, ইমনকল্যাণ, রাত্রে বেহাগ এইরূপ পর্যায়ক্রমে নাম করা হয়৷ সুতরাং ভক্তগণের অবসাদ যাহাতে না আসিতে পারে, তাহার জন্য নামকীর্তনে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়৷ বহু খোল-করতাল একসঙ্গে বাজিতেছে , বেহালা বাঁশি প্রভৃতি অন্য যন্ত্রও হয়তো আছে, বিশুদ্ধ সুরে লয়ে নামের প্রবাহ চলিয়াছে, শ্রোতা ও গায়ক অশ্রুসমাকুল কণ্ঠে ভগবানকে আহ্বান করিতেছেন, কখনও দ্রুত কখনও বিলম্বিত লয়ে, কখনও কখনও সুর মুদারাগ্রাম অতিক্রম করিয়া তারায় ছুটিতেছে, আর গায়ক ও শ্রোতা পরস্পরের সত্তা ভুলিয়া উদ্দাম নৃত্য করিয়া পরিশেষে ভাবাবেশে ভূলুণ্ঠিত হইতেছেন — ইহাই নামসংকীর্তনের সাধারণ একটি দৃশ্য৷ মনে রাখিতে হইবে জনসংগীত বা mass singing এর দৃষ্টান্ত ভারতীয় সংগীতে এরূপ আর কোথাও দেখা যায় না৷ বিলাতের ধর্মমন্দিরে যে জনসংগীত শুনিতে পাওয়া যায় বা জাতীয় সংগীতে সর্বসাধারণের যোগদান করিবার যেরূপ সুযোগ আছে, নামসংকীর্তনে সেইরূপ ব্যাপক একতা দেখা যায়৷ নামসংকীর্তনে যে রাগরাগিণীর সমাবেশের কথা বলিলাম উহা অনেকটা বৈঠকী বা হিন্দুস্থানী রীতির অনুগত৷ সুতরাং সুরজ্ঞ গায়ক ইচ্ছা করিলে নামসংকীর্তনে যথেষ্ট নূতনত্ব ও মাধুর্য সঞ্চার করিতে পারেন৷
একটি কথা এখানে বলা আবশ্যক৷ নামসংকীর্তনে যেমন ভগবানের নাম সুরসহযোগে গীত হয়, তেমনই সেই সঙ্গে প্রার্থনা ও দৈন্যনিবেদনও গীত হইতে পারে৷ এই সকল প্রার্থনাসংগীত বৈষ্ণব গীতিসাহিত্যের এক অপূর্ব সম্পদ৷ প্রার্থনাগীতে কীর্তনের লক্ষণ থাকে; সুরেরও ভাতি কীর্তনসংগীতের অনুগত৷
শ্রীভগবন্নাম লইয়াই নামসংকীর্তন— যেমন ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে৷ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে৷৷’ এ নামেরই পৌনঃপুনিক ও বিরামশূন্য আবৃত্তিতে অষ্ট প্রহর, চব্বিশ প্রহর অতিবাহিত হইতে পারে৷ অথবা শ্রীচৈতন্যের নামও তার সঙ্গে জুড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে, যথা ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ, হরে কৃষ্ণ হরে রাম শ্রীরাধে গোবিন্দ৷’ ‘নিতাই গৌর রাধে শ্যাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম৷’ শ্রীচৈতন্যও ভগবান বা ভগবানের অবতার বলিয়া পূজিত হন৷ শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ নামসংকীর্তন প্রচার করিয়া বঙ্গদেশে একপ্রবল ভাববন্যা আনয়ন করিয়াছিলেন৷ সেজন্য তাঁহাদিগকে সংকীর্তনের জনক বলা হয় :
প্রেমবন্যা নিতাই হৈতে অদ্বৈত তরঙ্গ তাতে
চৈতন্য বাতাসে উথলিল৷
– বলরাম দাস৷
এই প্রেমবন্যায় একদিন ‘শান্তিপুর ডুবুডুবু নদে ভেদে যায়’৷ শ্রীচৈতন্যের অদ্ভুত প্রেরণা, নিত্যানন্দের অনবচ্ছিন্ন প্রাচার এবং শান্তিপুরনাথ অদ্বৈতচন্দ্রের ভক্তিধর্ম-ব্যাখ্যা— এই তিনের সমাবেশে বাংলা জুড়িয়া এক বিরাট ধর্মের প্রবাহ বহিয়াছিল৷ শ্রীচৈতন্য শিক্ষায় সর্বাপেক্ষা প্রধান কথা—
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলং৷
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা৷
কলিকালে নাম ভিন্ন জীবেন অন্য গতি নাই, নাই, নাই৷ এই ত্রিসত্য করিবার উদ্দেশ্য এই যে ইহাতে সংশয়ের কোন অবকাশ নাই৷
সত্যযুগে লোকে ধ্যান যে লাভ করিত, ত্রেতাযুগে যজ্ঞ করিলে যে পুণ্য হইত,দ্বাপরে পরিচর্যায় বা অর্চনায় সে সুকৃতি প্রাপ্ত হইতে, কলিযুগে হরিকীর্তনে সেই ফল লভ্য হয়৷
সত্যে যদ্ ধ্যায়তে বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজতে মখৈঃ৷
দ্বাপরে পরিচর্যায়াং কলৌ তদএ্ হরিকীর্তনাৎ৷৷
চৈতন্যচরিতামৃতে নামের ফল সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে,
কৃষ্ণনাম মহামন্ত্রের এই ত স্বভাব৷
যেই জপে তার কৃষ্ণে উপজয়ে ভাব৷৷
কৃষ্ণবিষয়ক প্রেমা পরম পুরুষার্থ৷
যার আগে তৃণতুল্য চারি পুরুষার্থ৷৷
পঞ্চম পুরুষার্থ প্রেমানন্দামৃত সিন্ধু৷
মোক্ষাদি আনন্দ যার নহে এক বিন্দু৷৷
কৃষ্ণনামের ফল প্রেমা সর্ব শাস্ত্রে কয়৷
– চৈতন্যচরিতামৃত, আদি, ৭ম পরি

নামসংকীর্তনের উদ্দেশ্য এই প্রেমের উদয়৷ ভগবানের প্রতি মনের অনুকূলতা হইলে হৃদয়ে যে স্বার্থশূন্য বিমল ভাবের আবির্ভাব হয় তাহার নাম রতি৷ এই রতি গাঢ় হইলে তাহাকে বলে প্রেম৷ ইহা শুদ্ধসত্ত্ব স্বরূপ, নির্মল, কারণ ইহার মধ্যে কোনও স্বার্থের লেশ নাই৷ ভক্ত মোক্ষও কামনা করেন না৷ কারণ ভগবদ্‌ভজনে যদি মোক্ষের কামনা থাকে, তাহাও একপ্রকার স্বার্থপরতা৷
বৈষ্ণবেরা যে কেন মোক্ষ বাঞ্ছা করেন না, তাহা একটু প্রণিধান করিলে বুঝিতে পারা যায়৷ তাঁহাদের মতে ভগবানই একমাত্র কাম্য৷ ভগবান নিজেই যেখানে কামনার বস্তু, সেখানে আর অন্য কি কাম্য থাকিতে পারে ? অতএব নামসংকীর্তনের সার্থকতা হইতেছে চিত্তশুদ্ধিলাভ৷ সুরলয়-সহযোগে হউক বা এমনি হউক, নাম করিতে করিতে চিত্তের সমস্ত মলিনতা, বিষয়ের সমস্ত চিন্তা, স্বার্থের বা কামনার সকল প্রকার সন্ধান দূরীভূত হইয়া যায়৷ সুতরাং ভগবানের চিন্তা, তাঁহার নামগুণকীর্তন এবং ভগবৎ-সেবাই পরম বাঞ্ছিত৷ নামসংকীর্তন তাহারই সাধন৷ কারণ নাম ও নামী অভিন্ন৷

যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি৷
নামের সহিত ফিরেন আপনি শ্রীহরি৷৷
—চৈতন্যচরিতামৃত

পদ্মপুরাণে আছে—
নামচিন্তামণিঃ কৃষ্ণশ্চৈতন্যরসবিগ্রহঃ৷
পূর্ণঃ শুদ্ধো নিত্যমুক্তোঽভিন্নত্বান নামনামিনঃ৷৷

অর্থাৎ কৃষ্ণনাম চিন্তামণি (সর্বার্থপ্রদ); শুধু তাহাই নহে নাম সাক্ষাৎ চৈতন্য-রসমূর্তি শ্রীকৃষ্ণ যিনি পূর্ণব্রহ্ম, শুদ্ধবুদ্ধ এবং অপাপবিদ্ধ ও নিত্যমুক্ত৷ কারণ নাম ও নামীর কোনও ভেদ নাই৷