কীর্তনের অপর বিভাগের নাম লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন৷ শ্রীকৃষ্ণের লীলা অবলম্বন করিয়া যে সকল গীত, তাহা লীলাকীর্তন নামে অভিহিত হয়৷ কিন্তু বঙ্গদেশে যে লীলাকীর্তন প্রচলিত আছে, তাহা মাত্র কয়েকটি লীলা অবলম্বনেই রচিত৷ প্রথমতঃ সে-সমস্তই বৃন্দাবনলীলা-সম্পর্কে৷ বৃন্দাবনে যে-সকল লীলা অনুষ্ঠিত হইয়াছিল তাহারও সবগুলি কীর্তনে প্রচলিত নাই, যেমন পুতনাবধ, যমলার্জুনভঙ্গ ইত্যাদি৷ সচরাচর যে-সকল লীলা কীর্তনে শুনিতে পাওয়া যায় তাহা এই—
জন্মলীলা, নন্দোৎসব, বাল্যলীলা, গোষ্ঠলীলা,রাধাকুণ্ডমিলন, সূর্যপূজা, জলক্রীড়া, পাশাক্রীড়া, দানলীলা, সুবলমিলন, উত্তরগোষ্ঠ, নৃত্যরাস, মহারাস, বসন্তলীলা, বাসন্তী রাসলীলা, হোলিলীলা, হোলির নৃত্যরাস, ঝুলন, কুঞ্জভঙ্গ বা নিশান্তলীলা, পূর্বরাগ, রূপানুরাগ, অভিসার, আক্ষেপানুরাগ, কলহান্তরিতা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, খণ্ডিতা, বিপ্রলব্ধা, মান, বিরহ বা মাথুর, বংশীশিক্ষা ইত্যাদি৷
যাত্রায় কালীয়দমন, কলঙ্কভঞ্জন, কংসবধ প্রভৃতি পালা আছে বটে, কিন্তু কীর্তনেঐ সকল পালা প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায় না৷ কালীয়দমনের ও কলঙ্কভঞ্জনের পদাবলী আছে৷ লীলাগান সম্বন্ধে কেহ কেহ মনে করেন যে, উহা অনধিকারীর পক্ষে নহে৷ অনধিকারী লীলাকীর্তন শুনিয়া উহার আধ্যাত্মিক দ্যোতনা বুঝিতে পারেন না৷ সুতরাং উহাতে তাঁহাদের ইষ্ট না হইয়া অনিষ্ট হইবার আশঙ্কা বেশী৷ প্রেমদাসের বংশীশিক্ষায় আছে—
অন্তরঙ্গ সনে লীলারস-আস্বাদন
বহিরঙ্গ লৈয়া হরিনাম-সংকীর্তন৷৷
ইহা শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মত বলিয়া উদ্ধৃত হয়৷
কিন্তু কে বহিরঙ্গ এবং কে অন্তরঙ্গ তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে৷ অনেক সময়ে দেখিয়াছি যিনি অন্তরঙ্গ ও ভক্ত বলিয়া পরিচিত, তাঁহার মধ্যে রসের উপলব্ধি নাই, অথচ যাঁহাকে বহিরঙ্গ বলিয়া উপেক্ষা করিয়াছি, তাঁহার মন লীলাগানে গলিয়া গিয়াছে৷ সে যাহা হউক, প্রশ্নটি শুধু সংগীতের দিক দিয়া বিচার্য নহে; অধিকারী-ভেদ এবং লীলা-তাৎপর্যের গূঢ় তত্ত্ব ইহার সহিত জড়িত৷ সে সকল জটিল আলোচনার মধ্যে প্রবেশ না করিয়া বলা যাইতে পারে যে,যাঁহাদের নামসংকীর্তনে আনন্দ হয়, তাঁহাদের পক্ষে নামসংকীর্তনই শ্রেয়ঃ৷ আর যাঁহারা লীলাস্বাদনে আনন্দ পান, তাঁহারা লীলগানের অধিকারী৷ ভগবানের নামে যদি প্রীতি হয়, তাহা হইলে তাঁহার গুণানুবাদে, লীলাস্মরণে, তৎপদাঙ্কিত তীর্থাদিতেও প্রীতি হওয়া স্বাভাবিক৷
লীলাকীর্তনকে রসকীর্তন নামে অভিহিত করা হয়৷ রস অর্থে যাহা আস্বাদন করা যায় অর্থাৎ যাহা চিন্তা করিলে বা শুনিলে হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হয়, তাহার নাম রস৷ আনন্দময় ভগবানের লীলাও আনন্দের সৃষ্টি করে, এই জন্য লীলাকীর্তনের অপর নাম রসকীর্তন৷
কীর্তনে ৬৪ রস আছে৷ প্রথমতঃ অলঙ্কারশাস্ত্রে শৃঙ্গাররস দুই ভাগে বিভক্ত হয়৷ যথা বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ৷ অতিশয় অনুরক্ত যুবক-যুবতীর অসমাগমনিমিত্ত রতি যখন উৎকৃষ্টতা প্রাপ্ত হয়, অভীষ্টসিদ্ধি করিতে পারে না, তখন সেই ভাবকে ‘বিপ্রলম্ভ’ বলে৷ প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পর মিলনে যে উল্লাসময় ভাব হৃদয়ে আবির্ভূত হয় তাহার নাম ‘সম্ভোগ’৷ বিপ্রলম্ভ আবার চারি প্রকার, যথা— পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস৷ ইহাদের প্রত্যেকটি আবার আট ভাগে বিভক্ত৷ যথা— পূর্বরাগের অন্তর্গত আটটি রস— সাক্ষাৎ দর্শন, চিত্রপটে দর্শন, স্বপ্নে দর্শন, বন্দী বা ভাটমুখে গুণশ্রবণ, দূতীমুখে শ্রবণ, সখীমুখে শ্রবণ, গুণিজনের গানে শ্রবণ, বংশীধ্বনি শ্রবণ৷
মানের অন্তর্গত আটটি রস- সখীমুখে শ্রবণ, শুকমুখে শ্রবণ,মুরলীধ্বনি শ্রবণ, প্রতিপক্ষের দেহে ভোগচিহ্ন দর্শন, প্রিয়তমের অঙ্গে ভোগচিহ্ন দর্শন, গোত্রস্খলন, স্বপ্নে দর্শন, অন্য নায়িকার সঙ্গ দর্শন৷
প্রেমবৈচিত্ত্যের আটটি রস, যথা— শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আক্ষেপ, নিজপ্রতি আক্ষেপ, সখীর প্রতি, দূতীর প্রতি, মুরলীপ্রতি, বিধাতার প্রতি, কন্দর্পের প্রতি এবং গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ৷
প্রবাসের আটটি, যথা— ভাবী(বিরহ), মথুরাগমন, দ্বারকাগমন, কালীয়দমন (অদর্শনে বিরহ), গোচারণজনিত বিরহ, নন্দমোক্ষণ, কার্যানুরোধে প্রবাস, রাসে অন্তর্ধান৷
বিপ্রলম্ভের ন্যায় সম্ভোগেরও চারিটি বিভাগ আছে, যথা— সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ, সংকীর্ণ সম্ভোগ, সম্পন্ন সম্ভোগ এবং সমৃদ্ধিমান্‌ সম্ভোগ৷ সংক্ষিপ্ত সম্ভোগের অন্তর্গত আটটি রসের নাম— বাল্যাবস্থায় মিলন, গোষ্ঠে গমন, গোদোহন, অকস্মাৎ চুম্বন, হস্তাকর্ষণ, বস্ত্রাকর্ষণ,পথরোধ, রতিভোগ৷
সংকীর্ণ সম্ভোগ মহারাস, জলক্রীড়া, কুঞ্জলীলা, দানলীলা, বংশীচুরি, নৌকাবিলাস, মধুপান, সূর্যপূজা এই আটটি বিভাগ আছে৷
সম্পন্ন সম্ভোগের বিভাগ যথা— সুদূর দর্শন, ঝুলন, হোলি, প্রহেলিকা, পাশাখেলা, নর্তকরাস, রসালস, কপটনিদ্রা৷
সমৃদ্ধিমান্‌ সম্ভোগ— স্বপ্নে বিলাস, কুরুক্ষেত্র, ভাবোল্লাস, ব্রজাগমন, বিপরীত সম্ভোগ, ভোজনকৌতুক, একত্র নিদ্রা, স্বাধীনভর্তৃকা৷
পূর্বে যে সকল লীলার উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে এই চতুঃষষ্টি রসের অল্পাধিক বিস্তার আছে৷ কীর্তন গায়ককে সেইজন্য সাবধানতার সহিত গান করিতে হয়৷ কীর্তনিয়া শুধু সংগীতজ্ঞ হইলেই হয় না, তাঁহাকে পণ্ডিতও হইতে হয়৷ সকল কীর্তনিয়াই যে পণ্ডিত একথা বলিতেছি না৷ তবে পণ্ডিত হইলে ভাল হয়৷ পূর্বে এরূপ বহু কীর্তনগায়কের নাম শুনা যায় যাঁহারা পণ্ডিত ছিলেন৷ এই সেদিনও অদ্বৈতদাস পণ্ডিত বাবাজি, রায় বাহাদুর রসময় মিত্র কীর্তনগানে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া গিয়াছেন৷ রস-জ্ঞান না থাকিলে অভিজ্ঞ শ্রোতার নিকট গায়ককে পদে পদে লাঞ্ছিত হইতে হয়৷ রস-জ্ঞানের অভাব থাকিলে রসাভাস হয় এবং রসাভাসবিশিষ্ট গানে রসিক শ্রোতার মনস্তুষ্টি হয় না৷ রসাভাসের অর্থ মোটামুটি রসদুষ্টি৷ অর্থাৎ যেখানে যে রসের পরিবেশন করিতে হইবে তাহা না করিয়া অন্য রস বা বিরুদ্ধ রস পরিবেশন করিলে তাহা শ্রুতিকটু হয়৷ সূক্ষ্ম রসবিচারে নিপুণতার সহিত সুরলয়ের সংগতি থাকিলে তবেই শ্রুতিসুখকর হয়৷ রসাভাসের সম্বন্ধে পরে বলিতেছি৷ এখানে শুধু বলা আবশ্যক যে, আনন্দ সকল সংগীতের উপাদান হইলেও, কীর্তনের বৈশিষ্ট্য এই যে, গায়ক এবং শ্রোতা উভয়কেই রসজ্ঞ হইতে হয় অর্থাৎ বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত এবং অলংকারশাস্ত্রের মূল সূত্রের সহিত সুপরিচয় থাকা আবশ্যক৷
বর্তমান সময়ে যাঁহারা কীর্তনগান করেন, তাঁহারা সকলেরই যে অলংকারশাস্ত্রে পারদর্শী, তাহা বলা যায় না৷ বরং তাঁহাদের অনেকেরই হয়তো তাদৃশ শাস্ত্রজ্ঞান নাই৷ কিন্তু বংশপরম্পরা অথবা গুরুপরম্পরাক্রমে ইঁহারা কীর্তন শিক্ষা করিয়াছেন; তাহার ফলে অনেকটা সংস্কারবশতঃই ইহাঁরা রসাভাসের হাত এড়াইয়া যান৷ অনেকেই হয়তো জানেন যে উচ্চাঙ্গের কীর্তনে মহাজন রচিত পদাবলী গীত হইয়া থাকে৷ কীর্তনিয়া যদি এই পদাবলীর অর্থ না বুঝেন বা এক বুঝিতে আর বুঝেন, তবে তাঁহার কীর্তন ব্যর্থ হয়৷