চণ্ডীদাস-পদাবলীর আলোচনা-প্রসঙ্গে দেখিতে পাই বিষয়বস্তুর দিক্‌ দিয়া কতকগুলি পদ ‘একক-সম্পূর্ণ’৷ পদাবলীর সমগ্রতায় সুরের ঐক্য আছে, কিন্তু রসে ভাবে গাঢ়বন্ধ পদগুলি বক্তব্য যেন তাহারই মধ্যে পূর্ণতা লাভ করিয়াছে এবং সেই পূর্ণতার মধ্য হইতে এক আবেগকুল ব্যঞ্জনার অসমাপ্ত বাণী তাহাকে বাক্যাতীত অসীমের পথে অগ্রবর্তী করিয়া দিয়াছে ৷ বেদনার সে কি তীব্রতা, অনুভূতির সে কি সুধা-বিষের জ্বালা, যেন বুঝিতে পারি, অথচ সহ্য করিতে পারি না ৷ এই অসহ আনন্দের অননুভূতপূর্ব আস্বাদ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামধেয় গ্রন্থে বড়ু চণ্ডীদাসের কয়েকটি পদেও যেমন, চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত অপর কতকগুলি পদেও তেমনি ৷ তদ্ভিন্ন চণ্ডীদাসের নামে বহু পদ প্রচলিত একটি আখ্যায়িকা অনুসরণ করিয়াছে ৷ সেগুলির কবিত্ব অতি নিম্মশ্রেণীর; ছন্দের আড়ষ্টতা, ভাবপ্রকাশের দৈন্য এবং অন্ত্যানুপ্রাস মিলনের অক্ষমতা তাহার মধ্যে এত সুস্পষ্ট যে একজন সাধারণবুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রের দৃষ্টিতেও তাহা ধরা পড়িবে ৷ চণ্ডীদাস-পদাবলীর এই পার্থক্য লক্ষ্য করিয়াই বহুদিন পূর্বে গত সন ১৩৩৩ সালের পৌষ সংখ্যা ‘ভারতবর্ষে’ আমি ‘দীন চণ্ডীদাস’ নামক দ্বিতীয় একজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব স্বীকার করি এবং তাহার পরিচয় প্রকাশ করি ৷ অতঃপর বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ কার্যালয় হইতে ডঃ শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও আমার সম্পাদনায় চণ্ডীদাস-পদাবলী ও পণ্ডিত ৺বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে ‘দীন চণ্ডীদাসের পদাবলী’ প্রকাশ করিয়াছেন ৷ দীন চণ্ডীদাসের পদাবলীতে পদসন্নিবেশের যে রীতি অনুসৃত হইয়াছে তাহা যে নিতান্তই কল্পনাশ্রিত, সুতরাং ভ্রমসঙ্কুল, সম্প্রতি ‘দীন চণ্ডীদাসের পদের পুঁথি’ আবিষ্কৃত হওয়ায় আর একবার তাহা প্রামাণিত হইয়াছে ৷ পুঁথিখানির পরিচয় দিয়া পরে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার করিয়া বলিতেছি৷
বীরভূমের খ্যাতনামা সাহিত্যিক শ্রীমান্‌ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এম. এ মহাশয় মাঝে মাঝে প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করিয়া থাকেন ৷ ১৩৪৮ সালে ‘চণ্ডীদাস-নানুর’ সাহিত্য-সম্মেলন হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া তিনি তাঁহার বন্ধু বর্ধমান জেলার সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত বনপাস্‌ গ্রাম-নিবাসী শ্রীযুক্ত ত্রিভঙ্গ রায় মহাশয়ের নিকট চণ্ডীদাস-সাহিত্য-সম্মেলনের গল্প করেন ৷ কথা প্রসঙ্গে ত্রিভঙ্গবাবু বলেন যে তাঁহাদের বাড়ীতে একখানি পুঁথি কয়েক পুরুষ ধরিয়া পূজাপ্রাপ্ত হইয়া আসিতেছে ৷ পুঁথিখানি তিনি দেখিয়াছেন, সেখানি চণ্ডীদাস ঠাকুরের পদাবলীর পুঁথি৷ সতীশবাবুর নির্বন্ধাতিশয্যে ত্রিভঙ্গবাবু পুঁথিখানি কলিকাতায় লইয়া আসেন ৷ পুঁথিখানি আদ্যেপ্রান্ত দেখিয়া সতীশবাবু আবশ্যক উপকরণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন৷ আমি এই প্রবন্ধে তাহাই ব্যবহার করিয়াছি এবং তজ্জন্য সতীশবাবুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি৷
পুঁথিখানি খণ্ডিত ৷ ৩১০ সংখ্যক পদ হইতে ১২০২ সংখ্যক পদ পাওয়া গিয়াছে ৷ তাহার মধ্যেও পুঁথির অনেক পাতা পাওয়া যাইতেছে না ৷ মাঝে মাঝে এইরূপ লেখা আছে— “এই অবধি একানই পাত ৷ পরে ছিয়ানই পাতে লেখে ৷৷”( এইস্থানে পদসংখ্যা ৪৯৮, মাঝে কয়েকটি পদ নাই, পরের পদসংখ্যা ৫১৭) “এই হইতে একশত দুইএর পাত বেবাক হইল ৷ তারপর একশত চত্তিশ পাতের প্রথম লেখা যায়৷”(৫৫১ পদের পর ৭৩২ পদ, মাঝের পদগুলি নাই) (১০১৭ সংখ্যক পদের তিন পংক্তির পর) “এই অবধি বাসরের দুই শত পাত তামাম৷ তাহার পর ২১৯ পাতে লেখে ৷৷” ইহা হইতে বুঝিতে পারা যায় আদর্শ পুঁথিতেও এই পাতাগুলি ছিল না ৷ তজ্জন্যই লিপিকার ঐরূপ লিখিয়া রাখিয়াছিলেন ৷ পুঁথির লিপিকাল কিঞ্চিদধিক একশত বৎসর বলিয়া অনুমিত হয় ৷
এই পুঁথি দেখিয়া বুঝিতে পারা যায় দীন চণ্ডীদাস রাধা-কৃষ্ণ লীলাত্মক একখানি সুবৃহৎ কাব্য রচনা করিয়াছিলেন ৷ অন্যত্র প্রাপ্ত পুঁথি দৃষ্টেও জানা যায় তিনি শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা ও শ্রীরাধার জন্মলীলা হইতে আরম্ভ করিয়া শ্রীরাধাকৃষ্ণের পৌরাণিক-অপৌরাণিক প্রায় কোন লীলাই বর্ণন করিতে বাকী রাখেন নাই ৷ তিনি ঝুলন, গোষ্ঠ, রাস, দোল ইত্যাদিও যেমন বর্ণন করিয়াছেন, তেমনি অভিসার, বাসক, সজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা-আদি লইয়াও কবিতা লিখিয়াছেন ৷ তাঁহার কাব্যে মাথুর বিরহ – আদিরও অভাব নাই৷ আবার কাকমাল্য দান, ভ্রমরদূত, পবনদূত প্রভৃতিও আছে৷ আমাদের আলোচ্য পুঁথি হইতে জানা যায় — দীন চণ্ডীদাস শ্রীপাদ রূপ গোস্বামীর পরবর্তীকালে বর্তমান ছিলেন, অন্ততঃ তাঁহার কাব্য শ্রীপাদ রূপ গোস্বামীর ‘দানকেলীকৌমুদী’র পরে রচিত হইয়াছিল ৷ দীন চণ্ডীদাসের ১১৭১ পদে আছে —
বড়াই রসের তরু দোঁহে রসাইয়া ৷
দানকেলি কৌমুদিনী কহিয়াছে ইহা ৷৷
কবি লিখিয়াছেন — “বিচিত্র পালঙ্কপরে সোনার দুলিচা ৷ সুরঙ্গ পাটের তুলি সুরঙ্গ গালিচা ৷৷” সোনার দুলিচা হয় কিনা জানি না, তবে দুলিচা গালিচা দিয়াও কবির সময় নির্ণীত হতে পারে ৷ পুঁথির প্রথম দিকের পাতাগুলি পাওয়া গেল এবং তাহার মধ্যে পুঁথি আরম্ভের ধারা দেখিলে কবিকে আরো একটু ভালভাবে ধরিতে পারা যাইত ৷ আমাদের ভাগ্যহীনতা সে সাধে বাদ সাধিয়াছে৷ পুঁথির এক দিকের যে অংশটুকু পাওয়া গিয়াছে তাহাকে নায়িকা-বর্ণনার উপক্রমিকা বলিতে পারি ৷ অংশটী এইরূপ —
শ্রীমতী রাধিকা রাজার বালিকা তিঁহো সে রসের সখা ৷
তাহার প্রধান আট ডাল ভেল এই সে ব্যাসের লেখা ৷৷
এক ডাল ভেল তাহে উপজল ললিতা তাহার নাম ৷
তাহা হত্যে হল নবোঢ়ার রস শুন অতি অনুপাম ৷৷
তাহাতে মঞ্জরি সপ্ত সপ্ত করি জে হয়ে রসের নাম ৷
প্রেম সে মঞ্জরি হইতে হইল রসোল্লাস গুণ গ্রাম ৷৷
লিলা সে মঞ্জরি রতি সে সুন্দরী সে কহে ভাবের কথা ৷
তাহারে বলিয়ে ভাবের উল্লাস শুনিতে হিয়াতে বেথা ৷৷
কস্তুরি মঞ্জরি তাহা শুন পুন কহনে নাহিক যায় ৷
প্রেম রস কথা সদা উচাটন প্রেমের উল্লাস কয় ৷৷
লালস মঞ্জরির সতত আমোদ রূপের উদ্গার রসে ৷
তাহাতে হইল রূপের উল্লাস রূপ অনুপাম বেশে ৷৷
রাগ মঞ্জরির রাগেতে মোহিত ধরিয়া হাথেতে তাল ৷
তাহাতে হইল রসে উল্লাস কহিল রসের সার ৷৷
কেলি সে মঞ্জরি কেলি কলা রসে গৃহেতে গৃহিণী হয়া ৷
সতত কহয়ে গৃহের চাতুর্য দিল গৃহল্লাস কয়া ৷৷
কেলি মধু মঞ্জরির কথা কহিতে কতেক জানি ৷
শ্রীমতীর কাছে সতত থাকয়ে সখির উল্লাস বাণি ৷৷
চণ্ডীদাস কহে নরোঢ়া কহিল কহিয়ে উৎকণ্ঠা রস ৷
শুনিতে শ্রবণে হেন লয় মনে যাহাতে সকল বস ৷৷
মোক্ষ (মুখ্য) সখী ললিতা ১ মঞ্জরি ৭ এবং ৮ ৷৷ রস ভোলা ৷৷ এইরূপে প্রধানা অষ্ট সখীর সম্বন্ধেই বর্ণনা ছিল ৷ বিশাখা সখীর বর্ণনা অসম্পূর্ণ ৷ তাহার পর পাতা পাওয়া যায় নাই ৷ কবি ললিতাকে নবোঢ়া রসের ও বিশাখাকে উৎকণ্ঠিতা রসে উৎপত্তি-হেতু বলিয়াছেন ৷
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ‘দীন চণ্ডীদাসের পাদবলী’ ১ম খণ্ডের ভূমিকায় সম্পাদক মহাশয় লিখিয়াছেন — “চণ্ডীদাসের পাদবলী সম্বন্ধে বিরাটভ্রান্ত ধারণা সাধারণে প্রচলিত আছে ৷” ‘পদকল্পতরু’র ভূমিকায় ৺সতীশচন্দ্র রায় মহাশয় দীন চণ্ডীদাস সম্বন্ধে লিখিয়াছেন— “ইহার মত তৃতীয় শ্রেণীর একজন কবির দ্বারা চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস ভণিতার উৎকৃষ্ট পদাবলী রচিত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব ৷ একান্তই যদি দীন চণ্ডীদাসের পদাবলী গ্রন্থ মধ্যে স্থান দিতে হয়, তাহা হইলে পরিশিষ্টে দেওয়া কর্তব্য ৷ এ ধারণা সম্পূর্ণই ভ্রান্তিমূলক ৷” কিন্তু পদাবলী -সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত স্বর্গত সতীশচন্দ্র রায় মহাশয় পদকল্পতরুর সুবিস্তৃত ভূমিকায় মাত্র উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত মন্তব্য লিখিয়াইি বক্তব্য শেষ করেন নাই ৷ তিনি দৃঢ়তার সহিত লিখিয়াছেন— “…তাঁহার (বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত দীন চণ্ডীদাস-পদাবলী সম্পাদকের) লেখার অনবধানতা হেতু মনে হয় যেন তিনি দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস অভিন্ন পদকর্তা বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন ৷ ঐরূপ তাঁহার সিদ্ধান্ত হইলে উহাতে পূর্বোক্ত হেত্বাভাস ঘটে এবং ঐ মন্তব্য পদাবলীর আলোচনার দ্বারাও সমর্থিত হয় না ৷ কেননা চণ্ডীদাসের উৎকৃষ্ট পদাবলীর মধ্যে দ্বিজ চণ্ডীদাসের বহু পদ পাওয়া যায় ৷ …দীন চণ্ডীদাসের ভণিতার পদে যখন লিপিকরদিগের ভ্রম-প্রমাদ মানিতে সম্মত নহেন, তখন দ্বিজ চণ্ডীদাসের এই পদগুলিতেই কি জন্য লিপিকরদিগের ভূল বলা যাইবে ৷ আমাদিগের বিবেচনায় কৃষ্ণকীর্তনের প্রবল শক্তিশালী কিন্তু পদাবলীর উন্নত আধ্যাত্মিকতার লেশশূন্য কবি চণ্ডীদাস বরং কোন অচিন্তনীয় সাধনার বলে পদাবলীর শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক কবি চণ্ডীদাসে পরিণত হইলওে হইতে পারেন, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের পক্ষে উহা সম্পূর্ণ অসম্ভব বটে ৷ সুতরাং আমরা দ্বিজ চণ্ডীাস ভণিতার উৎকৃষ্ট পদগুলিকে বরং বড়ু চণ্ডীদাসের বলিয়াও মানিতে রাজি আছি, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসকে কিছুতেই দ্বিজ চণ্ডীদাস বলিয়া মানিতে পারি না ৷”
‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম ‘ এই পদ যাঁহার রচিত, অথবা বিরহের এবং আক্ষেপানুরাগের উৎকৃষ্ট পদগুলি যিনি রচনা করিয়াছেন, নিম্নের পদটী তাঁহার রচিত বলিলে কবি-প্রতিভার সম্মান রক্ষা হয় কিনা সুধীগণ তাহা বিবেচনা করিবেন ৷ এই পদটীও বিরহের পদ এবং দীন চণ্ডীদাসের উৎকৃষ্ট রচনাবলীর অন্যতম ৷
আর কবে পুন শ্রীমুখমণ্ডল পরশ করিব হেন ৷
শ্রীমুখমণ্ডলে কর্পূর তাম্বুল কবে তুলি দিব পুন ৷৷
শ্রীঅঙ্গে শীতল পাখার বাতাসে তুষিব পিয়ার মন ৷
দু বাহু পসারি নিজ কোরে করি এ দশা করয়ে কোন ৷৷
যদি সুফল সুদিন থাকয়ে এবে সে কুদিন দশা ৷
কোলের মাণিক রাখিতে নারল হইল সুদিন ভাসা ৷৷
মনে ছিল সাধ লইয়া সে পিয়া করব আনন্দ কেলি ৷
কোথা হতে আল’ অক্রূর মুরতি ক্রূর সে হৃদয় তার ৷
তেঞি তার পিতা মাতা সে বুঝিয়া এ নাম রাখিল যার ৷৷
হিয়া ভেদি ছেদি কাড়িয়া লইয়া চলিলা মথুরাপুর ৷
চণ্ডীদাস বলে সো হরি মিলব হব মনোরথ পুর ৷৷
তাবের দৈন্য, প্রকাশের আড়ষ্ট ভক্তি, দুর্বল ছন্দ এবং অধম মিল একজন তৃতীয় শ্রেণীর কবির কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়৷ মাথুর বিরহের পদের যদি এইরূপ দুর্দশ হয়, তবে আর অন্য পদে কৃতিত্বের আশা কোথায় ?

৮৮৯ পদে—এবে কহি শুন পরকীয়া সুখ স্বকীয়া থাকুক দূরে ৷
পরকীয়া সনে রস আস্বাদন কহিতে মরম সরে ৷৷
এই বলিয়া কবি ভ্রমর-সংবাদ রাধার কৃষ্ণনাম শ্রবণ, রূপ শ্রবণ, চিত্র দর্শন, কুটীলা তিরস্কার, পূর্বরাগ আদি বর্ণনা করিয়াছেন ৷ কিন্তু ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ পদটী এখানে নাই, পুঁথির অন্যত্রও নাই ৷ এই পদ দীন চণ্ডীদাসের রচিত হইলে এই স্থানেই লিখিত থাকিত ৷ কারণ কবি এই স্থানেই কৃষ্ণনাম শ্রবণের প্রসঙ্গ তুলিয়াছেন ৷ শ্রীরাধার রূপ বর্ণনের পদ চণ্ডীদাস ভণিতায় কয়েকটিই পাওয়া যায় ৷ এই পুঁথিতে তাহাদের একটিও নাই ৷
দীনের কবিতা পড়িয়া মনে হয় বিষয়বস্তু-সম্বন্ধে কবির কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না ৷ যদিই বা মনের মধ্যে কোন কিছু কল্পনা করিতেন,তাহাও প্রকাশের সামর্থ্য ছিল না ৷ গতানুগতিকতা রক্ষা করিতে গিয়া নিরর্থক বাজে বকিয়া পুঁথির কলেবর বাড়াইয়াছেন ৷
যাঁহারা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘প্রথম প্রহর নিশি’ পদটী পড়িয়াছেন এবং জ্ঞানদাসের সুপ্রসিদ্ধ “মনের মরম কথা তোমারে কহিয়ে হেথা শুন শুন মরমের সই” পদটী অবগত আছেন, তাঁহারা চণ্ডীদাসের নিম্নলিখিত পদটি পড়িয়া কৌতুক অনুভব করিবেন ৷
শুন লো মরম সখি তোরা ৷
নিশি অবশেষ কালে ঘুমে অচেতন ভালে স্বপনে দেখিল চিত চোরা ৷৷
একে নব ঘনশ্যাম পীতবাস অনুপাম বান্ধে চূড়া নানা ফুল দিয়া ৷
হাসিয়া নাগর বায় আসিয়া বৈঠল ঠায় দুটী করে কর আরোপিয়া ৷৷
একে হাম বিরহিনী কহেন একটী বাণী কোপে দিল কর ছাড়াইয়া ৷
পুনরপি করে ধরি সেই না রসিক হরি বসাইল যতন করিয়া ৷৷
সুতান চতুর ধরি মোহে নিজ কোরে করি আলিঙ্গন বেরি আচম্বিতে ৷
দারুণ কোকিলনাদ মনে না পুরিল সাধ বুঝিলাম হইল প্রভাতে ৷৷
যেমন সতিনী প্রায় ঘন ডাকে উভরায় মনে না পুরল মন আশা ৷
ননদিনী পাপমতি জানিবা দেখয়ে কতি হেন বুঝি নিশি ভেল উষা ৷৷
তুরিতে নাগর রাজ রাখিয়া নূপুর সাজ বড় দুখ রহল মরমে ৷
হেনক সময় কালে ভাঙ্গি ঘুম অবহেলে মিলি আঁখি দূরে গেল ঘুমে ৷৷
নিশির স্বপন এই দেখিল মরম সই পিয়া না পানু বঞ্চিতে ৷
চণ্ডীদাস কহে ধনী মেলিব নাগরমণি হেন বুঝি আসিব তুরিতে৷৷

মঙ্গলকাব্যের কবিদের মত এই কবিও এক ‘ছত্রিশ অক্ষরের করুণা’ লিখিয়াছেন ৷ এমন নিকৃষ্ট রচনা মঙ্গলকাব্যের মধ্যেও আছে কি না সন্দেহ ৷ ছত্রিশ অক্ষরের মধ্যে একটা অক্ষর তুলিয়া দিলাম ৷
টলবল করে টলটল দেহে টেরা সে বিষম বাঁশি ৷
টানিলে না টলে বুকে টেরা হয়ে হৃদয়ে রহিল পশি ৷৷
টাটক হইয়া সুধামুখী ধনী টেরা সে নয়নে চেয়া ৷
টারিয়া যাইবে তটস্থ ধনী টুটিল বিরহ দিয়া ৷৷
টানাটানি করে টেরেতে লইয়া মরিতে টাকর দিয়া ৷
টান টোন করি টাকাই তা সনে টের দূর দিকে রয়া ৷৷
টিপ টাপ করে টেটালির পারা টিকাদিনী পারা রাধা ৷
টল টল করে অবলা পরাণ সকল করিল বাধা ৷৷
টাটক হইয়া টানিয়া রাখিব আপনার নিজ পতি ৷
টেরেতে থাকিয়া টেটকারি দিয়া অক্রূর সে মহামতি ৷৷
চণ্ডীদাস কহে টাটক হইয়া টারল গোকুলনাথ ৷
টিপানে জানিল টেরা হয়ে নাথ ছাড়ব গোপীর সাথ ৷৷
মথুরায় শ্রীমতীকে স্মরণ হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ বকুলতলায় বসিয়া মুরলীধ্বনি করিয়াছেন এবং মথুরা-নাগরীগণ আসিয়া উপস্থিত হইয়োছেন ৷ মুরলী তাঁহাদের মনোহরণ করিয়াছে ৷ কাঁখে কনক গাগরি লইয়া জল ভরিবার ছলে বকুলতলে আসিয়া তাঁহারা বিতর্ক করিতেছেন, এ কি নবজলধর না অন্য কিছু ? কেহ বলিলেন, মেঘ হইলে বৃষ্টি হইত, আমরা সিঞ্চিত হইতাম
ইত্যাদি ৷ পবন দূত, ভ্রমর দূর ইত্যাদিও আছে, কিন্তু কোথাও কবিত্বের সম্বন্ধ নাই ৷ এই কবির একটি উৎকৃষ্ট রচনা তুলিয়া দিতেছি, অনুকরণ করিতে গিয়াও কবির অক্ষমতা ধরা পড়িয়াছে ৷ এই পদটিই বোধ হয় দীন চণ্ডীদাসের সর্বোৎকৃষ্ট পদ ৷ তথাপি “ওপারে বঁধুর ঘর বৈসে গুণনিধি ৷ পাখী হঞা উড়ি যাও পাখা না দেয় বিধি ৷৷” এই পদের সঙ্গে কিংবা — “ধিক্ বহু জীবনে পরাধিনী যেহ ৷ তাহার অধিক ধিক্‌ পরবশ নেহ ৷৷” প্রভৃতি পদের সঙ্গে ইহার তুলনাই হয় না ৷ আমরা একবড় প্রকাণ্ড পুঁথিখানায় দ্বিজ বা বড়ু ভণিতার আক্ষেপানুরাগ বা বিরহের উৎকৃষ্ট পদগুলির একটীও পাইলাম না ৷ আমাদের নির্বাচিত পদটি এই —
আর কি পুছসি বারে বার
সে নব নাগর বিনে সব সুখ দূরে গেল দেখি যেন সকলি আন্ধার ৷৷
যমুনা কদম্বতলা দেখিতে পরাণ ফাটে
শূন্য যেন কদম্ব কানন ৷
ঘর হইল বনবাস বিষের পুকুরে থাকি
হেনক লইছে মোর মন ৷৷
দারুণ শ্বাশুড়ি শুনে বঞ্চিতে না পারি ঘরে
কান্দিতে নারিয়ে কোন ছলে ৷
বিষম ননদী তায় আহুতি ভেজায়া দিয়া
সদা রাধা কান্দে কার তরে ৷৷
শুইলে সোয়াস্ত্য নাই ক্ষুধা দূরে গেল গো
কি মোর কহিস মন জ্বালা ৷
মুরলী বদন বিনে তিলেক না জিব আমি
কালা সে হিয়ার জপ মালা ৷৷
কে জানে এমন হব পরিণামে পরাভব
তবে কি করিব নব লেহা ৷
ভাবিতে গণিতে মোর পাঁজর হইল সারা
নিদান তেজিতে হইল দেহা ৷৷
মথুরা নগরে রহে তিলাঞ্জলি দিয়া তাহে
সে বড় কঠিন শ্যাম রায় ৷
হেনক করিয়ে সাধ পাখী হৈয়া উড়ি যাও
দীন চণ্ডীদাস পুন গায় ৷৷
পুঁথিখানির আদি অন্ত খণ্ডিত বলিয়া কবিরা কোন পরিচয় পাওয়া গেল না ৷ কবি যে শ্রীপাদ রূপ গোস্বামীর পরবর্তী একথা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি ৷ পুঁথিখানি আলোচনা করিয়া কাব্যের বিষয়বস্তু , রচনারীতি ও আখ্যানমালা দেখিয়া কবির বয়স বেশী বলিয়া মনে হয় না ৷ এখন হইতে কম-বেশী তিন শত বৎসরের মধ্যেই দীন চণ্ডীদাসের আবির্ভাব ও তিরোভাব স্বীকার করিতে হয়৷ আচার্য নরোত্তম ঠাকুর মহাশয়ের একজন শিষ্য ছিলেন — নাম চণ্ডীদাস ৷ ইঁহার নরোত্তম-বন্দনার পদেও পাওয়া গিয়াছে ৷ মহাভারতের সুপ্রসিদ্ধ কবি কাশীরাম দাসের এক পিতৃব্য ছিলেন — নাম চণ্ডীদাস ৷ কাশীরাম, গদাধর ও কৃষ্ণদাস ইঁহারা তিন ভ্রাতাই কবি ছিলেন৷ এই দেববংশ বৈষ্ণব ছিলেন, অন্ততঃ বৈষ্ণব-ধর্মের এবং — শ্রীমান্‌ মহাপ্রভুর অনুরক্ত ছিলেন, এইরূপই মনে হয় ৷ এই বংশের চণ্ডীদাস যদি রাধাকৃষ্ণ-লীলাত্মক এক সুবৃহৎ কাব্যই রচনা করিয়া থাকেন, দেববংশের এইরূপ অধ্যবসায়, উদ্যম ও ধৈর্য স্বাভাবিক ধরিয়া লইয়া তাহা অসম্ভব বলিয়া মনে হয় না ৷ আমি দীন চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত কোন কোন পদে পুরানো পুঁথিতে দেব চণ্ডীদাস ভণিতাও দেখিয়াছি ৷ আলোচ্য পুঁথির একটি পদে ‘নরহরি’ নাম পাইতেছি ৷ দীন চণ্ডীদাস কি শ্রীখণ্ডের শাখাভুক্ত ছিলেন? এ-সম্বন্ধে আরো অনুসন্ধান আবশ্যক ৷ নরহরি উল্লেখযুক্ত পদটি এইরূপ –
চান্দনী রাতি চন্দনে ভরা অঙ্গ ৷ গোপ নাগরী করে বেশ তরঙ্গ ৷৷
বেশ বিভূষণ আভরণ ভার ৷ নানা রঙ্গ তরঙ্গ অনিবার ৷৷
গোপ নাগরী যত বেশ বনায় ৷ রাধা মাঝে রূপ কহনে না যায় ৷৷
নানা আভরণ কৌতুক কেলি ৷ মুরলী নিশান দেয়ত বনমালী ৷৷
শুনত শ্রবণে সঙ্কেত বোল ৷ তব ধনী রমণী অথির ভেল ভোর ৷৷
কোই হেরু গুরু দুরুজন পথ ৷ ধাধসে নরহরি ভেল অনরথ ৷৷
প্রতিজন ঘুমল জানল কাজ ৷ সাজল কুঞ্জ নিকেতন মাঝ ৷৷
চলল রমণীগণ রাইক মেল ৷ রস পরসঙ্গে সভেই চলি গেল ৷
ঐছনে হরষে চলল বরনারী ৷ চান্দনী রাতি চলতহি ভোরি ৷৷
গমন নব নব করু বরনারী ৷ চণ্ডীদাস রস কহ তাহে ভোরি ৷৷