পদাবলী প্রধানতঃ রাধাকৃষ্ণের লীলা অবলম্বন করিয়াই রচিত৷ কিন্তু প্রেমের অবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন নদীয়ায় আবির্ভূত হইলেন তখন হইতে গৌরলীলা সম্বন্ধে পদাবলী রচিত হইতে লাগিল৷ শ্রীকৃষ্ণভজন পূর্ব হইতেই প্রচলিত ছিল কিন্তু শ্রীচৈতন্য তাঁহার প্রেমধর্মে এই কৃষ্ণলীলার স্থান দিলেন সর্বোপরি৷ তাঁহার জীবনের ভাববিহ্বল আদর্শে বহু কবি অনুপ্রাণিত হইলেন এবং গৌরাঙ্গের লীলা অবলম্বনে পদ রচনা করিয়া বঙ্গের গীতিকবিতার ভাণ্ডার পূর্ণ করিলেন৷ গৌরাঙ্গ সম্বন্ধীয় পদগুলিকে বলে গৌরচন্দ্রিকা৷ কীর্তনে গৌরচন্দ্রিকা গান করিয়া তবে রাধাকৃষ্ণলীলা গান করিতে হয়৷ কৃষ্ণের অবতার বলিয়া গৌরচন্দ্রের প্রতি কৃষ্ণলীলার অনেকগুলি ভাবই সহজে আরোপিত হয়৷ তিনি যেভাবে লীলা আস্বাদন করিতেন, ভক্ত বৈষ্ণবেরা সেইভাবে লীলা আস্বাদন করিতে চেষ্টা করেন৷ ইহার একটি উদ্দেশ্য এই যে, শ্রীকৃষ্ণের গূঢ় রস-নিষ্ণাত লীলা আস্বাদন করিবার অধিকার সকলের নাই৷ বৈষ্ণব মনে করেন যে, মহাপ্রভুর চরিত্রের মধ্য দিয়াই কৃষ্ণলীলা আস্বাদন করিবার যোগ্যতা-লাভ হয়—
গৌরাঙ্গ গুণেতে ঝুরে নিত্যলীলা তারে স্ফুরে
সে জন ভজন অধিকারী৷
– ঠাকুর নরোত্তমদাস
বস্তুতঃ শ্রীচৈতন্যের চরিত্র অতি নির্মল, অতি গভীর৷ সেইজন্য তাঁহার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই চৈতন্য-চরিত লিখিবার জন্য ভক্তগণের মধ্যে অপূর্ব উন্মাদনা দেখা দিল৷ তাহার ফলে চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যচন্দ্রোদয়, চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃ্তি বহু গ্রন্থ রচিত হইল৷ এখনও শ্রীচৈতন্যের নামে বৈষ্ণবদের মধ্যে যে ভাবপ্রবণতা দেখা যায় পৃথিবিরা আর কোনও ধর্মসংস্কারক মহাপুরুষের নামে সেরূপ হয় কিনা সন্দেহ৷
সুতরাং ‘পদাবলী’ বলিতে আমরা রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক ও গৌরাঙ্গ (এবং তাঁরার ভক্তগণ) সম্বন্ধে রচিত গানই বুঝিয়া থাকি৷