যতদূর জানা যায় তাহাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত কীর্তনের যথেষ্ট উন্নতি ছিল৷ তাহার পর ‘কবি’ ও পাঁচালির প্রাদুর্ভাবে কীর্তনের জনপ্রিয়তার হ্রাস হইতে থাকে ৷ উৎসাহ ব্যতীত, উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে, কোনও ললিতকলাই প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারে না৷ ইংরেজ বিজয়ের পরে দেশে পরিস্থিতির উদ্‌ভব হইল, তাহাতে বঙ্গদেশের বিশিষ্ট সম্পদ এই কীর্তনগানের সমাদর কমিতে আরম্ভ হইল৷ রাধামোহন ঠাকুরের পদামৃতসমুদ্র অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে সংকলিত হয় এবং ইহার কিছু পরেই বৈষ্ণবদাস তাঁহার সুবিখ্যাত ও সুবৃহৎ পদকল্পতরু সংকলন করেন৷ ইহার পরেও কীর্তনের প্রভাব কতকদিন চলিয়াছি বলিয়া বোধ হয়৷ সম্ভবতঃ ঊনবিংশ শতাব্দী হইতেই কীর্তনের অবনতি ঘটিতে লাগিল। এইসময় হইতে বাংলাদেশে ‘কবির গানে’র ধুম পড়িয়া যায়৷ কবির গানে দুই দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইত এবং শ্রোতৃমণ্ডলীর দ্বারা জয় পরাজয় নির্ণীত হইত৷ রাধাকৃষ্ণের লীলা অবলম্বন করিয়া গান বাঁধিয়া কবিওয়ালারা ‘পাল্লা’ দিতেন এবং তাহা সাধারণ জনগণ জাতিধর্মনির্বিশেষে উপভোগ করিত৷ এই সময়ে যাত্রা ও পাঁচালিরও প্রসার ঘটে৷ এইসকল সংগীত বা তথাকথিত সংগীতের প্রতি জনসাধারণের পক্ষপাত যেমন বাড়িতে লাগিল, তেমনি কীর্তনের আভিজাত্য খর্ব হইয়া গেল৷
ঢপকীর্তন : তবে কীর্তন ‘ভাঙিয়া’ ঢপের সৃষ্টি হইল৷ ‘ঢপ’ শব্দের ব্যুৎপত্তি জানা যায় না৷ মধুসূদন কান নামক একজন গায়ক ইহার স্রষ্টা না হইলেও যথেষ্ট পরিপুষ্টি সাধন করিয়াছিলেন৷ মধুকান বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং নিজ প্রতিভাগুণে বাংলার প্রায় সর্বত্র সুপ্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন৷ মধুকান নিজ পরিবারস্থ স্ত্রীপুরুষগণ লইয়া গান করিতেন এবং নানা রাগরাগিণী সমন্বিত গীতের দ্বারা লোকের মনোরঞ্জন করিতেন৷ রাধাকৃষ্ণের লীলা অবলম্বন করিয়া মধুসূদন বহু পদ রচনা করিয়াছিলেন এবং কীর্তন-পদাবলীর অনুকরণে প্রত্যেক পদের শেষে নিজের নামের ভণিতা যোগ করিতেন৷ সমগ্র নাম না দিয়া তিনি অনেক সময় ‘সূদন’ ভণিতা দিতেই ভালবাসিতেন৷ ইহা লইয়া একজন মধুকানকে একটু ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘মধু , তুমি সূদন ভণিতা দাও কেন?’ ইহার উত্তরে মধু বিনয় করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘নামে মধু থাকিলেই কি আর না থাকিলেই কি? গানে মধু থাকিলেই হইল৷’ এইগল্পের অন্য সংস্করণে আছে, মধু বলিলেন, ‘আপনারা মধু যোগ করিয়া লইবেন৷’ যাহা হউক, মধুসূদনের ঢপকীর্তন একসময়ে খুব খ্যাতিলাভ করিয়াছিল৷ ঢপে বৈঠকী রাগরাগিণী যথাযথভাবে অনুকৃত হইত৷ সুরের বিশিষ্ট ভঙ্গীতেই ইহার বৈশিষ্ট্য ছিল৷ রামপ্রসাদেরও যেমন একটি বিশিষ্ট সুরের ভঙ্গী ছিল যাহার জন্য রামপ্রসাদী গান বৈঠকী রীতি অনুসরণ করিলেও স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়াছে, মধুকানের ঢপ সুরও তেমনি একটি বিশিষ্ট সুর৷ ইহাতে কীর্তনেরও ছায়া বেশ সুপরিস্ফুট থাকিত৷ গানের মাঝে মাঝে সুরে কথা কহিবার রীতি ছিল, যেমন ‘কৃষ্ণ কহিতেছেন’ ‘শ্রীমতী কহিতেছেন’ ইত্যাদি৷
আধুনিক কালে এক শ্রেণীর কীর্তন শুনিতে পাওয়া যায়, যাহা সাধারণতঃ ‘ঢপকীর্তন’ নামে অভিহিত হয়৷ কিছুদিন পূর্বেও এই ঢপকীর্তন গায়িকাদের মুখেই সচরাচর শুনা যাইত৷ গত কয়েক বৎসর দেখিতেছি এই কীর্তনওয়ালীদের আর তেমন পসার নাই৷ বাংলাদেশের স্থানে স্থানে বিশেষতঃ কলিকাতা শহরে কীর্তন শ্রাদ্ধের একটি অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হয়৷ অর্থাৎ হিন্দুদের আদ্যশ্রাদ্ধ-বাসরে নিমন্ত্রিতদের জন্য সভা হয় এবং এই সভায় কীর্তনের ব্যবস্থা থাকে৷ ইহাকে বলে সভারোহণ৷ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত অধ্যাপকদের সমাগম ও কীর্তনগান এই সভারোহণের বিশিষ্ট অঙ্গ৷ নিমন্ত্রিতেরা এই শ্রাদ্ধসভায় যোগদান করেন৷ এইরূপ বহুসভায় কীর্তনওয়ালীদের গান শুনিতে পাওয়া যাইত৷ বিগত পঁচিশ ত্রিশ বৎসরের মধ্যে এই শ্রেণীর গায়িকাদের প্রভাব অনেক কমিয়া গিয়াছে৷ প্রথাটি ঠিকই আছে, তবে মেয়েদের স্থলে পুরুষদেরই কীর্তনের চলন হইয়াছে৷ কীর্তনগায়িকাদের মধ্যে পান্নাময়ী এক সময়ে খুব নাম করিয়াছিলেন৷ এখনও গ্রামোফোনে তাঁর গান বোধ হয় শুনিতে পাওয়া যায়৷
পুরুষ কীর্তনিয়ার সমাদর বৃদ্ধি হওয়ায় উচ্চাঙ্গ কীর্তনের পুনরভ্যুদয় কিছু কিছু ঘটিতেছে৷ এক সময়ে রসিকদাস, প্রেমদাস প্রভৃতি কীর্তনে প্রভূত প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছিলেন৷ রসিকের রসবোধ ছিল অসাধারণ৷ কি ভাবে গান করিলে লোকের মনোরঞ্জন করা যায়, তাহা তিনি বুঝিতেন৷ তাঁহার কণ্ঠও ছিল অতি মধুর৷ স্বীয় প্রতিভাগুণে তিনি বৈষ্ণবসমাজে বিখ্যাত গায়ক বলিয়া সর্বত্র সম্মানিত হইতেন৷ তিনি কীর্তনে ‘কাটাধড়া’ নামক তালের স্রষ্টা৷ সকলেই জানেন কীর্তনে করুণরসের প্রাধান্য৷ সেইজন্য পুত্রশোকাকুলা জননীর ক্রন্দনের সুর ও ছন্দ অবলম্বন করিয়া তিনি ঐ তালের উদ্‌ভাবন করেন৷ এক্ষণে মনোহরসাহী কীর্তনে অনেক গায়কের মুখে কাটাধড়ার গান শুনিতে পাওয়া যায়৷ প্রাচীনকাল হইতে ‘ধড়া’ একটি সুপরিচিত তাল ছিল৷ ধ্রুব তাল বা ধড়ার অনেকটা অনুরূপ বলিয়া রসিকদাস তাঁহার নূতন তালের নামকরণ ‘কাটাধড়া’৷ প্রেমদাসের কণ্ঠও ছিল অতি অপূর্ব৷ সেরূপ কণ্ঠ এখন আর বড় শুনিতে পাওয়া যায় না৷ ইঁহাদেরই সম সময়ে গণেশদাস অতি মিষ্ট গান করিতেন৷ বৎসরকয়েক পূর্বে তিনি দেহ রক্ষা করিয়াছেন৷ জীবিত গায়কদের মধ্যে কাহারও নাম বাদ দিয়া কাহারও নাম করিলে অবিচার করা হইবে৷ তবে ইঁহাদের মধ্যে একজনের নাম বোধহয় অসংকোচে করা যাইতে পারে : রামকমল ভট্টাচার্য— পাবনার অধিবাসী৷
তিনি প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে কলিকাতায় আসিয়া কীর্তনগানে শহর মাতাইয়াছিলেন৷ তাঁহার এরূপ অপূর্ব শক্তি যে,কখনও কখনও দশ হাজার লোক মন্ত্রমুগ্ধবৎ তাঁহার কীর্তন শুনিয়াছে৷ কীর্তনগানের এরূপ লোকসমাগম বোধহয় আর কখনও দেখা যায় নাই৷ তাহার বিশেষ একটি কারণ বোধ হয় এই যে তিনি নাচিয়া গাহিয়া কথকতার পুর দিয়া কীর্তন প্রচার করিয়াছেন যাহাতে সর্বসাধারণে কীর্তন মর্ম সহজে বুঝিতে পারে৷ তাঁহার গানে আধ্যাত্মিক ভাবের প্রাধান্য থাকিত বলিয়া অনেক অভিজ্ঞ শ্রোতা তাঁহার পদ্ধতি অনুমোদন করিতেন না৷ তাহা হইলেও এরূপ জনপ্রিয় কীর্তনসংগীত রামকমলের পূর্বে আর কখনও শোনা যায় নাই৷
যাঁহারা কীর্তনের প্রাচীন প্রথা সংরক্ষণে প্রয়াসী,তাঁহারা কোনও প্রকার অভিবনত্ব পছন্দ করেন না৷ প্রাচীনপন্থী গায়কদের মধ্যে অদ্বৈতদাস পণ্ডিতবাবাজি সমধিক খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন৷ যৌবনে সংসার ত্যাগ করিয়া তিনি বৃন্দাবন গমন করেন এবং তথায় ভক্তিশাস্ত্র-অধ্যয়নে ও কীর্তনশিক্ষায় মনোযোগ দেন৷ কীর্তন-শিক্ষা ব্যপদেশে তিনি বাংলায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন৷ এই সময়ে তিনি পাঁচথুপীর ‘চন্দ্রজি’ (কৃষ্ণচন্দ্র চন্দ্র) ও শ্রীখণ্ডের ঠাকুর এবং ময়নাডালের মিত্রঠাকুরগণের নিকট অক্লান্ত অধ্যবসায়ের সহিত কীর্তন শিক্ষা করেন৷ পাঁচথুপী, ময়নাডাল, শ্রীখণ্ড, নবদ্বীপ এবং এইরূপ আরও দুই-একটি স্থান এখনও কীর্তনগানের জন্য বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ হইয়া আছে৷