যমুনা কিনারে

কাহ্নাঞিঁক দেখি যত গোপ গোপীগণে

কাহ্নাঞিঁক দেখি যত গোপ গোপীগণে।
হরিয়েঁ হিয়লা তবেঁ সজল নয়নে।।
কেহো দৃঢ় ভুজযুগেঁ কৈল আলিঙ্গন।
কেহো ঘন ঘন তার চুম্বিল বদন।।
হরষিত ভৈল সব যুবতীসমাজে।
কালীয় সাপের মুখে জিলা দেবরাজে।।ধ্রু।।
ততিখনে যশোদার দেব দামোদরে।
তনে হৈতেঁ ঝরিআঁ পড়িল ক্ষীর ধারে।।
বুইল দশ দিশ শূন্য ভৈল মোরে।
চিরকাল জীউ পুত্র মোর গদাধরে।।
নেহেঁ তবেঁ আকুলী রাধিকা ততিখনে।
নিমেষেরহিত বঙ্ক সরস নয়নে।।
দেখিল কাহ্নের মুখ সুচির সমএ।
সকল লোকের মাঝেঁ তেজি লাজ ভএ।।
কাহাঞিঁ দেখিআঁ আর যত গোপীগণে।
সহ্মে আলিঙ্গন কৈল আপণ আপণে।।
হাসছলেঁ কৈল মন হরিষ বিকাশে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে।।

অন্তঃকথন:
এই পদটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কালীয়দমনখন্ডের খন্ডের পদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ঐশ্বর্য ভাব প্রদর্শন করে জলে নেমেছেন দুর্দান্ত কালীয় নাগকে দমন করতে। আমরা জানি যিনি জগতের ত্রাতা তাঁর কাছে কালীয় দমন তো তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজ! কিন্তু বৃন্দাবনবাসী? তাঁদের তো কৃষ্ণ প্রাণস্বরূপ ! তাঁরা তাই চিন্তায় আকূল ! কি হবে? আমাদের কানাইয়ের কি হবে? উদবেগে , ভাবনায় অস্থির সেই বৃন্দাবনের মানুষের সামনে কৃষ্ণ যখন উঠে এলেন কালীয় নাগকে দমন করে, তখন আর তাঁরা নিজেদের ধরে রাখতে পারলেন না। এতক্ষণের অবরুদ্ধ আবেগ ছড়িয়ে পড়ল নানা রূপে। কৃষ্ণপ্রীতির সেই নানা প্রকাশ কেই প্রকাশিত করেছে এই গান। সাক্ষাৎ কালস্বরূপ কালীয় নাগকে দমন করে কৃষ্ণ যখন উঠে এলেন জল থেকে তখন গোপগোপী গণ অর্থাৎ কৃষ্ণের সখাসখীগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কেউ বা তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরছেন, কেউ বা তাঁকে ঘন ঘন চুম্বনে সিক্ত করছেন। কালীয় নাগের বিষ থেকে বেঁচে ফিরেছেন কানাই এই আনন্দে মশগুল সকল গোপযুবতীবৃন্দ। লীলাময়ের একি লীলা! যিনি জন্ম মৃত্যুর অতীত তাঁকে জীবন্ত ফিরে পেয়ে হরষিত বৃন্দাবন বাসী। অবতারত্বের এই তো মহিমা, তিনি আমাদের ঘরের লোক হয়ে ওঠেন, আমরা ভুলে যাই তাঁর স্বরূপ, তাঁকে মানুষ রূপে পেয়েই আমাদের আহ্লাদ! পুত্রকে ফিরে পেয়ে এমনি আহ্লাদে মাতা যোশদা স্তন হতে পুত্রস্নেহে দুগ্ধধারা আপনিই ঝরে পড়তে লাগল। মাতা বলছেন গোপাল ছাড়া আমার দশদিক শূণ্য, পুত্র আমার চিরকাল বেঁচে থাকুক! বাৎসল্যরসের কি মধুর ছবি আঁকছেন কবি। তবে এখানেই শেষ নয়। সখ্য, বাৎসল্য পেরিয়ে একই পদে কবি পৌঁছে যাচ্ছেন মধুরে! শ্রীরাধিকা, তিনিও তো এতক্ষণ অধীর প্রতীক্ষায় ছিলেন, উদবেগে আকুল। কৃষ্ণকে ফিরে পেয়ে তিনি ভুলে গেলেন লোকলজ্জা, নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলেন কানুর মুখপানে। যে রাধা কৃষ্ণের পাঠানো তাম্বুলে লাথি মেরেছিলেন, তিনিই আজ সর্বসমক্ষে লাজভয় ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে আকূল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। প্রেমের এই ছবি চিরকালীন। এখানেই রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাল ছাপিয়ে, ভক্তি ছাপিয়ে সর্বকালের সর্বমানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। গানে শেষ ছবিটি বড় সুন্দর, কানুকে ফিরে পেয়ে গোপীগণ শুধু যে কানুকেই জড়িয়ে ধরছেন তাই নন আনন্দে তাঁরা নিজেদের মধ্যেও কোলাকুলি করছেন, আনন্দের এমন রূপ আঁকতে পারেন তিনিই যিনি মানব মনের খবর রাখেন। একই পদের মধ্যে সখ্য, বাৎসল্য,মধুরের এমন সফল প্রকাশ আমাদের বিস্মিত করে !

পদকর্তা:বড়ু চন্ডীদাস
রাগ:গুজ্জরী
তাল:যতি
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী