যমুনা কিনারে

জমুনক তিরে তিরে সাঁকড়ি বাটী

জমুনক তিরে তিরে সাঁকড়ি বাটী।
উবটি ন ভেলিহু সঙ্গ পরিপাটী।।
তরুতল ভেটল তরুন কহ্নাই।
নয়ন তরঙ্গে জনি গেলিহু সনাই।।
কে পাতিয়াএত নগর ভরলা।
দেখইতে সুনইতে হৃদয় হরলা।।
পলটি ন হেরল গুরুজন লাজে।
বচন চুকিলিহু সখিহ্নি সমাজে।।
এতদিন অছলিহু অপনে গেয়ানে।
আবে মোরা মরম লাগল পচবানে।।
নিঠুর সখী বিসবাস ন দেই।
পরক বেদন পর বাটি ন লেই।।
ভনই বিদ্যাপতি এহু রসভানে।
রাএ সিবসিংহ লখিমা দেই পরমানে।

অন্তঃকথন:
শ্রীমতী যমুনার পথে বনমালীকে দেখেছেন। আর সেই দর্শনেই বনমালী শ্রীমতীর হৃদয় হরণ করেছেন। কায়মনোবাক্যে প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন শ্রীমতী। আর প্রেমের ধর্মই এই যে সে গোপন থাকে না! শ্রীমতী এখন পূর্বরাগের রসোদ্গীরণ করছেন। শ্রীমতী বলছেন যমুনার তীরে তীরে সঙ্কীর্ণ পথ, সেই পথে যেতে যেতে তাকে দেখলাম। এমনই আঁকাবাঁকা পথ যে একবার দেখে আর ভালো করে ফিরে দেখতে পেলাম না! তরুতলে তরুণ কানাইকে যে সেই একবার দেখলাম, সেই একবার যে চোখে চোখ মিললো, নয়ন তরঙ্গে সে যেন আমায় স্নান করিয়ে গেল। আমার সর্ব অঙ্গে যেন সেই দৃষ্টির স্পর্শ! আমার এ দশা কে বিশ্বাস করবে যে জনাকীর্ণ নগরে, অত লোকের চোখের সামনে ক্ষণকালের দর্শনে সে আমার হৃদয় হরণ করে নিলো! গুরুজনদের সামনে লজ্জায় আমি আর ফিরে তাকাতে পারলাম না। কিন্তু এমন দশা হল আমার যে সখীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারে বারে ভুল হয়ে গেল, এক কথা বলতে আর এক কথা বলে ফেললাম! এতদিন আমি নিজের জ্ঞানে ছিলাম, আমার মনের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল, আর এখন কানাইয়ের দর্শনে মর্মে আমার পঞ্চবাণ এসে লাগলো, আর আমার মন আমার বশে রইলো না, অনঙ্গ এসে আমায় বশ করলেন! সখীদের এসে এ কথা বললাম, কিন্তু নিঠুর সখীর দল আমার কথা বিশ্বাস করে না! আমার মনোবেদনার ভাগ কেউ নিলো না! এমনই হয়, পরের বেদনা কেউ ভাগ করে নেয় না। আমার প্রেমবেদনায় আমিই জ্বলে মরছি কেবল! এত বলে বিদ্যাপতি ভণিতা করছেন যে এই প্রেমরসের স্বাদ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন কেবল রাজা শিবসিংহ আর রানী লছিমা! তাঁরাই কেবল প্রকৃত রসিক। এই ভণিতায় রাজসভার কবির রাজবন্দনার কর্তব্যটুকুও সুচারু ভাবে সম্পন্ন করলেন কবি! আর বাকি পদে নিজের সবটুকু কবিত্ব ঢেলে নারী হৃদয়ের প্রেমের আকূলতাকে ভাষা দিলেন বিদ্যাপতি ! প্রথম দর্শন জনিত পূর্বরাগের যে উন্মাদনা, যে বিচলন তার আশ্চর্য প্রকাশ এই পদটি!

পদকর্তা:বিদ্যাপতি
রাগ:অজ্ঞাত
তাল:অজ্ঞাত
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী