যমুনা কিনারে

বুঝিআঁ গোপীর মনে

বুঝিআঁ গোপীর মনে।
আল।
খণেক গুণিল কাহ্নে।
ষোল সহস্র গোপী তোষিবোঁ কেমনে।।
অনেক হয়িআঁ তখনে।
বিলসিল গোপীগণে।
যাহারে রমএ সেসি দেখে কাহ্নে।।
আল।
সব গোপীজন জাণে।
মোএঁ সে পায়িলোঁ এ বনে শ্রীমধুসূদনে।।ধ্রু।।
ফুটিল কুসুম পুঞ্জে।
সরস ভ্রমর গুঞ্জে।
এক এক নারি লআঁ এক এক কুঞ্জে।।
চির মনোরথ পুরি।
রসময় মন করী।
বৃন্দাবন মাঝে রতি ভূঞ্জিল মুরারী।।
একেঁ একেঁ গোপীজনে।
সহ্মে জাণিল আপণে।
রাধাতে আধিক কাহ্ন মণে।।
কাহ্নাঞিঁ তাহাক জাণী।
কিছু না বুয়িল বাণী।
রাধা চন্দ্রাবলী মনে কৈল চক্রপাণী।।
সংহরী সকল দেহে।
গোপী এড়ি কুঞ্জগেহে।
বিকল গোবিন্দ মুরারী রাধার নেহে।।
গেলা রাধিকার পাশে।
সুরতি রসের আশে।
গাইল বড়ু চণ্ডীদাসে।

অন্তঃকথন:
এই গানটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলার পদ।ভাগবৎপুরাণেই প্রথম কৃষ্ণের রাসলীলার বর্ননা আমরা পাই। প্রভু এক হতে অনেক হয়ে সকল গোপীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করছেন আবার তারই মাঝে একমেবদ্বিতীয়ম রাধার কথা তাঁর মনে পড়ছে এবং তিনি বহুরূপ সংবরণ করে একের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। শ্রীকৃষ্ণের এই মহোত্তম লীলার কথা প্রায় সকল বৈষ্ণব পদকর্তাই নানা ভাবে বর্ননা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বৃন্দাবন খন্ডের এই গানে বড়ু চন্ডীদাস সেই রাসলীলা কে তাঁর মত করে বর্ননা করেছেন। বৃন্দাবন খন্ডে রাধারানীর সঙ্গে তাঁর ষোল সহস্র সখী বৃন্দাবনে প্রবেশ করে বনের শোভা দেখে মোহিত হয়ে পড়লেন। তাঁরা প্রত্যেকেই মদনমোহন শ্রীহরিকে আপনার পাশে কামনা করলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের মনের ভাব বুঝতে পেরে ক্ষণকাল চিন্তা করলেন যে এই ষোল সহস্র গোপীকে কেমন করে তুষ্ট করবেন ! অতঃপর,তিনি এক থেকে বহু রূপ ধারণ করে সকল গোপীর সঙ্গেই কেলি বিলাস করলেন। অথচ কেউই তাঁর বহুমূর্তি ধারণের রহস্য বুঝতে প্রলেন না। তিনি যাঁর সঙ্গে রমণ করেন সেই ভাবে কানাই কেবল আমার সঙ্গেই রয়েছেন। সকল গোপীগণ প্রত্যেকেই জানল এই বৃন্দাবনে আজ আমিই কেবল মধুসূদনকে পেলাম। এক এক কুঞ্জে এক এক রমনীকে নিয়ে, চিরকালের মনের সাধ মিটিয়ে মন রসময় করে মুরারি বৃন্দাবনে রতিবিলাস করলেন। কিন্তু একে একে সকল গোপীই বুঝতে পারল যে শ্রীমাধব আসলে মনে মনে রাধার প্রতিই অধিক প্রীতি অনুভব করেন, তিনি আসলে শ্রীমতিকেই চাইছেন। শ্রীকৃষ্ণও সেকথা বুঝতে পারলেন। তখন কোন কথা না বলে চক্রপাণি চন্দ্রাবলী রাধাকেই মনে করলেন। মুরারি তখন সকল দেহ সংবরণ করে পুনরায় এক হয়ে কুঞ্জগৃহে গোপীগণ কে পরিত্যাগ করে রাধার প্রেমে বিহ্বল হলে পড়লেন এবং সুরতি রসের আশায় এক রাধারানীর পাশেই গেলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতে বলছেন, 'পরকীয়া ভাবে অতি রসের উল্লাস', সকল প্রেমের শ্রেষ্ঠ সেই পরকীয়ার সর্বোত্তম প্রকাশ যদি রাধার প্রেমে হয় তবে সেই পরকীয়ার সর্বাধিক প্রকাশ এই রাসলীলায়। যখন ভগবান একই সঙ্গে বহু হয়ে বহু গোপীর সঙ্গে বিহার করছেন। আবার এই রাসের মাহাত্ম্য এই যেই এই বহুর প্রেমেও মন ভরে না যদি মন সত্যিকারের প্রেমে মজে থাকে। তখন সকল গোপীকে তুচ্ছ করে মদনমোহন সেই রাধিকার কাছেই কাছেই যান। এখানেই রাধার প্রেমের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে প্রেম এমনই যে ষোল সহস্র গোপীনীর প্রেমেও তার তুলনা পাওয়া যায় না। এই এক রাসলীলায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমতত্ত্বের প্রায় সবটুকুই লুক্কায়িত থাকে। রসিকে সে রসের সন্ধান পায়।

পদকর্তা:বড়ু চন্ডীদাস
রাগ:কেদার
তাল:ক্রীড়া
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী