যমুনা কিনারে

কেশপাশে শোভে তার সুরঙ্গ সিন্দুর

কেশপাশে শোভে তার সুরঙ্গ সিন্দুর।
সজল জলদে যেহ্ন ঊইল নব সুর।।
কনককমলরুচি বিমল বদনে।
দেখি লাজে গেলা চান্দ দুঈ লাখ যোজনে।।
মুনি-মনমোহিনী রমণী আনুপামা।
পদুমিনী আহ্মার নাতিনী রাধানামা।।ধ্রু।।
ললিত আলকপাঁতিকাঁতি দেখি লাজে।
তমালকলিকাকুল রহে বনমাঝে।।
আলস লোচন দেখি কাজলে উজল।
জলে পসি তপ করে নীল উতপল।।
কণ্ঠদেশ দেখিআঁ শঙ্খত ভৈল লাজে।
সত্বরে পসিলা সাগরের জল মাঝে।।
কুচযুগ দেখি তার আতি মনোহরে।
আভিমান পাআঁ পাকা দাড়িম্ব বিদরে।।
মাঝা খিনী গুরুতর বিপুল নিতম্বে।
মত্ত রাজহংস জিণী চলএ বিলম্বে।।
দিনে দিনে রাঢ়ে তার নহুলী যৌবন।
গাইল বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীগণ।।

অন্তঃকথন:
এ গানটি তাম্বুলখন্ডের গান। শ্রীরাধিকা চলেছিলেন দধি দুগ্ধ বেচতে মথুরায়, সঙ্গে ছিলেন বড়াই। পথে বড়াই হারিয়ে ফেললেন তাঁকে। আবার তাঁকে খুঁজতে গিয়ে মাঝ বৃন্দাবনে বড়াই ফেললেন পথ হারিয়ে। শ্রীরাধিকাকে হারিয়ে, পথ হারিয়ে আকূল বড়াই আচম্বিতে দেখতে পান শ্রীকৃষ্ণকে। বড়াই তাঁকেই অনুনয় করেন পথ দেখাতে, খুঁজে দিতে নাতনি রাধাকে। কৃষ্ণ তখন বলেন কেমন দেখতে তোমার নাতনীকে সে কথা বিস্তারে বল। কৃষ্ণের এই কথা শুনে বড়াই বর্ননা করতে বসেছেন শ্রীরাধিকার রূপ। এ গানটি বড়াইয়ের মুখে কৃষ্ণের সমুখে শ্রীরাধার রূপবর্ননাগান। রাধা আইহনের পত্নী। প্রথমেই তাই বড়াই বলছেন শ্রীমতীর কালোচুলের সিঁথি সুড়ঙ্গের মাঝে জ্বলজ্বল করছে সুরঙ্গ অর্থাৎসু- রাঙা সিঁদুর। কিন্তু শুধু এই বললেই তো হয় না। কালো কেশে রাঙা সিঁদুরের সে শোভা কেমন? যেন মনে হয় কালো মেঘের মাঝে নব সূর্য উদিত হচ্ছেন! আসলে কালো মেঘের কথা বলে বড়াই কি ইঙ্গিতে কালো কানুর কথাই বলতে চাইলেন? বলতে চাইলেন যে কৃষ্ণ কালোর পাশে রাঙা রাধিকার শোভা অপরূপ হবে? তা সে বড়াইয়ের মনের কথা বড়াই জানেন আর জানেন বড়ু চন্ডীদাস! যাইহোক এরপর বড়াই একে একে তাঁর অতুল রূপের ব্যাখ্যা করছেন। বলছেন,রাধার মুখের দ্যুতি, দ্যুতিমান চন্দ্রকেও লজ্জিত করেছে। চন্দ্র তাই লজ্জায় দুই লক্ষ যোজন দূরে প্রস্থান করেছেন। এমন তাঁর রূপ যে মুনির মনও মোহপ্রাপ্ত হয়। তাঁর অলকাবলীর ললিত কান্তি দেখে অমন যে তমাল কলিকা সেও কিনা অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে। নীলউৎপল সাগর জলের মাঝে গিয়ে তপস্যামগ্ন। কেন? না রাধার কাজলশোভিত অলস নয়নের শোভা সে সইতে পারেনি! শুভ্র,রেখাঙ্কিত শঙ্খ সেও কিনা রাধার কণ্ঠদেশের শোভা দেখে লজ্জায় সমুদ্রের মাঝে গিয়ে লুকিয়েছে। আর পক্ক দাড়িম্ব তো শ্রীমতীর পয়োধরযুগল দেখে, লাজে-অভিমানে বিদীর্ণই হয়ে গেল! সুন্দরীর কটিদেশ ক্ষীণ অথচ নিতম্ব গুরুভার, তাই তাঁর গতি মত্ত রাজহংস অপেক্ষাও সুন্দর। এতদূর বলে বড়াই ছুঁড়লেন তাঁর মোক্ষম তীর, এমন মুনি মনোহারিনীর সৌন্দর্য এখনেই শেষ নয়। এতো সবে শুরু।দিনে দিনে তাঁর নবযৌবন যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে! অর্থাৎ , কৃষ্ণ জেনে রাখো সে আরও রূপবতী হবে। এই রূপকীর্তন শুনেই জগতের নাথ উন্মাদ হয়ে পড়লেন শ্রীরাধিকাকে পাওয়ার জন্য। এই পদটিই এ কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগের কারণ।

পদকর্তা:বড়ু চন্ডীদাস
রাগ:গুজ্জরী
তাল:রূপক
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী