যমুনা কিনারে

চন্দনচর্চ্চিতনীলকলেবর পীতবসনবনমালী

চন্দনচর্চ্চিতনীলকলেবর পীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডযুগস্মিতশালী।।
হরিরিহ মুগ্ধবধূনিকরে।
বিলাসিনি বিলসতি কেলিপরে।।ধ্রু।।
পীনপয়োধরভারভরেণ হরিং পরিবভ্য সরাগম্।
গোপবধূরনুগায়তি কাচিদুদঞ্চিতপঞ্চমরাগম।।
কাপি বিলাসবিলোলবিলোচনখেলনজনিতমনোজম্।
ধ্যায়তি মুগ্ধবধূরধিকং মদুসূদনবদনসরোজম্।।
কাপি কপোলতলে মিলিতা লপিতুং কিমপি শ্রুতিমূলে।
চারু চুচুম্ব নিতম্ববতী দয়িতং পুলকৈরনুকূলে।।
কেলিকলাকুতুকেন চ কাচিদমুং যমুনাজলকূলে।
মঞ্জুলবঞ্জুল্কুঞ্জগতং বিচকর্ষ করেণ দুকূলে।।
করতলতালতরলবলয়াবলিকলিতকলস্বনবংশে।
রাসরসে সহনৃত্যপরা হরিণা যুবতিঃ প্রশশংসে।।
শ্লিষ্যতি কামপি চুম্বতি কামপি কামপি রময়তি রামাম্।
পশ্যতি সম্মিতচারু পরামপরামনুগচ্ছতি বামাম্।।
শ্রীজয়দেবভণিতমিদমদ্ভুতকেশরকেলিরহস্যম্।
বৃন্দাবনবিপিনে ললিতং বিতনোতু শুভানি যশস্যম্।।

অন্তঃকথন:
এই গান জয়দেব বিরচিত 'শ্রীগীতগোবিন্দের' প্রথম সর্গ 'সামোদ-দামোদরঃ' এর অন্তর্গত। বৃন্দাবনে বসন্ত সমাগত। প্রকৃতির বাসন্তী হিল্লোল বৃন্দাবনবাসীকে উন্মনা করে তুলেছে। মদনবেদনে আকুলা শ্রীরাধিকা বৃন্দাবনের নিভৃত কুঞ্জে কুঞ্জে কৃষ্ণের সন্ধান করে ফিরছেন। এমন সময় সখীরা এসে শ্রীমতিকে সংবাদ দিলেন যে, এ মধুবসন্তে শ্রীহরি ব্রজবধূদের সঙ্গে সানন্দে নৃত্য-বিহার করছেন। এই কথা শুনে মানিনীর মান যখন বেড়ে উঠছে তখন সখীরা শ্রীরাধিকাকে মাধবের সেই মধুর বিহারের অনুপুঙ্খ বর্ননা দিয়ে তাঁকে আরো উচাটন করে তুলছেন। সখীরা দূর থেকে শ্রীহরিকে দেখিয়ে রাধিকাকে বলছেন, দেখো সখী বনমালী আজ অপূর্ব সজ্জায় সেজেছেন। তাঁর শ্যাম অঙ্গ শ্বেত চন্দনে অনুলিপ্ত, পীত বসন তাঁর পরনে। তিনি ক্রীড়া মত্ত হওয়ায়, তাঁর কর্ণের মনিময় কুণ্ডল দোদুল্যমান, আর তাঁর ঈষৎ হাস্যোজ্জ্বল গালে সেই কর্ণভূষণের ছায়া পড়েছে। আহা কি তার শোভা! এমন অপরূপ সাজে তোমার মনোহরণ শ্রীহরি এখন বিলাস মত্তা ব্রজ বধূদের নিয়ে কেলিবিলাসে মগ্ন। কেমন সেই বিলাস? সখী, দেখো দেখো,কোন ব্রজাঙ্গনা মাধবকে আলিঙ্গন করে তাঁর সঙ্গে পঞ্চমস্বরে সুর মিলিয়েছেন। ওই যে আর একজন শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্মের ধ্যানে মগ্ন। তাঁর হরিধ্যানিমগ্না বিলাসবিলোল কটাক্ষে মধুসূদনের মন মদনমদে উল্লসিত হয়ে উঠছে। ওমা শুধু মাধবকে আলিঙ্গন করেই খান্ত নয়, গুরু নিতম্বিনী এক ছলনাময়ী আবার কানে কানে গোপন প্রণয়বাক্য বলবার ছল করে মাধবের কপোলতলে কর্ণমূলে অধর স্পর্শ করছেন। তাঁর স্পর্শে মাধব পুলকিত হয়ে উঠলেন যে। দেখো সখী প্রশ্রয় পেয়ে সেই নারী কেমন মধুর চুম্বনে বনমালীকে সিক্ত করে তুলছেন। একজন কূলকামিনী তো কেলিকলাকৌতুকে শ্রীকৃষ্ণের উত্তরীয় প্রান্ত ধরে তাঁকে যমুনার তীরবর্তী বেতসকুঞ্জের দিকে আকর্ষণ করছেন। আর এক মোহিনী যুবতী কৃষ্ণের বংশীধ্বনির সঙ্গে করতালি দিয়ে তাল রক্ষা করছেন। আর সেইকারণে তার হাতের বলয়গুলি থেকে মৃদু শিঞ্জন শোনা যাচ্ছে। শ্রীহরিও রাসরসে নৃত্যপরা সেই সহচারিনীর প্রভূত প্রশংসা করছেন। কেলিবিলাসরত শ্রীহরি কাউকে আলিঙ্গন করছেন,কাউকে চুম্বন করছেন, কারো সঙ্গে রমণ করছেন, কারো দিকে সস্মিত কটাক্ষ নিক্ষেপ করছেন আবার কারো বা মানভঞ্জনের জন্য তাঁর অনুগমন করছেন। এইভাবে মাধবের প্রেমবিলাসের সবিস্তার বর্ননা করে সখীরা শ্রীমতির মনকে ঈর্ষাজ্বালায় জর্জরিত করে তুললেন। রাধা-কৃষ্ণের দিব্য প্রেমলীলা মানিনীর ঈর্ষাযুক্ত হয়ে আরো ঘনীভূত হয়ে উঠবে গীতগোবিন্দের পরবর্তী সর্গগুলিতে। বৃন্দাবনে কেশবের মধুরলীলারসযুক্ত এই সঙ্গীত শ্রবণে সকলের যেন মঙ্গল হয়,সেই আশা নিয়েই জয়দেব এই গান রচনা করেছেন।

পদকর্তা:জয়দেব
রাগ:রামকিরী
তাল:যতি
সংকলন:দেবহূতি সরকার

পদ: চন্দন চর্চিত
বিবরণ: চন্দন চর্চিত
আলেখ্য: হরে কৃষ্ণ মন্দির, পুনে
গায়ক: দিলীপ কুমার রায়
অবদান: অনির্বাণ ভাদুড়ী

সন্ধিনী