‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
শ্রীঅদ্বৈত-প্রেমাধাম—ভজ,–নিতাই গৌর রাধে শ্যাম
গদাই-শ্রীবাস-প্রাণারাণ—ভজ,–নিতাই গৌর রাধে শ্যাম
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
‘‘জয় জয় কৃপাসিন্ধু জয় গৌরচন্দ্র।’’
কৃপাসিন্ধু-গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
কৃপা-পারাবর-গোরার—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
জয় জয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য-ন্যাসিরাজ।
জয় জয় চৈতন্যের ভকত-সমাজ।।’’
ভক্তসনে প্রাণগৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
মধুর-নীলাচল চাড়ি—চলিয়াছেন গৌরহরি
বৃন্দাবন যাবার ছল করি—চলিয়াথেন গৌরহরি
মথুরায় চলিলেন ভক্তগোষ্টী লইয়া।।’’
ব্রজে যাবার মনোরথে—চলিলেন নিজভক্ত-সঙ্গে
ভাগ্যবতী সুরধুনীতীর—এ যে,–পদাঙ্কিত ভূমি রে
আমার,–প্রাণের প্রাণ গৌরহরির—এ যে,–পদাঙ্কিত ভূমি রে
এই,–ভাগ্যবতী সুরধুনীর—তীরে তীরে চলিলেন প্রভু
স্নান-পানে গঙ্গার পূরিল মনোরথ।।’’
যমুনার,–তীরে নীরে যুগলবিহার দেখে—গঙ্গার ক্ষোভ ছিল মনে
জড়াজড়ি তীরে বিহরিছে—আজ,–সেই ক্ষোভ মিটাইছে।
ব্রাহ্মণ সমাজ, তার ‘রামকেলি’ নাম।।
দিন চার পাঁচ প্রবু সেই পুণ্যস্থানে।
আসিযা রহিলা যেন কেহো নাহি জানে।।
সূর্য্যের উদয় কি কখনো গোপ্য হয়।
সর্ব্বলোক শুনিলেন চৈতন্য বিজয়।।
সর্ব্বলোক দেখিতে আইসে হর্ষ-মনে।
স্ত্রী-বালক-বৃদ্ধ-আদি-সজ্জন-দুর্জ্জনে।।’’
কমল বিকাশ হলে পরে—ডাকতে হয় না ভ্রমরেরে
মধুপানে মুগ্ধ হয়ে—ভ্রমর ত আপনি আসে
জানি গৌর-আগমন—আইলেন রূপ-সনাতন
বাদশার দত্ত,–দবিরখাস শাকর মল্লিক—তখন ত নাম ছিল তাদের
প্রাণপ্রিয় রূপ-সনাতন—মিলিলেন প্রভু নিজজনে
গঙ্গাতীরে রামকেলি গ্রামে—এসেছেন তাদেরই আকর্ষণে
প্রেমাবতার গোরার—রামকেলিতে অদ্ভুত বিহার
প্রেমভক্তি বিনু আর নাহি কোন রঙ্গ।।
হুঙ্কার গর্জ্জন কম্প পুলক ক্রন্দন।
নিরন্তর আছাড় পড়য়ে ঘনেঘন।।’,
ভাবনিধি প্রাণ-গৌরাঙ্গের—ও ত আছাড় খাওয়া নয় রে
ভাগ্যবতী রামকেলি ভূমির–সৌভাগ্য বাড়ায় রে
প্রাণনাথ বিশ্বম্ভরে—ভাগ্যবতী ধরণী বুকে ধরে
তিলার্দ্ধেক প্রভুর নাহি অন্য কর্ম্ম।
নিরন্তর লওয়ায়েন সঙ্কীর্ত্তন ধর্ম্ম।’’
সঙ্কীর্ত্তন পিতা গৌরহরি—নাহি থাকে নাম-কীর্ত্তন ছাড়ি
রামকেলি গ্রামে গোরারায়—বিহরে নিজ সঙ্কীর্ত্তন-লীলায়
দেখিয়া কাহারো চিত্ত না লয় যাইতে।।
আপনার প্রাণ জগতে—কে না ভালবাসে
দেখি’ মূর্ত্ত প্রাণ গৌরাঙ্গের—কে না ভাল বাসবে তবে
একবার যে হেরে গোরারে—কেউ ঘরে যেতে নারে
যবনেও বলে হরি অন্যের কি দায়।।
যবনেও দূরে থাকি করে নমস্কার।
হেন গৌরচন্দ্রের কারুণ্য অবতার।।
যে হুসেন-সাহা সর্ব্ব উড়িষ্যার দেশে।
দেবমূর্ত্তি ভাঙ্গিলেক দেউল বিশেষে।।
হেন যবনেও মানিলেক গৌরচন্দ্র।
তথাপিও এবে না মানয়ে যত অন্ধ।।
বোল বোল হরিবোল হরিবোল বলি।
এই মাত্র বলে প্রভু দুই বাহু তুলি।।
চতুর্দ্দিকে মহানন্দ কোটি কোটি লোক।
তালি দিয়া হরি বলে পরম কৌতুক।।’’
প্রাণের গৌরহরি হেরি—সবাই বলে হরি হরি
রামকেলি ভাসায়ে নাম-প্রেমে—চলেছিলেন ব্রজের পথে
রামকে হতে নিজগণ-সাথে—চলেছিলেন ব্রজের পথে
মথুরা যাবার সঙ্কল্প ছেড়ে—ফিরিলেন,–কানাই-নাটশালা হতে
বহুলোক সংঘট্ট ভয়ে—ফিরিলেন,–কানাই-নাটশালা হতে
বহুলোক সংহতি—ব্রজে যাবার নয় ত রীতি
ব্রজে যাবার এই ত বিধান—একা কিবা সঙ্গে একজন
পুনঃ আইলেন রামকেলি গ্রামে
রামকেলিতে বসতিকালে
একদিন ডাকি গোপনে
রূপ সনাতন দুইজনে—একদিন ডাকি গোপনে
যাও যাও ত্বরা করি
উদ্ধার কর লুপ্ত-ব্রজপুরী—যাও যাও ত্বরা করি
পড়ি প্রাণ গৌর-চরণে—ব্যাকুল হয়ে কাঁদের দুজনে
ঐ,–হরিবোলা রসের বদন—কতদিনে পাব দরশনে
গৌরহরি তাদের প্রেমভরে—বাহু পসারি ধরলেন বুকে
লুপ্ত-ব্রজ উদ্ধারে—শকতি সঞ্চার কৈলেন
লুপ্ত-ব্রজ প্রকাশিতে—ব্রজে যাবার আজ্ঞা দিয়ে
ডাকিলেন দুই বাহু তুলি
সঙ্কীর্ত্তন-ভাবাবেশে—ডাকিলেন দুই বাহু তুলি
খেতুরী গ্রামের পানে চেয়ে—ডাকিলেন দুই বাহু তুলি
নরু নরু বলে সঘনে—ডাকিলেন দুই বাহু তুলি
ভাসি দুটি নয়ন-জলে—ডাকিলেন দুই বাহু তুলি
প্রভু আকর্ষিছেন তারে
কোন প্রিয়জন আছে এদিকে–প্রভু আকর্ষিছেন তারে
নিজ,–গুপ্ত-কার্য্য সাধন তরে—প্রভু আকর্ষিছেন তারে
প্রভু নরোত্তম আকর্ষিয়ে—রামকেলিহতে আসবার কালে
গঙ্গাতীর পথ ধরে—রামকেলি হতে আসবার কালে
রাখিলেন নিজ-প্রেমধন
ভাগ্যবতী পদ্মাবতীর কাছে—রাখিলেন নিজ-প্রেমধন
প্রভু করেছে তারে আকর্ষণ
রামকেলি হতে পূর্ব্বে—প্রভু করেছে তারে আকর্ষণ
অভিন্ন শ্রীনিত্যানন্দ—নিশ্চয় আসবে নরোত্তম
তার নিজ-প্রেমের মুরতি—নিশ্চয় আসবে নরোত্তম
ভাগ্যবতী পদ্মাবতীর কাছে—তাই রাখিলেন নিজ-প্রেমধন
নরোত্তমে করিবারে সমর্পণ—তাই রাখিলেন নিজ-প্রেমধন
রাখ অতি যতন করে
নিজ-প্রেম দিলাম তোমারে—রাখ অতি যতন করে
তোমা অবগাহনে—আমার,–নরু এলে দিও তারে
প্রেমতলীঘাট বলে—অদ্যাপিও খ্যাতি আছে
‘প্রেমলীঘাট বলে’—
পদ্মাবতী-তীরে—প্রেমতলীঘাট বলে
আজও,–সেই লীলার সাক্ষী দিছে
অতি প্রাচীন সেই তমাল তরু—আজও,–সেই লীলার সাক্ষী দিছে
অতি প্রাচীন সেই তমাল তরু
আজও সেই লীলার সাক্ষী দিছে
প্রেম রাখি পদ্মাবতী ঠাঁই
চলিলেন চৈতন্য গোসাঞি চলিলেন
কীর্ত্তন-নটন-রঙ্গে
প্রেমাবেশে গঙ্গাতীরে—চলিলেন কীর্ত্তন-নটন-রঙ্গে
কতদিনে আইলেন অদ্বৈত-মন্দিরে।।’’
শান্তিপুর-নাথের-ঘরে—প্রাণগৌর আইলা শান্তিপুরে
আবিষ্ট হইয়া আছে ছাড়ি সর্ব্বকার্য্য।।
হেনই সময়ে গৌরচন্দ্র ভগবান।
অদ্বৈতের গৃহে আসি হৈল অধিষ্ঠান।।’’
নিজ পুত্রের মুখে—গৌর-মহিমা শুনে ছিল বিভোর
হেন কালে গৌরকিশোর—গৌর-মহিমা শুনে ছিল বিভোর
যে বড় অদ্ভুত-কথা কহি শুন রঙ্গে।।
যোগ্য পুত্র অদ্বৈতের সেই সে উচিত।
শ্রীঅচ্যুতানন্দ নাম জগতে বিদিত।।
দৈবে একদিন এক উত্তম সন্ন্যাসী।
অদ্বৈত-আচার্য্য-স্থানে মিলিলেন আসি।।
অদ্বৈত দেখিয়া ন্যাসী সঙ্কোচে রহিলা।।
অদ্বৈত ন্যাসীরে নমস্করি বসাইলা।।
অদ্বৈত বোলেন ‘‘ভিক্ষা করহ গোসাঞি।’’
ন্যাসী বোলে ‘‘ভিক্ষা দেহ’’ আমি যাহা চাই।।
‘‘কিছু মোর জিজ্ঞাসা আছয়ে তোমা-স্থানে
সেই ভিক্ষা মোর তাহা কহিবা আপনে।।
আচার্য্য বোলেন ‘‘আগে করহ ভোজন।
শেষে যে জিজ্ঞাসা তাহা কহিব কথন।।’’
ন্যাসী বোলে ‘‘আগে আছে জিজ্ঞাসা আমার।’’
আচার্য্য বোলেন ‘‘বোল যে ইচ্ছা তোমার।।
সন্ন্যাসী বোলেন ‘‘এই কেশব ভারতী।
চৈতন্যের কে হয়েন ? কহ মোর প্রতি।।’’
মনে মনে চিন্তে অদ্বৈত মহাশয়।
‘‘ব্যবহার পরমার্থ—দুই পক্ষ হয়।।
যদ্যপিহ ঈশ্বরের মাতা-পিতা নাই।
তথাপিহ ‘দেবকীনন্দন’ করি গাই।।
পরমার্থে গুরুও তাঁহার কেহো নাই।
তথাপি যে করে প্রভু তাই সভে গাই।।
প্রথমেই পরমার্থ কি কার্য্য কহিয়া।
ব্যবহার কহিয়াই যাই প্রবোধিয়া।।’’
এত ভাবি বলিলেন অদ্বৈত মহাশয়।
‘‘কেশব ভারতী চৈতন্যের গুরু হয়।।
দেখিতেছ গুরু তান কেশব ভারতী।
আর কেনে তবে জিজ্ঞাসহ আমা প্রতি।।’’
এইমাত্র অদ্বৈত বলিতে সেই ক্ষণে।
ধাইয়া অচ্যুতানন্দ আইলা সেই স্থানে।।
পঞ্চ-বর্ষ বয়স—মধুর দিগম্বর।
খেলা-খেলি সর্ব্ব অঙ্গ ধূলায় ধূসর।।
অভিন্ন কার্ত্তিক যেন সর্ব্বাঙ্গ-সুন্দর।
সর্ব্বজ্ঞ পরমভক্ত সর্ব্ব শক্তিধর।।
‘চৈতন্যের গুরু আছে’ বচন শুনিয়া।
ক্রোধাবেশে কহে কিছু হাসিয়া হাসিয়া।।
‘কি বলিলা বাপ ! বোল দেখি আর বার।
‘চৈতন্যের গুরু আছে, বিচার তোমার।।
‘‘কোন বা সাহসে তুমি এমত বচন।
জিহ্বায় আনিলা ইহা না বুঝি কারণ।।
তোমার জিহ্বায় যদি এমত আইল।
হেন বুঝি—এখনে সে কলিকাল হৈল।।
অথবা চৈতন্যমায়া পরম দুস্তর।
যাহাতে পায়েন মোহ ব্রহ্মাদিশঙ্কর।।
বুঝিলাঙ—বিষ্ণুমায়া হইল তোমারে।
কেবা চৈতন্যের মায়া তরিবারে পারে।।
‘চৈতন্যের গুরু আছে’ বলিলা যখনে।
মায়াবশ বিনে ইহা কহিলা কেমনে।।
যাহা হইতে হয় আসি জ্ঞানের প্রচার।
তান গুরু কেমতে বোলহ আছে আর।’’
তার গুরু ভারতী কোন শাস্ত্রে নাই।।
বাপ ! তুমি তোমা হৈতে শিখিবাঙ কোথা।
শিক্ষা গুরু হই কেনে বোলহ অন্যথা।।
এত বলি শ্রীঅচ্যুতানন্দ মৌন হৈলা।
শুনিয়া অদ্বৈত পরামানন্দে প্রবেশিলা।।
বাপ ! বাপ ! বলি ধরি’ করিলেন কোলে।
সিঞ্চিলিন অচ্যুতের অঙ্গ প্রেমানন্দজলে।।’’
প্রাণপ্রিয়,–অচ্যুতেরে করি কোলে—সীতানাথ ভাসে প্রেমজলে
‘প্রাণপ্রিয়,–অচ্যুতেরে করি’ কোলে’—
আইস আমার বাপ বলে—প্রাণপ্রিয়,–অচ্যুতেরে করি’ কোলে
তুমি আমার জনক বলে—প্রাণপ্রিয়,–অচ্যুতেরে করি কোলে
শিখাইতে পত্ররূপে হইলে উদয়।।’’
চৈতন্য-তত্ত্ব জানাবার তরে—আইলা অচ্যুত-রূপ ধরে
আর না বলিমু এই কহিনু তোমারে।।’’
আবেশে বলেন সীতানাথ
আর যতমত সব যাক্ ছারখার।।’’
‘‘আত্মস্তুতি শুনি শ্রীঅচ্যুত মহাশয়।
লজ্জায় রহিলা প্রভু মাথা না তোলয়।।
শুনিয়া সন্ন্যাসী শ্রীঅচ্যুত-বচন।
দণ্ডবৎ হইয়া পড়িলা সেইক্ষণ।।
ন্যাসী বোলে যোগ্য যোগ্য অদ্বৈতনন্দন।
যেন পিতা তেন পুত্র অচিন্ত্য-কখন।।’’
এ ত ঈশ্বরের শক্তি বিনে অন্য নহে।
বালকের মুখে কি এমন কথা হয়ে।।
শুভলগ্নে আইলাঙ অদ্বৈত দেখিতে।
অদ্ভুত মহিমা দেখিলাঙ নয়নেতে।’’
পুত্রের সহিতে অদ্বৈতেরে নমস্করি।
পূর্ণ হই ন্যাসী চলিলেন বলি ‘হরি’।।’’
দেখি’ অদ্বৈত পূর্ণকাম—সন্ন্যাসী লয় হরিনাম
যে চৈতন্য-পাদপদ্মে একান্ত শরণ।।
অদ্বৈতেরে ভজে গৌরচন্দ্রে করে হেলা।
পুত্র হউ অদ্বৈতের তভু তিঁহ গেলা।।
পুত্রের মহিমা দেখি অদ্বৈত আচার্য্য।
পুত্র কোলে করি’ কাঁদে ছাড়ি সর্ব্বকার্য্য।।’’
চৈতন্য-পার্ষদ জন্মিল মোর ঘরে—আমি ধন্য হলাম বলে
পুত্রের অঙ্গের ধূলা আপনার অঙ্গে।
লেপেন অদ্বৈত অতি পরমানন্দ রঙ্গে।।
‘‘চৈতন্যের পার্ষদ জন্মিল মোর ঘরে।’’
এত বলি’ নাচে প্রভু তালি দিয়া করে।।’’
অদ্বৈত পুত্রে করি’ কোলে—হেলে দুলে নাচে প্রেমভরে
চৈতন্য-পার্ষদ জন্মিল বলে—হেলে দুলে নাচে প্রেমভরে
ত্রিভুবনে যাহার ভক্তির সম নাঞি।।
পুত্রের মহিমা দেখি’ অদ্বৈত বিহ্বল।
হেন কালে উপসন্ন সর্ব্ব-সুমঙ্গল।।
সপার্ষদে শ্রীগৌর সুন্দর সেইক্ষণে।
আসি’ আবির্ভাব হৈলা অদ্বৈত-ভবনে।।’’
যাঁর মহিমা শুনি’ ছিল মুগ্ধ—আইলা সে শচীসুত
গৌরহরি অদ্বৈত-ভবনে—আইলা নিজগণ-সনে
দণ্ডবৎ হৈয়া পড়িলেন পৃথিবীত।।
‘হরি’ বলি’ শ্রীঅদ্বৈত করেন হুঙ্কার।’’
পরাণনাথ পাইনু বলে—অদ্বৈত নাচে প্রেমভরে
জয়জয়কার ধ্বনি করে নারীগণে।’’
গৌর আমার অদ্বৈত-ঘরে—সবে জয়জয়কার করে
গৌররসের বদন হেরে—নারীগণের উলুধ্বনি করে
নয়ন তাদের,–কুলুকুলু ধারে বেয়ে পড়ে—নারীগণে উলুধ্বনি করে
অদ্বৈত-গৃহে প্রেম-পারাবার—বয়ে যায় প্রেমের পাথার
প্রেমহুঙ্কারে আমার আসন নাড়ালে –আইস আমার নাড়া বলে
সীতানাথে করি কোলে—গৌর বাসে নয়ন-জলে
রোদন করেন অতি বাহ্য কিছু নাঞি।।’’
আরে আমার প্রভু বলে—সীতানাথ ভাসে নয়ন-জলে
কি অদ্ভুত প্রেম হৈল না যায় বর্ণন।।
স্থির হই ক্ষণেকে অদ্বৈত মহাশয়।
বসিতে আসন দিলা করিয়া বিনয়।।
বসিলেন মহাপ্রভু উত্তম-আসনে।
চতুর্দ্দিকে শোভা করে পারিষদগণে।।
নিত্যানন্দ-অদ্বৈতে হইল কোলাকুলী।
দুঁহা দেখি অন্তরে দোঁহেই কুতুহলী।।’’
শ্রীচৈতন্য-কল্পতরুর—আজ,–দুইবাহু জড়াজড়ি
শ্রীনিত্যানন্দ-শ্রীঅদ্বৈ—আজ,–দুইবাহু জড়াজড়ি
আচার্য্য সভারে কৈল প্রেম-আলিঙ্গন।।
যে আনন্দ উপজিল অদ্বৈতের ঘরে।
বেদব্যাস বিনে তাহা বর্ণিতে কে পারে।।’’
অদ্বৈত-গৃহে গোরারায়—আনন্দের পাথার বয়ে যায়
প্রভুর চরণে আসি হৈলা নমস্কার।।
অচ্যুতেরে কোলে করি শ্রীগৌরসুন্দর।
প্রেমজলে ধুইলেন তাঁর কলেবর।।’’
অচ্যুতেরে করি কোলে—গৌর ভাসে নয়ন-জলে
অচ্যুতো প্রবিষ্ট হৈলা চৈতন্য-দেহেতে।।’’
অচ্যুত আমার দেহ হয়—দেখালেন গৌরাঙ্গরায়
প্রেমে সভে লাগিলেন করিতে ক্রন্দন।।’’
জয় জয় অচ্যুতানন্দ—প্রেমস্বরে সবাই বলে
গৌর-কৃপা-পাত্র একান্ত—প্রেমস্বরে সবাই বলে
অচ্যুতের প্রিয় নহে হেন নাহি জন।।
নিত্যানন্দ-স্বরূপের প্রাণর সমান।’’
ঠাকুর বৃন্দাবন বলিছেন—সেই ত অচ্যুত বটে
পরিচয় শুন ভাই সবে—সেই ত অচ্যুত বটে
গদাধর-পণ্ডিতের শিষ্যের প্রধান।।
ইহারে সে বলি যোগ্য অদ্বৈতনন্দন।।
যেন পিতা তেন পুত্র উচিত মিলন।।
এই মত শ্রীঅদ্বৈত-গোষ্ঠীর সহিতে।
আনন্দে ডুবিলা প্রভু পাইয়া সাক্ষাতে।।
শ্রীতৈন্য কথোদিন অদ্বৈত-ইচ্ছায়।
রহিলা অদ্বৈত-ঘরে কীর্ত্তন-লীলায়।।
প্রাণনাথ গৃহে পাই আচার্য্য গোসাঞি।
না জানে আনন্দে আছেন কোনঠাঞি।।
কিছু স্থির হইয়া অদ্বৈত-মহামতি।
আই-স্থানে লোক পাঠাইল শীঘ্রগতি।।
দোলা লই নবদ্বীপে আইলা সত্বরে।
আইরে বৃত্তান্ত কহে চলিবার তরে।।
প্রেম-রস-সমুদ্রে ডুবিয়া আছে আই।
কি বোলেন কি শুনেন বাহ্য কিচু নাই।।
সম্মুখে যাহারে আই দেখেন তাহারে ।
জিজ্ঞাসেন মথুরার কথা কহ মোরে।।
রামকৃষ্ণ কেমত আছেন মথুরায়।
পাপী কংস কেমত বা করে ব্যবহার।।
চোর অক্রুরের কথা কহ জান কে।
রাম-কৃষ্ণ মোর চুরি করিলেক যে।।
‘‘হেনমতে পরমানন্দ-সমুদ্র-তরঙ্গে।
ভাসেন দিবস নিশি আই মহারঙ্গে।।
কদাচিত আইর যে কিছু বাহ্য হয়।
সেহো বিষ্ণুপূজা লাগি জানিহ নিশ্চয়।।
কৃষ্ণের প্রসঙ্গে আই আছেন বসিয়া।
হেনই সময়ে শুভবার্ত্তা হৈল সিয়া।।
শান্তিপুরে আইলেন শ্রীগৌরসুন্দর।
চল আই ! ঝাট আসি দেখহ সত্বর।।’’
শান্তিপুরে এল তোমার নিমাই—ত্বরা করি চল আই
তাহার অবধি আর কহিবারে নাই।।
বার্ত্তা শুনি প্রভুর যতেক ভক্তগণ।
সভেই হইলা অতি পরানন্দমন।।
গঙ্গদাসপণ্ডিত প্রভুর প্রিয়-পাত্র
আই লই চলিলেন সেই ক্ষণমাত্র।।
শ্রীমুররি-গুপ্ত-আদি যত ভক্তগণ।
সভেই আইর সঙ্গে করিলা গমন।।’’
দেখিতে গৌরাঙ্গরায়—নদীয়াবাসী প্রেমে ধায়
আনন্দে আকুল চিত না পারে চলিতে।।
সত্বরে আইলা শচী-আই শান্তিপুরে।।
বার্ত্তা শুনিলেন প্রভু শ্রীগৌরসুন্দরে।।
শ্রীগৌরসুন্দর প্রভু আইরে দেখিয়া।।
সত্বরে পড়িলা দূরে দণ্ডবৎ হৈয়া।।
‘‘পুনঃপুনঃ প্রদক্ষিণ হইয়া হইয়া।
দণ্ডবত হয় শ্লোক পড়িয়া পড়িয়া।।
‘‘তুমি বিশ্বজননী কেবল ভক্তিময়ী।
তোমারে সে গুণাতীত-সত্ত্বরূপা কহি।।
তুমি যদি শুভ-দৃষ্টি কর জীব-প্রতি।
তবে সে জীবের হয় কৃষ্ণে রতি মতি।।
তুমি সে কেবল মূর্ত্তিমতী বিষ্ণভক্তি ।
যাহা হৈতে সব হয়—তুমি সেই শক্তি।।
তুমি গঙ্গা দেবকী যশোদা দেবহুতি।
তুমি পৃশ্নি অনসূয়া কৌশল্যা অদিতি।।
যত দেখি সব তোমা হৈতে যে ঊদয়।
পালহ তুমি সে তোমাতে সে লীনো হয়।।’’
যত সব মাতৃশক্তি
তুমি তার মূল-মূরতি—যত সব মাতৃশক্তি
তোমা হতে সবার উদয়
তুমি মাতৃ-শক্তির মূল-আশ্রয়—তোমা হতে সবার উদয়
‘‘তোমার প্রভাব বলিবার শক্তি কার।
সভার হৃদয়ে পূর্ণ বসতি তোমার।।
শ্লোকবন্ধে এ মত করিয়া স্তবন।
দণ্ডবৎ হয় প্রভু ধর্ম্ম-সনাতন।।
কৃষ্ণ বই—ও কি পিতৃ-মাতৃ-গুরু-ভক্তি।
করিবারে এমত ধরয়ে কেহো শক্তি।।’’
পরতত্ত্ব-সীমা শচীসুতে—আইলা এ-জগতে
আচরি ধর্ম্ম শিখাইতে—আইলা এ-জগতে
শ্লোক পঢ়ি নমস্কার হয় বহুমতে।।
আই বেলি—দেখি মাত্র শ্রীগৌর-বদন।
পরামন্দে জড় হলেন সেইক্ষণ।।
রহিয়াছে আই যেন কৃত্রিম পুতলী।।
স্তুতি বোলে ‘‘বিষ্ণুভক্তি যে কিছু আমার।
কেবল একান্ত সব প্রসাদ তোমার।।
কোটিদাস-দাসেরো যে সম্বন্ধ তোমার।
সেহ জন প্রাণ হৈতে বল্লভ আমার।।
বারেকো যে জন তোমা’ করিব স্মরণ।
তার কভু নহিবেক সংসার-বন্ধন।।
সকল পবিত্র করে যে গঙ্গা তুলসী।।
তানাও হয়েন ধন্য তোমারে পরশি।।
তুমি যত করিয়াছ আমার পালন।
আমার শক্তিয়ে তাহা না হয় শোধন।।
দণ্ডে দণ্ডে যত স্নেহ করিলা আমারে।
তোমার সাদ্গুণ্য সে তাহার প্রতিকারে।।
এইমত প্রভু স্তুতি করেন সন্তোষে।
শুনিয়া বৈষ্ণবগণ মহানন্দে ভাসে।।
আইর ভক্তির সীমা কে বুঝিতে পারে।
গৌরচন্দ্র অবতীর্ণ যাঁহার উঠরে।।
প্রাকৃত-শব্দেও যেবা বলিবেক আই’।
আই-শব্দ-প্রভাবে তাহার দুঃখ নাই।।
প্রভু দেখি সন্তোষে পূর্ণিত হৈলা আই।
ভক্তগণ আনন্দে কাহারো বাহ্য নাই।।
হেনমতে শ্রীগৌরসুন্দর শান্তিপুরে।
আছেন পরমানন্দে অদ্বৈত-মন্দিরে।।
মাধবপুরীর আরাধনা পুণ্যতিথি।
দৈবযোগে উপসন্ন হৈল আসি তথি।।
মাধবেন্দ্র-অদ্বৈতে যদ্যপি ভেদ নাঞি।
তথাপি তাহান শিষ্য—আচার্য্য গোসাঞি।।
মাধবপুরীর দেহে শ্রীগৌরসুন্দর।
সত্য সত্য সত্য বিহরয়ে নিরন্তর।।
মাধবেন্দ্রপুরীর অকথ্য বিষ্ণুভক্তি।
কৃষ্ণের প্রসাদে সর্ব্বকাল পূর্ণ শক্তি।।
যেমতে অদ্বৈত শিষ্য হইলেন তান।
চিত্ত দিয়া শুন সেই মঙ্গল আখ্যান।।
যে সময়ে না ছিল চৈতন্য অবতার।
বিষ্ণুভক্তি শূন্য সব আছিল সংসার।।
তখনেও মাধবেন্দ্র চৈতন্য-কৃপায়।
প্রেম-সুখ-সিন্ধু-মাঝে ভাসেন সদায়।।
নিরবধি দেহে রোমহর্ষ-অশ্রু-কম্প।
হুঙ্কার গর্জ্জন মহাহাস্য স্তম্ভ ঘর্ম্ম।।
নিরবধি গোবিন্দের ধ্যানে নাহি বাহ্য।
আপনেও না জানেন—কি করেন কার্য্য।।
পথে চলি যাইতেও আপনা আপনি।
নাচেন পরমানন্দে করি হরিধ্বনি।।
কখনো বা হেন সে আনন্দমূর্চ্ছা হয়।
দুই-তিন প্রহরেও দেহে বাহ্য নয়।।
মাধবপুরীর প্রেম অকথ্য কথন।
মেঘ দরশনে মূর্চ্ছা পায় সেইক্ষণ।।
কৃষ্ণনাম শুনিলেই করেন হুঙ্কার।
ক্ষণেকে সহস্র হয় কৃষ্ণের বিকার।।
এইমত কৃষ্ণসুখে মাধবেন্দ্র সুখী।
সবে ভক্তি শূন্য লোক দেখি বড় দুঃখী।।
এতেকে সে বন ভাল এ সব হইতে।
বনে কথা নহে অবৈষ্ণবের সহিতে।।
এইমত মনো দুঃখ ভাবিতে চিন্তিতে।
ঈশ্বর ইচ্ছায় দেখা অদ্বৈত সহিতে।।
বিষ্ণুভক্তি শূন্য দেখি সকল সংসার।
অদ্বৈত আচার্য্য দুঃখ ভাবেন অপার।।
হেনই সময়ে মাধবেন্দ্র মহাশয়।
অদ্বৈতের গৃহে আসি হইলা উদয়।।
দেখিয়া তাঁহার বিষ্ণুভক্তির উদয়।
বড় সুখী হইলা অদ্বৈত মহাশয়।।
তার ঠাঞি উপদেশ করিলা গ্রহণ।
হেন মতে মাধবেন্দ্র—অদ্বৈত মিলন।।
মাধবপুরীর আরাধনার দিবসে।
সর্ব্বস্ব নিঃক্ষেপ করে অদ্বৈত হরিষে।।
দৈবে সেই পুণ্য-তিথি আসিয়া মিলিলা।
সন্তোষে অদ্বৈত সজ্জ করিতে লাগিলা।।’’
গৃহে পেয়েছে প্রাণ-গৌরহরি—সীতানাথের আনন্দ ভারি
তাতে তিথি মাধবেন্দ্রপুরীর—সীতানাথের আনন্দ ভারি
বড় সুখী হইলেন সেই পুণ্য-দিনে।।
সেই তিথি পূজিবারে আচার্য্য গোসাঞি।
যত সজ্জ করিলেন তার অন্ত নাঞি।।
নানা দিগ্ হৈতে সজ্জ লাগিল আসিতে।
হেন নাহি জানি কে আনয়ে কোন ভিতে।।
মাধবেন্দ্রপুরী-প্রতি প্রীতি সভাকার।
সভেই লইলেন যথাযোগ্য অধিকার।।’’
মহোৎসবের সেবা কার্য্য—মানে সভে করি ভাগ্য
আই লইলেন যত রন্ধনের ভার।
আই বেঢ়ি সর্ব্ব-বৈষ্ণবের পরিবার।।
নিত্যানন্দ মহাপ্রভু সন্তোষ অপার।
বৈষ্ণব পূজিতে লইলেন অধিকার।।’’
জগদ্গুরু নিতাই আমার—লইলেন বৈষ্ণব সেবার ভার
বৈষ্ণব-সেবার ভার আমার—নিতাই বলেন বারবার
কেহো বোলে ‘‘মালা আমি করিব গ্রন্থন।।’’
কেহো বোলে ‘‘জল আনিবার মোর ভার।’’
কেহো বোলে ‘‘মোর দায় স্থান-উপস্কার।।’’
কেহো বোলে ‘‘মুঞি যত বৈষ্ণব-চরণ।
মোর ভার সকল করিব প্রক্ষালন।।’’
কেহো বান্ধে পতাকা, চান্দোয়া কেহো টানি।
কেহো বা ভাণ্ডরী কেহো দ্রব্য দেয় আনি।।
কথোজনে লাগিলা করিতে সঙ্কীর্ত্তন।
আনন্দে করেন নৃত্য আরো কথোজন।।
কথোজন আরো ‘হরি’ বোলয়ে কীর্ত্তনে।
শঙ্খ ঘণ্টা বাজায়েন আরো কথোজনে।
কথোজন করে তিথি পূজিবার কার্য্য।
কেহো বা হইলা তিথি-পূজার আচার্য্য।।
এইমত পরানন্দরসে ভক্তগণ।
সভেই করেন কার্য্য যার যেন মন।।
খাও পিও আনো নেহ দেহ ‘হরিধ্বনি’।
ইহা বই চতুর্দ্দিকে আর নাহি শুনি।।
‘‘শঙ্খ, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, করতাল।
সঙ্কীর্ত্তন সঙ্গে ধ্বনি বাজয়ে বিশাল।।
পরানন্দে কাহারো নাহিক বাহ্যজ্ঞান।
অদ্বৈত-ভবন হইল শ্রীবৈকুণ্ঠধাম।।
আপনে শ্রীগৌরচন্দ্র পরম-সন্তোষে।
সম্ভারের সজ্জ দেখি কাষ্ঠ সারি সারি।।
ঘর-পাঁচ দেখে ঘট রন্ধনের স্থালী।
ঘর দুই-চারি দেখে মুদ্গে্র বিয়লি।।
নানাবিধ বস্ত্র দেখে ঘর পাঁচ-সাত
ঘর দশ-বার প্রভু দেখে খোলা-পাত।।
ঘর দুই-চারি প্রভু দেখে চিপিটক।
সহস্র সহস্র-কান্দী দেখে কদলক।।
না জানি কতক নারিকেল গুয়াপান।
কোথা হইতে আসিয়া হইল বিদ্যমান।।
পটোল বাস্তুক শাক থোড় আলু মান।
কত ঘর ভরিয়াছে নাহিক প্রমাণ।।
সহস্র সহস্র ঘড়া দেখে দধি দুগ্ধ।
ক্ষীর ইক্ষুদণ্ড অঙ্কুরের সনে মুদ্গ্র।।
তৈল বা লবণ গুড় দেখে প্রভু যত।।
সকলি অনন্ত লিখিবারে পারি কত।।
অতি—অমানুষি দেখে সকল সম্ভার।
চিত্তে যেন প্রভু হইলেন চমৎকার।।
প্রভু বোলে ‘‘এ সম্পত্তি মনুষ্যের নয়।
‘‘আচার্য্য মহেশ’’ হেন মোর চিত্তে লয়।।
মানুষ্যেরা এমত কি সম্পত্তি সম্ভবে।
এ সম্পত্তি সকলে সম্ভবেদ মহাদেবে।।
বুঝিলাম ‘‘আচার্য্য মহেশ-অবতার।’’
এইমত হাসি প্রভু বোলে বারবার।।
গৌর হাসি বলে বারবার—অদ্বৈত মহেশ-অবতার
আসন টলাল আমার—অদ্বৈত মহেশ-অবতার
এ সম্পত্তি কি মনুষ্যের হয়—আচার্য্য শিব নিশ্চয়
এই মত হাসি ছলে—প্রভু অদ্বৈত-তত্ত্ব বলে
তার পরিকর রহস্য—নৈলে কে জানতে পারে
আচার্য্যের প্রশংসা করেন অনুক্ষণ।।
একে একে দেখি প্রভু সকল সম্ভার।
কীর্ত্তনস্থলীতে আইলেন পুনর্ব্বার।।
প্রভু মাত্র আইলেন সঙ্কীর্ত্তন-স্থানে।
পরানন্দ পাইলেন সর্ব্ব-ভক্তগণে।।
না জানি কে কোন দিগে নাচে গায় বায়।
না জানি কে কোন দিগে মহানন্দে ধায়।।
সভে করে জয় জয় মহা হরিধ্বনি।
‘‘বোল বোল হরিবোল’’ আর নাহি শুনি’’।।
শান্তিপুরে অদ্বৈতের ঘরে—আনন্দের পাথার বয়ে যায় রে
সবাই বলে হরিবোল—উঠিল আনন্দ-রোল
সভার সুন্দর বক্ষ মালায় পূর্ণিত।।
‘‘সভেই প্রভুর পরিষদের প্রধান।
সভে নৃত্য গীত করে প্রভু-বিদ্যমান।।
মহানন্দে উঠিল শ্রীহরি-সঙ্কীর্ত্তন।
যে ধ্বনি পবিত্র করে অনন্ত-ভুবন।।
নিত্যানন্দ মহামল্ল প্রেমসুখময়।
বাল্যভাবে নৃত্য করিলেন অতিশয়।।
বিহ্বল হইয়া অতি আচার্য্য গোসাঞি।
যত নৃত্য করিলেন তার অন্ত নাঞি।।’’
ঘরে পেয়ে গৌরগুণনিধি—আচার্য্যের সুখের নাই অবধি
সভেই নাচেন অতি পাইয়া উল্লাস।।
মহাপ্রভু শ্রীগৌরসুন্দর সর্ব্বশেষে।
নৃত্য করিলেন অতি অশেষ বিশেষে।।
ভক্তগণের প্রাণধন—নাচে প্রাণ শচীনন্দন
শেষে নৃত্য করেন আপনে সভা লৈয়া।।
মণ্ডলী করিয়া নৃত্য করে ভক্তগণ
মধ্যে নাচে মহাপ্রভু শ্রীশচীনন্দন।।’’
ভকত-মণ্ডলী-মাঝে—প্রাণগৌর সঙ্কীর্ত্তনে নাচে
চারিদিকে পারিষদ ঘেরি—মাঝে নাচে গৌরহরি
নিজ-পারিষদে করি কোলে—গৌর নাচে হেলে দুলে
রইলেন মহাপ্রভু সভারে লইয়া।।
তবে শেষে আজ্ঞা মাগি অদ্বৈত আচার্য্য।
ভোজনের করিতে লাগিলা সর্ব্বকার্য্য।।
বসিলেন মহাপ্রভু করিতে ভোজন।
মধ্যে প্রভু চতুর্দ্দিগে সর্ব-ভক্তগণ।।
চতুর্দ্দিগে ভক্তগণ যেন তারাময়।
মধ্যে কোটিচন্দ্র যেন প্রভুর উদয়।।’’
চতুর্দ্দিগে ভক্ত-তারা ঘিরে—গৌরচন্দ্র ভোজন করে
ঘিরে পরিকর-তারার মালা—মাঝে গোরাচাঁদ করে আলো
মাধবেন্দ্র-আরাধনা আইর রন্ধন।।
মাধবপুরীর কথা কহিয়া কহিয়া।
ভোজন করেন প্রভু সর্বগণ লইয়া।।’’
মাধবেন্দ্রগুণ বর্ণন করি—ভোজন করেন গৌরহরি
মাধবেন্দ্রপুরীর গুণ গায়—সভে কৃষ্ণ-অধরামৃত পায়
প্রাণ গৌরগণ যত গৌরকে ঘিরে—সবাই গায় উচ্চ করে
মাধবেন্দ্রপুরী রসপুর।
রাসবিলাস পরিণতি, রাই কানু একাকৃতি,
গৌরপ্রেম-তরুর অঙ্কুর।।’’
ভক্তিপথের প্রথম অবতরী—জয় জয় মাধবেন্দ্রপুরী
নবাম্বূদ হেরিলে গগনে।
প্রেমে অঙ্গ পুলকিত, সেইক্ষণে মূরছিত,
শ্যামনবঘন-উদ্দীপনে।।’’
কাল-মেঘ দেখে শ্যাম-উদ্দীপনে—মূরছিত হয় প্রেমে
নির্জনে মধুর বৃন্দাবনে।
প্রেমরসে মগ্নমন, ভ্রময়ে দ্বাদশ বন,
রাধাকুণ্ড-গিরিগোবর্দ্ধনে।।
একদিন শুভক্ষণে পরিক্রমি গোবর্দ্ধনে,
শ্রীগোবিন্দকুণ্ড-তীরে আসি।
স্নান করি সন্ধ্যাকালে, বসিলেন তরুতলে,
অযাচকবৃত্তি উপবাসী।।
আছেন,–মাধবেন্দ্র অনশনে অতি-উৎকণ্ঠিত মনে,
দুগ্ধভাণ্ড নিজ-শিরে ধরি।
গোপ-বালকের বেশে, আসিলেন তার পাশে,
ভকত-বৎসল গিরিধারী।।
দুগ্ধ ভাণ্ড আগে ধরি, বলে ও মাধবপুরী,
এই দুগ্ধ লইয়া কর পান।
মাগি কেনে নাহি খাও, ব্রজবনে দুঃখ দাও,
মনে মনে কিবা কর ধ্যান।।’’
বালকের রূপ হেরি,’’
অপরূপ বালক রে
‘‘বালকের রূপ হেরি, মুগধ মাধবপুরী,
বাক্যামৃতে ক্ষুদা তৃষ্ণা গোল।’’
এমন কথা ত কভু শুনি নাই—এমন রূপ ত কভু দেখি নাই
মহামন্দে হৃদয় ভরিল।।
পুরী কহে কেবা তুমি, কোথায় বসতি ভূমি,
কেবা আমি কেমনে জানিলে।
উপবাসী আছি জেনে, এই নিরজন বনে,
দুগ্ধ ভাণ্ড লইয়া আইলে।।
বালক কহে গোপ আমি, গোবর্দ্ধন বাসভূমি,
স্ত্রীগণে জল লইতে আইলা,
তারা তোমা দেখি গেলা, তুমি তাদের না দেখিলা,
তারাই দুগ্ধ দিয়া পাঠাইলা।।’’
গোপীগণের ইঙ্গিত বিনে—নৈলে বা আসবে কেনে
গ্রামে উপবাসী না রহিবে।
যদি অযাচক হয়, খুঁজিয়া খুঁজিয়া তায়
সযতনে তারে ভুঞ্জাইবে।।
এই ব্রত নিষ্ঠাবলে, জানিলা গোপী সকলে,
তুমি অযাচক উপবাসী।
তাই মোরে দুগ্ধ দিয়া, তোমা ঠাঁই পাঠাইলা,
ধ্যান কর যথা তুমি বসি।।
‘‘গোদোহণ করিতে চাই, তাহে আমি শীঘ্র যাই,
বিলম্ব না করিতে পারিব।
দুগ্ধপান কর তুমি, আর বার আসি আমি,
দুগ্ধভাণ্ড লইয়া যাইব।।
এত বলি বালক গেলা, মাধব দুগ্ধপান কৈলা,
দুগ্ধভাণ্ড ধুইয়া রাখিল।
অতি উৎণ্ঠিত প্রাণে, সদা চায় পথপানে,’’
সে বালক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে—প্রাণ হারা হয়ে বসে আচে;
পুরী বলি নাম লয়, রাত্রে নিদ্রা নাহি হয়,
নিশি শেষে তন্দ্রা আকর্ষিল।
সেই বালকে স্বপ্নে দেখে, আসি দাঁড়াইল সম্মুখে,
হাতে ধরি কুঞ্জে লইয়া গেল।।
এক কুঞ্জ দেখাইয়া, কহে আমি রহি ইহা,
বহুদিন মৃত্তিকা ভিতরে।
শীত বৃষ্টি দাবাগ্নিতে, বড় দুঃখ পাই তাতে,
আছি তব আশাপথ হেরে।।’’
কবে মাধবেন্দ্র অস্বে—আশা-পথ-পানে চেয়ে আছি
আসি আমার সেবা করবে—আশা-পথ-পানে চেয়ে আছি
চিরদিন এই বাঞ্ছা মনে।
এতদিনে পাইনু তোরে, কুঞ্জ হৈতে কাড়ি মোরে,
গোবর্দ্ধনে করহ স্থাপনে।।
তাহা এক মঠ করি, ওহে মাধবেন্দ্রপুরী,
কর মোরে সতত সেবন।
শতশত কুম্ভ ভরি, গোবিন্দ-কুণ্ডের বারি,
দিয়া মোরে করাহ স্বপন।।
ক্ষুধায় কাতর আমি, আমারে ভুঞ্জাহ তুমি,
তুয়া প্রেম করিব ভোজন।
তব প্রেমে বাঁধা রব, দরশনে উদ্ধারিব,
অবিচারে সকল ভুবন।।
তোমায় দুগ্ধ দান কালে পরিচয় জিজ্ঞাসিলে,
গো-দোহনে ব্যস্ত ছিনু তায়।
মোর সব পরিচয়, না কহিনু সে সময়,
এবে শুন মোরে পরিচয়।।
শ্রীগোপাল মোর নাম, এই মোর নিত্য-ধাম,
আমি সেই গোবর্দ্ধনধারী।
ব্রজের স্থাপিত আমি, গোবর্দ্ধন লীলা-ভূমি,
হেথা মুঞি হই অধিকারী।।
সেবক মোর ম্লেচ্ছ ভয়ে, গোবর্দ্ধন হইতে লয়ে,
লুকাইয়া কুঞ্জের ভিতরে।
গেলা সেই পলাইয়া, সেই হতে রহি ইহা,
তব আশাপথ আশা করে।।
মাধবপুরী স্বপ্নভঙ্গে, ভূমে আছাড়িয়া অঙ্গে,
কাঁদে অতি-কাতর-অন্তরে।
কৃষ্ণ দেখা দিলা মোরে, না চিনিনু ভাগ্য ফেরে,
পালাইলু ফাঁকি দিয়া মোরে।।’’
কৃষ্ণ মোরে দেখা দিয়া—ফাঁকি দিয়া পলাইয়া
ঠাকুর মাধবপুরী কাঁদেন—ফাঁকি দিয়া পলাইয়া
আজ্ঞা পালন করিবার তরে।
প্রাতঃস্নান সমাপিয়া, গ্রাম্য মধ্যে প্রবেশিয়া,
কহিলেন ডাকিযা সবারে।।
তোমার গ্রামের ঠাকুর, গিরিধারী মহাশূর,
কুঞ্জমাঝে আছেন গোপনে।
চল সবে মিলি যাই, প্রকট করিব তায়,
গিরিধরে হেরিব নয়নে।।
অত্যন্ত নিবিড় কুঞ্জ, বহু বৃক্ষ লতা পুঞ্জ,
প্রবেশিতে দ্বার করিবারে।।
কুঠার কোদালি লহ, চল নিজজন সহ,
শুনি সবার আনন্দ না ধরে।।
যত ব্রজজন প্রতি, সহজে গোপালের প্রীতি,
শ্রীগোপাল ব্রজজন প্রাণ।
সেই গোপালে আজি পাবে, আনন্দে উন্মত্ত সবে,
ধাইলেন ব্রজবাসীগণ।।
কুঞ্জ কাটি করি দ্বার, প্রবেশি কুঞ্জ মাঝার,
অপরূপ হেরয়ে নয়নে !
শ্রীগোপাল গিরিধারী, অপরূপ ভঙ্গি করি,
আছে মাটি-তৃণ-আচ্ছাদনে।।
মাধবেন্দ্র নির্দ্দেশেতে, মৃর্ত্তিকা ভিতর হইতে,
শ্রীগোপালে তুলি সযতনে,
পর্ব্বত উপরে লইয়া, আনন্দে উন্মত্ত হইয়া,
বসাইলেন শিলা সিংহাসনে।।
‘‘তৃণ টাটি আচছাদিযা, শ্রীমন্দির নিরমিয়া
সর্ব্বজন আনন্দে গমন।
গোবন্দি কুণ্ডের জলে, অভিসিঞ্চি শ্রীগোপালে,
মাধবেন্দ্র প্রেমে অচেতন।।
সুচন্দন সুলেপনে, বস্ত্র-পুষ্প-মাল্য-দানে,
শ্রীগোপাল অঙ্গ বিভূষণ।
দধি দুগ্ধ ক্ষীর ছানা, মিষ্টান্ন পক্কান্ন নানা,
পিঠাপানা নৈবেদ্য প্রদান।।
অন্ন দালি গোধুম-চূর্ণ, আনি পর্ব্বত কৈল পূর্ণ,
আনন্দেতে যত ব্রজজন।
অন্নকূট রুটি রাশি, গব্যঘৃতে রহে ভাসি,
অপরূপ বিবিধ ব্যঞ্জন।
দধি দুগ্ধ রসালাদি, মিষ্টান্ন আর লড্ডুকাদি,
মাধবেন্দ্র মহাপ্রেম ভরে।
অন্নকূট সাজাইয়ে, প্রেমামৃত মিশাইয়ে,
ভুঞ্জাইল শ্রীগিরিধরে।।
জয় মাধবেন্দ্র পুরী, জয় জয় গিরিধারী,
অপরূপ প্রেমের সেবন।
যার প্রেম প্রকাশিতে, অঙ্গ-জ্বালা জুড়াইতে,
গোপাল যারে মাগিলা চন্দন।।
সেই আজ্ঞা শিরে ধরি, চলিলা মাধবপুরী,
নীলাচলে চন্দন আনিতে।
সুদূর দুর্গম পথ, নিজ অযাচক ব্রত,
তিল আধ চিন্তা নাই তাতে।।
নীলাচলে যাত্রা পথে, রেমুণাতে গোপীনাথে।
দরশনে মত্ত মাধবপুরী।
‘‘গোপীনাথ যার তরে, প্রেমে ক্ষীর চুরি করে,
নাম হইল ক্ষীর-চোরা হরি।
নীলাচলপুরে গিয়া, জগন্নাথে নিরখিয়া,
প্রেমানন্দ-সমুদ্রে মজ্জন
গোপালের আজ্ঞা বলে, চন্দন লইয়া চলে,
বৃন্দাবন গিরি-গোবর্দ্ধন।।
দর্শন লাগি গোপীনাথে, পুনঃ আইল রেমুণাতে,
সেথা স্বপ্নে বলেন গোপাল।
গোপীনাথের শ্রীঅঙ্গেতে, চন্দন লেপহ তাতে,
মোর অঙ্গ হইবে শীতল।।
মাধবেন্দ্র অজ্ঞা পাইয়া, কর্পূর চন্দন লইয়া,
গোপীনাথ-অঙ্গে লেপাইলা।
যাবৎ না হৈ অন্ত, মাধবেন্দ্র সে পর্য্যন্ত,
রেমুণাতে অবস্থান কৈলা।।
মাধবেন্দ্র প্রেমসিন্ধু, শ্রীচৈতন্য পূর্ণ ইন্দু,
যাঁর অনু-শিষ্য সুপ্রচার।
জয় মাধবেন্দ্রপুরী, জয় জয় ঈশ্বরপুরী,
গৌরহরি গুণ গায় যার।।
কৃষ্ণ বাঁধা প্রেমে যাঁর, দেখাদেন তিনবার,
কেবা তাঁর কহিবে মহিমা।
লক্ষীপুরী সমন্ধেতে, নিত্যানন্দ-সহ প্রীতে,
ত্রিজগতে সেই সে উপমা।।
মহাবিষ্ণু অবতার, শ্রীঅদ্বৈত শিষ্য যাঁর
পুরীশ্বর ঈশ্বর-ঈশ্বর।
‘‘প্রেমাঙ্কুর পুষ্ট হইল, নবদ্বীপে উপজিল,
প্রেমতরু গৌরাঙ্গ-সুন্দর।।
আপনে গৌরাঙ্গরায়, শ্রীমুখে যাঁর গুণ গায়,
প্রেমোন্মাদে মহামত্ত হইয়া।
নিত্যানন্দে লয়ে সাথে, গোপীনাথ মন্দিরেতে,
সিন্ধি প্রাপ্তি লীলা স্মঙরিয়া।।
বিরহিণী রাধারাণী, কহিলেন সেই বাণী,
সেই শ্লোক সিদ্ধি প্রাপ্তিকালে।
করি কণ্ঠে উচ্চারণ, হইলেন অদর্শনে,
গৌরহরি সেই শ্লোক বলে।।
অয়ি দীন অয়ি দীনে বলি, গৌর কাঁদে ফুলি ফুলি,
ভবোচ্ছাসে কণ্ঠ রুদ্ধ হইল।
প্রেমভরে মুরছিত, হেরিয়া ছাড়াই সুত,
ব্যাকুলিত গৌর কোলে কৈল।।
প্রভু নিতাই সযতনে, অচৈতন্য শ্রীচৈতন্যে,
প্রেম সেবায় চৈতন্য করায়।
জয় মাধবেন্দ্র বলি, গৌর নাচে বাহুতুলি,’
প্রেমের পাথার বয়ে যায়।।
জয় মাধবেন্দ্র পুরী, জয় গৌর গিরিধারী,
প্রেমসিন্ধু জগত ডুবায়।
সেই সিন্ধু না ভজিয়া’ দীন দ্বিজ অভাগিয়া,
ভবার্ণবে হাবু ডুবু খায়।।’’
পুরীর আরাধনা উৎসবে—প্রেমানন্দে মাতল সবে
মাধবপুরী—গুণ গানে—প্রেমানন্দে মাতল সবে
ভক্তি হয় গোবিন্দে ভোজন কৈলে ইথি।।
এইমত রঙ্গে প্রভু করিয়া ভোজন।
বসিলেন গিয়া প্রভু করি আচমন।।
তবে দিব্য সুগন্ধি চন্দন দিব্য মালা।
প্রভুর সম্মুখে আনি অদ্বৈত থুইলা।।’’
সীতানাথ আনন্দ-অন্তরে
আজ,–মাধবপুরীর উৎসব করে—সীতানাথ আনন্দ-অন্তরে
দিলেন চন্দন মালা মহা অনুরাগে।।
তবে প্রভু সর্ব্ব বৈষ্ণবের জনে জনে।
শ্রীহস্তে চন্দনমালা দিলেন আপনে।।
শ্রীহস্তের প্রসাদ পাইয়া ভক্তগণ।
সবার হইল পরানন্দময় মন।।
উচ্চ করি সভেই করেন হরিধ্বনি।
কিবা সে আনন্দ হৈল কহিতে না জানি।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দ চাঁদ জান।
বৃন্দাবন দাস তছু পদযুগে গান।।’’
মাধবেন্দ্র-আরাধনা দিন—আজ সেই পূণ্যতিথি
সীতানাথের বসতি-ভূমি—এই সেই লীলাস্থলী
কানাই নাটশালা হতে ফিরি—এসেছিলেন প্রাণ-গৌরহরি
রামকেলি গ্রাম হয়ে—এসেছিলেন শান্তিপুরে
শ্রীনরোত্তমে আকর্ষিয়ে—এসেছিলেন শান্তিপুরে
লয়ে নিজ পরিকরে—এসেছিলেন শান্তিপুরে
গৌর আগমন জেনে—গৌরগণ আইলা ধেয়ে
ভক্ত-ভ্রমর মধুপান লোভে—চারিদিক হতে আইলা ছুটে
নদীয়াবাসী সঙ্গে লয়ে—এসেছিলেন শচীমাতা
দেখিতে প্রাণ গোরাশশী—সবাই মিলিল আসি
মাধবপুরীর আরাধনা-তিথি—আসি হইল উপনীত
গৌর-পরিকর লয়ে—কৈলেন মহা মহোৎসব
কীর্ত্তন—ভোজন-রঙ্গে—কৈলেন মহা মহোৎসব
পুরীর আরাধনা-তিথিতে—বয়েছিল আনন্দের পাথার
প্রাণ কেঁদে কেঁদে উঠছে
দেখিতে ত পাই নাই
সেই মহোৎসব-রঙ্গ—দেখিতে ত পাই নাই
তখন জনম হয় নাই—দেখিতে ত পাই নাই
সেই লীলা-অদর্শন-শেল—নিশিদিশি জ্বলছে হিয়ায়
ত্রিকাল-সত্য গোরারায়—শুনেছি শ্রীগুরু-মুখে
আজ,-এসেছি এই শান্তিপুরে
শ্রীসীতানাথের ঘরে—আজ,–এসেছি এই শান্তিপুরে
শ্রীগুরু-কৃপা প্রেরণা-বলে—আজ,–এসেছি এই শান্তিপুরে
মহামহোৎসব-রঙ্গ—বড় সাধ দেখব বলে
ত্রিকাস-সত্য-লীলায়—সবাই ত এসেছে
মহামহোৎসব হতেছে—মহানন্দে বিহরিছে
হা গৌর প্রাণ গৌর—একবার দেখা দাও
রসময় প্রাণগোরা—দেখা দাও চিতচোরা
যদি এনেছ কৃপা করে
এই মহামহোৎসব-দিনে—যদি এনেছ কৃপা করে
সাঙ্গোপাঙ্গে প্রাণ-গৌরাঙ্গে –একবার দেখাও হে
কীর্ত্তন-নটন-ভোজন-রঙ্গে—একবার দেখাও হে
মাধবপুরীর আরাধনা-তিথিতে—একবার দেখাও হে
তবে কি দেখাবে না—কথা যে কইছ না
তোমার একার অধিকার কি
বিশ্বম্ভর গৌরহরি—তোমার একার অধিকার কি
বিশ্বম্ভর নাম যার—তোমার একার কি অধিকার
কেঁদে কেঁদে এনেছ তুমি—তোমার বটে আছে দাবী
এ কি বিপরীত রীতি
গৌর পেয়ে একা রইলে মাতি—এ কি বিপরীত রীতি
আমাদের ভাগ্য দোষে-স্বার্থপর কবে হলে
এইখানে আর নদীয়ায় বসে—তুমি ত,–ডেকেছিলে একপ্রাণে
আমার,–প্রাণকৃষ্ণ এস বলে—তুমি ত,–ডেকেছিলে একপ্রাণে
জগতেরে দেখাবে বলে—তুমি ত,–ডেকেছিলে একপ্রাণে
কত না সাধনা করে—এনেছিলে দেখায় ছিলে
গৌর এনেছিলে বলে—শান্তিপুর-নাথ হলে
তোমার নামে যে হবে কলঙ্ক—এখন এ কি বিপরীত রঙ্গ
দেখ্তে ত আনা নাই—দেখাবার লাগি ত এনেছিলে
আমাদের যদি না দেখাবে—তোমার সঙ্কল্প যে ভঙ্গ হবে
মহা মহোৎসব দেখাও—ঘুচাও নামের কালিমা ঘুচাও
গৌর আনা-ঠাকুর সীতানাথ—একবার দেখাও হে
তোমার,–আনানিধি প্রাণগৌরাঙ্গে—একবার দেখাও হে
ভালবাসতে জানি না মোরা
সে,–প্রেমপিয়ারা রসের গোরা—ভালবাসতে জানি না মোরা
তোমার গৌর তোমারি থাকবে—গৌর নিয়ে কিবা করব
বহুদিন পরে পেযেছ—গৌর লয়ে কোথা লুকায়ে আছ
দেখ্বার ত শক্তি নাই—কৃপা করে দেখাও হে
দেখ্বার নেত্র দিয়ে—কৃপা করে দেখাও হে
চিতচোরা মূরতি-খানি—শুধু একবার দেখব
শচীদুলাল গৌরহরি—চিত চুরি করেছে আমার
খেলার রসে মেতেছিলাম—কিছুই ত জানতাম না
খোল-করতালে নাম-গুণ-শুনায়ে—ঘরের বাহির করেছ মোরে
চিতচোরা দেয় না ধরা
খুঁজে খুঁজে হলাম সারা—চিতচোর দেয় না ধরা
তোমার ঘরে এসেছে জেনে—আজ,–এসেছি বড় আশা করে
একবার দেখ্ব
পরীক্ষা কর্ব
তার,–মূরতি কত শকতি ধরে
যার,–নামে ঘরের বাহির করে,–তার,–মূরতি কত শকতি ধরে
কোথা আছ শ্রীঅচ্যুতানন্দ
কোথা দাঁড়ায়ে গৌর দেখ্ছ—কোথা আছ শ্রীঅচ্যুতানন্দ
একবার দেখাও হে
প্রভু নিতাই কোথা তুমি—একবার দেখাও হে
গৌর,–দেখব পুরীর আরাধনা-দিনে—বড় আশা মনে মনে
পরাণ গৌরাঙ্গগণ—তোমরা সবাই ত এসেছ
প্রাণগৌর দেখ্বার লাগি—এসেছ ঠাকুর হরিদাস
হেরি,–গোরাচাঁদ-মুখখানি—আনন্দে নাচিছ তুমি
বাসু বসু রামানন্দ—সবাই ত এসেছ
মুরারী মুকুন্দ আদি—এসেছ সব নদীয়াবাসী
শ্রীবাস শ্রীধর পণ্ডিতাদি—এসেছ সব নদীয়াবাসী
পরাণ গৌরাঙ্গ সনে—মহা মহোৎসব করছ;
সেই,–চিতচোর চূড়ামণিরে—একবার দেখাও হে
তোমরা,–সদাই পরের দুঃখে দুঃখী
ভুবন-পাবন গৌরাঙ্গগণ—তোমরা,–সদাই পরের দুঃখে দুঃখী
আমাদের মুখপানে চেয়ে—একবার দেখাও হে
‘আমাদের মুখপান চেয়ে’—
আমাদের দুর্দ্দশা ভেবে—আমাদের মুখপানে চেয়ে
কেউ কথা যে কইছ না—একবার দেখাও হে
একবার দেখাও দয়া করে
সীতানাথেরগণ তোমরা—একবার দেখাও দয়া করে
যারে শান্তিপুর-নাথ বল—কোথা,–তোমাদের কুলের ঠাকুর
প্রাণনাথে পেয়ে সে—কোথা লুকায়ে বসে আছে
আর কার কাছে যাব
কে বাসনা পূরাইবে—আর কার কাছে যার
পরমকরুণ শ্রীগুরুগণ—তোমরা,–সবাই ত আছ গো
গৌরলীলার সন্ধান দিয়ে—তোমরাই ত পাগল কৈলে
একবার দেখাও গো ওগো তুমি কোথায় গো
পরমকরুণ শ্রীগুরুদেব—ওগো তুমি কোথায় গো
গৌরলীলা জানাইলে—সঙ্গে করে লয়ে এসে
সন্ধান দিয়ে দেখাবে বলে—ফাঁকি নিয়ে লুকাইলে
প্রাণের প্রাণ গৌর লেয়—লুকাইেয় করছ খেলা
একবার দেখাও হে
অধিকার নাই কৃপা করে—একবার দেখাও হে,
সংসার-কূপে ছিলাম ডুবে—তুমি ত,–যেচে গিয়ে হাত ধরিলে
এই সঙ্কল্প লয়ে বুকে—তুমি ত,–যেচে গিয়ে হাত ধরিলে
যতদিন স্বভাব না পাই—তোমার ত নিস্তার নাই
‘যতদিন স্বভাব না পাই,–
পরাণ গৌরাঙ্গ পাবার—যতদিন স্বভাব না পাই
যদি এনেছ নিজগুণে টেনে
এই লীলাস্থলী স্থানে—যদি এনেছ নিজগুণে টেনে
নিতাই-অদ্বৈত-সনে—প্রাণ গৌরাঙ্গ দেখাও হে
মাধবপুরীর মহা মহোৎসবে—প্রাণ গৌরাঙ্গ দেখাও হে
শান্তিপুরাধিপ-সীতানাথে—একবার বলে দাও
তার,–আনানিধি দেখাইতে—একবার বলে দাও
গৌর দেখবার আমার অধিকার নাই—আমি একা দেখ্তে চাই না
মহা মহোৎসব-রঙ্গ—দেখাবে প্রতি নরনারী-হৃদে
তবে শান্তিপুরনাথ—নৈলে,–নামে যে কলঙ্ক হবে
জগতের অশান্তি দেখে—একদিন কেঁদে ছিল
জগত অশান্তিতে ভরে গেছে—আর কি দেখ্তে পাচ্ছে না
বুঝি,–গৌর লয়ে মজে আছে ঘুমের আবেশ ভাঙ্গায়ে দাও
প্রতি-হৃদে গৌর করাক্ উদয়—জগত করুক শান্তিময়
গুণনিধি অদ্বৈত-সোণা—পূরাক মোদের এই বাসনা
ঘরে ঘরে,–দেখ্ব গৌর-প্রেমের কান্না—পূরাক মোদের এই বাসনা
জয় মাধবেন্দ্রপুরী—সবাই কাঁদুক প্রেমস্বরে
জয় প্রেমসিন্ধু গৌরহরি—সবাই কাঁদুক প্রেমস্বরে
জয় সীতানাথ বলিহারি—সবাই কাঁদুক প্রেমস্বরে
জয় নিতাই অদ্বৈত গৌরহরি—সবাই কাদুক প্রেমস্বরে
জয় সাঙ্গোপাঙ্গ গৌরহরি—সবাই কাঁদুক প্রেমস্বরে
জয় প্রেমাবতার গৌরহরি—জয় সীতানাথ মাধবেন্দ্রপুরী