শ্রীধাম-বৃন্দাবনস্থ-অক্রুরঘাটে শ্রীমন্মহাপ্রভুর শুভাগমন-স্মরণ কীর্ত্তন
‘‘ভজ নিতাই গৌর রাধ্যে শ্যাম।
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
‘‘জয় জয় গৌরচন্দ্র জয় নিত্যানন্দ।’’
ওরে ভাইরে আমার,–প্রেমাবতার গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
‘প্রেমোবতার গৌরহরি’—
স্থাবর-জঙ্গম-উন্মত্তকার—প্রেমাবতার গৌরহরি
আমার,–ব্রজবিহারী গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
আমার,–শচীদুলাল গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
মহা,–ভাব ভোরা ব্রজবিহারীর—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
প্রাণের প্রাণ গৌরহরির—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
ওরে ভাইরে আমার,–প্রভু নিতাই প্রাণ গৌরাঙ্গের—প্রাণভরে জয় দাও ভাই
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ।।’’
‘‘শরৎকাল আইল প্রভুর চলিতে হৈল মতি।’’
ছিলেন প্রভু নীলাচলে
যাবার লাগি উৎকণ্ঠিত চিত—ছিলেন প্রবু নীলাচলে
প্রভু করে,– রামানন্দ স্বরূপ-সঙ্গে নিভৃতে যুকতি।।
মোর সহায় কর যদি তুমি দুইজন।’’
আমার লীলার সহায়
প্রতি-লীলায় তোমরা দোঁহা—কর আমার লীলার সহায়
ভাসি দুটি নয়ন-জলে—স্বরূপ,—রামরায়ের করে ধরে বলে
তবে আমি যাই দেখি শ্রীবৃন্দাবন।।’’
ওহে স্বরূপ রামানন্দ—বড় উৎকণ্ঠিত মন
দেখিতে শ্রীবৃন্দাবন—বড় উৎকণ্ঠিত মন
একাকী যাইব কাহো সঙ্গে না লইব।।
কেহ যদি সঙ্গে যাইতে পাছে উঠি ধায়।
সবারে রাখিবে যেন কেহ নাহি যায়।।
প্রসন্ন হঞা আজ্ঞা দিবে না মানিয়া দুঃখ।
তোমা সবার সুখে পথে হবে মোর সুখ।।’’
আমার সুখ দিবার পাত্র—ও,–প্রিয় স্বরূপ রামানন্দ
দুইজন কহে তুমি ঈশ্বর স্বতন্ত্র।
যে ইচ্ছা সে করিবা নহ পরতন্ত্র।।’’
আচরণ বিনে কোন কার্য্য হয় না—আচরিয়ে শিখাইছেন
তোমার সুখে আমার সুখ কহিলে এখন।।
আমা দোঁহার মনে তবে বড় সুখ হয়।
এক নিবেদন যদি ধর মহাশয়।
উত্তম ব্রাহ্মণ এক সঙ্গে অবশ্য চাহি।।
ভিক্ষা করি ভিক্ষা দিবে যাবে পাত্র বহি।।
বনপথে যাইতে নাহি ভোজ্যান্ন ব্রাহ্মণ।
আজ্ঞা কর সঙ্গে চলে বিপ্র একজন।।
প্রভু কহে নিজ সঙ্গী কাহো না লইব।
একজন নিলে আনের মনে দুঃখ হব।
নূতন সঙ্গী হইবেক স্নিগ্ধ যার মন
ঐছে যদি পাই তবে লই একজন।।
স্বরূপ কহে এই বলভদ্র ভট্টচার্য্য।।
তোমাতে সুস্নিগ্ধ বড় পণ্ডিত-সাধু-আর্য্য।।
প্রথমে তোমার সঙ্গে আইলা গৌড় হৈতে।
ইহার ইচ্ছা আছে সর্ব্বতীর্থ করিতে।।’’
‘‘ইহার সঙ্গে আছে ব্রাহ্মণ এক ভৃত্য।
ইহো পথ করিবেন সেবার ভিক্ষাকৃত্য।।
ইহা সঙ্গে লও যদি হয় সবার সুখ।
বনপথে যাইতে তোমার নাহি কোন দুঃখ।।’’
বনপথে তোমায় একাকী—কোনপ্রাণে ছেড়ে দিব
ওহে পরম-করুণ-প্রভু—আমাদের এই কথা রাখ
দুইদনে সঙ্গে রাখ—আমাদের এই কথা রাখ
এই বিপ্র বহি লবে বস্ত্রাম্বুভাজন।
ভট্টাচার্য্য ভিক্ষা দিবে করি ভিক্ষাটন।।
তাঁহার বচন প্রভ অঙ্গীকার কৈল।
বলভদ্র-ভট্টাচার্য্যে সঙ্গে করে নিল।।’’
নিগূঢ় গৌরাঙ্গ-লীলা—অনুভব কর ভাই রে
প্রাণ,–গৌর-গোবিন্দের সেবাবিগ্রহ
বলরাম—নিত্যানন্দ—প্রাণ,–গৌর-গোবিন্দের সেবাবিগ্রহ
সেবা ছাড়া রইতে নারে
যদিও প্রকাশ্যে,–নিতাই সঙ্গে গেলেন না
রহিতে কি পারে রে
সেবা ছেড়ে সেবক কভু—রহিতে কি পারে রে
নিতাই,–ছেড়ে না দিলে যাবে কেমতে–তার,–প্রাণ যাবে বনপথে
বলভদ্র-নাম ধরে—তাই,–গোপনেতে চলিলেন নিতাই
সেই,–প্রেমোন্মত্ত-পরাণগৌরাঙ্গে—কে বা ধরিবে বল
গঙ্গা-পথ দর্শন করে
আজ হবে উনমত—গঙ্গা-পথ দর্শন করে
সেই,–প্রেমোন্মত্ত যথায় যাব—কে বা তারে ধর্বে বল
ধরণী-ধর নিতাই বিনে—কে বা তারে ধর্বে বল
সেবা-শকতি নিতাই বিনে—বিশ্বম্ভরে কে বা ধরে
বলভদ্-ভট্টচার্য্য—নাম ধরে—তাই—গোপনে চলিলেন নিতাই
পূর্ব্ব-রাত্রে জগন্নাথ দেখি আজ্ঞা লঞা।
শেষ-রাত্রে উঠি প্রভূ চলিলা লুকাইয়া।।
প্রাতঃকালে ভক্তগণ প্রভু না দেখিয়া।
অন্বেষণ করি ফিরে ব্যাকুল হইয়া।।’’
প্রাণের ঠাকুর নীলাচল ছাড়ি—কোথা বা গেল রে
এই নীলাচল শূন্য করে—প্রভু আমার কোথায়গেলে
এই নীলাচল আঁধার করে—কোথা গেলে প্রাণগৌর
স্বরূপ গোঁসাঞি সবার কৈল নিবারণ।’’
উঠিল ক্রন্দনের রোল
মধুর-শ্রীনীলাচলে—উঠিল ক্রন্দনের রোল
হা-গৌর প্রাণ-গৌর বলে—উঠিল ক্রন্দনের রোল
প্রাণগৌর-শূন্য-নীলাচলে—বলে,–কেমন করে থাকব রে
নিবৃত্ত হঞা রহে সবে জানি প্রভুর মন।।
প্রসিদ্ধ পথ ছাড়ি প্রভু উপপথে চলিলা।
কটক ডাহিনে করি বনে প্রবেশিলা।।’’
বনমালী অন্বেষিতে—প্রভু পশিলা বনেতে
নির্জ্জন-বনে চলেন প্রভু কৃষ্ণ-নাম লঞা।’’
দেখিতে প্রাণের বংশীধারী—যায়,–বিরহিণী গৌরকিশোরী
হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া।।’’
নিগূঢ়-গৌরাঙ্গৃ-লীলা—অনুভব কর ভাই রে
শ্রীগুরু-চরণ হৃদে ধরে—অনুভব কর ভাই রে
গৌর-লীলার মাধুরীর—বালাই লয়ে মরে যাই
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র
বনপথে যাবার কালে
বন্যপশু তাড়ায়ে গেল
নানা-অস্ত্রশস্ত্র-দ্বারে—বন্যপশু তাড়ায়ে গেল
একমাত্র নাম অস্ত্র—এবার কোন অস্ত্র নাই
গৌরেরে মুখে কৃষ্ণ নাম শুনে—সিংহ-পশু পথ ছাড়ি দেয়
যেন,–কত প্রাণের জন যায়—সিংহ-পশু পথ ছাড়ি দেয়
প্রাণগৌর নেচে যায়
সিংহ-ব্যাঘ্র পথ দেয়—প্রাণগৌর নেচে যায়
নিজ-জন আসছে জেনে—হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে
তাই পথ ছাড়ি দেয়—যেন,–কত আপানার জন আসছে
সিংহ ব্যাঘ্র কেঁদে লুটায়—তাই পথ ছাড়ি দেয়
নিজ প্রিয়জন আসছে জেনে—তাই পথ ছাড়ি দেয়ে
অনুভব কর ভাই রে
শ্রীগুরু-চরণ হৃদে ধরে—অনুভব কর ভাই রে
গৌরাঙ্গ-মূরতি হেরে—স্বরূপ জেগেছে সবার
স্বরূপ-জাগান স্বরূপ—স্বরূপ জাগাতে এসেছে
স্বরূপ-জাগান স্বরূপ দেখে—সবার স্বরূর জেগে উঠেছে
গৌরাঙ্গগ-স্বরূপ হেরে—মনুষ্য-ভাব জেগেছে
আজ,–সিংহ-ব্যাঘ্র নিজ-স্বভাব ভুলে
গোপীভাব জেগেছে তাই—আজ,–সিংহ—ব্যাঘ্র নিজ-স্বভাব ভুলে
ও-মা এ কি স্বরূপ বলে—অবাক হয়ে দেখছে তারা
হেরি,–রাই-আবরণে বংশীধারী—তারা,–নয়নভরে দেখ্ছে
পালে পালে ব্যাঘ্র হস্তী গণ্ডার শুকরগণ।
তার মধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।।’’
ভাবাবেশে চলেছে—কোনই সঙ্কোচ নাই
প্রাণ-গৌরহরির আগমনে—আজ,–হয়েছে তারা ব্রজের পশু
প্রাণ-গৌরহরির দরশনে—আজ,–হয়েছে তারা ব্রজের পশু
গৌর আগমনে দরশনে—আজ,–হয়েছে তারা ব্রজের পশু
যাঁহা কৃষ্ণ তাঁহা ব্রজ—না হবে বা কেন রে
হিংস্র-স্বভাব ভুলে গেছে—তারা,–ব্রজের পশু হয়েছে
ব্রজের পশুর স্বভাব পেয়েছে—হিংস্র-স্বভাব ভুলা নয়
প্রেমাবতার গৌর আমার—সব কৈল একাকার
ব্রজের নিজ-জন হয়—তারা বন্য পশু নয়
দেখি’ ভট্টাচার্য্যের মনে হয় সহাভয়।
প্রভুর প্রতাপে তারা একপাশ হয়।।’’
প্রাণপ্রিয় এস বলে—যেন,–প্রার্থনা করে লয়ে যায়
একদিন পথে ব্যাঘ্র করিয়াছে শয়ন।
আবেশে তার গায়ে প্রভুর লাগিল চরণ।।
প্রভু কহে কহ কৃষ্ণ ব্যাঘ্র উঠিল।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহি ব্যাঘ্র নাচিতে লাগিল।।
এ বা ভয়ে কিবা বিস্ময়
যাঁরে,–হেরি হয় প্রেমোদয়—এ বা ভায় কিবা বিস্ময়
যাঁরে,–দূরে হেরি হয় প্রেমোদয়—তার,–পরশ হলে কি না হয়
স্থাবর-জঙ্গম-প্রেমোন্মত্তকারী—জয় জয় গৌরহরি(মাতন)
আর দিন মহাপ্রভু করে নদীস্নান।
মত্তহস্তি-যূথ আইল করিতে জলপান।।
প্রভু জল-কৃত্য করে আগে হস্তী আইলা।
কৃষ্ণ কহ বলি প্রভু জল ফেলি মাইলা।।’’
প্রেমাবতারের করুণার—বালাই লয়ে মরে যাই
জল যে প্রেম হয়ে গেল
প্রেমাবতারের পরশেতে—জল যে প্রেম হয়ে গেল
প্রেম বরিষণ হয়—ও তো জল ফেলা নয়
সেই জল-বিন্দু-কণা লাগে যার গায়।
সেই কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহে প্রেমে নাচে ধায়।।’’
গৌর দেখে কৃষ্ণ বলে—শুধু,–কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলা নয়
গৌর-স্বরূপ দেখে বলে
এ যে বংশীগানামৃত-ধাম—গোর-স্বরূপ দেখে বলে
কেহ ভূমি পড়ে কেহ করয়ে চীৎকার।’’
এ যে বটে প্রেমের হুঙ্কার—ও তো চীৎকার করা নয়
সব,–প্রেমে কৈল একাকার—আমার,–প্রাণগৌর প্রেমাবতার
বল ভাই জয় জয়—জয়,–প্রেমাবতার গৌরহরি
স্থাবর-জঙ্গম-প্রেমান্মত্তকারী—জয় জয়,–প্রেমাবতার গৌরহরি
গৌরলীলা শ্রবণ করি—এই যেন মনে হয়
ঝারিখণ্ডপথে,–গৌরলীলা শ্রবণ করি—এ যেন মনে হয়
বন্য-হস্তী—ব্যাঘ্রের-স্বরূপ জেগে উঠল
বন্য-জন্তুগণের যেন –স্বরূপ জেগে উঠল
মায়ার আবরম ঘুচে গেল—স্বরূপ জেগে উঠল
কৃষ্ণ ভোগের অনুকূল—স্বরূপ জেগে উঠল
পরিপূর্ণ-কৃষ্ণ-ভোগের—স্বরূপ জেগে উঠল
যে কথা কেবল তত্ত্বে ছিল—সেই কথা প্রকট হোলো
একা,–পুরুষ কৃষ্ণ আর সব প্রকৃতি—সেই কথা প্রকট হলো
বারিখণ্ড-পথে আজ—সেই তত্ত্বের বিকাশ হোলো
জীবের নিত্য রাধাদাসী—স্বরূপ জেগে উঠল
স্বরূপ-জাগান-স্বরূপ দেখে—স্বরূপ জেগে উঠল
দেখে,–মধুর-গৌরাঙ্গ-স্বরূপ—স্বরূপ জেগে উঠল
গৌর-মুখে,–নাম শুনে নাম বলা নয়—স্বভাবেতে বলছে
তাদের,–স্বরূপ জেগে উঠেছে তাই—স্বভাবেতে বলছে
গৌর দেখে এই কৃষ্ণ—স্বভাবেতে বলছে
পথে যাইতে করে প্রভু উচ্চ-সংকীর্ত্তন।
মধুর কণ্ঠধ্বনি শুনি আইলা মৃগীগণ।।’’
ব্রজবিহারীর আগমনে—ঝারিখণ্ড হোলো ব্রজবন
যাঁহা কৃষ্ণ তাঁহা ব্রজ—মহাজন-বাক্য আছে
মনে হয়েছে বৃন্দাবন
আরও গুঢ়-কথা আছে
সেই বিহার-ভূমি হয়—ব্রজবিহারীর,–যেথায় বিহারের ইচ্ছা হয়
প্রভু বিহার করবে বোলে—বৃন্দাবন এসেছে
ব্রজের মৃগীর স্বভাব পেয়েছে
ব্রজের বংশীধ্বনি শুনিছে—ব্রজের মৃগীর স্বভাব পেয়েছে
মৃগী শুনে বংশীধ্বনি—ও তো কণ্ঠধ্বনি নয়
ঐ,–শ্যামের বংশী বাজে বলে—পাগল হয়ে ছুটেছে
ধ্বনি শুনি ডাহিনে বামে যায় প্রভু-সঙ্গে।
প্রভু তার অঙ্গ মুছে শ্লোকে পড়ে রঙ্গে।।’’
ঝারিখণ্ডে মৃগী যত—ব্রজের স্বভাব পেয়েছে
আজ ব্রজের স্বভাব পেয়ে—যেন তাঁর সঙ্গে চলেছে
ব্রজবনে সদা ফিরিছে—যেন তাঁর সঙ্গে চলেছে
হেনকালে ব্যাঘ্র তথা আইল পাঁচ-সাত।
ব্যাঘ্র মৃগী মিলি চলে চলে মহাপ্রভুর সাথ।।’’
হিংস্র-স্বভাব ভুলে গিয়ে—তারা,–পেয়েছে ব্রজের মধুর-স্বভাব
গোপী-ভাবে মেতেছে—নিজ-স্বভাব ভুলে গেছে
স্বরূপ-জাগান-স্বরূপ দেখে—আবরণ ঘুচে গেছে
জীব নিত্য রাধাদাসী—হ্লাদিনীর বৃত্তি জীব
স্বরূপ-জাগান-স্বরূপ হেরে—স্বভাব দেহে উঠেছে
ব্রাঘ্র মৃগী নয় তারা—স্বভাব জেগেছে তাদের
স্বভাব জেগেছে তাদের—হয়েছে তারা সহচরী
দেখি মহাপ্রভুর বৃন্দাবন স্মৃতি হৈল।
বৃন্দাবন-গুণ-বর্ণন শ্লোক পড়িল।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কহ বলি প্রভু যবে বৈল।
কৃষ্ণ কহি ব্যাঘ্র মৃগ নাচিতে লাগিল।।’’
আমার,–প্রেমসিন্ধু গোরারায়—সিংহ ব্যাঘ্র প্রেমে নাচায়
স্বভাব দিয়ে প্রেমে নাচায়—প্রেমাবতার প্রাণ-গোরারায়
নাচে কাঁদে ব্যাঘ্রগণ মৃগীগণ-সঙ্গে।’’
‘‘বলভদ্র ভট্টাচার্য্য দেখে প্রভুর রঙ্গে।।
ব্যাঘ্র মৃগ অন্যোহন্যে করে আলিঙ্গন।
মুখে মুখ দিয়া করে অন্যোহন্যে চুম্বন।।’’
হয়ে গেছে বৃন্দাবন—হিংসা শূন্য এ কোনস্থান
তাদের ব্রজের সহচরীর-স্বরূপ জেগে উঠেছে;
মহা,–ভাবনিধির দরশনে—পশু-আবরণ ঘুচে গেছে
যেন,–পরস্পর গোপা হয়েছে—পশু আবরণ ঘুচে গেছে
তাদের স্বভাব জেগেছে—যেন,–পরস্পর দুই ভগিনী ঞ
যেন,–পরস্পর দুই ভগিনীর—বহুদিন পরে হয়েছে দেখা
মুখে মুখ দিয়ে পরস্পর—তাই সম্ভাষণ করিছে
আলিঙ্গন চুম্বন করি—তাই সম্ভাষণ করিছে
‘আলিঙ্গন চুম্বন করি’—
পরস্পর দুই ভগিনা—আলিঙ্গন চুম্বন করি
কৌতুক দেখিয়া প্রভু হাসিতে লাগিলা।
তা সবাকে তাঁহা ছাড়ি আগে চলি গেলা।।
ময়ূরাদি চলে পক্ষিগণ প্রভুকে দেখিয়া।
সঙ্গে চলে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হৈঞা।।’’
বনের ময়ূর ময়ূরা—যেন পেয়েছে ব্রজবিহারী
স্বরূপ উপলব্ধি হলো—ঘিরিয়া দাঁড়াইল
তারেই ঘিরে নাচিছে—স্বরূপ দেখ্তে পেয়েছে
ব্রজবনে তারেই ঘিরে নাচে—স্বরূপ দেখতে পেয়েছে
তাদের,–প্রেমনেত্রের বিকাশ হয়েছে
তাই,–আনন্দেতে ঘিরে নাচ্ছে
পেয়ে,–জড়াজড়ি কিশোর কিশোরী—তাই,–আনন্দেতে ঘিরে নাচছে
যত,–বনের ময়ূর ময়ূরী আজ—তাই,–আনন্দেতে ঘিরে নাচছে
‘হরিবোল’ বলি প্রভু করে উচ্চধ্বনি।
বৃক্ষলতা প্রফুল্লিত সেই ধ্বনি শুনি।।’’
হরিবোল বলা নয়—হোলো যেন বংশীধ্বনি
যেন শ্যামের বংশী শুনে—তাই,–বৃক্ষলতা পুলকিত
যেন ব্রজের স্বভাব পেয়ে—ঝারিখণ্ডের বৃক্ষলতাগণ
তাই বংশীধ্বনি শুনে—ঝারিখণ্ডের বৃক্ষলতাগণ
যত,–ঝারিখণ্ডের তরুলতা—তাই হোলো পুলকিত
ঝারিখণ্ডের স্থাবর জঙ্গম আছে যত।
কৃষ্ণ নাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত।।’’
জয় জয় জয় জয়—জয়,–প্রেমাবতার গৌরহরি
সবে মিলে বল জয়—জয়,–প্রেমাবতার গৌরহরি
স্থাবর-জঙ্গম-প্রেমোন্মত্তকারী—জয় জয়,–প্রেমাবতার গৌরহরি (মাতন)
যেই গ্রাম দিয়া যান যাঁহা করেন স্থিতি।
সে সব গ্রামের লোকের হয় কৃষ্ণভক্তি।।’’
আগে আগে চলে রে
ব্রজবিহারী যেখানে যায়—আগে আগে চলে রে
কোথায় দাঁড়াবে বলে—আগে আগে চলে রে
অমনি বিহার ভূমি,–ব্রজধাম আগে যায়—ব্রজবিহারীর,–যেখানে যেতে মন হয়
অন্যত্র কি স্থিতি হয়
ব্রজবিহারী শ্যামরায়ের—অন্যত্র কি স্থিতি হয়
সে সব গ্রামের লোকের হয় কৃষ্ণভক্তি।।’’
বিশ্ব প্রেমে ভরে বলে—বিশ্বম্ভর নাম ধরে
কেহ যদি তাঁর মুখে শুনে কৃষ্ণনাম।
তার মুখে আন শুনে তার মুখে আন।।
সবে কৃষ্ণ হরি বলি নাচে কাঁদে হাসে।
পরস্পরায় বৈষ্ণব হইল সর্ব্বদেশে।।’’
প্রেমে জগৎ মাতাইলা—প্রেমাবতার শচীদুলাল
যাঁর,–নাম লইলে বৈষ্ণব হয়
তাঁর,–দর্শনে হবে কি সংশয়—যাঁর,–নাম লইলে বৈষ্ণব হয়
সদ্যপি প্রভু লোক-সঙ্ঘট্টের ত্রাসে।
প্রেম গুপ্ত করে, বাহিরে না প্রকাশে।।
তথাপি তাঁর দর্শন-শ্রবণ-প্রভাবে।
সকল-দেশের লোক হইল বৈষ্ণবে।।
গৌড়-বঙ্গ-রাঢ়-উৎকলাদি-দেশে গিয়া।
লোকের নিস্তার কৈলা আপনে ভ্রমিয়া।।
মথুরা যাবার ছলে আসি ঝারিখণ্ড।।
ভিল্ল-প্রায় লোকে তাঁহা পরম-পাষণ্ড।।
নাম-প্রেম দিয়া কৈল সবার নিস্তার।
চৈতন্যের গূঢ়-লীলা বুঝে শক্তি কার।।’’
প্রেম কৈল একাকার—প্রেমাবতার গৌর আমার
বন দেখি ভ্রম হয় এ বৃন্দাবন।
শৈল দেখি মনে হয় এই গোবর্দ্ধন।।
যাঁহা নদী দেখে তাঁহা মানয়ে কালিন্দী।’’
যাঁহা নদনদী দেখে—অমনি,–কালিন্দী হয়ে যায়
চিন্তামাত্র বন বৃন্দাবন হয়—অমনি,–কালিন্দী হয়ে যায়
শৈল গোবর্দ্ধন হয়—অমনি,–কালিন্দী হয়ে যায়
ওযে,–কালীয়দমন দেখা পেয়েছে—না হবে বা কেন রে
এই ত সেই কালীয় বলে—মহা,–প্রেমাবেশে নাচছে
আবেশে মহাপ্রভু বলে—ও কালিন্দী বল বল
আমার,–কালীয়দমন কোথা গেল—ও কালিন্দী বল বল
‘আমার,–কালীয়দমন কোথা গেল’—
এই ত এখনি ছিল—কালীয়দমন কোথা গেল
তাঁহা নাচে গায় প্রেমাবেশে পড়ে কাঁদি।।
পথে যাইতে ভট্টাচার্য্য শাক মূল ফল।
যাঁহা যেই পায়েন তাহা লয়েন সকল।।
যে গ্রামে রহেন প্রভু তথায় ব্রাহ্মণ।
পাঁচ সাত জন আসি করে নিমন্ত্রণ।।
কেহ অন্ন আনি দেয় ভট্টাচার্য্যস্থানে।
কেহ দুগ্ধ দধি কেহ ঘৃত খণ্ড আনে।।’’
আজ,–প্রাণ গৌর সেবা করে—তাদের ভাগ্যের সীমা নাই
আসি যবে ভট্টাচার্য্যে করে নিমন্ত্রণ।।
ভট্টাচার্য্য পাক করে বন্যব্যঞ্জন।
বন্যব্যঞ্জনে প্রভুর আনন্দিত মন।।
দুই চারি দিনের অন্ন রাখেন সংহতি।
যাঁহা শূন্য বন লোকের নাহিক বসতি।।
তাঁহা সেই অন্ন ভট্টাচার্য্য করে পাক।
ফলমূলের ব্যঞ্জন করেন বন্য নানা শাক।
পরমসন্তোষ প্রভুর বন্য ভোজনে।
মহা সুখ পান যেদিন রহেন নির্জ্জনে।।
ভট্টাচার্য্য সেবা করে স্নেহে যৈছে দাস।
তাঁর বিপ্র বহে জলপাত্র-বহির্ব্বাস।।
‘‘নির্ঝরের উষ্ণোদকে স্নান তিনবার।
দুই সন্ধ্যা অগ্নি তাপে কাষ্ঠ অপার।।
নিরন্তর প্রেমাবেশে নির্জ্জনে গমন।
সুখ অনুভবি প্রবু কহেন বচন।।
শুন ভট্টাচার্য্য আমি গেলেম বহু দেশে।
বনপথে সুখের সম নাহি লব লেশ।।
কৃষ্ণ কৃপালু আমার বড় কৃপা কৈল।
বনপথে আনি আমার বহুসুখ দিল।।
পূর্ব্বে বৃন্দাবন যাইতে করিলাম বিচার।
মাতা, গঙ্গা, ভক্তগণ দেখিব একবার।।
ভক্তগণ সঙ্গে লঞা যাব বৃন্দাবন।।
এত ভাবি গৌরদেশে করিলাম গমন।
মাতা, গঙ্গা, ভক্ত দেখি সুখী হইল মন
ভক্তগণ লয়ে তবে চলিলাম সঙ্গে।
লক্ষ কোটি লোক তাঁহা হৈল আমা-সঙ্গে।।
সনাতন-মুখে কৃষ্ণ আমা শিখাইলা।
তাঁহা বিঘ্ন করি বনপথে লঞা আইলা।।
কৃপার সমুদ্র দীন-হীনে দয়াময়।
কৃষ্ণ-কৃপা বিনে কোন সুখ নাহি হয়।।
ভট্টাচার্য্যে আলিঙ্গিয়া তাহারে কহিল।
তোমার প্রসাদে আমি এত সুখ পাইল।।
তেঁহো কহেন তুমি কৃষ্ণ তুমি দয়াময়।
অধম জীব মুঞি মোরে হইলা সদয়।।
মুঞি ছার মোরে তুমি সঙ্গে লইয়া আইলা।
কৃপা করি মোর হাতে ভিক্ষা যে করিলা।।
অধম কাকেরে কৈলে গরুড়-সমান।
স্বতন্ত্র ঈশ্বর তুমি স্বয়ং ভগবান।।
এইমত বলভদ্র করেন স্তবন।।
প্রেমে সেবা করি তুষ্ট কৈল প্রভুর মন।।’’
‘‘এইমত নানা সুখে প্রভু আইলা কাশী।
মধ্যাহ্ন স্নান কৈল মণিকর্ণিকায় আসি।।
সেইকালে তপনমিশ্র করে গঙ্গাস্নান।
প্রভু দেখি হইল তাঁর কিছু বিস্ময় জ্ঞান।।
পূর্ব্বে শুনিয়াছি প্রভু করিয়াছেন সন্ন্যাস।
নিশ্চয় করিল হৈল হৃদয়ে উল্লাশ।।’’
এই ত চিতচোর প্রাণধন
সন্ন্যাসী-বেশ করেছে ধারণ—এই ত চিতচোর প্রাণধন
সন্ন্যাসী-বেশধারী—এই ত প্রাণের গৌরহরি
নৈলে,–কেল কৈল চিত চুরি—এই ত প্রাণের গৌরহরি
চিতচোর গৌর বিনে—চিত,–চুরি করতে কি পারে আনে
ছুটিলেন তপনমিশ্র
আপন-প্রাণের ঠাকুর জেনে—ছুটিলেন তপনমিশ্র
ছিন্ন-কদলীর মত-পড়িলেন গৌর-পদতলে
ছিন্ন-কদলীর মত—পড়িলেন গৌর-পদতলে
ছুটে গিয়ে তপনমিশ্র—পড়িলেন প্রভুর পদতলে
আরে আরে আমার প্রভু বলে—পড়িলেন প্রভুর পদতলে
হেরয়ে বদন-কমলে—পড়ি প্রভুর চরণতলে
মিশ্র ভাসে নেত্রজলে—পড়ি প্রভুর চরণতলে
ব্যাকুল হয়ে তপন কাঁদে—আরে আমার প্রভু রে
চিতচোর প্রাণগৌর—আরে আরে প্রভু রে
প্রভু তাঁরে উঠাইয়া কৈল আলিঙ্গন।।”
আইস,—আইস আমার তপন বলে—প্রেম-বাহু পশারি কৈলা কোলে
প্রভু লঞা গেল বিশ্বেশ্বর দরশনে।
তবে আসি দেখে বিন্দু-মাধব-চরণে।।
ঘরে লঞা আইলা প্রভুকে আনন্দিত হইয়া।’’
ঘরে পয়েছে প্রাণ শচীনন্দন—তপন মিশ্রের কি আনন্দ
সেবা করি নৃত্য করে বস্ত্র উড়াইয়া।।’’
বস্ত্র উড়াইয়া নাচি—জাগায় ভবিষ্যৎবাণী
অচিরে এই কাশীধাম—গৌরপ্রেম-বন্যায় ভাসবে
তাই বস্তর উড়াইয়া নাচে—এই কাশীধামে উড়বে
শ্রীগৌরাঙ্গ-প্রেমের ধ্বজা—এই কাশীধামে উড়বে
গৌরপ্রেমের ধ্বজা উড়বে—ভবিষ্যৎ জানাইয়া
প্রভুর চরণোদক সবংশে কৈল পান।
ভট্টাচার্য্যের পূজা কৈল করিয়া সম্মান।।’’
প্রভুকে নিমন্ত্রণ করি ঘরে ভিক্ষা দিল।
বলভদ্র-ভট্টাচার্য্যে পাক করাইল।।’’
সেবা ছাড়িয়া সেবক—রহিতে কি পারে গো
আমার,–অতিগূঢ় নিত্যানন্দ—প্রাণগৌরাঙ্গের গূঢ় সেবক
সঙ্গে সঙ্গে এসেছে
কেন বা আসবে না
ছায়া কি কায়া ছাড়া থাকে—কেন বা আসবে না
গোপনে এসেছে নিতাই
গৌর,–সেবা ছেড়ে থাকতে নারবে বলে–গোপনে এসেছে নিতাই
বলভদ্র নাম ধরি—গোপনে এসেছে নিতাই
সঙ্গে সঙ্গে সেবা করে চলেছে
ভিক্ষা করি মহাপ্রভু করিলা শয়ন।
মিশ্রপুত্র রঘু করে পাদ সম্বাহন।।’’
প্রাণধনে—নিজ-ভবনে—বড় সাধে পেয়েছে
নিত্য-সেবক রঘু—বড় সাধে পেয়েছে
প্রভুর শেষান্ন মিশ্র সবংশে খাইলা।
প্রভু আইলা শুনি চন্দ্রশেখর আইলা।।
মিশ্রের সখা তেঁহো প্রভুর পূর্ব্বদাস।
বৈদ্যজাতি লিখনবৃত্তি বারানসী বাস।।
আসি প্রভুপদে পড়ি করেন রোদন।
প্রভু উঠি তাঁরে কৃপায় কৈল আলিঙ্গন।।’’
আইস,–আইস চন্দ্রশেখর বলে—প্রেমাবতার-গৌর কৈলা কোলে
আপনে আসিয়া ভৃত্যে দরশন দিলা।।
আপন প্রারব্ধে বসি বারানসী স্থানে।
যাঁহা ‘ব্রহ্ম’ শব্দ বিনা নাহি শুনি কাণে।।
ষড়দর্শন ব্যাখ্যা বিনা কথা নাহি এথা ।
মিশ্র কৃপা করি মোরে শুনান কৃষ্ণকথা।।
নিরন্তর দোঁহে চিন্তি তোমার চরণ।
সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর তুমি দিলে দরশন।।’’
আমরা দুই-জনে—তোমার চরণ চিন্তা করি
কবে,–কাশী আসিবে প্রেমাবতার
প্রেমে হবে একাকার—কবে,–কাশী আসিবে প্রেমাবতার
প্রেমাবতার গৌর আমার
কতদিনে আসবে হেথা—প্রেমাবতার গৌর আমার
সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর তুমি দিলে দরশন।।
শুনি মহাপ্রভু যাবেন শ্রীবৃন্দাবন।
দিন কত রহি তার ভৃত্য দুইজন।।
মিশ্র কহে প্রভু যাবৎ কাশীতে রহিবে।
মোর নিমন্ত্রণ বিনা অন্য না মানিবে।।
এইমত মহাপ্রবু দুই-ভৃত্যের বশে।
ইচ্ছা নাহি তবু তথা রহিল দিন-দশে।।
মহারাষ্ট্রী বিপ্র আইসে প্রভু দেখিবারে।
প্রভুর রূপ প্রেম দেখি হয় চমৎকারে।।
বিপ্র সব নিমন্ত্রয়ে প্রভু নাহি মানে।
প্রভু কহে আজি মোর হয়েছে নিমন্ত্রণে।।
এই মত প্রতিদিন করেন বঞ্চন।
সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভয়ে না মানে নিমন্ত্রণ।।
প্রকাশানন্দ শ্রীপাদগ সভাতে বসিয়া।
বেদান্ত পড়ান বহু শিষ্যগণ লঞা।।
এক বিপ্র দেখি আইল প্রভুপ ব্যবহার।
প্রকাশানন্দ আগে কহে চরিত্র তাঁহার।।
এক সন্ন্যাসী আইলা জগন্নাথ হৈতে।
তাঁহার মহিমা প্রভাব না পারি বর্ণিতে।।
প্রকাণ্ড শরীর শুদ্ধ কাঞ্চন বরণ।
আজানুলম্বিত ভুজ কমল নয়ন।।
যত কিছু ঈশ্বরের সর্ব্ব সল্লক্ষণ।
সকল দেখিয়ে তাঁতে অদ্ভুত কথন।।
তাঁহো দেখি জ্ঞান হয় এই নারায়ণ।
যেই তারে দেখে করে কৃষ্ণ-সঙ্কীর্ত্তন।।
মহাভাগেবত লক্ষণ শুনি ভাগবতে।
সে সব লক্ষণ প্রকট দেখিয়ে তাঁহাতে।।
নিরন্তর কৃষ্ণনাম জিহ্বা তাঁর গায়।
দুই-নেত্রে অশ্রু বহে গঙ্গাধারা প্রায়।।
ক্ষণে নাচে হাসে গায় করয়ে ক্রন্দন।
ক্ষণে হুহুঙ্কার করে সিংহর গর্জ্জন।।
জগতমণ্ডল তাঁর কৃষ্ণচৈতন্য নাম।।
নাম রূপ গুণ তাঁর সব অনুপম।।
দেখিলে সে জানি তাঁরে ঈশ্বরের রীতি।
অলৌকিক কথা শুনি কে করে প্রতীতি।।
শুনিয়া প্রকাশানন্দ বহুত হাসিলা।
বিপ্রে উপহাস করি কহিতে লাগিলা।।
শুনিয়াছি গৌড়দেশে সন্ন্যাসী ভাবুক।
কেশবভারতী-শিষ্য লোক-প্রতারক।।
চৈতন্য নাম তাঁর ভাবুকগণ লঞা।
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে বুলে নাচাইয়া।।
যেই তাঁরে দেখে সেই ঈশ্বর করি কহে।
ঐছে মোহন বিদ্যা যে দেখে সে মোহে।।
সার্ব্বভৌমভট্টাচার্য্য পণ্ডিত প্রবল।
শুনি চৈতন্যের সঙ্গে হইল পাগল।।
সন্ন্যাসী নামমাত্র মহা ইন্দ্রজালী।
কাশীপুরে না বিকাবে তার ভাবকালী।।
বেদান্ত শ্রবণ কর না যাইহ তার পাশ।
উচ্ছৃঙ্খল লোক সঙ্গে দুইলোক নাশ।।
এত শুনি সেই বিপ্র মহা দুঃখ পাইল।
‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ কহি তথা হইতে উঠি গেল।।
প্রভুর দর্শনে শুদ্ধ হঞাছে তার মন।
প্রভু আগে দুঃখী হঞা কহে বিবরণ।।’’
‘‘শুনি মহাপ্রভু ঈষৎ হাসিয়া রহিলা।
পুনরপি সেই বিপ্র প্রভুরে পুছিলা।।
তার আগে যবে আসি তোমার নাম লইল।
সেহো তোমার নাম জানে আপনে কহিল।।
তোমার দোষ কহিতে কারে নামের উচ্চার।
চৈতন্য চৈতন্য করি কহে তিন বার।।
তিনবারে কৃষ্ণ নাম না আইল তার মুখে।
অবজ্ঞাতে নাম লয় শুনি পাই দুঃখে।।
ইহার কারণ মোরে কহ কৃপা করি।
তোমা দেখি মুখ মোর বলে ‘কৃষ্ণ হরি।।’
প্রভু কহে মায়াবাদী কৃষ্ণ-অপরাধী।
‘ব্রহ্ম’ ‘আত্মা’ ‘চৈতন্য’ কহে নিরবধি।।
অতএব তার মুখে না আইসে ‘কৃষ্ণ নাম’।
‘কৃষ্ণ নাম’ ‘কৃষ্ণ স্বরূপ’ দুইত সমান।।
নাম, বিগ্রহ, স্বরূপ, তিন একরূপ।
তিন ভেদ, নাহি, তিন চিদানন্দ-রূপ।।
দেহ দেহী, নাম নামী, কৃষ্ণে নাহি ভেদ।
জীবের ধর্ম্ম, নাম, দেহ, স্বরূপ বিভেদ।।
অতএব কৃষ্ণের নাম, দেহ, বিলাস।
প্রাকৃতেন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে হয় স্বপ্রকাশ।।
কৃষ্ণ-নাম, কৃষ্ণ-গুণ, কৃষ্ণ-লীলাবৃন্দ।
কৃষ্ণের স্বরূপ সম সব চিদানন্দ।।
বৃহ্মানন্দ হইতে পূর্ণানন্দ লীলারস।
ব্রহ্মজ্ঞানী আকর্ষিয়া করে আত্মবশ।
ব্রহ্মানন্দ হইতে পূর্ণানন্দ কৃষ্ণ-গুণ।
অতএব আকর্ষয়ে আত্মরামের মন।।
এহো সব রহু কৃষ্ণচরণ সম্বন্ধে।
আত্মারামের মন হরে তুলসীর গন্ধে।।
অতএব কৃষ্ণানাম না আইসে তার মুখে।
মায়াবাদিগণ যাতে মহাবিহির্ম্মুখে।।
ভাবকালী বেচিতে আমি আইলাম কাশীপুরে।’’
প্রভুর মনে মহাদুঃখ—কৃষ্ণ নাম কেউ করে না
গ্রাহক নাই না বিকায় লঞা যাব ঘরে।।
ভারি বোঝা লইয়া আইলাম কেমনে লঞা যাব।
অল্প স্বল্প মূল্য পাইলে এথাই বেচিব।।
এতবলি সেই বিপ্রে আত্মসাৎ করি।
প্রাতে উঠি মথুরায় চলিলা গৌরহরি।।
সেই তিন সঙ্গে চলে, প্রভু নিষেধিল।
দূর হইতে তিনজনে ঘরে পাঠাইল।।
প্রভুর বিরহে তিনে একত্রে মিলিয়া।
প্রভু-গুণ গান করে প্রেমে মত্ত হঞা।।
প্রয়াগে আসিযা প্রভু কৈল বেণী স্নান।
মাধব দেখিয়া প্রেমে কৈলা নৃত্য গান।।
যমুনা দেখিয়া প্রেমে পড়ে ঝাঁপ দিয়া।
আস্তে আস্তে ভট্টাচার্য্য উঠায় ধরিয়া।।’’
কোথা আছ প্রাণ কালিয়-দমন—এই ত হইল যমুনা দর্শন
প্রেমাবেশে ভট্টাচার্য্য—ব্যাকুল হয়ে কাঁদে রে
আপনি যে সেইশক্তি—আপনি তা জানেন না
একবার এস হে
প্রভুকে ধরি নারি—একবার এস হে
এইত তিনদিন প্রয়াগে রহিলা।
কৃষ্ণ-নাম—প্রেম দিয়া লোক নিস্তারিলা।।
মথুরা চলিতে পথে যথা রহি যায়।
কৃষ্ণ-নাম-প্রেম দিয়া লোকেরে নাচায়।।
পূর্ব্বে যৈছে দক্ষিণ যাইতে লোক নিস্তারিলা।
পশ্চিমদেশ তৈছে সব বৈষ্ণব করিলা।
পথে যাঁহা যাঁহা হয় যমুনা দর্শন।
তাঁহা ঝাঁপদিয়া পড়ে প্রেমে অচেতন।।
‘‘মথুরা নিকটে আইলা মথুরা দেখিয়া।
দণ্ডবৎ হৈঞা পড়ে প্রেমাবিট হৈঞা।।’’
মহাভাবনিধির আস্বাদনের—বালাই লয়ে মরে যাই
ব্রজভূমি শ্রীমথুরা—আপনি আস্বাদন করিছেন
জন্মস্থানে কেশব দেখি করিল প্রণাম।।
প্রেমাবেশে নাচে গায় সঘন হুঙ্কার।
প্রভুর প্রেমাবেশ দেখি লোকে চমৎকার।।
এক বিপ্র পড়ে প্রভুর চরণ ধরিয়া।
প্রভুসঙ্গে নৃত্য করে প্রেমাবিষ্ট হইয়া।।
দোঁহে প্রেমে নৃত্য করি করে কোলাকুলি।
‘‘হরি কৃষ্ণ’ কহে দোঁহে দুইবাহু তুলি।।
মথুরা আইলা কৃষ্ণ, কোলাহল হৈল।
কেশব –সেবক প্রভুকে মালা পরাইল।।
লোক কহে প্রভু দেখি হইয়া বিস্ময়।
এ রূপ এ প্রেম লৌকিক কভু নয়।
যাঁহার দর্শনে লোক প্রেমে মত্ত হৈঞা।
হাসে কাঁদে নাচে গায় কৃষ্ণ-নাম লৈয়া।।
সর্ব্বথা নিশ্চিত ইঁহা কৃষ্ণ-অবতার।
মথুরা আইলা লোকের করিতে নিস্তার।।’’
যারে দেখি লোক প্রেমে নাচে গায়—এ কি কৃষ্ণ বিনা অন্য হয়
মথুরা আইলা লোকের করিতে নিস্তার।।
তবে মহাপ্রভু সেই ব্রাহ্মণ লইয়া।
তাহারে পুছিল কিছু নিভৃতে বসিয়া।।
আর্য্য সরল তুমি বৃদ্ধ বাহ্মণ।
কাঁহা হৈতে পাইলে তুমি এই প্রেমধন।।
‘‘বিপ্র কহে শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী।
ভ্রমিতে ভ্রমিত আইলা মথুরা-নগরী।।
কৃপাকরি তেঁহো মোর নিলয়ে আইলায
মোরে শিষ্য করি মোর হাতে ভিক্ষা কৈলা।।
গোপাল প্রকট করি সেবা কৈল মহাশয়।’’
পরাণ-গৌরাঙ্গের—আনন্দ আর ধরে না
মাধবেন্দ্রপুরী-পরিচয়ে—আনন্দ আর ধরে না
যাঁহার সম্বন্ধ ধরি—সেই মাধবেন্দ্রপুরী
গোবর্দ্ধন গোপাল প্রকটকারী—সেই মাধবেন্দ্রপুরী
শুনি প্রভু কৈল তাঁর চরম-বন্দন।’’
প্রভু নিজ-সন্ন্যাসের—সম্বন্ধ জেনে কৈল মর্য্যাদ
আপনি আচরি ধর্ম্ম—আর কে বা শিখাবে
প্রভু কহে তুমি গুরু আমি শিষ্য-প্রায়।
গুরু হঞা শিষ্যে নরস্কার না যুয়ায়।।
শুনিয়া বিস্মিত বিপ্র কহে ভয় পাঞা।
ঐছে বাত কহ কেন সন্ন্যাসী হইয়া।
কিন্তু তোমার প্রেম দেখি মনে অনুমানি।
মাধবেন্দ্র-পুরীর সম্বন্ধ ধর জানি।।
কৃষ্ণপ্রেমা তাঁহা যাঁহা তাঁহার সম্বন্ধ।
তাঁহা বিনা এই প্রেমের কাঁহা নাহি গন্ধ।।’’
ভক্তিকল্প অবতরী—জয় মাধবেন্দ্রপুরী
শুনি আনন্দিত বিপ্র নাচিতে লাগিল।।’’
পেলাম,–মাধবেন্দ্রপুরীগণের দর্শন—আজ আমার শুভদিন
আপন ইচ্ছায় প্রভুর নানা সেবা করে।।
ভিক্ষা লাগি ভট্টাচার্য্য করাইল রন্ধন।
তবে মহাপ্রভু হাসি বলিল বচন।।
‘‘পুরী গোসাঞি তোমার ঠাঞি করিয়াছে ভিক্ষা।’’
সম্বন্ধে আমার পরমগুরু
যদ্যপি সনোড়িয়া হয় সেই ত ব্রাহ্মণ।
সনোড়িয়া-ঘরে সন্ন্যাসী না করে ভোজন।।
তথাপি পুরী দেখি তাঁর বৈষ্ণব-আচার।
শিষ্য করি তাঁর ভিক্ষা কৈল অঙ্গীকার।।
মহাপ্রভু তাঁরে যদি ভিক্ষা মাগিল।
দৈন্য করি সেই বিপ্র কহিতে লাগিল।।
তোমারে ভিক্ষা দিব বড়ভাগ্য সে আমার।
তুমি ঈশ্বর নাহি তোমার বিধি ব্যবহার।।
মুর্খলোক করিবেক তোমার নিন্দন।
সহিতে না পারিব সে দুষ্টের বচন।।
প্রভু কহে শ্রুতি স্মৃতি যত ঋষিগণ।
সব একমত নহে ভিন্ন মত ধর্ম্ম।
ধর্ম্ম-স্থাপন-হেতু সাধু-ব্যবহার।
পুরী গোঁসাঞির আচরণ সেই ধর্ম্মসার।।
তবে সেই বিপ্র প্রভুকে ভিক্ষা করাইল।
মধুপুরীর লোক প্রভুকে দেখিতে আইল।।
লক্ষসংখ্যা লোক আইলে নাহিক গণন।
বাহির হইয়া প্রভু দিলা দরশন।।
বাহু তুলি বলে প্রভু ‘বোল হরিহরি’।
প্রেমে মত্ত নাচে লোক হরিধ্বনি করি।।
যমুনার চব্বিশঘাটে প্রভু কৈল স্নান।
সেই বিপ্র প্রভুকে দেখায় তীর্থ-স্থান।।’’
আপনার বিহার ভূমি আস্বাদন করিছেন
মহাবিদ্যা, গোকর্ণাদি দেখেন সকল।।
বন দেখিবারে যদি প্রভুর মন হৈল।
সেই ব্রাহ্মণে প্রভু নিজ-সঙ্গে লৈল।।
‘‘মধুবন, তালবন, কুমুদ, বহুলা।
তাঁহা তাঁহা স্নান করি প্রেমাবিষ্ট হৈলা।।’’
নিজ-নাম-গুণ শুনিবার—ভোগের লাগি অবতার
গাভী দেখি স্তব্ধ প্রভু প্রেমের তরঙ্গে।
বাৎসল্যে গাভীগণ প্রভুর চাটে অঙ্গে।।’’
স্বরূপ-জাগান স্বরূপ দেখে—আজ স্বভাব জেগে উঠ্ল
গৌরঅঙ্গ চাটতে চাটতে—উনমত হয় রে
গৌরকৃষ্ণ-অঙ্গ-গন্ধ পেয়ে—উনমত হয় রে
সুস্থ হয়ে প্রভু করে অঙ্গ কণ্ডুয়ণ।
প্রভু-সঙ্গ নাহি ছাড়ে চলে ধেনুগণ।।’’
দেখতে পেয়েছে
বর্ণ-পঞ্চালিকা-ঢাকা নীলমণি—দেখতে পেয়েছে
কষ্টে সৃষ্টে ধেনু সব রাখিল গোয়াল।
প্রভু-কণ্ঠধ্বনি শুনি আইসে মৃগীপাল।।’’
বহুদিন পরে মৃগী শুনিল—পরিচিত কণ্ঠস্বর
শ্যামের বাঁশী বাজছে—মৃগীপাল শুনিছে
মৃগমৃগী মুখ দেখি প্রভু-অঙ্গ চাটে।
ভয় নাহি করে সঙ্গে যায় বাটে বাটে।।’’
শ্রীগুরুচরণ হৃদে ধরে—অনুভব কর ভাই রে
প্রাণ-গৌরাঙ্গের ব্রজবিহার—অনুভব কর ভাই রে
গোরারসের বদন হেরে—তাদের,–দুনয়নে বারি ঝরে
পিক-ভৃঙ্গ প্রভুকে দেখি পঞ্চম গায়।
শিখিগণ নৃত্য করি প্রভু-আগে যায়।।’’
তারা যে দেখছে
তাই,–আনন্দেতে নাচছে—তারা যে দেখছে
দেখি,–জড়াজড়ী কিশোরী কিশোর—তাদের,-আনন্দ আর ধরে না
রাইকানু জড়াজড়ী—অপরূপ দেখে রে
যা,–নিত্য নিভৃত-নিকুঞ্জে থাকে—আজ,–শিখিগণ দেখে প্রত্যক্ষে
আজ পথে চলে যায়
জড়জাড়ী প্রেমের মূরতি—আজ পথে চলে যায়
মধুর-শ্রীবৃন্দাবনে—আজ পথে চলেযায়
এ যে,–অপরূপ দান রে
আজ, ব্রজের পথে পথে চলে—যা ছিল নিভৃত-নিকুঞ্জেতে
প্রভু দেখে বৃন্দাবনের বৃক্ষলতাগণ।
অঙ্কুর-পুলক মধু-অশ্রু বরিষণ।।’’
তরুলতাগণ যেন—অশ্রু বরিষণ করে
দেখি গৌর পুলক-ছলে—অশ্রু বরিষণ করে
মধুধারা-ছলে যেন—অশ্রু বরিষণ করে
এতদিন কোথা ছিল বলে—অশ্রু বরিষণ করে
ফুলফলে ভরি ডাল পড়ে প্রভু-পায়।
বন্ধু দেখি বন্ধু যেন ভেট লঞা যায়।।’’
বহুদিন পরে দেখা পেলাম বলে—লুটায়ে পড়ে পদতলে
প্রভু দেখি বৃন্দাবনের স্থাবর-জঙ্গম।
আনন্দিত বন্ধু যেন দেখে বন্ধুগণ।।
তা সবার প্রীতি দেখি প্রভু ভাবাবেশে।
সবা-সঙ্গে ক্রীড়া করে হঞা তার বশে।।
প্রতি-বৃক্ষ-লতা প্রভু করে আলিঙ্গন।’’
বৃন্দাবনের তরুলতা—কখনও কি পেয়েছে
জড়াজড়ী-মূরতিতে আলিঙ্গন—কখনও তো পায় নাই
পুষ্প-আদি ধ্যানে করেন কৃষ্ণে সমর্পণ।।
অশ্রু-কম্প-পুলক-প্রেমে শরীর অস্থিরে।
‘কষ্ণ বোল’ ‘কৃষ্ণ বোল’ বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
স্থাবর জঙ্গম মিলি করে কৃষ্ণধ্বনি।
প্রভুর গম্ভীর স্বরে যেন প্রতিধ্বনি।।
মৃগের গলা ধরি’ প্রভু করেন ক্রন্দন।’’
প্রাণ-বঁধুকে—অন্বেষিতে এসেছে ব্রজে—বিরহিনী গৌরকিশোরী
মৃগের পুলক অঙ্গ অশ্রু নয়ন।।
বৃক্ষডালে শুকশারী দিল দরশন।
তা’ দেখি প্রভুর কিছু শুনিতে হইল মন।।
শুকশারিকা প্রভুর হাতে উড়ি পড়ে।
প্রভুকে শুনাঞা কৃষ্ণের গুণ শ্লোক পড়ে।।
শুকবাক্য শুনি শারী করে রাধিকা বর্ণন।
পুনঃ শুক কহে কৃষ্ণ মদনমোহন।
পুনঃ শারী কহে শুকে করি পরিহাস।
এত শুনি প্রভুর হৈল বিস্ময় প্রেমোল্লাস।।
শুকশারী উড়ি পুনঃ গেল বৃক্ষ-ডালে।
ময়ূরের নৃত্য প্রভু দেখে কুতূহলে।।
ময়ূরের কণ্ঠ দেখে কৃষ্ণ-স্মৃতি হৈলা।
প্রেমাবেশে মহাপ্রভু ভূমিতে পড়িলা।।’’
মহাভাবনিধি—গৌরাঙ্গ আমার
বিরহিনী-কিশোহী-গৌরাঙ্গ আমার
বিরহিণী-কিশোরী-আবেশে—পাগল হয়ে প্রভু ধায়
এতক্ষণে লুকাইয়ে—প্রাণবঁধু তুমি ছিলে কোথায়
ব্রজবনে গৌর-কিশোরী—খুঁজে খুঁজে বেড়াইছে
প্রভুকে মূর্চ্ছিত দেখি সে ত ব্রাহ্মণ।
ভট্টাচার্য্য-সঙ্গে করে প্রভুর সন্তর্পণ।।
আস্তে ব্যস্তে মহাপ্রভুর লঞা বহির্ব্বাস।
জল সেক করে অঙ্গে বস্ত্রের বাতাস।।
প্রভুর কর্ণে কৃষ্ণ নাম করে উচ্চ করি।
চেতন পাইয়া প্রভু যান গড়াগড়ি।।’’
বয়ান ভাসে নয়ন-জলে—বলে,–দেকা দিয়ে কোথা লুকালে
ভট্টাচার্য্য কোলে করি প্রভু সুখ কৈল।।’’
বলভদ্র-ভট্টাচার্য্য—ব্যাকুল হয়ে ডাকে রে
কোথায় আছ প্রাণের নিতাই
প্রাণ-নিতাই কোথায় আছ
প্রেমোন্মত্ত্-গৌরাঙ্গে রাখ—প্রাণ-নিতাই কোথায় আছ
আমি রক্ষা করিতে নারি—আসি প্রভুকে রক্ষা কর
কৃষ্ণাবেশ প্রভুর প্রেমে গরগর মন।
‘বোল’ ‘বোল’ করি উঠে করেন নর্ত্তন।।
ভট্টাচার্য্য সেই বিপ্র কৃষ্ণনাম গায়।
নাচিতে নাচিতে প্রভু পথে চলি যায়।।
প্রভু-প্রেমাবেশে দেখি ব্রাহ্মণ বিস্মিত ।
প্রভু রক্ষা লাগি বিপ্র হইলা চিন্তিত।।
নীলাচলে ছিলা যৈছে প্রেমাবেশ মন।
বৃন্দাবন যাইতে পথে হৈল শতগুণ।।
সহস্রগুণ বাড়ে মথুরা দর্শনে।
লক্ষগুণ প্রেম বাড়ে ভ্রমে যবে বনে।।’’
প্রেমাবতার গৌর আমার—ভ্রমিছেন বনে বনে
সেবক নিত্যানন্দ বিনে—আর,–প্রেমের ভার কেবা ধরবে
অন্যদেশে প্রেম উছলে বৃন্দাবন-নামে।
সাক্ষাৎভ্রময়ে এবে সেই বৃন্দাবনে।।’’
গৌররূপে বংশীধারী—আস্বাদিছে ব্রজমাধুরী
স্নান-ভিক্ষাদি নির্ব্বাহ করে অভ্যাসে।।
এইমত প্রেম যাবৎ ভ্রমিলা বার-বন।
একত্র লিখিল সর্ব্বত্র না যায় বর্ণন।।
বৃন্দাবনে হৈল প্রভুর যতেক বিকার।
কোটি-গ্রন্থে অনন্ত লিখে তাহার প্রকার।।
তবু লিখিবারে নারে তার এককণ।
উদ্দেশ করিতে করি দিগ্-দরশন।।
জগৎ ভাসিল চৈতন্য-লীলার পাথারে।
যার যত শক্তি তত পাথারে সাঁতারে।।
এই মত মহাপ্রভু নাচিতে নাচিতে ।
আরিট-গ্রামে আসি বাহ্য হৈল আচম্বিতে ।।
আরিটে রাধাকুণ্ড-বার্ত্তা পুছে লোক-স্থানে।
কেহ নাহি কহে সঙ্গের ব্রাহ্মণ না জানে।।
তীর্থলুপ্ত জানি সর্ব্বজ্ঞ ভগবান।
দুই ধান্যক্ষেত্রে অল্পজলে কৈল স্নান।।
প্রেমে প্রভু করে রাধাকুণ্ডের স্তবন।।
সব গোপী হইতে রাধা কৃষ্ণের প্রেয়সী।
তৈছে রাধাকুণ্ড প্রিয় প্রিয়ার সরণী।।
যেই কুণ্ডে নিত্য কৃষ্ণ রাধিকার সঙ্গে।
জলে জলকেলি করে তীরে রাসরঙ্গে।
সেইকুণ্ডে যেই একবার করে স্নান।
তারে রাধাসম প্রেম কৃষ্ণ করে দান।।
কুণ্ডের মাধুরী যেন রাধা মধুরিমা।।
কুণ্ডের মহিমা যেন রাধার মহিমা।।
এইমত স্তুতি করে প্রেমাবিষ্ট হঞা।
তীরে নৃত্য করে কুণ্ডলীলা স্মরিয়া।
কুণ্ডের মৃত্তিকা লয়ে তিলক করিল।
ভট্টাচার্য্য সেই মৃত্তিকা সঙ্গে কিছু লৈল।।’’
তবে চলি আইলা প্রভু সুমন-সরোবরে।
গোবর্দ্ধন দেখি তাঁহা হৈল বিহ্বলে।।
গোবর্দ্ধন দেখি প্রভু হৈলা দণ্ডবৎ।
এক শিলা আলিঙ্গিয়া হইলা উন্মত্ত।।
প্রেমে মত্ত চলি আইলা গোবর্দ্ধন-গ্রাম।
হরিদেব দেখি তাঁহা করিল প্রণাম।।
মথুরা-পদ্মের পশ্চিমদলে যাঁর বাস।
হরিদেব নারায়ণ আদি পরকাশ।।
হরিদেব আগে নাচে প্রেমে মত্তহঞা।
লোক সব দেখিতে আইসে আশ্চর্য্য শুনিয়া।
প্রভুর প্রেম সৌন্দর্য্য দেখি লোকে চমৎকার।
হরিদেবের ভৃত্য প্রভুর করিল সৎকার।।
ভট্টাচার্য্য ব্রহ্মকুণ্ডে পাক যাঞা কৈল।
ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করি প্রভু ভিক্ষা লৈল।।
সে রাত্রে রহিলা হরিদেবের মন্দিরে।
রাত্রে মহাপ্রভু করেমনেতে বিচারে।।
গোবর্দ্ধন-উপরে আমি কভু না চড়িব।
গোপাল-দেবের দরশন কেমনে পাইব।।
এত মনে করি প্রভু মৌন ধরি রহিলা।
জানি গোপাল ম্লেচ্ছ-ভয়-ভঙ্গী উঠাইলা।।
অন্নকূটনাম-গ্রামে গোপালের স্থিতি।
রাজপুত লোকের সেই গ্রামেতে বসতি।।
একজন আসি রাত্রে গ্রামিকে কহিল।
তোমার গ্রাম মারিতে তুড়ুকধারী সাজিল।।
আজি রাত্রে পালাও গ্রামে না রহ একজন।
ঠাকুর লইয়া ভাগ আসিবে কালযবন।।
শুনিয়া গ্রামের লোক চিন্তিত হইল।
প্রথমে গোপাল লঞা গাঁঠুলী গ্রামে থুইল।।
বিপ্রগৃহে গোপালের নিভৃতে সেবন।
গ্রাম উজাড় হৈল পলাইল সর্ব্বজন।।
ঐছে ম্লেচ্ছভয়ে গোপাল ভাগে বারে বারে।
মন্দির ছাড়ি কুঞ্জে রহে কিবা গ্রামান্তরে।।
প্রাতঃকালে প্রভু মানস-গঙ্গায় করি স্নান।
গোবর্দ্ধন পরিক্রমায় করিলা প্রয়াণ।।
গোবর্দ্ধন দেখি প্রভু প্রেমাবিষ্ট হৈয়া।
নাচিতে নাচিতে চলিলা শ্লোক পড়িয়া।।
গোবিন্দকুণ্ডাদি-তীর্থে প্রভু কৈল স্নান।
তাঁহাই শুনিল গোপাল গেল গাঁঠলী-গ্রাম।।
সেই গ্রামে গিয়া কৈল গোপাল দর্শন।
প্রেমাবেশে প্রভু করে কীর্ত্তন-নর্ত্তন।।
গোপালের সৌন্দর্য্য দেখি প্রভুর আবেশ।
এই শ্লোক পড়ি নাচে হৈল দিন শেষ।।
এই মত তিন দিন গোপাল দেখিলা।
চতুর্থ দিবসে গোপাল মন্দিরে আইলা।।
গোপাল-সঙ্গে চলি আইলা নৃত্যগীত করি।
আনন্দ-কোলাহলে লোক বলে ‘হরি হরি’।।
গোপাল মন্দিরে গেলা প্রভু রহিলা তলে।
প্রভুর বাঞ্ছা পূর্ণ সব করিল গোপালে।।
এইমত গোপালের করুণ-স্বভাব।
যেই ভক্তজনের দেখিতে হয় ভাব।।
দেখিতে উৎকণ্ঠা হয় না চড়ে গোবর্দ্ধনে।
কোন-ছলে গোপাল উত্তরে আপনে।।
কভু কুঞ্জে রহে কভু গ্রামান্তরে।
সেই তাঁহা আসি দেখয়ে তাঁহারে।।
পর্ব্বতে না চড়ে দুই রূপ-সনাতন।
এইরূপে তাঁ’ সবারে দিয়াছেন দর্শন।।
বৃদ্ধকালে রূপ গোঁসাই না পারে যাইতে।
বাঞ্ছা ছিল গোপালের সৌন্দর্য্য দেখিতে।।
ম্লেচ্ছ ভয়ে আইলা গোপাল মথুরা—নগরে।
একমাস রহিল বিটঠলেশ্বর-ঘরে।।
তবে রূপ গোঁসাঞি সব নিজগণ লঞা।
একমাস দর্শন কৈল মথুরা রহিঞা।।
সঙ্গে গোপালভট্ট দাসরঘূনাথ।
শ্রীরঘুনাথভট্ট গোঁসাঞ লোকনাথ।
ভূগর্ভ গোঁসাঞি আর শ্রীজীব গোঁসাঞি।
শ্রীযাদব আচার্য্য আর গোবিন্দ গোঁসাঞি।।
শ্রীউদ্ধব দাস আর মাধব দুইজন।
শ্রীগোপাল দাস আর দাস নারায়ণ।।
গোবিন্দ-ভকত আর রাণী কৃষ্ণদাস।
পুণ্ডরীকাক্ষ ঈশান আর লঘু হরিদাস।।
এই সব মুখ্যভক্ত লঞা নিজে-সঙ্গে।
শ্রীগোপাল দরশন কৈল বহুরঙ্গে।।
একমাস রহি গোপাল গেল নিজ-স্থানে।
শ্রীরূপ গোঁসাঞি আইলা শ্রীবৃন্দাবনে।।
প্রস্তাবে কহিল গোপাল-কৃপালু-আখ্যান।
তবে মহাপ্রভু গোলা শ্রীকাম্যবনে।।
প্রভুর গমন রীতি পূর্ব্বে যে লিখিল।
সেই মত বৃ্ন্দাবনে যাবৎ দেখল।।
তাঁহা লীলাস্থলী দেখি গেলা নন্দীশ্বর।
নন্দীশ্বর দেখি প্রেমে হইল বিহ্বল।।
লোকেরে পুছিল পর্ব্বত-উপরে যাইয়া।।
কিছু দেব মূর্ত্তি হয় পর্ব্বত-উপরে।
লোকে কহে মূর্ত্তি হয় গোফার ভিতরে।।
দুইদিকে মাতাপিতা পুষ্ট কলেবর।
মধ্যে এক হয় শিশু ত্রিভঙ্গ-সুন্দর।।
শুনি মহাপ্রভ মনে আনন্দ পাইয়া।
তিন মূর্ত্তি দেখিলা সেই গোফা উঘারিয়া।।
ব্রজেন্দ্র-ব্রজেশ্বরীর কৈল চরণ-বন্দন।
প্রেমাবেশে কৃষ্ণের কৈল সর্ব্বাঙ্গ স্পর্শন।।
সব-দিন প্রেমাবেশে নৃত্য-গীত কৈল।
তাঁহা হৈতে মহাপ্রভু খদির-বন অইলা।।
লীলাস্থল দেখি তঁহা গেলা শেষশায়ী।
লক্ষ্মী দেখি এই শ্লোক পড়েন গোঁসাঞি।।
তবে খেলাতীর্থ দেখি ভাণ্ডীর-বন আইলা।
যমুনাতে পারহঞা ভদ্রবন গেলা।।
শ্রীবন দেখি পুনঃ গেলা লৌহবন।
মহাবন গিয়া জন্মস্থান দরশন।।
যমলার্জ্জুন-ভঙ্গাদি দেখিল সেই-স্থল।
প্রেমাবেশে প্রভর মন হৈল টলমল।।
গোকুল দেখিয়া আইলা মথুরা-নাগরে।
জন্মস্থান দেখি রহে সেই বিপ্রঘরে।।
লোকের সংঘট্ট দেখি মথুরা ছাড়িয়া।
একান্তে অক্রূরতীর্থে রহিল আসিয়া।।’’
ব্রজমাধরী আস্বাদিতে—প্রভু ভ্রমে ব্রজবনে
ব্রজবন ভ্রমণ করি—অক্রূরতীর্থে আইলা গৌরহরি
শ্রীমহাপ্রভুর বিশ্রামস্থান—এই সেই অক্রূরতীর্থ
ব্রজবনে ভ্রমি শ্রান্ত হয়ে—মহাপ্রভুর বিশ্রামস্থান
পূণ্যভূমি অক্রূরতীর্থ—মহাপ্রভুর বিশ্রামস্থান
পরাণ-গৌরাঙ্গ-বিহার—যেন,–প্রাণে প্রাণে ভোগ করিতে পারি
‘পরাণ-গৌরাঙ্গ-বিহার’—
এই মধুর-ব্রজবনে-পরাণ-গৌরাঙ্গ-বিহার
কেবল আস্বাদনের লাগি—মধুর গৌরাঙ্গ-লীলা
লীলাস্থলী ভোগ করে—ব্রজবনে গৌর বিহরে
গুরু-চরণ হৃদে ধরে—অনুভব কর ভাই রে
প্রেমাবতার গৌর আমার—কেবল,–ভোগের লাগি অবতার
গৌরাঙ্গ-রূপ ধরে—অশেষ-বিশেষে ভোগ করে
নাম-রূপ-গুণ-লীলা—অশেষ-বিশেষে ভোগ করে
কেবল,–ভোগের লাগি অবতার—রাধা,–ভাবদ্যুতি-সুবলিত
ব্রজলীলা ভোগ করি
প্রাণের প্রাণ গৌরাঙ্গের—ব্রজলীলা ভোগ করি
শ্রীগুরু-চরণ হৃদে ধরি—ব্রজলীলা ভোগ করি
ভোগের লীলা ভোগ করে—শ্রীগুরু-চরণ হৃদে ধরে
আজ প্রাণ কেঁদে উঠছে
তখন জনম হয় নাই মোদের
সকল-সুখেই বঞ্চিত মোরা
দেখিলেও পাই নাই মোরা
প্রাণ-গৌরাঙ্গের,–প্রেম-পুরুষোত্তম-লীলা—দেখিতেও পাই নাই মোরা
স্থাবর-জঙ্গম,–প্রেমোনমত্তকারী-লীলা—দেখিতেও পাই নাই মোরা
প্রাণগৌরাঙ্গের,–পাষাণ-গলান-লীলা—দেখিতেও পাই নাই মোরা
প্রাণগৌরাঙ্গের,–কীর্ত্তন-নটন-লীলা—দেখিতেও পাই নাই মোরা
সেই,–লীলা-অদর্শনে-শেল—নিশিদিশি জ্বলছে হিয়া
ভাই ভাই মিলে আসি ছুটে
শ্রীগুরুদেবের কৃপা-প্রেরণায়—ভাই ভাই মিলে আসি ছুটে
সেই আশায় বুক বেঁধে—ভাই ভাই মিলে আসি ছুটে
ত্রিকাল-সত্য প্রাণ-গৌর-লীলা
ভাই ভাই মিলে যাই ছুটে
এসেছি বড় আশা করে
প্রাণ-গৌরাঙ্গের,–ত্রিকাল-সত্য-লীলা জেনে—এসেছি বড় আশা করে
প্রভুর গণের কৃপা-আকর্ষণে—এসেছি বড় আশা করে
এই,–ভাগ্যবান অক্রূর-তীর্থে—প্রভু,–আজ তোমার আসবার তিথি
হা গৌর প্রাণ গৌর—নিশ্চয় এসেছ তুমি
তোমার,–ত্রিকাল-সত্য-লীলায়—নিশ্চয় এসেছ তুমি
শতশত,–নরনারী এই দুর্গমবনে—এসেছে কার আকর্ষণে
তারা,–দেহ-গেহ—স্বভাব ভুলে—এসেছে কার আকর্ষণে
একবার দেখা দাও
হা গৌর প্রাণ গৌর—একবার দেখা দাও
আমরা,–পেয়েছি তার নিদর্শন—নিশ্চয় এসেছ তুমি
সুদূর-নীলাচল হতে—এসেছেন শ্রীমহাপ্রসাদ
তোমার,–প্রতাপরুদ্রের প্রীতে এসেছেন শ্রীমহাপ্রসাদ
তোমার,–ত্রিকালসত্য-লালায়—জেনেছেন প্রাণে প্রাণে
নীলাচলে বসে প্রতাপরুদ্র—জেনেছেন প্রাণে প্রাণে
প্রভু,–তুমি উপনীত বৃন্দাবনে—জেনেছেন প্রাণে প্রাণে
গৌরপ্রিয়গণের সরঙ্গে—পাঠায়েছেন অতি-প্রীতে
সুদূর-নীলাচল হতে—পাঠায়েছেন অতি-প্রীতে
আজ একবার দেখা দাও
তোমার প্রতাপরুদ্রের প্রীতে—আজ একবার দেখা দাও
মহাপ্রসাদ-অঙ্গীকার-ছলে—আজ একবার দেখা দাও
কোথা ওহে,-সীতানাথের আনানিধি—একবার দাঁড়াও রসের বদন হেরি হে
কোথা ওহে,–নদীয়া-বিনোদিয়া—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–প্রাণ-শচীদুলালিযা—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–শ্রীবাসাঙ্গনের নাটুয়া–একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,-গদাধরের প্রাণবঁধুয়া—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–নরহরির চিতচোর—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–রাজা প্রতাপরুদ্রের ত্রাণকারী—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–সার্ব্বভৌমের চৈতন্যদাতা—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–প্রকাশানন্দের নয়নানন্দ—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–রামরায়ের চিতচোর—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–স্বরূপের সর্ব্বস্বনিধি—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–শ্রীরূপ-হৃদকেতন—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–শ্রীসনাতনের গতিদাতা—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–লোকনাথের হৃদ্বিহারী—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–শ্রীগোপালভট্টের পরাণ—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–রঘুনাথভট্টের প্রাণারাম—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–শ্রীজীব-জীবন গোরা—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–ভূগর্ভের প্রাণ-গৌরাঙ্গ—একবার দাঁড়াও
কোথা ওহে,–দাসরঘুনাথের সাধনের ধন—একবার দাঁড়াও
নিতাই-পাগল-করা গোরা—একবার,–দাঁড়াও রসের বদন হেরি হে
হা গৌর প্রাণ গৌর—একবার দেখা দাও
প্রাণগৌর তোমায় হেরি—সকল-দুঃখ পাসরি
ভাই ভাই ভাই মিলে—পাগল হয়ে বেড়াই মোরা
হা,–চিতচোরা প্রাণগোরা—পাগল হয়ে বেড়াই মোরা
তোরা,–দেখ্বি যদি আয় ত্বরা করি
ওগো ও ব্রজবাসী নরনারী—তোমরা,–তোরা,–দেখবি যদি আয় ত্বরা করি
দেখবি আয় ত্বরা করি—নাম ধরেছে গৌরহরি
রাইসম্পুটে বংশীধারী—নাম ধরেছে গৌরহরি
আজ ব্রজবনে বিহরে
হয়ে,–রাই কানু একধারে—আজ ব্রজবনে বিহরে
প্রাণভরে গাই সবে
গুরু-দত্ত-নাবাবলী—প্রাণভরে গাই সবে
সাধ্য-সাধন-নির্ণয়করা নাম—প্রাণভরে গাই সবে
জপ হরে কৃষ্ণ হরে রাম।।’’
গৌর-হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল হরিবোল।।
শ্রীগুরু-প্রেমানন্দে নিতাই-গৌর-হরিবোল।।’’