যমুনা কিনারে

সখি অবলম্বনে চলবি নিতম্বিনি

সখি অবলম্বনে চলবি নিতম্বিনি
থম্ভবি থম্ভ সমীপে।
জব হরি করে ধরি কোর বইসাওব
আঁচরে চোরায়বি দীপে।।
সখি মান ন রহত উদাসে।
সত সম্ভসে ন বচন পরগাসব
জেহন কৃপন অসোয়াসে।।
লহু লহু হসি হসি মুহু মুখ মোড়বি
দসন দেখাওব হাসে।
বদন আধ বিনু সাধ ন পূরব
কুচ দরসাওব পাসে।।
বহুবিধ আদরে পহুক কাতর লখি
বৈমুখী বইসব বামে।
করে কর ঠেলব আলিঙ্গন বারব
সেজ তেজি বইসব ঠামে।।
করে কর জোরি মোরি তনু উঠব
অম্বর সম্বরি পীঠে।
ভনই বিদ্যাপতি উতকট সঙ্কট
উপজায়ব তুহুঁ দীঠে।।

অন্তঃকথন:
কেমন করে মাধব মিলনে যাবেন শ্রীমতী, ঠিক কোন কলায় রাই জয় করে নিতে পারবেন মাধবকে সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন সখীরা! গুরু নিতম্বিনী আমাদের শ্রীমতীকে সখীরা বলছেন, হে নিতম্বিনী তুমি যখন প্রিয়মিলনে যাবে তখন একা যাবে না, কোন সখীকে অবলম্বন করে তবেই মিলন কুঞ্জ অবধি যাবে। আর সেই মিলন মন্দিরে প্রবেশ করেই যেন নির্লজ্জের মত সোজা মাধবের কাছে চলে যেও না! শয়নগৃহে প্রবেশ করে, স্তম্ভের পাশে শ্তম্ভবৎ দাঁড়িয়ে থাকবে। হরি তখন নিজে এসে হাতে ধরে তোমায় কোলে বসাবেন, মনে করে তখন কিন্তু আঁচল দিয়ে দীপ আড়াল করো। মিলনে উজ্জ্বল আলোয় নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে নেই যে! সখী উদাসিনী হয়ে, নিজেকে বিলিয়ে দিলে মান থাকে না, একথা মনে রেখো। তাই হরি আমাদের শত কথা বললেও তুমি যেন সহজে কথা বোলো না, কৃপণ যেমন সহজে আশ্বাস দেয় না, তেমন করেই নীরব থাকবে! মাধবের কথার উত্তরে মৃদু মৃদু হেসে বারবার মুখ ফিরিয়ে নেবে, দেখো তোমার হাসিতে যেন দশনপংক্তি ইষৎ উন্মুক্ত হয়, তাহলেই হরি আকৃষ্ট হবেন বেশি করে। ভুলেও যেন সম্পূর্ণ আনন দেখিয়ে মাধবের সাধ পূর্ণ করে দিয় না, অর্ধবদন দেখিয়ে হরির আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তুলো কুচযুগেরও কেবল পার্শ্বদেশটুকুই দেখাবে। সাধ কখনো পূর্ণ করবে না! বহুবিধ আদর করে প্রভু যখন কাতর হয়ে উঠবেন তখন মুখ ফিরিয়ে তাঁর বাঁদিকে গিয়ে বসবে। আর তখন তিনিই তোমায় আলিঙ্গন করতে এলে হাত দিয়ে মাধবের হাত ঠেলে দিয়ে আলিঙ্গন নিবারণ করবে। শয্যা ত্যাগ করে মাটিতে বসবে। করে কর যুক্ত করে শরীর মুচড়ে পিঠের কাপড় সামলাবে! এ অঙ্গভঙ্গীতে হরি পাগল না হয়ে পারবেন না, সেই জন্যই তো সখীরা এমন শিক্ষা শ্রীমতীকে দিচ্ছেন! বিদ্যাপতিও সখীদের মতোই রাইকে শিক্ষা দিয়ে বলছেন, এসবের পাশাপাশি তুমি নয়নের দৃষ্টিবাণ হেনে আমাদের মাধবের মনে উৎকট সঙ্কট সৃষ্টি কোরো। এই সখীশিক্ষার পদগুলি আসলে মানব প্রেম মনস্তত্ত্বের নিগূঢ় কথার সাবলীল বহিঃপ্রকাশ। মিলনকে সার্থক করে তুলতে, মিলনকে উদযাপন করার পূর্বপ্রস্তুতি এই সকল ছলা কলা।এ ভিন্ন মিলন পূর্ণতা পায় না। এই বাস্তব জীবন বোধ থেকেই কবি বিদ্যাপতি রচনা করেছেন এই সকল পদ তা আমাদের বুঝতে ভুল হয় না!

পদকর্তা:বিদ্যাপতি
রাগ:অজ্ঞাত
তাল:অজ্ঞাত
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী