যমুনা কিনারে

সুরুজ সিন্দুর বিন্দু চাঁদনে লিখএ ইন্দু

সুরুজ সিন্দুর বিন্দু চাঁদনে লিখএ ইন্দু
তিথি কহি গেলি তিলকে।
বিপরিত অভিসার অমিয় বরিস ধার
অঙ্‌কুস কএল অলকে।।
মাধব ভেটলি পসাহনি বেরী।
আদর হেরলক পুছিও ন পুছলক
চতুর সখী জন মেরী।।
কেতকিদল দএ চম্পকফুল লএ
কবরিহি থোএলক আনী।
চন্দনে কুঙ্‌কুমে অঙ্গরুচি কএলক
সময় নিবেদ সয়ানী।।
ভনই বিদ্যাপতি সুনহ অভয়মতি
কুহূ নিকট পরিমানে।
রাজা সিবসিংঘ রূপনরাএন
লখিমা সেই বিরমানে।।

অন্তঃকথন:
শ্রীমতীর অভিসার বার্তা সখী মাধবের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন! সকল লোকের মাঝে সঙ্কেতে রাধিকা সখীকে জানিয়েছেন তিনি কখন কোথায় মাধব মিলনে যাবেন, সে সঙ্কেত বড় সহজ সঙ্কেত নয়! একমাত্র দূতীই সে কথা বুঝেছেন। এখন সখী দূতী হয়ে মাধবের কাছে এসে বলছেন, রাধিকা সিন্দুর বিন্দুতে সূর্য্য আর চন্দনে চাঁদের কথা বুঝিয়ে তিলকের মাধ্যমে অভিসার তিথির কথা ব্যক্ত করেছেন! অর্থাৎ চোদ্দটি তিলকবিন্দুর দ্বারা চন্দ্র-সূর্য হীন কৃষ্ণা চতুর্দশীর কথা বলেছেন! সখী বলছেন, বিপরীত অভিসার অমৃতের ধারা বর্ষণ করে! আসলে পরকীয়া অভিসারে তো নায়িকার গৃহে নায়কের আসা সম্ভব হয় না, তাই নায়িকাকেই অতি গোপনে অভিসার যাত্রায় যেতে হয়! নায়িকা কোন নির্দিষ্ট স্থানে নায়ককে আহ্বান করেন! তাই দূতী একে বিপরীত অভিসার বলছেন! রোমাঞ্চকর বলেই এ অভিসার অমৃতের মত মধুময়! সখী বলছেন, শ্রীমতী তাঁর কৃষ্ণবর্ণ অলককে অঙ্কুশ করে মদনকে দমনের জন্য অঙ্কুশরূপ মাধবকে আসার ইঙ্গিত করেছেন! দূতী বলছেন, মাধব! রাধিকার প্রসাধন বেলায় তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হোল, চতুরা সখীরা তাঁকে তখন ঘিরে ছিল। তাই রাধিকা আমার পানে সাদরে দৃষ্টিপাত করলেও কোন কথা জিজ্ঞেস করে উঠতে পারল না! কেবল কেতকী আর চম্পক ফুল সে কবরীতে রাখলো আর চন্দনে কুঙ্কুমে অঙ্গরাগ করে চতুরা আমার অভিসারের সময় জানালো! কৃষ্ণ কবরীতে কেতকী আর চম্পক রাখার অর্থ এই যে অন্ধকার রজনীতে কেতকী আর চাঁপা ফুল ফোটার সময়ে মাধব যেন আমার জন্য অপেক্ষা করেন! কেতকী আর চাঁপার বর্ণের সঙ্গে চন্দন ও কুঙ্কুমের বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বলছেন এর মধ্যে অভিসার স্থানের সঙ্কেতও বিদ্যমান। কুঙ্কুমের অঙ্গরাগে শ্রীমতী কেশরকুঞ্জের কথা বলতে চেয়েছেন! যদিও খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও বিমানবিহারী মজুমদার ‘চন্দনে কুঙ্কুমে’ এর জায়গায় ‘মৃগমদকুঙ্কুমে’ পাঠ গ্রহন করেছেন। তাঁদের বক্তব্য ‘মৃগমদকুঙ্কুম’ কৃষ্ণবর্ণের, তাই এর মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাত্রির কথা বোঝানো হয়েছে! হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই যুক্তি খণ্ডন করে বলছেন ‘বলা বাহুল্য কুঙ্কুমের বর্ণ কৃষ্ণ নয়’। প্রাচীন হাতে লেখা পদাবলীর ক্ষেত্রে এই জাতীয় পাঠভেদ হয়েই থাকে। পাঠভেদ যাই হোক সঙ্কেতে শ্রীমতী ঘোর অন্ধকার রাত্রিতে লোকচক্ষুর নজর বাঁচিয়ে মাধবকে অভিসারে আমন্ত্রণ করেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই! পদের শেষে বিদ্যাপতি মাধবকে আশ্বাস দিয়ে বলছেন, সুনহ অভয়মতি, কুহূ রজনী অর্থাৎ অমাবস্যা নিকটেই, কাজেই, শ্রীমতীর সঙ্গে তোমার মিলনেও আর বেশি দেরি নেই। রসজ্ঞ সমালোচকরা বলছেন অভয়মতি হয়ত কোন রাজ আমাত্য বা কবির কোন বিশেষ বন্ধুর নামও হতে পারে! সবশেষে রাজ সভাকবি বিদ্যাপতি রাজার জয়গান গেয়ে বলেছেন , রাজা শিবসিংহ রূপনারায়ণ লখিমাদেবীর বল্লভ!

পদকর্তা:বিদ্যাপতি
রাগ:অজ্ঞাত
তাল:অজ্ঞাত
সংকলন:দেবহূতি সরকার

সন্ধিনী