বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত প্রাচীন পুরাণগুলি থেকে উপাদান নিয়ে রচিত এক বিরাট লৌকিক কাব্য কাহিনী। এ কাব্যের অপৌরাণিক অংশ কোনও খানেই এর পৌরাণিক গুরুত্বকে তরল হতে দেয়নি। বৌদ্ধ চর্যাপদগুলি ছাড়া আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যেটুকু সাহিত্যকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা তাদের মধ্যে প্রাচীনতম বলেই মনে করা হয়। এ কাব্যের রচনাকাল আনুমানিক ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ। সমস্ত কাব্যটি মোট ১৩টি খণ্ডে বিভক্ত।। জন্মখণ্ড, তাম্বূলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, যমুনান্তর্গত কালীয়দমনখণ্ড, যমুনান্তর্গত বস্ত্রহরণখণ্ড, যমুনান্তর্গত হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহখণ্ড। এখানে এক এক করে প্রতিটি খণ্ডের নিবিড়পাঠ নেওয়া গেল।

বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ডের নাম ‘তাম্বুলখণ্ড’। মূল পাণ্ডুলিপিতে এই খণ্ডটি শুরু হয়েছে ৫ নম্বর পাতার দ্বিতীয় শ্লোক থেকে, শেষ হয়েছে ১৫ নম্বর পাতার দ্বিতীয় শ্লোকে। তবে ৯ নম্বর পাতাটি (৯/১, ৯/২- দুটি শ্লোক) পাওয়া যায়নি।

রাধা প্রতিদিন পসরা সাজিয়ে সখীদের সঙ্গে মথুরার হাটে যান দুধ-দই বেচতে। সঙ্গে যায় বড়াই। একদিন মথুরার পথে বনের মধ্যে দিয়ে সখীদের সঙ্গে রঙ্গ পরিহাস করতে করতে অনেকটা পথ এগিয়ে এসে যখন তিনি বকুলতলার কাছে পৌঁছেছেন, তখন হঠাৎ খেয়াল করলেন বড়াই সঙ্গে নেই, পিছিয়ে পড়েছে। বড়াইকে না দেখে বিহ্বল রাধা বকুলতলাতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

এদিকে পথ হারিয়ে বড়াই বনের মধ্যে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বৃন্দাবনের মাঝামাঝি এসে পড়েছে। সেখানে সে তার নাতি, কৃষ্ণের দেখা পেয়ে গেল। কৃষ্ণ তখন লাঠি হাতে গোরু চরাচ্ছিলেন। কৃষ্ণকে দেখে বড়াই তখন তাঁর কাছে বনের মধ্যে মথুরায় যাওয়ার পথে হারিয়ে যাওয়া নাতনি, ‘চন্দ্রাবলী’র সন্ধান জানতে চাইলো। কিন্তু কৃষ্ণ বড়াইয়ের নাতনি ‘চন্দ্রাবলী’কে চিনবেন কি করে? বড়াই তখন কৃষ্ণের কাছে রাধার রূপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে লাগলো – রাধিকার চুলের মধ্যে সিন্দুর শোভা পাচ্ছে, যেন কালো মেঘের মধ্য দিয়ে সূর্য উঠছে। স্বর্ণপদ্মের মতো তাঁর বিমল মুখের দ্যুতি দেখে চাঁদ দু’ লক্ষ যোজন দূরে চলে গেছে। সেই অনুপম রমণী মুনি-মনমোহিনী, পদ্মিনী, সে আমার নাতনি, নাম তার রাধা। তাঁর ললিত চুলের কান্তি দেখে তমাল কলিকাগুলি লজ্জায় বনবাসী হয়েছে। তাঁর কাজল-শোভিত অলস নয়ন দেখে নীলপদ্ম জলের তলায় তপস্যায় বসেছে। শঙ্খ তার কন্ঠদেশ দেখে দ্রুত সাগরে প্রবেশ করেছে। তার অতি মনোহর স্তনযুগল দেখে পাকা ডালিম অভিমানে বিদীর্ণ হয়েছে। তার কটিদেশ ক্ষীণ, নিতম্ব গুরুভার, তার ধীর গমন মত্ত রাজহংসের গমনকেও জয় করে। দিনে দিনে তার এই যৌবন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাধার রূপের এই রকম বর্ণনা শুনে নিদারুণ কুসুমশরের আঘাতে অতিশয় দীর্ণ হলেন কৃষ্ণ। তিনি রাধাকে কামনা করলেন, রাধার দর্শন পাওয়ার জন্য বড়াইয়ের কাছে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। এদিকে বড়াই তখন রাধাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণের সব কথা মানতে রাজী। ফলে বড়াই কৃষ্ণের পরামর্শ মতো কৃষ্ণের পক্ষ থেকে প্রেমপ্রস্তাবসহ কর্পূর-দেওয়া পান, চাঁপা-নাগেশ্বর প্রভৃতি ফুল উপহার হিসেবে রাধার কাছে নিয়ে যেতে রাজী হলো। আর বদলে কৃষ্ণও বড়াইকে রাধার সন্ধান বলে দিলেন।

বড়াই এবার দেবতাদের স্মরণ করে কৃষ্ণের পাঠানো উপহার নিয়ে রাধার কাছে উপস্থিত হলো, এবং সব কথা খুলে বললো। মূল পাণ্ডুলিপিতে এইখানে ৯ নম্বর পাতাটি নেই এবং এর পরের পৃষ্ঠার শ্লোকটিও, অন্যান্য শ্লোকের সঙ্গে ভাবগত তারতম্যের করণে, প্রক্ষিপ্ত বলেই অনুমান করা হয়। ফলত এই সময় ঠিক কি হয়েছিলো, বলা যায় না। তবে এরপরেই দেখি, রাধা কৃষ্ণের প্রস্তাব ও উপহার, দুইই অত্যন্ত ঘৃণা ভ’রে প্রত্যাখ্যান করেন এবং কর্পূর-দেওয়া পানা, ফুল – সব কিছু মাটিতে ফেলে বাম পা দিয়ে দলিত করে বলেন, আইহন-পত্নী পরপুরুষের ভজনা করেন না। এই বলে তিনি বড়াইকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।

বড়াই কৃষ্ণের কাছে ফিরে এসে তাঁকে সমস্ত কথা বললো। কিন্তু মদনশরাতুর কৃষ্ণ রাধার অদর্শনে বড়ই কাতর। কৃষ্ণের একান্ত অনুনয়ে বড়াই আবার সেই একই প্রস্তাব নিয়ে রাধার কাছে ফিরে যায়। এবার রাধা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে অত্যন্ত কটূ ভাষায় গালি দিয়ে, এমনকি রাগের বসে বড়াইয়ের পিঠে দু’চার ঘা চড়-চাপড় লাগিয়ে বড়াইকে তাড়িয়ে দিলেন।

অপমানিত বড়াই এবার কৃষ্ণের কাছেই গিয়ে তাঁকে নিজের লাঞ্ছনার কথা জানিয়ে প্রতিকার চাইলো। তখন দুজনে মিলে রাধাকে শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করে ঠিক করলো, কৃষ্ণ ‘মহাদানী’ সেজে মথুরার পথে কদলতলায় বসে থাকবেন। বড়াই রাধাকে সেখানে নিয়ে এলে কৃষ্ণ তাঁর দুধ-দই নষ্ট করে, সাতেসরী হার কেড়ে নিয়ে, কাঁচুলী ছিঁড়ে ‘দূতী’কে অপমান করার শোধ তুলবেন। দিনক্ষণ স্থির হয়, মনের ভাব গোপন করে বড়াই রাধাকে এসে জানায় কৃষ্ণকে সে নিবৃত্ত করেছে, কৃষ্ণ আর রাধাকে বিরক্ত করবেন না।

এরপর রাধা নিয়মিত মথুরায় যায় পসরা নিয়ে। বড়াই দিনান্তে দুধ-দই বেচার টাকা রাধার শাশুড়ির হাতে তুলে দেয় ও আইহনকে নানান কৌশলে সন্তুষ্ট রাখে।

এদিকে রাধা বিরহে ক্লিষ্ট কৃষ্ণ বড়াইকে ‘মহাদানী’ হওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় আবার। এই সময় কিছু দিনের জন্য কোনও এক কারণে রাধা মথুরায় যাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। কবি কিন্তু একথা এখানে উল্লেখ করেননি। পরবর্তী কাহিনী থেকে তা জানা যাচ্ছে। এবার বড়াই আবার রাধার শাশুড়িকে বোঝাতে থাকে দুধ-দই না বেচলে গোয়ালাদের চলে কি করে! শাশুড়ির অনুমতিক্রমে পরদিন খুব ভোরে রাধা আবার বড়াই ও সখীদের সঙ্গে মথুরায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। এইখানেই ‘তাম্বূলখণ্ড’ শেষ। এই খণ্ডের মোট শ্লোক সংখ্যা ২৬ ও ১০টি রাগরাগিণীর উল্লেখ পাই। এর পরের খণ্ডটি নাম ‘দানখণ্ড’।