এখন পদাবলীর মোটামুটি একটা বিশ্লেষণ দেওয়া যাচ্ছে ৷ পদাবলীতে চতুঃষষ্টি রসকে প্রথমে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন— বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ ৷ বিপ্রলম্ভ বা বিরহ চার ভাগে বিভক্ত : পূর্বরাগ, মান, প্রেমবৈচিত্ত্য ও প্রবাস ৷ প্রিয়সঙ্গমের পূর্বে যে রতি তাই পূর্বরাগ ৷ কবিকর্ণপুর এই পূর্বরাগের বিভাগ আটটি বলে নির্দেশ করেছেন ৷ যথা —
১৷ সাক্ষাৎ দর্শন, ২৷ চিত্রপটে দর্শন, ৩ ৷ স্বপ্নে দর্শন, ৪৷ বন্দী বা ভাটমুখে শ্রবণ, ৫৷ দূতীমুখে শ্রবণ, ৬৷ সখীমুখে শ্রবণ, ৭৷ গুণিজনের গানে শ্রবণ, ৮৷ বংশীধ্বনি শ্রবণ ৷ কবিকর্ণপুর কেবল নামশ্রবণে পূর্বরাগসঞ্চারের কথা বলেননি ৷

নামানুরাগ— চণ্ডীদাস নামানুরাগকে প্রাধান্য দিয়াছেন ৷ চণ্ডীদাসের রাধা বলিয়াছেন—
সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম ৷
কাণের ভিতর দেয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ৷৷
নাম পরতাপে যার ঐছন করিল গো
অঙ্গের পরশে কিবা হয় ৷
যেখানে বসতি করে নয়নে দেখিয়া গো
যুবতীর ধরম কৈসে রয় ৷৷
রূপ গোস্বামীর ললিতমাধবে রাধা, সখী ললিতাকে এই কথাই বলেছেন —
রাধা (সরোমাঞ্চম্‌) — ললিদে, কো ক্‌খু কহ্নো ত্তি সুণীঅদি ৷ জেণ কেঅলং কণ্ণস্‌স চেচঅ অদিধী হোন্তেণ উন্মত্তী কিজ্‌জামি ৷

ললিতা, কে এই কৃষ্ণ, কেবল যাহার নাম আমার কর্ণের অতিথি হওয়ামাত্র আমাকে উন্মত্তা করে তুলল ৷
ললিতার বদলে কুন্দলাত এর উত্তর দিয়েছেন— সহি, এসো লোওত্তরস্‌স বত্থুণো নিসগ্‌গ, জং সব্বদএ উপভুজ্যমানব্বি অউরুব্ধো জেব্ব ভোদি ৷
এর তাৎপর্য — সখি, তুমি নিত্যকাল যার সঙ্গে মিলিত তার নাম ত তোমার নিত্যসঙ্গী৷ তবে অলৌকিক বস্তুর স্বভাবই এই যে, ইহা সর্বদা উপভোগ করলেও মনে হয় পূর্বে যেন এর আস্বাদই পাওয়া যায়নি ৷
কৃষ্ণপ্রেম যে লোকাতীত বস্তু রূপ গোস্বামী এই কথাই কুন্দলতার মুখ দিয়ে শুনিয়ে দিলেন ৷ নামশ্রবণে যে অনুরাগ তা দেহাত্মকতাবর্জিত ৷ নাম শুনে অবধি এ নাম রাধার ‘বদন ছাড়িতে নাহি পারে৷’
প্রভাতে উঠিয়া জটিলার ভয়ে করয়ে গৃহের কাম৷
হাতেতে করিছে মনেতে ভাবিছে মুখেতে জপিছে নাম ৷৷
রূপ গোস্বামী এই নামের আকর্ষণী শক্তি বুঝাতে বিদগ্ধমাধবে লিখেছেন—

তুণ্ডে তাণ্ডবিণীং রতিং বিতনুতে তুণ্ডাবলীলব্ধয়ে
কর্ণক্রোড়কড়ম্বিনী ঘটয়তে কর্ণার্বুদেভ্যঃ স্পৃহাম্ ৷
চেতঃপ্রাঙ্গণসঙ্গিনী বিজয়তে সর্বেন্দ্রিয়াণাং কৃতিম্‌
নো জানে জনিতা কিয়দ্ভিরমৃতেঃ কৃষ্ণেতিবর্ণদ্বয়ী ৷৷

যদুনন্দনদাস এই শ্লোকের মূল রসবস্তুকে তরলায়িত করে আমাদের সকলের উপভোগ্য করে তুলেছেন ৷

মুখে লইতে কৃষ্ণনাম নাচে তুণ্ড অবিরাম
আরতি বাড়ায় অতিশয় ৷
নাম সুমাধুরী পিয়ে ধরিবারে নারি হিয়ে
অনেক তুণ্ডের বাঞ্ছা হয় ৷৷
কি কহব নামের মাধুরী ৷
কেমন অমিয়া দিয়া কে জানি গড়ল ইহা
কৃষ্ণ এই দু-আঁখর করি ৷৷
আপন মাধুরী গুণে আনন্দ বাড়ায় কানে
তাতে কানে অঙ্কুর জনমে৷
বাঞ্ছা হয় লক্ষ কান যবে হয় তার নাম
মাধুরী করিয়ে আস্বাদনে ৷৷
কৃষ্ণ দু-আঁখর দেখি জুড়ায় তাপিত আঁখি
অঙ্গ দেখিবারে আঁখি চায় ৷
যদি হয় কোটি আঁখি তবে কৃষ্ণরূপ দেখি
নাম-তনু ভিন্ন নাহি ভায় ৷৷
চিত্তে কৃষ্ণ নাম যবে প্রবেশ করয়ে তবে
বিস্তারিত হৈতে হয় সাধ ৷
সকল ইন্দ্রিয়গণ করে অতি আহ্লাদন
নাম করে প্রেম উনমাদ ৷৷
যে কানে পরশে নাম সে তেজয়ে আন কাম
সমভাব করয় উদয় ৷
সকল মাধুর্যস্থান সব রস কৃষ্ণনাম
এ যদুনন্দন দাসে কয় ৷৷

যে নাম সকল ইন্দ্রিয়গণের প্রহ্লাদন ও পরম প্রেমের উন্মাদন, তা অলৌকিক—অপ্রাকৃত ৷ তা চর্মকর্ণে শ্রুত নয় মর্মকর্ণেই আকর্ণিত ৷