কেবল মাথুর বেদনার কথা নয়, পদাবলী আগাগোড়া বেদনারই গান ৷ পূর্বরাগ থেকে মাথুর পর্যন্ত কোথাও বেদনার বিচ্ছেদ নাই ৷ শ্রীকৃষ্ণের মুরলীধ্বনি শ্রবণ হতে রাধার প্রাণে ‘সোয়াথ’ নাই ৷ রাধার বেশভূষায় অনাসক্তি, আহারে বিরতি, হাস্যপরিহাসে বিতৃষ্ণা জন্মিল ৷ চিত্রদর্শনে শ্রীমতী বলেছেন— হায় হায় সরলবুদ্ধি আমরা কি করে বুঝব— এত চিত্র নয়— এটা ‘নিবিড় বড়ববহ্নিজ্বালা কলাপ-বিকাস৷’ বংশী কর্ণে দংশন করল— সে বিষের জ্বালায় রাধা অস্থির , ”উড়ু উড়ু আনচান ধক্‌ ধক্‌ করে প্রাণ” ৷ লালসার অবলম্বন যে রূপ সে রূপ তো মলিন হয়ে গেল, বাঁধুলী ফুলের মত অধর ধুতুরার মত পাণ্ডুর হয়ে গেল ৷ রাধার অন্তরে এই যে রূপানল জ্বলিল— তা ধূপানল হয়ে ধিকি ধিকি জ্বতে লাগল ৷
শ্রীকৃষ্ণের দশাও তথৈবচ ৷ ‘শ্যামর অঙ্গ ধামর’ হয়ে গেল ৷
যদি বা দূতীর সাহায্যে পরস্পরের মনের কথা জানাজানি হল, রাধা কি করে প্রিয়তমের সঙ্গে মিলিত হবেন ? ‘দুর্জনের’ নয়নপ্রহরী চারিদিকে ৷ শ্রীমতী ব্যাধের মন্দিরে যেন কম্পিতা হরিণী ৷ ”শানানো ক্ষুরের ধার স্বামী দুরজন”৷ একদিকে কুলশীল— অন্যদিকে কালা ৷ ক্ষুরের উপর রাধার বসতি ৷ তারপর কলঙ্কের জ্বালা আছে ৷ কিন্তু কালার পিরীতি ঘরে থাকতে দেয় না ৷ তাই দুর্গম বনপথে অভিসার ৷ কণ্টকাকার্ণ শ্বাপদসঙ্কুল বনপথ ৷ প্রকৃতির রাধার অন্ত নাই ৷ শীতের রজনী, দুর্বিষহ শীতল সমীর, তুহিনপাত ; গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন শিরে প্রখর তপন, পদতলে তপ্ত বালুকা ৷ আর বর্ষার পঙ্কিল শঙ্কিল বনবাট— আকাশে বজ্রগর্জন ৷ অভিসারে গিইয়েও দয়িতকে পাওয়া যাবে এমন কোন স্থিরতা নাই ৷ প্রতীক্ষার বেদনা আছে ৷ ‘সুদীঘল’ রাত্রির প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলি এক একটি কল্প বলে মনে হয় ৷ অশ্রুতে সম্ভোগতল্পের সাথে সম্ভোগকল্পও ভেসে যায় ৷ ‘চৌরি পিরীতি’ যতই মধুর হোক, পদকর্তারা একে সুলভ করে দেখান নি ৷ পদাবলীতে বিরহেরই প্রাধান্য ৷ সম্ভোগের বা মিলনের পদের তুলনায় বিরহের পদের সংখ্যা ঢের বেশি ৷ বিরহের বেদনার সঙ্গে অনুতাপ ও আত্মধিক্কারের বেদনা আছে ৷ লাজে তিলাঞ্জলি দিয়ে রাধা যার জন্য কলঙ্কের ডালা মাথায় নিলেন, সে যদি উপেক্ষা করে তবে সে বেদনা রাখার ঠাঁই নেই৷ অভিমানিনী রাধা শ্যামের সামান্য উপেক্ষাও সহ্য করতে পারেন না৷ ক্ষণে ক্ষণেই তাঁর মনে হয়েছে ধৃষ্ট শঠ বুঝি তাকে ভুলে গেল ৷ এই চিন্তায় রাধার বিরহবেদনা দ্বিগুণিত ৷ তখন বিরহতন্বী রাধার আক্ষেপবহ্নি শত শিখায় জ্বলে উঠেছে ৷
গভীর প্রেমের একটা লক্ষণ অতৃপ্তি ৷ এই অতৃপ্তির বেদনা রাধার কণ্ঠে হাহাকারে পরিণত হয়েছে ৷ রাধার কেবলই কাঁদন আসে ৷ কিন্তু লোকভয়ে প্রাণ খুলে কাঁদতেও পারে না— ”চোরের মা যেন পোয়ের লাগিয়া ফুকারি কাঁদিতে নারে”৷ রাধা রন্ধনশালায় গিয়ে ধোঁয়ার ছলনা করে কাঁদেন ৷ মধুর মিলনের স্মৃতির বেদনাই কি কম নিদারুণ ৷
সঙ্কেত করে মিলিতে না পারলে আঙিনার কোণে বঁধুয়াকে ভিজতে দেখলে রাধার বুক ফেটে যায় ৷ আবার সঙ্কেতস্থলে গিয়ে শ্যামের দেখা না পেলে শ্যামের জন্য উদ্বেগের অন্ত নাই ৷ সঙ্কেতস্থলে প্রতীক্ষার বেদনার সঙ্গে সংশয়ের বেদনা আছে ৷ আবার অঙ্গে সম্ভোগচিহ্ন বহন করে শ্যাম প্রভাতের সময় প্রতীক্ষমাণার কাছে এসে দেখা দিয়ে যখন সংশয়কে সত্য করে তোলেন— তখন রাধার কি বেদনা তা সহজেই অনুমেয় ৷ খণ্ডিতার বেদনা দুর্বিষহ হলেই মানের পালা ৷ স্বখাত হলেও মান একটা ব্যবধান ৷ ইহা স্বয়ংবৃত বিরহ ৷ প্রিয়তমেক দণ্ডিত করার জন্য নিজে দারুণতর দণ্ডভোগ ৷ মানের ব্যবধানের বিরহ দেশকালগত সাধারণ বিরহের চেয়েও দারুণতর ৷ মানের গান বিরহেরই গান—তাই বেদনাঘন ৷ মান-ভুজঙ্গের দংশনজ্বালা ত কম নয় ৷ ”কবেলে কবলে জিউ জরি যায় তায়” ৷
মানের পর অবশ্য মিলন হইয়াছে ৷ এ মিলনে মানের বিষাদচ্ছায়া একেবারে তিরোহিত হয় না ৷ সেজন্য এই মিলনের সম্ভোগকে সঙ্কীর্ণ সম্ভো্গ বলে ৷ রাধামোহন একে বলিয়াছেন— ‘চরবন তপত কুশারি’ অর্থাৎ তপ্ত ইক্ষুচর্বণ ৷
সম্ভোগের মধ্যে প্রেমবৈচিত্ত্য আছে ৷ শ্যামের ভুজপাশে রহিয়াও রাধা — ”বিলপই তাপে তাপায়ত অন্তর বিরহ পিয়ক করি ভান” ৷ মিলনেও স্বস্তি নাই, বিচ্ছেদের ভয়— হারাই-হারাই ভাব ৷ ”প্রাণ কাঁদে বিচ্ছেদের ডরে”৷ ”দুহুঁ ক্রোড়ে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া” ৷ চরম প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত এ মিলনে তৃপ্তি নাই ৷ ”লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া” রাখিয়াও হিয়া জুড়ায় না ৷
তারপর মাথুর-বিরহের কথা আর কি বলব ? জগতের সাহিত্যে এই বেদনার তুলনা নাই ৷ রূপ গোস্বামীর একটি শ্লোক তুলিয়া একটু আভাস দিই—
উত্তাপী পুটপাকতোঽপি গরলগ্রাসাদপি ক্ষোভণঃ
দাম্ভোলেরপি দুঃসহঃ কটুরলং হৃন্মগ্নশল্যাদপি ৷
তীব্রঃ প্রৌঢ়বিসূচিকানিচয়তোঽপ্যুচ্চৈর্মমায়ং বলী
মর্মাণ্যদ্য ভিনত্তি গোকুলপতের্বিশ্লেষজন্মা জ্বরঃ ৷৷
(পুটপাক হ’তে তাপসঞ্চরী
হলাহল হ’তে মোহনকারী,
হৃদয়মগ্ন শূল হ’তে কটু
বজ্র হ’তেও হৃদ্‌বিদারী,
বিসূচিকা হ’তে ক্রূর দুঃসহ
গোকুলপতির বিরহখেদ,
বলবান্‌ হ’য়ে মহাবিক্রমে
মর্মগ্রন্থি করিছে ভেদ ৷ )

পদাবলী-সাহিত্যে লালসার গীত যে নাই তা নয় ৷ সেগুলোর কথা আগেই বলেছি৷ তবে সেগুলি যেন বিরহকেই গভীরতর ও দুঃসহতর করে তুলবার উদ্দেশ্যে একটা বিপরীত প্রত্যন্ত সৃষ্টির জন্য রচিত৷ অন্য-দিকে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কে অনেকস্থলে যৌনবোধস্পর্শ-শূন্য করাও হয়েছে ৷ নামানুরাগ বা বংশীরবানুরাগের পদগুলি এই শ্রেণীর ৷ অপেক্ষানুরাগের অনেক পদও তাই ৷ চণ্ডীদাসের অধিকাংশ পদ লালসার চিহ্নও নাই ৷ লোচন বলেছেন—
আমারে, নারী না করিত বিধি তোমা হেন গুণনিধি
লইয়া ফিরিতাম দেশে দেশে ৷
রায় রামানন্দ বলিয়াছেন, সে যে রমণ, আর আমি যে রমণী এই দ্বৈতভাব পর্যন্ত আমি হারিয়েছি৷ এমন কি বিদ্যাপতি পর্যন্ত রাধার প্রেমের স্বরূপকে শেষ পর্যন্ত নির্লালস করে চিত্রিত করে বলেছেন—”অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে সুন্দরী ভেলি মাধাই” ৷ বৈষ্ণব পদাবলীর যাহা কিছু উৎকৃষ্ট তা বিপ্রলম্ভাত্মক অনুরাগের বেদনারই গান ৷