চৈতন্য মহাপ্রভুর অব্যবহিত পরবর্তী কালে যে তিন মহাপুরুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ধারক-বাহক হিসেবে চিহ্নিত, সেই তিন ঠাকুর হলেন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু, শ্যামানন্দ এবং নরত্তোম দাস। পদকর্তা গোবিন্দদাস চক্রবর্তী প্রথেমোক্ত শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর শিষ্য। ইনি গোবিন্দ চক্রবর্তী নামেও খ্যাত, কিন্তু স্বকৃত পদের ভণিতায় তিনি গোবিন্দদাস নামটি ব্যবহার করতেই ভালবাসতেন।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তী আগে বহরমপুরের কাছে মহুলা নামে একটি গ্রামে থাকতেন, পরে চলে আসেন বোরাকুলি গ্রামে এবং এই গ্রামই এখন গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর শ্রীপাট। মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ২৮ মাইল।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর স্ত্রীও পরম ভক্তিমতী ছিলেন। তিনি আবার শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর পত্নী ঈশ্বর দেবীর কাছে দীক্ষালাভ করেন। গোবিন্দদাসের তিন পুত্র রাজবল্লভ, রাধাবিনোদ এবং কিশোরীদাস। বোরাকুলির শ্রীপাট কিন্তু গোবিন্দদাসের পুত্র রাজবল্লভ চক্রবর্তীর নামে—রাজবল্লভও ঈশ্বরীদেবীর শিষ্য ছিলেন।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তী নিজে কৃষ্ণপ্রেমে সর্বদা ভাবিত ছিলেন বলে তাঁর অন্য একটি নাম হয়েছিল ভাবক চক্রবর্তী। বহরমপুর থেকে প্রকাশিত ‘কর্ণানন্দ’ নামে একটি গ্রন্থে গোবিন্দদাস চক্রবর্তী সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
প্রভুকৃপা হইল গোবিন্দ চক্রবর্তী নাম।
বাল্যকালেতে যিঁহো ভজন অনুরাগ।।
প্রেমমূর্তি কলেবর বিখ্যাত যাঁর নাম।
‘ভাবক চক্রবর্তী’ খ্যাতি বোরাকুলি গ্রাম।।
তাঁহার ঘরণী সুচরিতা বুদ্ধিদমন্তা।
শ্রী ঈশ্বরী কৃপাপাত্রী অতি সুচরিতা।।
লক্ষ হরিনাম যিঁহো করেন গ্রহণ।
ক্ষণে ক্ষণে মহাপ্রভুর চরিত্রকীর্তন।।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তী কৃষ্ণপ্রেমে ভাবিত ছিলেন বলেই সঙ্গীতশাস্ত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি গোবিন্দদাস নামটি পদশেষে ভণিতা লেখার ফলে অনেক সময়েই তাঁর পদ বিখ্যাত পদকর্তা গোবিন্দ কবিরাজের সঙ্গে এককার হয়ে গেছে, তাতে দুই পদকর্তারও একাকার হয়ে গেছেন। তবে গোবিন্দ কবিরাজের সঙ্গে চক্রবর্তী-ঠাকুরের তফাৎ হল—গোবিন্দদাস কবিরাজ বিদ্যাপতি ঠাকুরের কাছে ভাষা এবং ভাবে ঋণী ছিলেন বলে চক্রবর্তী ঠাকুর সেই পথে যাননি। তিনি অনেক সহজ ভাষায় সালংঙ্কার পদ রচনা করেছেন। পদগুলির মধ্যে কোথাও কোথাও ব্রজবুলি ভাষার ইঙ্গিত থাকলেও গোবিন্দদাস চক্রবর্তী প্রধানত বাঙলা ভাষাতেই পদ লিখেছেন।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তী নিজেকে গোবিন্দদাস কবিরাজের মহিমা থেকে পৃথক করে রাখতে পেরেছেন আপন ভণিতার মাধুর্যে। বেশীর ভাগ পদেই তাঁর নামের ভণিতাটি এত মধুরভাবে অপভ্রষ্ট হয়েছে যে, তাঁকে বিদ্যাপতি-সমাবিষ্ট গোবিন্দদাস কবিরাজ থেকে পৃথক করে ফেলা যায়। এই ভণিতাটি হল ‘গোবিন্দদাসিয়া’। শ্রদ্ধেয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর নামে পঁচানব্বইটি পদ সংকলন করেছেন। সেগুলির মধ্যে অন্তত বাষট্টিটি পদে ভণিতা হল—‘গোবিন্দদাসিয়া’। যে কটি বাকী পদ আছে সেগুলিতে বৈষ্ণবোচিত দীনতার স্ফুরণে কখনো ‘পামরি গোবিন্দ’, কখনো ‘গোবিন্দদাসা’, খুব অল্প কয়েকবার ‘দাস গোবিন্দ’ বা ‘দাস গোবিন্দা’—যেখানে গোবিন্দদাস কবিরাজের সামান্য আভাস চলে আসে।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর মধ্যেও কিছু গৌর-নাগরী ভাবের আভাস আছে, তাতে ‘গোবিন্দদাসিয়া’ নামটি ভণিতার মধ্যে একদিকে যেমন শিশুজনের প্রতি সমাদর-স্বভাব আবিষ্ট করে, তেমনই ব্রজভূমি বৃন্দাবনে যুগলসেবার মঞ্জরীভাবটুকুও চরম দীনতায় আখ্যাত হয়েছে ‘দাসী’ শব্দটির প্রসারণে – ‘গোবিন্দদাসিয়া বলিহারি।’ এই সেদিনও পর্যন্ত চিঠিপত্রের পুরাতন বাংলা গদ্যে, দলিল-দস্তাবেজে গৃহবধূ থেকে বিধবা মহিলাদের আত্মীকরণের ভাষা ছিল ‘ষষ্ঠী বিভক্তিতে ‘দাস্যাঃ’। এই ‘দাস্যঃ’ শব্দজটির বিসর্গটি বাদ দি ‘দাস্যো’ আর ‘দাসিয়া’ শব্দটির অর্থ এবং উচ্চারণ প্রায় একই হয়ে দাড়ায়। গোবিন্দদাস চক্রবর্তী খুব সচেতন ভাবেই এই ‘দাসিয়া’ পদের মাধ্যমেই নিজেকে পৃথক করেছেন সেটা বোঝা যায়, যখন তিনি ‘গোবিন্দ’ শব্দটি ত্যাগ করে শুধুই ‘দাসিয়া’ বলে ভণিতা দিয়েছেন—
এত শুনি সহচরি গেল।
‘দাসিয়া’ অনুমতি দেল।।
গোবিন্দদাস চক্রবর্তী পুত্র-পরিবার সহ কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। তাঁর বোরাকুলি গ্রামের বাড়িতে যেদিন ‘রাধা বিনোদ’ নামে যুগলমূর্তির সেবা প্রতিষ্ঠিত হল সেই উপলক্ষে স্বয়ং শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু সশিষ্য বুধুরী গ্রাম থেকে বোরাকুলি গ্রামে এসেছিলেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি সেই বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠার মহোৎসব সুসম্পন্ন করেন। সবচেয়ে বড়ো কথা এই বিগ্রহ-প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে মহোৎসবের ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর প্রিয় পুত্র বসুধা-জাহ্নবা-প্রাণ স্বয়ং বীরচন্দ্র প্রভু উপস্থিত। প্রধানত তাঁরই কারণে যে কীর্তনমঙ্গল সম্পন্ন হয়েছিল, যেখানেই গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর সঙ্গীত প্রতিভা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনার নিশ্চিদ্র বিবরণ পাওয়া যায় নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তি রত্নাকর গ্রন্থে।
শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু ব্রজবুলির-পদ খ্যাত গোবিন্দদাসের কাছেই ছিলেন বুধুরি বা তেলিয়া বুধুরি গ্রামে। সেখানে ঠাকুর নরোত্তম দাস এসে জুটেছিলেন আচার্যপ্রভুর সঙ্গে। সেখান থেকেই নরোত্তম দাস এবং অন্যান্য ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে শ্রীনিবাস আচার্য এলেন বোরাকুলি গ্রামে, বোরাকুলির আর এক গোবিন্দদাস—গোবিন্দদাস চক্রবর্তী প্রভুকে নিজের ঘরে এনে তুললেন এবং এখানে চক্রবর্তীর প্রধান পরিচয়—তিনি গীতবাদ্যে অতি-নিপূণ
কিছুদিন শ্রীবুধুরি গ্রামে বিলাসিয়া।
বোরাকুলি গ্রামে যাত্রা কৈল হর্ষ হইয়া।।
শ্রী গোবিন্দ চক্রবর্তী বিহ্বল প্রেমায়ে।
গণসহ আযার্যে দিলেন নিজালয়ে।।
আচার্যের অতিপ্রিয় শিষ্যচক্রবর্তী।
গীতবাদ্য বিদ্যায় নিপুণ ভক্তিমূর্তি।।
নরহরি চক্রবর্তী লিখেছেন—গোবিন্দ চক্রবর্তী কীভাবে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর শিষ্য হলেন, কীভাবে তিনি মহুলা গ্রাম ছেড়ে বোরাকুলিতে এলেন—এই কাহিনী নাকি সবাই জানে, দুঃখের বিষয় নরহরি কিছু লিখলেন বলেই আমরাওর কিন্তু জানতে পারলাম—গোবিন্দ চক্রবর্তী কেমন করে শ্রীনিবাস আচার্য প্রভুর শিষ্য হলেন এবং কেনই বা মহুলা ছেড়ে তিনি বোরাকুলি গ্রাামে এসে বসতি স্থাপন করলেন।
যাই হোক আচার্য প্রভুর আগমনে বোরাকুলি উত্তাল হয়ে উঠল। গোবিন্দ চক্রবর্তী ঘরে যুগলমূর্তির প্রতিষ্ঠা করবেন স্বয়ং শ্রীনিবাস আচার্য—এই মর্মে নিমন্ত্রণ পত্র গেল তৎকালীন বৈষ্ণব মহাজনদের কাছে। একে একে এসে পৌঁছালেন নিত্যানন্দপুত্র বীরচন্দ্র প্রভু। এলেন কৃষ্ণ মিশ্র, হৃদয়ানন্দের শিষ্য গোপীরমণ চক্রবর্তী। এলেন অম্বিকা কালনা থেকে, শ্রীখণ্ড থেকে ঠাকুর কানাই, যদুনন্দন দাস কিংবা নয়নানন্দের মতো পদাবলী কারেরাও চলে এলেন। বুধুরি থেকে আর এক পদাবলীকার গোবিন্দদাসের কাকা রামচন্দ্র কবিরাজ—যিনি নরোত্তম দাস ঠাকুরের পরম বন্ধু তিনিও এলেন উৎসবে যোগ দিতে। ফলে হইল অদ্ভুত রঙ্গ গোবিন্দ ভবনে। ভক্ত-মহাজনেরা আসার পর সন্ধ্যারাত্রি পর্যন্ত নৃত্য-গীত-কীর্তন চলল। পবের দিন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু বিগ্রহ আনালেন গোবিন্দ চক্রবর্তীর ঘরে। আচার্য ঠাকুর নিজে যুগলমূর্তির অভিষেক করলেন এবং আচার্য ঠাকুরের নির্দেশে স্বয়ং নরোত্তম দাস প্রথম গৌরগুণাত্মক গৌরাঙ্গবিষয়ক গান আরম্ভ করলেন। বিগ্রহ অভিষেক করার সময়েও যুগলমূর্তির নাম কী হবে ঠিক হয়নি। আচার্য প্রভুও চিন্তিত আছেন এ বিষয়ে
শ্রীবিগ্রহ নাম কি হইবে বিচারিতে।
অকস্মাৎ হৈল শব্দ মন্দির মধ্যেতে।।
শ্রীরাধাবিনোদ নামে কর অভিষেক।
শুনি সর্ব চিত্তামোদ জন্মিল অনেক।।
মন্দিরে রাধা বিনোদজিউ প্রতিষ্ঠিত হলেন। গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর ভবন সেদিন হরি-হরি, গৌর-গৌর জয়কারে মুখরিত হল। তারপরের দিন বীরচন্দ্র প্রভু এবং অদ্বৈত প্রভুর পুত্র কৃষ্ণমিশ্র—দুইদনে স্নান সেরে রাধাবিনোদ-মন্দির প্রঙ্গণে উপস্থিত হতেই সেখানে এসে পৌঁছালেন শ্যামাদাস আর দেবীদাস সঙ্গে গোকুলানন্দ। শ্যামাদাস আর দেবীদাস দুইজনে সেইকালের মৃদঙ্গবাদ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বাজনদাস। তাঁরা মন্দির-প্রাঙ্গনে এসেই মৃদঙ্গে সুমধুর বোল তুলতে আরম্ভ করেলেন—
শ্যামাদাস দেবীদাস বাজায় মৃদঙ্গ।
তাহে উপজায় কত রসের তরঙ্গ।।
ভেদয়ে গগন মৃদু মৃদঙ্গের ধ্বনি।
কেহ থির হৈতে নারে তাল পাঠ শুনি।।
গোকুলাদি নানা ছাঁদে রাগ আলাপয়।
রাগালাপে উৎকট গমক প্রকাশয়।।
সপ্তস্বর গ্রামাদিক হৈল মূর্তিমান্।
প্রথমেই করে গৌরচন্দ্রগুণ গান।।
গানমন্ত্রে প্রভু গৌরচন্দ্রে আকর্ষিল।
গণ-সহ প্রভু যেন সাক্ষাৎ হইল।।
নরহরি চক্রবর্তীর লেখা এই কীর্তনচিত্র আজ থেকে পাঞ্চাশ/ষাঠ বছর আগেও কিছু কিছু মঠ-মন্দিরে, শ্রীপাটে আমি নিজের চোখে দেখেছি। কিন্তু সে আর কী, এ রসের তুলনায় সেটা আভাসমাত্র। এখানে দেবীদাস শ্রীখোলে বোল তুলছেন, যে দেবীদাসকে খেজুরীর মহোৎসবে আমরা মাদলে তাল তুলতে দেখেছি, সে দেবীদাস গোবিন্দ চক্রবর্তীর উৎসব-প্রাঙ্গনে মৃদঙ্গের আলাপ করছেন, সেখান থেকে গোকুলানন্দের রাগালাপ আরম্ভ হল; তা থেকেই গমক, সপ্তসুরে গৌরচন্দ্রিকা আরম্ভ হল। আমাদের বিশ্বাস—গোবিন্দদাস চক্রবর্তী গৌরাঙ্গ-বিষয়ক যে গানগুলি লিখেছিলেন, সেগুলিই গাওয়া হয়েছে এখানে। কেননা দুই-তিন-ব্যাপী যেসব নামকীর্তনের আসরে আমি অংশ নিয়েছি, সেখানে অধিবাস কীর্তনের সময়ে আমি গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর এই পদ আমি শুনেছি
ব্রজেন্দ্রনন্দন যেই শচীসুত হইল সে
বলরাম হইল নিতাই।
দীন হীন যত ছিল হরিনামে উদ্ধারিল
তার সাক্ষী জগাই মাধাই।।
(হেন) প্রভুর শ্রীচরণে রতি না জন্মিল কেনে
না ভজিলাম হেন অবতার।
দারুণ বিষয়রসে সতত মজিয়া রৈলুঁ
মুখে দিলু জ্বলন্ত অঙ্গার।।
এমন দয়াল দাতা আর বা হইবে কোথা
পাইয়া হেলায় হারাইলুঁ ।
গোবিন্দদাসিয়া কয় অনলে পুড়িলুঁ নয়
সহজেই আত্মঘাতী হইলুঁ।।
হয়তো বা গোবিন্দ চক্রবর্তীর এই গৌরবিরহের গান গাইছিলেন স্বয়ং ঠাকুর নরোত্তমদাস এবং সেই গানের সঙ্গে নৃত্য করেছেন শ্রীনিবাস আচার্য ঠাকুর এবং বীরচন্দ্র প্রভু। কেননা নরহরি চক্রবর্তী ভক্তিরত্নাকরে লিখেছেন
শ্রীনরোত্তমের কণ্ঠস্বর অতিমনোহর।
বরিষয়ে কি নব অমিয়া নিরন্তর।।
প্রেমময়াচার্য-অঙ্গে অঙ্গ হেলাইয়া।
নাকে বীরচন্দ্র প্রভু অধৈর্য্য হইয়া।।
প্রভু বীরচন্দ্র নৃত্যাবেশে স্থির হইয়া।
করয়ে ক্রন্দন নরোত্তম আলিঙ্গিয়া।।
এই সংকীর্তন-রঙ্গের পরেই নরহরি চক্রবর্তীর বিবরণে দেখি গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর নতুন নামের উপলব্ধি জুটল ‘ভাবক চক্রবর্তী’—আমাদের মনে হয়, পদাবলীকার হিসেবে এটাই ছিল স্বীকৃতির ইঙ্গিত—
‘শ্রীভাবক চক্রবর্তী’ হৈল তাঁর খ্যাতি।
কেবা না প্রশংসে দেখি প্রেমভক্তিরীতি।।
বোরাকুলি গ্রামে ভাবক-ভাবুক গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর ঘরে মহাজন বৈষ্ণবেরা আরও কিছুদিন কাল কাটিয়েছেন সংকীর্তনরঙ্গে। এরপর সকল মহাজন মিলে নরোত্তম দাসের শ্রীপাট খেতুরীতে। এত যে মহোৎসবের মধ্যে গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর ‘রাধাবিনোদজিউ’র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই শ্রীবিগ্রহ কালের পর্যায়ে জিয়াগঞ্জ ভাটপাড়ায় আছেন।
ভাবক চক্রবর্তীর পদাবলীর ভাব নিয়ে আলোচনা হবে সবেচয়ে অল্প। গৌর-নাগরী ভাবে যিনি গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদগুলি লিখেছেন, সেখানে কবির ভাবকদম্বের প্রত্যেকটি রোয়া যেন একসঙ্গে ফুটে উঠেছে। কৃষ্ণের বিষয়ে যেগুলি পূর্বরাগের পদ হতে পারে, সেই পদে প্রতীকীভাবে নন্দকিশোরের জায়গায় গৌরকিশোর স্থান কর নিয়েছেন। সেখানে গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর আকৃতিময়ী ভাষা
অমিয়া জিতল মধুর বোল
অরুণ চরণে মঞ্জির রোল
চলতে মন্দমন্দুয়া।
অখিল ভুবন প্রেমে ভাস
গোবিন্দদাসিয়া করত আশ
প্রেমসিন্ধু বিন্দুয়া।।
মহাপ্রভুর সন্ন্যাস ব্যাপারটা গোবিন্দদাস সেভাবে গ্রহণ করতে পারেননি বলেই তাঁর সন্ন্যাস বিষয়ক পদগুলি বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের ভাবনাী সৃষ্টি করে। ‘ছাড়ি নাগরালি বেশে / ভ্রমে পহুঁ দেশে দেশে’— সন্ন্যাসীর এই পরিব্রজন দেখে কবি কষ্ট পান, তাই চৈতন্যের রাধারভাবে পাগলপারা অবস্থা বুঝেও তাঁর নিজের ভণিতা হল –না বুঝিয়া কান্দি মরু গোবিন্দদাসা।
এমন কবি তাঁর কৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলি আরম্ভ করেছেন বাঁধার বন্দনা দিয়ে যার আরম্ভটাই এত সরল, স্বচ্ছ এবং সুন্দর যাতে লাস্যময়ী শ্রীরাধিকা কবির অলঙ্কার-বর্জিত ভাবসমন্বিত ভাষার মতোই সরল-মধুর হয়ে ওঠেন—জয়তি জয় কৃষ্ণ/ ভানুনন্দিনি/শ্যামমোহিনী রাধিকে। এরপরে পদাবলীর বিবর্তন-পরিবর্তন হয়েছে বাঁধা নিয়মে—রাধার পূর্বরাগ, কৃষ্ণের পূর্বরাগ ইত্যাদির সঙ্গে অভিসার। রাস বিষয়ক একটি পদ গোবিন্দ চক্রবর্তীর ভাগবত পুরাণের প্রতি শ্রদ্ধা ব্যক্ত করে। কেননা ভাগবত পুরাণের অন্তর্গত রাসপঞ্চাধ্যায়ীর প্রথম আরম্ভটুকু এখানে প্রায় অবিকল ধরা আছে।
রাধাকৃষ্ণের নিত্য-নৈমিত্তিক লীলার মধ্যে গোষ্ঠ, দানলীলা, কুঞ্জভঙ্গ, হোরি যেমন আছে তেমনই আছে মাথুর-বিরহের পদ এবং অষ্টকালীয় নিত্যলীলা, গোবিন্দদাস চক্রবর্তীর পদাবলীর ভাষা মুখর হয়ে ওঠে রাইকানুর মিলন বর্ণনায়—
রাধা মাধব দুঁহুঁ তনু মীলল
উপজল আনন্দকন্দ।
কনকতালে তমাল জনু বেঢ়ল
রাহু গরাসল চন্দ।।
[যদুনাথ বিরচিত ‘কর্ণানন্দ’, রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন কর্তৃক সম্পাদিত এবং প্রকাশিত, মুর্শিদাবাদ, বঙ্গাব্দ ১২৯৮ (খ্রিষ্টাব্দ ১৮৯১), পৃ. ১১-১২; নরহরি চক্রবর্তী বিরচিত ভক্তিরত্নাকর, রামদেব মিশ্র কর্তৃক প্রকাশিত, মুর্শিদাবাদ, চৈতন্যব্দ ৪২৬ (খ্রিষ্টাব্দ -১9১২), পৃ. ১0৪0-১0৪৪]