বৈষ্ণব পদের পাঠক মাত্রেই বাংলা সাহিত্যের সেই পদকর্তাকে চেনেন যার পদ মাধুর্যে ও প্রসাদগুণে কীর্তনের ভাষাছাঁদ নির্মাণ হয়েছে। তিনি অবশ্যই বাংলার কবি চণ্ডীদাস। বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না। তার রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ ন্যয়দর্শনের স্নাতকদের হাত ধরেই মূলত বাংলায় এসেছিল। পরে কীর্তনীয়ারা বিদ্যাপতির পদসংগ্রহ করেছেন; সংকলকদের সংকলনেও তা সংকলিত হয়েছে। এমনকি মৈথিলী ভাষাছাঁদ অবলম্বনে বাংলায় কীর্তনের নতুন ভাষা ব্রজবুলিরও নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু তা বাংলার নিজস্ব সংগীত হয়ে ওঠেনি। বলতে গেলে চণ্ডীদাসের পদেই বাংলার নিজস্ব গান তার ভাষ্যসহ ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয় পরবর্তীকালীন সময়ে এই সংগীত ধারা অধিকাংশ পদকর্তাদের প্রেরণারূপে কাজ করেছি।
বলা বাহুল্য চণ্ডীদাস নামটিই কালোত্তীর্ণ কিন্তু সাহিত্য ছেড়ে কবির জীবন চরিতে চণ্ডীদাসকে খুঁজতে গেলেই সাহিত্য সীমার বাইরে চণ্ডীদাস আর প্রামাণ্য নন। তার নামে চলিত এমন কোনো পদ বা সংকলন নেই যা বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। চণ্ডীদাসের জীবন কাহিনি পরস্পর বিরোধী নানান কিংবদন্তীর মধ্যে লুকিয়ে আছে। তবে একথা ঠিক যে চণ্ডীদাস ছিলেন, এক বা একাধিক। এবং ছিলেন এই পশ্চিম রাঢ়েই এবিষয়ে সন্দেহ নেই।
সাধারণত সংস্কৃতি বিজ্ঞানে লিজেণ্ড গড়ে ওঠার এক বা একাধিক প্রক্রিয়ার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল অপ্রমাণিত ইতিহাসে উপকরণ সংগ্রহ। চণ্ডীদাস সমস্যার ক্ষেত্রে কিংবদন্তীর সঙ্গে কিংবদন্তীর মালা জড়িয়ে বিষয়টি ক্রমশঃ জেলাওয়াড়ি বিবাদে পরিণত হয়েছে। বলাবাহুল্য প্রামাণ্য উপাদানের স্বল্পতাই এক্ষেত্রে বিবাদের মূল কারণ এবং বিষয়টি বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ অমীমাংসীত সমস্যা এবিষয়ে সন্দেহ নেই।
চণ্ডীদাসের কাব্যসংগ্রহ
চণ্ডীদাসের পদগুলি কীর্তনীয়ারাই বিখ্যাত করেছেন। এই পদগুলির মধ্যে কয়েকটি অমর কাব্যগুণ সম্পন্ন গীতি। তবে কীর্তনীয়ারা রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলিকেই বেছেছেন অধিকতর ভাবে। যদিও সহজ সাধনা বিষয়ক চণ্ডীদাসীয় পদ পাওয়া যায়। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদ সংগ্রহ পদকল্পতরু পদামৃত সমুদ্র কীর্তনানন্দতে প্রচুর চণ্ডীদাসীয় পদ গৃহীত হয়েছে। তবে চণ্ডীদাসের সম্বন্ধে আলোচনা ১৮৫৮ সালের বিবিধার্থ সংগ্রহের বৈশাখ সংখ্যাতেই সম্ভবত প্রথম পাওয়া যায়। প্রবন্ধটি অজ্ঞাত নামা লেখক রচিত। তবে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ঐ প্রবন্ধের রচয়িতা হতে পারেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের হরিমোহন মুখোপাধ্যায় রচিত কবিচরিতে চণ্ডীদাসের নাম ও পদ উল্লিখিত হয়েছিল। ১৮৭১ প্রকাশিত মহেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গভাষার ইতিহাসে চণ্ডীদাসের উল্লেখ আছে। ১৮৭২ সালে জগদ্বন্ধু ভদ্র প্রকাশিত মহাজন পদাবলীতে চণ্ডীদাসের রচিত একটি গ্রন্থরূপে কৃষ্ণকীর্তনের নাম করেন। চণ্ডীদাস সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা প্রথম দেখা যায় বাঙ্গলাভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব ১৮৭৩ এ রামগতি ন্যায় রত্নের আলোচনায়। ১৮৭৮ এ প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ প্রথম খণ্ডে চুঁচুড়া সাধারণ যন্ত্র থেকে অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সম্পাদনায় চণ্ডীদাসের পদাবলী প্রকাশ হয়। ১৮৮৫ সালে আদিব্রহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত পদরত্নাবলী। এতে ১৪টি চণ্ডীদাসের পদ গৃহীত হয়েছিল। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে (১ম সংস্করণে) চণ্ডীদাস ও তার জীবনসংক্রান্তি কিংবদন্তী সমূহ আলোচনা করেন দীনেশচন্দ্র সেন। এরফলে বঙ্গীয় বিদ্বৎ সমাজে চণ্ডীদাসের জীবন তার রামীরজকিনী সংক্রান্ত কিংবদন্তী সবই আলোচ্য হয়ে পড়ল। এই একই সময়ে ১৮৯৩ সালে রমণীমোহন মল্লিক চণ্ডীদাস নামে দুই সংস্করণে সর্বমোট ৩৪0টি চণ্ডীদাসের নামাঙ্কিত পদ প্রকাশ করেন এর মধ্যে ৫১টি পদ ছিল ‘রাগাত্মিকা’। রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদার চণ্ডীদাসের নামে চলিত কোনো রাগাত্মিকা পদ প্রকাশ করেননি। এইখানেই চণ্ডীদাসের প্রথম রাগাত্মিকা পদ প্রকাশিত হল। ১৮৯৮ সালে নীলরতন মুখোপাধ্যায় নানুর থেকে চণ্ডীদাস রচিত ৭১টি রাসলীলার পদ পেয়েছিলেন। তিনি ১৩0৫ সনের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় ‘চণ্ডীদাসের অপ্রকাশিত পদাবলী’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধও প্রকাশ করেছেন। এতদিন চণ্ডীদাস রচিত শুধুমাত্র পদ পাওয়া গিয়েছিল এই প্রথম কোনো পালাগান পাওয়া গেল। এবারে আবার সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় চণ্ডীদাসের চতুর্দ্দশ পদাবলী নাম দিয়ে নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব একটি পুঁথি প্রকাশ করেন। বিষ্ণুপুর থেকে সংগৃহীত একটি পুঁথি থেকে তিনি ১0টি পদ প্রকাশ করেন। এই পুথিটিতে চণ্ডীদাস সম্পর্কে বহুকিংবদন্তী চণ্ডীদাস রামী কিংবদন্তী সহজিয়া মতের পিরীতি তত্ত্ব, কনিষ্ঠভ্রাতাকর্তৃক চণ্ডীদাসকে জাতে তোলার ব্যবস্থা ইত্যাদিও ছিল। নীলরতন মুখোপাধ্যায়ও দুটি পুথিতে মহজিয়া চণ্ডীদাসের কাহিনি পেয়েছিলেন যেগুলির মধ্যে একটি ১৬0২ খ্রিষ্টাব্দে রচিত। এরপর ১৯0৫ সালে (বাংলা ১৩১২ সন) দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত বৈষ্ণব পদলহরীতে চণ্ডীদাসের ৩৩৬টি পদ গৃহীত হইয়াছিল।
১৯0৯ সালে চণ্ডীদাস সমস্যার সর্ববৃহৎ আলোচ্যমূল বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকৃর্তন’ বসন্তরঞ্জন রায বিদ্বদ্বল্লভ আবিস্কার করেন। ১৯১১ সালে (১৩১৮ বঙ্গাব্দ ২য় সংখ্যায়) সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তারপরেই চণ্ডীদাসের প্রতিস্পর্ধী বড়ু চণ্ডীদাসের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়।
১৯১৩ সালে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় (২য় সংখ্যা, ১৩২0) সতীশচন্দ্র রায় ‘প্রাচীন পদাবলী ও পদকর্তৃগণ নামক প্রবন্ধে সর্বপ্রথম সংশয় প্রকাশ করে লেখেন যে চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত সমস্ত পদ এক চণ্ডীদাসের রচনা নয়। ১৯১৪ সালে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার ১ম সংখ্যায় ব্যোমকেশ মুখার্জী চণ্ডীদাস ভণিতাযুক্ত ‘জর্ম্মলীলা’ পালাগানের পদগুলি প্রকাশ করে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ঐ বছরই চট্টগ্রামের মুন্সী আবদুল করিম বিশারদ ‘রাধার কলঙ্কভঞ্জন’ নামক চণ্ডীদাসের আর একটি পালাগান প্রকাশ করে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ১৯২৪ সালেই নীলরতন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত চণ্ডীদাসের বিরাট পদাবলীতে প্রায় নয় শত পদ প্রকাশ হল। এবপর ১৯১৬ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভের সম্পাদনায় শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন প্রকাশিত হল। বাংলা সাহিত্যে এসময় বিতর্ক চরমে উঠল চণ্ডীদাস এক না বহুর পদাবলীর চণ্ডীদাসের রচনাগুলি আসল না বড়ু চণ্ডীদাসের ? চৈতন্য চরিতে মহাপ্রভু যে চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদ করতেন সেকি বড়ু চণ্ডীদাস হতে পারে ? তার রচিত গ্রাম্যদুষ্ট তুলনায় অশ্লীল পালাগান মহাপ্রভুর আস্বাদ্য ছিল ?
কিন্তু এই বিতর্কের পরেও আরো উপাদান আবিস্কৃত হল, মনীন্দ্রমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালা থেকে রাধাকৃষ্ণ লীলার বিরাট পালাগানের দুটি পুথিতে দীনচণ্ডীদাসের প্রায় ২000 পদ আবিস্কার করলেন। ১৯২৬ -২৭ সালের সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় এগুলি প্রকাশ হয়েছিল। এরপরে চণ্ডীদাস বিতর্ক নতুন মোড় নিল।
চণ্ডীদাসের রচনা প্রকাশের সালতামামি
সাল | সম্পাদক | সংকলন | মন্তব্য |
---|---|---|---|
১৮৬৯ | হরিমোহন মুখোপাধ্যায় | কবিচরিত | পদের উল্লেখ পাওয়া গেছে। |
১৮৭২ | জগদ্বন্ধু ভদ্র | মহাজনপদাবলী | |
১৮৭৮ | অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারাদাচরন মিত্র | প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ | |
১৮৮৫ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার | পদরত্নাবলী | ১৪টি চণ্ডীদাসের পদ ছাপা হয় |
১৮৯৩ | রমণীমোহন মল্লিক | চণ্ডীদাস | প্রথম সংস্করণে ৩0১টি দ্বিতীয় সংস্করণে ৩৪0টি পদপ্রকাশ করেন। |
১৮৯৮ | নীলরতন মুখোপাধ্যায় | চণ্ডীদাসের অপ্রকাশিত পদাবলী | সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩0৫ সন) রাসলীলার ৭১টি পদ |
১৮৯৮ | নগেন্দ্র নাথ বসু প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব | চণ্ডীদাসের চতুর্দ্দশ পদাবলী | ১৩0৫ সন ৩য় সংখ্যা ১৪টি পদ |
১৯০৫ | দুর্গাদাস লাহিড়ী | বৈষ্ণবপদ লহরী | চণ্ডীদাসের ৩৩৬টি পদ প্রকাশ হয় |
১৯১৪ | ব্যোমকেশ মুস্তাফী | ‘জর্ম্মলীলা’ | জন্মলীলা পালাগান সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা ১৩২১ সন ১ম সংখ্যা |
১৯১৪ | মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য়বিশারদ | ‘রাধার কলঙ্ক ভঞ্জন’ | পালাগান সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা |
১৯১৪ | নীলরতন মুখোপাধ্যায় | চণ্ডীদাসের পদসংগ্রহ | প্রায় ৯00 পদ প্রকাশ করেন |
১৯১৬ | বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ | বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন | রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ভূমিকাসহ প্রকাশিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে। |
১৯২৬ – ২৭ | মণীন্দ্রমোহন বসু | দীনচণ্ডীদাসের পদাবলী | কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর পুথিশালা থেকে প্রাপ্ত, প্রায় ২000 পদ। সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশিত। |
চণ্ডীদাস চরিত
কবিরে খুঁজো না কবির জীবন চরিতে, একথা রবীন্দ্রনাথ কাকে নিয়ে লিখলেন ? চণ্ডীদাস ? বোধ হয় কোনো কবির জীবন নিয়ে এতো মসীযুদ্ধ হয় নি চণ্ডীদাসকে নিয়ে যা হয়েছে। কারণ চণ্ডীদাসের সমগ্র জীবনই তো কিংবদন্তী দিয়ে মোড়া। বাঙালি জাতির মধ্যে এমনিতেই ‘আমাদের’ করে নেবার প্রবণতা আছে। কোথাকার প্রশ্নে আমরা বাঙালিরা একবার যাকে বঙ্গভূমির ত্রিসীমানায় পাই তাকে বাঙালি বানিয়ে ছাড়াই দস্তুর। নইলে, কালিদাস, নৈষধের শ্রীহর্ষ, ভট্টনারায়ণ বা জয়দেবে কেউই বাঙালি পেটেন্ট দাবির হাত থেকে নিস্তার পাননি। জয়দেবের ক্ষেত্রে অবশ্য ওড়িয়ারা তাদের বিন্দুবিল্ব গ্রাম নিয়ে দাবি এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিতর্কের গলার জোরে বাঙালিত্বই জিতেছে। চণ্ডীদাসের ক্ষেত্রে আবার বাঙালিত্ব নিয়ে সংশয় নেই বিতর্কটা জেলাওয়াড়ি। কতগুলি কিংবদন্তী কিছু কিছু অনুদঘটিত প্রশ্ন চণ্ডীদাসের জীবন চরিতের কিংবদন্তীগুলিকে প্রবল প্রতিস্পর্ধী করে রেখেছে। বলাবাহুল্য এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রামী রজকীনি সংক্রান্ত অসংগত প্রেমের কাহিনি। যেখানে রামীর উপস্থিতি কেচ্ছাপ্রিয় বাঙালিকে চণ্ডীদাস আলোচনায় বরং রামী কাহিনি আলোচনায় আরো প্রোৎসাহিত করেছে সন্দেহ নেই। বিষয়টা আরো গভীরভাবে অনুধাবণ করার বিষয়। রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার পদ রচনার ধারা সেনযুগ থেকেই চালু আছে। শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্ণামৃত সংগ্রহে রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক সংগ্রহ সংস্কৃত ভাষায় হয়েছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দ সংগীত সংগ্রহে অনেক সংগীতই পরবর্তীকালের কীর্তনীয়াদের দ্বারা গৃহীত ও গীত। চৈতন্যদেবের জীবৎকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার যে প্রতিষ্ঠা নিত্যানন্দ মহাপ্রভূ তার জীবত্কালে প্রসারিত করে দিয়ে গেছেন তাতে বৈষ্ণব জীবনাচর্যের মধ্যে কলা চর্চার সবোৎকৃষ্ট উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কীর্তন গান ও তার জন্য পদ রচনা। এরজন্য সেকালে প্রসিদ্ধ ছিল বেশ কয়েকটি বৈষ্ণবপদের সংগ্রহ গ্রন্থ। বিশ্বনাথের ক্ষণদাগীত চিন্তামণি থেকে শুরু করে রাধামোহনের পদামৃত সমুদ্র, নরহরি চক্রবর্তীর গীতচন্দ্রোদয়, বৈষ্ণব দাসের কল্পতরু, গৌরসুন্দর দাসের কীর্তনানন্দ এই সংগ্রহের তালিকায় মুখ্য। পরবর্তীকালে মুদ্রাযন্ত্রের যুগে বৈষ্ণব অবৈষ্ণব দুই ধারাতেই বৈষ্ণবপদের সংকলন হয়েছে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে পদরত্নাকার, …… পদকল্পলতিকা বৈষ্ণব ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ। অন্যদিকে সারদাচরণ মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের প্রাচীনকাব্য সংগ্রহ, রবীন্দ্রনাথ ও শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পদরত্নাবলী গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ। এই সমস্ত গ্রন্থে চণ্ডীদাসের পদ সংগৃহীত হয়ে এসেছে সগৌরবে। কারণ চণ্ডীদাসের নামের চলিত পদগুলির মধ্যে কতকগুলি একই মাধুর্যময় এবং প্রসাদগুণে অদ্বিতীয় যে চণ্ডীদাস বাংলার পদকর্তাদের মধ্যে প্রধান পদকর্তায় পরিণত হয়েছিলেন। বলাবাহুল্য চৈতন্যদেবের জীবৎকালের পরে বৈষ্ণব ভাবধারার জোয়ারে কীর্তনের আসরে সংগীতকাররূপেই চণ্ডীদাসের খ্যাতি। আর এরই সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছে চণ্ডীদাসের জীবন সংক্রান্ত কিংবদন্তীগুলি। এগুলিকে জনশ্রুতি তৌলে বিচার করাই শ্রেয়। কারণ কোনো খানেরই কোনো বিষয়ে কোনো প্রামাণিকতা এমন নেই যে একটা ধারণার দ্বারা অন্য ধারণাকে নস্যাৎ করে দেখা যায়। অতএব জনশ্রুতির প্রাচীনত্ব নয় জনশ্রুতির পার্শ্বে সমর্থকদের প্রাবল্যের বিষয়েই এখানে ক্রমতালিকা তৈরি হয়েছে এখানে তাই একের পর এক কিংবদন্তীগুলি আলোচনা করা হল।
‘নানুর সংক্রান্ত কিংবদন্তী’
পদকল্পতরু ৮৭৭ নং সংগৃহীত চণ্ডীদাসের পদে আছে
নানুরের মাঠে গ্রামের হাটে
বাহুলি আছয়ে যথা।
তারারি আদলে কহে চণ্ডীদাসে
সুখ সে পাইবে কোথা।।
সারাবাংলার প্রসিদ্ধ চণ্ডীদাস নানুর বা নানুরের কবি। তিনি ছিলেন নানুরের বিশালক্ষী বা বাপুলি বা বাসলী দেবীর সেবক বা পুরোহিত। পবরর্তীকালের চণ্ডীদাসের পদ সংকলনের সম্পাদক চণ্ডীদাস সংক্রান্ত কিংবদন্তীকে আশ্রয় করে উল্লেখ করেছেন যে চণ্ডীদাস ছিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণের পুত্র তেমন করে বেশি কিছু লেখাপড়া শিখতে পারেন নি। সম্ভবত গ্রামীণ কথক ঠাকুরদের বা অন্য কোন থান থেকে একটু আধটু পুরাণ জেনেছিলেন কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য গীত গোবিন্দ ভালোভাবেই পড়েছিলেন। গান বাঁধার ক্ষমতা ও কবিত্ব শক্তি উভয়ই ছিল। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ তার নামে প্রচুর পাওয়া গিয়েছে। তিনি গণনার হিসাবে চৈতন্য দেবের পূর্ববর্তী সময়ের মানুষ। চৈতন্য পূর্বযুগে কীর্তনের চণ্ডীদাসের পদ সহজেই সংগৃহীত ও আলোচিত হয়েছে। তিনি যে চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী কালের মানুষ চৈতন্য চরিতে সেপ্রসঙ্গে আছে
চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটক গীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীত গোবিন্দ।
স্বরূপরামানন্দ মনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে
গায় শোনে পরম আনন্দ।।
কবি বিদ্যাপতি রায়রামানন্দের নাট্যগান লীলাগুণবিল্বমঙ্গল ঠাকুরের শ্রীকৃষ্ণ কর্ণামৃত নাটক, জয়দেবের গীতগোবিন্দের সঙ্গে মহাপ্রভু চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদ করতেন। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন আবিস্কারের পর এবিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় যে চণ্ডীদাস নামধেয় কোন কবি অবশ্যই চৈতন্যপূর্বযুগেই জীবিত ছিলেন। যাই হোক কিংবদন্তীর সূত্রে কিন্তু কবির বিবাহাদি প্রসঙ্গে কিছুই জানা যায় না। তবে চণ্ডীদাসের পদের পংক্তি ধনজন দ্বারা সোঁপিনু তোরে পদাংশের সূত্রধরে দারা বা পত্নী ছিল বলে সিদ্ধান্তে এসেছেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্ববল্লভ। কিন্তু এধারণার সহায়ক অন্য কোনো কিংবদন্তী নেই।
চণ্ডীদাস বিষয়ক কিংবদন্তীর আসল অংশ তার রামীরজকিনী বা রামতারা নামিকা সাধন সঙ্গিনী সংক্রান্ত। নানুর গ্রামের তিন ক্রোশ দূরে তেহাই নামক গ্রামে নাকি রামী রজকিনীর বাস ছিল। রামী সেখানে থেকে নানুরে এসেছিলেন। এমন হতে পারে রামী বা তারা বা রামতারা সরাসরি বাহুলি দেবীর মন্দিরে আশ্রয় পেয়েছিলেন হয়তোবা চণ্ডীদাসের আগ্রহেই। নচেৎ রামী তিনক্রোশ দূর থেকে নানুরের সেই পুকুরে কাপড় কাচতে আসবেন কেন যেখানে চণ্ডীদাস ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যান। কেউ কেউ রামী সংক্রান্ত এই কিংবদন্তীকে মানতে চান না। কিন্তু এসীতা বাদ দিয়ে এই রামায়ণও দাঁড়ায় না। শুদ্ধতাবাদীদের চাইতে সহজিয়া প্রেমের পক্ষে জনশ্রুতি বেশি। চণ্ডীদাসের বহুপদেই রামী, রামতারা, তারা রজকিনীর কথা আছে। (এমনকি অন্য কবিদের চণ্ডীদাস বিষয়ক পদরচনায় এই বিষয় রয়েছে।) মুকুন্দ দাসের ‘সিদ্ধান্ত চন্দ্রোদয়’ সহজিয়া গ্রন্থের একটি শ্লোকে ‘তারাস্ব্যরজকীসঙ্গী চণ্ডীদাসোদ্বিজোত্তম’ আছে। লক্ষ্যণীয় চণ্ডীদাসের রামীরজকী, বিদ্যাপতির সঙ্গে রাজা শিবসিংহের রাণি লখিমা বা লছিমা এবং লীলাশুকের সঙ্গিনী চিন্তা সকলেই পরকীয়া রতির চর্চা করে রাধাকৃষ্ণ সাধনার পরকীয়াসাধন ধারাকে (যা চৈতন্য পরবর্তীকালে প্রচলিত হয়েছে।) পরিপুষ্ট করেছে। অকিষ্কনের বিবর্ত বিলাস ও তরুণীরমণ রচিত সহজ উপাসনা তত্বে চন্ডিদাশ ও তার রজকিনীর কাহিনী বিশদে রয়েছে । অকিষ্কনের গ্রন্থে আছে স্থানীয় রাজা চণ্ডীদাসকে নীচজাতীয়ার সংসর্গের জন্য নীচ প্রেমে উন্মাদ হয়ে নিন্দা করে সমাজ চ্যুত করেছিল। স্থানীয় রাজা চণ্ডীদাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নকুলকে চণ্ডীদাসকে প্রায়াশ্চিত্য করে জাতে ওঠার পরামর্শ দিলেন বলা বাহুল্য সমাজপতি ব্রাহ্মণদের কোপেই তার এই পদচ্যুতি। কথিত আছে চণ্ডীদাস অংসকোচে রজকিনীর গৃহেই উঠেছিলেন। জাতে ওঠানোর চেষ্টায় নকুল চণ্ডীদাসকে বলেন ‘ধোবিনী ছাড়াই ভাই জাতে উঠ তুমি! কিন্তু চণ্ডীদাস সেকথায় কর্ণপাত করলেন না, বললেন ‘সর্বস্ব ধোবিনী মোর এভূমি আকাশ’। চণ্ডীদাসের কথায় নকুলের সমস্ত সংশয় কেটে গেল এবং নকুল রামীর কাছেই সহজতত্ত্ব শিক্ষা করেন।
তরুণীরমণের সহজউপাসনাতত্ত্বে আরও আছে নকুলের উপরোধে চণ্ডীদাস প্রায়শ্চিত্য করে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে জাতে উঠতে রাজি হলেন। নিমন্ত্রণের দিন ব্রাহ্মণরা খেতে বসেছেন, চণ্ডীদাসও সকলের পাতে অন্নপরিবেশনে ব্যপৃত এমন সময় রামী কাছেই দাঁড়িয়ে পিরীতি পিরীতি জপ করতে শুরু করেন। তরুণী রমণের পুথি এখানে খণ্ডিত কিন্তু কিংবদন্তী মতে ধোবিনীকে দেখে চণ্ডীদাস আলিঙ্গন করতে গেলেন তার দুই হাতে অন্ন ব্যাঞ্জন ছিল, আরো দুটি হাত কাঁধ থেকে বেরিয়ে রামীকে আলিঙ্গন করতে গেল। দ্বিভূজ চণ্ডীদাস চতুর্ভূজ হয়ে পড়লেন। এইসব অলীক কিংবদন্তীর মাধ্যমে এখানেও রামীও চণ্ডীদাসের মিলন হল। আর এই সম্পর্ককে দৈবভ শুদ্ধ প্রমাণের চেষ্টা বারংবার চলে। এখানে রামী-চণ্ডীদাস, লছিমা-বিদ্যাপতি, চিন্তা বিল্বমঙ্গলের প্রেমের শুদ্ধতার প্রসঙ্গটিই ফিরে আসে। যাই হোক বিনোদ রায় নামক এক ব্যক্তির প্রভাবে চণ্ডীদাস বোধ হয় এই বিসংবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছিল। বিনোদ রায় সম্ভবত সেই ব্যক্তি যিনি বাহুলী দেবীর আদেশে রামীও চণ্ডীদাসের এই প্রেমকে মেনে নিয়ে ছিলেন এবং সামাজিক সমস্যা থেকে চণ্ডীদাসকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
চণ্ডীদাসের মৃত্যু কীর্ণাহারে হয়েছিল। এক নাটমন্দিরে রামীর সঙ্গে কীর্তন করতে গিয়ে নাটমন্দির ভেঙে উভয়ের মৃত্যু হয়। বিশ্ব ভারতীর একটি পুথিতে কবি দ্বিজ চণ্ডীদাসের বর্ণনায় আছে
পূর্বেতে গ্রামেতে ছিলা কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস
করিনাহার গ্রামেতে তাহার হইল নির্জাস।
তাহার পুজিৎ আছেন দেবি বিশালাক্ষি
সেই পাদপদ্ম মোই করি থক্কি।।
তবে আর একটি কিংবদন্তীর মতে চণ্ডীদাস কোনো এক গৌড়ের পাৎসা (সুলতান) এর প্রাসাদে তার আমন্ত্রণে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। চণ্ডীদাসের সংগীত শ্রবণে বিমুগ্ধ রাণী বা বেগম চণ্ডীদাসের প্রেমে পড়ে যান। গৌড়েশ্বর সব জানতে পেরে ক্রোধান্বিত হয়ে চণ্ডীদাসকে হস্তীপৃষ্ঠে ফেলে শৃঙ্খলিত করে অথবা হাতীর পায়ের তলায় ফেলে চেপে চণ্ডীদাসকে মেরে ফেলেন। রাণী চণ্ডীদাসের প্রতি এই দন্ডাদেশ সহ্য করতে না পেরে স্বয়ং প্রাণ ত্যাগ করেন। রামী রজকিনী পর্যন্ত বেগমের প্রেমের শক্তিতে মোহিত হয়ে তাকে প্রণতি জানান। কেউ কেউ বলেন চণ্ডীদাসের কীর্ণাহার স্তুপের কাহিনিই সত্য বেগমের চণ্ডীদাসের প্রতি আসক্তির কথা জানতে পেরে বাদশা কামানের গোলার দ্বারা ঐ মন্দির উড়িয়ে দেন, এটিও অসত্য। কারণ মোগল যুগের আগে কামানের ব্যবহার তেমন করে প্রচলিত ছিল না। চণ্ডীদাস কিংবদন্তীর আর একটি অংশ বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের মিলন। একাহিনিও সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এ কাহিনিতে আছে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের কবিত্বের খোঁজ পেয়ে রাজা শিবসিংহ যখন বঙ্গদেশে রাজকার্যে আসেন তখন এসে চণ্ডীদাসের সঙ্গে দেখা করেন। বলাবাহুল্য এই কাহিনি অসত্য, গালগল্প তবু এরকম বহু কিংবদন্তী চণ্ডীদাসের নামে পাওয়া যায়। তার কাশী ও বৃন্দাবনযাত্রা এর মধ্যে অন্যতম। এবং কোনো কিংবদন্তীতে আছে কবি বৃন্দাবনেই মারা যান।
ছাতনার কিংবন্তী
চণ্ডীদাসের দ্বিতীয় জন্মস্থান ছাতনা। প্রাচীন সামন্তাবনীনাথের রাজ্য বা ছত্রিণা থেকে ছাতনা নামর উৎপত্তি। মজা হল চণ্ডীদাস এখানেও বাসলী বা বাশলীদেবীর সেবক। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এবং সত্য কিংকর সাহানা বিদ্যাবিনোদ এরা ছাতনার ভ্রমণ করে চণ্ডীদাসের বাসলীমন্দির, ধোপা পুকুর যেখানে রামী কাপড় কাচতেন এবং চণ্ডীদাস মাছ ধরতেন এবং শাঁখা পুকুর চিহ্নিত করেন। বলাবাহুল্য ছাতনা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের জনশ্রুতি চণ্ডীদাস সেখানকার লোক। সেখানে তিনটি পর্যায়ে মন্দির অর্থাৎ বর্তমান মন্দিরের পূর্ববর্তী ভগ্নপ্রায় মন্দির ও চণ্ডীদাসের সমসাময়িক সর্বপ্রাচীন পুরাতন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। এখানে বাসলী দেবী মূর্তিতে অধিষ্ঠিতা। ইনিই চণ্ডীদাসের পূজিতা বাসলী। ছাতনার রাজাদের দীর্ঘ রাজবংশীয় কিংবদন্তীর সঙ্গে বাসলীদেবীর যোগ আছে তবে চণ্ডীদাস প্রসঙ্গে সে আলোচনা অপ্রয়োজনীয় তবে কোনো এক রাজা হামীর উত্তররায় দেবী বাসলীর আদেশে পাশ্ববর্তী শালতোড়া বাসী নিত্যা দেবীর পূজক চণ্ডীদাস ও তার ভাই দেবীদাসকে ছাতনায় এনে বসতিদান করেন এবং বাসলীর সেবায়েত নিযুক্ত করেন। চণ্ডীদাস সেখানেই রামী বা তারা বা রামতারা রজকিনীর সঙ্গে সহজিয়া সাধনায় লিপ্ত হন। প্রবাসী পত্রিকায় যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ও তার গোষ্ঠী-যার মধ্যে স্মরণীয় সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও ছিলেন ছাতনা ও বাঁকুড়া বাদকে নানুর বা বীরভূমবাদের চেয়ে উর্দ্ধে তুলে ধরতে চেয়ে বহুপ্রবন্ধাদি মুদ্রিত করেছেন। এখানে পদ্মলোচন শর্মা যিনি ১৩৮৭ শকের শ্রাবণে ‘বাসলীমাহাত্ম্য’ নামে একটি সংস্কৃত পুথি রচনা করেন, সেটিও সঠিক ছাপা হয়েছে। এই পদ্মলোচন বাসলী দেবীর পূজক দেঘরিয়াদের পূর্বপুরুষ ও চণ্ডীদাসের ভ্রাতা দেবীদাসের পুত্র বা পৌত্র। দেঘরিয়া বা বাসলীদেবীর বর্তমান পূজক রাড়ীয় মুখুটি কুলজাত ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ। দেঘরিয়া উপাধিপ্রাপ্ত তার গ্রন্থে আছে একটি শ্লোক যেখানে চণ্ডীদাসের নাম রয়েছে। শ্লোকটি তারই বন্দনা—
ততো নিত্য নিরঞ্জনো বুধবরঃ শ্রীকৃষ্ণ ভক্তপ্রিয়ঃ
মাতা লক্ষ্মীরিবাপরা গুণবতী বাসিনী বিন্ধ্যপূর্ব্বা।
ভ্রাতা ধার্মিক ধূরীণোহুনুরজতঃ শ্রীদেবীদাসো দ্বিজঃ
ভরদ্বাজকুলোদ্ভবঃ সহয়ুত শ্রীচণ্ডীদাসঃ কবিঃ।
‘দ্বীপেভরামভূমানে শাকে কর্কটকে রবৌ’ গ্রন্থ সমাপ্তির সময় ১৩৮৭শক অর্থাৎ ১৪৬৫ খ্রি. এই গ্রন্থরচিত। চণ্ডীদাসের ছাতনার উপস্থিতি প্রামাণ্য হলে তারিখের সূত্রে বিষয়টা অবিশ্বাস্য হয়না।
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রবাসীপত্রে কৃষ্ণপ্রসাদ সেন রচিত চণ্ডীদাস চরিত নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সে গ্রন্থে যা আছে তার চেয়ে সেই গ্রন্থ রচিত হবার পর যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির কাছে কিভাব এলো তার বিবরণই রহস্য গল্প। ছাতনার রাজা উত্তর নারায়ণ ১৫৭৫ শকে (১৬৫৩ খ্রি.) তার সভাকবি উদয়চাঁদ সেনকে দিয়ে চণ্ডীদাস চরিত্র বর্ণনা করতে বলেন। সংস্কৃত কাব্য চণ্ডীদাস চরিতমএর দুই একটি পৃষ্ঠা ব্যাতীত কিছুই পাওয়া না যাওয়ায় উদয় সেনের প্রপৌত্র কৃষ্ণপ্রসঙ্গ ১৮১৩ অব্দে বাংলা ছন্দে ঐ কাব্যের পুর্ণবয়ান করেন এর নাম বাসলীও চণ্ডীদাস। ১৮৬৭ খ্রি. রাজা শিব বাগদী নামক দারোয়ানকে ঐ পুথি দিয়েছিলেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে মারা যাবার আগে। শিবুর পুত্র তা কৃষ্ণপ্রসাদের পৌত্র মহেন্দ্র সেনকে বিক্রয় করেছিল সেখান থেকে রামানুজ কর এবং তার পরে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ঐ গ্রন্থ হাতে পান। এতে বিপুল কাহিনি লেখা আছে সবই কিংবদন্তী। এই গ্রন্থে চণ্ডীদাসের ভাষ্যে তার নিজ জন্ম সম্পর্কে ১৩২৫ খ্রি. কে ইঙ্গিত করেছেন। তবে গ্রন্থটি নির্ভরযোগ্য নয়।
তৃতীয় স্থান আরও কয়েকজন চণ্ডীদাসের কথা
সুকুমার সেন মহাশয় ষোড়শ শতাব্দীতে জীবিত এক চণ্ডীদাসের সন্ধান দিয়েছেন। ইনি ‘শ্রীভগবচ্চরণারাবিন্দমধুরত শ্রীচণ্ডীদাস’ ‘ভাবচন্দ্রিকা’ নামে এক কাব্যের রচয়িতা।
আর এক চণ্ডীদাস কবিরাজ উপাধিপ্রাপ্ত গীত গোবিন্দের টীকাকার। এমন সম্ভব ইনিই কাব্যপ্রকল্পের ধ্বনিপ্রকরণের দীপিকা নাম্নী টীকা রচনা করেছিলেন। (দ্রষ্টব্য – সুকুমার সেন বা. শঅ. ই ১ম খণ্ড পৃ-১৪৯)
কোনো কবীন্দ্র চণ্ডীদাসের বংশধর নৃসিংহ তর্কপঞ্চানন গণমার্তণ্ড নামে সংক্ষিপ্ত সার ব্যাকরণের গণপাঠের বৃত্তি রচনা করেছিলেন। সেই চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যও ‘মুখকুলে’ জাত ছিলেন। কিন্তু সে কবীন্দ্র চণ্ডীদাস এর সরাসরি বংশ থাকা, বর্ধমানের কেতুগ্রামে উত্তরপুরুষদের বসতি থাকা এবং রামী সংক্রান্ত কোনো গুজব না থাকায় ইনি মূল চণ্ডীদাস বলে মনে হয় না। উল্লেখ নৃসিংহের পূর্বপুরুষ ও অলংকার শাস্ত্রের টীকাকার ছিলেন।