বিদ্যাপতি গুণগত উৎকর্ষে ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম স্থপতি ৷ যে সময়ে আর্যাবর্তে সংস্কৃতই ছিল সংস্কৃতির বাহক ভাষা, সেই সময়ে নিজের আঞ্চলিক কথ্য ভাষাকে তিনি কবিতা রচনায় ব্যবহার করেন মধুর ও মনোহরী করে এবং ভাষাটিকে অভিব্যক্তির প্রকাশমূলকতার দিক দিয়ে যে কোনো সাহিত্যানুগ ভাষার সমকক্ষ করে তোলেন ৷ তিনি এক নতুন আঙ্গিকের কবিতার রচনাশৈলীর জনক যা অপরে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে পারে এবং আর্যাবর্তের এমন কোনো সাহিত্য নেই যা বিদ্যাপতির প্রতিভা ও রচনাশৈলীর কাছে বিপুলভাবে ঋণী নয় ৷ বিদ্যাপতিকে যথার্থ কারণেই ‘মৈথিল-কোকিল’ বলা হয়, কারণ এঁর মধুর কূজন আধুনিক উত্তরপূর্ব ভারতের ভাষার কাব্যে সত্যকারের বসন্তের সূচনা করে ৷
বিদ্যাপতির জন্ম মিথিলার প্রাণকেন্দ্রের (বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী মহকুমায়) বিসপি নামক গ্রামে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে, বিদ্বান–রাষ্ট্রশাসনকার্যে দক্ষ পরিবারে, যাঁরা পাঁচ পুরুষেরও বেশী সময় মৈথিল সমাজের নেতৃস্থানীয় ছিলেন ৷
অতি প্রাচীনকাল থেকেই মিথিলা অঞ্চল বুদ্ধিবৃত্তি ও দূরকল্পনার জন্য প্রসিদ্ধ, কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়ে মিথিলা গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে মগধের আধিপত্য স্বীকার করে নিয়েছে ৷ গুপ্তরাজাদের পর যখন রাজন্যবর্গের কাছে অশ্বমেধ যজ্ঞই ছিল দ্বিগ্বিজয়ের আদর্শ, তখন ভারতের প্রত্যেক নৃপতি গঙ্গা পার হয়ে মিথিলার বুকের ওপর দিয়ে হিমালয়ের দিকে এগিয়ে যেতেন কারণ হিমালয়ই সাম্রাজ্যের উত্তরসীমা নির্দেশক ৷ সেই কারণেই যদিও মিথিলার নিজস্ব কোনো রাজা ছিল না, তবুও এই জনপদ কখনই শান্তির আশ্বাস পায়নি ৷ সত্যিই ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে কি করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও মিথিলা নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রাখতে পেরেছিল, কিন্তু এটিই মিথিলার স্বকীয়তা ও জীবনদর্শন যা রাজনীতিকে কোনো মূল্যই দেয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত তা সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে অব্যাহত রেখেছে ৷ কিন্তু তবুও মিথিলা কলাবিদ্যার যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারেনি এবং সেই কারণেই মিথিলার সন্তানদের হতে হয়েছে পরদেশবাসী ৷ তাই ১৯০৭ সালে কর্ণাটের নন্যদেব যখন সুদূর দক্ষিণ থেকে মিথিলায় আসেন, মিথিলাবাসী তাঁকে বরণ করে নেয় সাদরে, কারণ তিনি ছিলেন বিদগ্ধ ব্যক্তি, সাহিত্য ও কলাবিদ্যার অনুরাগী ৷ তিনি স্বীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর কর্ণাট বংশীয়রা ছয় পুরুষ মিথিলায় রাজত্ব করে ৷ কর্ণাট বংশীয়রা সর্বতোভাবে নিজেদের মিথিলাবাসীদের সঙ্গে একাত্ম করে নেয় এবং তাদের উদার হিতৈষী শাসন ব্যবস্থায় মিথিলা শান্তি ও সমৃদ্ধির আশ্বাস পায় ৷ আর্যাবর্তের অবশিষ্টাংশ যখন মুসলমান শাসনের অধীনে, মিথিলায় তখন পরিপূর্ণ সুফলপ্রসূ ক্ষত্রিয় রাজত্ব ৷ এরই ফলে মিথিলাতে রেনেসাঁ বা শিল্প সাহিত্যের নবজীবনের সূচনা ৷ লক্ষ্মীধর রচনা করেন বিখ্যাত নীতিসংহিতা ‘কল্পতরু’, গঙ্গেশ প্রণয়ন করেন দর্শনশাস্ত্রের অসাধারণ গ্রন্থ ‘তত্ত্বচিন্তামণি’, এই দুই প্রাজ্ঞ মনীষী সমগ্র আর্যাবর্ত, এমন কি আর্যাবর্তের সীমানা ছাড়িয়েও বিদগ্ধতার এমন এক প্রোজ্জ্বল নিদর্শন স্থাপন করেন, যার খ্যাতি অব্যাহত ছিল পরবর্তী কয়েক শতকেও ৷
মৈথিল সমাজের নেতারা কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন যে দীর্ঘদিন মুসলমানদের এইভাবে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, তাই তারা নিজেদের সামাজিক জীবনের পুনর্বিন্যাস, সামাজিক স্থিতাবস্থা এবং সংগঠনের প্রতি মনোযোগী হন যাতে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে ৷ সেই কারণেই, যখন নির্ভীক নবীন রাজা হরিসিংহদেবের আমলে গিয়াসুদ্দীন তুঘলক ১২৪৫ শকাব্দে (১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে) মিথিলা আক্রমণ ও অধিকার করেন, তখন উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয়শাসন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও অচিরেই একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে মিথিলায় মুসলমান সুবেদারের প্রত্যক্ষ শাসন লাভজনকনয়, সম্ভবও নয় ৷ এর ফলস্বরূপ ফিরোজ শাহ্ তুঘলক তিরহুত রাজ্য রাজপণ্ডিত কামেশ্বর ঠাকুরের অধীনে করে দেন এবং এই কামেশ্বর ঠাকুর ও তাঁর বংশধরদের পূর্ণ সমর্থন করেন বিদ্যাপতির পরিবার ৷ বিদ্যাপতির পরিবার শুক্ল যজুর্বেদভুক্ত কাশ্যপ গোত্রীয় অত্যন্ত সম্মানিত ব্রাহ্মণ পরিবার, আদিবাস মজঃফরপুর জেলার পুসার কাছে সমৃদ্ধ আর উন্নত গ্রাম ঐনীতে ৷ বিদ্যাপতির জন্ম কর্ণাটদের পতনের মাত্র ২৭ বছর পরে এবং মিথিলায় ঐনবরা শাসনকালের এক দশকের মধ্যে ৷
যখন নবহিন্দুত্ব বৌদ্ধমতকে অঙ্গীভূত করে বৈদিক ও বৌদ্ধ মতবাদের সংঘর্ষকে শান্ত করেছে এবং জাতিগত ক্ষেত্রীয় বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তখনই কর্ণাটরা মিথিলায় রাজ্যস্থাপন করে ৷ নতুন ধরনের সামাজিক মূল্যবোধ তখন প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে, পুরনো প্রথা ধীরে ধীরে জায়গা করে দিচ্ছে নতুন ধ্যানধারণাকে, প্রাচীন বিধিনিষেধ রীতি-নীতির নতুন ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছে সমাজ ৷ অন্যদিকে মুসলমানেরা পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে আসছে আর্যাবর্তের দিকে এবং এক এক করে উত্তর ভারতের প্রতিটি রাষ্ট্র বিধর্মীদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে –এ সবই কর্ণাটদের রাজ্যস্থাপনের ঠিক পরের কথা ৷ মিথিলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উন্নত ও উদার কর্ণাট রাজত্বে মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এবং নিজেদের সামাজিক ভিক্তি সুদৃঢ় করতে বিভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন ৷ নতুন আদর্শ ও আইন প্রণয়ন করা হয় সামাজিক বিধিব্যবস্থা ও জাতিভেদ অনুযায়ী ব্যক্তিগত ন্যায়নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ৷ যদিও জীবনাদর্শের প্রতিটি বৃত্তে বিপুল পরিবর্তন আনা হয় কিন্তু সেগুলি পুরনো নীতিরই নব্য সংস্করণ ছিল যাতে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াই বিবর্তনমূলক হয়, আমূল পরিবর্তনমূলক না হয় ৷ এইভাবে অতীতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তদানীন্তন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয় ৷