আপন পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের সঙ্গে বিদ্যাপতি কবির সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা এতটাই মর্যাদা এবং বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, রাজা শিবসিংহের কতগুলি স্ত্রী ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে কোন বিদগ্ধা রমণীটি রাজার প্রিয়তমা পত্নীটি, তাও কিন্তু অন্য কোনো ইতিহাসের নথি থেকে জানা যায় না। বিদ্যাপতির লেখা এক একটি পদের ভণিতাই শিবসিংহের অন্তঃপুরের ইতিহাস বলে দেয়।
বিদ্যাপতির পদগুলি থেকেই বুঝতে পারি যে, তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের অনেকগুলি স্ত্রী ছিলেন। প্রসিদ্ধা লক্ষ্মণা দেবী- বিদ্যাপতির ভাষামাধুর্যে কিংবা শিবসিংহের সমাদর-মধুরতায় যিনি লছিমা দেবী কিংবা লখিমা দেবী, তাঁর কথা অন্যত্র হবে, কেননা বিদ্যাপতির অধিকাংশ রাজ-নামাষ্কিত পদেই শিবসিংহের সঙ্গে লছিমা দেবী সালংকারে বিদ্যমান। কিন্তু লছিমা দেবী ছাড়াও আরও যেসব রমণী শিবসিংহের অন্তঃপুরবাসিনী হয়েছিলেন, তাঁরাও সকলে কবি বিদ্যাপতির কবিজনোচিত সমব্যথায় উল্লিখিত হয়েছেন এক-একটি পদে। এই পদাবলী থেকেই জানতে পারি লছিমা দেবীর মতো প্রধানা মহিষী ছাড়াও শিবসিংহের অন্য স্ত্রীরা হলেন মধুমতী দেবী, সুখমা দেবী, সোরম দেবী, মেধা দেবী, রূপিনী দেবী এবং মোদমতী দেবী।
মধুমতী দেবী
মধুমতী দেবী হলেন শিবসিংহ রাজার সাত রাণীর এক রাণী। কবি বিদ্যাপতি তাঁর একটি পদে সখীর উক্তিতে রাধার যৌবনোদ্ভেদী রূপ-পরিবর্তনের উল্লেখ অবশেষে ভণিতায় বললেন —
নব জউবন নব কন্তা।
সিবসিংহ রাজা এহো রস জানএ
মধুমতি দেবি সুকন্তা।।
ভণিতায় নবযৌবনান্বিত কান্তের সঙ্গে নবকান্তার মিলন দেখে মনে হয়–শিবসিংহের সঙ্গে নতুন বিয়ে হওয়া নববধূর স্মারক হিসেবেই যেন মধুমতী দেবীর কথা বিদ্যাপতির পদে এসেছে।
সুখমা দেবী
সুখমা দেবী বোধহয় সাধু সংস্কৃত ভাষায় সুষমা দেবী। তিনিই সম্ভবত রাজা শিবসিংহের দ্বিতীয়া প্রিয়তমা পত্নী যিনি বিদ্যাপতির দুখানি পদে কাব্যিক সরসতায় উল্লিখিত হয়েছেন। একটি পদে রাজা শিবসিংহের সঙ্গে সাধারণভাবে–
মধুর জানি কর পরভীতি।।
রাজা রূপনরাএন জান।
সুখে সুখমা দেবি রমনি।
আর একটি পদে সুখমা দেবী শিবসিংহের প্রিয়তমা পত্নী লখিমা দেবীর সঙ্গে একত্রে উল্লিখিত হয়েছেন। বিদ্যাপতির শব্দব্যঞ্জনা খেয়াল করলে এই পদে লখিমা দেবীর বিধিসম্মত পতিত্বের পাশে সুখমা দেবী শিবসিংহের রমনপদবী লাভ করেন। এখানে সুখমা দেবীর সৌন্দর্য-মাধুর্য যেন লখিমা দেবীর ঈর্ষণীয় স্থানে বিশ্রান্তি লাভ করে। পদটি এইরকম —
মেদিনি মদন সমানে।
লখিমা দেবিপতি রূপনরাএণ
সুখমা দেই রমানে।।
পদটিতে কবি মাধব কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে বলছেন– কামিনীর কেলি আর কুমুদিনীর সঙ্গে চাঁদের সম্বন্ধ এক মনে হয়। প্রভু ! তুমি দূরে দূরে আছ, তবু কী এটা বুঝেছো যে, প্রেমসন্তপ্তা এক বিরহিনী রমণীকে দেখতে কত আনন্দ। বিদ্যাপতি বলছেন –শোনো যুবতি ! লখিমা দেবীর স্বামী সুষমা দেবীর প্রিয় বল্লভ। রূপনারায়ণ শিবসিংহ এই পৃথিবীতে মদনের সমান।
এই পদে সুখমাদেবীর বল্লভতা লখিমাদেবীর বিধিসম্মত পাতিব্রত্যকে অতিক্রম করে যেন।
সোরম দেবী
সাধু ভাষায় এই সোরম দেবী সম্ভবত সুরমা দেবী। বিদ্যাপতির মূল পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের অন্যতমা পত্নী। শিবসিংহের প্রিয়তমা পত্নী লখিমা দেবী যদিও বিদ্যাপতির সর্বাধিক পদে শিবসিংহের পাশাপাশি বহু মর্যাদায় উল্লিখিত হয়েছেন, তবু তাঁর অন্য পত্নীরাও বিদ্যাপতির সহৃদয়তা থেক বঞ্চিত হননি। সোরম দেবী বা সুরমা দেবী তাঁদের মধ্যে একজন । একটি জ্যোৎস্নাভিসারের পদে অভিসারিকার সাহসের কথা সমর্থন করে বিদ্যাপতি তাঁর ভণিতায় সোরম দেবীর উল্লেখ করে বলছেন — শোনো যুবতি, শোনো ! সাহস করলেই সব কাজের সিদ্ধি হবে। রসময় শিবসিংহ রাজা সুরমা দেবীর (সোরম দেবি) সঙ্গে এই রস বোঝেন —
সাহসে সকল কাজে।
বুঝ সিবসিংহ রস রসময়
সোরম দেবি সমাজে।
মেধা দেবী
কবি বিদ্যাপতির মূল পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের অন্যতম স্ত্রী হিসেবেই তিনি বিদ্যাপতির একটি পদে স্থান লাভ করেছেন। লক্ষণীয়, যে পদটিতে মেধা দেবী শিবসিংহের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছেন, সেটি খগেন্দ্রনাথ মিত্র এবং বিমানবিহারী মজুমদারের যুগ্ম সম্মাদনায় প্রকাশিত সংস্করণে নেই। কিন্তু তালপত্রের পুঁথি এবং লোচন কবির রাগতরঙ্গিনীতে ধৃত আছে বলে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তাঁর বিদ্যাপতির পদাবলীতে উল্লেখ করেছেন। এই পদটিতে এক কুলবতী রমণী, সম্ভবত রাইকিশোরী দুধের কলসী নিয়ে হাটে গেছে। সেখানে কৃষ্ণকে দেখে তাঁর যে মোহ উপস্থিত হয়েছিল, সেটা তিনি সখীর কাছে বর্ণনা করছেন।
এই বর্ণনা শেষে বিদ্যাপতির ভণিতা। ভণিতায় রাজা শিবসিংহকে দান কল্পতরু আখ্যা দিয়েছেন বিদ্যাপতি। একই সঙ্গে তাঁকে ‘হিন্দু সুলতান’ বলে সম্বোধন করার মধ্যেও তৎকালীন ইসলামি শাসকের সমান-গোত্রিয়তা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। পদের শেষে শিবসিংহের সংসারী রূপের বর্ণনায় মেধাদেবীর প্রতিষ্ঠা ঘটেছে রাজার পত্নী হিসেবে। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সঙ্কলিত পদটি এইরকম –
লোচন জুগল জুড়াএল বটিআঁ।। ২ ।।
দরশন লোভে পসার দেল হমে
সখি মুখে সুনি বড়রসী।
তখনে উপজু রস ভেলিহু মোঞে পরবস
বিসরলি দুধহু কলসী।।৪
মধুরিপু সম নহি দেখিঅ সোহাওন
জে দিঅ তহ্নিক উপাম রে।
সরদ সুধানিধি জসু মুখ নেঞোছন
পঙ্কজ কী লেব নাম রে।। ৬ ।।
অধরাঞে লোচনে জখনে নিহারলহ্নি
বাঙ্ক কইএ ভউহ ভঙ্গা রে।
তখনুক অবসর জাগল পচসর
থানে থানে গেল অঙ্গা রে।।৮।।
দান কলপতরু মেদিনি অবতরু
নৃপতি হিন্দু সুরতান রে।
মেধা দেবিপতি রূপনরাঅন
সুকিথ ভনথি কণ্ঠহার রে। ১0।।
রূপিনী দেবী
কবি বিদ্যাপতির মূল পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের আর এক স্ত্রী হলেন রূপিনী দেবী। শিবসিংহের পট্টমহিষী প্রিয়তমা লখিমা দেবীর কথা ছেড়েই দিলাম। রাজা শিবসিংহের অন্তঃপুরে আরও যেসব স্ত্রীরা ছিলেন– সুখমা দেবী থেকে মোদমতী দেবী–তাঁদের মধ্যে ইনিও হারিয়ে যেতেন অনামিকার মতো। শুধু বিদ্যাপতির একটি পদে তিনি উল্লিখিত হয়েছেন বলেই বুঝতে পারি যে, রূপিনী দেবীও শিবসিংহের অন্যতম পত্নী ছিলেন। যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন বলেই তাঁর নামও হয়তো রূপিনী দেবী ছিল। বিদ্যাপতি তাঁকেও রূপিনী-রমন বলেই তাঁর ভণিতায় লিখেছেন–কান্তা কান্তের মনোরথ পূর্ণ করে, বিরহিনী ব্যাকুল হয়ে কেঁদে বেড়ায়। বিদ্যাপতি বলেন — রূপিনী দেবীর রমণ রাজা শিবসিংহ এই রস জানেন–
রাত্র শিবসিংঘ রূপিনি দেই রমান।।
মোদমতী দেবী
পদাবলীকার বিদ্যাপতির পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের একজন পত্নী। জনবাদে জর্জরিত এক বিরহিনী রমনীর দুঃসহ কষ্ট-বর্ণনার শেষে বিদ্যাপতি তাঁর ভণিতায় লিখেছেন–যে যার প্রতি অনুরক্ত হয়েছে, তার ওপরে বিধি বাম হয়ে কী করবে ? বিদ্যাপতি গাইছেন –মোদমতী দেবীর কান্ত রসজ্ঞ রাজা শিবসিংহ মন দিয়ে সব রস বোঝেন —
রস বুঝয় রসবন্ত।
রাজা সিবসিংঘ মন দয় সজনী
মোদবতী দেই কন্ত।।
এই একটি মাত্র পদেই মোদবতী দেবীর উল্লেখ আছে এবং সে উল্লেখই এটা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট যে, মোদবতী দেবী রাজা শিবসিংহের অন্যতমা স্ত্রী ছিলেন।
লখিমা দেবী
পদাবলীকার বিদ্যাপতির কবিতা সহৃদয়ের হৃদয় দিয়ে যাঁরা বুঝেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মিথিলা-তিরহুতের রাজা শিবসিংহ যদি প্রধান হন, তবে তাঁর পট্টমহিষী এবং প্রিয়তমা পত্নী লখিমা দেবী ছিলেন বিদ্যাপতির সমপ্রাণা সখীর মতো। শ্রদ্ধেয় লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকবি কালিদাসের কাব্য জীবন নির্মাণ করেছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য এবং তাঁর মহিষীর সহৃদয়তা ব্যবহার করে। যে কালিদাসের জীবন সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় না, যিনি রাজসভার কবি হওয়া সত্ত্বেও আপন জীবনের সমস্ত ভালমন্দ, ব্যক্তিজীবনের সমস্যাগুলি ছাড়াও রাজসভার ষড়যন্ত্র, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে কাব্যের অমৃতটুকু আমাদের দিয়ে গেছেন, তাঁর জীবন নির্মাণ করেছেন শরদিন্দু এবং অত্যন্ত সফলভাবেই ।
আমাদের দুঃখ হয়, বিদ্যাপতির জীবনে তাঁর স্বলিখিত উপাদানই ছিল শত শত। তাতে কবির সামাজিক জীবনে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে তো এক বিরাট প্রবন্ধ তৈরী হতে পারে, সেখানে তাঁর কবিতাও তো নিরালম্বা ছিল না কখনও। মিথিলা-তিরহুতের ওইনিবার-বংশের রাজারা অতি অল্প বয়স থেকেই পণ্ডিত-কবি বিদ্যাপতিকে পালন-পোষণ করেছেন অত্যন্ত মর্যাদা সহকারে এবং এখানে তাঁর নান্দনিক কাব্য-জীবনে যখন তিনি পদাবলীর কবি হয়ে উঠেছেন , সেখানে রাজাদের সঙ্গে তাঁদের মহিষীরাও বিদ্যাপতির কবিতা-পোষণী হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে হয়। রাজা শিবসিংহের সময়ে বিদ্যাপতি কবিতার রসায়ন গাঢ়তম হয়ে ওঠে এবং সেখানে শিবসিংহের সখাসম প্রসন্নতা, গুণগ্রাহিতা এবং সমাদর আর্থিক সচ্ছলতা দিয়ে থাকে বিদ্যাপতিকে, তাহলে তাঁর কবিতার নান্দনিক প্রসারে রাজমহিষী লখিমা দেবীর প্রসন্ন মুখখানিও বিদ্যাপতির কবিতা সহচরী হয়ে উঠেছে।
বিদ্যাপতি কবিতা-পদ যেখানে-যেখানেই শিবসিংহের নামাঙ্কিত, সেখানে সেখানেই প্রায় লখিমা দেবীর রমণ-বসতি। শিবসিংহের নাম যে পদগুলিতে আছে, সেইরকম ২0২ টি পদের মধ্যে সাত-আটটি বাদ দিলে প্রায় সবগুলিতেই লখিমা দেবীর কবিসহায়িনী উপস্থিতি প্রকট হয়ে উঠেছে। ‘রাজা সিবসিংহ রূপনারায়ণ’-এর সঙ্গে যখন ‘লখিমাদেই পরমান’ হয়ে ওঠেন, তখন যেন মনে হয় বিদ্যাপতির কাব্যগুণের বিচারে রাজা শিবসিংহের চেয়েও লখিমা দেবী বোধহয় কষ্টিপাথরটির মতো হয়ে ওঠেন । বিদ্যাপতির ভণিতায় বারবার শিবসিংহের নাম এসেছে বিদ্যাপতির কাব্যরসের রসিক সহৃদয় বলে, তেমনই লখিমা দেবী শিবসিংহের প্রিয়তমা সহচারিণীর সম্মান লাভ করেও তিনিও কিন্তু , কবির কবিতার রস বোঝেন বলেই এমন একটা পংক্তি ভণিতায় এসেছে যে, রাজা শিবসিংহ এবং লছিমা (লখিমা) দেবীর জন্যই এই রসগান–
আপে করহ পয়ান
রাজা শিবসিংহ রূপনরায়ণ
লখিমা দেই রসগান।।
পণ্ডিত উমেশ মিশ্র তাঁর ‘বিদ্যাপতি ঠাকুর’ নামে বিশাল প্রবন্ধে লখিমা দেবীকে নিয়ে যে পদটি উদ্ধার করেছেন, সেটা পড়লে মনে হয় ব্যক্তিগতভাবেও লখিমা দেবী বিদ্যাপতির কবিগুণের উৎসাহদাত্রী ছিলেন এবং হয়তো বা এই উৎসাহ বিদ্যাপতির কাছে নান্দনিক অনুপ্রেরণা বহন করেছে। তাতে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বিদ্যাপতি তাঁর ভণিতায় লখিমা দেবী সম্বন্ধে লিখেছেন–
বিদ্যাপতি ইহ ভান।
এখানে পদের মধ্যে ‘লখিমা চরণ’ কথাটিই সেই চরমতম অনুমানগুলি নিরস্ত করে দেয়, স্তব্ধ করে খল-নিন্দুকের স্বভাব এবং মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যাপতিকে প্রতিষ্ঠা করে এক ‘নিরস্ত-কুহক’ সত্যের মধ্যে। অর্থাৎ লখিমা দেবী অবশ্যই বিদ্যাপতির গুণগ্রাহী ছিলেন, কিন্তু এই গুণগ্রাহিতা এমন পর্যায়ের ছিল না, যেখানে লখিমা দেবীর সঙ্গে বিদ্যাপতির একটা সম্পর্ক -সৃষ্টির কাহিনী তৈরী করা যায়। অথচ মানুষ কিন্তু সেটা করেছে। গবেষকেরা লক্ষ্য করেছেন যে, বিদ্যাপতির জীবন-বৃত্তান্ত এদেশের লোক অনেকটাই লক্ষ্য করেছেন যে, বিদ্যাপতির জীবন-বৃত্তান্ত এদেশের লোক অনেকটাই জানে না কিংবা অনেকেই বিদ্যাপতিকে ভুলে গেছে, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে প্রবাদগুলি মানুষ ভোলে না। অবশ্য এখানে প্রবাদ তৈরী হওয়ার কারণও আছে।
শিবসিংহ রাজার নামাঙ্কিত পদগুলিতে প্রায় সর্বস্থানেই লখিমা দেবীর নাম করেছেন বিদ্যাপতি। এই নাম শিবসিংহের সহচরী হিসেবে এলেও লখিমা দেবীকে বেশ একটা ‘রোমাণ্টিক’ সতী হিসেবে চিহ্নিত করায় বঙ্গদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষও এটা বিশ্বাস করেন যে, লখিমা দেবীর ব্যাপারে কবির অনুরাগ ছিল। এখানে কবি চণ্ডীদাসের রামতারা বা রামী রজকিনীর মতোই বিদ্যাপতির ওপর এই আরোপ তৈরী হয় যে, তিনিও লখিমা দেবীর প্রেমাসক্ত ছিলেন। এই অনুমান আরও বাড়িয়ে তুলেছেন জনৈক বৈষ্ণব কবি। পণ্ডিত গবেষক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘নরহরি’ নামে একজন বৈষ্ণবকবির পদ উদ্ধার করে লিখেছেন —
বিলসয়ে রূপনারায়ণ সঙ্গ।।
আবার অন্য একটি পদে সেই নরহরি লিখেছেন —
যারে দেখি কবিতা স্ফুরয়ে শত ধার।।
এই পয়ারগুলির সারমর্মটা যতটুকু বোঝা যায়, তাতে এটাই যেন প্রমাণ হয় যে, বিদ্যাপতি লখিমা দেবীকে প্রেমের চোখেই দেখতেন এবং সে প্রেম এমনই যে লছিমাদেবী বিদ্যাপতির আরাধ্য দেবী রাধার আসনে বসে গেছেন — লছিমারূপিনী রাধা। এখানে এই কাব্যশংসার মধ্যে যতটুকু সহজিয়া ভাব ধরা পড়ে, শুদ্ধা ভক্তি ততটা নয়। তবে সহজিয়াই হোক অথবা শুদ্ধা ভক্তির কথাই হোক–বিদ্যাপতি এই দুয়েরই ঊর্ধ্বে । কেননা, গবেষণায় এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বিদ্যাপতি ধর্মক্ষেত্রে শৈব ছিলেন, কৃষ্ণলীলার অনেক কথা তিনি লিখেছেন বটে, কিন্তু চৈতন্য ভাবিত রাধাভাবে তিনি ভাবিত ছিলেন না, সহজিয়া ভাবের তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
তাছাড়া পরবর্তী কালের গবেষণা এটাও প্রমাণিত করেছে যে, বিদ্যপতির পদে বা ভণিতায় এমন কোনো আভাসও নেই যেখানে তিনি তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজার স্ত্রীর প্রতি কোনে হৃদয়ানুরাগ প্রকাশ করছেন। বিশেষত এটাও প্রায় অসম্ভব কথা যে, শিবসিংহর মতো রাজা, যিনি একবার রাজকর বন্ধ করে দিয়ে, আর একবার নিজের নামে মুদ্রা ছাপিয়ে সুলতানের শাসন অতিক্রম করেছিলেন, সেই স্বাধীনচেতা রাজা আপন রাজসভার রাজপণ্ডিতের সঙ্গে আপন পট্টমহিষীর সম্পর্ক-শিহরণ সহ্য করবেন। আসলে সেই কালে বিদ্যাপতির মতো এক বিদগ্ধ কবি তাঁর কাব্যমধ্যে তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজার স্ত্রীর নাম রাজার সঙ্গে সমান আদর-শ্রদ্ধায় বারবার উল্লেখ করেছেন বলেই ‘মুখর জগতের মুখ’ তিনি স্তব্ধ করতে পারেননি । কিন্তু এটা কেউ ভাবলেন না যে, বিদ্যাপতি তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজার অন্য স্ত্রীদের নামও করেছেন একই সমাদরে এবং তাও ভণিতার মধ্যেই। অল্পসংখ্যক পদেই একবার কী দুবার সেই সব স্ত্রীদের নাম উচ্চারিত হয়েছে এবং রাজার ‘পরিগ্রহ-প্রিয়ত্ব’ বুঝেই।
লখিমা দেবীর নাম যে বারবার বিদ্যাপতির রাজনামাঙ্কিত পদগুলিতে মুখর করে তুলেছে তার সবচেয়ে বড়ো কারণ লখিমা দেবী নিজেই। সেইকালের দিনে যখন মহিমাদের শিক্ষা এবং জ্ঞানলাভের পথ তত মসৃণ ছিল না, তখন লখিমা দেবী নিজেই ছিলেন প্রত্যুদাহরণের মতো। তাঁর বিদ্যা-শিক্ষার সঙ্গে রাজবাড়ির আভিজাত্য সহোদরের মতো অবস্থান করায় লখিমা দেবী নিজেই যেহেতু এক অতিবিদগ্ধা রমণী হয়ে উঠেছিলেন, তাই রাজপণ্ডিত বিদ্যাপতির লেখা ‘বিদগ্ধ্য-ভঙ্গী-ভণিতী’-র সমঝদারি করাটা তাঁর বৈদগ্ধ্য-ভাবনার অবসর। এক কাব্যশৃঙ্গারী কবি যেখানে জগৎকে রসময় করে তুলেছেন, সেখানে বহুশিক্ষিতা বিদগ্ধা রমণী তাঁর প্রশংসা না করে থাকবেন কী করে!
সেইকালেই শিবসিংহ রাজার এই পট্টমহিষীটির বিদ্যাবত্তার কথা লোকে জানত। হয়তো বিদ্যাপতির মতো তিনি অবহট্ট বা ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনা করেননি, কিন্তু তৎকালীন দিনে যে ভাষার জ্ঞান বিদ্যাবত্তার পরিচয় ছিল, সে সংস্কৃত ভাষায় লখিমা দেবীর এতটাই জ্ঞান ছিল যে, সংস্কৃতে তিনি তির্যক বিষয়বস্তু নিয়েও শ্লোক রচনা করতে পারতেন। যে শ্লোক তিনি লিখেছিলেন বা বলেছিলেন, সেগুলি কতগুলি গল্পকাহিনীরও জন্ম দিয়েছে।
শোনা যায়, কোনও এক সময়, যখন লখিমা দেবী পুরোপুরী এক রাজমহিষী হয়ে ওঠেননি, সেইকালে তিনি পুকুর থেকে জল আনতে গিয়েছিলেন। সুন্দরী রমণী কলসী কাঁখে নিয়ে ঘরে ফিরছেন, এই সময় এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণ তাঁর দিকে তাকাতে তাকাতেই অলস মনে পথ চলছিলেন। একজন পুরুষ মানুষ এইভাবে এক স্ক্রীলোকের দিকে তাকালে তারও চোখ পড়ে সেই পুরুষের দিকে, মুহূর্তের সে তার দৃষ্টি বুঝে নিয়ে আপন ইতিকর্তব্যতাও স্থির করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়া চলার মধ্যে ব্রাহ্মণটি নিজের দৃষ্টিদোষ লখিমা দেবীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে বলল–
তুমি আমার দিকে এমন করে তাকাচ্ছো কেন, মেয়ে! তোমার কাঁখে কলসী, অথচ অর্ধোন্মীলিত চারু দৃষ্টিতে এমন বাঁকা করে তাকাচ্ছো কেন আমার দিকে ?
বক্রেণ চারু -পরিমীলিত-লোচনেন।
এটুকু বলেই আপন দৃষ্টি-রমণের দোষটুকু সম্পূর্ণভাবে লখিমাদেবীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে পণ্ডিত-ব্রাহ্মণ বলল–
তুমি অন্য কোনো পুরুষের দিকে দৃষ্টি দাও হে সুন্দরী ! তাতেই তোমার কাজের কাজ হবে। আমার কথা যদি ভেবে থাকো, তাহলে জেনে রেখো –আমি এইসব মেয়েরে ছুঁয়েও দেখি না। কলসী কাঁখে নিয়ে চলার পরিশ্রমে যাদের কোমরে খাঁজ তৈরী হয়ে গেছে, সেই সব মেয়েদের আমি ছুঁই না কখনও —
নাহং ঘটাঙ্কিত-কটীং প্রমদাং স্পৃশামি।।
পণ্ডিত-ব্রাহ্মণের এই শ্লোকটির যত ব্যঞ্জনা ওই রমণীর ঘটাঙ্কিত কটীতটের মধ্যেই। লোকপ্রসিদ্ধি এইরকমই যে, কলসী কাঁখে জল আনার ব্যায়ামে স্ত্রীলোকের কোমর সরু হয় এবং তাতে অন্য অঙ্গে পৃথুলতা আরও বেশী লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। বস্তুত ব্রাহ্মণের পৌরুষের দৃষ্টি কটীনিমিত্তক অন্যদর্শনে আবিষ্ট ছিল। অতএব প্রত্যাখ্যান এবং অপমান করার জন্য কলসী ভরে পুকুর থেকে জল আনার মতো একটা ব্যাপারকে হীনকর্মের আখ্যা দিয়ে পণ্ডিত লখিমা দেবীকে কাজের লোক বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করল।
কিন্তু একজন মহিলাকে এই অপমান করার পর ব্রাহ্মণ ভাবল-সংস্কৃত ভাষায় শ্লোক বলে তিনি অপমানে জর্জরিত করে দিয়েছেন এক সুন্দরী রমণীকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ এটা বোঝেনি যে, সে এই তির্যক কথাগুলি যার বিরুদ্ধে বলেছে, তিনি হলেন লখিমা দেবী। তাঁর বিদ্যাবত্ত এবং বিদগ্ধতার কথা জানে না এই উপরিচতুর ব্রাহ্মণ। লখিমা দেবী নিজেকে বুঝিয়ে ব্রাহ্মণের উদ্দেশে প্রতিশ্লোক উচ্চারণ করে। লখিমা দেবী বললেন —
কামনার দেবতার পঞ্চশরে মুগ্ধ হয়েছো তুমি ব্রাহ্মণ ! সত্যি বলছি -তোমায়–তোমার কথা ভেবে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকিনি। আসল ঘটনা হল — আমার বাড়িতে যে কাজ করত, আমার চাকরটা কোথায় যেন চলে গেছে। অথচ ওই চাকরটা ঠিক তোমার মতো দেখতে। আর সেইজন্য তোমাকে দেখার পর থেকেই আমার মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব-দোটানা হচ্ছিল–এই লোকটাই আমার সেই পুরাতন ভৃত্যটি, নাকি এটা অন্য লোক । এই জন্যই তোমার দিকে তাকেয়ে দেখছিলাম আমি–
নাহং ত্বদর্থমনসা পরিচিন্তয়ামি।
দাসো’দ্য মে বিঘটিতস্তবতুল্যরূপঃ
স ত্বং ভবেন্নহি ভবেদিতি মে বিতর্কঃ।।
পণ্ডিত উমেশ মিশ্র মহাশয় তাঁর ‘বিদ্যাপতি ঠক্কুর’ নামক গ্রন্থে (পৃ. ২৩-২৪) লখিমা দেবীর কবিতা হিসেবে এই কথোপকথনের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার মিথিলায় প্রচলিত কবিতা-সংগ্রহ থেকেও লখিমা দেবীর নামে আরোপিত কবিতাও তিনি উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে প্রহেলিকা আছে একটি যার অর্থ নির্ণয় করা খুব কঠিন । আর একটি কবিতা স্বয়ং গ্রিয়ার্সন সাহেব Indian Antiquary (1886)এ লখিমা দেবীর নাম উল্লেখ তার লেখা বলে অনুবাদও করে দিয়েছেন। গ্রিয়ারর্সন লিখেছেন — With these may be compard Lakhima Thakurani’s verses on the pangs of anticipated separation, which are very popular in Mithila :-
তারাকারাত্ তৃষা পিবতিন পয়সাং বিপ্রুষঃ পত্রসংস্থাঃ।
ছায়ামম্ভোরুহাণামলিকুল শবলাং বীক্ষ্য সন্ধ্যামসন্ধ্যা
কাণ্ডাবিক্ষেপভীরু র্দিনমপি রজনীং মন্যতে চক্রবাকঃ।।
“He breaks the crisp lotus tendrils to eat them but does not do so, for he mistakes them for the rays of the moon : though athirst he does not drink the drops of water in the lotus leaves for the thinks them stars; in the shade of the lotus flowers dark of the swarms of bees he sees night when there is no night; always dreading separation from the beloved, the chakravaka imagines the day to be night.”
চক্রবাক-পক্ষীকে নিয়ে লখিমা দেবীর এই কবিতাখানি আমাদের ভাবনার অন্য একটি দ্বার খুলে দেয়। যদি কবিপ্রসিদ্ধি বা poetic convention-কে এতটুকু মূল্য দিই, তাহলে এই কবিপ্রবাদ মনে রাখতে হবে যে, চক্রবাক এবং চক্রবাকী –এই যুগলপক্ষী চিরকাল সম্ভোগ-বিরহের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই পক্ষী-যুগলের প্রেমের বিধি এইরকম যে, চক্রবাক আর চক্রবাকী সারা দিন একত্রে কাটায়, সারা দিন মিলন-মুগ্ধতায় কাটানোর পর সূর্য অস্তমিত হলেই চক্রবাকী নদীর পরপারে যায় অথবা চক্রবাক। তারপর সারা রাত বিরহ -যন্ত্রণার নানান কষ্ট ভোগ করে। একে অপরকে ডাকে সারা রাত ধরে, এদিকে যায়, ওদিকে যায়, এটা করে, সেটা করে–অবশেষে উদয় সূর্যের রক্তিম কিরণ গায়ে মেখে সকাল হলেই একে চলে আসে অপরের কাছে। আবারও সারাদিন পূর্ণ মিলন।
এই কবিপ্রসিদ্ধি মাথায় রেখেই কবিরা রাত্রির বিরহ-কালে নায়ক-নায়িকার একতরের হৃদয় যন্ত্রণার প্রতিরূপ তৈরী করেন চক্রবাক অথবা চক্রবাকীর বিচ্ছেদ-বেদনার মধ্যে। গ্রিয়ার্সন লখিমা ঠাকুরাণীর লেখনীতে সেইরকম একটা কবিতার উচ্চারণ করেছেন। আমাদের বক্তব্য হল–পণ্ডিত উমেশ মিশ্র তাঁর গ্রন্থে লখিমা দেবীর নামে আরোপিত আরও দুটি শ্লোক সংগ্রহ করেছেন ‘বিদ্যাকর-সাহস্রী’ নামে অমুদ্রিত মিথিলা কবিতাবলী থেকে। এখানে আরও দুটি পদও চক্রবাকীর বিরহগাথা, আর এইখানেই একটা সন্দেহের প্রস্তাবনা তৈরী হয়। সন্দেহ এটাই যে, লখিমা দেবীর কবিতার মধ্যে চক্রবাকীর হৃদয় যন্ত্রণা তাঁর নিজের জীবনের প্রতিলিপি কিনা ?
প্রথমে স্বয়ং গ্রিয়ার্সনই কল্পনাটা উস্কে দিয়েছিলেন ১৮৯৯ সালের Indian Antiquaryতে। তিনি লিখেছিলেন — মুসলমান শাসকের হাতে রাজা শিব সিংহ পরাজিত হন এবং তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লীতে। শিবসিংহের স্ত্রী লখিমা এবং কবি বিদ্যাপতি নেপালে অবস্থিত জনকপুরের কাছে বনৌলিতে আশ্রয় নেন। অন্তত বারো বছরেও যখন লখিমা স্বামীর কোনো খবর পেলেন না, তখন তিনি সতী হন।
[He was conquered by the Musalmans and carried to Delhi. His wife Lakhima, with Vidyapati, took refuge in Banauli, which is close to Janaka-Pura in Nepal. When no news on Siva-simha had been received from Delhi for twelve years,Lakhima became Sati and Padmasimha, Siva-simha’s younger brother,came to the throne, but only reighned for a year.]
গ্রিয়ার্সনের এই লেখায় শিবসিংহরে শাসন-কাল, তাঁকে দিল্লী নিয়ে যাওয়া এবং লখিমা দেবীর বারে বচ্ছর অপেক্ষার পর সতী হবার খবরগুলি ঐতিহাসিক সমসাময়িকতার নিরিখে আরও বিচার-ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। ব্যাখ্যা-বিচার করেওছেন অনেকে, কিন্তু তাতে বিচারের অংশ যতখানি, ব্যাখার অংশ তার চেয়ে অনেক বেশী । যেমন John Beams ১৮৭৫ সালে, অর্থাৎ গ্রিয়ার্সন সাহেবেরও আগে Indian Antiquary-তে ‘on the Age and Country of Bidypati বলে একটা প্রবন্ধে শিবসিংহের পিতা দেবসিংহের রাজত্বকাল ধরেছেন ৯১ বছর। তারপর শিবসিংহের রাজত্বকাল ধরেছেন ১৪৪৬ থেকে ১৪৫0 খ্রিষ্টাব্দ পর্য়ন্ত। শিবসিংহের পর মিথিলার সিংহাসনে তিনি অধিষ্ঠিত করেছন জনৈকা পদ্মাবতী দেবীকে। তারপর লখিমা দেবীর নয় বছরের রাজত্বের বিশ্বাস দেবী সিংহাসনে বসেছেন ১২ বছরের জন্য। (পৃ. ২৯৯-৩0১) বলা বাহুল্য, পদ্মাবতী দেবী বলে শিবসিংহের কোনো স্ত্রীর খবর আমরা কোথাও পাইনি এবং তারপর লখিমা দেবীর প্রসঙ্গ। এটা অবিশ্বাস্য।
Julius Eqqeling সেকালেই Beans-এর মত মানতে পারেননি। তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের তালিকায় বিদ্যাপতির লেখা ‘দুর্গাভক্তিরঙ্গিনী’র বিবরণ দেবার কালে বিদ্যাপতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি Beams-সাহেবের ভ্রান্তি দূর করার জন্য লিখেছেন , যে Beams ভুলটি করেছেন মিথিলার পুরাতন পঞ্জী ধরে। তিনি খানিক সংশোধন করে বলেছেন–We may then assume that Silva Simha, having died without issue, was succeeded by his queen Lakhima Devi, and the Latter by Visvasa Devi.
ইগ্লিং সাহেবের এই কথাটাই সত্য যে, শিবসিংহের পরে লখিমা দেবী বেশ কিছু কাল রাজ্যশাসন করেছিলেন। বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন যে, শিবসিংহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরুদ্দেশ হবার পর তাঁর পত্নী লখিমাদেবী বারো বছর অপেক্ষা করার পর তাঁর কুশশ্রাদ্ধ করেন। একই সঙ্গে বিমানবিহারী পরের পৃষ্ঠায় আরও একটি খবর দিয়ে বলছেন —
কিন্তু রাজবনৌলির পরিবারের সঙ্গে লক্ষিমা দেবী এবং বিদ্যাপতির কোনো সম্পর্কের কথা বিমানবিহারী না বললেও ঐতিহাসিকেরা অনেকেই বলেছেন যে, শিব সিংহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরুদ্দেশ হবার পর লখিমা দেবী তাঁর বিশ্বস্ত মন্ত্রী-আমত্যদের নিয়ে রাজবনৌলিতে পুরাদিত্যের রাজপ্রসাদে চলে যান এবং সেখানে বিদ্যাপতিও লখিমাদেবীর সহগামী বিশ্বস্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সেখানে যাবার পর পর লখিমা দেবী বিদ্যাপতির চেষ্টা এবং সৌজন্যেই সুলতান ইব্রাহিম শর্কির সনদ পান এবং ফিরে আসেন তিরহুতে।
সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ কিন্তু লখিমা দেবীকে নিয়ে বেশ রোমাঞ্চকর চিত্র সৃষ্টি করেছেন। দেশজ লোককথার সত্য এবং ইতিহাসের অনুমান-খণ্ড একত্র করে তিন লিখেছেন —
আবার মুসলমান সম্রাট বিপুল আয়োজনে মিথিলা আক্রমণ করেন। শিবসিংহ বুঝিলেন এবার নিস্তার নাই। রাজবনৌলিগ্রাম লেপাল পাহাড়ের পাদদেশে। তথায় তখন দ্রোণবংশীয় রাজারা রাজত্ব করিতেন। শিবসিংহের সহিত তাঁহাদের বন্ধুত্ব ছিল। বিদ্যাপতি এ বিপদের সময় মানসম্ভ্রম বজায় রাখিবার জন্য রাণী লখিমাকে লইয়া তথায় চলিয়া গেলেন। শিবসিংহ একাই রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। যেদিকে সম্রাট সেইদিকে বায়ুবেগে অশ্ব ছুটাইলেন। শিবসিংঘ তরবারি অগ্রভাগ দিয়া সম্রাটের শিরস্ত্রাণ উড়াইয়া দিয়া সৈন্যব্যুহ ভেদ করিয়া চলিয়া গেলেন। পশ্চাতে বিপক্ষ সেনা ছুটিতেছিল; মুসলমান সম্রাট বলিলেন শিবসিংহকে ধরিয়া কাজ নাই ; শিবসিংহ যে মুহূর্ত্তে আমার শিরস্ত্রাণ উড়াইয়াছেন সেই মুহূর্ত্তেই আমাকে হত্যা করিতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। তিনি বীরের মত আমাকে দেখাইয়া আপন স্বাধীনতা বজায় রাখিয়া স্বাধীন ভাবে বিহার করিতে চলিয়া যাইবেন। আর উহাকে ধরিয়া কাজ নাই। আর যুদ্ধেও কাজ নাই; বুঝিয়াছি শিবসিংহ আর ফিরিবেন না; অনুসন্ধান কর শিবসিংহের আর আছে কে; তাহাকেই এই রাজ্য দিয়া চল আমরা স্বদেশে ফিরিয়িা যাই। তাহাই হইল। শিবসিংহের থাকিবার মধ্যে পত্নী লখিমা, তিনিও তখন রাজা বনৌলি গ্রামে। সম্রাট তাঁহাকে রাজত্ব দিয়া চলিয়া গেলেন। লখিমা রাণী হইলেন। বিদ্যাপতি যেমন ছিলেন তেমনই রহিলেন। শিবসিংহের অভাব তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিল না; তিনি সর্ব্বদাই শিবসিংহকে দেখিতে পাইতে লাগিলেন; তাঁহার কবিত্ব তখন আরও সজীব হইয়া উঠিল কিন্তু পতিপ্রাণা লখিমা বেশী দিন বিরহ যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিলেন না, অল্প দিনের মধ্যে সংসার জ্বালা হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন।
[বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ, ‘বিদ্যাপতি এবং তৎসাময়িক বৃত্তান্ত’, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩0৭ সাল (১৯00), ১ম সংখ্যা পৃ. ৩২]
সমস্ত প্রমাণ থেকে এটাই মনে হয় যে, শিবসিংহের পরে লখিমা দেবী তিরহুতের শাসনভার সামলেছেন বেশ কিছুদিন এবং সেটা বারো বছর হবে। এই গোটা সময়টা তাঁর জীবনে শিবসিংহের যে অভাব ছিল এবং সেই অভাবে তাঁর অন্তরে যে বিরহযন্ত্রণা ছিল, তারই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। আমরা তাঁর কবিতার কথা বলতে বলতে তাঁর জীবনেতিহাসে চলে গিয়েছিলাম এবং যে কবিতার প্রসঙ্গে আমাদের এই অপ্রসঙ্গ সেটা ছিল এক চক্রবাকের কবিতা। অস্তমিত সূর্যের কালে চক্রবাকী নদীর ওপারে চলে গেলে চক্রবাকের অবস্থা কী হতে পারে, লখিমা দেবী তা লিখেছেন। কিন্তু অনুরূপভাবে চক্রবাকীর অবস্থা কেমন হতে পারে তাও একটি শ্লোকে লিখেছেন লখিমা।
সূর্য অস্ত গেলেই চলে যেতে হবে চক্রবাকী পক্ষীকে। যাবার আগে আসন্ন বিরহশঙ্কায় সে কাঁপছে, এদিক-ওদিক যাচ্ছে, মাঝে মাঝে বাঁকা পথে হাঁটছে, অরা মাঝে মাঝে মুহ্যমান হয়ে তাকাচ্ছে প্রিয়তম চক্রবাকের দিকে, তার কূজন-আহ্বান-ধ্বনিও বড়ো শিথিল। সে ভাবছে –জীবন থাকতেও এই বিরহযন্ত্রণার চেয়ে মরণ অনেক ভাল–
কান্তং চিলোকয়তি কূজতি দীনরূপম্।
অস্তে হি ভানুমধিগচ্ছতি চক্রবাকী
হা জীববিতেরপি বরং মরণং বিয়োগে।।
প্রায় একই সুরে এবং একই ছন্দে চক্রবাকের কষ্টও পুনরায় চিত্রায়িত করেছেন লখিমা দেবী। লিখছেন–কেমন পাগল পাগল অবস্থা চক্রবাকের — সে চেঁচিয়ে ডাকেছ বার বার, নিশ্বাস ফেলছে, ঝিমিয়ে পড়ছে, একবার পুকুরের পারের দিকে যাচ্ছে, কখনো তীর থেকে তরু, আবার তরু হতে পুষ্করিণী-নীরে, পুকুরের জল ভাল লাগে না বেশী ক্ষণ, মুখ দিয়েও দেখে না পদ্মের মৃণাল, রাত্রিবেলায় চক্রবাকীর বিরহে চক্রবাক এইরকমই —
তীরাত্ তরুং তরুবরাৎ পুনরেতি বাপীম্।
বাপ্যাং ন রজ্যতি ন চাত্তি মৃণালখণ্ডং
চক্রঃ ক্ষপাসু বিরহে খলু চক্রবাক্যাঃ।।
আমাদের ধারণা, চক্রবাক-চক্রবাকী সংক্রান্ত এই শ্লোকগুলি লখিমা দেবীর আপন বিরহ যন্ত্রণা থেকে উৎসারিত। উমেশ মিশ্র তাঁর বিদ্যাপতি ঠক্কর গ্রন্থে (পৃ. ২৪) লখিমা দেবীরর এই শ্লোকগুলি সংকলন করেছেন লখিমা দেবীর নামে, আমরা তার আস্বাদন দিলাম-বাংলার পাঠককে।
চক্রবাক এবং চক্রবাকীর বিরহকল্প ছাড়াও লখিমা দেবীর নামে আরও কয়েকটি সংস্কৃত রচনা পাওয়া যায়। এই কবিতাগুলিও যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত বিদগ্ধ ভঙ্গীতে রচিত হয়েছে এবং স্ত্রীজনোচিত সূক্ষ্ম এক রসবোধ কবিতাগুলির মধ্যে যেন এক প্রকার পৌরুষেয় প্রগল্ভতাও অনুস্যূত করেছে। এই কবিতাগুলিও প্রথমে সংগ্রহ করেন মহামতি G. A. Grierson, যিনি বিদ্যাপতির মৈথিল পদের হদিশ দিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে। এখানে আশ্চর্যের হল, বিদ্যাপতির পদে অনেকবার তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহের সঙ্গে লখিমা দেবীর নাম দেখা সত্ত্বেও লখিমা দেবীর নামে প্রচলিত সংস্কৃত কবিতাগুলি নিয়ে প্রবন্ধ লেখার সময় তিনি শিবসিংহের পত্নীর সঙ্গে এই লখিমা দেবীকে একাত্মক প্রতিপন্ন করেননি। তিনি শুধুই লিখেছেন — Lakhima Thakurani was a famous poetess of Mithila. I have not been able to obtain any particulars as to when she lived-Numerous stories are told of her learning. The following are samples.
প্রকৃতপক্ষে Grierson তাঁর লেখাটিকে, ভারতীয় সাহিত্যে তাঁর কৌতূহলী চেষ্টা হিসেবে একটা ‘communication’ হিসেবে Indian Antiquary তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কবিতাগুল নিয়ে তিনি গবেষণা করার সুযোগ পাননি। যদিও আমাদেরই এটা বোঝা দরকার যে মিথিলার জনপ্রবাদে লখিমা দেবী নামে অন্য কোনো বিদুষী মহিলার নাম শোনা যায় না। যাঁর নাম শোনা যায়, তিনি শিবসিংহেরই স্ত্রী। যাই হোক, লখিমার কবিতা হিসেবে যে কবিতাটি প্রথমেই সংগ্রহ করেছেন Grierson, সেই কবিতার মধ্যে একটি কাহিনী লুকনো আছে এবং সেখানেই কবিতার বুদ্ধিদীপ্তি। Grierson প্রথমে যে শ্লোকটি উদ্ধার করেছেন, সেটি তিনি যেমনটি মৈথিলি পণ্ডিতদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তেমনটিই ছাপিয়ে দিয়েছেন, যদিও তাঁর ধারণা ছিল যে, কবিতার ভাষায় ব্যাকরণগত ভুল আছে। এইখানে উমেশ মিশ্র তার গ্রন্থে যথাসম্ভব শুদ্ধ কবিতাটি প্রকাশ করেছেন, আমরা সেটাকেই প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করে কবিতার পটভূমিতে চলে যাই।
সেকালের দিনে বাল্যবিবাহ চালু ছিল বলে লখিমা দেবীর কন্যারও বিবাহ হয়ে গিয়েছিল বাল্যকালেই। কন্যা বয়স্থা হলে তাঁকে জামাইয়ের কাছে পাঠানোর জন্য পণ্ডিত জামাতার কাছে একটি শ্লোকে যেন পত্র লিখলেন লখিমা দেবী। উমেশ মিশ্রের জবানীতে এই কন্যা শ্বশুরবাড়িতেই ছিল, কিন্তু কোনো কারণবশত বহুকাল বাড়ি আসেননি। কন্যার বান্ধবীদের মুখে এই সংবাদ শুনে লখিমা দেবী জামাতার উদ্দেশে পত্র লেখেন শ্লোকাকারে। এখানে জানানো দরকার যে, সম্পূর্ণ পত্রটি ভারতীয় জ্যোতিষের অঙ্গ রাশিচক্রের নামগুলির আধারে সংখ্যা ধরে রচিত হয়েছে। অর্থাৎ রাশি-নামের বদলে রাশিগুলির গৃহ অর্থাৎ মেঘ-বৃষ ইত্যাদির ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় এইভাবে মীনরাশির গৃহ দ্বাদশ পর্যন্ত ব্যবহার করে কবি লখিমা তাঁর মেয়ের মানসিক-শারীরিক অবস্থা জামাইকে জানিয়ে তার ইতিকর্তব্য সম্বন্ধে পরামর্শ দিয়েছেন। লখিমা দেবীর এই কবিতা বোঝার জন্য প্রথমেই রাশিচক্রের স্থানগুলি সংখ্যা-অনুসারে জানাই–
দ্বিতীয় – বৃষ অষ্টম – বৃশ্চিক
তৃতীয় – মিথুন নবম – ধনু
চতুর্থ – কর্কট দশম – মকর
পঞ্চম – সিংহ একাদশ – কুম্ভ
ষষ্ঠ – কন্যা দ্বাদশ – মীন
এবার লখিমা দেবীর কবিতাটি শোনাই। জামাইকে লেখা কবিতা –
তুর্য্য-দ্বাদশবদ্ দ্বিতীয়মতিমন্নেকাদশাভস্তনী।
সা ষষ্ঠী কটিপঞ্চমী চ নবমভ্রঃ সপ্তমী বর্জিতা
প্রাপ্নোত্যষ্টমবেদনাং ত্বমধুনা তূর্ণং তৃতীয়ো ভব।।
একটা বৎসরের মাস-গণনার সময় বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত অনুক্রম ঠিক সেইরকম মেঘ থেকে মীন পর্যন্ত বারোটি রাশিতে পরপর সূর্যের সংক্রমণ ঘটে। সেই রাশিচক্রে দ্বিতীয় স্থান হল বৃষ। নিজ কন্যার বিরহদশায় জামাতার উদ্দেশে কবি লখিমার মধ্যস্থজননী লখিমা বলছেন — বাছা! তুমি ‘দ্বিতীয়ের মতি-বুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ। অর্থাৎ রাশিচক্রে দ্বিতীয় ঘরের অধিকারী বৃষ । মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত সাহিত্যে শক্তিমান বীর পুরুষকে বৃষ বা ঋষভ বলে সম্বোধন করা হত পুরুষটির প্রশংসনীয় বলবীর্য সকলের সামনে আখ্যাপন করার জন্য। রামায়ণ-মহাভারতে ‘পুরুষর্ষভ’ ‘নবর্ষভ’ কথাগুলি বহুল ব্যবহৃত। আর একটি বৃষের মধ্যে প্রজননের চরম সংজ্ঞা তৈরী করে শক্তিমান প্রজননক্ষম পুরুষকে শুধু ‘বৃষ’ বলেই আখ্যাত করা হয়েছে। লখিমা দেবী জামাতাকে আহ্বান করছেন বৃষের মানসিকতায় ফিরে আসার জন্য–যদিও সেটা রাশিচক্রের ভাষায় ‘দ্বিতীয়-মতিমান’।
কেন এই বৃষের মানষ চাইছেন জামাতার মধ্যে? লখিমা দেবী এবার নিজের মেয়ের অবস্থা জানাচ্ছেন রাশিচক্রের দশম ‘মকর’ এবং দ্বাদশ ‘মীন’ রাশির সংজ্ঞা। মকর একপ্রকার হাঙরজাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী, কিন্তু তার থেকেও বাড়ো কথা মকরধ্বজ (এখানে দশমধ্বজ) মানে কামদেব। লখিমা দেবী লিখছেন–দশমধ্বজের গতিতে আর্থাৎ কামনা-ভালবাসার দেবতা মকরধ্বজ কামদেবের জ্বালায় তাঁর মেয়েটি এখন জলহীন অবস্থায় কাঁকড়া কিংবা মাছের মতো হয়ে আছে। ‘তুর্য’ মানে চতুর্থ–রাশিচক্রে চতুর্থ ঘর হল কর্ক=কর্কটরাশির ঘর, আর মীন হল রাশিচক্রের দ্বাদশ ঘর। জল ছাড়া কাঁকড়া কিংবা মাছ যেমন থাকতে পারে না — লখিমা দেবী জামাইকে লিখছেন — তেমনই তুমি নেই, এই অবস্থায় ভালবাসার দেবতা কামদেবের তাড়নায় আমার মেয়ের অবস্থাটা কিন্তু ‘জলবিন্ মছ্লি’ কিংবা কাঁকড়ার মতো।
কেন তাঁর মেয়ের এই অবস্থা, তার জন্য একদিকে যেমন কামদেবকে দায়ী করছেন লখিমা দেবী, তেমনই দায়ী করছেন কন্যার যৌবন সন্ধির চেহারাকে । তিনি বলছেন — আমার এই ষষ্ঠী অর্থাৎ কন্যাটি — রাশিচক্রের ষষ্ঠ গৃহে কন্যারাশির অবস্থান। তাই আমার এই ষষ্ঠী অর্থাৎ কন্যাটি এখন কিন্তু আর ছোট্টটি নেই — সে এখন একাদশাভস্তনী’ তার ঊর্ধাঙ্গে স্তনের মধ্যে একাদশের স্পর্শ লেগেছে। রাশিচক্রে একাদশ হল কুম্ভের স্থান। কুম্ভ মানে কলস, ঘড়া। সেই একাদশের মতো, মেয়ের বুকের গড়ন। আর তার মধ্যদেশ সিংহের মতো কবির ভাষায় — ‘কটিপঞ্চমী’ — রাশিচেক্র পঞ্চম ঘরে সিংহারাশি–সিংহের মধ্যদেশের মতো কটিদেশ কবিকুলের উপমার বিষয় –‘কেশরী জিনিয়া মাঝ’।
ধনুরাশির নবম ঘরটির কথা উচ্চারণ করে কবি লখিমা তাঁর মেয়ের ভুরু দুটি যে ধনুকের আকারে কপালে বিন্যস্ত হয়েছে, সে কথা জানিয়েছেন জামাইকে। আর বলেছেন শারীরি সৌন্দর্যের কথা বিচার করলে এ মেয়ের কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। — সপ্তমী- বর্জিতা — অর্থাৎ তুলনারহিতা । এই অতুলনীয় শরীর সৌন্দর্য নিয়েও স্বামী-নায়কটি কাছে না থাকায় যে কষ্ট পাচ্ছে, সে কষ্ট বৃশ্চিক দংশনের সমান–কবিকৃত রাশিচক্রের ভাষায় অষ্টমে বৃশ্চিকের অবস্থান এবং এই মেয়ের বিরহকষ্ট ‘অষ্টম বেদনা’-র মতো। এখন একমাত্র পথ–লখিমা দেবী জামাতাকে লিখছেন- জামাতাকে –শরীর-মনের এই যন্ত্রণার মধ্যে যত তাড়াতাড়ি পারো তুমি এসে তৃতীয় হও এবার–ত্বমধুনা তূর্ণং তৃতীয়ো ভব। রাশিচক্রে তৃতীয় মিথুনের অবস্থান। মিথুন মানে নরনারীর যুগল, তাদের একত্র হওয়া। লখিমা দেবী কবিতার মধ্যে রাশিগুলির নাম এবং প্রত্যেক মাসে সংখ্যানুক্রমে রাশিগুলির অবস্থান-গৃহকে সংখ্যানামে চিহ্নিত জামাতার কাছে মেয়ের বিরহকষ্ট প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছেন।
লখিমা ঠাকুরাণীর এই কবিতার একটা ক্রমিক পরিণতি আছে বলে জানিয়েছেন Grierson অর্থাৎ কিনা জামাতার প্রতি ওইরকম একটি কাব্যপত্রী পাবার পর সেই পুরুষ নাকি ফিরে আসে তার কন্যার কাছে। বৈবাহিক নিয়মে মেয়েকে এবার পাঠানো হয় জামাতৃপুরুষের ঘরে। পুরুষ নায়কটি নিপাট ভদ্রলোক। সে বুঝতে পারে –মেয়েটির যৌবন সন্ধিতে যতই তার শারীরিক গরিমা ব্যক্ত করা হোক, তার মনের মধ্যে থেকে কৈশোরগন্ধী ভাবটুকু এখনও যায়নি। ফলে পুরুষটি নাগরিক আভিজাত্য বজায় শুধুমাত্র বৈবাহিক অধিকার প্রয়োগ করেনি কিশোরীপ্রমাণা যুবতীর প্রতি।
মেয়ে অবশ্য সব ঘটনা জানাল তার মাকে। স্নেহময়ী জননী জামাইকে, ঘরে বেঁধে ফেলার জন্য উদ্গ্রীব হলেন। তিনি মন্দাক্রান্তা ছন্দে মন্দাক্রান্ত শব্দটি ব্যবহার করেই জামাতাকে লিখলেন কবিপত্র —
কাচিদ্ দৃষ্টা ভ্রমরভরতো মঞ্জরী ভজ্যমানা।
তস্মাদোষা রহসি ভবনে নির্দযং পীড়নীয়া
মন্দাক্রান্তং বহুতররসং নো দদাতীক্ষুদণ্ডঃ।।
মেয়ের মা জামাতাকে বলছে —
এই তন্বী মেয়েটিকে বালিকা-কিশোরী বলে, কিংবা একটু রোগাশরীরের মেয়ে বলে যে আশঙ্কা তুমি করছো, সে আশঙ্কা কোরো না। কোনোদিন কোথাও কী এমন দেখেছো যে, ভ্রমরের ভাবে ধ্বস্ত-বিধ্বস্ত হয়েছে ফুলের মঞ্জরী। অতএব এই মেয়েটিকে নির্জনে পেলে নির্দয়ভাবেই পীড়ন কোরো। ইক্ষুদণ্ড বা আঁখের খণ্ডকে যদি তুমি খুব হালকা করে পেষো, তাহলে তাতে অনেক রক বোরায় না, বাছা–মন্দাক্রান্তং বহুতররসং ন দদাতীক্ষুদণ্ডঃ ।
স্বয়ং কন্যাজননীর স্পষ্ট ইঙ্গিতে বুঝে পরের দিন রাত্রিতে জামাতা আর সে কিশোরী বধূটিকে অবহেলা করল না। শাশুড়ির পরামর্শ সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। কিন্তু পরের দিন সকালে নববধূ নিজের মায়ের কাছে এসে অনুযোগ করে বলল- মা! আর আমি ওই ঘরটাতে শুতে যাবো না কখনা। এখানে কথাসূত্রে মা আর মেয়ের কথোপকথন নিয়ে একটি কবিতা গ্রন্থনা করেছেন লখিমা ঠাকুরাণী। কবিতাটিতে ‘শার্দূলবিক্রীড়িত’ নামে একটি সংস্কৃত ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে পূর্ব শ্লোকটিতে মন্দাক্রান্তা ছন্দে লিখিত কবিকথ্যের মধ্যেই যেমন ‘মন্দাক্রান্ত’ শব্দটি ব্যবহার করে কাব্যের উৎকর্ষ বাড়ানো হয়েছে, তেমনই ‘শাদূর্দ-বিক্রীড়িত’ শব্দের অর্থ যেহেতু বাঘের খেলা, তাই শব্দশ্লেষে ছন্দোনাম ব্যবহার করে লখিমা দেবী এখানে বধূটির মনোবিশ্লেষণ করেছেন কবিতায় —
জামাতা তব নির্দয়ো নিজভুজে বদ্ধো’পি মাং পীড়তি।
কেনেয়ং রতিরাক্ষসেন রমিতা শার্দূলবিক্রীড়িতা।।
এই কবিতাটি কথোপকথনের ভঙ্গীতে ভাঙলে পরেই তবে তার অর্থ পরিষ্কার হচ্ছে। পূর্বকথিত রাত্রির পর সকাল হতেই মেয়ে তার মাকে বলছে– মেয়ে-মা! আর কোনো দিন আমি ওই কেলি গৃহে শয়ন করতে যাবো না — মাতঃ কেলিগৃহং ন যামি শয়নে। মা–চাঁদমুখি মেয়ে আমার ! কেন যাবি না, শুনি– কস্মাচ্ছ চন্দ্রাননে ? মেয়ে– তোমার ওই জামাইটির মতো নিষ্ঠুর -নির্দয় পুরুষ আর হয় না। তাকে যদি আমি আমার দুই হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আটকেও রাখি, তাহলেও তার সুখের পীড়ন চলতে থাকে। দ্যাখো না, দাঁত, নখ বসিয়ে আমার সর্ব অঙ্গে এমন করে কটেছে যাতে আগুনে পোড়ার মতো জ্বলছে — অঙ্গারব্রণতা কবোতি চ নখৈর্দণ্ডৈশ্চ খণ্ডীকৃতা । আমার তো মনে হয় , কোনো এক রতি রাক্ষসের রমণ সহ্য করলাম আমি, যেন একটা সময় আমি একটা বাঘের ক্রীড়ার সামগ্রী হয়ে উঠেছিলাম কেনেয়ং রতিরাক্ষসের রমিতা শার্দূলবিক্রীড়িতা।
উপরি উক্ত শ্লোকগুলির মধ্যে রসিকতা যতখানি আছে, তার চেয়ে বেশী আছে বচন-চাতুরী। কিন্তু এই দুটির চেয়েও যেটা বেশী আছে — সেটি এক ধরনের সমাজ-সচেতনতা। একটু আগে যে শাশুড়ি -জামাই এবং মেয়ের দাম্পত্য জীবন নিয়ে লখিমা ঠাকুরাণীর শ্লোক শুনলাম, তাতে একটা সময় এক কন্যা-জননীকে অতি প্রগল্ভা এক কুট্টনী মহিলাও মনে হতে পারে, কিন্তু লখিমা দেবী এখানে তথ্য নিবেদন করে সমাজচিত্র অঙ্কন করছেন। মধ্যযুগে যে বাল্যবিবাহগুলি হত, তাতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা যতই থাকুক , সে বিবাহের মধ্যে অল্পবয়সী মেয়েদের পৌরুষেয় বিকার ধারণ করার জন্য মেয়েদেরই কতটা উদ্যোগ নিতে হত, সেই চিত্র লখিমা ঠাকুরাণীর লেখনীতে সামাজিক তথ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে।
একটি মেয়ের বাল্যবিবাহের পর বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে পুরুষের ভোগযোগ্য হবার অপেক্ষায়। বিবাহের পর পুরুষ তার খবর নেয় না। অবশেষে সেই পুরুষের কাছে নিজকন্যার শরীরী সংবাদ পাঠাতে হয় শাশুড়িকে। শাশুড়ি জামাতার কাছে যে সংবাদ পাঠান, তার মধ্যে বাড়িয়ে বলা আছে। একটি কৈশোরগন্ধী যৌবনসন্ধিতে কামনায় ছটফট করছে, স্তনকুট্মলের প্রকাশমাত্রেই সেখানে কুম্ভস্তনের আভাস– ‘একাদশাভস্তনী’ প্রকট করে তুলছেন কন্যাজননী–এখানে যেন এক অদ্ভুত সামাজিক অভিচার তৈরী হয়। যেন পুরুষ যে মাত্রায় একটি স্ত্রীলোককে ভোগ করতে চায়, তার পূর্ণ ব্যবস্থা করাটা যেন পাত্রীপক্ষের দায় হয়ে ওঠে।
অবশেষে যে পুরুষ প্রলুব্ধ হয়ে যখন শ্বশুরবাড়ির কেলিকক্ষে শ্মশ্রূবর্ণিত আপন স্ত্রীটির শারীরিক সংগঠন সরেজমিনে বুঝতে চেষ্টা করে, তখন পরের দিনই সে বরং অভিজাত কৌশলে প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ মেয়েটি এখনও বালিকা, মেয়েটি রোগা, যতই তুমি তাকে তন্বী বলে চালাও না কেন। এক্ষেত্রে কন্যাজননীর কাজ যে কোনা উপায়ে জামাইকে সম্ভোগে প্রবৃত্ত করে তাকে শারীরিক সম্বন্ধে বেঁধে ফেলা। ফলে শাশুড়ির মুখেই পুষ্পমঞ্জরীতে ভ্রমরের আমন্ত্রণ তৈরী হয়। রতি সম্প্রয়োগের ক্ষেত্রে তৈরী হয় পৌরুষের শক্তির ব্যাকরণ। মন্দাক্রান্ত ইক্ষুদণ্ডে রসের প্রস্রবণ তৈরী হয় না। সেখানে বলের সম্প্রয়োগ আমন্ত্রণ করেন কন্যাজননী নিজেই । ফলটা এই দাঁড়ায় বালিকা বধূ আর স্বামীর ঘরে একান্তে মিলিত হতে চায় না। রাত্রির প্রণয় তার কাছে এক রতিরাক্ষসের ব্যাঘ্রক্রীড়া বলে মনে হয়– কেনেদং রতিরাক্ষসেন রমিতং শার্দূলবিক্রীড়িতম্ — এমন একটা পাঠাও শেষপংক্তিতে নৈব্যক্তিক চিৎকার ভেসে ওঠে বালিকা বধূর কণ্ঠে।
লখিমা দেবী সমাজ-সমালোচনা করেন না স্পষ্টভাবে, তিনি তথ্য নিবেদন করেন প্রগল্ভ চাতুরীতে। আমরা যে শ্লোকটির কথা পূর্বে বলেছিলাম প্রহেলিকার মতো শুনতে — সেই শ্লোকটির মর্ম ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে, লখিমা দেবী সমাজকে কীভাবে প্রকাশ করেন নীতিজ্ঞতার পূর্ণদৃষ্টি । মিথিলায় সেকালে এক ধরনের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন, যাঁরা নিজেদের বাড়ির কন্যা কিংবা ভগিনীর সঙ্গে নিম্নস্তরের ব্রাহ্মণের বিয়ে দিতেন –অবশ্যই অর্থের বিনিমিয়ে। অর্থাৎ তাঁরা ভগিনী কিংবা কন্যাকে বিক্রী করে দিতেন এবং নিজেরাও সেই সব নিম্নস্তরের ঘরে বিয়েও করতেন, হয়তো বা সেটাও অর্থের বিনিময়ে। এই ধরনের ব্রাহ্মণদের মিথিলায় বলা হত ‘বিকৌয়া’ — Grierson লিখেছেন ‘mercenary Brahmans’. শুদ্ধসংস্কারযুক্ত ব্রাহ্মণেরা এই ‘বিকৌয়া’ ব্রাহ্মণদের যথেষ্ঠ ঘৃণা করতেন । কিন্তু তাতে ‘বিকৌয়া’ দের শক্তি কিছু কমেনি।
শোনা যায়, লখিমা ঠাকুরাণী এই রকম একটা বিয়েতে গিয়েছিলেন, যেখানে এক ‘বিকৌয়া’ তার বোনটিকে বেচে দিয়েছে ছোট ঘরে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে লখিমা ঠাকুরাণী তির্যকভাবে এক প্রহেলিকা লিখলেন শ্লেষ করে —
তুমি তোমার তেজী ঘোড়াগুলিকে নাচাতেই পারো, তুমি পারে এই ঘোড়াগুলিকে দিয়ে পুরবাসী পথচারীদের মাড়িয়ে দিতে। কিন্তু এটা আমরা জানি যে, তোমার এই ধনৈশ্বর্য, বিভব তুমি তোমার নিজের ক্ষমতায় তৈরী করতে পারোনি, তোমার এই বিভব তৈরী হয়েছে তোমার ভগিনীর স্ত্রীচিহ্নজনিত ভাগ্য থেকে, অর্থাৎ ভগিনীক বিয়ে দিয়ে যে অর্থসম্পত্তি লাভ করেছো, সেই ভাগ্যে তোমার বৈভব–
পথি পৌরজনান্ পরিমর্দয়তঃ।
ন হি তে ভুজভাগ্যভবো বিভবঃ
ভগিনী-ভগ-ভাগ্য-ভবো বিভবঃ।।
লখিমা দেবী-লিখিত অথবা তাঁর নামে আর একটি মাত্র শ্লোকের কথা আমাদের জানা আছে। আর এই শ্লোকটি উমেশ মিশ্র সংগ্রহ করেছেন ‘বিদ্যাকর-সাহস্রী’ নামে অমুদ্রিত একটি পাণ্ডুলিপি থেকে। শ্লোকটিতে একটি রমণীকে দেখে এখটি পুরুষের শারীরিক আকর্ষণের কথা উল্লিখিত হয়েছে শৃঙ্গাররসাত্মক ভাষায়। শৃঙ্গারী পুরুষের উক্তি লখিমা দেবীর ভাষায় —
মগ্নং মে নেত্রযুগ্মং কুচকলশ-সমালম্বনং প্রাপ্য তস্থৌ।
তস্মান্নাভীহ্রদান্তং সুললিত-ত্রিবলি-প্রান্তকান্ত্যা লসন্তং
দূরাদালোক্য ভীতং দ্বয়মপি কলশং নৈব হাতুং শশাক।।
এই কবিতার অন্তঃসার সামান্য জটিল হলেও একজন মহিলা কবির লেখনীতে এই শ্লোকটি লখিমা দেবীর বাস্তববোধের প্রমাণ। পুরুষ মানুষ এবং পৌরুষে ‘রোমান্স’ যে অনেকটাই যৌনতার ওপর নির্ভর করে, সেটা লখিমা দেবীর এই কবিতার শব্দার্থতত্ত্বে ধরা পড়ে । এই কবিতার অনুবাদ– সুন্দরী! নিষ্পাপ সুন্দরী আমার ! তুমি যখন সালস্যে বিশ্রাম করছিলে, তখনই তোমার মুখের দিকে চোখ পড়ে আমার। চাঁদের মতো মুখ এবং সে মুখের ভিতরে যেন সৌন্দর্য-কান্তির পানীয় পুরে রাখা হয়েছে। আমার চোখ দুটি সেই পানীয়-পূরে মগ্ন হবার পর অবশেষে তোমার স্তন-কলশে স্থির আশ্রয় পেয়ে বাঁচল। সেখান থেকেই দৃষ্টি গিয়ে পৌঁছল তোমার নাভি-হ্রদের পারে, তোমার ললিত ত্রিবলির প্রান্তদেশে সেই সৌন্দর্যকান্তির ছটা। দূর থেকে এত সব দেখে আমার ভীত-ত্রস্ত চোখ দুটি তাদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় তোমার কলশ-দুটিকে আর ত্যাগ করে যাবার সাহস পেল না।
মিথিলাপতি শিবসিংহের পত্নী লখিমা দেবী অথবা Grierson-এর লখিমা ঠাকুরাণী এই স্তরের কবিতা লিখেছেন বলেই বিদ্যাপতির মতো এক মহাকবির সহৃদয় হয়ে ওঠাটা তাঁর পক্ষে আরও বেশী সহজ হয়ে ওঠে। আর বিদ্যাপতিও তেমনই এক সহৃদয়-হৃদয় লাভ করেছিলেন লখিমা দেবীর মধ্যে, যাঁর চরণ-ধ্যানে তাঁর কবিতা মুকুলিত হত —
বিদ্যাপতি ইহ ভান।